মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ১
ইশরাত জাহান
মন্ত্রীর বিয়েতে বউ পালিয়েছে।এই নিয়ে চারপাশে কানাঘুষা চলতে থাকে।সাংবাদিক হলের চারপাশের ছবি ও ভিডিও তুলতে ব্যাস্ত।শাহমীর রাজ যে কি না এত বছর সিঙ্গেল থেকে কঠোর পরিশ্রম করার পর সফল হয়েছে।তার পিছনে লেগে আছে অহরহ সুন্দরী মেয়ের পরিবার।আজ তারই বিয়েতে কনে উধাও।বিয়ের এতগুলো অনুষ্ঠানে মেয়ের হাবভাব দেখলে মনে হতো বিয়েতে শাহমীর রাজের থেকে তারই আগ্রহ বেশি কিন্তু আজ হঠাৎ বউ নেই।এটা যেনো সবাইকে অবাক করে দিলো।এই তো কালকের গায়ে হলুদের কথাই বলা যাক।মালিনী আর সোনালী মিলে যখন আয়রাকে নিয়ে মঞ্চে উপস্থিত হলো তখন আয়রা ওর বান্ধবীদের কানে কানে বলেছিলো,”এই শোন না।আমার এখন খুব নাচতে ইচ্ছা করছে।”
অবাক হয়ে গেলো বান্ধবীরা।আয়রার কানে কানে ওর এক বান্ধবী বলে,”মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর?আজকে তোর গায়ে হলুদ।আমরা নাচবো তুই দেখবি।”
আয়রা মুখ গোমড়া করে থাকে।সাথে সাথে আয়রার আরেক বান্ধবী বলে,”আরেহ!আজকাল বিয়েতে বউও নাচে।এগুলো কোনো ব্যাপার না।চল আয়ু আমাদের সাথে নাচবি।”
সাথে সাথেই খুশি হলো আয়রা।ওর বান্ধবীরা মিলে ওকে নাচের মঞ্চে নিয়ে গেলো।সবাই মিলে আনন্দে মেতে ওঠে।আজকে তাকেই কি না পাওয়া যাচ্ছে না।কাল তো মিডিয়ার লোকেরা কাগজে ছাপিয়ে দিয়েছিলো,”মন্ত্রীর হবু বউ বিয়ে করার জন্য সবথেকে বেশি এক্সাইটেড।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এখন আবার তারাই হেড অফিসে কথা বলছে,”স্যার ব্রেকিং নিউজ।মন্ত্রীর বউ পালিয়েছে।”
সাংবাদিক কথাটা বলতে দেরি করেছে কিন্তু তার কান থেকে ফোনটা ছো মেরে নিতে দেরি করেনি রাজ।ফোনটা নিয়ে নিজের কানে রেখে রাজ বলে,”কি সব ভুলভাল সাংবাদিক পোষেন আপনারা?একটা খবরও সঠিকভাবে দিতে পারেনা।আব্বে মিয়া!আমার বউ পালাবে কেনো?পালিয়েছে তো আমার হবু বউ।”
অনুষ্ঠানের সবাই যেনো এবার নাটক দেখছে।মন্ত্রীর বিয়েতে বউ পলাতক আর মন্ত্রী কি না রিল্যাক্স আছে।এটাও সম্ভব!সবার কানাঘুষার মাঝে চিন্তায় পড়ে গেল সরদার বাড়ির লোকজন।মালিনী ও সোনালী একপাশে কথা বলছে।মাহমুদ সরদার চুপ করে বসে আছে।মোহন সরদার এদিক ওদিক কল করছে।কাউকে পাওয়া গেলো না।কাজের সময় কাউকে পায় না।এতেই যেনো রাগ তরতর করে বেড়ে গেলো তার।দূর থেকে এই দৃশ্য উপভোগ করছে একজন।যার গায়ে সাদা রংয়ের সার্টের উপর নীল রঙের কোর্ট আর জিন্স পায়ে স্টিলেটো।চোখে সানগ্লাস মাথায় পনিটেল করা ঠোঁটে বিজয়ের হাসি।দুজন ব্যাক্তির জীবনের কাল হয়ে এসেছে সে।সফলও হয়েছে এখন।এই মোহন সরদার আর শাহমীর রাজ এদের পতন দেখতেই তো তার আসা।
এদের মান সম্মান মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা করে দিতে তার যত প্রচেষ্টা।সে আর কেউ না ফ্যাশন হাউজের মালিক মেহেরুন জাহান মায়া।লোকের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে চোখটা স্থির রেখেছে মোহন সরদারের দিকে।মুখে বিদ্রুপের হাসি ফুটিয়ে বলে,”এই শাহমীর রাজের সাথে তুমিও আমাকে আর আমার মাকে অপমান করেছিলে।আজ এই মায়া তোমাদের জনগণের সামনে অপমানিত করলো।হিসাব এখনও বরাবর হয়নি।এটা তো সবে শুরু।আগে আগে দেখো হোতা হে কেয়া!”
