মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ১৯
ইশরাত জাহান
“নিজেকে কি ভাবেন আপনি?একটা খেলায় জিতেছেন শুধু।কিন্তু আপনাকে চিরতরে হারিয়ে দিবো এই আমি।”
রাজ মায়ার দুই কাঁধ ধরে মায়াকে উল্টো ঘুরিয়ে দেওয়ালে চেপে ধরে বলে,”হারতেই তো চাই মায়াবতী।তোমার মায়ায় হেরে গেছি আমি।এর থেকে আর কোনো হার আছে কি এই জগতে?”
মায়া তাকিয়ে থাকে রাজের চোখের দিকে।বলে,”এভাবে আমাকে আপনার দিকে আকর্ষিত করতে চাইবেন না।আপনার জারা বেইবী আছে আপনার জীবনে।”
“আমার জারা বেইবী তো আর আমার মায়াবতী না।”
“শাট আপ।আমাকে আপনার ওই হেংলা জারা বেইবী ভাববেন না।”
“পাগল নাকি!আমার জারা বেইবী ওয়ান পিস।সে তো খালি চেষ্টা করতে থাকে আমার সান্নিধ্য পাওয়ার।কিন্তু আমার মায়াবতী হলো মাইনাস ওয়ান পিস।যাকে পুরো পৃথিবী জুড়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। যার সান্নিধ্য পেতে ছুটতে থাকে এই মন্ত্রী মশাই।”
“আপনার এই আবেগকে ক্ষত বিক্ষত করে দিবো আমি মন্ত্রী মশাই।”
রাজ মায়ার মুখের উপর তার বুড়ো আংগুল দিয়ে স্লাইট করতে করতে বলে,”আমার ক্ষতে মলম দিয়ে সরিয়ে তুলবে আমার জারা বেইবী। আর তারপর আবারও তোমার কাছে ক্ষত নিতে আসবো আমি।”
বলেই রাজ হো হো করে হেসে দেয়।মায়া রাজের সাথে কথা বাড়াতে চায় না।তাই সেখান থেকে আশ্রমের ভিতরে যেতে নেয়।পিছন থেকে রাজ বলে,”আব্বে এই মায়াবতী।”
মায়া দাড়িয়ে পড়ে।পিছনে তাকিয়ে দেখে ঘাড় কাত করে রাজ তার দিকেই তাকিয়ে আছে।মায়ার তাকানোর পরপরই রাজ তার হাতের দুই আঙ্গুল দিয়ে ঠোটের কাছে স্পর্শ করে মায়াকে একটি ফ্লাইং কিস দেখিয়ে দেয়।মায়া দেখে কিছু না বলে উল্টো ফিরে চলে আসে।রাজ সেখানে দাড়িয়ে বিড়বিড় করে,”এই জীবনে দুই নারী আসলো।একজন পুরো বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়েই নাটক করে আমার জারা বেইবী।আরেকজন দূরত্বের নাটক দেখায় আমার মায়াবতী।”
অবশেষে বাচ্চাদের সাথে খাবার খেয়ে বিদায় নিলো সবাই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সরদার বাড়িতে,
রাতের খাবার খাওয়া শেষ করে রুমে এসে নাইট ড্রেস পরে ঘুমের প্রিপারেশন নিতে থাকে সোনালী।বয়স বাড়লেও শরীরে তার নেই কোনো বয়সের ছাপ।কিভাবে থাকবে?এই যে এত মেইনটেইন করে চলে।আবার অনেক হাই লেভেলের ড্রিংক করেছে জীবনে। তাই তো রূপ যৌবন এখনও টিকে আছে তার। হ্যাঁ আগের থেকে একটু ডেমেজ এসেছে।মুখের লাবণ্য কমে গেছে।কিন্তু তাকে দেখলে বোঝাই যাবে না যে সে এত বড় দুই সন্তানের মা।মোহন সরদার ঘরে এসে স্ত্রীকে আয়নার সামনে দাড়িয়ে এমন লুকসে দেখে একটু রসিকতা শুরু করেন।সোনালীর কাছে এসে তাকে পিছন থেকে আলিঙ্গন করে বলে,”আমার মিষ্টি বউ।”
সোনালী পিছনে ঘুরে মোহন সরদারকে বিছানায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন।মোহন সরদার চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েন বিছানায়।সোনালী দূরে আয়নার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।মোহন সরদারের দিকে তাকিয়ে বলে,”রক্ষিতাদের সাথে প্রেমলীলা শেষ হয়ে গেছে বুঝি?”
