মায়াকুমারী পর্ব ৬১+৬২
মেহেরিন আনজারা
রাতের নরম অন্ধকার ধীরে ধীরে লিভিং স্পেসের জানালার কাচের মধ্য দিয়ে ভেতরে ঢুকছে। হাওয়ায় দূরের গাছের পাতা নরম দোল খাচ্ছে,মহুয়াফুলের সুবাস ঘরের বাতাসে মিশে আছে। বাইরে দূরে ধূসর আকাশে ছোট ছোট তারা ঝলমল করছে,আর মাঝারি বাতাসে ব্রাশফুলের পাতাগুলো হালকা দুলছে। ঘরের ভেতর শীতল বাতাস,টেবিলের আলো আর টিভির মৃদু আলোর ছায়া মিলিয়ে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছে। লিভিং স্পেসের সোফায় বসে আছেন আসাদ সাহেব। নিশু উনার হাঁটু জড়িয়ে ধরে তাতে থুতনি রেখে বসে আছে। আসাদ সাহেব টিভির দিকে মন দিয়েছেন। নিশুও তাকিয়ে রয়েছে টিভির দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে হসপিটাল থেকে সবাই বাসায় ফিরল।
নিশুর দিকে দৃষ্টি পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলো ধূসর। সোজা সিঁড়ি বেয়ে রুমের দিকে পা বাড়াল। অপ্রসন্ন ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল নিশু। কেন জানি মনে হলো,ধূসরের মুখে যেন একরাশ অচেনা অভিমান ফুটে রয়েছিল। এটা কি তার কারণে বুঝতে পারল না নিশু। চিন্তিত হয়ে না উঠে কিচেনের দিকে পা বাড়াল। রিনাকে নিয়ে ডাইনিং টেবিল সাজাতে লাগল। নৈশভোজের সময় এসে গিয়েছে। নিশু মনোযোগ দিয়ে টেবিল সাজিয়ে সবাইকে খেতে ডাকল। ধ্রুব ও ধূসর গোসল সেরে চেয়ারে বসল। একে একে সবাই বসল। নিশু আসাদ সাহেবের হাত ধরে চেয়ারে বসাল। শান্ত অথচ মৃদু উত্তেজনাপূর্ণ সেই মুহূর্তে সবাইকে মনোযোগ দিয়ে খাবার পরিবেশন করতে লাগল নিশু। খেতে খেতে নীরবতার মাঝে ধ্রুব হঠাৎ বলে উঠল,”পড়াশোনা তো চাঙে তুলেছিস।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
ভ্রু কুঁচকে তাকায় নিশু।
“খেয়েদেয়ে সোজা মন দিয়ে পড়তে বসবি। আর কাল সকাল থেকে ভার্সিটিতে যাবি।”
“আমার মতো অসুন্দরীকে বউ বানানোর জন্য অনেক ছেলে জান দিয়ে পড়ালেখা করছে। আমার পড়াশোনার দরকার নেই।”
“কী বললি?”
“যা সত্য তাই।”
“নিশুর বাচ্চা!”
আচমকা নিশুর বেণিতে টান দিতেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠল,”আহ্! বেণি টানো কেন?”
“পাকনা পাকনা কথা কম বলিস।”
“সত্য বলেছি বলে তোমার লেগেছে তাই না!”
রাতের নরম আলো,জানালার ধুলোমাখা চাঁদের আলো,ঘরের ভিতরের শান্ত বাতাস,খাবারের গন্ধ আর তাদের মধ্যে ছোট ছোট কথোপকথন- সব মিলিয়ে মুহূর্তটা যেন এক মৃদু উষ্ণতায় ভরে গিয়েছে। নিশুর অভিমানী হাসি আর ধ্রুবর ধীরভঙ্গি মিলিয়ে রাতটি হয়ে উঠল এক অদ্ভুত অথচ পরিচিত নান্দনিকতা,যেখানে ভালোবাসা আর মিষ্টি হাসির ছোঁয়া সবকিছুকে ঘিরে রেখেছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে রুমে ফিরে গেল সবাই। আসাদ সাহেব বললেন,”দিলরুবা শুনছো?”
“কী?”
“কাল বাসায় মেহমান আসবে।”
“কীসের?”
“দ্যুতির বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে। আমিও কখন মরে যাই ঠিক নেই। তাই ভাবছি ওর বিয়ে দিয়ে দিবো। খুব ভালো ঘর থেকে প্রস্তাব এসেছে ওর জন্য।”
“যা ভালো মনে হয় করুন। তবে আপনার মেয়ে রাজি হবে তো?”
“দেখতে আসলেই বিয়ে হয়ে যায় নাকি! আর প্রথম প্রথম মেয়েরা একটু এমন করেই পরে ঠিকই মানিয়ে নেয়। ওইসব নিয়ে ভেবো না।”
“যা ভালো হয় করুন।”
“হ্যাঁ,বলে দিও ওদের।”
নৈশভোজ শেষ করে যে যার যার রুমে ফিরে গেল। রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। চাঁদের নরম আলো জানালার কাচের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকছে,দেওয়ালে হালকা ছায়া ফেলে। হাওয়ায় পর্দাগুলো মৃদু দুলছে,যেন রাতের নিঃশব্দও নিঃশ্বাস ফেলে। বাইরে গাছের পাতার কোমল দুল,ঘরে ভেসে আসা বসন্তের ফুলের সুগন্ধ- সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত,অস্থির শান্তি তৈরি করছে। দ্যুতি বিছানা ঝেড়ে ঠিক করল। আজ তারা তিনজন একসাথে ঘুমাবে,অনেক অনেক গল্প করবে। নিশু ব্যালকনির দরজা বন্ধ করতে নিতেই হঠাৎ সিগারেটের ধোঁয়ার ঘ্রাণ পেতেই খুকখুক করে কেশে উঠল। চোখ বড় করে পাশের ব্যালকনির দিকে তাকাতেই দেখল ধ্রুব সিগারেট ফুঁকছে। মেজাজ খারাপ হলো নিশুর। সে কখনোই সিগারেট খাওয়া ছেলেদের পছন্দ করে না। দরজা বন্ধ করে রুম থেকে বেরোতে নিতেই দ্যুতি বলল,”কোথায় যাস?”
