মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ১৬

মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ১৬
ইশরাত জাহান

সবাই মিলে পোড়ানো মাছ খেয়ে নেয় তারপর ঘুমানোর প্রিপারেশন করবে। কাল শেষ দিন চট্টগ্রামে।পরের দিনই চলে যাবে ঢাকা।যে যে যার যার তাবুর দিকে চলে যায়।মায়া তাবুর চেইন খুলতেই ওখানে কিছু একটা নড়ে ওঠে।রাজ মায়ার পিছনেই দাড়িয়ে আছে।মায়া পকেট থেকে ফোন বের করে লাইট জ্বালিয়ে তাবুর দিকে তাকায়। পিয়াশ উকি দিয়ে দেখতে থাকে।মৌ পিয়াশের উকি দেওয়া দেখে বলে,”এভাবে উকি দিয়ে কি দেখছো?”
পিয়াশ মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”বসের প্রেম দেখবো। ব্যাটা সবসময় বলে,বাচ্চারা চোখ বন্ধ করো।তোমাদের মন্ত্রী মশাই এখন প্রেম করবে।এখন তার অগোচরে প্রেম দেখতে চাই।”

মৌ হা হয়ে যায়।তারপর বলে,”কি করেছো তুমি?”
“তাবুতে তেলাপোকা ছেড়েছি।এখনই ম্যাম ভয়তে চিল্লিয়ে বসকে আলিঙ্গন করবে।ঘন জঙ্গলে চাঁদকে সাক্ষী রেখে আমার মতো লুকায়ীত পিএ এর সামনে বস আর ম্যামের প্রেম চলবে।”
মৌ ভ্রু কুচকে বলে,”পাগল টাগল হয়েছো কি?”
“ওটা তোমাকে বিয়ে করার পর পরই হয়েছি।সুযোগ পেলে বসকে বলবো যাতে সেও কোনোদিন বিয়ে না করে।”
“মানে?”(চোখ রাঙিয়ে মৌ বলে)
পিয়াশ ঢোক গিলে বলে,”আরে তোমার প্রেমে পাগল হয়েছি।উল্টোপাল্টা ভাববে না।আচ্ছা ম্যাম এখনও চিল্লাচ্ছে না কেন?চট্টগ্রামের তেলাপোকা কি দুর্বল?”
মৌ হাসতে থাকে।বলে,”মায়া আপুর মত মেয়েকে পেলে তেলাপোকার ভয় দেখাতে।দুনিয়াতে কি ভীতু মেয়ের অভাব ছিলো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পিয়াশ মৌকে আর কিছু বলতে যাবে তার আগে দেখতে পেলো মায়া তাবু থেকে তিনটি তেলাপোকা বের করে একটি ঠোঙায় রেখে জ্বলন্ত আগুনের ভিতর দিয়ে দেয়। পিয়াশ এটা দেখে বলে,”শুনেছি মেয়েরা রণচণ্ডি হলেও তেলাপোকার কাছে নেতিয়ে যায়।এ তো তেলাপোকা কেন হাতি আসলেও তাকে হারিয়ে দিবে।”
মৌ জোরে জোরে হেসে দেয়।মায়া ও রাজ মৌয়ের হাসি শুনতে পেয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে।মায়া রাজ ওদের দিকে তাকাতেই ওরা বের হয়ে আসে।মৌ হাসতে হাসতেই বলে,”তোমার আর রাজ ভাইয়ার রোমান্স দেখতে ও এখানে তেলাপোকা রেখেছে।”

মায়া চুপ করে তাকিয়ে থাকে পিয়াশের দিকে।রাজ আলতো হেসে বলে,”পিয়ু বেবী!বসের সেটিং করিয়ে দিচ্ছ বুঝি?”
হালকা ঢোক গিলে পিয়াশ বলে,”ওই আর কি।”
“শুনো পিয়ু বেবী!আমার মায়াবতী হলো আস্ত এক রক্তবতী।রক্ত নিয়ে খেলা তার নেশা।তাই বসের মায়াবতীর সাথে তার রোমান্স এর ব্যাবস্থা একটু ডিফারেন্ট ভাবেই করবে।”
“ওকে বস।”
মায়া সবাইকে বলে,”গুড নাইট।”
বলেই তাবুতে যেয়ে ঘুমিয়ে যায়।রাজ তার তাবুর দিকে যেতে যেতে পিয়াশকে ক্রস করার সময় পিয়াশের মাথায় টোকা দিয়ে বলে,”মাই ইনোসেন্ট পিয়ু বেবী।”
সকাল বেলা,

