মায়াকুমারী পর্ব ৪৯

মায়াকুমারী পর্ব ৪৯
মেহেরিন আনজারা

সিঙ্গাপুরের আকাশে আবারও ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালের উঁচু জানালা দিয়ে দূরের আলো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটায়। বাইরে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে রজনীরানীরা,বৃষ্টির সঙ্গে মিশে শহরের ভেজা মাটির গন্ধে বাতাস যেন আরও ভারী। নিশুর চোখ লালচে,অশ্রুভেজা কণ্ঠ কাঁপছে। কান্না যেন কেবল শব্দ নয়,তার ভাঙা হৃদয়ের নীরব আর্তনাদ। প্রতিটি অশ্রু ধ্রুবের বুক ভেদ করে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। ধ্রুব নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে,দৃষ্টিতে গভীরতা- যেন নিশুর প্রতিটি ব্যথা সে নিজের ভিতর টেনে নিচ্ছে। নিশু কাঁদছে,যা মনে আসছে তাই বলে যাচ্ছে- ক্ষোভ,অভিমান,ভালোবাসা,অসহায়তা।

ধ্রুব কিছুই বলছে না,শুধু তাকিয়ে রয়েছে। তবু তার নীরবতার আড়ালেই বোঝা যায় নিশুর এই অশ্রু আসলে ভালোবাসারই আরেক রূপ। কোনো মেয়ের পক্ষেই এমন দৃশ্য সহ্য করা সম্ভব নয়,আর নিশুও তার ব্যতিক্রম নয়। শৈশবের কোমলতা,তার বাবা-মায়ের অতি আদরে বেড়ে ওঠা আহ্লাদী স্বভাব- সব মিলিয়ে নিশু যেন শিশুসুলভ এক প্রাণ। ভীষণ স্পর্শকাতর,মানসিকভাবে দুর্বল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে এলো ধ্রুব। নিশু কিছু বোঝার পূর্বেই পেছন দিয়ে হাত বাড়িয়ে তাকে শক্ত করে নিজের বুকে টেনে নিলো। মুহূর্তেই নিশুর শরীর কেঁপে উঠল,ঠোঁটে এসে পড়ল ধ্রুবের তীব্র চুম্বন। বাইরে বৃষ্টির শব্দ যেন থমকে গেল এক নিঃশ্বাসে। নিশুর চোখ বিস্ফোরিত,ঠোঁটে কাঁপন। রেগে উঠে চেঁচিয়ে সরে যেতে চাইল কিন্তু ধ্রুবের শক্ত বাহু তাকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে রাখল,যেন সিঙ্গাপুরের রাত,বৃষ্টির ধারা আর এই শহরের আলো- সব মিলেমিশে তাদের দু’জনকে আঁকড়ে ধরেছে। নিশুর অশ্রু গলে মিশে গেল ধ্রুবের ঠোঁটে। ভেজা শহরের মতোই তাদের হৃদয়ও হয়ে উঠল একাকার- অভিমান,কান্না আর ভালোবাসার অদৃশ্য বন্ধনে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ছাড়ো!”
“শান্ত হ,এবার। অনেক পাগলামি করেছিস,আর না প্লিজ।”
ধ্রুবর স্বর গভীর নদীর মতো স্থির।
“না,ছাড়ো!”
চিৎকার করে উঠল নিশু। প্রতিটি শব্দে ভাঙা অনুভূতির ঝাঁঝ।
“আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছিস তোরা সবাই,তাই না? আমি কি মানুষ না? নাকি অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি না বলে রোবট ভেবে তোরা যার যা ইচ্ছে তাই করছিস! না বাবা,আর না মা; আর না ভাইবোন কিংবা স্ত্রী হয়ে তুইও কিছু বুঝতে চেষ্টা করছিস!”

