মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ২৪
ইশরাত জাহান
মায়া তারেককে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেই দরজাটা লাগিয়ে দিল।অতঃপর তারার দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি আমাকে কিছু বলতে চান যেটা অন্য কাউকে না।এটা আপনার ভাবভঙ্গিতে প্রকাশ পায়।এবার বলুন কি বলতে চান?”
তারা মায়ার কাছে এসে মায়ার গাল ছুতে গিয়েও ছুলো না।কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে,”তোমাকে একটু কি জড়িয়ে ধরতে পারবো মোহ মা?”
মায়ার হাত পা শীতল হয়ে এলো।তার শৈশবের নাম ধরে তারা ডাকলো কেন?এরমানে তারা জেনে গেছে।মায়া অন্যদিকে ফিরে বলে,”আমি মোহ নই।আমি মায়া।মেহেরুন জাহান মায়া।”
তারা ম্লান হাসলো।চোখের পানি মুছে বলে,”বেশ খানিকটা বদলেছো তুমি।তাই তো জিজ্ঞাসা করলাম যে জড়িয়ে ধরতে পারব কি না?হয়তো ছোটবেলার মোহনা এখন আর নেই।তার মনটা এতটাই পাথর হয়ে গেছে যে সে এখন হয়তো আমাদের মূল্যায়ন করে না।”
মায়া তারার দিকে ফিরে বলে,”আমি মূল্যায়ন জানি না?আমাকে অহংকারী মনে হয়?আসলেই কি আমি এমন ধরণের যেটা আপনি বলছেন?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“না তুমি আগের মতোই আছো।যেমনটা শাহানা আপা তোমাকে বানাতে চেয়েছিল।একটুও বদলে যাওনি।”
“কেন বারবার ওইসব নাম নিচ্ছেন আমার কাছে?”
“কারণ আমি জেনে গেছি তুমি মোহনা।তোমার দাদাজানের আদরের মায়াবতী।”
মায়া তাকিয়ে আছে তারার চোখের দিকে।তারা আবারও বলে,”তোমার গলার কাছে যে তিল আর তোমার মাঝে মোহন সরদারকে নিয়ে যে রাহ এগুলো স্পষ্ট যে তুমি কে?এখন তোমাকে কিছু জানানোর ছিলো আমার।”
“কি?”
“আসলে…”
বলতে গিয়েও থেমে এদিক ওদিক উকি দিল।মায়া বলে,”কেউ নেই এখানে।তারেক কাউকে আসতে দিবে না।তুমি বল।”
তারা এবার মলিন হাসলো।তারপর বলে,”আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কেন এই বাড়িতে পরিচয় পরিবর্তন করে এসেছো।এটা নিয়েই আমার কথা ছিল।”
“কি কথা?”
“এই বাড়িতে তুমি সুরক্ষিত না।ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে।ঠিক যেমনটা তোমার দাদাকে মেরেছিল।”
“আমার দাদাজানকে মেরেছিল মানে?”
“হ্যাঁ,তোমার দাদাজানকে খুন করা হয়।আর এটা করা হচ্ছে একটা ফর্মুলার জন্য।”
মায়ার মনে পড়ে তার দাদাজান ছোটবেলায় তাকে একটা কাগজপত্র দিয়েছিলো।আর সাথে দিয়েছিলো একটা কাচের বয়াম।যার মধ্যে ছিল মাটি আর সেখানে তৈরি করা হয় সার।মায়া সেই কাগজপত্র হারিয়ে ফেলে কিন্তু বয়াম তার কাছেই আছে।মায়ার খুব ভালো করেই মনে আছে দাদাজানের মৃত্যুর ঠিক কিছুদিন পরই মোহন সরদার বিয়ে করে বাড়িতে আনে সোনালীকে।মায়া এগুলো আর না ভেবে বলে,”কে খুন করেছে আমার দাদাজানকে?”
