মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ৫

মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ৫
ইশরাত জাহান

মাহমুদ সরদার একটু কেশে দূরে সরে গেলেন।মালিনী তার পাশে এসে দাড়ালো।মাহমুদ সরদারের কাধে হাত রেখে বলে,”বোঝই তো ছেলেটা আমার জন্য তোমার সাথে রুড বিহেভ করতে করতে আজ এমন তৈরি হয়েছে।না তুমি আমাকে বিয়ে করতে আর না আজ রাজের এমন মুখ হতো।”
মাহমুদ সরদার মাথা উপর নিচ করে বলেন,”ঠিকই বলেছো তুমি।যে বয়সে ছেলেকে শাসন করা দরকার একটু আদর করা দরকার ওই বয়সে আমি ছেলেকে সময় না দিয়ে উল্টো রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। রোহিনীর মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েছিলাম।তাইতো ছেলেটা আমার এমন তৈরি হলো।”

গাড়ির আওয়াজ পেতেই সবাই পিছনে তাকালো।গাড়ি থামার সাথে সাথে গান থেমে গেলো।মায়া এখনও নিচে বসে আছে।সোনালী মায়ার পা ধরে দেখছে।রুদ্র মিলি সিয়া হিয়া এরা নামার পর সোনালী চোখ ফিরিয়ে মায়াকে বলে,”এই যে মেয়ে।তোমার পায়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।”
মায়া কাদো কাদো মুখ করে বলে,”আমার পায়ে খুব ব্যাথা।”
সিয়া আর হিয়া দৌড়ে এসে বলে,”ভাবির কি হয়েছে?”
মায়া ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,”পড়ে গেছি আমি।খুব ব্যাথা করছে।”
“আমাদের সাথে ভিতরে চলো।পায়ে মলম দিয়ে দিবো।”
“হাঁটতেই তো পারছি না।”
রুদ্র এগিয়ে এসে বলে,”আমার মত দেবর থাকতে চিন্তা কিসের ভাবিজি?চল তোমাকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে যাই।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রুদ্রের এহেন কথায় মায়ার চোখ রাগে লাল হলেও রাজ রুদ্রের মাথায় দিলো এক চাপড়।রাগ দেখিয়ে বলে,”বর থাকতে দেবর কেনো লাগবে শুনি?আমার বউয়ের থেকে দশ হাত দূরে থাকবি।এমন দেবর থাকা ভাইদের জন্য বিপদজনক।”
হিয়া ঠোঁটটা টিপেটিপে বলে,”একদম ঠিক হয়েছে।”
বলেই চোখের চশমা ঠিক করে।রুদ্র শুনে মৃদু হাসলো।রাজ মায়াকে কোলে নিয়ে ভিতরে ঢুকলো।মায়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে চারপাশ।বাড়ির সামনের বড় জায়গায় ফল ফুলের বাগান।এটা আগেও ছিলো।এর পাশেই একটি সুইমিং পুল।মায়া কল্পনা করে এই সুইমিং পুলের পাশে সে বই নিয়ে বসে থাকতো আর তার মা শাহানা পারভীন খাবার এনে খাইয়ে দিত।প্রথমদিকে রাজ অনেক ভালো ছিল।ওই সময় রাজ মায়াকে নিজের হাতে খাইয়ে দিত।মায়াকে আগলে রাখতো।ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়ে যায় রাজ।অত্যাচার শুরু করে মায়ার প্রতি।এক সময় করলো তাদের প্রতি নির্মম নির্যাতন।অতীত মনে পড়তেই মায়া চোখটা ঘুরিয়ে রাখলো রাজের দিকে।রাজের মুখশ্রী দেখতে থাকে আর মনে মনে বলে,”আপনাকে আমি এমন অপমান করব যে আপনার এই অহংকার মাটিতে গুড়িয়ে যাবে।এই মায়া আপনাকে সুখে থাকতে দিবে না।এটা মায়ার প্রমিস।”

