মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ৭১+৭২
ইশরাত জাহান
“হিয়াপাখি!”
“হুমমম?”
“ভালোবাসিস আমাকে?”
হিয়া পাশ ফিরে তাকিয়ে চোখের চশমা ঠিক করতে নেয় কিন্তু তার আগেই রুদ্র চশমা নিজ হাতে ঠিক করে দেয়।চোখটা এখনও প্রশ্নসূচক করে রাখা।হিয়া একটু ঢোক গিলে বলে,”কেন জানতে চান রুদ্র ভাই?”
রুদ্র ঠোঁট কামড়ে হাসে।উত্তর দিলো না তাকে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো।কিছুক্ষণ পর গম্ভীর দৃষ্টি রেখে বলে,”আমি ভাই না হবু জামাই।”
“এতদিন ভাই ডাকতে ডাকতে অভ্যস্ত।”
“অভ্যস্ত বদলা।”
“বিয়ের পর বদলাবো।”
“এই বালের বিয়েটা কবে হবে এটাই তো বুঝতে পারছি না।”
দুজনের মাঝে তৃতীয় কন্ঠ পেয়ে হিয়ার লাইব্রেরির দরজার দিকে চোখ রাখে দুজনে।সিয়া বিরক্ত হয়ে বলে,”একটা কথা বলে দেই তোমাদের।শোনো রুদ্র ভাই তোমার ভাইয়ার অপেক্ষা করতে হবেনা।উনি মনে হয় আমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিয়েই যাবেন কিন্তু বিয়ে আর করবেন না।উনি বিয়ে না করলে তুমি করবেনা এমন মনস্থির রেখো না।”
রুদ্র সহমত পোষণ করে বলে,”আমি তো চাই বিয়েটা করতে।আমার বাপ তো তার গুণধর বড় পুত্রের আগে বিয়ে না দিয়ে আমার বিয়ে দিবেই না।এক ভাইয়ের জ্বালায় আমার জীবন অতিষ্ঠ।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হিয়া দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোরা বিয়ে বিয়ে করিস কেন?আদ্র ভাই এমনি এমনি কানাডা যায়নি।বাইরের দেশে ক্যারিয়ার গড়তে যায়। যেমনটা আমাদের ভাইয়েরা পড়াশোনা করতে বাইরে যেতো।একজন সার্জেন্ট হিসেবে তার কাজের চাপ বেশি থাকে।ওয়াপ্রেশন এমনি এমনি করেনা তাকে তো এজন্য প্রশিক্ষণ নিতে হয়।আধুনিক প্রযুক্তি বের হবার কারণেই তো হঠাৎ করে আদ্র ভাই গেলো।না গেলে বাংলাদেশের সার্জেন্ট বিদেশিদের সাথে দেশের চিকিৎসা উন্নত করবে কিভাবে?”
সিয়া মেডিকেলের একটা বই হাতে নিয়ে বলে,”ওই এলেন আরেক বিদ্যাসাগর।একাডেমিকের দিকে তো মন দেয়ই না আবার আসে একেকজনের ক্যারিয়ার দেখতে।”
“আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবিনা মানে এই না যে অন্যের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে দিবো না।আদ্র ভাই যথেষ্ঠ ভালো মানুষ।তুই শুধু শুধু রাগ দেখাস।”
“হ্যাঁ!লোকটা এতই ভালো যে আমার সাথে এই তিনমাসে একবারও কথা বলেনি।”
“সে তো মেজো বাবার সাথেও বলেনি।রুদ্র ভাইয়ের কাছ থেকে শোন।”
“তোর বালের ভাই আমি।হবু জামাইকে ভাই বলে!”
সিয়া হেসে দিয়ে বলে,”বলদকে আমার জা বানাতে চেয়েছো।এখন ফল ভোগ করো।”
“শুধু বলদ না আস্ত একটা নিরামিষ।”
বলেই হাই ফাইভ দেয় সিয়া আর রুদ্র।হিয়া রাগে ফুঁসে উঠে।চশমাটা এর কারণে নাকের ডগায় আসে।ওই চশমা আঙুল দিয়ে উঠিয়ে সঠিক জায়গায় রেখে বলে,”তোরা দুটোই আমার লাইব্রেরি থেকে বের হ।”
“এটা কি তোর একর বাপের লাইব্রেরি যে থাকতে পারবো না?”
“আমার বাবার বাড়ি এটা তার কারণেই এই লাইব্রেরি আমার।”
“ওই বাপটা আমারও।তাই বেশি বকবক করবি না।আর কথায় কথায় আমার দেবরকে অপমান করবি না।”
“কি করবি রে!তোর দেবরকে অপমান করব না খুন করব এটা আমি বুঝব।”
রুদ্র দুইবোনের ঝগড়া দেখছে।না পেরে চিল্লিয়ে উঠে বলে,”থাম তোরা দুটোতে।ভাই আজকে রাতের ফ্লাইটে রওনা দিবে।”
“তারমানে কাল আসবে আদ্র ভাই?”
“হ্যাঁ।”
সিয়া মুখ ভেংচি দিয়ে বলে,”এসে কি হবে?সেই তো মহান হিয়ার কথামত আবারও ক্যারিয়ার গড়তে যাবে।”
“তুই বড্ড অধৈর্য সিয়া।”
“তোর তো কষ্ট নেই।রুদ্র ভাই যথেষ্ঠ কেয়ারিং তো তাই বুঝবি না আমার কষ্ট।”
“আদ্র ভাই কেয়ারিং না?”
“আমি তো দেখি না।”
“আচ্ছা তাই!তাহলে তোকে নিয়ে আদ্র ভাই এত চিন্তিত কেন?তুই ভালো ডাক্তার হতে চাষ আর আদ্র ভাই তার ব্যবস্থা করতে এত খাটছে। তোরা স্বামী স্ত্রী যেনো একই স্থানে থাকতে পারিস তার চেষ্টা করে।যেকোনো হামলা হলেই আদ্র ভাই নিজের জীবন বাঁচানোর আগে তোকে আগলে রাখে।তোর জ্বর আসলে আদ্র ভাই আমাকে পাগল করে দেয় যেনো আমি তোকে এটা দেই ওটা দেই।তুই মাথা ব্যথায় ঘুমিয়ে থাকলে আদ্র ভাই আমাকে কল দিয়ে বলেন প্রেয়সীকে এটা দেও ওটা দেও।ওর ঘুমের বিরক্ত করবে না।লাইট জ্বালিয়ে যেনো আমি উপন্যাস না পড়ি ওই সময়টায় কারণ তুই অসুস্থ হবি।আদ্র ভাই একবার এক্সিডেন্ট করে তোকে জানানো নিষেধ থাকে।এই যে আগেরবার তোদের বিয়ে হবার কথা ছিল কিন্তু আদ্র ভাই দেরি করে আসে কানাডা থেকে কেন জানিস?