“এটা আমি জানি না।তবে এটা জানি এই খুনির সাথে যুক্ত আছে সোনালী আর মালিনী ম্যাম।আমি শুধু এক রাতে তোমার দাদাজানের কণ্ঠের একটা ছোট টেপ রেকর্ডার পেয়েছিলাম।ওখানে বলেছিলো যে তাকে খুন করতে এসেছে সোনালী আর তার প্রেমিক।একটু পরে সে মারা যাবে।তার শরীরে বিষ দেওয়া হয়েছে।শুধু তাই না।রাজের মাকেও খুন করা হয়েছে।খুনির আসল উদ্দেশ্য ওই ফর্মুলা জোগাড় করা।কাগজপত্র ওই লোকেরা নিয়ে গেছে।ওরা সরদার পরিবারকে ধ্বংস করে দিবে।”
“রাজের মাকে খুন করেছে মানে তো মন্ত্রী মশাইয়ের আরেকটা মা বোঝানো হয়।”
“হ্যাঁ,রাজ বাবার মায়ের নাম রোহিনী খান।মালিনী খান তার জমজ বোন।আমি এগুলো কিছুই জানতাম না।কিভাবেই বা জানবো?আমাকে এই বাড়িতে কাজে আনা হয় তোমার জন্মের কয়েকমাস আগে।তাই অতশত কাহিনী জানতাম না।কিন্তু তোমরা বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর আমি এক এক করে অনেককিছু জানতে পারি।আমি তো ভেবেছিলাম তোমাদের খুন করে দিয়েছে।আমি তো শুধু প্রমাণ খুঁজছিলাম যে এগুলো আসলেই সত্যি নাকি আমার মনের ভুল।কোনো কিছু জোগাড় করতে না পারলেও অনেককিছু জানতে পেরেছি।”
“কি কি জেনেছো?”
“এই যে রোহিনী খানের মৃত্যুর পর মহসিন সরদার একপ্রকার ছেলের সুখের জন্য জোর করে তার বিয়ে দেন মালিনী খানের সাথে।রাজের এখানে সম্মতি ছিলো না।মায়ের শোকে সে তখন পাথর।এরপর মালিনী ম্যাম আর মাহমুদ স্যারের একটা ছেলে সন্তান হয়।দুর্ভাগ্যবশত সে নাকি হারিয়ে যায়।এগুলো জানার ঠিক কিছুদিন পর আমি একদিন মহসিন সরদারের ওই রেকর্ড পাই।”
“রেকর্ডটা কোথায়?”
“আমি ওটা মাহমুদ সরদারকে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার হাত থেকে ওটা পানিতে পড়ে যায়।সেই যে হারিয়েছি আর খুঁজে পাইনি।কিন্তু আমি সত্যি কথাটাই বলছি।এই বাড়িতে ওই সোনালীর আগমণ ফর্মুলার জন্যে।ও তোমার বাবাকে ওই ফর্মুলার জন্য বিয়ে করেছে।সোনালী কার সাথে মিলে এসব করছে এটা আমি জানি না।শুধু জানি ও ওই ফর্মুলার লোভে নিজের রূপ দিয়ে তোমার বাবাকে ঘায়েল করেছে।এমনকি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়ায় তোমার বাবার মন জোগাতে পেড়েছে।”
“আমি বিশ্বাস করি তোমার কথা।ওই লোকটাকে একদম আমার বাবা বলবে না।সে যতই সোনালীর চক্রান্ত হোক না কেন দিনশেষে এটাই সত্যি ওই লোকটা এখন লোভী।ওই লোক একজন বাজে লোক।যে তার স্ত্রী সন্তানকে রেখেও পরকীয়া করেছে।তার মাঝে ছিলো না অনুতপ্ত বরং সে আমাদেরকে অনেক অত্যাচার করেছে।সাথে করেছে ওই শাহমীর রাজ।”
“রাজ বাবা?”
“হ্যাঁ তোমার রাজ বাবা।আমাকে আর আমার মাকে তিলে তিলে মেরেছে।”
“রাজ বাবা কোথা থেকে এলো?”
