মায়াকুমারী পর্ব ৫০
মেহেরিন আনজারা
ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল নিশু। নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ধ্রুব। চোখে শুধুই নিশুর প্রশান্ত মুখ। এই নিশুকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাকে। আবহাওয়া আদ্র,বাতাসে ভিজে থাকা ঘ্রাণ কেবিনজুড়ে অথচ ধ্রুব তরতর করে ঘামছে। মনে হচ্ছে সে কোনো যুদ্ধ জয় করেছে। হ্যাঁ,বউ- এই জিনিসটা,কখনো কখনো যুদ্ধ জয় করার চাইতেও কম নয়। যার এমন একটা অবুঝ,নাছোড়বান্দা বউ আছে কেবল সেই বুঝে বউ আর যুদ্ধ কী জিনিস! ঘাম ছেড়ে দিয়েছে শরীরে। যেমনটা জ্বর হলে ঔষধ খাওয়ার পর হয়। আস্তে করে নিশুকে বুক থেকে সরিয়ে আরাম করে বালিশে শুইয়ে দিলো। ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে। যেন স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝেই হালকা ঢেউ খেলছে। গায়ের উপর চাদর টেনে দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তপ্ত শ্বাস ফেলে নীরবে কেবিন থেকে বেরোল।
কেবিনের বাইরে মাথা নুয়ে নীরব হয়ে বসে রয়েছে বুশরা। দেশে ফিরে এখন সে কার কাছে যাবে? না চাইতেও বাবার সাথে সম্পর্ক খারাপ করে এসেছে। তার মা’ও বাবার বিরুদ্ধে যেতে পারবেন না। তাকে কোনোরূপ সাহায্য করলেও উনাদের দাম্পত্যকার জীবনে সমস্যা সৃষ্টি হবে। যা চায় না বুশরা। তার একজন উচ্চশিক্ষিতা,স্বাবলম্বী নারী হলেও স্বামীর ছায়ার বাইরে কোনোদিনও হাঁটেননি। কথার বাইরে দ্বিমত পোষণ করেননি। স্বামীর প্রতিটি আদেশই উনার কাছে ধর্মীয় নির্দেশের মতো। অতএব তার মা তার বাবার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস কখনোই করবে না। বুশরার বুকের গভীরে বারবার বেজে ওঠে এক অদৃশ্য ভয়ের ঢেউ।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
দেশে ফিরলেই তার বাবার লোকজন তাকে আঁটক করবে। তারপর তার বাবা আবারও তাকে জোর করে সেই অচেনা খাঁচায় বিয়ের নামে এক অন্ধকার বন্ধনে ঝুঁকিয়ে ফেলবে। কিন্তু বুশরা জানে,জোর করে চাপানো সম্পর্কটি তাকে ভেঙে দিবে,শ্বাসরোধ করবে। কিন্তু সেটা বিয়ে নয় তা হবে মৃত্যুর মতো এক যন্ত্রণা। তার বুকের ভিতর কেবল একটাই প্রতিজ্ঞা যা-ই হোক,জোর করে দেওয়া বিয়ের শিকল গলায় নিবে না। বিয়ে মানে তার কাছে ভালোবাসা,নিরাপত্তা,আত্মসম্মান কোনো লেনদেন নয়,কোনো শাস্তি নয়। বাবার পছন্দে গড়া জীবন মানেই হবে ধ্বংসের অন্ধকূপ। তার ভিতর থেকে প্রতিটি সুর চিৎকার করে বলে উঠছে,”না,আর নয়। জোর করে বাঁধা কোনো বিয়ে মানেই জীবন্ত কবর।”
ফরহাদকে কখনো বিয়ে করবে না সে। কারণ ফরহাদের স্বভাব-চরিত্র তার পছন্দ নয়। বিদেশি মেয়েদের সঙ্গে তার নানান হিস্ট্রি রয়েছে। এমন ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে কেউ গ্রহণ করবে কি? কখনো না। মেয়েরা হয়তো খাবারের অভাব মানিয়ে নিতে পারে কিন্তু স্বামীর অবহেলা আর অশ্রদ্ধা কখনও সহ্য করতে পারে না। মেয়েদের স্বামী খারাপ হলে সেটা শুধু জীবনের আফসোস নয় ওটা হয়ে যায় কবরের দেয়াল পর্যন্ত টেনে নেওয়া শেকল। যা মৃত্যুর পরও শ্বাসরুদ্ধ করে রাখে। আর যদি সেই স্বামী চরিত্রহীন হয়,তবে মেয়েটার ভাগ্যে অপেক্ষা করে কেবল দুঃস্বপ্ন। বেঁচে থেকেও প্রতিটি মুহূর্তে দুনিয়ার ভিতর জাহান্নামের আগুনে পুড়ে মরতে হয় তাকে। ফরহাদের চরিত্রের কালিমা তার বাবা জানেন না কিংবা হয়তো জানতেও চান না।