হিয়া এখন অনেকটাই সুস্থ।ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে ডায়নিং টেবিলে এসে বসেছে।মাহমুদ সরদার হিয়াকে দেখে বলেন,”তোমার তো খুব জ্বর মা।উঠতে গেলে কেনো?”
হিয়া মিষ্টি হেসে বলে,”আমার জ্বর এখন নরমাল বাবা।”
“তোমার তো পরশু থেকে পরীক্ষা।প্রিপারেশন কেমন?নাকি দুর্বল বোধ করছো?যদি এমন হয় এবার আর এক্সাম দিতে হবে না।”
“আমি এক্সাম দিবো বাবা।আমি কি সিয়ার মত নাকি যে এখন ডাক্তার হবো বলে ভালো রেজাল্ট করতে হবে।আমি তো নরমাল পাশ করলেই হ্যাপি।”

হিয়ার কথায় সবাই হেসে দেয়।সবাই জানে হিয়া পড়াশোনাতে পিছিয়ে।কিন্তু কোনো ক্লাস গ্যাপ দিবে না।সবার হাসির মাঝে সেখানে উপস্থিত হয় রুদ্র।অন্যদিক থেকে আসে মিলি ও জারা।রুদ্রকে চেয়ার টেনে বসতে দেখে হিয়া একবার রুদ্রের দিকে তাকায়।কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে হিয়া খাওয়া দাওয়ায় মন দেয়। জারাকে দেখে সিয়া বলে,”তুমি কখন এসেছ, জারা আপু?তোমার তো কালকে আসার কথা ছিলো।”
জারা একটু বিদেশি কণ্ঠ নিয়ে বলে,”রাতেই চলে এসেছি। কাল তো আমার রাজ বেইবী আসবে।তাই আমিও চলে এসেছি।”
রুদ্র বলে ওঠে,”তোর রাজ বেইবী কি বলেছিলো তোকে আসতে?”
জারা অপমানবোধ করে।সোনালী এসে বলে,”আহ রুদ্র!এভাবে বলো না। জারা অনেক ভালোবাসে আমাদের রাজ কে।”

“ব্রো ভালোবাসে কি না এটা একবারও শুনেছ?নিজেদের থেকেই তো উৎসাহ বাড়িয়ে দিচ্ছো।”
মালিনী রুদ্রের দিকে এগিয়ে এসে বলে,”ও আর কি বলবে?ও তো ওর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।এই যে গেলো ঘুরতে আমাদের ফোন তো একবারও ধরেই না।এত ব্যাস্ত তার।তাকে তো এখন বিয়ে করতে হবে।আমি ভাবছি মন্ত্রীর সাথে একজন স্মার্ট মেয়ে না হলে হয়না।আমাদের জারা অনেক স্মার্ট।ওর সাথে রাজকে খুব মানাবে।”
রাজ ব্রেডে বাটার মাখাতে মাখাতে বলে,”ওটাকে স্মার্ট বলে না।ওটাকে বলে গায়ে ঢলে পড়া স্বভাব।”
সোনালী এবার রুদ্রকে চেঁচিয়ে বলে,”রুদ্র!তুমি কিন্তু জারাকে অপমান করছো।”
“অপমানের কিছুই না।এখন এইটুকু সহ্য করতে পারছ না। আর যখন সারসরি জারার হার্টব্রেক হবে তখন সহ্য করতে পারবে তো?”

সোনালী একটু থমকে যায়।উনি এতটুকু জানে রাজ গায়ে ঢলে পড়া মেয়েদের পছন্দ করে না।বিদেশে থাকতেও রুদ্রকে বারে যেতে শুনলেও রাজ কখনও যায়নি।মালিনী রাজের খোঁজ নিলে জানতে পারতো রাজ বাসায় বই পড়ছে বা ল্যাপটপে কোনো শিক্ষণীয় ভিডিও দেখছে।
সোনালীর ভাবনার মাঝেই মালিনী এসে সোনালীর কাধে হাত রেখে বলে,”জারা বিদেশে পড়াশোনা করেছে।এগুলো নরমাল ব্যাপার। জারা তো আর সব ছেলেদের সাথে কথা বলে না।ও শুধু রাজের জন্য পাগলামি করে।আমরা শিখিয়ে দিবো রাজের মন জয় কিভাবে করতে হয়।”