“প্রতারক কোথাকার! তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছ! কী বুঝব তোমার?”
নিশুর চোখ লাল,গলা কাঁপছে,হৃদয় ভেঙে পড়ার মতো অনুভূতি।
“কী প্রতারণা করলাম?”
“তুমি বলেছিলে খুব শীঘ্রই আমাকে তোমার ঘরে তুলবে। কিন্তু সেটা না করে তুমি ওকে বিয়ে করে নিলে! এটা কি প্রতারণা নয়?”
“ইসলাম ধর্মে তো একসাথে চারটা বউ রাখা জায়েজ,নিশু। তুইও না হয় ওকে মেনে..”
চেঁচিয়ে উঠল নিশু। রণমূর্তির রূপ ধারণ করে নিজেকে ছাড়াতে চাইল। ধ্রুব হাসল।
“কখনো না! আমি কখনো সতীনের সংসার করব না। দরকার পড়লে তোমাকে ডিভোর্স দিবো।”
“তাহলে তো আমাদের রাস্তা ক্লিয়ার,নিশু।”
“কী বললে?”

ভেজা ঢোক গিলল নিশু।
“ও তোর ফ্রেন্ড,নিশু। প্লিজ.. কম্প্রোমাইজ কর।”
“না,ও একটা ডাইনি। ও আমার বিশ্বাস ভেঙেছে।”
“আমাকে ডিভোর্স দিয়ে থাকতে পারবি তুই?”
“হ্যাঁ,পারব। একশো বার পারব।”
নিশুর গলা কেঁপে উঠল। ফিচেল হাসল ধ্রুব।
“সত্যি?”
“একশো বার সত্যি। দু’শ বার সত্যি। একহাজার বার সত্যি। শুনতে পেয়েছ?”
“তো কাঁদছিস কেন,নিশু।”

নিশু কিছু বলতে পারল না। শুধু চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। ভাঙা অনুভূতিগুলো বুকের ভিতর ঝরছে,ধ্রুবর হৃদয়ে স্পন্দিত হচ্ছে। ধ্রুব নীরবে নিশুর কান্না শোনে,আলতো করে কাঁধে মাথা রাখে,বুকের সঙ্গে মিশিয়ে শান্ত করতে চায়। বৃষ্টি ধীরে ধীরে টুপটাপ পড়ছে,জানালার কাঁচে ভেজা ফোঁটা ঝলমল করছে। নিশুর চোখের জল ধ্রুবের টি-শার্টের দিকে পড়ছে,ভিজিয়ে দিলো তার বুক। নিঃশ্বাস,কান্না,ভালোবাসা সব মিলেমিশে তৈরি হলো এক অদৃশ্য বন্ধন,যা একমাত্র তারা বুঝতে পারছে। শহরের আলো,বৃষ্টি,রাত-সব মিলেমিশে যেন তাদের দু’জনকে আঁটকিয়ে রেখেছে এক অবিচ্ছেদ্য মুহূর্তে।
“বললে তো শেষ। আর কখনও আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না,তাহলে কেন গেলে?”
অত্যন্ত দুঃখে নিশুর বুক ভেঙে যাচ্ছে।
“প্রতিশ্রুতি দেওয়া ঠিক নয়,নিশু। প্রতিশ্রুতি দিলে সেটা খুব তাড়াতাড়ি ভঙ্গ হয়। তোকে প্রতিশ্রুতি দিলাম ঠিক এই যে দেখ ভঙ্গ করে ফেললাম।”
নিশু বুক কাঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

“কেন গেলে আবার কেন এলে? আমি কত কষ্ট পাচ্ছি তা দেখতে এসেছ বুঝি?”
নিশুর কণ্ঠে ক্ষোভ আর ব্যথা একসাথে ঢেউ খেলল।
“তুই তো শুনতেই চাচ্ছিস না কিছু।”
“শুনব না।”
“শোন,সবটাই একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং। আমি সবটা তোকে বলতে চাই। চুপচাপ আমাকে শোন। এরপর রিয়েক্ট করিস।”
“একদম না।”

অভিমানী নিশু ফোঁপায়। বুকের ভিতর ভাঙছে,অশ্রু ঝরে পড়ছে চোখ থেকে,যেন বাইরের বৃষ্টির স্রোতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ধ্রুব আলতো করে নিশুর খোলা চুলের ভাঁজে আঙ্গুল গুঁজল। করিডরের হালকা আলো জানালায় প্রতিফলিত হয়ে তাদের ছায়া খেলা করছে। বাইরে বৃষ্টি থেমে আবার ঝেঁপে উঠছে,বাতাস ভেজা শহরের ঘ্রাণ আর হালকা শীতের সংমিশ্রণ।
“নিশু,ঢোলকলমি চিনিস?”
মুখ তুলে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাল নিশু।
“কীসের মধ্যে কী! কথা ঘুরাও,তাই না? শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছ! ভেবেছ তোমার চালাকি বুঝতে পারব না,তাই না?”
নিশুর গলায় আগুন ঝরা ক্ষোভ।

