মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ১২

মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ১২
ইশরাত জাহান

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে বইয়ের পাতায় মুখ লুকিয়েছে হিয়া।আজ রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছিলো।বই আর পড়া হয়নি। উহু কোনো একাডেমিক বই না তার প্রিয় গল্পের বই নিয়ে।চশমা চোখে দেওয়া মুখে হালকা হামি উঠছে।চেয়ারে বসে টেবিলের উপর এক হাত ভর করে থুতনিতে ঠেকিয়ে আরেক হাত বইয়ের পাতায় আবদ্ধ করে রাখলো হিয়া।ঠোঁটে মিষ্টি হাসির সাথে দুষ্টু মিষ্টি গল্পের কাহিনী।এই দৃশ্য দূর দরজায় দাড়িয়ে দেখছে রুদ্র।মনোমুগ্ধকর লাগছে তার কাছে এই শীতের সকালের দৃশ্য।করা শীত গায়ে চাদর জড়ানো হিয়াকে দেখতে রুদ্রর নিজের আলাদা ভালো লাগে।হিয়া সাজগোজ করে না।সবসময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বজায় রাখে।রুদ্র হিয়ার এই রূপে অভ্যস্ত।রুদ্র কল্পনা করতে থাকে সিয়া ও হিয়ার জন্মের সময়টি।যেদিন সিয়া ও হিয়া হয় সেদিন রুদ্র মিলিকে নিয়ে হসপিটালে অপারেশন রুমে পাশে খেলছে আর আনন্দ করছে। মিলি বলে,”আমাদের নতুন দুই বোন আসবে।খুব ভালোবাসবো আমরা তাকে।”

রুদ্র বলে,”হ্যাঁ।আমাদের আরো দুই খেলায় সাথী আসবে।”
রুদ্রর তখন নয় বছর বয়স আর মিলির দুই বছর।সবার উত্তেজনায় রুদ্র নিজেও উকি দিতে থাকে অপারেশন রুমের দিকে কিন্তু সে ব্যার্থ।কিছুই দেখতে পারে না।মুখ ফুলিয়ে ফিরে আসে সেখান থেকে। ছোট রুদ্র মুখ ফুলিয়ে বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে আছে ঠিক সেই সময় নার্স বের হয়। হাতে দুটো ছোট ছোট শিশু।একজন শিশুকে কোলে নিয়ে কানে আজান দিচ্ছেন মাহমুদ সরদার।শিশুটি চুপ করে বাবার আজান শুনছে।সেই শিশুটি ছিলো সিয়া।রুদ্র সিয়ার দিকে থাকে অতঃপর বিরক্ত হয়ে তাকায় হিয়ার দিকে।হিয়া মে মে করে কান্না করছে।যেনো সে এক হিংসুটে।মাহমুদ সরদার সিয়ার কানে আজান দিয়ে সিয়াকে মিসেস সোনালীর হাতে দিয়ে দেন।তারপর হিয়াকে কোলে নেন।হিয়ার কানে আজান দিলে হিয়া আজানের পর পরই খিল খিল করে হেসে দেয়।রুদ্র এখনও মুখ ফুলিয়ে দেখছে।মাহমুদ সরদার খেয়াল করে দেখে রুদ্রর কাছে আসেন।বলেন,”কি হয়েছে বাবা?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রাগী রাগী মুখ করে রুদ্র বলে,”তোমার মেয়েকে তো দেখতেই পারছি না।”
মাহমুদ সরদার হেসে হেসে রুদ্রর কোলে হিয়াকে দিতে যায়। আর বলে,”এই নেও আমার মেয়েকে দেখো।”
রুদ্র হিয়াকে কোলে নিয়ে হিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।বাবার কোল থেকে ছোট হিয়া অন্য কারোর কোলে গেছে।এবার সে নিজেই কান্না করতে থাকে।রুদ্র মুখ কালো করে ফেলে।বলে,”তোমার মেয়ে আমাকে ভালোবাসেনা।আমি কি পঁচা?”