“তোরা শুয়ে পড়,আমি একটু আসছি।”
দ্যুতি আর বুশরা শুয়ে পড়ল। ঘরে নীরবতা নেমে এলো। নিশু ধ্রুবর রুমের দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। পা বাড়াল ব্যালকনির দিকে। ঠিক তখনই কয়েক কদম এগিয়ে আকস্মিক তার কোমর পেঁচিয়ে ধরল ধ্রুব। হকচকিয়ে উঠল নিশু। ধ্রুবর চোখে নেশার ছাপ,ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি,নাক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে। নিশুর হৃদয় ধড়ফড় করতে লাগল।
“কী করছো?”
“কেন এলি?”
“জানতে?”
“হুম।”
“সিগারেট খাচ্ছ কেন?”
“তো কী খাব?”
“কোমর ছাড়ো।”
ঠোঁট দুটো এগোতেই চোখ বন্ধ করে ফেলল নিশু। অনুভব করল ধ্রুবর উষ্ণ স্পর্শ,যেন তার অন্তরের নিঃসঙ্গ আবেগকে জাগিয়ে তুলছে। চাঁদের নরম আলো তাদের মুখে হালকা ছায়া ফেলছে। বাতাসে ধোঁয়ার ঘ্রাণ,বসন্তের ফুলের সুবাস এবং নিঃশ্বাসের খেলা- সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। নিশু চুপচাপ অথচ ভিতরে অস্থির। ধ্রুবর হাত ধীরে ধীরে নিশুর কোমরের চারপাশে ঘুরে গেল। নিশু মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে থমকে গেল।
“নিশু!”
“হু!”
“তোকে ছাড়া ঘুম আসে না।”
নিশুর বুক কেঁপে ওঠে।
“কী জাদু করলি?”
কিছু বলতে চাইল কিন্তু শব্দগুলো গলায় আঁটকে গেল। ধ্রুবর আঙুল ছুঁয়ে যায় তার গাল,যেন বসন্তের রাতের প্রথম উষ্ণ হাওয়া। নিশু চোখ বুজে ফেলল। তার কাঁধে ধ্রুবর হাত,আর ব্যালকনির পর্দা হাওয়ায় নরমভাবে দুলে ওঠে। দূরের গাছের ফাঁক দিয়ে জোনাকিরা আলো ছড়ায়।
“তোর গায়ের গন্ধে যেন বসন্তটা বদলে যায়।”
নিশু চোখ খুলে তাকায়। ধ্রুবর মুখ একেবারে কাছে। সময় যেন থেমে যায়,পৃথিবী শুধু দু’জন মানুষকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে। বাতাসে ভেসে আসে মহুয়া,বকুলের গন্ধ,কোথাও দূরে কুকুর ডাকছে নিঃসঙ্গ রাতের সঙ্গী হয়ে। ধ্রুব আলতো করে নিশুর কপালে ঠোঁট রাখে। এক মুহূর্তের জন্যই কিন্তু তাতে যেন গোটা বসন্ত গলে মিশে যায় তাদের মধ্যে। নীরব,অস্থির অথচ গভীর ভালোবাসার এক অব্যক্ত প্রতিশ্রুতিতে।
ভোরের কোমল ও স্নিগ্ধ আলো জানালার ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতর। পাখিরা ডালে ডালে ডাকছে,আমগাছের পাতায় শিশির টলমল করছে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে পরোটা ভাজার গন্ধ। তার সাথে হালকা চায়ের বাষ্প। নাস্তা শেষ করে নিশু আর দ্যুতি ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে নিলো ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য। বিছানার কোণে মনভার করে চুপচাপ বসে আছে বুশরা। চোখে হালকা ক্লান্তি,মুখে অন্যমনস্ক ভাব। দ্যুতি ওর দিকে তাকিয়ে থেমে গেল।
“কীরে মুখটা এমন করে রেখেছিস কেন?”
“আমি তো একা হয়ে যাব।”
“আরে,একা মানে! আম্মুর সাথে থাক না,গল্প কর,ফ্রি হ! আমরা দুপুরের মধ্যেই ফিরব।”
“কীভাবে কী করব বুঝতে পারছি না!”
নিশু ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল। মৃদু হেসে বলল,”একটা কথা বলি?”
“কী?”
“শোন,মন খারাপ করিস না কিন্তু শুনে রাখ- সংসার করতে হলে শুধু স্বামীকে নয়,তার পরিবারকেও আপন করে নিতে হয়। শুধু দূরে বসে থাকলে কেউ তো তোর মন বুঝবে না,তাই না?”