“বৃষ্টির মধ্যে হালকা হাওয়ায় দোলা বৃষ্টিস্নাত ঢোলকলমি দেখেছিস কখনও?”
“আমি জানতে চেয়েছি এইসব? তুমি দেখো গিয়ে বসে বসে।”
চেঁচিয়ে উঠল নিশু। কণ্ঠে আগুন ঝরা ক্ষোভ,চোখে অশ্রু।
“ছোটবেলায় গ্রামে থাকতে বৃষ্টি হলে আমি দৌঁড়ে খালপাড়ে কিংবা নদীর তীরে ছুটে যেতাম আর ঢোলকলমির ঝাঁক দেখতাম।”
ধ্রবর মুখে একরাশ নস্টালজিয়া।
“কেন? ওটা দেখার মধ্যে কী আছে?”
হালকা হাসল ধ্রুব।
“মনোমুগ্ধকর লাগত। মনে হতো এই পৃথিবীটা যেন কেবল ওই মুহূর্তের জন্যই তৈরি। সব ব্যথা,সব দুঃখ যেন থেমে যেত কয়েকটা ক্ষণের জন্য। তখন মনে হতো আমি বৃষ্টির সঙ্গে,ফুলের সঙ্গে,জীবনের সঙ্গেই এক হয়ে গিয়েছি। আর সেই ফুলের মতই- তুই।”

অশ্রুসিক্ত নয়নে নির্বাক হয়ে তাকাল নিশু। মাথার উপর ঠোঁটদুটো চেপে ধরতেই চোখ বুজে ফেলল নিশু।
“অযত্নে জন্মেও যার সৌন্দর্য নিভে যায় না,সেই ফুলের মতোই অনিন্দ্য সুন্দর তুই আর তোর ভালোবাসা। আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য বৃষ্টিস্নাত ঢোলকলমির মতো অনিন্দ্য সুন্দর তুই। নিশু,তুই-ই আমার আলো,আমার নিঃশ্বাস। যে আলো অন্ধকার ভেদ করে উঠে আসে,সে আলো তুই। প্রতিটি ব্যথা মুছে ফেলে,প্রতিটি ছায়া সরিয়ে দিয়ে,নিঃশ্বাসের প্রতিটি স্পন্দনে তুইই বাজিস।”
শ্বাস আঁটকে এলো নিশুর। ঠোঁট কেঁপে উঠল।

“তুমি আমাকে এমনভাবে বলছো,আমার তো মনে হয় আমি নিজেকেই চিনি না!”
“কারণ তুই আমার সত্যি,নিশু। পৃথিবীর সব মায়া ম্লান হয়ে গেলেও তুই হারিস না। তুই-ই আমার সৌন্দর্য,আমার শেষ ভরসা। আমি যদি কখনো পথ হারাই,তবে ফিরিয়ে আনে তোর চোখ,তোর কান্না,তোর নিঃশ্বাস।”
বাইরে বৃষ্টি ঝেঁপে পড়ল আরও জোরে। যেন কোথ থেকে হঠাৎ বাতাসে ভেসে এলো ঢোলকলমির দোলার অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ। নিশুর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে নামল কিন্তু এবার সেই জল যেন তীব্র বেদনার নয় বরং অদ্ভুত এক প্রশান্তির। নিশুর কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল ধ্রুব। চোখের গভীরে তাকিয়ে নিঃশব্দে ফিসফিস করে বলল,”মায়াকুমারী.. অযত্নে বেড়ে ওঠা ঢোলকলমির মতো অনিন্দ্য সুন্দর তুই। তুই-ই আমার ঢোলকলমি। পৃথিবীর সব ব্যথা মুছে যদি কোনো নাম ডাকি,তবে সেটা শুধু- নিশু।”