কারণ লোকটার এক্সিডেন্ট হয়।টানা এক সপ্তাহ জ্বর ছিল।আমরা ভাইয়ের বিয়েটা ইনজয় করি তোর সাথে ভাইয়ার কোনো কথা হয়নি মানে ধরে নিলি সে তোকে ভালোবাসে না বাহ!সিয়া আমরা না পুরুষ মানুষের ভালোবাসা দেখতে পাইনা কারণ তারা অতি সহজে সেটা প্রকাশ করেনা।আদ্র ভাইকে ভালোবাসিস তুই কিন্তু ভাইয়ের ব্যক্তিত্ব চিনতে পারলি না।যদি বুঝতে পারতিস তুই যাকে ভালোবাসিস সে গম্ভীর ব্যক্তিত্বের তাহলে তুই এতগুলো অবজেকশন রাখতি না।আদ্র ভাই গম্ভীর কিন্তু তুইও ইগো নিয়ে থাকিস।তোর মধ্যেই ছোট বড় হবার একটা স্থান গড়ে উঠেছে।মেয়েদের যে ইগো ওটা খুব ভয়াবহ হয়।
আশেপাশের কারো পরোয়া করেনা তখন। জাস্ট এক্সাম্পল আমাদের ভাবী।ছোট বাবার লাশের দিকে এক পলক তাকায়নি।এটাতে আমি তার দোষ দিব না।কিন্তু তোর ব্যাপারে আমি তোকে দোষ দিব।আদ্র ভাইকে একা দোষী করিস না।তুইও আদ্র ভাইকে বুঝতে পারিস না। ভালোবাসতে গেলে একটু মানিয়ে নিতে হয়।আদ্র ভাই তোর জন্য অনেকটা মানিয়ে নিয়েছে।রুদ্র ভাইয়ের মত এতটা মিশুক আদ্র ভাই না।মেজো মা মারা যাওয়ার কারণে আদ্র ভাই বেশি আঘাত পায় সেখান থেকেই গম্ভীর হয়ে ওঠে।হ্যাঁ বিয়ের ডেট বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এতে আদ্র ভাই আনন্দিত না।আদ্র ভাইয়ের একটা মেডিকেল বইয়ে আমি হঠাৎ একদিন দেখি উনি নিজেই লিখে রাখেন,আমি দূরত্ব বজায় রাখতে চাইনা প্রেয়সী।আমিও চাই খুব দ্রুত বিয়ে করে সুখে সংসার করতে কিন্তু আমাদের যে স্বপ্ন সেটাও তো পূরণ করতে হবে।একবার তুমি স্বপ্ন পূরণের কাছে আসলে আমার ব্যস্ততা কমে যাবে।”
সিয়া নীরবে সব শুনছে।রুদ্র স্থির নয়নে হিয়াকে দেখছে।এই তিনমাসে সিয়ার মনেও ক্ষোভ জমে ছিল কিন্তু আজ নেই।আসলেই আদ্র চাপা স্বভাবের। সে চায় সিয়া তার ভালোবাসা নীরবেই বুঝুক।কিন্তু চাইলেই তো সম্ভব না।সিয়া এতকিছু ভাবেনি।তার মধ্যে ভিন্ন ভাবনা জমা দেয়।আর এসবের কারণেই সিয়া নিজেকেও একটু একটু করে আদ্র থেকে দূরে করেছে।কিন্তু ভালো তো সে বাসেই।আচমকা রুদ্র হাততালি দেয়।হিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালে রুদ্র বলে,”ভাসুরের থেকে ছোঁয়াচে রোগ পেয়েছিস মনে হয়।নাহলে আমাকে ভালোবাসার কথা মনে বলিসনা?”
“ধুর!এই লোক সবসময় থাকে প্রেম নিয়ে।”
সিয়া মুচকি হেঁসে বলে,”আমি যাই রে।তোরা একা সময় কাটা।”
“ঘরে গিয়ে কান্না করবি নাকি?”
হিয়ার কথা শুনে সিয়া মৃদু হেসে বলে,”আমাকে নিয়ে ভাবছিস যে?”
“কারণ তুই আমার বাবা মায়েরর মেয়ে।”
“তোর কিছু হইনা?”
“ভুলবশত বোন আমার।”
ম্লান হেসে সিয়া বলে,”পাগলি বোন আমার।কান্না করব না আমি।রুদ্র ভাইয়েরও তো তোর সাথে আলাদা গল্প করতে ইচ্ছা করে।সারাদিন ইনভেস্টিগেশন করে এসে এটুকু সময় তো সেও ডিজার্ভ করে।”
“যাক কেউ তো আমার কষ্ট বুঝলো।”
সিয়া হেসে দিয়ে চলে যায়।হিয়া কোনো ভাব প্রকাশ না করে বইয়ের পাতা মেলে।ওটা বন্ধ করে রুদ্র বলে,”ওই চোখটা একটু আমার দিকে ফেরা হিয়াপাখি।”
হিয়া তাকালো রুদ্রের দিকে।রুদ্র মিষ্টি হেসে বলে,”এবার ভালো লাগছে।বুকের বাম পাশটায় ঠান্ডা বাতাস বইছে।”
হিয়া চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসে।লজ্জা পেয়েছে মেয়েটা।
রাজ এসেছে রাতেরবেলা।মায়া সন্ধ্যায় চলে আসে।এসেই মেহরাজকে নিয়ে খেলায় মেতে থাকে।রাজ ক্লান্ত শরীরে এসেই বউ ও বাচ্চার পাশে বসে।মায়া মেহরাজের হাতদুটো ধরে রাজের দিকে চোখ রেখে বলে,”কি হয়েছে মন্ত্রী মশাই?”
“কাজের চাপ বেশি এখন।সামনেই ইলেকশন তো।”
“আমাদের সন্তান এবার বাবার ইলেকশন দেখবে।”
“হুমম,কিন্ত এবারের ইলেকশনে ঝামেলা আছে।”
“কেন?”
“বিরোধী দল চটে আছে।পরপর চারবার মন্ত্রীর আসন পেয়েছি আমি তাই।”
“এতে তোমার অন্যায় কোথায়?তোমার সততা দেখেই তো জনগণ ভোট দেয়।”
“সে তো ঠিক আছে কিন্তু এবার ওরা এতটাই ক্ষেপে আছে যে বস্তিতে গিয়ে জনে জনে হুমকি দিয়ে আসছে।”
“মানে ক্ষমতার অপব্যবহার।”
“হুম।”
“ভাই জানে?”