“নিশু ঠিক বলেছে,বুশরা। তুই ভাব,আমাদের পরিবারটা অন্য দশটা বাড়ির মতো না। এখানে হিংসা-বিদ্বেষ নেই। সবাই খোলামেলা,সহজ-সরল। একবার মন জিতে নিতে পারলে,সবাই তোর পাশে থাকবে। দেখ,আমার মা-বাবা হয়তো এখনও পুরোপুরি তোর সাথে মিশতে পারেননি কিন্তু সেটা সময়ের ব্যাপার। ভাব তো,তুই এখনও একটা কথাও বলিসনি উনাদের সঙ্গে- তবুও কেউ তোর ওপর রাগ করেনি। অন্য পরিবার হলে হয়তো এখনই দোষ ধরত।”
“আমার সাহস হয় না দ্যুতি.. মনে হয়,কথা বললেই ভুল কিছু বলে ফেলব।”
কয়েক কদম এগিয়ে দ্যুতি হেসে ওর হাত ধরে বলল,”ভুল হলে শোধরাবে,তাতেই তো সম্পর্ক তৈরি হয়। দেখবি,একদিন তুই এই ঘরের প্রাণ হয়ে উঠবি। আমার আম্মু এমন মানুষ,একবার মন খুলে কথা বললেই আপন করে নিবে। তুই চেষ্টা করিস,শুধু একবার।”
নিশু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলল,”চল,দেরি হয়ে যাচ্ছে,নইলে মুডি স্যার আবার মুড দেখাবে।”
দ্যুতি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে হাসল।
“ঠিক আছে,আমরা যাচ্ছি। তুই এখন হাসবি,ঠিক আছে? আর আজ দুপুরে আম্মুর পাশে গিয়ে একটু গল্প করিস। দেখবি,উনিই আগে হাসবেন।”
বুশরা মৃদু মাথা নাড়ল। দু’জন বেরিয়ে গেলে ঘরটা আবার নরম আলোয় ঢেকে গেল। জানালা দিয়ে আসা বাতাসে পর্দা দুলল,আর দূরে কোথাও পাখির ডাক মিলিয়ে গেল। বুশরা নিঃশব্দে উঠে আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে বাসা থেকে বের হলো ওরা। সূর্যালোকে চোখ মেলল ওরা দু’জন। সকালের বাতাসে ধুলো মিশে আছে,গেটের ধারে রোদ ঝলমল করছে। ঠিক তখনই সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো তাহমিদ। হাতে গাড়ির চাবি,চোখে সেই চিরচেনা নিস্তব্ধতা। তাহমিদকে দেখতেই নিশুর নিঃশ্বাস থমকে গেল। বুকের ভিতর হঠাৎ কেমন চাপা ধকধক। চোখ নামিয়ে নিলো দ্রুত,যেন কারও দৃষ্টিতে পুড়ে যাবে এখনই। দ্যুতি একবার তাকিয়ে আবার চুপ করে গেল। বাতাসে অদ্ভুত একটা নীরবতা নেমে এলো। তাহমিদের চোখ এক মুহূর্তের জন্য স্থির হলো নিশুর মুখে। কিছু না বলে সে গাড়ির দরজা খুলে বসল,ইঞ্জিনের গর্জন উঠতেই সেই নীরবতাও ভেঙে গেল। গাড়ি ধীরে ধীরে গেট পার হয়ে মিলিয়ে গেল মোড়ের বাঁকে। ধ্রুব ঠিক তখনই এসে দাঁড়াল। পরনে সাদা শার্ট,গম্ভীর মুখ। গাড়ির দরজা খুলে দিলো। ওরা দু’জন নীরবে উঠে বসল। রাস্তায় গাড়ি এগিয়ে চলল,শহর তখন ব্যস্ত হয়ে উঠছে। রাস্তার পাশে স্কুলের বাচ্চারা,দোকানের ঝাঁপ উঠছে,বাতাসে সকালের কোলাহল। ধ্রুবর হাত স্টিয়ারিংয়ে আর নিশু জানালার বাইরে তাকিয়ে। ওরা বেরিয়ে যেতেই হঠাৎ বাসায় এলো ধ্রুবর দাদীমা এবং ফুপি। দিলরুবা খাতুন কুশল বিনিময় করে আদর-আপ্যায়ন করলেন। সুফিয়া বেগম বললেন,”ধূসর নাকি বিয়ে করেছে,দিলরুবা?”
“জি,আম্মা।”
“বউ কই?”
“ঘরে।”
“ডাকো। দেখে না মেহমান আসছে।”
“রিনা,একটু ডেকে নিয়ে আয় তো।”
“জি,খালাম্মা।”
রিনা বুশরাকে বলল,”মেহমান আসছে,আপনারে ডাহে।”
“কে এসেছে?”
“আপনার দাদী আর ফুপি শ্বাশুড়ি আসছে।”
বুশরার বুকটা ধক করে উঠল। গলা শুকিয়ে এলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওড়নাটা ঠিক করল,তবু মনে হলো কিছু যেন ঠিক হচ্ছে না। পা দুটো কাঁপতে কাঁপতে ধুরু ধুরু বুকে লিভিং স্পেসের দিকে এগিয়ে গেল এবং সালাম দিলো। আপাদমস্তক চোখ বুলালেন উনারা দু’জন।
“সারাক্ষণ সোয়ামির লগে ঘরের মধ্যে বইসা থাকো বুঝি?”
অপ্রস্তুত হলো বুশরা। মুখ শুকিয়ে গেল তার কিছু বলতে পারল না। চোখ নামিয়ে রাখল।
“কাজকাম করো না?”
কিছু বলল না বুশরা।
“রান্ধাবাড়া পারোনি?”
আমতাআমতা করল সে।
“দেহি কেমন রান্ধাবাড়া করো। আইজ রান্ধো গিয়া।”
দিলরুবা খাতুন বললেন,”সবে বিয়ে হয়েছে। এখন রান্না করার কী আছে! ধীরে ধীরে সব শিখে নিবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।”
“চুপ করো,দিলরুবা। এত দরদ দেখিও না।”
চুপ হয়ে গেলেন তিনি। তবে ভিতরে ভিতরে বুশরার জন্য কেমন একটা মায়া অনুভব করলেন।
“বউ হয়ে আসছে,ঘর সামলাইতে শিখতে হইবো। দুধে-ভাতে থাকবা,কাজকাম না শিখলে সংসার কেমনে টিকবো?”