বুশরা যতবার বলতে চেয়েছিল,ততবারই তার বাবার কণ্ঠ যেন দেয়ালের মতো শক্ত হয়ে উঠেছিল। কোনো যুক্তি,কোনো চোখের পানি সেই দেয়াল ভেদ করতে পারেনি। এ যেন আমাদের বাঙালি পিতাদের এক চিরন্তন মুদ্রাদোষ- মেয়ের কণ্ঠকে অগ্রাহ্য করে নিজের সিদ্ধান্তকেই একমাত্র সত্য মনে করা। মেয়ের জীবনের সুখ-দুঃখ যেন তাঁদের কাছে কোনো আলোচনার বিষয়ই নয়,যেন কেবল এক লেনদেনের খেলা। অনিক যদি বেঁচে ওঠে,তবে হয়তো এই জোরজবরদস্তি ব্যর্থ হবে। তাই এমন পরিস্থিতি। তবে বুশরা তার ভাইয়ের সুস্থ হওয়ার আশাতেই আঁকড়ে ধরে আছে। তবু এই মুহূর্তে তার হৃদয় একেবারেই অসহায়। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে,বুক কেঁপে উঠছে অনন্ত ভয় আর অজানা অন্ধকারের ভারে। বসুন্ধরায় তাদের প্রাচুর্যের অভাব নেই। কয়েক শ কোটি টাকার সম্পত্তি,বিলাসী বাড়ি- সবই তার বাবার। কিন্তু এতকিছুর মাঝেও আজ এই মুহূর্তে বুশরা নিজেকে চালচুলোহীন মনে করছে। হৃদয় ভাঙছে,চোখ ভিজে গিয়েছে অশ্রুর সঙ্গে।
হ্যাঁ,তার বাবা-মায়ের কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ আছে কিন্তু তার নিজের বলতে কিছু নেই। সে তো এখনও পরনির্ভরশীল। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সামর্থ্য নেই। সেই অনুভূতিই ধীরে ধীরে বুকের ভিতর অশ্রুর স্রোতে মিশে যাচ্ছে,টুপটুপ করে দুই গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে। বুশরার মন এই সময় এক বাস্তবতায় পৌঁছেছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিটি মেয়ের স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। একটা নির্দিষ্ট ইনকাম সোর্স থাকা প্রয়োজন। আজ যদি তার নিজের কিছু থাকতো,তাহলে হয়তো এই অসহায়বোধ তার হৃদয়কে ছুঁতে পারতো না। আজকের মুহূর্তে সে বুঝতে পারল,স্বাধীনতা শুধু অর্থ নয়,আত্মবিশ্বাসেরও বিষয়। নিজের কিছু না থাকায় এই অসহায়তার বোঝা আরও ভারী মনে হচ্ছে। কেবিন থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এলো ধ্রুব। সিঙ্গাপুরের এই রাতের বৃষ্টিভেজা মাটির ঘ্রাণ,হালকা হাওয়া এবং দূরে পড়ে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা সব মিলিয়ে এক অনাবিল প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ল। তার উপস্থিতি টের পেতেই হকচকিয়ে চোখের জল মুছে নিলো বুশরা।
“কিছু মনে করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলেই নিশু অসুস্থ তো তাই।”
“আমি নিজেকে অনেক অসহায় মনে করছি।”
কেমন জানি খারাপ লাগল ধ্রুবর। মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো।
“ধুর মেয়ে! কী বলছো! তুমি একা নও,আমি এখানে আছি। আর দেখো,তোমার নিজের শক্তি খুঁজে পাবে এটাই তোমার আসল প্রাচুর্য।”
বুক ঠেলে কান্না বেরিয়ে এলো বুশরার।
“তোমার কোথাও লেগেছে? ডাক্তার ডাকব?”