“সে আছে অনেক ঘটনা।”
তারা এবার কিছু একটা ভেবে বলে,”আরো একটা কথা ছিল তোমাকে জানানোর।”
“কি?”
“মাহমুদ সরদার আর রোহিনী খানের যমজ পুত্র হয়।একজন রাজ আরেকজনের নাম তাজ।”
“কিঃ?”
“হ্যাঁ, তাজ ছেলেটি জন্মগত প্রতিবন্ধী।তাই তাকে এই বাড়িতে রাখা হয়না।সে এখনও অটিজমে।ওখানেই তার বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত।রাজ বাবা আর মাহমুদ সরদার গিয়ে দেখা করে আসে।”
“আমার আরেকটা প্রশ্ন আছে।”
“কী?”
“অহর্নিশ আদ্র আর রৌদ্রদীপ রুদ্র।আমি যখন এই বাড়িতে ছিলাম তখন তো এরা ছিলো না।তাহলে এদের কি সম্পর্ক এই বাড়ির সাথে?”
“আহান সরদার হলো মহসিন সরদারের দ্বিতীয় পক্ষের ছেলে।আবার শাহানা আপা ও অবনী আপা দুই বান্ধবী।অবনী আপাই আসলে তোমার মা বাবার দিয়ে নিয়ে কথা তোলে।আসলে দুই বান্ধবী একসাথে থাকবে তাই।পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়।এরপর আহান সরদার কি কাজে বিদেশ চলে যান।ওখানেই তাদের সংসার জীবন চলতে থাকে।আদ্র বাবা মাঝেমধ্যে আসতেন অবনী ম্যামের সাথে।তাই তোমার সাথে দেখা।রুদ্র বাবা আসতো না।এসেছে এই কয়েক বছর হলো।মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে এখানে আসে।আবারও চলে যায়।তারপর বছর কয়েক আগেই পার্মানেন্ট এসেছে এখানে থাকার জন্য।শুনেছি রুদ্র বাবা পড়াশোনায় তেমন ভালো না।ফুর্তি আড্ডা এসব নিয়েই থাকে।তাই এখানে তাকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে আহান সরদার।”
এটা শুনে মায়া একটু হাসলো।রুদ্র এমন এক সিক্রেট যার ব্যাপারে কেউ কোনো ছিটেফোঁটা আন্দাজ করতে পারে না।মায়া নিজেও অবশ্য জানে না রুদ্র কে বা কি কিন্তু মায়া এটা শিওর রুদ্রের মাঝেও আছে কোনো রহস্য।মায়া এবার তারাকে প্রশ্ন করে,”তাজকে কি এই বাড়িতে আনা হয়না?”
“না,আসলে রাজ বাবা আসার পর একবার আনা হয়।রাজ বাবাই চেয়েছিল ভাইয়েরা একসাথে হেসে খেলে থাকবে কিন্ত এখানে আনলে আমাদের মত স্বাভাবিকভাবে চলতে পারেনা।তার চলাফেরা একটু ব্যতিক্রম।অনেক সময় তো তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার কথাও ওঠে।তাই তাকে ওখানেই রাখা হয়।প্রায় ঈদে গিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।ওই একদিন কি দুইদিন ঠিক থাকলেও আবারও সে পাগলামি শুরু করে।তাই আনে না তাজ বাবাকে।”
“ওহ।”
“আমার একটা বিষয়ে সন্দেহ হয়।”
“কি?”
“তাজ বাবার অসুস্থতার জন্য সোনালীর অনেক হাত আছে।”
“মানে?”
“আমি দেখেছি সোনালী আর তাজ বাবার জন্য আনা ডাক্তার একসাথে একদিন কথা বলছিল।আমি বাজার করতে গিয়েছিলাম ওইদিন।দূর থেকে ওদেরকে একসাথে দেখেছি।এগুলো আমি তখন অত পাত্তা দিতাম না কিন্তু যেদিন তাজ বাবার ব্যাপারে জানতে পারলাম সেদিন থেকে সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করেছে।”
“তুমি এগুলো কাউকে জানাওনি কেন?”