মোহন সরদার উঠে বসে বলেন,”আরে কি বলো এসব?আমার জন্য তো তুমি আছো।”
“কি মনে করো তুমি?তোমার কুকর্ম আমি জানি না।তোমার পিএর সাথে যে সম্পর্ক ওগুলো আমি খুব ভালো করেই জানি।”
“জানোই যখন তখন এত বলার কি আছে।তুমিও তো এক সময় আমার পিএ ছিলে এখন ঘরের বউ।ওরা তো আর বউ হতে পারবে না।”
“হ্যাঁ,সেই তোমাকে বিয়ে করে হয়েছি এক পুতুল।কোন দুঃখে যে তোমার মত এক বিবাহিত পুরুষকে বিয়ে করতে গেলাম?”
মোহন সরদার ভ্রু কুচকে বলেন,”কিসের কমতি আছে তোমার?সবকিছুই তো হাতের নাগালে।”
সোনালী এবার ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,”কি পেয়েছি আমি?এই রান্নাবান্না কাজ কর্ম।বাচ্চা হওয়ার পর তো খালি ওদেরকে সেবা করলাম।আগে কি সুন্দর বারে যেতাম পার্টি করতাম।ফ্রেন্ডের সাথে চিল মুডে ছিলাম এখন কোথায় সেই ফ্রীডম?”
মোহন সরদার সোনালীর কাছে এসে শান্তনা দিয়ে বলেন,”আচ্ছা শান্ত হও।তুমি চাইলে এখনও পার্টি করতে পারো।”
“এই বাড়িতে সেই সুযোগ আছে নাকি?তোমার বড় ভাই আর তার সন্তান তো রাজ করছে এই রাজত্বে।নাম যেমন দিয়ে রেখেছে রাজ তেমন করছেও কাজ।একটুও শান্তি পাচ্ছি না আমি।”
“এই বাড়িটি শুধু ভাইয়ের একার নয়।এটা আমারও বাসা।তুমি তোমার নিজ স্বাধীনতায় থাকবে।তোমার মন চাইলে তুমি পার্টি করবে না চাইলে না।বাধা দিলে আমি দেখে নিবো।”
“সত্যি বলছো?”
“হ্যাঁ।এবার একটু হাসো।”
সাথে সাথে সোনালী হেসে দিয়ে জড়িয়ে ধরেন মোহন সরদারকে।তার উদ্দেশ্য এই বাড়িতে পার্টি রাখার। আর এই পার্টি করতে পারলে সে বাড়িতে কিছু ধামাকা করতে পারবে। যার মাধ্যমে জারা রাজ এক হতে পারবে।
সকাল বেলা,
মায়া ব্যাগ প্যাক করতে থাকে।একটু পর তাদের ফ্লাইট। মায়া তার সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে ব্যাগে ভরছে।ঠিক তখনই রুমে প্রবেশ করে রাজ।রাজ এসে মায়ার রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা হেলে দাড়িয়ে বলে,”আর ইউ রেডী,মায়াবতী?”
“কিছু সময় লাগবে।প্রায় হয়ে এসেছে।”
বলেই ভালো করে সবকিছু খেয়াল করে মায়া।রাজ মায়ার সামনে এসে বলে,”সবকিছু তো মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করছো।আমাকে খেয়াল করে নিবে না?”
“আপনি তো পিছন পিছন এমনিতেই চলে আসবেন।আপনাকে আর কি নিবো?”
“একবার একটু তোমার এই রক্তমাখা হৃদয়ে আমার নাম গেঁথে দেও মায়াবতী।সত্যি বলছি পিছন থেকে না একদম হৃদয়ে লেপ্টে থাকবো।”
“শুরু হয়ে গেছে?”
“শেষ করতে চাও এত তাড়াতাড়ি?”
“শাট আপ অ্যান্ড লেট মী প্যাক।”
“কেন আই হেল্প ইউ?”
“নো নীড।”
“কিন্তু আমি তো সাহায্য করবো।”
“বিরক্ত করছেন কেনো?”
“বিরক্ত হচ্ছো কেনো?”