“জানে কিন্তু এখনই একশন নেওয়া যাবে না।”
বলেই মেহরাজকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কোলে নিয়ে মেহরাজের গালে চুমু দিয়ে বলে,”আমার কলিজার টুকরো তাড়াতাড়ি বড় হও।বাবার সাথে তুমিও একজন সৎ ব্যক্তি হয়ে দেশ রক্ষা করবে।”
মেহরাজ তো বাবাকে পেয়ে খুব খুশি।রাজের গালে হাত দিয়ে গাল হা করে হাসছে আর দুই পা লাফাচ্ছে।আচমকাই এগিয়ে এসে লালা গড়িয়ে পড়া গালটা রাজের মুখের বামপাশে আটকে রাখে।এটা বুঝিয়ে দেয় ছোট্ট মেহরাজ তার বাবাকে মাম মানে চুমু দিচ্ছে।রাজ খুশিতে দুইহাত দিয়ে মেহরাজকে জড়িয়ে রাখে।এখন রাজের বাড়িতে সময় কাটে মায়া ও মেহরাজের সাথে।মায়া অপলক হয়ে দেখছে বাবা ছেলেকে। মেহরাজের দাঁত ওঠেনি।রাজ মেহরাজের গালের মারির সাথে গালের কাপড় পেয়ে ছেলের দিকে তাকায়।ব্যাথা নেই বরং নিজের ছেলের থেকে ভালোবাসা আছে।এই সুখ রাজকে অন্য জগতে নিয়ে যায়।নিজের সন্তানের ভালোবাসা যেনো আলাদা প্রশান্তি।মায়া এবার বলে,”ফ্রেশ হয়ে নিন।খাবার আনছি আমি।”
“হুমমম কিন্তু আমার ডানপাশের গালটা খচখচ করছে একটা মাম দিয়ে দেও তো।”
“মন্ত্রী মশাই!”
“কি?”
“মেহরাজ আছে কিন্তু।”
“ও তো ছোট।”
“এগুলো দেখতে দেখতে শিখে যাবে।”
“ওহ,এই ব্যাপার!দাড়াও একটা আইডিয়া আছে।”
বলেই মেহরাজকে দোলনায় শুইয়ে দিয়ে বলে,”বাবা মেহরাজ চোখটা বন্ধ করো। তোমার বাবা এবার প্রেম করবে।”
মেহরাজ ছাতার মাথাও বোঝেনি কিন্তু খিলখিল করে হেসে দেয়।রাজ এবার মায়ার মুখের দিকে তাকাতেই দেখে মায়ার রাগী মুখ।পাত্তা না দিয়ে বলে,”আমার ক্লান্ত শরীরে তোমার সংস্পর্শ সকল ক্লান্তি দূর হবে।”
“আপনি পাগল মন্ত্রী মশাই।”
রাজ কোনো কথা না বলেই মায়াকে নিয়ে বিছানায় ঝুঁকে যায়।মায়ার ঠোঁট আঁকড়ে নিয়ে ব্যস্ত হয় নিজের ক্লান্ত দুর করতে।কিছুক্ষণ পর উঠে বলে,”নাহ!সেই ফিলটা পাচ্ছি না কারণ মেহরাজ আছে এখানে।ছেলের সামনে রোমান্স করতে আমার লজ্জা করে।”
মায়ার চোখ যেনো অবাকের মত বড় হলো।রাজ নাকি লজ্জা পায়!বলে,”যাক অবশেষে ছেলের সামনে রোমান্স করতে লজ্জা পাচ্ছেন আপনি।’
রাজ একটু ভেবে বলে,”ভাবছি আমি আমার টেকনিকে রোমান্স করব।”
“বাথরুম বিলাসে?”
রাজ চোখ টিপে বলে,”ব্রিলিয়ান্ট বউ আমার।”
মায় চোখ বড় বড় করে বলে,”দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসুন।রাতে খাবার খেয়ে নিন আগে।”
রাজ শুনল না মায়ার কথা।নিজের যেটা প্রয়োজন সেটা মিটিয়েই নিবে।মায়াকে কোলে নিয়ে মেহরাজের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুই একটু একা একা খেলা কর বাবা।আমি তোর আরেকটা ভাইবোন আনার ব্যবস্থা করি।”
মায়া হালকা চাপড় দিলো রাজের বুকে।রাজ নেশালো দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,”let’s go Mayaboti.”
বাথরুমে এসে দরজা লাগিয়ে মায়াকে বাথটাবে শুয়ে দিয়ে মায়ার উপর ঝুঁকে বলে,”আমার বাথরুম বিলাসে তোমাকে স্বাগতম,মায়াবতী।”
মায়া উঠতে নিবে কিন্তু রাজ উঠতে দিলো না। মেহরাজকে দোলনায় রাখার কারণেই মায়া উঠতে নেয় কিন্তু রাজ বলে,”আমাদের সন্তানের সামনে রোমান্স করলে বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগে।তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখানেই আমি আমার রোমাঞ্চকর মুহূর্ত কাটাব।”
মায়া কিছু বলেনা কিন্তু হঠাৎ রাজের গলার কাছে কাটা দাগ দেখে বলে,”এখানে কি হয়েছে?”
রাজ যে আজকে হামলার স্বীকার হয় এটা জানাতে চায়না মায়াকে।আসলে আজকে রাজের উপর হামলা করা হয়।ছুরির আঘাত লাগে গলায়।একটুর জন্য জীবন বাঁচাতে পেরেছিল রাজ।ব্যাপারটা গোপন রাখতে মায়ার ওষ্ঠ নিজের আয়ত্তে নিয়ে চুম্বন বিলাসে মত্ত হয়।মায়া ভোলেনি তার উত্তর লাগবে।তাই নিজেকে ছাড়াতে চাইলে রাজ বিরক্তির সাথে বলে,”দুষ্টুমি করবে না মায়াবতী।”
বলেই মায়ার গলায় মুখ ডুবিয়ে নিজের ক্লান্ত দুর করতে ব্যাস্ত।মায়া বুঝলো রাজ কিছুই জানাবে না।কিন্তু মায়াও কম না।তার মন্ত্রীকে কেউ আঘাত করলে সে ছেড়ে দিবেনা।খোঁজ নিবে যে এই কাজ করেছে।আপাতত রাজের সাথে মত্ত হয়ে থাকে।
পরদিন আদ্র এসেছে।সেই সাথে এসেছে বীরজারা।সবাইকে দেখে পরিবারের সকলে এক জায়গায় আড্ডা দিচ্ছে।এক সময়ে শাহানা পারভীন মুখ খোলেন,”আমরা কিন্তু মিষ্টি মুখ করার ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছি।”
সবাই ভ্রুকুটি করে তাকায়।শাহানা পারভীন এবার রাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন,”ছেলের হয়ে সুখবর দিবেনা নাকি?”
