মায়াকুমারী পর্ব ৪৮

মায়াকুমারী পর্ব ৪৮
মেহেরিন আনজারা

হঠাৎ নিশুর হাত জোরে টেনে সরিয়ে দিলো ধ্রুব। বুশরাকে নিজের আড়ালে নিয়ে এলো। নিশুর চোখে দাউদাউ আগুন,গলায় ঝড়ো চিৎকার,”তাহলে বলো! সত্যিই কি বিয়ে করেছ ওকে?”
আবারও তেড়েফুঁড়ে এলো নিশু। ধ্রুব দু’হাতে নিশুর বাহু ধরে টেনে সরাতে চেষ্টা করল।
“নিশু,থাম।”
কিন্তু নিশু তো নিশুই! শুনছেই না। চোখ লাল,গলায় বজ্রনিনাদ,”মিথ্যে! সব মিথ্যে! তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছ। মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ। তুমি আমার ইমোশন নিয়ে গেম খেলেছ।”

আবেগে উন্মত্ত হয়ে আবারও বুশরার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তেই ধ্রুব আঁটকানোর চেষ্টা করল,তবুও সে যেন অগ্নি হয়ে উঠেছে। চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ছুটে এলো ডাক্তার আর দু’জন নার্স। পরিস্থিতি দেখে আতঙ্কিত হলো তারা।
“স্টপ! প্লিজ,উনি অসুস্থ! ওভাবে নড়াচড়া করলে বিপদ হবে। পেটের সেলাই খুলে যেতে পারে!”
কিন্তু নিশু ততক্ষণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। দ্যুতির মুখ দিয়ে কেবল ফোঁপানির শব্দ বের হচ্ছে,দিলরুবা খাতুন কাঁপতে কাঁপতে বলছেন,”মেয়েটাকে কেউ থামাও।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ডাক্তার দ্রুত সংকেত দিলো নার্সদের। মুহূর্তেই তারা ধরে ফেলল নিশুকে। হাত-পা ছুঁড়ছে,বুকে কান্নার ঝড়,”আমি ওদেরকে ছাড়ব না! আমার স্বপ্ন,আমার বিশ্বাস সব ভেঙে দিয়েছে এরা!”
নার্স ইনজেকশন প্রস্তুত করে দ্রুত হাতে পুশ করতেই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিশুর শরীর ঢলে পড়তে লাগল। চোখ আধখোলা,ঠোঁট কাঁপছে,গলার শেষ চিৎকার ঝরে এলো মৃদু ফিসফিসে,”তুমি আমার না হলে কারো হতে দিবো না। খু’ন করব তোমাকে।”

তারপরই নিস্তব্ধ। অজ্ঞান হয়ে গেল নিশু। কেবিনজুড়ে হিম শীতল নীরবতা। ধ্রুব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে,বুক দুলছে ভারী শ্বাসে। চারদিকে শুধু নার্সদের ব্যস্ততা আর দম বন্ধ করা আবহ যেন ভাঙা ভালোবাসার আর্তনাদ দেয়ালে লেগে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পাশের বেডে শুইয়ে দিলো নিশুকে। টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে চোখের কোণ বেয়ে। ডাক্তার-নার্স শিওর হয়ে চলে গেলেন। নিশুর দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললেন আসাদ সাহেব।
“মীর জাফরকে বেরিয়ে যেতে বলো,দিলরুবা।”
“আপনি কী শুরু করলেন?”
“যা বলেছি তাই করো।”

গর্জে উঠলেন আসাদ সাহেব। ধ্রুব নিজেই নীরবে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বুশরা। আমতাআমতা করছে,কিছু বলতে চাচ্ছে অথচ ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। দ্যুতি চোখ ফিরিয়ে নিলো,মুখে তীব্র হতাশা। বুশরা সাহস সঞ্চয় করে দ্যুতির দিকে কয়েক পা এগোতেই বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে থেমে গেল তার পা,”তুমি এখানে কী করছো?বেরিয়ে যাও!”
“আ.. আঙ্কেল..”
“বেরিয়ে যাও!”
“আসলেই..”
“দেখতে চাই না কাউকে!”
দ্যুতির বুক ফেটে যাচ্ছে। অশ্রু মুছে নাক টানলো।