সাদিকা খাতুন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,”এই যুগের মেয়েরা শুধু সাজগোজ করতে জানে,রান্নাবান্না জানে না।”
বুশরার মুখের রঙ বদলে গেল। অপমানের ভারে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। বুশরা মাথা নিচু করে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। কপালের ঘাম মুছে নিলো হাতের পেছন দিয়ে। বুকের ভিতর একরাশ অজানা ভয়,এই বাড়ির প্রথম পরীক্ষা আজই বুঝি শুরু হলো। কফি বা নুডলস ছাড়া সে আর কোনো রান্না জানে না। এখন কীভাবে কী রান্না করবে বুঝতে পারল না। রিনা নীরবে কাজ করতে লাগল। বুশরাকে দেখতেই ভ্রু কুঁচকাল।
“আপনারে তো পাকের ঘরে আইতে দেহি না। কিছু লাগবো?”
“রান্না করব।”
“কী রানবেন?”
“কী রান্না হবে আজ?”
“মেহমান আসছে। মাছ,গোজ,পোলাও আরও অনেক কিছু।”
“আ.. আমি তো পারি না।”
“আইচ্ছা,আমি আপনারে সাহায্য করমু।”
মাথা নাড়ল বুশরা।
“প্রথমে মাংসটি বসাই দেন। মাংস সিদ্ধ হইতে মেলা সময় লাগবো।”
“আচ্ছা,কীভাবে রান্না করবো?”
রিনা বাইরের দিকে একপলক তাকিয়ে মাংসগুলো ধুয়ে সব মশলা একসাথে মাখিয়ে চুলায় বসিয়ে দিলো।
“এখন আস্তে আস্তে নাড়েন। মানে কষান।”
“আচ্ছা।”
আরেক চুলায় চিকেন রোস্ট রান্না করার জন্য পাতিলে তেল দিলো। গরম হতেই পেয়াজ দিতে গিয়ে তেল ছিটকে পড়তেই চিৎকার করে উঠল বুশরা। তার হাত লাল হয়ে উঠল মুহূর্তেই,চোখে পানি চলে এলো ব্যথায়।
“আরেহ কী করতাছেন! কলে হাত ভেজান।”
কল ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে রইল বুশরা। মুখ দিয়ে আহ! উহ! করছে। তবে বুশরার চিৎকার শুনতেই ধূসর সহ সবাই ছুটে এলো।
“কী হয়েছে?”
“তেল ছিটকাইয়া পড়ছে,ভাইজান।”
“ও এখানে কী করছে?”
“রান্ধাবাড়া করতে আসছে।”
মেজাজ খারাপ হলো ধূসরের। কিচেনে ঢুকে বুশরার হাত তুলে ধরল। গরমে দগ্ধ চামড়া দেখে ধূসর রেগে গেল।
“তুমি কি পাগল নাকি? যা পারো না তা করতে আসো কেন?”
কিছু বলতে পারল না বুশরা। তার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। ওদিকে পেয়াজ পুড়ে গন্ধ বেরুচ্ছে। মাংসেও পোড়া দাগ লেগে গেল। মেজাজ খারাপ হলো ধূসরের।
“তোমাকে কে বলেছে রান্না করতে,স্টুপিড মেয়ে কোথাকার!”
বুশরার হৃদয় ভার হয়ে এলো। উনারা তিনজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। ধূসর ঠাণ্ডা পানির নিচে বুশরার হাতটা ধরে রাখল,মুখে অনবরত বকছে অথচ চোখে স্পষ্ট উদ্বেগ। সুফিয়া বেগম ঠোঁট বাকিয়ে বললেন,”বাপরে কত ঢং! কত রানছি,কত হাত পুড়ছে আমগো কই কেউ তো এমন করে নাই। এই যুগের ছেরি গো কত রঙ কত ঢং!”
“চুপ করো,দাদীমা। পেঁচাল কম করো।”
থমথমে হয়ে গেল উনার মুখ।
“তোর বউয়ের লাইগা আমারে ধমক দিছোছ?”
“ও ধ্রুবর বউ নয় ধূসরের বউ। কথা বলতে হিসেব-নিকেশ করে বলবে।”
বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যেন সবার মাথায়। তবে মনে মনে উৎফুল্ল হলেন দিলরুবা খাতুন। এই দু’জন ভদ্রমহিলা যা করেছে নিশুর সঙ্গে তা-ও আবার ধ্রুবর দূর্বলতা নিয়ে। তবে ধূসর আজ বুশরার বেলায় সেটা হতে দেয়নি। একেই বলে যোগ্য মায়ের যোগ্য সন্তান,যোগ্য স্বামী। নিজেকে ধূসরের বউ বলায় বুশরার মনে হলো তার সব ব্যথা ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে। স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে সব। বুশরার ইচ্ছে করছে আরও কয়েক কোটিবার হাত পুড়তে,শুধু ‘বউ’ কথাটি শোনার জন্য।
“দেখছো,কত বড় কথা কইলো বউয়ের লাইগা!”
বুশরার হাত ধরে কিচেন থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে নিয়ে গেল ধূসর এবং অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিলো।
“কে বলেছে তোমাকে পাকনামি করতে?”
ধমকে উঠতেই কেঁপে উঠল বুশরা।
বিকেলের আলো ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে। ক্যাম্পাসের গেটে ভিড়,ছাত্রছাত্রীরা দল বেঁধে বেরিয়ে আসছে। ঠিক সেই সময় গম্ভীর হয়ে গেটের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল ধ্রুব। সাদা শার্টের হাতা গোটানো,চোখে সানগ্লাস।
“কখন এলে,ভাইয়া?”
“একটু আগে। চল,আজ কফি খাওয়া যাক।”
নিশু কোনো কথা বলল না,ব্যাগের স্ট্র্যাপ ঠিক করে নিঃশব্দে ওদের সঙ্গে হাঁটতে লাগল। রোদের আলো তখন সোনালি আভায় ভরে দিয়েছে রাস্তা। রেস্তোরাঁয় ঢুকে কোণের টেবিলটা বেছে নিলো। গরম কফির মগ,হালকা স্ন্যাকস-বার্গার,স্যান্ডউইচ। খাওয়া শেষে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এলো এবং গাড়িতে উঠল। গাড়ি ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। বিকেলের রোদ তখন ম্লান,বাতাসে কেমন এক শান্ত উষ্ণতা। কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামল শহরের এক বড় শপিংমলের সামনে। নিশু অবাক হয়ে বলল,”এখানে কেন?”