রাজিয়া বলে ওঠে,”আমি একা কেন দাদি হবার খবর দিবো?তুমিও তো এক প্রকার দাদি হতে চলেছো।”
সবাই বুঝে নিলো।রাজ এসে বীরকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আব্বে শালা কংগ্রাচুলেশন।আমি মামা প্লাস চাচা হবো।”
রুদ্র হেঁসে দিয়ে বলে,”তোমার ব্রো এক বাচ্চার থেকে দুরকম ডাক শোনার ভাগ্য হয়েছে।প্রলয়ের মামাও তুমি প্রলয়ের চাচাও তুমি আবার প্রলয়ের আংকেলও তুমি অন্যদিক থেকে হিসাব করলে প্রলয়ের ফুফাও তুমি।কারণ কাজিন ক্রস বিয়ে হয়েছে যে।এখন বীর ব্রোর বাচ্চার মামাও তুমি চাচাও তুমি।”
সবাই একত্রে বলে ওঠে,”ব্যাপারটা তো খেয়াল করে দেখিনি।”
রাজ বলে ওঠে,”হ্যাঁ তারপর তোদের থেকেও হবো।তোদের একেকটা বাচ্চা আমাকে একবার চাচা বলে ডাকবে আবার মামাও বলে ডাকবে।”
মাহমুদ সরদার বলে ওঠেন,”সব যখন হয়েই যাচ্ছো শশুর ডাকটাও এদিক ওদিক থেকেই শোনার ব্যাবস্থা করে নিও।”
“এটা তো তোমার নাতিরাই ঠিক করবে বাবা।যদি ওদের আলাদা কোনো চয়েজ না থাকে আমরা ভাই বোন একেকজনের বাচ্চার সাথে একেকজনের বিয়ের ব্যবস্থা করবো।”
রুদ্র এবার রাজের পাশে বসে বলে,”ব্যাপারটা কিন্তু ইন্টারেস্টিং হবে।আমাদের বাবাদের মত আমরাও কিন্তু ভাই বোন থেকে বেয়াই বেয়াইন হবো।”
আহান সরদার এবার সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,”এবার আমি কিছু বলি?”
“হ্যাঁ,বলো মেজো বাবা।”
“আমার হতচ্ছাড়া বড় পুত্র তো এখনো বিয়ের সময়ই পাচ্ছেনা।বলি কি আমি দাদা ডাক শুনে মরতে পারবো তো নাকি আশায় আশায় নিরাস হতে হবে?”
আদ্র আড়চোখে সিয়ার দিকে তাকালো।সিয়া কোনো ভাব প্রকাশ করেনি এবার।নীরব আছে শুধু আদ্র কি জানায় এটা জানার জন্য।যতই হিয়া বুঝিয়ে বলুক সিয়ার মন তো চায় আদ্রকে নিয়ে একটু সময় কাটাতে।বারবার আশাহত হতে ভালো লাগেনা তার।এটাও তো বুঝতে হবে।আদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সবার দিকে তাকালো।সবাই সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে তাকে দেখছে।আদ্র ভ্রুকুটি করে বলে,”কি হয়েছ?”
রুদ্র সূক্ষ্ম দৃষ্টি রেখেই বলে,”আমার জন্য দ্রুত ভাবী আনবে নাকি আমি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে আসব।”
“কে পালাবে আপনার সাথে রুদ্র ভাই?”
হিয়ার প্রশ্নে রুদ্র বলে,”যাকে বিয়ে করব সে।”
“আমার বয়েই গেছে পালিয়ে বিয়ে করতে ।”
“তুলে নিয়ে বিয়ে করব তাহলে কিন্তু মরার আগে বিয়েটা করবই।”
রাজ এবার মাহমুদ সরদারের দিকে তাকান।মৃদু হেসে বলে,”এই জীবনে আমি একা না আরো ব্যক্তি আছে বউহিনা ভুগছে।”
“দ্রুত বিদায় করো বোন দুটোকে।”
“আমি বললেই কি হবে?বোনের জামাইগুলোই তো নিয়ে যায়না।”
রুদ্র বলে ওঠে,”জামাইগুলো বলবে না ব্রো।বলো ওই একটা ব্যক্তির কথা যার জন্য আমার বিয়েটা হচ্ছে না।”
আহান সরদার হতাশ হয়ে মাহমুদ সরদারের পাশে বসে বলেন,”আমার ভাগ্যটাও হয়েছে আরেক!বড় ছেলে বিয়ে করতে গিয়ে ক্যারিয়ারের জন্য ডেট পিছায়,ছোট ছেলে বিয়ে করার জন্য সারাদিন লাফায়।”
রুদ্র বলে ওঠে,”আমার আলাদা কোনো ক্যারিয়ার নেই বাবা।তাই বিয়েটাকেই ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছি।”
“মুখে লাগাম দেও।”
“পাশে যে একটা আছে তাকে দেখতে পাচ্ছো না?সাদা পাঞ্জাবি পরে দেশ রক্ষা করা আমার হতচ্ছাড়া এসব ট্রেইনিং দেয় ভাইদের।”
মাহমুদ সরদার এসব বলাতে রাজ চোখ বড় বড় করে বলে,”আমার তো খেয়ে কাজ নেই যে লাগামহীন কথাবার্তার জন্য একটা স্কুল খুলবো।তোমরাই তোমাদের ছেলেদের সঠিক সময়ে বিয়ে দিতে জানো না তাই অবলা ছেলেরা মুখ খুলে লাগামহীন হয়ে যায়।”
আহান সরদার এবার আদ্রকে ধমক দিয়ে বলেন,”এবার কি বিয়েটা করে তোমার ভাইকে উদ্ধার করবে নাকি আবারো কোনো কাজে বিদেশ যেতে হবে?”