মাথা নাড়াল,লাগেনি।
“অনেক রাত হয়েছে। চলো,তোমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি। সেখানে ডিনার করে নিও।”
হাত ধরে দু’কদম এগুতেই,”এই কি তাহলে তোমার ভালোবাসার নমুনা?”
চমকে পিছু ফিরতেই বিস্ফোরিত হলো দু’জন। অগ্নিমূর্তির রূপ ধারণ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিশু। চোখে ক্রোধ,ঝলসে দেওয়া আগুন। শ্বাস আঁটকে গেল ধ্রুবর। এই নিশুও না একদম! ওহ! কী যে করবে এখন?এবার নিশুকে বুঝাতে কী করতে হবে সে বুঝতে পারছে না।
“আবারও আমাকে ফেলে চলে এলে?”
“নিশু..”
“তুমি আবারও আমার সঙ্গে চিট করলে?”
“নিশু,প্লিজ,ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।”
কিন্তু নিশুর গর্জন তার কণ্ঠে ঠেকিয়ে দিলো। ধাক্কা দিলো ধ্রুবর বুকে।
“সত্যি ওকে বিয়ে করেছ?”
“না।”
“মিথ্যা কথা।”
“সত্যি বলছি।”
নিশু চোখ ফেটে বড় করল।
“তাহলে ওর সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক?কেন আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে ওর কাছে এলে?এতক্ষণ যে ভালোবাসার বাণী শোনালে এইসব কি তাহলে মিথ্যা ছিল?”
“নিশু,শোন.. বুশরার বাবা তাকে আমেরিকা নিয়ে জোর করে তার কাজিনের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। আর বুশরা সু’ইসাইড এটেম্প করেছিল। সে পরিস্থিতি খুব বিপজ্জনক ছিল। সে সময় ওর জন্য নিরাপত্তা ছিল না। তাই আমি আমেরিকা ফিরলাম,আর তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। তবে আসাটা মোটেই সহজ ছিল না। অগণিত বাধা,ঝুঁকি আর খুঁটিনাটি সবকিছু পার করতে হয়েছে।”
বাইরে জানালার বাইরে বৃষ্টি থমথমে,বাতাসে ভিজে থাকা পাতা-ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে। করিডোরের ভিতরে চাপা আলো,কেবল তিনজনের মধ্যে নিঃশব্দ শ্বাস আর দূরের বৃষ্টির টপটপ। প্রতিটি শব্দ,প্রতিটি নিঃশ্বাস সবই যেন এক এক করে মনোযোগী হয়ে তাদের আবেগকে ঘিরে ধরছে।
“বিশ্বাস করি না।”
বিমূঢ় নেত্রে তাকায় ধ্রুব।
“নিশু,আমি তোরই। প্লিজ সন্দেহ করিস না। বুশরা আপসেট হয়ে আছে।”
“ওর জন্য তোমার এত দরদ কেন?”
“দরদ নেই।”
“আমি কি অন্ধ?”
“বুঝতে চেষ্টা কর।”
বুশরার মুখোমুখি দাঁড়াল নিশু।
“তুই না মেজ ভাইয়াকে ভালোবাসিস?”
চমকায় ধ্রুব। বুশরার চোখে অশ্রু। যেন সেটাই নীরব সম্মতি।
“তাহলে ওর সাথে কী তোর?”
বুশরা কিছু বলল না। ক্লান্ত সে। বলতে ইচ্ছে করছে না।
“নিশু,আবারও ডমিনেটিং করছিস!”
“এই মুহূর্তে কাজী ডাকো।”
চিৎকার করে উঠল নিশু। চমকায় ধ্রুব।
“কেন?”
“আনো যাও।”
“কেন?”
“ওর সঙ্গে মেজ ভাইয়ার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আমি স্থির হব না। আমি শান্তি পাব না।”
নিশু এখনও ধ্রুবকে বিশ্বাস করছে না।
“যাও,দাঁড়িয়ে থেকো না।”
“এইসব কী বলছিস?”