“চল,ভেতরে।”
গাড়ি থেকে নেমে ওরা ভেতরে ঢুকল। শোরুমজুড়ে চকচকে বাইকের সারি। লাল,নীল,কালো,সিলভার। আলো পড়ে বাইকের গায়ে ঝলমল করছে ধাতব ছটা। নিশু একটার পর একটা দেখে হাত বুলিয়ে নিচ্ছে। অবশেষে এক কালো বাইকের সামনে থেমে গেল সে।
“এটা সুন্দর.. শক্ত অথচ এলিগেন্ট।”
“তাহলে ঠিক হলো। নাম রাখব স্টর্মব্ল্যাক।”
দ্যুতি বলল,”চমৎকার নাম তো!”
কিছুক্ষণের মধ্যেই কাগজপত্র সেরে ফেলল ধ্রুব। বাইকটা দোকানের সামনে এনে দাঁড় করানো হলো। সূর্যের শেষ আলো বাইকের কালো বডিতে ঝিলিক দিচ্ছে। নিশু ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,”তুমি তো সত্যিই সারপ্রাইজ দিতে জানো।”
ধ্রুব কিছু বলল না। বিকেলের বাতাসে ওদের হাসি মিশে গেল। দূরে শহরের আলো জ্বলে উঠছে,একটা নতুন শুরু যেন নীরবে জন্ম নিচ্ছে সেই মুহূর্তে,স্টর্মব্ল্যাক বাইকের গায়ে প্রতিফলিত সূর্যাস্তের সোনালি ছায়ায়। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। সোনালি আলোয় ঝলমল করছে শহরের রাস্তা,বাতাসে হালকা গরম,তবু কোথাও এক অদ্ভুত প্রশান্তি। শপিংমলের সামনে চকচক করছে নতুন কালো বাইক স্টর্মব্ল্যাক,যেন নিজেই বসন্তের আলো শুষে নিয়ে দীপ্ত হয়ে উঠেছে। ধ্রুব হেলমেট হাতে ঘুরে তাকাল নিশু আর দ্যুতির দিকে।
“চল,আজ প্রথম রাইডটা তিনজন মিলে হোক।”
দ্যুতি হেসে উঠল।
“তিনজন! বাইক কি জাদুর কার্পেট?”
“আজ ওটাই হবে। বসন্তের সন্ধ্যায় জাদু ছাড়া গল্প চলে?”
নিশু প্রথমে একটু ইতস্তত করল,তারপর দ্যুতির তাগিদে বাইকে চেপে বসল। ধ্রুব সামনে,দ্যুতি মাঝখানে,আর একেবারে পেছনে নিশু। চুলের গোছা উড়ছে হাওয়ায়,মুখে নরম আলো। ইঞ্জিনের গর্জন উঠতেই বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল একরাশ উচ্ছ্বাস। বাইকটা ধীরে ধীরে রাস্তায় গতি পেল। রাস্তার দুই পাশে ফিকে আলো জ্বলে উঠছে,দোকানগুলোর কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছে চলমান ছায়া। হাওয়ার ধাক্কায় নিশুর চুল ধ্রুবর কাঁধ ছুঁয়ে যাচ্ছে,দ্যুতি মাঝেমধ্যে হাসছে উচ্চস্বরে। তাদের হাসির প্রতিধ্বনি মিশে যাচ্ছে শহরের কোলাহলের সঙ্গে। লালবাতি পেরিয়ে,ফাঁকা রাস্তায় বাইক ছুটে চলে যেন এক স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে। নিশু দু’চোখ বন্ধ করে অনুভব করল বাতাসের গন্ধ,ধ্রুবর কণ্ঠের গভীর উষ্ণতা,আর বসন্ত সন্ধ্যার উড়ন্ত শান্তি। দূরে দেখা গেল তাদের বাসার গলির মোড়। ধ্রুব গতি কমাল,ব্রেকে চাপ দিলো আলতো করে। বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে চারপাশে নেমে এলো এক মোলায়েম নিস্তব্ধতা। আকাশে তখন গোধূলির শেষ আলো। কমলা,লাল আর হালকা বেগুনি রঙে মিশে গিয়েছে। বাতাসে হালকা ফুলের ঘ্রাণ,দূরে আজানের সুর ভেসে আসছে। দ্যুতি আগে নেমে পড়ল,চুল এলোমেলো হয়ে গিয়েছে,তবু মুখে উচ্ছ্বাস।
“আহা,কী সুন্দর ছিল রাইডটা! মনে হচ্ছিল,যেন সিনেমার দৃশ্য।”
“নিশু বলল,”সিনেমা না নিজের জীবনের একটা সুন্দর অধ্যায় ছিল এটা।”
ধ্রুব কিছু বলল না,হেলমেট খুলে নিলো।
“আম্মা,চিন্তা করবে বাসায় যা।”
সায় দিয়ে ওরা ভেতরে ঢুকে গেল। ধ্রুব বাইকটা গ্যারেজে রাখল। বাসায় ঢুকতেই দেখল লিভিং স্পেসে বসে আছেন সুফিয়া বেগম,সাদিকা খাতুন আর তাদের সামনে গম্ভীর মুখে চুপ করে বসে আছেন আসাদ সাহেব। নিশুর পেছনে ধ্রুবর উপস্থিতি টের পেতেই যেন হঠাৎ ছায়া নেমে এলো ঘরে। সুফিয়া বেগম বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালেন। যেই মেয়ের নামটা পর্যন্ত শুনতে পারত না ধ্রুব এখন তার পেছনে। মা-মেয়ে দু’জন নড়েচড়ে বসলেন। নিশু চুপচাপ সালাম দিয়ে দ্যুতির পেছনে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। রুমে ঢুকে ওরা দেখল বুশরা নেই।
“কীরে,বুশরা কই,নিশু?”