মায়াকে ভিতরে এনে সোফায় বসিয়ে দিলো রাজ।বাসার সবাই ভিতরে ঢুকতেই একজন সার্ভেন্ট মিষ্টি আর শরবত নিয়ে আসে।বউকে সবাই মিষ্টি দিয়ে সম্বোধন করতে চায়।সর্বপ্রথম মাহমুদ সরদার মিষ্টি খাইয়ে দেয় মায়াকে।একেক করে সবার হাতে মিষ্টি খাওয়ার পর মোহন সরদার আসে মায়াকে মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য।মায়া মোহন সরদারের চোখের দিকে তাকিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে,”অতিরিক্ত মিষ্টি খেলে আমার কষ্ট হয়।আমি আর খেতে পারব না।”
মাহমুদ সরদার মায়ার মুখের দিকে চেয়ে আছেন।কিছু একটা ভেবে বলেন,”মেয়েটা আজ অনেক কষ্ট করেছে।এখন মিষ্টি আর খাওয়াতে হবে না।”

মোহন সরদার অপমান বোধ করলেও চলে আসে।মায়া ওনার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটটা একটু বাকালো।যেনো এটাও একটা অপমান হলো মায়ার তরফ থেকে।মাহমুদ সরদার ভিতরে গেলেন কিছু সময়ের জন্য।মিনিট পাঁচ পরে হাতে কিছু গহনার বাক্স নিয়ে উপস্থিত হলেন।হাতে প্রায় সাত আটটা গয়নার বক্স হবে।ওগুলো সার্ভেন্টদের ইঙ্গিত করতেই ওরা বক্সগুলো নিয়ে মায়ার সামনের টেবিলে রাখলো।একেক করে প্রতিটি বক্স খুলতেই গহনা দেখতে পেলো সবাই।চোখ কপালে উঠলো যেনো সোনালীর।যে গহনা আছে এগুলো পুরোনো সময়ের কিন্তু এখন এগুলোর মর্ম অনেক।বিক্রি করলে কোটি টাকা উঠে আসবে।সবগুলো গহনার মধ্যে সোনালীর চোখ গেলো সবথেকে বড় বক্সের গহনার দিকে।ওখানে একটি সীতাহার আছে।যেটার কারুকাজ নিজ মাহমুদ সরদারের দাদি পছন্দ করে বানিয়ে যান।এরপর থেকে এই বাড়ির বউয়েরা এই গহনা পায়।বউ বললেও ভুল যে বড় বউ সেই পায়।সোনালী শিওর এখন এটা মায়া পাবে।একবার মিলির দিকে তাকালো সোনালী তারপর তার ছেলের কথাটাও ভাবলো।মিহির এখন সুইজারল্যান্ড আছে।এই সরদার বাড়িতে এসে সে এই গহনা আজ অব্দি দেখেনি তার ছেলে মেয়েরাও দেখেনি অথচ মায়া আজ হুট করে আসা মেয়ে পাবে।এটা ভেবেই রাগ যেনো তরতর করে বাড়ল।মাহমুদ সরদার বক্স থেকে সিতাহার নিয়ে মায়ার গলায় দিলেন।সোনালী দুই পা এগিয়ে এসে বলে,”এটা করা কি ঠিক হলো?”

মাহমুদ সরদার ভ্রুকুটি করে বলে,”কোনটা করা?”
“এই যে এই মেয়েকে চেনেন না জানেন না আজ হুট করে বিয়ে তো দিলেন আবার দামী গহনা দিয়ে দিলেন?”
“তো?”
“বাইরের কাউকে কি এভাবে বিশ্বাস করা উচিত?”
“এই বাড়িতে যেই বউ হয়ে এসেছে সবাই তো বাইরের মেয়ে।তাদের যদি বাড়িতে রেখে খাওয়াতে পড়াতে পারি তাহলে আমার বউমা কি দোষ করল?”
মাহমুদ সরদারের এহেন কথাতে কি বলবে সোনালী বুঝতে পারছে না।চোখ দিয়ে ইশারা করে মালিনীকে কিছু বুঝালো।মালিনী মাথা উপর নিচ করে এগিয়ে এসে বলে,”বড় বউ হিসেবে তো এই গহনা আমি পাই।তাহলে এটা আমাকে আগে দেওয়া হয়নি কেন?এখন এই মেয়েকে দিচ্ছ যে।”