“আমি একবার না অনেকবার চেষ্টা করেছি মাহমুদ স্যারের কাছে সবকিছু বলার কিন্তু আমি ধরা পড়ে যাই মালিনী খানের কাছে।সে কিছু বলেনা আমাকে শুধু চুপ থাকার হুমকি দেয়।কেউ কিছু জানতে পারলে আমার গ্রামে অসুস্থ বাবা মারা যাবে এগুলো বলে।এছাড়া প্রমাণ ছাড়া কিছু বললে কে শুনবে আমার কথা?আমি তো রেকর্ড নিয়েও মাহমুদ সরদারের কাছে যেতে নিয়েছিলাম কিন্তু পারলাম না।রেকর্ড পানিতে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়।রাজ বাবাকে যে বলব সে উপায়ও নেই কারণ তোমরা কিভাবে বাড়ি থেকে চলে যাও।শাহানা আপা কোথায় এগুলো কিছুই তো জানি না।তোমাদের এই ঘটনার ঠিক ছয়দিন আগেই তো আমরা বাড়িতে যাই।আমাদেরকে ছুটিতে রাখা হয় যে।এসেই এসব শুনে আমরা অবাক হই।মাহমুদ সরদার তো গ্রামে ছিলেন।এইজন্য তিনিও কিছু জানেন না।”
“তোমাদের ছুটিতে রাখা হয়।আর এদিকে আমাদের জানানো হয় তোমাদের বাড়ি থেকে বিদায় করেছে।আমার মাকে ওই সময় কাজের মেয়ের মত খাটাতো।দিনরাত পরিশ্রম করতে হত মাকে।এরপর ওরা সবাই একসাথে ডায়নিং টেবিলে খেতে বসলে আমি আর মা খেতে বসতাম ফ্লোরে।আমাকে তোমার ঐ রাজ বাবা অনেক অত্যাচার করেছিলো।”
“রাজ বাবা অত্যাচার করেছিলো মানে?এর আগেও বলেছো রাজ বাবা অত্যাচার করেছে।এগুলো কি বলছো তুমি?”
“আসলে তোমাদের বিদায় দেওয়ার পর উনি দেশে ফিরেন।আমাদের সারপ্রাইজ দেন।দুইদিন ঠিক ছিল কিন্তু এরপর শুরু করে দিলো মারপিট।আমাকে কারণে অকারণে অসংখ্যবার মেরেছে।মাকে ডাক্তার দেখানোর দরকার ছিল কিন্তু যেতে দেয়নি।ওই মোহন সরদার আমার মাকে চাবুক দিয়ে আঘাত করতে করতে রক্তাক্ত করে দেয় শুধুমাত্র তার ওই সুন্দরী বউটার কথাতে।আমি ছাড়ব না ওদেরকে।ওদের সবাইকে তিলে তিলে মারব।ওই সোনালীকে আমি মারার আগে এই বাড়ির কাজের মহিলা বানিয়ে দিবো।ওই মোহন সরদারের এমন হাল করব যে পরকীয়ার শাস্তি যে কি সে এটা উপলব্ধি করব।পথের ভিখারী করে দিবো আমি তাকে।”
হাঁফাতে হাঁফাতে কথা বলে মায়া।তারা মায়ার কাধে হাত রেখে বলে,”আমি তোমাকে সাহায্য করব।”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারো বলে,”কিন্তু আমার মনে হয়না রাজ বাবা এগুলো করেছে।”
“কেন মনে হয়না?”