মালিনীর কথা শুনে সোনালী শান্তি পায়।মনে মনে শয়তানি বুদ্ধি করে ফেলে।সোনালীর উদ্দেশ্য রাজের থেকে এই বাড়ি নেওয়া।তাই তো জারাকে এই বাড়িতে রেখেছে।রাজ থাকবে তার বাংলোতে।রাজের সবকিছু তো আর তার চাই না।এই পুরো বাড়িটা নিজের করে স্বামী সন্তান নিয়ে থাকবে। জারা আর রাজ নাহয় বাংলোতে।এনার এই গেদারিং ভালো লাগে না। আর তার থেকেও বড় কথা এই পরিবারের লোকজনের চলাচল তার থেকে বিপরীতে।সোনালী জারার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দেয়।যা দেখে জারা নিজেও এক ভ্রু উচু করে মিস্কি হাসি দেয়।শাশুড়ি তো রাজি। আর কি লাগে তার?

রুদ্র দুজনের দিকে তাকিয়েই আলতো হাসি দিতে থাকে।মাহমুদ সরদারকে বলে,”বুঝলে বড় বাবা!”
মাহমুদ সরদার খাওয়া থামিয়ে তাকায় রুদ্রের দিকে।রুদ্র বলে,”জীবনে অনেক কিছু দেখার আছে।এখনই যেনো হাঁফিয়ে যেও না।পিকচার আভি বাকি হে।”
মাহমুদ সরদার মজা করে বলেন,”কিছু পপকর্ন এর ব্যাবস্থা করে দিও।দেখবো আর খাবো।”
বাচ্চারা সবাই মিলে হেসে দেয়।পরিবারের সাথে থাকার কারণে হিয়ার এখন আর ভয় লাগছে না।কিন্তু মনে মনে বলে,”আমি আপনার মুখোশ খুলে দিবো রুদ্র ভাই।”

এদিকে,
মায়া ও রাজ চলে আসে রিসোর্টে।সন্ধায় মায়া ও রাজের দাওয়াত আছে।মিডিয়াতে পাবলিক হওয়ার পর থেকে সবাই দেখা করার জন্য অনেক রিকোয়েস্ট করছে।তাই রাজ সকালেই হাজির হয় রিসোর্টে।সকাল সকাল মিডিয়ার লোকদের কিছু উত্তর দিয়ে রাতের দাওয়াত খেতে যাবে।দাওয়াত এসেছে মায়ার আশ্রম থেকে।মায়ার আশ্রমের কর্মী যখন জানতে পারে মায়া এবার মন্ত্রীর সাথে টুরে এসেছে তখনই সবাই মিলে তোলপাড় শুরু করেছে।
রিসোর্টের সামনে চার পাঁচটি গাড়ি শো শো করে এসে ধূলাবালির মিশ্রণ তৈরি করে।গাড়ির আগমন দেখেই মিডিয়ার লোক মাইক ক্যামেরা নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে যায়।তাই সমস্ত ধুলাবালি তাদের দিকেই এগিয়ে আসে।দূর থেকে তাদের এই অবস্থা দেখে হেসে দেয় কিছু ক্ষুদ্র জনগণ।তাদের মুখ থেকে বের হয়,”টাকার জন্য মানুষ উচ্চ শিক্ষা অর্জন করলেও সহ্য করতে হয় অনেক কিছুই।”

গাড়ি থেকে বের হয় সুট বুট পরা রাজ।রাজের ওপর প্রান্ত থেকে জানালা খুলে বের হয় মায়া।মায়ার পরনে গাঢ় নীল রঙের গাউন।গাড়ি থেকে বের হয়ে চোখের সানগ্লাস খুলে সবার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে মায়া।মুখে ঝুলিয়ে ওঠে মিষ্টি হাসি।
এইসব কিছুই লাইভ ভিডিও চলছিলো।সরদার পরিবার ঢাকা থেকেই লাইভ দেখছে।রাজের গাড়িতে এতবড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মেয়েকে তাও এত সকাল সকাল দেখে অবাক হয় জারা ও মালিনী সোনালী।রুদ্র ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে দেয়।হিয়া সিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”নতুন ভাবীর আগমন শুভেচ্ছায় স্বাগতম।”
আস্তে করেই বলে কথাগুলো।রুদ্রের পাশে মিলি আর তার পিছনে সিয়া ও হিয়া।মিলি চোখ ছোট ছোট করে বলে,”কিসের ভাবী?ভাবী তো আমাদের সাথে বাসায়ই আছে।”