মায়া মালিনীর ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না।রাজ একবার তো এরা একবার কি সব বলছে সবই মাথার উপর দিয়ে যাওয়ার মত।মাহমুদ সরদার চোখ রাঙিয়ে মালিনীকে বলেন,”ছেলের বউ হয় তোমার আর তুমি তাকেই ঈর্ষা করছ?”
“চিনি না জানি না খোঁজ খবর নেই একে ছেলের বউ বলি কিভাবে?”
“এত কথার তো দরকার নেই।খোঁজ খবর আমরা নিয়ে নিবো।এত বড় কোম্পানির ওনার এই মেয়েটি এটাই কি একটা পরিচয় না?বাকিটা আমাদের ছেলেই বুঝে নিবে।”
“বাবা মা হিসেবে আমরা ছেলের ভালো চাইতে পারিনা?”
“ভালো চাইতে হলে জীবনে বাকি পথ যেনো তারা সুখে দুঃখে একসাথে কাটায় সেই চেষ্টা করো।বাড়তি কথা শুনতে চাই না।আমার ছেলের বউকে আমি গ্রহণ করে নিয়েছি।এখন তার দায়িত্ব তোমার সমতুল্য।সেও এখন তোমার মত এই বাড়ির বড় ছেলের বউ।”

মালিনী থেমে গেলো।সোনালী রাগান্বিত হয়ে আছে।রাজ মুখটা আফসোস ভঙ্গিতে করে বলে,”আমার বউকে নিয়ে দেখছি সবার আপত্তি।বলি এমনিতেই আমি বিয়ে দেরি করে করেছি।এখন তোমরা কি চাও?লেট লতিফ বিবাহটা নষ্ট হয়ে যাক।এখনও তো বউকে নিয়ে একটা দিন পার করতে পারলাম না তাকে পরিপূর্ণ চিনব কিভাবে?”
রাজের কথা শুনে চোখ বড়বড় করে তাকালো মায়া ও মাহমুদ সরদার।রাজ শুকনো ঢোক গিলে বলে,”আরে তোমরা আমার বউকে চেনা জানা নিয়ে প্রশ্ন তুললে বলেই তো আমি এই কথাটা বললাম।এভাবে তাকানোর কি আছে।এক মিনিট!তোমরা কি অন্যকিছু ভেবে নিয়েছো?এই তোমাদের এত দুষ্টু চিন্তা ভাবনা আসে কিভাবে ?আমি তো ভালো দিকটা ইঙ্গিত করেছিলাম।তোমরা যে দুষ্টু কি বলব।আমাকেও দুষ্টু বানিয়ে দেও।”
রাজের এই কথাগুলো শুনে কান ঝালাপালা হয়ে গেলো মাহমুদ সরদারের।রুদ্র হো হো করে হেসে দেয়।বিরক্ত হয় হিয়া।চশমা পরা চোখজোড়া দিয়ে রাগ দেখিয়ে বলে,”আপনি এমনিতেও একজন নষ্ট পুরুষ রুদ্র ভাই।আমার ভাইয়ের কথাতে আরো বেশি নষ্ট হয়ে যাচ্ছেন।”

“তোর ভাইকে থামা তাহলে।”
“আফসোস থামাতে পারবো না।কারণ আমি যে বয়সে ছোট।”
“বুদ্ধিতে পাকনা তুই।”
“শাট আপ রুদ্র ভাই।”
সিয়া এসে হিয়ার হাত ধরে মায়ার কাছে গিয়ে বলে,”ভাবী তুমি আমাদের সাথে চলো।তোমাকে ভাইয়ের ঘর সরি তোমাদের ঘরে রেখে আসি।”
রাজ বুকের বাম পাশে হাত রেখে বলে,”আহ আমাদের ঘর।শুনেই তো হৃদপিন্ড চিলিক দিয়ে ওঠে।”
সিয়া মুখ টিপে হেসে চলে যায় মায়াকে নিয়ে।রাজ ওদের পিছনে যেতে নিলে মাহমুদ সরদার বাধা দিয়ে বলেন,”বউয়ের পিছনে পরে যাও।আগে আমার সাথে এসো।কথা আছে তোমার সাথে।”

“আমার সংসারের বড় শত্রু।”
“এই শত্রু থাকাটা তোমার জীবনে প্রয়োজন।”
মাহমুদ সরদার চলে গেলেন মিটিং রুমে।রাজ এসেই দরজা বন্ধ করে দিলেন।ঘরে এসে বাবা ছেলে ঘর কাপানো হাসি হাসতে থাকে।দুজনের হাসিতে এটা প্রকাশ পায় যে তারা আগে থেকেই জানতো মায়া আজকে আসবে আর মায়ারাজের বিয়েটা হবে।কিছুক্ষণ হাসার পর হাসি থামিয়ে মাহমুদ সরদার বলেন,”অবশেষে তোমার বউকে তোমার করে দেওয়া হলো।খুশি তো তুমি?”
“ভীষন খুশী বাবা।যাকে পেতে জীবনের এতগুলো বছর অধীর আগ্রহে দিন গুনতে থাকলাম তাকে পেয়ে খুশি না হয়ে পারি।”