“আমিও তো সেটাই ভাবছি।”
ড্রেস চেঞ্জ করে নিলো দু’জন। রিনাকে ডাকল দ্যুতি। আসতেই জিজ্ঞেস করল,”বুশরা কোথায়?”
“মাইজ্জা ভাইজানের ঘরে।”
চমকায় দু’জন।
“কখন গেল?”
“আরেহ,ভাইজানই তো হাত ধইরা নিয়া গেল।”
ফের চমকায় দু’জন।
“মানে?”
“সত্যি কইতাছি।”
ওদের দৃষ্টিতে অদ্ভুত বিস্ময়।
“মানে কীভাবে কী?”
রিনা ওদের বিস্তারিত বলল। পুরো ঘটনাটা শুনতেই নিশু মৃদু হাসলেও দ্যুতির চোখে নেমে এলো একরাশ অভিমান। রান্না করতে সমস্যা নেই বরং সেটা আনন্দেরও হতে পারে। কিন্তু বুশরা অন্তত একবার তার মাকে জিজ্ঞেস তো করতে পারত! আর এভাবে তাদের সম্পর্কটা উন্নত-ও হত। আড়ষ্টতা ভাঙ্গত। ইসলাম ধর্মে পুত্রবধূর উপর শ্বশুরবাড়ির কারো সেবা করা ফরজ নয় এ কথা দ্যুতি জানে। কিন্তু সৌজন্যবোধ,শ্রদ্ধা,ভালোবাসা- এসব তো ধর্মের বাইরেও সামাজিক একটা সেতু গড়ে দেয়। একটা সম্পর্ক তো তৈরি হয় ছোট ছোট সৌজন্যবোধ,শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দিয়ে। ধর্মীয় দায়িত্ব নয়,সামাজিক সৌন্দর্য। ভাবনাগুলো দূরে ঠেলে দিয়ে নিজেকে সামলে নিলো দ্যুতি। ঠিক তখনই দরজায় টোকা পড়ল। দিলরুবা খাতুন ভেতরে ঢুকে বললেন,”নামাজ পড়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে নে তোরা। আর নিশু,শোন।”
“জি,ফুপি?”
দিলরুবা খাতুন তাকে একটু আড়ালে ডেকে বললেন,”একটু পরে বাসায় মেহমান আসবে। চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে হবে।”
“একদম টেনশন নিও না,ফুপি।”
“আর শোন,দ্যুতিকে একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে দিস। ওকে দেখতে আসবে।”
মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেল নিশুর মুখ। তবু মুখে কিছু প্রকাশ করল না।
“আচ্ছা,বুঝেছি।”
চলে গেলেন তিনি।
“আম্মু কী বলল,নিশু?”
“তোকে দেখতে আসবে।”
“আমি এখন বিয়ে করব না।”
“দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না!”
“এই একটা কথাতেই হাজারটা মেয়ের জীবনের ইতিহাস হয়ে গিয়েছে,নিশু।”
“আচ্ছা,টেনশন নিস না। মাথা ঠাণ্ডা রাখ। আর আমাদের তো নিনজা টেকনিক আছে! এখন চল,নামাজ পড়ে নিই।”
অযু করে নামাজ আদায় করে দু’জন খাবার খেয়ে নিলো। এরপর দু’জনে মিলে চা-নাস্তার আয়োজন করল। রিনা সাহায্য করল কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বুশরা একবারও রুম থেকে বের হলো না। ওরা-ও আর যে-চে জিজ্ঞেস করল না কিছু। ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দিলো। কিছুক্ষণ পর পাত্রপক্ষ এলো। আদর-আপ্যায়নের পর অতিথিরা দ্যুতিকে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করল। নিশু দ্যুতির হাত ধরে লিভিং স্পেসে নিয়ে গেল। সুযোগ বুঝে ফিসফিস করে বলল,”শুরু কর!”
পরিকল্পনা মোতাবেক,দ্যুতি কুঁজো হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল পাত্রপক্ষ। এমনভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটল যে মনে হলো দ্যুতির একটি পা খাঁটো। আসাদ সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। দ্যুতি মাথা নিচু করে পাত্রের সামনে বসল। পাত্র কফির মগে চুমুক দিয়ে দ্যুতির দিকে তাকাতেই সে এমনভাবে চোখ টেরা করে তাকাল,যেন সে কিছুতেই স্বাভাবিক নয়। সঙ্গে সঙ্গে কেশে উঠল পাত্র এবং মুখ থেকে ছিটকে কফি বেরিয়ে গেল। দ্যুতিকে দেখা শেষে পাত্রপক্ষ যাওয়ার পূর্বে বলে গেল,বাসায় গিয়ে জানাবে। এরপর তারা খুব তাড়াতাড়িই বিদায় নিলো। পাত্রপক্ষ চলে যেতেই নিশু আর দ্যুতি একে-অপরের দিকে তাকিয়ে বিজয়ের হাসি হাসল এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পাত্রপক্ষ বিদায় নেওয়ার পর বাড়িজুড়ে যেন হঠাৎ এক ভারি নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কারও মুখে কোনও কথা নেই,তবু মনে হচ্ছিল চারপাশে অজস্র প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। দ্যুতি ধীর পায়ে রুমে চলে গেল। নিশু কোমরে শাড়ির আঁচল বেঁধে কিচেনে ঢুকে নৈশভোজের আয়োজন শুরু করল। ঠিক তখনই পেছন থেকে এসে দাঁড়ালেন দিলরুবা খাতুন।
“নিশু,কী করিস?”