বলেই মায়া চলে যেতে নেয় ঠিক তখনই গলা উঁচিয়ে সবার সামনে রাজ বলে ওঠে,”আব্বে এই মায়াবতী।”
পা থেমে গেলো মায়ার।সাথে সবার চোখ স্থির হলো একদিকে।শাহমীর রাজ!হ্যাঁ তাকেই দেখছে সবাই।তার দৃষ্টি অনুসারে সামনে তাকাতেই সবাই দেখলো শার্ট কোর্ট পড়ে দাড়িয়ে আছে একটি মেয়ে।মায়া রাজের দিকে ঘুরতেই সবাই ক্যামেরা মায়ার দিকে নিলো।ছবি তুলতে থাকে আর বলে,”ম্যাম আপনি মন্ত্রী শাহমীর রাজের বিয়েতে?এভাবে চলে যাচ্ছেন কেনো?”
মায়ার এক কথায় উত্তর,”কারণ বিয়েটাই তো হচ্ছেনা।”
রাজ ফিচেল হেসে বলে,”কে বলল বিয়ে হবেনা?”
“বউ ছাড়া বুঝি বিয়ে হয় মিস্টার শাহমীর রাজ?”
“বউ থাকলে তো বিয়ে অবশ্যই হয় মায়াবতী।”
“কি তখন থেকে মায়াবতী মায়াবতী করছেন?আপনি কি আমাকে চেনেন?”
রাজ অবাক হওয়ার অভিনয় করে বলে,”অনেক হয়েছে মায়াবতী।আর রাগ করে থেকোনা।আমি বুঝতে পেরেছি তুমি আমার উপর রাগ করেছো তাই তো?ওকে বাবা সরি।এখন সবার সামনে সত্যিটা বলছি আমি।”
ভ্রুকুটি করে মায়া বলে,”কিসের সত্যি?”
“এই যে তোমার আমার এফেয়ার।এই বিয়ের নাটক যে তোমাকে পেতেই সাজিয়েছি।”
“হোয়াট?”
“হুম।তোমাকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনতেই তো আয়রার সাথে মিথ্যে বিয়ের প্ল্যান করেছিলাম।আয়রা চলে গেছে কারণ তুমি এসেছো মায়াবতী।”
রাজের নিকটে তেড়ে আসলো মায়া।আঙুল উচু করে কিছু বলতে যাবে ওমনি সবার সামনে মায়াকে জড়িয়ে ধরলো রাজ।মায়ার কানে কানে গরম নিশ্বাসের সাথে বলতে থাকে,”মন্ত্রীকে সিঙ্গেল রাখা কি এতই সোজা?যে যে এই শাহমীর রাজকে সিঙ্গেল লাইফ উপহার দিতে যাবে তার পাশাটাই উল্টে যাবে।”
মায়া রক্তিম চোখে তাকালো রাজের দিকে।রাজ মৃদু হেসে তার ফোন বের করলো পকেট থেকে।অতঃপর একটি ভিডিও দেখালো মায়াকে।যেখানে দেখা যাচ্ছে আয়রাকে অজ্ঞান করে গাড়ির ডিকিতে শুইয়ে দিয়েছে মায়া।কাউকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে গাড়ি সহ তার বিদায় দিয়েছে।এটা দেখেই মায়া যেনো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।রাজ ফোন বন্ধ করে পকেটে ঢুকালো।মায়া বলে,”আমাকে কি করতে হবে?”