“কারণ সবকিছু কেমন হুটহাট করে চলল মনে হলো।এদিকে আমরা নেই ওদিকে মাহমুদ সরদার ছিলেন না।অন্যদিকে রাজ বাবা এসেছে।রাজ বাবা যে এসেছিল এই নিয়ে তো একটা কথাও তখন হয়নি।অন্তত হলেও মাহমুদ সরদার থাকতে পারতো ছেলের আসার খবর পেয়ে।সে কিন্তু আসেনি।আমার মনে হয় তোমাকে আরেকটু খোঁজ নেওয়া দরকার।কারণ এখানে ওদের ষড়যন্ত্র খুব নিখুঁতভাবে ধরা পড়েছে।ভালো করে ভেবে দেখো তোমাদের উপর অত্যাচার কিন্তু ওই সময় হয়নি যখন মাহমুদ সরদার বাড়িতে ছিল।ওরা সবকিছু করতো আড়ালে।এরমানে মাহমুদ সরদার যে গ্রামে যাবে এটারই সুযোগে ছিলো সোনালী আর মালিনী।তাই হয়তো তখন আমাদেরকে ছুটিতে রাখে আর তোমাদেরকে চাকরের মত খাটায়।”
মায়া এবার শান্ত হল।ভাবতে থাকলো তারার কথা।আসলেই তো তাই।রাজ যে বাসায় এসেছে এই খুশিতে তো মাহমুদ সরদারের এই বাড়িতেই থাকার কথা।তিনি কেন ছিলেন না?আবার রাজ এসে তো বাবাকে জানাবে।যেহেতু রাজ এসেছে এটা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেনি সেহেতু ঘটনা এরমাঝে ভিন্ন কিছু ছিল?মায়া মনে মনে ভাবতে থাকে আর বলে,”তাহলে কি ওই সময় মন্ত্রী মশাই ছিলো না?ওটা কি তবে তাজ ছিলো?”
একটুর জন্য ঠোঁট প্রসারিত করে মায়া বলে ওঠে,”আমাকে আবারও সবকিছু শুরু থেকে খোঁজ করতে হবে।তুমি আমাকে সাহায্য করবে কি?”
“হ্যাঁ,করব সাহায্য তোমাকে।এই বাড়ির প্রাণটাকে ফিরিয়ে আনতে আমি তোমাকে সাহায্য করব।”
“তাহলে আমি যেমন যেমন বলব ঠিক তেমনটাই করবে।”
তারা মাথা নাড়ালো।মায়া এবার নিজে থেকে জড়িয়ে ধরলো তারাকে।তারাও স্নেহের হাতটা মায়ার মাথায় রাখলো।মায়া আলতো হেসে বলে,”মা যখন আমার পুতুল বরকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো আমি মুখ ফুলিয়ে তোমার কাছে আসতাম।তুমি আমাকে এভাবেই আগলে রাখতে।”
“হ্যাঁ, আর ঠিক তার মিনিট পাঁচ কি দশ পরে তোমার পুতুল বর এসে তোমাকে নিয়ে চলে যেতো।কি হিংসে ছেলেটার।”
মায়া আর তারা হেসে দিলো।
রাজ এসেছে নিজের ঘরের দরজার সামনে।তারেককে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,”তুমি আমার ঘরে উঁকি মারছ কেন?বাসর তো আজ ওই ঘরটায় হবে।”
“ম্যাম আদেশ করেছেন তাই আমি এখানে।”
“ওহ।”
বলেই রাজ ঘরের দিকে যেতে নিবে তারেক পথ আটকে দাড়ালো।রাজ তারেকের দিকে তাকিয়ে বলে,”অদ্ভুত তো!ঘর আমার এদিকে রাস্তা আটকে আছো তুমি।কাহিনী কি?”
“ভিতরে প্রবেশ নিষেধ স্যার।”
“মাথা কি পুরো গেছে নাকি?ঘরটা আমার ভিতরে বউটাও আমার।আর প্রবেশ নিষেধটাও নাকি আমার!”
“দুঃখিত স্যার।ঘর আপনার ছিলো এখন এই ঘর আপনার আর আপনার মিসেসের।আপনার মিসেস এখন প্রাইভেসি চেয়েছেন।”
“রাখ তোর প্রাইভেসি।ব্যাটা ফাউল বডিগার্ড।আমার বউকে কি না আমার থেকে প্রাইভেসি মেইনটেইন করতে বলে।”
“দুঃখিত স্যার।রাগ করবেন না প্লিজ।এটা ম্যামের আদেশ।আমাকে তার আদেশ মানতে হয়।”
“আমি কে এটা কি তুমি ভুলে গেছো?”