“এই তো তেমন কিছু না। রাতের খাবার রেডি করছি।”
“তোর করতে হবে না। যা,একটু রেস্ট নে। শরীরটাকে একটু বিশ্রাম করতে দে।”
“না,ফুপি তুমি যাও। আমি ঠিক আছি।”
“এমন করলে তুই আরও অসুস্থ হয়ে পড়বি,নিশু। হসপিটাল থেকে এসেছিস,সপ্তাহ দুইও তো হয়নি এখনও।”
“ওত ভেবো না,ফুপি। আমি এখন একদম ফিট।”
“কিন্তু ভার্সিটি থেকে ফিরেছিস,একটু তো রেস্ট নিবি,পড়াশোনা করবি।”
“পড়াশোনা করে আর কী হবে,ফুপি.. একটা ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দাও বরং। তোমার ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বুড়ি হয়ে যাব আমি। এমনিতেই কুঁড়ি পার হয়ে গিয়েছে।”
শব্দ করে হেসে ফেললেন তিনি।
“পাগলি মেয়ে।”
নিশুও ফিক করে হেসে ফেলল। গাল দুটি রাঙা হয়ে উঠল। রিনার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে নিশু টেবিল সাজাতে শুরু করল। পাত্রপক্ষ চলে গেলেও মেহমান রয়ে গিয়েছে বাড়িতে। আয়োজনের কোনো কমতি রাখা চলবে না। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো দিলরুবা খাতুনের। নিশুর মনে অনেক কষ্ট,তা তিনি উপলব্ধি করেন। বাবা-মায়ের কথা ভেবে ভীষণ কষ্ট পায়,ডিপ্রেশনে ভুগে। তিনি সবসময়ই চেষ্টা করেন সব কষ্ট ভুলিয়ে দিতে। নিশু কাজের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পায়,দুঃখ-কষ্ট ভুলে যায় তাই তিনি কখনও নিষেধ করেন না কিছুর জন্য। যেভাবে নিশু ভালো থাকবে সেভাবেই স্বাধীনতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। অনেক দিন পর শাড়ি পরেছে নিশু। হালকা রঙ,তার গায়ে যেন আলো এসে পড়েছে। চুলগুলো খোলা,কানে টানা ঝুমকা,ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। সবমিলিয়ে অনন্য লাগছে। দিলরুবা খাতুন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। চোখে মুগ্ধতা আর একরাশ আফসোস। এত সুন্দরী একটা মেয়ে,এত গুণী,এত ধৈর্যশীলা,তবু কেন উনার ছেলে এতগুলো বছর অবহেলা করল! তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না মাঝে মাঝে।
“তোকে আজ খুব সুন্দর লাগছে রে,নিশু।”
থমকে তাকায় নিশু।
“কিন্তু আপনার মুডওয়ালা ছেলে তো বলে আমি নাকি সুন্দরী না।”
“মজা করে বলে হয়তো!”
“একদম না,ফুপি। কেউ মজা করলে আমি বুঝতে পারি।”
“তোকে রাগানোর জন্যই বলে হয়তো।”
“তোমার ছেলে কেমন তুমি এখনও বুঝো না বুঝি!”
দিলরুবা খাতুন এবার হেসে ফেললেন। নিশুর সরলতা আর স্পষ্টভাষী মন উনাকে একদিকে কষ্ট দেয়,অন্যদিকে একধরনের ভালোলাগায়ও ভরে তোলে। দ্যুতি শাড়ি পাল্টে বেরিয়ে এলো। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছায়া। বাইরে এসে দেখল,নিশু একাই কাজ করছে আর তার মায়ের সাথে হেসেখেলে আহ্লাদী হয়ে কথা বলছে। বেশ ভালো লাগল দ্যুতির। কীসের ফুপি,কীসের ভাইঝি- বউ-শ্বাশুড়ীর সম্পর্কটা হওয়া উচিত এমনই বন্ধুত্বপূর্ণ,প্রাণখোলা,ভালোবাসাময় এবং স্নেহভরা। রিনা পাশে আছে কিন্তু বুশরার কোনও অস্তিত্ব নেই। সকালবেলা দু’জন বুশরাকে বুঝিয়েও গিয়েছে তার মায়ের সাথে হাসি দিয়ে গল্প করতে। কাজের জন্য নয় তাদের বাড়িতে দু’জন কাজের লোক আর ছুটা বুয়াও আছে। এছাড়াও তার মা,নিশু আর সে-ও ঘরের কাজ করে। দরকার পড়লে আরও কাজের লোক রাখত।কিন্তু প্রয়োজন নেই বিধায় রাখে না। বুশরা চাইলে এই মুহূর্তে সুন্দর একটা মুহূর্ত পার করতে পারত তা না করে.. আর ভাবল না দ্যুতি। তবে মনের মধ্যে অনুচ্চারিত একটা ক্ষোভ জমে উঠল। হঠাৎ দ্যুতির দিকে চোখ পড়তেই বলল,”খাবারের সময় হয়ে গিয়েছে। সবাইকে ডাক তো!”
“অপারেশনের পেশেন্ট তুই,তোর উচিৎ বিশ্রাম নেওয়া।”
“এই তো নিবো,যা তুই।”
দ্যুতি মুখের অভিব্যক্তি সোজা করে নিঃশব্দে চলে গেল। সবাইকে খাবার খাওয়ার জন্য ডাকল। একে একে সবাই চেয়ার পেতে বসল। সবার পরে ধূসরের পিছু পিছু এলো বুশরা। সবাই তাকায় তাদের দিকে। নিশু-দ্যুতি চুপচাপই রইল। চেয়ারে বসল ওরা। নিশু ধীরস্থিরে সবার পাতে খাবার তুলে দিতে লাগল। দ্যুতি হেল্প করল প্রতিদিনের ন্যায়। দিলরুবা খাতুন আয়েশী ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। বেড়েগুড়ে খাওয়াতে ভীষণ পছন্দ করে নিশু। আর নিশু এই ব্যাপারে পাকাপোক্ত। কে কী খায়,কী পছন্দ সে সব জানে বিধায় খাবারের সময়টায় নিশুই বেশিরভাগ সার্ভ করে। বুশরার অভিব্যক্তি বুঝা গেল না। ধূসরের পাতে খাবার তুলে দিতে নিতেই সে নিজেই বাম হাত দিয়ে চামচ ঠেলে নিজের হাতে বেড়ে নিতে লাগল। চমকায় নিশু ধূসরের আচরণে। সে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে রাখল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই যার যার রুমে ফিরে গেল। মলিন মুখে দ্যুতিকে নিয়ে খেতে বসল নিশু।
“নিশু,কিছু বুঝেছিস?”