রাজের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।মায়াবতীকে তার কিছু বুঝিয়ে দিতে হয়না।এই মেয়ে যেনো হালকা ইঙ্গিতেই সব বুঝে যায়।এই যে ভিডিও দেখে বুঝে গেলো রাজ তাকে ব্ল্যাকমেইল করছে।রাজ কানে কানেই হলে,”আপাতত আমাকে বিয়ে করতে হবে।”
রাজকে আলতো ধাক্কা দেয় মায়া।কিন্তু এই ধাক্কা দেওয়াটা যেনো ব্যার্থ।রাজ তো সরলোই না বরং আরো জোরে জড়িয়ে ধরলো।মায়া দাত কঠমঠ করতে করতে বলে,”অসম্ভব,আমি আপনাকে বিয়ে করব না।”
“তাহলে ভিডিও সবাইকে দেখিয়ে বলব তুমি আমার হবু বউকে কিডন্যাপ করেছো।ভেবে দেখো।ভালো লাগবে তো তোমার স্থান জেলে হলে?”
মায়া চুপ হয়ে আছে।নিজের পাতা ফাঁদে এখন নিজেই পা দিয়েছে।রাজ বলে,”ভেবে দেখো এই মন্ত্রীকে বিয়ে করলে লাভে লাভ আছে তোমার।আর বিয়ে না করলে লসে লস।”
মায়ার রাগ বাড়ছে রাজের প্রতিটি কথার ভাজে।সহ্য করতে পারছে না রাজকে।ইচ্ছা করছে এখনই খুন করে দিবে রাজকে।কিন্তু এখন সেই সময় আসেনি।তাকে আর তার মাকে যেভাবে এই বাড়ি থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করা হয়েছিল ঠিক সেভাবে এদেরকেও বের করবে।তারপর যার যার শাস্তি আলাদাভাবে দিবে।মায়ার ভাবনার মাঝে রাজ বলে,”কি হলো উত্তর দেও।এতক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলে তো লোকে বলবে মন্ত্রী বিয়ের আগেই বউকে নিয়ে বাসরের বাসনা পূর্ণ করতে চাইছে।”
“মুখে লাগাম দিন।”
“বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাও আমি বাসরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মুখে লাগাম দিব।”
মায়া যখন কোনোকুল খুঁজে পেলনা তখন রাজি হলো।বলে,”ঠিক আছে।আমি বিয়ে করব আপনাকে।”
রাজের এই কর্মকাণ্ড হা হয়ে দেখছিল হিয়া আর সিয়া।মাহমুদ সরদার অন্যদিকে চলে গেছেন সেই প্রথমেই।রাজ নিজেই তাকে বলেছিলো,”ছেলের বউ আনতে তুমি ব্যর্থ বাবা।তাই ছেলেকেই মাঠে নামতে হবে।এর জন্য তোমার একটা উপকার লাগবে?”
মাহমুদ সরদার গলা খাকারি দিয়ে বলেন,”কি উপকার?”
“তোমার প্রাণপ্রিয় দ্বিতীয় স্ত্রী ও ভাইদের নিয়ে এখান থেকে কেটে পড়।”
“কি!এখন তোমার এই বিয়েতেও আমাকে থাকতে দিবেনা?”
“আহা!আমি কি এখন বিয়ে করছি যে তুমি এত উত্তেজিত।তুমি তো আমাকে বউ এনে দিতে পারলে না।এখন আমার বউ আমাকেই আনতে হবে।বিয়ে করার সময় তোমাকে ডাকা হবে।এখন তোমার বউ আর ভাইদের নিয়ে যাও তো।”
“বেশরম ছেলে আমার।কপালটাই খারাপ।”
বলে সবাইকে নিয়ে চলে যান মাহমুদ সরদার।তারপর শুরু হয় মায়ারাজের সাক্ষাৎ।হিয়া চোখের চশমা ঠিক করে সিয়াকে বলে,”ভাই কবে প্রেম করলো বোন?”
সিয়া সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে বলে,”তুইও যেখানে আমিও সেখানে।কি করে জানবো বল?”