“না স্যার ভুলিনি।আপনি হলেন মন্ত্রী শাহমীর রাজ।যার বউ মন্ত্রীর থেকেও ভয়ংকর।”
“কি বলতে চাও?”
“এই যে আপনি আপনার বউয়ের কাছে একজন ভেজা বেড়াল।আপনাকে ভিতরে পাঠানো মানে আমাকে ওপারে পাঠানো।কারণ সব দোষ আমার উপরেই দিবেন তাই।”
“আব্বে ব্যাটা!একবার ভিতরে যেতে দে।আমি ভেজা বেড়াল নাকি বাঘের গর্জন দিয়ে উঠি তোকে দেখিয়ে দিচ্ছি।”
“দুঃখিত স্যার।আপনার গর্জন দেখার জন্য আমার সময় নেই।ম্যামের অর্ডার পেলেই আমাকে চলে যেতে হবে।”
“তুই তো এবার আমার হাতেই মরলি রে তারেকের বাচ্চা।তোর ম্যাডাম তোকে ওপারে পাঠানোর আগে আমিই তোকে ওপারে পাঠিয়ে আমার বউয়ের কাছে যাচ্ছি বাঘের গর্জন দিতে।”
রাজ কথাগুলো জোরে রাগের সাথে বলে। পিয়াশ ছুটে আসে রাজের চিৎকার শুনে।এদিকে মায়া চেঁচামেচি শুনে তারাকে ছেড়ে দরজা খুলল।পিয়াশ এগিয়ে এসে রাজের মুখে এগুলো শুনে বলে,”এই ব্যাটা এতদিন আমার মাথা খেয়েছে এখন কি তারেকের মাথাটাও খাবে?এই মন্ত্রীর আশেপাশে যারা আছে একটারও শান্তি নেই।বর যেমন বউও ঠিক হয়েছে তেমনই।”
মায়া দরজা খুলে ভ্রু কুঁচকে বলে,”কি হয়েছে?”
“এই ফাউল ব্যাটা আমাকেই কি না আমার ঘরে আসতে দিবেনা।বলে কি না আমার বউয়ের প্রাইভেসি লাগবে।আমার বউয়ের কি না আমার থেকেই প্রাইভেসি দরকার?কত বড় ফাউল হলে এসব বলে।”
“ও তো ঠিকই বলেছে।আমি যেটা আদেশ দিয়েছি ওকে তো ওটাই মানতে হবে।”
তারা বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে।রাজ ভ্রু কুঁচকে দেখলো শুধু।তারা নিজের মত চলে গেলো নিচে।তখনই তারাকে ক্রস করে এগিয়ে আসলো রুদ্র।রুদ্র কিছু বলার আগেই রাজ চোখের ইশারা দিয়ে দেখালো তারাকে।এরপর বল ওঠে,”আমার বউ কি না শেষমেষ আমাদের সার্ভেন্ট নিয়ে প্রাইভেসি টাইম স্পেন্ড করছে!”
“শাট আপ মন্ত্রী মশাই।”
মায়া ঘরে চলে যায়।এদিকে রুদ্র বুঝলো রাজ কেন এই কথা বলেছে।এরমানে তারাকে টার্গেট করতে হবে তাদেরকে।বেশ কিছুক্ষণ ধরেই তারার মাঝে গোপন কিছুর আভাস পেয়েছিল রাজ ও রুদ্র।
রাজ ঘরে এসে মায়ার হাত ধরে নিজের কাছে আনে।মায়ার কপাল ছুঁয়ে বলে,”জ্বর কি কমেছে?”
“কিছুটা।”
রাজ মায়ার চোখমুখ দেখছিল খুঁটে খুঁটে।মায়া এটা দেখে বলে,”এভাবে কি দেখছেন?”
“সারাদিন পর একটু ক্লান্তি দূর করছি মায়াবতী।”
“আমাকে দেখে?”
“পুরুষ মানুষের ক্লান্তির অবসান কখন ঘটে জানো মায়াবতী?”