“কী?”
“অন্ধকে পথ চেনানোর আর কোনো দরকার নেই।”
“মানে?”
“পথ চিনলে তোকে আর তার প্রয়োজন হবে না।”
“এমন করে কথা বলছিস কেন হঠাৎ?”
নীরব রইল দ্যুতি।
“তুই কি রেগে আছিস?”
“যাকে তাকে পথ চিনিয়ে দিতে নেই,নিশু। পথ চেনা হয়ে গেলে সেই মানুষটাই সর্বপ্রথম তোর জন্য কাঁটা বিছিয়ে দিবে।”
“বকবক কম কর।”
খাবার শেষ করে টেবিল গুছিয়ে নিলো ওরা। ধ্রুব ডেকে বলল,”নিশু,কফি দিস তো!”
চুলায় কফির পানি বসাল নিশু। এই সময় কফি খায় ধূসরও। তার জন্য আরেক মগ পানি দিতে গিয়েও দোটানায় পড়ল। কফি দিবে কি দিবে না সেই দ্বিধাদ্বন্দে পড়ল।
“মেজ ভাইয়ার জন্য কফির পানি দিবো রে?”
“তোর এত টেনশন কেন,নিশু?”
বিব্রতবোধ করল সে।
“ওর এখন বউ আছে,সে করবে। তুই তোর স্বামীকে নিয়ে ভাব। তাকে কীভাবে খুশি করবি সেটা ভাব। আর কাজকর্ম কমিয়ে দে। নিজের শরীরের যত্ন নে। নিজের সুস্থতা সবার আগে। তুই বিছানায় পড়ে থাকলে কেউ তোকে সেবা করতে আসবে না। এই দুনিয়াটা এমনই,এখানে স্বার্থপরের আধিপত্য চলে বেশি।”
মলিন হয়ে গেল নিশুর মুখ। চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। নিশু পড়ল দোটানায়। এখন সে যদি শুধু তার স্বামীর জন্য করে তাহলে সবার চোখে পড়বে ব্যাপারটা। বলবে,নিশু এখন থেকেই হিসেবি হয়ে গিয়েছে,হিংসুটে হয়ে গিয়েছে,ভাগাভাগি করতে শিখেছে। সে এই পরিবারকে আপন ভাবে। তবে দ্যুতির কথাই হয়তো ঠিক। তার উচিৎ ধূসরের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য এবং বোন বা ভাবী হিসেবে আবেগ কমিয়ে দেওয়া। চোখের জল মুছে নিলো। দেখলেও না দেখার ভান করল দ্যুতি।
“কে কী বলল তা দেখার দরকার নেই তোর। তোর স্বামীর প্রতি যত্নশীল হ।”
ঠিক তখুনি কিচেনে এলো বুশরা। দ্যুতি দেখলেও না দেখার ভান করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখল। নিশু ফুটন্ত পানির দিকে তাকিয়ে রইল। নাক টেনে মগে পানি ঢেলে নিয়ে কফি বানাতে লাগল।
“কার জন্য বানাচ্ছিস?”
চমকে তাকায় নিশু।
“উনার জন্য।”
“আরেক মগ হবে,নিশু?”
“হুম।”
“তাহলে তুই বরং এই মগ আমাকে দে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নিশু। বুশরা মগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। তীর্যক চোখে তাকায় দ্যুতি।
“নিজেকে কবে থেকে মাদার তেরেসা ভাবতে শুরু করেছিস?”
মলিন মুখে তাকায় নিশু।
“ঢং কম করিস।”
নির্লিপ্তে নিশু আরেক মগ কফি বানিয়ে সিঁড়িতে পা বাড়িয়ে ধ্রুবর রুমের দিকে এগোল। বুশরা ধূসরের রুমে ঢুকল।
“আপনার কফি।”
“কে বানিয়েছে?”
হকচকায় বুশরা।
“ইয়ে.. মানে.. আমি।”
কফির মগ হাতে তুলে চুমুক দিতেই ধূসর বুঝল এটা নিশু বানিয়েছে। হাজারটা কফির মগ তার সামনে রাখলেও সে স্বাদ ট্রাই করে আলাদা করতে পারবে নিশুরটা। আচমকা মগ ছুঁড়তেই কফি ছিটকে বুশরার পায়ে পড়তেই জোর আর্তনাদ করে উঠল,”আহ!”
“মিথ্যা বললে কেন?”
ভীত নজরে তাকায় বুশরা।
“মিথ্যা বললে কেন?”
ধ্রুবর দরজায় নক করতে নিতেই দৃশ্যটা দেখতেই থমকে তাকিয়ে রইল নিশু।
মায়াকুমারী পর্ব ৬০
“তুমি না বানাতে পারলে আমাকে বলতে,তা না করে অন্যের হাতে বানানো কফি কেন নিয়ে এলে?”
বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় নিশু। ধূসর তাকে এখন থেকেই পর ভাবতে শুরু করেছে!
“কীরে দাঁড়িয়ে রইলি কেন?”
হকচকায় নিশু। ধ্রুব হাত ধরে নিশুকে টেনে নিলো রুমের ভেতর। কফির মগ নিয়ে বেড সাইড টেবিলের উপর রাখল।
“মনখারাপ কেন?”
“কই না তো!”