“ধুর!এতদিন ভাবতাম বয়স হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ভাই বিয়ে কেন করছে না?এখন যখন ভাইয়ের বিয়েতে আনন্দ করতে চাই ওমনি দেখি বউ উধাও।এখন আবার দেখি ভাইয়ের বার্বি ডলের মত কিউট দেখতে গার্লফ্রেন্ড আছে।”
“হুমমম।”
হিয়া কথা শেষ করতেই ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে রুদ্র।এতক্ষণ মকটেল কাউন্টারে ছিলো সে।এক গ্লাস শরবত হাতে নিয়ে এসেছে সে।হিয়ার কানের কাছে মুখ রেখে বলে,”মন্ত্রীর বিয়ের নমুনা এটা।তুই বুঝবি না হিয়াপাখি।”
রাগ মিশিয়ে হিয়া তাকালো রুদ্রের দিকে।হাতে মদের গ্লাস দেখে রাগটা বাড়িয়ে বলে,”আপনাকে জিজ্ঞাসা করিনি আমি।”
“এটা তো দেখতেই পাচ্ছি।আচ্ছা হিয়াপাখি!তোর ভাই কি কোনো সাধনা করে রেখেছিল যে বউকে বিয়ের আগে শক্ত করে লম্বা সময় নিয়ে জড়িয়ে ধরবে?”
“শাট আপ রুদ্র ভাই।”
“বাহ রে!মন্ত্রী করবে লীলাখেলা আমি বললেই দোষ?”
মুখ ঝামটি দিয়ে হিয়া বলে,”নষ্ট পুরুষ কোথাকার।”
বলেই চলে যায় হিয়া।রাজ মায়ার থেকে সম্মতি পেয়ে মায়াকে ছেড়ে দেয়।সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,”তো এখন মন্ত্রীর বিয়ে শুরু হোক।আব্বে এই সাংবাদিক।হেড অফিসে কল করে জানিয়ে দিন।মন্ত্রীর বিয়ে হচ্ছে।শুধু সিনেমাটিকাল ভাবে।না মানে আপনারা সঠিক তথ্য না দিলে তো বাংলদেশে আমার নামে দুর্নাম ছড়াবে তাই।”
রাজের কথা শুনে সাংবাদিকরা লোক দেখানো হাসি দিলো।মনে মনে তারাও বলে,”আমাদের কি খেয়ে কাজ আছে যে আপনাদের নিয়ে পড়ে থাকবো?আজকাল আসল তথ্য এড়াতেই তো আপনাদের এই আজাইরা আলাপ প্রকাশ করতে হয়।নইলে আমরা পেট চালাবো কিভাবে?সব দোষ খালি সাংবাদিকের না।কিছু দোষ ওপর মহল থেকেও।”
রাজের ইশারা পেয়ে হিয়া আর সিয়া নিয়ে যায় মায়াকে।উদ্দেশ্য মায়াকে বউ সাজাবে।
চট্টগ্রামের,,,,,,
অন্ধকার ঘরের একটি চেয়ারে হাত পা বাধা অবস্থায় ঘুমিয়ে আছে জারা।জারার শরীরে টপস আর জিন্স গলায় ওড়না প্যাঁচানো।সেই ঘরে প্রবেশ করলো কালো কোর্ট পরিহিতা এক যুবক।রুমের দরজা খুলতেই বাইরের আলো এসে জারার চোখমুখে জ্বলজ্বল করে উঠলো।ফর্সা মুখশ্রীর জারাকে দেখে যুবকটি হাসলো।ডানপাশের ত্বকের উপর দিয়ে বামহাত বিচরণ করতে লাগলো।কিছুক্ষণ সেদিকে মনস্থির রেখে পরে পাশে থাকা জগ থেকে পানি নিয়ে যুবকটি পানির বিন্দু বিন্দু ছিটা দিলো জারার মুখে।ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরল জারার।চোখ খুলতেই চোখের সামনে যুবকটিকে দেখে ভয় পেলো।ভয়তে চোখ বড়বড় হয়ে এলো জারার।শুকনো ঢোক গিলে বলে,”ব ব বীর!”
শয়তানি হাসি ফুটিয়ে বীর বলে,”হ্যাঁ জানেমান আমি।কেমন লাগলো সারপ্রাইজ?”
জারার আত্তা পালাই পালাই করতে ব্যাস্ত।এমন এক মাফিয়ার সামনে থাকা যে কতটা ভয়ানক তা সে যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছে সেদিন থেকেই পালায় বেড়ায়।