“হুমম,কিন্তু মায়া মাকে চোখে চোখে রাখতে হবে।কোনো অঘটন ঘটানোর সুযোগ দেওয়া যাবে না।আগে জানতে হবে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিসটি কোথায়।”
“চিন্তা করো না বাবা।আগে আমাদের জিনিসটি হাতে পাবো তারপর সবার ব্যাবস্থা আমি নিজেই নিবো।”
“বেশি দেরি যেনো নাহয়।তোমার বউয়ের ধৈর্য কম।সে কিন্তু তোমার কার্য সিদ্ধির আগেই সবাইকে পরপারে পাঠিয়ে দিবে।”
“এটাই তো ভয়।তবে আমি আমার বউকে সেই সুযোগ দিবই না।”

বলেই দুষ্টু হেসে রাজ দরজা খুলে।সোজা চলে যায় শীষ বাজাতে বাজাতে।দরজার কোনায় সোনালী দাড়িয়ে ছিল।যে এতক্ষণ কান পেতে ছিলো কিন্তু শুনতে পায়নি কিছুই।রাজ যেতে যেতে শীষ বাজিয়ে গান গাইছে,”ডাইনির দিন হইবো রে শেষ,আমার বউ ডেমো দেখাইলো যে বেশ।ছলাকলা আর হবেনা পূরণ।বউ তোমাকে পাঠাইবে বৃন্দাবন।”
কথাটা গানের মাধ্যমে সোনালীকে বুঝিয়ে দিলেও সোনালী বুঝলো না কিছুই।ওড়নার আচল মুষ্টি করে ধরে ঘরে চলে যায়।রাজ যাবে তার বাসরে।বউ তার অপেক্ষায় আছে বলে কথা।কিন্তু পথিমধ্যে বাধা হয়ে দাড়ালো মিলি সিয়া হিয়া ও রুদ্র।ভাই বোনদের দেখে রাজ ভ্রুকুটি করে বলে,”বাসরে যাচ্ছিলাম তো ভাই।কোনোকিছু চুরি করে পালাচ্ছি না যে এভাবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকবি আমাকে আটকাতে।”

রুদ্র বুকে দুই হাত গুঁজে বলে,”বাসরে বর চোরের মত গেলে তো তাকে আটকাতে হবেই।”
“আব্বে ব্যাটা রুদ্র!আমি আমার ঘরে আমার বউয়ের কাছে আমার বাসর করতে যাব। এতে মনোবল শক্ত করা লাগে।তুমি আমাকে চোর উপাধি দিতে পারো না।”
“আচ্ছা দিলাম না চোর উপাধি।এবার বাসরে যাওয়ার টাকাটা দেও।”
“বাসর করে বাচ্চার বাপ হবো আমি।তাহলে বাসরের টাকা কেন পাবে তুমি?
“কারণ বাসর করবে তুমি কাকা হবো আমি।এবার কাকা হওয়ার আগে দিয়ে দেও তোমার বাসরের টাকাখানি।”
হিয়া রুদ্রকে হাতের কনুই দিয়ে ঘুতা দেয়। পেটে ব্যাথা পেলো রুদ্র।রাজকে প্রশ্ন করে,”তোমার এই উপন্যাস প্রেমী বোনটা কি খালি উপন্যাস পড়ে ঘুতা মারতেই শিখেছে নাকি প্রেম ট্রেম কিছু শিখেছে?”
“আমার বোনের প্রেম বিয়ের পর হবে।ছোট মানুষের প্রেম মানায় না।ও আর প্রেম আকাশ পাতাল দূরত্বে।ওদিকে নজর দিবে না আমার বোনেরা।”

মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ৪

হিয়া রুদ্রকে দেখিয়ে বিজয়ের হাসি দিলো।রুদ্র ডোন্ট কেয়ার ভাব করে বলে,”তোমার বোনের পালা পরে আগে বউকে দেখো।”
“তাই তো দেখতে চাই।”
“টাকাটা দিয়ে বানিয়ে দেও আমাকে কাকা।”
রাজ পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে দিলো ভাই বোনেদের মাঝে।যেটা নিয়ে ওরা খুশি হয়ে দরজা ছেড়ে দিলো।রাজ হাফ ছেড়ে চলে গেলো ভিতরে।এবার তো তার বাসরের পালা।

মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ৬

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here