আদ্র সবার কথা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে।আসলে তারও দোষ আছে।বিয়ে ঝুলিয়ে রাখার দরকার কি?সিয়ার দিকে চেয়েই তো এসব করা।এগুলো তো কেউ বুঝবে না।সিয়ার পরীক্ষা ছিল।এই সময়ে বিয়ের কথা ভাবলে মেয়েটার পরীক্ষা দেওয়া হতো কিন্তু ভালোভাবে পরীক্ষা দেওয়া হতো না।তাই তো সুযোগ বুঝে আদ্র নিজেও বাইরে গেলো যেনো সিয়ার পরীক্ষা ভালো হয় আর নিজের নতুন টেকনোলজি সম্পর্কে ধারণা হয়।আদ্র কিছু বলতে নিবে সিয়া বলে,”তোমরা রুদ্র ভাইয়ের বিয়েটা আগে দেও।সমাজের দিক তাকানোর তো মানে নেই।মন্ত্রীর বাড়িতে কে কি করলো এগুলো দেখতে এমনিতেও মানুষ কান পেতে সারাজীবন থাকবেই।রুদ্র ভাইকে এতে আটকে রাখার দরকার নেই।আমাদের ব্যাপারটা পরে দেখলেও চলবে।”
সিয়ার কথা শুনে সবাই আদ্রকে দেখছে।বিশেষ করে মায়ারাজ।দুজনের চোখ আছে আদ্রের দিকে।আদ্র গলা ঝাড়া দিয়ে বলে,”আগেরবার তো এসেছিলাম বিয়ের জন্য কিন্তু পারিবারিক একটা ঝামেলার জন্যই তো আমাদের পিছিয়ে যেতে হলো।ভাগ্যক্রমে বীরের বিয়ে হয় কিন্তু ওটাও কিন্তু ছিলো একটা ট্রমা।আমি নির্ভেজাল জীবন কাটাতে চাই।তাই ওই সময় বিয়েটা করতে না করি।এখন সিয়ার পরীক্ষা ছিল আমার নিজেরও নতুন টেকনোলজি সম্পর্কে জানার
ছিলো বলেই ডেট পিছিয়ে দেওয়া।কিন্তু সব যখন মিটিয়েছেই এবার আমি আর ডেট পিছাবো না।তোমরা যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের ডেট ঠিক করো।”
সবাই হাততালি দিয়ে বলে,”তাহলে আমরা দ্রুতই বিয়ের কাজ শেষ করে নেই।”
এর মধ্যেই মিষ্টি আসে বাসায়।রাজিয়ে বলে,”আমি অর্ডার করেছিলাম।বীরজারা তরফ থেকে।”
মায়া একটা মিষ্টি নিয়ে জারাকে খাইয়ে দিয়ে বলে,”কংগ্রাচুলেশন।”
জারাও এক কামড় নিয়ে মায়াকে অন্যদিক দিয়ে খাইয়ে দেয়।মিষ্টি খাওয়ার পরেই মায়া করেই কেমন নড়েচড়ে ওঠে।”ওয়াক” করেই দৌড় দেয়।সবাই অবাক হয়ে তাকায়।মালিনী দৌড়ে গেলো।বাকিরা নিচেই আছে।কিছুক্ষণ পর নিচে এসে বলে,”আমাদের মনে হয় আবারও খুশির খবর আসতে চলেছে।খান বাড়ির সুখবর আর সরদার বাড়ির সুখবর একসাথে আসতে চলেছে।ডাক্তার ডাকো তোমরা।”
সবাই রাজের দিকে তাকিয়ে হাততালি দেয়।রুদ্র বলে দেয়,”সেকেন্ড টাইম কংগ্রাচুলেশন ব্রো।”
মৌ দেখলো সবার সাথে সাথে প্রলয় হাততালি দিচ্ছে। পিয়াশের উদ্দেশ্যে বলে,”আমাদের ছেলেটা কত খুশি দেখো।”
পিয়াশ প্রলয়কে দেখে হাসলো।সবাই মিষ্টি মুখ করে কিন্ত রাজ বিড়বিড় করে বলে,”আমার কপালে কেন এমন হয়?কিক দিতে পারিনা গোল হয়ে যায়!”
আশ্রমে এসেছে সরদার পরিবার ও খান পরিবারের সদস্য।এটা মায়ার নানার তৈরি আশ্রম।দেশ যুদ্ধের পর মায়ার নানা ব্যবসায়িক দিকে উন্নত হলেই তিনি চেয়েছিলেন দেশের অনাথ ব্যক্তিদের ঢাল গিয়ে দাঁড়াবেন।নিজের গার্মেন্টস যেটা শিবচরে ওটা তখন খুব নামকরা ছিল।সেখান থেকেই বিভিন্ন গ্রামে তাতের শাড়ি সাপ্লাই করা হতো।দেশের এক নাম্বার পজিশনে ছিলো গার্মেন্টস।যার কারণে টাকা পয়সার অভাব হয়না।লোকটা টাকার অপব্যবহার করতেন না।নিজেদের জীবন চলার ব্যাবস্থা করে বাকীটা ইনভেস্ট করেন আশ্রমে।সেই থেকেই শাহানা পারভীন ও পরে মায়া দেখাশোনা করে।মায়ার নানার ওই গার্মেন্টস ছিলো বলেই মায়া সেখান থেকে আরো দুটো আলাদা নিজের যোগ্যতায় দার করিয়েছে।
সাথে বীরের মতো ভাইয়ের অবদান অনেক।বলতে গেলে রাজ ও বীর মিলেই মায়ার ঢাল।সবাই গাড়ি থেকে নামতেই বাচ্চারা ছুটে আসে।এসেই মায়াকে জড়িয়ে ধরে।সবাই খুশি হয়।এই দশ বিঘা জমির উপর আশ্রমটির অর্ধেক স্থানে এতিম শিশুদের জন্য অর্ধেক বৃদ্ধ বাবা মায়ের জন্য।পিছনের গাড়ি থেকে মিষ্টির প্যাকেট ফলের ঝুড়ি নামছে একেক করে।সবাই সেগুলো ভিতরে নিয়ে যাচ্ছে।মন্ত্রী ও তার পরিবার এসেছে বলে এলাহী কায়দায় আয়োজন করা হয়েছে।বাবুর্চির রান্নার ঘ্রাণ ভেসে আসছে। রোস্টের ঘ্রাণ সবাই উপভোগ করলেও সহ্য করতে পারল না মায়া ও জারা।দুজনেই নাকে হাত দেয়।জারা একটু ওয়াক করে উঠতেই বীর জারার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,”পানি পান করো।”
জারা পানি পান করা শেষ করলেই সকলের মাঝে জারাকে কোলে নিয়ে দ্রুত ভিতরে চলে গেলো।যেনো এতগুলো রাস্তাজুড়ে খাবারের গন্ধে আরো অসুস্থ না হয়।প্রেগন্যান্সিতে সবার শরীরের অবস্থা এক হয়না।মায়া যদিও একটু সুস্থ থাকতে পারে জারা যেনো চেষ্টা করলেও পারেনা। বীর জারাকে নিয়ে যেতে থাকলে জারা বলে,”লোকে দেখছে তো।”
“পরোয়া করিনা আমি।”
“খারাপ ভাববে আমাদেরকে।”
“বউকে সুস্থ রাখার জন্য যদি লোকের চোখে খারাপ হয়ে যাওয়া হয় তবে আমি খারাপই থাকবো।”
“হ্যান্ডসাম!”