মাহমুদ সরদার জোরে জোরে হেসে বলেন,”আমার বাবা অনেক ভালো।তুমি ওর সাথে খেলতে খেলতে ওর মন জয় করে নিও।দেখবে একদিন না একদিন ও তোমাকে ভালোবাসবে।”
রুদ্রর ছোট মনে কথাগুলো গেঁথে যায়।হিয়া ওকে একদিন না একদিন ভালোবাসবে।এটা যেনো বড় হওয়ার পরও রুদ্রর কাছে মুখস্ত বিদ্যা।রুদ্রর ভাবনার ছেদ ঘটে হিয়ার অট্টহাসিতে।হিয়া খুব জোরে জোরে হাসছে।রুদ্র শূন্য দৃষ্টির ছেদ ঘটিয়ে আবার হিয়ার দিকে তাকায়।হিয়া বইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।রুদ্র বুঝলো মজার কোনো এক জায়গা হিয়া এখন পড়ছে।
বই পড়ায় মগ্ন হিয়ার কানে ভেসে এলো,”কোনো নষ্ট পুরুষের প্রেম কাহিনী কি লেখা আছে তোর উপন্যাসের পাতায়?”

কথাটি রুদ্র বলে হিয়াকে।হিয়া থমকে যায় রুদ্রর কণ্ঠে।গত চারদিন ধরে রুদ্র তার আশেপাশে ঘোরে না।হিয়া আর তারেক কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছে তাই ভেবে রুদ্র দূরে সরে আছে।এমনটা ভেবে রেখেছিলো হিয়া।তাই কাল আর তারেকের সাথে দেখা করেনি হিয়া।তারেকের সাথে ঘুরতে হিয়ার ভালো লাগে না।কিন্তু রুদ্রের জন্য শো অফ করে হিয়া।আবার তারেক নিজেও এখন ফ্রেন্ডলি হয়ে গেছে।ভালো না লাগার সত্বেও কথা বলতে থাকে হিয়া।রুদ্রের কণ্ঠ শুনে হিয়া তাকায় রুদ্রের দিকে।কিছু না বলে গাঁয়ের চাদর আরেকটু উপরে উঠিয়ে বইয়ের দিকে আবার তাকায়।রুদ্র ডান হাতে থাকা চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে হিয়ার সামনে রাখে।বাম হাতের আঙুলের ভিতর দুটো মগের গোল অংশ একসাথে ঢোকানো।তার টুকটুক শব্দে হিয়া তাকায় রুদ্রের হাতের দিকে।রুদ্র হালকা হেসে বলে,”চায়ের নেশা কাটাতে চাই।”

হিয়া চশমা হালকাভাবে ঠিক করে বেল,”নারীর নেশা কেটে গেছে?”
“হিয়াপাখির নেশা জেগে উঠেছে।”
“মদ ও ভিন্ন নারীতে মেতে থাকা পুরুষদের মুখে এমন কথা মানায় না।”
“মদের বদলে চা,ভিন্ন নারীর বদলে আমার হিয়াপাখি কবে হবে আমার?”
“নির্লজ্জ ও নষ্ট পুরুষ মানুষ।”
“তোর প্রেমে মত্ত।”
ঠাট্টার হাসি দেয় হিয়া।রুদ্র দেখেও যেনো দেখেনি। কাপ দুইটি টেবিলে রেখে ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে হিয়ার সামনে এক কাপ দেয় রুদ্র।বলে,”নে তোর নেশা।”

হিয়া কাপ নিয়ে চায়ে চুমুক দেয়।রুদ্র নিজেও তার নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে।কিন্তু চোখ তার হিয়ার চায়ের কাপে আবদ্ধ।হিয়ার ঠোঁট চায়ের কাপে মিশে যেনো আলাদা আগুন জ্বলে উঠতে থাকে রুদ্রর বক্ষে।রুদ্র হিয়ার দিকে চোখ রেখেই বলে,”আমরা মানুষ কি অদ্ভুত তাই না হিয়াপাখি?”
হিয়া বুঝলো না এখানে এখন এই কথার মানে কি।তাই ভ্রু কুচকে তাকালো রুদ্রের দিকে।রুদ্র বলে,”আমরা যাকে একবার মন দেই তার সাথে কোনো কিছুর ঘর্ষণটাও যেনো সহ্য করতে পারি না।হোক এটা কোনো বস্তু বা কোনো ব্যাক্তি।হিংসেগুলো মনের মধ্যে নিজের থেকেই আবিষ্কার করে।এই যেমন এখন তোর চায়ের কাপ আমাকে হিংসায় পুড়িয়ে দিচ্ছে।”