“এমনটা আশা করিনি তোর থেকে। বিশ্বাসই হচ্ছে না তুই..!”
“আমার কথা শোন..”
“সামনে থেকে যা!”
“আরে,আমরা..”
“প্ল্যান হোক বা সত্যি- তোর এমনটা করা একদমই উচিত হয়নি। নিশু অসুস্থ,তুই কি জানিস না?”
মাথা নোয়াল বুশরা,কিছু বলতে পারল না। দ্যুতির চোখে তীব্র দহন।
“ও আমার ভাইয়ের জন্য একবার পাগল হয়ে গিয়েছিল। আর তুই সেই দুর্বলতাকে টেনে এনে এইসব করছিস?এটা ঠিক হয়নি তোর।”
নীরব,ভাঙা মনে দরজার দিকে পা বাড়াল বুশরা। বেরিয়ে গেল কোনো শব্দ না করে। তপ্ত শ্বাস ফেললেন আসাদ সাহেব।
“মীর জাফরের সঙ্গে আরেক ঘষেটি বেগম যোগ হলো।”
কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা ধূসর তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। বুশরার প্রতি হঠাৎ জন্ম নিলো তীব্র ঘৃণা। এক অদ্ভুত অন্ধকার তার ভিতরে জমতে লাগল।

হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে ধ্রুব প্রায় ঘন্টা দুয়েক। ততক্ষণে রাত ঘনিয়ে এসেছে। দেয়ালের সাদা রঙ,চারপাশের নীরবতা আর জীবাণুনাশকের গন্ধ তাকে যেন শ্বাসরুদ্ধ করে তুলছে। জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। বৃষ্টিভেজা আকাশ,ভেজা কাঁচের ওপর ঝাপসা আলো,আর সুগন্ধি ফুলের সুবাস। মন তার ছুটে যাচ্ছে নিশুর দিকে। ওর চোখের আগুন,গলার ঝড়ো চিৎকার,ভেঙে পড়া বুক,কান্না,আর্তনাদ,হাহাকার ইত্যাদি সবকিছুই কানে বাজছে এখনও। হাত মুষ্টিবদ্ধ করল। জানালার ওপাশে বাজ হঠাৎ ঝলসে উঠল। মনে হলো,ওর নিজের ভিতরের অন্ধকারটাই যেন বাইরের আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। মুহূর্তের জন্য চোখ বুজল। তারপর ধীরে ধীরে খুলল। জানালার কাচে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখল। বেশ কিছুক্ষণ পর নিঃশব্দে কেবিনে ঢুকল। আসাদ সাহেব বেডে আধশোয়া হয় আছেন। চোখ বন্ধ,ঘুমাচ্ছেন নাকি গভীর ক্লান্তিতে ডুবে আছেন বোঝা গেল না।

দিলরুবা খাতুন চুপচাপ বসে আছেন। চোখ ভেজা,মুখে এক অদ্ভুত অসহায় ছায়া। ক্ষণে ক্ষণে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে। দ্যুতি জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে ঝাপসা আলো,ভেজা বাতাস কিন্তু তার দৃষ্টি ভেতরে নয়,অনেক দূরে। চোখের কোণে জমে থাকা জল তাকে নিঃশব্দ সাক্ষী করে তুলেছে। আর ধূসর,সে বসে আছে গম্ভীর মুখে। ঠোঁট শক্তভাবে চেপে রাখা,চোখে অস্বস্তির ছায়া। যেন চারপাশের আবহাওয়া তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে তুলেছে। বুকের ভিতর জমাটবদ্ধ ভারী হাওয়া,কোথাও যেন বাতাস পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে,হাসফাঁস করার মতো একটুখানি জায়গাও নেই এই কেবিনের ভেতরে। নিঃশব্দ,ভারী কেবিনের ভেতর শুধু নিশুর অচেতন দেহটাই যেন সবার চেতনা জড়িয়ে ধরে রেখেছে অদৃশ্য শেকলের মতো।

ধীরে ধীরে পা টিপে এগিয়ে এলো ধ্রুব। নিশুর কাছে পৌঁছে থমকে দাঁড়াল। ক্লান্ত,নিস্তেজ,চোখ-মুখ ফুলে আছে কান্নায়। নিঃশ্বাসগুলো ভারী,তবুও অচেতন নীরবতা যেন তাকে কাবু করে রেখেছে। দিলরুবা খাতুন চোখ ফিরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। দ্যুতি আর ধূসরও অবহেলার মতো মুখ ঘুরিয়ে নিলো। সেই দৃষ্টি ধ্রুবর বুকের ভিতর শূলের মতো বিঁধল কিন্তু থামল না। আকস্মিক ঝুঁকে নিশুকে দু’হাতে জড়িয়ে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধ ঘরে হালকা গুঙুনির শব্দ উঠল,”আঁ.. ধ্রু..”