“ও.. মেজ ভাইয়াকে ভালোবাসে।”
ধ্রুব স্তব্ধ হয়ে গেল। বুশরা তাকে এ কথা বলেনি। তাকে বলেছিল অন্য কাউকে ভালোবাসে।
“আমি ওদের বিয়ে না দেখা অব্ধি শান্তি পাব না। তুমি কাজী ডাকো।”
“এখন কীভাবে? আব্বা-আম্মা কী ভাববে?”
“আমি ম্যানেজ করব তাদের। তুমি কাজী ডাকো।”
দ্বিধা করল ধ্রুব।
“নিশু,এখন এইসব করা কি ঠিক?”
“তাহলে আমি নিশ্চিত হব তুমি ওকে বিয়ে করেছ।”
“ধুর! তোকে বিয়ে করে কূল পাচ্ছি না। ডমিনেটিং করছিস আরেকটা করে পৃথিবী থেকে বিদায় হতে চাই না।”
“কাজী ডাকো। আমার সঙ্গে মজা করো না।”
একপ্রকার বাধ্য হয়ে ধ্রুব বৃষ্টি মাথায় করে হসপিটাল থেকে বের হলো। বাইরের বাতাসে ভেজা ঘ্রাণ,ঠান্ডা ফোঁটা তার চুল ভিজিয়ে দিচ্ছে কিন্তু চোখে শুধু নিশুর দৃঢ় চাহনি। ধ্রুব জানে সে বাধ্য হয়ে কাজী খুঁজতে যাবে। কারণ এই মুহূর্তের শান্তি,নিশুর বিশ্বাস আর সত্যের মিলন সবই তার হাতের মধ্যে। বাইরে বৃষ্টি থামছে না। শহরের বাতাসে ভেজা মাটির সুবাস,দূরের গাছের ভিজে পাতা,সব মিলিয়ে যেন ধ্রুবকে আরও তাঁড়িয়ে দিচ্ছে। ধ্রুব আঙ্গুল দিয়ে ভেজা চুল আঁচড়ে হালকা দৌঁড়ে নিচের রাস্তায় নেমে গেল। চুপচাপ শহরের কোনায় কাজীর সন্ধান করতে লাগল। পথ ভিজে আছে,রাস্তায় ছোট ছোট জলাধার,বাতাসে ভিজে পাতা আর মাটির ঘ্রাণ। হসপিটালের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল নিশু যতক্ষণ ধ্রুবকে দেখা গেল।
“চল,আমার সঙ্গে।”
নিশু বুশরার হাত ধরে আসাদ সাহেবের কেবিনে ঢুকতেই চমকে তাকাল সবাই। কেননা নিশুর এই অপ্রত্যাশিত দৃঢ়তা কেউ আশা করছিল না। বুশরাকে নিয়ে এগিয়ে আসাদ সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়াল।
“আব্বু,ফুপি.. তোমাদের কিছু বলতে চাই?”
ভ্রু কুঁচকালেন আসাদ সাহেব।
“কী?”
“আমার বাবা-মায়ের পরে তোমরাই আমার বাবা-মা। জন্ম দিলেই কেবল বাবা-মা হওয়া যায় না। তবুও আজ একটা অন্যায় আবদার করছি। প্লিজ,আমাকে নিরাশ করো না। আমি তো তোমাদের আরেকটা মেয়ে।”
নিশুর চোখে অশ্রু,কণ্ঠ ভাঙা ভাঙা।
“তোমরা আমার একটা আবদার রাখো। নয়তো আমি বাঁচব না।”
নিশুর কণ্ঠে তীব্র অনুনয় আর ভাঙা হৃদয়ের প্রতিধ্বনি। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন উনারা দু’জন।
“মেজ ভাইয়া আর ও- ওরা দু’জন একে অপরকে পছন্দ করে। আমি চাই ওরা বিয়ে করুক,তাও তোমাদের সম্মতিতে। প্লিজ।”
পুরো কেবিনের ভেতর নীরব চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। বিস্ফোরিত হলেন আসাদ সাহেব। চোয়াল শক্ত করলেন। দ্যুতি নিঃশব্দ,মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ধূসর স্তম্ভিত! নিশু তার নামে এটা কী বলল! মুষ্টিবদ্ধ করল হাত। তবে উনারা বিশ্বাস করতে পারছিল না নিশু কীভাবে এমন সাহস দেখাল!