রুদ্রর কথা মন দিয়ে শুনতে থাকে সাথে করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে হিয়া।রুদ্রর শেষ বাক্য শ্রবণ হতেই বিষম খেলো হিয়া।কটমট চশমা চোখে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি এত লুচু কেনো?”
ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে রুদ্র বলে,”তোর মাইন্ড লুচু তাই।তুই কি ভেবেছিস!আমি তোকে চুমু খাবো?বোকা মেয়ে।”
“তাহলে চায়ের কাপকে হিংসা করার মানে কি?”
“চায়ের কাপে হিংসে করেছি মানে আমি তোকে চুমু খাবো?”

কোনো উত্তর না দিয়ে হিয়া ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে রুদ্রর দিকে।এই লুচু লোকটি তাকে কি বলতে চাইছে।রুদ্র হিয়ার কাপে তাকালো।এখনও অর্ধেক চা আছে ওটাতে।হিয়ার হাত থেকে চা নিয়ে নিজে চুমুক দিলো।হিয়া তাকিয়ে আছে সেদিকে।রুদ্র প্রায়ই এমন করে।হিয়া চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার পরপরই রুদ্র কাপ নিয়ে নিজেও চুমুক দেয়।
এক ডোকে সম্পূর্ণ চা শেষ করে রুদ্র।হিয়া তাকিয়ে থাকে সেদিকে।বলে,”এটা চা ছিলো আপনার মদ না।”
“আমার জন্য চাও যা মদও তাই।মদ ভুলিয়ে দেয় যন্ত্রণা,কল্পনায় ভেসে আনে তোকে আর চা থাকা মানে তো আস্ত তোর সাথেই একটি সময় কাটানো।”

“আপনার এই শক্ত শক্ত কথা আমার বুঝে আসে না।”
“আস্ত আমিটাকেই তো তুই বুঝিস না।”
বলেই কাপ ও ফ্লাক্স টেবিলে রেখেই উঠে যায় রুদ্র।গেট দিয়ে বেড় হতে হতে বলে,”চায়ের কাপে কখনও আমি নিজের ঠোট কল্পনা করি না।রুদ্র কারো জায়গা দখল করে না।বরং নিজের জায়গা করে নেয়।আমি নিজের জায়গা করতে আস্ত চায়ের কাপটাকেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিবো।”
হিয়া রুদ্রর কথাগুলো শুনলো।রুদ্র চলে যাওয়ার পর নিজের অজান্তেই দুই হাতে দুইটি চায়ের কাপ নিলো।তারপর কাপদুটি একত্র করে মিষ্টি এক হাসি দেয়।নিজের মনে আওড়ায়,”বাস্তবে মিলন না হোক।আমার কল্পনায় আপনার সাথে মিলন তো হয়েই গেছে।”

সূর্যের আলো বড় খোলা কাচের জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে।শীতের মধ্যেও সূর্যের আলো আলাদা গরম উষ্ণতা উপহার দিতে থাকে।এই গরম উত্তাপে ঘুম ভেংগে যায় মায়ার।চোখ পিটপিট করে তাকায় মায়া।চোখ খুলেই যেনো অবাক হয়ে যায় সে। বেডের পাশেই মুখে হাত রেখে বসে আছে ব্ল্যাক ড্রেস পড়া রাজ।মায়া তাড়াতাড়ি উঠে বলে,”হাউ ডেয়ার ইউ?”
“মন্ত্রীকে ডেয়ার দেখাচ্ছো,মায়াবতী?”
রক্ত চক্ষু নিয়ে মায়া বলে,”আমার পারমিশন ছাড়া আমার রুমে কেনো ঢুকেছেন?”
রাজ ফিচেল হেসে বলে,”বিনা পারমিশনে আমার হৃদয়ে কেনো ঢুকেছ?”
দাত কটমট করে মায়া বলে,”আপনার ওই হৃদয়ে তালা মেরে রাখুন,মন্ত্রী মশাই।তাহলে আর কেউ ঢুকতে পারবে না।”