ধ্রুবর বুক কেঁপে উঠল অথচ নিশু আবার ঢলে পড়ল গভীর ঘুমে। ধীরপায়ে পাশের কেবিনে ঢুকে আলতো করে শুইয়ে দিলো নিশুকে। চাদর গুছিয়ে দিলো শরীরের ওপর,মাথার কাছে হাত রেখে কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল। চোখ-মুখ এখনও ফুলে আছে কান্নায়। ভেজা দাগ যেন চেপে বসেছে গালের ওপর। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে মৃদু ছুঁয়ে দিলো সেই দাগ,তারপর হঠাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। চুপচাপ শার্ট খুলে নরম একটি টি-শার্ট পরে নিলো। যেন নিজের ভিতরের অস্থিরতাকে ঢাকতে চাইছে। নিশুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে গভীর শ্বাস ছাড়ল। মনে হলো এই নিস্তব্ধতার মাঝেই সে নিজের সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা শুরু করেছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল নিশু। অচেনা এক নিস্তব্ধতা তাকে ঘিরে রেখেছে। চারপাশে অন্ধকারে মৃদু আলো,দেয়ালে টানা ছায়া। অচেতন ভঙ্গিতে মাথা তুলতে চাইল,চোখ দুলে উঠল,কোথায় সে? চতুর্দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল,অপরিচিত পরিবেশ। বুকের ভিতর হালকা ধড়ফড়ানি। ঠিক তখনই তীক্ষ্ণ ধোঁয়ার গন্ধ নাকে ঢুকতেই কাশতে লাগল। হাত দিয়ে নাক-মুখ ঢাকল। চোখ ভিজে গেল কাশিতে। তা শুনে দ্রুত সিগারেটের টুকরো মেঝেতে ফেলে পায়ের তলায় পিষে আঁধার ভেদ করে এগিয়ে এলো ধ্রুব। নিশুর চোখ স্থির হয়ে গেল ওর দিকে। পরমুহূর্তেই যেন বুক ফেটে চিৎকার বেরিয়ে এলো,”তুমি!”

শব্দটা কেবিন কাঁপিয়ে তুলল। তবে কণ্ঠে ঘৃণা আর কান্নার মিশ্র ঝড়। ধ্রুব থেমে গেল কয়েক কদম দূরে।
“এখানে কেন? তুমি আবার আমার কাছে কেন এসেছ? আমি তোমাকে ঘৃণা করি! শুনতে পাচ্ছ? ঘৃণা করি!”
“নিশু,তুই যা ভাবছিস তা নয়। আমি..”
“চুপ! কিছু বলবে না। তুমি আমার সবকিছু নষ্ট করে দিয়েছ। আমার বিশ্বাস ভেঙেছ। আমার ভালোবাসাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছ!”

মায়াকুমারী পর্ব ৪৭

নিশুর কণ্ঠ ফেটে যাচ্ছিল কান্নায়,প্রতিটি শব্দ যেন ছু’রি হয়ে ধ্রুবর বুক ভেদ করছে। ধ্রুব এক কদম এগোল।
“একদম আমার কাছে আসবে না! আমার কাছ থেকে দূরে থাকো!”
কেবিনের ভেতর ঝড়ো আবেগে ভারী হয়ে উঠল বাতাস। ধ্রুব নিঃশব্দে থেমে গেল। সিগারেটের ছাঁইয়ের মতোই তার ভিতরের সব জ্বলন মাটিতে ঝরে পড়ছে,তবুও চোখে নীরব অঙ্গীকার। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। নিশুর চিৎকার থেমে গেল,কেবল বুক ওঠা-নামা করছে কান্নায়। ভেতরের নিস্তব্ধতা নেমে এলো। দু’জনের মাঝের দূরত্বটা যেন শূন্য নয় অদৃশ্য প্রাচীর,ঘৃণা আর ভালোবাসার ভয়ঙ্কর এক মিশ্র টান।

মায়াকুমারী পর্ব ৪৯