“তোর ঘটে বুদ্ধি থাকলে তো হতই।দেখতে থাক কি হয়।”
মিলি মুখ ভেংচি কেটে মনোযোগ দেয় লাইভ দেখতে।মাহমুদ সরদার টিভির সাউন্ড বাড়িয়ে দেন।
মায়া ও রাজকে একসাথে বের হতে দেখে মিডিয়ার লোক ধুলাবালি গেলার পরও তাদের কাছে যায়।কিছুক্ষণ সাক্ষাৎ করে একজন সাংবাদিক বলে,”আপনাদের এই সাপ্তাহিক ভ্রমণে তাও একসাথে এটা লোকজন জানাজানি হওয়ার পর অনেকে অনেককিছুই ভাবছে।আপনাদের কি আদৌ এমন কোনো সম্পর্ক আছে?”
রাজ সানগ্লাস পড়া ছিলো।যেই সাংবাদিক এমন কথা বলে রাজ তার দিকে তাকিয়ে বলে,”এটা আমি এখন বলতে চাই না।তবে যদি এমন কিছু থেকে থাকে তাহলে আপনারা খোঁজ পেয়ে যাবেন।”

রাজের উত্তরে হ্যাঁ বা না কোনোটিই প্রকাশ পায় না।আরেকজন সাংবাদিক বলে,”আপনাদের পরিচয় কিভাবে হয়?”
“একই শহরের একই গন্তব্যের দুই বাসিন্দা আমরা।আমাদের কি আলাদা পরিচয় দরকার?”
সাংবাদিক হেসে দেয়।রাজের ইনডাইরেক্ট উত্তরগুলো তারা আগে থেকেই আশা করে রেখেছিলো।কোনো ব্যাক্তি তার জীবন নিয়ে সরাসরি কনভারসেশন করে না।কিন্তু তাদের কোম্পানি তাদের এসব প্রমোট করতেই তো পাঠিয়ে দেয়।তাই বাধ্য হয়ে টাকার চেহারা দেখে আসল নিউজ বাদ দিয়ে এদের কীর্তি কলাপ শুনতে এসেছে।একজন মেয়ে সাংবাদিক মায়ার দিকে মাইক নিয়ে বলে,”আপনার জীবনে সফলতার এই জার্নি আমাদের একটু শেয়ার করুন ম্যাম।”

মায়া মিষ্টি হেসে বলে,”আমি যদি এখন আপনাকে প্রশ্ন করি আপনি কিভাবে এই মিডিয়াতে সফলতা পেয়েছেন।বলতে পারবেন ফুল ডিটেইলস?”
সাংবাদিক থতমত খেয়ে যায়।এদের কাজ হলো অন্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা।তাদের বিষয় কেউ করে না।তারপরও বলে,”হায়ার স্টাডি করে ইন্টারভিউ দিয়ে কিছু ট্রেইনিং এভাবেই।”
মায়া এবার নিজের দিকে মাইক নিয়ে বলে,”প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে সফলতার শুরু হয় বিদ্যার সূত্র দিয়ে।যতটা বিদ্যা অর্জন করবে ততটা সফলতা পাবে।আপনি যেমন একটা সাবজেক্ট নিয়ে স্টাডি করে এই পজিশনে,আমিও তেমন আমার স্টাডি কমপ্লিট করে এই পজিশনে।”

কেউ কথা বাড়ায় না।মায়া কাউকে বলতে চায় না এই সফলতা তাদের পারিবারিক ব্যাবসা মানে নানাভাই এর ফ্যাক্টরি থেকে শুরু।বললে আস্তে আস্তে সব প্রকাশ পাবে।এতে তার উদ্দেশ্য কখনও সফল হবে না।সে তো এই পজিশনে এসেছে সারদার বাড়িকে বরবাদ করতে।
জারা মায়াকে আজ প্রথম দেখলো।তাই সে প্রশ্ন করে,”রাজ বেইবীর সাথে এই মেয়েটি কে?
রুদ্র সোফায় হেলান দিয়ে বলে,”তোর সতিন।”

মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ১৫

জারা রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে থেকে বলে,”কখনও হবে না।”
“তুই না চাইলে ব্রোকে ছেড়ে দিতে পারিস।যদিও তুই আর বেশিদিন নেই।”
সোনালী জারার পাশে বসে জারার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”শাট আপ রুদ্র।রাজ এন্ড জারা একটা বেস্ট জুটি।এখানে অন্য কেউ আসবে না।”
রুদ্র হামি দিতে দিতে হেয়ালি করে বলে,”দেখা যাক।”

মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ১৭