“অসম্ভব!”
চেঁচিয়ে উঠলেন আসাদ সাহেব।
“আমার পুরো পরিবারের সদস্যদের নামে ওর বাবা মামলা করেছে। শত্রুর মেয়েকে আমি বউ করব- অসম্ভব!”
“এতে ওর কোনো দোষ নেই,আব্বু। ওর বাবা শুধু আমাদের পরিবারের উপর নয় ওর উপর ও অন্যায় করেছে। এখন একজন পিতা তুমি যদি ওকে বুকে টেনে না নাও,তাহলে ওর যাওয়ার জায়গা নেই- ঠিক যেমন আমার মতো। আমার যেমন কেউ নেই,তেমনি এখন ওরও কেউ নেই,তোমরা ছাড়া।”
বুশরার হাত ছেড়ে আসাদ সাহেবের হাত জড়িয়ে ধরল নিশু।
“আব্বু,প্লিজ,মনে করো ও তোমাদের আরেকটি মেয়ে। যদি তাঁড়িয়ে দাও,ওর কী হবে- ভাবো।”
দমে যাওয়ার মানুষ কোনোকালেই ছিলেন না আসাদ সাহেব।
“নিশু,তুই আবেগে ভাসছিস। শত্রু কখনও বন্ধু হয় না। একবার ভুল হলেও মেনে নে।”
“না।”
এ সময় কেবিনের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে কাজী সাহেবের হাত ধরে ভেতরে ঢুকল ধ্রুব। কেবিনের মধ্যে মুহূর্তের জন্য নিঃশব্দ বিরাম। সবাই চমকে তাকাল। কেননা,এখন শুধু নিশুর আবদার নয়,ধ্রুব ও কাজীর উপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরও দৃঢ়তা দিয়েছে।
“আব্বু,সব ঠিক হবে শুধু তুমি রাজি হয়ে যাও।”
পুরো কেবিন যেন একমাত্র আবেগের লড়াইয়ে স্থবির হয়ে গিয়েছে। মুখ ঘুরিয়ে নিলেন আসাদ সাহেব,কণ্ঠে কঠোরতা,চোখে ক্রোধ।
“ভালো হবে না কিন্তু।”
আব্বু,প্লিজ।”
“অসম্ভব!”
আসাদ সাহেবের কণ্ঠ কড়া। পুরো কেবিন নীরব,মুহূর্তে হঠাৎ চাপা উত্তেজনা। ধ্রুব উনার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,”কারো অনুমতি লাগবে না। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ান।”
তার কণ্ঠে এমন দৃঢ়তা,যেন সব বাঁধা অচল হয়ে গিয়েছে। কাজী ধীরে ধীরে পাত্র ও পাত্রীর নাম উচ্চারণ করলেন। দিলরুবা খাতুন মুখে আঁচল চেপে চুপ কিন্তু চোখে রহস্যময় বিস্ময়।
“মানব না এই বিয়ে।”
“চুপ থাকুন!”
জোরে ধমকে উঠল ধ্রুব। কেঁপে উঠল সবাই।
“সারাক্ষণ এক লাইন না বুঝলে হয় না। ওভার রিয়েক্ট করা ছাড়া আর কী পারেন আপনি?”
ধ্রুবর চোখে আগুন। এবার কেউই তার শক্তি অবজ্ঞা করতে পারল না। চোয়াল শক্ত করল ধ্রুব।
“আপনার পছন্দে আমি দুইবার বিয়ে করেছি। এবার আমার পছন্দে না হয় আপনার ছেলে বিয়ে করুক- সমস্যা কোথায়? আপনি আর আম্মার পরে ওর গার্ডিয়ান আমিই তো!”