“তোমার মত চোরেরা ঠিকই পারবে।”বলেই মায়ার দিকে ঝুঁকে মায়ারমুখে ফু দিয়ে কপালের চুলগুলো উড়িয়ে দেয়।মায়া রাজের কলার চেপে ধরে।রাজ তাকায় তার দুই পাশের কলারের দিকে।বলে,”এমনি তোমার ঘুমন্ত মুখের নেশালো দৃশ্য দেখে আমি শেষ।এভাবে কলার টেনে কাছে টানলে তো মরেই যাবো।”
“তো যান মরে।”

“এভাবে বলে না,মায়াবতী। সত্যি সত্যি মরে যাবো।তবে আমি মরে যাওয়ার আগে তোমাকে আমার করেই যাবো।”
হালকা দুর্বল হয়ে এসেছে মায়ার হাত।কিন্তু রাজের কলার এখনও ধরে আছে।চোখ জ্বলতে থাকে তার।রাজের কথাগুলো দুর্বল করেছে মায়াকে।মায়া ঘোরে চলে গেলো।শক্ত সাহসী মায়ার চোখের কোনায় পানির বিন্দু জমেছে।রাজ উপলব্ধি করলো মায়ার দুর্বলতা।যখন মায়া শক্ত করে রাজের কলার ধরেছিলো রাজের গলার দিকে টান অনুভব করে।মায়া দুর্বল হওয়ার পর এই টান অনুভব হয় না রাজের।খোঁচা খোঁচা দাড়ির মাঝে কালো ঠোঁট জোড়া হাসতে থাকে।সিগারেট খায় রাজ।ঠোঁট তার আস্ত এক প্রমাণ।মায়া তাকিয়ে আছে সেই দিকে।

চোখের পানি বিন্দু হয়ে আটকে আছে।এখনও গড়িয়ে পড়েনি চোখ থেকে।মায়া বের করতে চায় না এই পানি।শক্ত রাখতে চায় মনকে।কিন্তু পারছে না সে।রাগ হচ্ছে মায়ার খুব।মায়া তো চায় না দুর্বল হতে।এই দুর্বলতার জন্য যে তার হৃদয়হরণ হওয়ার ভয় কাজ করে।মাথায় কাজ করা বন্ধ করে দেয়।মায়ার এই শক্ত মন গড়ার প্রচেষ্টার ভিতরেই রাজ মায়াকে আরো দুর্বল করে দেয়।মায়ার ললাটে এক চুম্বন একে দেয় রাজ।সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে নেয় মায়া।চোখের পানি এবার অনিচ্ছায় গড়িয়ে পড়ে মায়ার চোখ থেকে।রাজের ঠোঁটের দূরত্ব অনুভব করতেই মায়া চোখ খুলে।সাথে সাথে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে দেয় রাজকে।বালিশের পাশে থাকা গুলি হাতে নিয়ে তাক করে রাজের দিকে।বলে,”আমি আপনার মায়াবতী না,মন্ত্রী মশাই।আমি এক হৃদয়হীনা কন্যা।নিজেকে দাউ দাউ করে পুড়িয়েছি আমি।আপনাকে পোড়াতে চাই না।তাই দূরে সরে যান আমার থেকে।”

মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ১১

ঠোঁটের কোণায় বাকা হাসি রেখে রাজ ঘাড় কাত করে তাকায় মায়ার দিকে।নিজের ঠোটে নিজেই স্লাইট করে রাজ বলে,”পূরন্ত মায়াবতীর জখমে মলম লাগানোর কেউ ছিলো না।এখন এসে গেছে।মেনে নেওয়া না নেওয়া তোমার ব্যাপার।তোমার এই জখম যেমন আমি সারিয়ে দিবো,তোমার হৃদয়ে আমার স্থান আমিই গড়ে তুলবো।”
মায়া হাতে থাকা বন্দুক নামিয়ে বলে,”চলে যান মন্ত্রী মশাই।একা থাকতে চাই আমি।”
রাজ কথা বাড়ায় না।একা থাকতে দেয় মায়াকে।যেতে যেতে বলে,”ব্রেকফাস্ট টাইম হয়ে এসেছে।তাড়াতাড়ি চলে এসো।না খেয়ে অপেক্ষা করব আমি।”

মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ১৩