বৃষ্টির শব্দ মিশে গেল নিশুর অশ্রুর সঙ্গে। দূরের অর্কিড আর চম্পার ভেজা গন্ধ মুহূর্তটাকে এমনভাবে ভরিয়ে তুলল,যেন সমগ্র সিঙ্গাপুর শহর থমকে গিয়েছে শুধু তাদের দু’জনের জন্য। হঠাৎ কী হলো নিশুর বুঝে উঠতে পারল না। ধ্রুবর ঠোঁটের ফিসফিসানিগুলো যেন তার কানে গলে ঢুকে গিয়েছিল হৃদয়ে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতর জমে থাকা ক্ষোভ চেপে রাখতে পারল না,ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো ধ্রুবকে।
“না! এসব কবিতা বলে আমার ক্ষত ঢাকতে আসবে না। আমি বিশ্বাস হারিয়েছি। তুমি সেটা ফিরিয়ে দিতে পারবে?”
নিশুর কণ্ঠে আগুন,চোখে অশ্রু। ধ্রুব নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
“পারবে না। হ্যাঁ,জানি পারবে না। তোমার কাছে আমি যদি সত্যিই এত মূল্যবান হতাম,তবে আমার চোখের জল ঝরার আগেই তুমি আমাকে আঁকড়ে ধরতে। আমি একা কাঁদতাম না।”
ধ্রুব কাছে এগিয়ে এসে নিশুর কাঁধ ধরে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,”নিশু,আমি ভুল করেছি। কিন্তু তুই-ই আমার শুরু,তুই-ই আমার শেষ। আমি হয়তো হারিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু ফিরেছি শুধু তোর জন্য। তুই চাইলে আমাকে শাস্তি দে,ঘৃণা কর কিন্তু আমার থেকে নিজেকে আলাদা করার কথা ভাবিস না। তোর রাগ,তোর অভিমান- এসবই প্রমাণ করে তুই আমাকে কতটা ভালোবাসিস।”

“তোমার তো ছেড়ে যাওয়ার বাতিক আছে। তুমি যদি আবারও ফেলে যাও? আবারও যদি আমাকে অন্ধকারে ফেলে চলে যাও তখন কী হবে আমার?”
“তোর হাত ছেড়ে দিলে আমি আর আমি থাকব না। নিশু,তুই-ই আমার অস্তিত্ব। তুই ছাড়া আমি শূন্য। শপথ করে বলছি,বৃষ্টির মতোই তোর কাছে বারবার ফিরে আসব। যতবার তুই আমায় তাঁড়াবি,ততবার ফিরে আসব। কারণ তুই-ই আমার ঘর।”

নিশুর চোখে আবার জল জমল। ঠোঁট কামড়ে নীরব হয়ে রইল। বুকের ভিতরে যুদ্ধ চলছে,ক্ষোভ আর ভালোবাসার। ধ্রুবর হাত শক্ত করে চেপে ধরলেও ঠোঁটে কিছু বলল না। বাইরে তখনও অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। মনে হলো পুরো শহর যেন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে শুধু এক মেয়ের অভিমান গলতে আর এক ছেলের ভালোবাসা প্রমাণ করতে। নিশুর বুকের ভিতর ক্ষোভ আর ভালোবাসার তীব্র লড়াই,যেন নিজেকেই ছিঁড়ে ফেলছে। চোখে জমে থাকা অশ্রু ধরা গেল না,আবার টুপটাপ গড়িয়ে পড়ল। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে তার মুখটা নিজের আঙুলের ফাঁকে বাঁধল।
“এই চোখের জলই আমার সবচেয়ে বড় শাস্তি,নিশু। যা ইচ্ছে কর,আমাকে ঘৃণা কর,তিরস্কার কর কিন্তু এভাবে ভেঙে পড়িস না। তোর ভাঙন আমার মৃত্যুর মতো।”
নিশু ধাক্কা দিয়ে সরাতে গেল কিন্তু ধ্রুবর শক্ত বাহু তাকে আবার বুকের ভিতর টেনে নিলো।
“ছাড়ো!”
“না,আজ ছাড়ব না। আজ আমার নিশুকে হারাতে দিবো না।”