“ডোন্ট বি শাই জানেমান।ইটস অনলি আওয়ার লাইফ।”
জারা মৃদু হেসে বীরের গম্ভীর মুখের দিকে তাকায়।রাজ মায়ার দিকে চেয়ে থাকে।মায়া পাশ ফিরে রাজের দিকে তাকালে দেখে চোখ পাকিয়ে বলে,”খবরদার না।আমি সুস্থ আছি।”
“একটু অসুস্থ হলেই পারতে।”
“মন্ত্রী মশাই!”
রাজ মৃদু হেসে বলে,”চলো ভিতরে।”
প্রলয় আছে সিয়ার কোলে আর মেহরাজ আছে হিয়ার কোলে।ফুফু হবার পর থেকেই সিয়া আর হিয়া কোল পাল্টাপাল্টি করেই দিন পার করে।ওদের বিয়ে আর দুইদিন পর।কেনাকাটা শেষ শুধু তারিখটা আসার অপেক্ষা।ভিতরে ঢুকতেই সবাই দেখতে পায় মায়ার নানার ছবি বড় করে দেওয়ালে টাঙানো আছে।মাহমুদ সরদার সেই ছবি দেখে বলেন,”মহান ব্যক্তিদের সবসময় সম্মানের সাথে দেখা হয়।একজন আদর্শ লোকের পরিচয় দেওয়ায় আজ উনি মারা গিয়েও সম্মান পাচ্ছেন।ওনার সম্মানার্থে দেয়ালে ওনার মস্ত বড় ছবিটা টাঙানো।এর থেকে আর কিই বা চাওয়ার থাকে?”
“তুমি চাইলে ভবিষ্যতে তোমার ছবিটাও টাঙানো যাবে বাবা।”
রাজের কথা শুনে মাহমুদ সরদার চোখ বড় বড় করে বলেন,”হতচ্ছাড়া তুমি আমার মৃত্যু কামনা করো?”
“আমি কখন তোমার মৃত্যুর কামনা করলাম?আমি শুধু বললাম এমনটা সম্ভব হবে যদি তুমি চাও।”
মাহমুদ সরদার আরো কিছু বলতে নিবেন মালিনী খান হাত চেপে ধরে বলেন,”ছেলের সাথে পাগলামো করো কেন?সিনক্রিয়েট না করে চুপচাপ চলো আমার সাথে।”
“আমি সিনক্রিয়েট করছি?”
“এইমাত্র চেচালো কে শুনি?এখন কথা না বাড়িয়ে চলো।লোকে হাসাহাসি করবে।”
বেচারি মাহমুদ সরদারের ব্যাপারটা কেউ বুঝলো না।সবসময় তাকেই জনেই পচানো হয়।হোক সন্তান বা হোক বউ যে পারে তাকেই যেনো হারিয়ে দিবে।
নিজেদের স্থানে বসে মাহমুদ সরদার দুই মেয়ের দিকে তাকালেন।সিয়া আর হিয়া এখনো দুই ভাতিজা নিয়ে খেলছে।পাশেই তাদের হবু বরেরা আছে।মাহমুদ সরদার আশ্রমের হেড কর্মীকে বলেন,”সামনেই আমার মেয়েদের বিয়ে।বিয়ের জন্য আশেপাশের সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হবে।কিন্ত ওদের ইচ্ছা এই আশ্রমের মাঝেই বিয়েটা স্মৃতি করে রাখতে।এর আগে কয়েকবার আসাতে দুই মেয়ের মনেই পরিবেশটা বেশি ভালো লেগেছে।আমরা চাই এই আশ্রমের মধ্যে ধুমধাম আয়োজন করতে।আমার বউমা মায়ার ভাষ্যমতে আপনাদের সুযোগ সুবিধা দেখে তারপর যা আয়োজন করা হবে ও রাজি।আমরা মায়া মায়ের সিদ্ধান্তে খুশি।আপনারা কি চান?”
সবাই খুশিতে নেচে ওঠে।বিয়ের অনুষ্ঠান মানে ভালো ভালো মজার খাবার পাবে।বাচ্চারা চিল্লিয়ে সম্মতি দেয়।সাথে বৃদ্ধ কয়েকজন বলেন,”আমরা অনাথ মানুষ।আমরা বিয়ে দেখবার সুযোগ এখন আর পাইনা।আমাদের কেউ দাওয়াতও দেয়না।সেখানে আপনারা এই সুযোগ করে দিবেন।না করা যায়না।”
বাচ্চারা তো খুশিতে লাফিয়ে ওঠে।রান্না শেষ করে বাবুর্চি খাবারের ডেক নিয়ে অন্যদিকে রাখে।আদ্র এবার সিয়ার দিকে চেয়ে বলে,”তুমি খুশি তো প্রেয়সী?”
সিয়া ঠোঁট চেপে হেসে আদ্রের দিকে তাকালো।প্রলয়কে দেখিয়ে বলে,”সবার মত কি আমরাও বিয়ের দুইমাসের মধ্যে বেবী নিবো নাকি একটু দেরি করে?”
সিয়া লজ্জায় চুপ করে ঠোঁট কামড়ায়।আদ্র বাধা দিতে বলে,”উহু,ঠোঁট কামড়াবে না।আর তো মাত্র কিছুদিন।এরপর ঠোঁটের মালিক হবো আমি।তাই এটাকে সেফ রাখো।যত অক্ষত করার প্রয়োজন হবে তার জন্য আমাকে পাবে।”
সিয়া মাথা উঁচিয়ে আদ্রকে দেখে কেঁপে ওঠে।শুকনো ঢোক গিলতে নিলেই আদ্র হেসে দিয়ে বলে,”বোকা প্রেয়সী আমার।একটুতেই নার্ভাস হয়ে যায় আবার ডাক্তার হবে।”
সিয়া চুপচাপ প্রলয়ের দিকে ফিরল।ছেলেটা ঘুমিয়ে গেছে।মৌকে দেখিয়ে বলে,”প্রলয় ঘুমিয়ে গেছে ভাবী।”
মৌ আফসোস করে বলে,”ছেলেটাও হয়েছে বাবার মত।সারাদিন ঘুমায়।এত শান্ত স্বভাবের ছেলে তো আমি চাইনি।একটু দুষ্টু হবে সারাদিন না হোক আমাকে একটু হলেও তো বিরক্ত করবে।আমার তো মনেই হয়না আমি কারো বউ আমি কারো মা।”
হিয়া চোখ বড় বড় করে বলে,”এদিকে মেহরাজ বাবা হয়েছে পুরো উল্টো।এরমত বাচ্চা আমি আমার জীবনে একটাও দেখিনি।টিভিতে খবর দিলে কান্না করে যেই ডিজে দেই ওমনি খিলখিল হেসে দেখে।এইটুকু বাচ্চার কিনা ডিজে দেখতে ভালো লাগে!”