“কখন?”
রাজ মায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,”যখন সে তার বউয়ের মুখটা দেখে নিজের আশেপাশের সবকিছু ভুলে যায়।ভুলে যায় তার পরিচয়।ভুলে যায় তার দায়িত্বের কথা।শুধু মেতে থাকে বউয়ের ভালোবাসায়।হারিয়ে যাবে গভীরতম প্রেম নিবেদনে।”
মায়া রাজের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।রাজ নেশালো দৃষ্টিতে দেখছে মায়াকে।রাজের ঠোঁট এখনও মায়ার কানের কাছে।মায়া একটু মুখটা বেকিয়ে রাজের দিকে তাকাতেই মায়ার ঠোঁট যেনো আপনাআপনি রাজের ঠোঁটের নিকটে চলে যাচ্ছে।দুটো ঠোঁট একত্রিত হতে নিবে ঠিক তখনই দরজায় কেউ কড়া নারে।মায়া রাজকে ছেড়ে দরজা খুলতেই একজন সার্ভেন্ট বলে,”স্যার এগুলো অর্ডার করেছিলো।”
মায়া দেখলো একটা রেপিং পেপার দিয়ে সাজানো বক্স।মায়া ওটা নিয়ে দেখতে থাকলো।সার্ভেন্ট চলে যেতেই মায়া ভিতরে ঢোকে।রাজ ওই সময়ই চলে যায় ওয়াশরুমে।মায়া মিনিট কয়েক ধরে দেখতে থাকে।একবার ভাবলো এটা তার জন্য এনেছে রাজ।আবার ভাবলো রাজ আসলে রাজকে দিবে।আবারও কেন যেন দেখার আগ্রহ জাগলো।তাই হাতে কেচি নিয়ে পেপার কাটতে থাকে।রেপিং পেপার কাটার পর একটা বাক্স দেখে মায়া।ওখানে কিছুই লেখা নেই।তাই আরো খুলে।এর মধ্যেই রাজ মাথা মুছতে মুছতে ওয়াশরুমের দরজা খুলে।মায়া বক্সটা খুলতেই দেখতে পেলো কিছু পার্সোনাল প্যাকেট।যেগুলো দেখে মায়া চোখ বড়বড় করে তাকালো রাজের দিকে।রাজ মায়ার হাতে ওগুলো দেখে বলে,”এগুলো তোমার হাতে কেন?”
“এগুলো আমার হাতে কেন এটা না জেনে আগে বলুন আপনার সাহস হয় কি করে এগুলো নিয়ে আসার?আমি কি আপনাকে অনুমতি দিয়েছি আমার কাছে আসার?”
“আরে এগুলো আমাদের জন্য না।এগুলো তো আজকে যাদের বাসর তাদের জন্য এনেছি।”
“আপনি এগুলো আমার বোনের জন্য এনেছেন।ছিঃ!”
“এই একদম অন্যদিকে ঘুরিয়ে যাবে না।এগুলো আমি তোমার বোনকে দিবো কেন?এগুলো তো পিয়ু বেবীকে দিতাম।বেচারার হঠাৎ করে বিয়ে হয়েছে।এখনও প্রস্তুত না।এসব তো আমাদেরকেই ব্যাবস্থা করে দিতে হবে।”
“আপনার মাথায় এগুলো ছাড়া কিছু আসেনা তাই না?”
“আমার মাথায় অনেক কিছুই আসে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওই জিনিসটাই বেশি আসে যেটা আমার পূরণ হয়না।”
“লুচ্চা মন্ত্রী মশাই আপনি।”
“পুরুষ জাতি দুঃখ প্রকাশ করলেই হয় লুচ্চা।”
“চুপ করুন আপনি।এগুলো ওদেরকে দিবেন না।”
“তুমি কি চাও তোমার বোন এত তাড়াতাড়ি তোমাকে খালামণি বানাক?তুমি তো নিজেই মা হওয়ার মিশন শুরু করছ না।তোমার বোনের ক্যারিয়ার শুরু করার আগে মা হতে দিবে বলে তো মনে হয়না।”
“তাই বলে এগুলো দিতে হবে?”