মায়া এবার ভ্রু কুচকে তাকালো রাজের দিকে।সাথে সাথে রাজ মায়াকে ফ্লাইং কিস দেখিয়ে দিলো।মায়া রাজের কলার চেপে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয়।মায়া বিছানায় কোনায় দাড়িয়ে রাজের কলার চেপে আছে।ভয়ংকর দৃষ্টি দিয়ে মায়া বলে,”আমাকে আপনার জারা পেয়েছেন নাকি।আমি মায়া।এটা ভুলে যাবেন না।”
রাজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে দেয়।মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,”জারা বেইবী আর মায়াবতী এই দুজনের মধ্যে যদি কমপেয়ার করা হয় তাহলে বলতে হয় তুমি ফার্স্ট মায়াবতী।আমার জারা বেইবী তো কখনও আমার এতটা কাছে আসেনা যতটা তুমি আসো।”
মায়া পাশে থাকা ছোট টেবিলে তাকায়।সেকশনে একটি ঝুড়িতে কিছু ফল আর ফল কাটা ছুরি আছে। ছুরিটি নিয়ে রাজের গলায় তাক করে বলে,”শুধু একবার চালাবো এই ছুরি আপনার গলার উপর দিয়ে।সাথে সাথে গলার সমস্ত শিরা উপশিরা থেকে টগবক করবে রক্তের বন্যা।”
রাজ তার দুই হাত উচু করে আয়েশে মাথার পিছনে রেখে বলে,”নেও।আমি আরাম করে শুয়ে আছি।আজ আমার ভালোবাসার জন্যই না হয় হবে মায়াবতীর হাতে আমার মৃত্যু।”
মায়া ছুরি ধরেই রাজের দিকে ঝুঁকে আছে।ঠিক তখনই গেট নক করে পিয়াশ বলে,”গাড়ি রেডি আমাদের পৌঁছাতে হবে।আপনারা রেডি তো?”
মায়া উঠে যায় ছুরি নিয়ে।রাজ ঠিক সেভাবেই শুয়ে আছে। পিয়াশের দিকে ঘাড় কাত করে বলে,”আমরাও রেডি।শুধু দশ মিনিট অপেক্ষা করো।আমরা আসছি একটু পর।”
পিয়াশ চলে যায়।মায়া প্যাকিং শেষ করে ল্যাকেজের চেইন লাগাতে থাকে।তারপর নিজেকে দেখে নেয় আয়নায়।রাজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে মায়ার বাহু ধরে মায়াকে জড়িয়ে ধরে।মায়া নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে।কিন্তু সে ব্যার্থ।রাজের এই শক্তপোক্ত শরীরে সে কিছুতেই পেরে উঠবে না রাজের সাথে।রাজ মায়াকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,”উহুম মায়াবতী।আমি না চাওয়া অব্দি তুমি এই বাঁধন খুলতেই পারবে না।”
মায়া রাজের কথা শুনে।কিন্তু সে তার জেদের সাথে ব্যার্থ শক্তি খাটাতে থাকে।রাজ মায়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেই বলে,”দুষ্টুমি করতে নেই,মায়াবতী।আমার অনুভূতিতে বাধা পড়ছে তো!”
মায়া চিল্লিয়ে বলে ওঠে,”ছাড়ুন আমাকে।দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।”
“দুষ্টুমি করবে না তো?শান্তিতে এভাবে থেকে আমার অনুভূতিতে ব্যাঘাত ঘটাবে না তো?আমি কিন্তু তাহলে আমার প্রেমের ডোজ আরো বাড়িয়ে দিবো।”
মায়া থেমে গেলো।এই লু চুর কাছে তাকে হার মানতে হবে।তাছাড়া উপায় নেই।যেভাবে লেগে আছে।
রাজ হালকা হেসে মায়ার মাথায় চুলের উপর দিয়ে আলতো ঠোঁটের পরশ দিয়ে বলে,”বউ বউ অনুভূতি পাচ্ছে, জান।
মায়া অবাক হয়ে যায়।এ কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি।কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করে না।বাড়াবাড়ি করলে এই পাগলা মন্ত্রী ডোজ বাড়িয়ে দিবে।মায়ার দমে যাওয়া দেখে রাজ বলে,”আর দুই মিনিট।তারপর তো আমরা ঢাকার জন্য রওনা দিবো।সেখানে পদে পদে অপেক্ষা করছে তোমার শত্রু আমার শত্রু।আচ্ছা এত শত্রুর নিঃশেষ হতে হতে আমাদের মিলন কবে হবে?”