মাহমুদ সরদার এবার রাজের দিকে একবার দেখে আক্রোশ মিটিয়ে বলেন,”বাপটা কেমন দেখতে হবেনা!যেমন বাপ তেমন ছেলে।”
“আমার বাপটাও কি এমন ছিলো বাবা?”
“হতচ্ছাড়া আমিই তোর বাপ।”
“ওহ,আমি তো ভুলেই গেছি।”
মায়া চোখ রাঙিয়ে বলে,”আসলেই বাবা ঠিক বলেছে।আমার মেহরাজ আমার মত একদমই হয়নি।ওর সাথে দুষ্টুমি না করলে ও ওইটুকু পা দিয়ে লাথি দেয়।যেই ওর সাথে একটু খেলতে হবে গল্প করতে হবে ওমনি লাফিয়ে লাফিয়ে হাসবে।”
“রাজ বেইবি কি তোমাকে লাথি দেয় মায়া?”
বীর দাঁত খিঁচে বলে,”যদি খেতে না চাও আমার লাথি তাহলে বন্ধ করো তোমার বলা রাজ বেইবি।”
জারা মুখ ভেংচি দিয়ে সামনে তাকালো।আজ অনেকদিন পর বীরকে রাগিয়ে দিলো।একটু ভেবে বলে,”আচ্ছা বাচ্চাগুলো যদি বাবার ফটোকপি হয়ে থাকে তাহলে আমার বাচ্চাটাও কি আমার স্বামীর ফটোকপি হবে? মানে রসকষহীন আর রাগী।”
বীরের চাহনি দেখে জারা বাকিটা বলেনি।রাজিয়া বলে ওঠে,”আমার বউমাকে ভয় দেখাবি না।ও তো ভুল কিছু বলেনি।তোর মত স্বামী নিয়ে যে সে ধৈর্য ধরে সংসার করছে এতে বেস্ট বউমা পুরস্কার জারা পাবে।এখন যদি হয় আমার নাতি বা নাতনি এমন তাহলে জীবন টোটাল গেলো।”
“মা তুমিও?”
“অবশ্যই আমিও।”
জারা এবার রাজিয়ার বাম বাহুতে মাথা রেখে বলে,”বেস্ট বউমার সাথে বেস্ট শাশুড়ি পুরস্কার তুমি পাবে মা।”
দুজনের ভালোবাসা দেখে চুপ হয়ে গেলো বীর।আজ এখানে মায়া ও জারার জন্য সবার আসা।এত ঝড় ঝামেলায় পর সুখবর পাওয়া গেলো।হ্যাঁ প্রলয় ও মেহরাজ সুখবর ছিলো কিন্তু ওই সময় আনন্দ ফুর্তি করার পরিবেশ ছিল না।নিজেদের কর্ম জীবন আবার সাথে শত্রুর আক্রমণ।সব মিটিয়ে আজ ওরা একটা ছুটির দিন বের করে।যদিও দুজনে শাহী খাবার খেতে পারবেনা তাও দুজন পোয়াতি মেয়ের জন্য আজ খাবারের আয়োজন। মেহরাজের সময়ও চেয়েছিল আশ্রমের লোকেরা।তখন না করে দেয় মায়া। বিভান খানের কুনজর থেকে বাঁচানোর জন্য।ওরা না জেনেই মন খারাপ করে।এবার নিজেদের থেকে আসলো সবাই।মায়া ওর জারার সামনে সাজানো খাবারের থালা। আনা মাত্রই জারা আবারও ওয়াক করে।সহ্য হচ্ছে না জারার এত ফ্লেবার। রাজিয়া মাঝে মধ্যে দুশ্চিন্তা করে কিন্তু শাহানা পারভীন জানান,”এরকম অনেকের হয়।এসব খাবারের গন্ধ আমিও সহ্য করতে পারতাম না।লেবু চটকে ভাত খেতাম অনেক সময়।”
বীর কিছু বলতে নিবে জারা হাত ধরে বলে,”রাগ দেখাবে না।এনারা ফর্মালিটি পালন করছে।আমার খারাপ লাগতে পারে এজন্যই মায়ার সাথে আমাকেও খাবার দিচ্ছে।”
কানে কানে বলে সবার উদ্দেশ্যে বলে,”আমি খাবো না।”
মায়া দুগাল খেয়ে বলে,”আমি আর খেতে পারবো না।নষ্ট না করে বাচ্চারা এক থালাতে মজা করে খাক।”
“আমরাও খাবো ওদের সাথে।”
হিয়া আগ বাড়িয়ে বলে ওঠে।সিয়া তাল মিলিয়ে বলে,”হ্যাঁ হ্যাঁ বাচ্চাদের সাথে আমরাও আছি।এক থালায় খেলে মনে হবে পিকনিক করছি।”
দুই বোন ওঠাতে দুই ভাইও উঠে ওদের পাশে বসে ওদের সাথে।হিয়া অবাক হয়ে বলে,”আপনিও খাবেন?”
“একসাথে চা শেয়ার করতে পারি আর একসাথে খাবার শেয়ার করতে পারবো না?”
পিছনে ঘুরে সবার দিকে তাকাতেই দেখে সবাই খাওয়ায় ব্যাস্ত।বাচ্চারা নিজেরাও থালা থেকে রোস্টের পিস নিয়ে তৃপ্তি করে কামড়ে খাচ্ছে।সুযোগ বুঝে এক লোকমা হিয়ার। সামনে ধরে।হিয়া মৃদু হেসে নিলো।এদিকে সিয়া নিজের মত পোলাও আর গোস নিয়ে যেই গালে নিবে ওমনি ওই লোকমা নিজের গালে নেয় আদ্র।সিয়া অবাকের সাথে দেখলে আদ্র ইশারা করে বলে,”অনেক মজা।”
সিয়া আমতা আমতা করে বলে,”খাইয়ে দিবো?”