বৃষ্টির শব্দ আরও তীব্র হয়ে উঠল। চারদিক যেন অন্ধকারের ভিতর দাঁড়িয়ে শুনছে শুধু তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ। নিশু কাঁদছে,কাঁপছে কিন্তু ধ্রুবর বুকে ঠেসে রাখতেই হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে এলো। সেই নিস্তব্ধ মুহূর্তে ধ্রুব মুখ নামিয়ে ঠোঁট রাখল নিশুর কাঁপতে থাকা ঠোঁটে। প্রথমে নিশু ধাক্কা দিতে চাইল কিন্তু বুকের ভিতর জমে থাকা ভালোবাসা আর অভিমান একসাথে গলে গিয়ে হাত দুটো অনিচ্ছায় ধ্রুবর কাঁধে আঁকড়ে ধরল। চোখের জলে ভিজে যাওয়া সেই চুম্বন একসাথে ছিল প্রতিশোধ,অভিমান আর অন্তহীন ভালোবাসার প্রমাণ। বাইরে তখনও অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে। ঢোলকলমির গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। মনে হলো সমগ্র সিঙ্গাপুর শহর থেমে গিয়েছে শুধু এই দু’জনের ভাঙন আর মিলনের সুর শুনতে। দীর্ঘ চুম্বনের পর নিশু যেন পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। বুকের ভিতর যত ক্ষোভ,যত অভিমান ছিল সব যেন গলে গিয়ে অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে লাগল। ধ্রুবর কাঁধে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল। ধ্রুব নিশুর চুলে আঙুল বুলিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল,”যতবার ভুল করব,ততবারই তোর কাছে ফিরে আসব। কারণ তুই ছাড়া আমার কোনো পথ নেই,নিশু। আমি তোকে হারাতে চাই না- কখনোই না।”

নিশু কাঁপা কণ্ঠে বলল,”আমি ভয় পাই,ধ্রুবতারা.. ভীষণ ভয় পাই। যদি আবার আমাকে ফেলে যাও! যদি আবার প্রতিশ্রুতি ভাঙো! আমি কি আর বাঁচতে পারব?”
ধ্রুব নিশুর চোখের গভীরে তাকিয়ে দৃঢ়ভাবে বলল,”ভয় পাবি না। প্রতিশ্রুতি দিবো না আর,কারণ প্রতিশ্রুতি ভেঙে যায়। তবে আমি শপথ করে বলছি,যতদিন বেঁচে থাকব,নিশু.. তুই-ই আমার প্রথম আর শেষ আশ্রয়।”
নিশুর চোখ আবার ভিজে উঠল। ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে ধ্রুবর মুখ ছুঁয়ে বলল,”আমাকে আর ভাঙতে দিও না। আমি খুব দুর্বল,ধ্রুবতারা। আমার শক্তি শুধু তুমি।”
ধ্রুব তাকে বুকের ভিতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

“তুই দুর্বল না,নিশু। তুই-ই আমার শক্তি। তোকে নিয়েই আমি পূর্ণ। তুই-ই আমার ঘর,তুই-ই আমার জীবন।”
বাইরে বৃষ্টি ক্রমে থেমে এলো। বাতাসে ভেসে এলো ভেজা মাটির গন্ধ। জানালার কাঁচ বেয়ে ঝরে পড়া ফোঁটাগুলো যেন সাক্ষী হয়ে রইল তাদের মিলনের। ধ্রুব নিশুর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল,”চল,নতুন করে শুরু করি। তুই-আমি- শুধু আমরা দু’জন।”

নিশু চোখ বন্ধ করল,বুকের ভিতর জমে থাকা ভয় আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছিল। শুধু রয়ে গেল এক অদ্ভুত শান্তি,আর এক অটুট বিশ্বাস- ধ্রুব এবার সত্যিই থাকবে। টি-শার্টের ভিতর দিয়ে দৃশ্যমান ধ্রুবর লোমশ বুকে মুখ গুঁজল নিশু। বুকের ভিতর দাপাদাপি করা হৃদস্পন্দন যেন কানে আঘাত করছে। কিন্তু সেই শব্দও কত আপন,কত মায়াময়! মনে হচ্ছিল ধ্রুবর বুকের প্রতিটি ধ্বনি তার নাম উচ্চারণ করছে।ধ্রুবর শরীর থেকে ভেসে আসা কাঁচা,বুনো,পুরুষালী ঘ্রাণে নিশুর সমগ্র সত্তা কেঁপে উঠল। চোখ বন্ধ করলেই মনে হচ্ছিল এই সুবাসে সে ডুবে যেতে চায়,হারিয়ে যেতে চায়। এটাই তার শান্তি,এটাই তার নেশা।