কিছু বলতে পারলেন না আসাদ সাহেব।
“যা ইচ্ছে তাই করো। তবে আমি মানি না এই বিয়ে।”
উনার কণ্ঠে অভিমান।
“আপনি ছাড়া আর সবাই মানলেই হয়েছে। কাজী বিয়ে পড়ান। আম্মা,তোমার নীরব সম্মতি চাইছি।”
দিলরুবা খাতুন নীরব। কিছু বললেন না। কাজী ধীরে ধীরে বিয়ে পড়ালেন। ধূসরকে কবুল করতে বললেন। সে নীরব,দ্বিধায় পড়েছে। বুশরাকে ফিরিয়ে দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। মেয়েটা লজ্জিত এবং অপমানিত হবে। আর সে তো ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বুশরার সঙ্গে সব ঠিক করে নিবে। এছাড়াও ধ্রুব ছোট হবে। বড় ভাই হিসেবে বাবা-মা,ভাইবোন এবং বুশরার সামনে অপমানিত হওয়ার আতঙ্ক সব মিলিয়ে ধূসর নীরব। যদি এমন হয়,হয়তো ধ্রুব আবারও দেশ ছেড়ে চলে যাবে। আর নিশু,সে নিশ্চয়ই আত্মহ’ত্যার চেষ্টা করবে। নিশু স্থির চোখে ধূসরের দিকে তাকাল।
“ভা..ভাইয়া,কবুল বলো।”
নিশুর চোখগুলো অশ্রু ভরা কিন্তু দৃঢ়,হৃদয়বিহ্বল আর অনুরোধময় করে যেন বলছে,”তোমার বড় ভাইয়ের সম্মান,আমার বিশ্বাস আর বুশরার জীবন- তিনটিই এখন তোমার হাতে। দয়া করে ভুল করো না।”
বৃষ্টি বাইরে থেমেছে,তবে বাতাসে ভেজা পাতার ঘ্রাণ এবং ধূসর-নিশুর মধ্যে সৃষ্টি হওয়া চাপা উত্তেজনা কেবিনভিত্তিক আবহকে আরও নাটকীয় করে তুলেছে। মুহূর্তটা স্থির কিন্তু অন্তর্দাহে ভরা- যেমন আকাশের ঝড় থেমে গিয়েছে কিন্তু মেঘের নিচে বজ্রের প্রতিধ্বনি এখনও কানে বাজছে। ধূসরকে আর কিছু বলার প্রয়োজন হলো না। ধীরে ধীরে নিশুর দিকে তাকাল। নিশু তাকিয়েই রইল। ধূসর দেখল সেই চোখে কত আকুতি। হয়তো,নিশু তার অব্যক্ত কথাগুলো বুঝাতে চাইছে। নীরবে শব্দহীন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নিশুর চোখের মণিতে চোখ রাখল। সবাইকে হতভম্ব করে ‘কবুল’ বলতেই কেঁপে উঠল নিশু। শ্বাস আঁটকে রইল। প্রতিটি শ্বাস যেন থেমে আছে,হৃদয় কেঁপে ওঠে-
ভয়,উত্তেজনা,স্বপ্ন আর আশা সব মিলিয়ে। অপ্রস্তুত হয়ে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো নিশু,ঠোঁট কম্পমান,বুকের ভিতর ব্যথা আর উত্তেজনার মিশ্রণ। কিছুক্ষণ পর বুশরাও নিঃশব্দে কিন্তু দৃঢ়ভাবে ‘কবুল’ বলল। মুহূর্তেই প্রশান্ত হয়ে গেল সব। পরের কার্যক্রমগুলোও খুব দ্রুত সারলেন কাজী সাহেব। মৃদু হেসে সবাইকে মিষ্টি বিতরণ করল নিশু। আসাদ সাহেব নিলেন না মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
মায়াকুমারী পর্ব ৪৯
হাত-পা কাঁপছে উনার। গুরুত্ব দিলো না ধ্রুব। কেবিনের ভেতরে সেই স্থির,শান্ত কিন্তু অন্তর্দাহে ভরা মুহূর্ত। বাইরের হালকা বৃষ্টি এখনও ফোঁটা ফোঁটা কাঁচে পড়ছে। বাতাসে ভেজা পাতার সুবাস,জানালার ফাঁকে আসা আলো সব মিলিয়ে এই মুহূর্তকে যেন অপার্থিব করে তুলেছে। কাজী সাহেবকে নিয়ে বেরিয়ে গেল ধ্রুব। উনাকে পৌঁছে দিয়ে উনার হাতে হাদিয়া তুলে দিলো। কাজী সাহেব গ্রহণ করলেন তা। উনার চোখে প্রশান্তি আর সম্মান।