“আমি এখানে শুধু তোমার বোন দেখছি না মায়াবতী।পিয়ু বেবীকে নিয়েও ভাবছি।ওর নেই নিজস্ব কোনো বাড়ি।ওর একটা ছোট্ট কুড়েঘর হোক তারপর নাহয় বাচ্চা নিয়ে ভাববে।আর সবথেকে বড় কথা একজন নারী পুরুষ যখন এক ঘরে এক বিছানায় একসাথে সময় কাটায় তাদের মাঝে কিন্তু পৃথিবীর কোনো ভাবনা আসেনা।তখন একটা কিছু ঘটে গেলে পরে কোনোকিছু ভেবেও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।আর এটা যে আমি ওদেরকে দিচ্ছি এটা তো ওরা জানতে পারত না।গিফট হিসেবে পার্সেল তো ওদের হাতে যাওয়ার কথা।কে দিলো এটা ওরা তো জানতেই পারতো না।”
মায়া মাথা নিচু করে জিনিসগুলো ঘৃণার সাথে ব্যালকনি দিয়ে ফেলে দেয় আর বলে,”ওই যে একজন সার্ভেন্ট এসে দিয়ে গেলো।আমি ভেবেছিলাম কোনো গিফট এসেছে তাই আমিও খুলে দেখছিলাম।”
রাজ দুষ্টু হেসে মায়ার কাছে এসে বলে,”বরের প্রতি ভালোবাসা জেগেছে বুঝি মায়াবতী।”
মায়া কোনো কথা না বলে ল্যাপটপ নিয়ে বসে।রাজ হাতের টাওয়ালটা চেয়ারের উপর রেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুলগুলো সেট করে নেয়।আয়নার সামনে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলে,”শুনেছি ত্রিশ পার করলে নাকি চুল পাকে।”
“তো?”
“চুল পাকার আগে কি বাবা ডাক শুনতে পাব না আমি?”
মায়া ল্যাপটপ ছেড়ে রাজের দিকে তাকালো।রাজ একটা ফ্লায়িং কিস দেখিয়ে দিলো।
রুদ্র এসেছিলো বাগানের দিকে।নিজের মত আনমনে হাঁটতে থাকে।কিছুদূর হাটার পর পায়ের কাছে কিছু প্যাকেট পায়।ওগুলো হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।এরপর যেখানে ওগুলো পেয়েছিল সেই ঘর বরাবর তাকিয়ে দেখলো এটা গেস্ট রুম।যেটা রাজের ঘরের পাশে কিন্তু একটু দূরে ঠিক কোণা দিয়ে।মায়া ওগুলো নিচে ফেললেও বাতাসে হয়তো এদিক ওদিক ছড়িয়ে অন্যদিকে চলে যায়।রুদ্র একবার গেস্ট রুম আরেকবার প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে বলে,”এই গেস্টরুমে আবার কে এগুলো কাজে লাগায়?আকামের কি জায়গার অভাব পড়ছে!”
হিয়া কানে হেডফোন আর হাতে বই নিয়ে এসেছিল বাইরে।রুদ্রকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসলো।লাইটের আলোয় রুদ্রের হাতের প্যাকেটের নাম পড়ে একটু জোরেই বলে,”ছিঃ!”
মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ২৩
রুদ্র হা হয়ে পিছনে ঘুরল।হিয়া রাগে রিরি করতে করতে বলে,”আপনি আসলেই একটা নষ্ট পুরুষ।”
বলেই দৌড়ে চলে গেলো ঘরের দিকে।রুদ্র আহম্বকের মত চেয়ে থেকে বলে,”ইনভেস্টিগেশন করতে গিয়ে শুধু নষ্ট পদবিটাই পেয়ে যাচ্ছি!কি ভাগ্য আমার। শখের নারী আমাকে দুর্ঘটনার সময় দেখে শুধু নষ্ট পুরুষ বানিয়ে দেয়।”