“দিলে মন্দ হয়না।”
সিয়া আশপাশ তাকিয়ে চুপিচুপি সুযোগ বুঝে দিয়ে দেয় আদ্রের গালে।ভেবেছে কেউই দেখতে পায়নি।এদিকে রুদ্র আচমকা বলে,”হবু বরকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য আশেপাশে তাকিয়ে এত সুযোগ খোজার কি আছে?আমরা কি বাঘ নাকি ভাল্লুক?”
সিয়া লজ্জা পেয়ে পিছনে তাকালো।হিয়া কনুই দিয়ে ঘুতা দেয় রুদ্রের বুকে।রাজ ফিচেল হেসে বলে,”আমার বোনেদের লজ্জায় ফেলছো ব্যাটা রুদ্র।বিয়ের পর কিন্তু ওরা বউ হয়ে প্রতিশোধ নিবে।”
“তোমার বোন এমনিতেও প্রতিশোধ নিতে ভালোবাসে ব্রো।এটা নিয়ে আমি সন্দেহ রাখছি না।”
“রুদ্র ভাই!”
“আমি তোর বালের ভাই।”
কানে কানে বললেও হিয়া চোখে রাগ দেখায়।রুদ্র ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে খাচ্ছে।সিয়া অনেক আগেই উঠে চলে যায়।আদ্র ফেলফেল করে দেখে রুদ্রের দিকে ফিরে বলে,”তোর জন্য মেয়েটা না খেয়ে উঠে গেলো।”
“খাচ্ছিলো কোথায় ও তো খাওয়াচ্ছিল।তোমার মত দামড়া একজনকে খাইয়ে দেয়।”
“শাট আপ রুদ্র।”
“শাট আপ রুদ্র ভাই।”
আদ্র ও হিয়ার ধমক কানে নিলো না রুদ্র।উল্টো বলে,”আজকাল সত্যি কথার দাম নেই।মুখের উপর শুনতে হয় শাট আপ।”
আদ্র একটা প্লেটে খাবার নিয়ে বাইরে যায়।মাহমুদ সরদার ও আহান সরদার মৃদু হাসছেন।ছেলে মেয়েদের বিয়েটা তাদের মনমত হবে।বাবা হিসেবে তাদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে সন্তানদের সেভাবেই দেখছেন।আদ্র চলে যেতেই আহান সরদার নিজের বউকে মানে অবনীর কথা ভাবছেন।অবনীকে নিয়ে এভাবে কত মিষ্টি মধুর সময় কাটাতো।এখন ধীরে ধীরে বৃদ্ধ হচ্ছেন।এক সময় ছেলেদের মতোই ইয়ং ছিলেন বউকে নিয়ে কত ঘুরতে যেতেন।বউয়ের লাজুক মুখে দেখে তাকে লজ্জায় ভড়ে রাখতেন।ভাবতেই চোখের কোণা দিয়ে পানি জমতে শুরু করে।মাহমুদ সরদার নিজেও অনেককিছু কল্পনা করেন।সেই সাথে নিজের ভাই মোহন সরদারকে নিয়েও ভাবেন।পুরোনো অতীত তিক্ত হলেও জীবনের এক অংশ।সেখানে যে শুধু তিক্ততা ছিলো এমন না তার আগেই কিছু সোনালী দিন ছিল।আহান সরদারকে শান্তনা দিতে অন্য কথা নিয়ে বলেন,”আমরা দুই অবশেষে বেয়াই হবো।”
“অবনী কিন্তু তোমার মেয়েদের খুব ভালোবাসত।ছেলে দুটোও মায়ের পছন্দকে না জেনেই মূল্য দিলো।”
“মোটেই না তোর ছেলেদের সামনেই তো অবনী বলতো এমন লক্ষী মেয়ে দুটিকে আমার ঘরের বউ বানাবো।সেখান থেকেই তোমার ছেলে দুটোর নজর আমার মেয়েদের উপর।”
“এটাও ঠিক।আমার বউয়ের বাধ্য সন্তান ছিল তো আমার ছেলে দুটো।অন্যকিছু না মানলেও মায়ের দেখা পাত্রী দুটোকে মানতে রাজি।”
হেসে দেয় দুই ভাই।মাহমুদ সরদারের মনে মনে আফসোস থেকেই যাবে মোহন সরদার কেন এমন হলো না।বাবার ছোট বউয়ের সন্তান হয়েও আহান কত ভালো মিলেমিশে থাকে।বউকে ভালোবাসে এখনো।কোনো খারাপ কাজে লিপ্ত না হয়ে বরং সন্তানদের সৎ পথ দেখানোর চেষ্টাটাই করেছে।এমনটা মোহন সরদার হলে আজ পরিবারের মাঝে শূন্যতা থাকতো না।তিনভাই একসাথে আজ এখানে হেসেখেলে কাটাতো।মানুষ যাই বলুক ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই কান্না আসে মাহমুদ সরদারের।নিজের মায়ের পেট কেটে আসা ভাই বলে কথা।পারেননা ভাইকে ঘৃণা করে থাকতে।কান্না আসছে এখনও।মায়ার মুখের দিকে চেয়ে ভাইকে নিয়ে ভাবছে।হঠাৎ মায়া চোখ রাখলো তার দিকে।মাহমুদ সরদারকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মায়া কিছুই বুঝলো না।প্রশ্ন করে,”কিছু লাগবে বাবা?”
মাহমুদ সরদার মলিন হেসে বলেন,”না মা তুমি কিছু তো খাও।”
বলতে না বলতেই মায়া ও জারার জন্য সাদা ভাত আর সবজি সাথে মাছ ভুনা আনে।ওগুলো রাখতেই বলে,”দেরি হয়েগেলো আপনাদের দুজনের খাবার আনতে।স্যার ওগুলো মাত্র দিয়ে রান্নার খবর পাঠালেন তো তাই দেরি করা।স্যারের কথা মতোই তেল মশলা অল্প দিয়ে রান্না করছি।”
মায়াবতীর ইচ্ছা সিজন ২ পর্ব ৬৯+৭০
রাজের উদ্দেশে বলে কথাগুলো।মায়া মুখে হাসি ফুটিয়ে দেখলো রাজকে।মায়ার সবদিকে খোঁজ নেয় রাজ।মায়াকে কখনও কষ্ট পেতে দেয়না।এই তো রাতের বেলায় মায়ার পা কামড়ে ওঠে।অস্বতি লাগছে শরীরে।রাজ বুঝতে পেরে না ঘুমিয়ে মায়ার পা টিপে দেয়।মায়া হেসে দিয়ে রাজের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,”মাই বেস্ট হাসব্যান্ড।”
রাজ টুক করে মায়ার কপালে চুমু দিয়ে বলে,”তুমিও আমার বেস্ট বউ।”