মায়া চুপ করে আছে।রাজ তার মতো বকেই যাচ্ছে।মায়ার থেকে উত্তর না পেয়ে রাজ বলে ওঠে,”আমার হিংস্র মায়াবতী হঠাৎ কেনো হলে শান্তবতী?”
“দুই মিনিট শেষ।”
রাজ ছেড়ে দিলো মায়াকে।বলে,”তুমি এতক্ষণ ধরে কাউন্ট করছিলে!আমি ভাবলাম আমার সমস্ত স্পন্দন অনুভব করছিলে।”
মায়া ফিচেল হেসে বলে,”মায়াকে যতটা দুর্বল মনে করেন মায়া ততটা না।”
বলেই ল্যাকেজ নিয়ে বের হতে থাকে মায়া।রাজ তার সোজাই থাকে।মায়া বের হওয়ার সাথে সাথে মায়ার থেকে ল্যাকেজ নিয়ে গাড়িতে ঢুকিয়ে দেয় একজন গার্ড।রাজের ল্যাকেজ আগেই ঢোকানো হয়েছে।
এয়ারপোর্টে কিছু চেকিং করে প্লেনে উঠে বসে মায়া ও রাজ।চট্টগ্রামে আসার সময় যেভাবে করে সবাই সিটে বসেছিলো,আজও সেভাবে করেই সবাই একই সিটে বসে ঢাকা যাচ্ছে।
মৌ মন খারাপ করে আছে।তারা অনেক জায়গায় ঘুরেছে।কিন্তু এই সাতদিন যেনো কম লাগছে তার কাছে। পিয়াশ সামলাতে থাকে মৌকে।মৌ পিয়াশের বুকে মাথা রেখে বলে,”আনন্দ মুহূর্ত কত তাড়াতাড়ি যায় তাই না?”
“চিন্তা করো না বউ!আনন্দ মুহূর্ত আরো আসবে।”
রাজ পিয়াশের দিকে ফিরে বলে,”আর সবার আনন্দের মুহূর্ত আসলেও তোমার আনন্দ মুহূর্ত আসবে না পিয়ু বেবী।”
প্লেনের সবাই অট্টহাসিতে মেতে ওঠে।প্লেনে রাজ ও মায়ার লোক ছাড়া কেউ নেই।রাজ নিজে এই প্লেনের সমস্ত টিকিট নিজের নাম কেটেছিলো।যেখানে বাইরের লোকজন থাকবে না। পিয়াশ বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”আমার প্রেমের কাবাব কি হাড্ডি।আমি করবো আমার বউয়ের সাথে প্রেম মাঝখানে খাম্বা হয়ে দাঁড়ায় আমার বস।”
মৌ পিয়াশের কানে কানে বলে,”আরেকটু জোরে বলো।ভাইয়া শুনে তোমার কি করে দেখো।”
“মাথা খারাপ!এ যা লাগামহীন বস।আমি টিকতে পারবো না,বউ।”
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ঘরের বাইরে বের হয় হিয়া।চারপাশে ভালোভাবে উকি দেয়।দেখতে থাকে কোথাও রুদ্র আছে কি না।একা একা রুদ্রের সামনে যেতে ভয় পায় সে।তাই এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে। নাহ,নেই রুদ্র।হিয়া এবার সাহস নিয়ে পিটপিট পায়ে সিড়ি দিয়ে যেতে লাগলো নিজের ছোট লাইব্রেরির দিকে।ভালোভাবে আবারও চারপাশ পরখ করে লাইব্রেরির ভিতর ঢুকেই দরজায় ছিটকিনি দিয়ে দিলো হিয়া।ছিটকিনি দিয়ে একটু শান্তির নিশ্বাস নিচ্ছে সে।কিন্তু হঠাৎ বন্ধ রুমের ভীতর থেকে ভেসে এলো,”আমার থেকে পালানোর চেষ্টা করছিস, হিয়াপাখি?”
মায়াবতীর ইচ্ছা পর্ব ১৮
দরজার দিকে মুখ করে ছিলো হিয়া।রুদ্রের এমন কণ্ঠ শুনে যেনো আতকে উঠলো।রুদ্র কোথা থেকে আসলো?কাপা কাপা শরীর নিয়ে পিছনে ঘুরে দেখলো লাইব্রেরির এই ছোট রুমটির মধ্যে থাকা বুকশেলফে হেলান দিয়ে আছে রুদ্র।হিয়া চুপ করে তাকিয়ে আছে রুদ্রের দিকে।রুদ্র লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসে হিয়ার দিকে।