“শোন.. এই স্পন্দন,এই ঘ্রাণ,এই বুক- সব শুধু তোরই। তুই চাইলে ধুকপুক থামিয়ে দিবো,নিশু।”
“না,কখনো না। এভাবে বলবে না। তুমি বাঁচবো শুধু আমার জন্য,আমার ভিতরে।”
ধ্রুব মৃদু হেসে কপালে ঠোঁট রাখল।
“তোর অশ্রুতে আমি জ্বলে উঠি,তোর হাসিতে বেঁচে যাই। তুই যদি পাশে থাকিস,তবে দুনিয়ার কোনো শক্তিই আমাকে হারাতে পারবে না।”
নিশু এক মুহূর্তের জন্য কিছু বলতে পারল না। শুধু হাত বাড়িয়ে ধ্রুবর চোয়াল ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলল,”কতবার ভেবেছি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব,মুছে ফেলব কিন্তু তোমার এই ঘ্রাণ,এই স্পর্শ,এই বুকের স্পন্দন আমাকে বারবার টেনে আনে। আমি পারি না। আমি কখনও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।”
ধ্রুব নিশুর হাত শক্ত করে চেপে ধরল।
“তাহলে আর দূরে যাস না। আমায় নিয়ে যত ভয় আছে সব ফেলে দে। আমি শুধু তোরই হব- আজ,কাল,যতদিন আছি।”

নিশু ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল। বুকের ভিতরে কাঁপুনি থেমে গিয়ে শান্তির ঢেউ নেমে এলো। ধ্রুবর বুকের ঘ্রাণ,তার নিঃশ্বাসের উষ্ণতা,তার কণ্ঠের দৃঢ়তা- সব মিলিয়ে মুহূর্তটা যেন অমর হয়ে গেল। বাইরে তখনও টুপটাপ বৃষ্টি ঝরছে। সেই বৃষ্টির স্রোতের মতোই নিশুর ভিতর গলে যাচ্ছিল সমস্ত অভিমান,সমস্ত ভয়। শুধু থেকে গেল ধ্রুব- তার ঘ্রাণ,তার স্পর্শ,তার ভালোবাসা। নিশু চোখ বন্ধ করে ধ্রুবর বুকে আরও গভীরভাবে গা এলিয়ে দিলো। বুকের ভিতর থেকে ভেসে আসা উষ্ণতায় তার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা যেন এক অদ্ভুত স্রোতে কেঁপে উঠল। ধ্রুবর ঘাড়ে মুখ গুঁজতেই সেই পুরুষালী গন্ধ আরও তীব্র হয়ে নিশুর শ্বাস রুদ্ধ করে দিলো।

মায়াকুমারী পর্ব ৪৮

ধ্রুব চিবুক তুলে ধরল আলতো করে। চোখে চোখ রাখল কিছুক্ষণ। সেই দৃষ্টি যেন আগুনের মতো,একই সঙ্গে জ্বালিয়ে দিচ্ছে,আবার গলিয়েও দিচ্ছে। ধ্রুব আর দেরি করল না। ঠোঁট রেখে দিলো নিশুর কাঁপা ঠোঁটে। মুহূর্তেই বুকের ভিতর জমে থাকা সব ভয়,সব অভিমান যেন গলে গেল। নিশু প্রথমে দ্বিধা করল কিন্তু ধ্রুবর দৃঢ়তায় নিজেকে সমর্পণ করে দিল সম্পূর্ণভাবে। তারপর একে একে ধ্রুবর ঠোঁট ছুঁয়ে গেল নিশুর চোখ,গাল,কপাল,গলার কাছে। নিশু কেঁপে উঠল প্রতিবার,বুকের ভিতর যেন ঢেউ খেলে গেল। হাত দুটো শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ধ্রুবর কাঁধ।

মায়াকুমারী পর্ব ৫০