মায়াবতী পর্ব ১১

মায়াবতী পর্ব ১১
ইসরাত জাহান ইকরা

আলিফ আর তিশা কে নৌকায় বসা দেখে থমকে দাঁড়িয়ে র‌ইলো মেঘা, পরক্ষনেই হাতে টান পড়াতে খেয় হাড়িয়ে মেহমিদের বুকে হুমরি খেয়ে পড়লো মেঘা। মেহমিদ রাগান্বিত কন্ঠে বলতে লাগলো, ডাকছি শুনতে পাচ্ছো না,ক‌ই ধ্যান ধরে দাঁড়িয়ে র‌ইলে, এদিকে নৌকা ছেড়ে দিয়েছে।

মেহমিদের কথার জবাবে মেঘা বলে উঠলো _ ওই আসলে,, চিন্তা করছিলাম এইভাবে এতো সকালে বের হয়ে এলাম, বাসায় চাচী আমায় খুঁজে না পেলে তো তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে।
মেহমিদ ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো _ এই চাচী কে ভয় পাওয়া কবে যে বন্ধ করবে কে জানে। এই বলে রেগে নৌকার এক পাশে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভাবতে লাগলো। মেঘা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে র‌ইলো, তখনি দেখতে পেলো আলিফ আর তিশা মেঘাদের দিকে মনযোগ সহকারে তাকিয়ে আছে।। আলিফের কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। তা দেখে মেঘার বেশ ভালোই লাগছে, । এদিকে মেঘা কে একটা ছেলের সঙ্গে এভাবে দেখে আলিফের জ্বলে যাচ্ছে, মেঘার চাচী কি জানে সে একটা ছেলের সাথে বাইরে বের হয়েছে তাও এই সকাল বেলায়। তখনি আলিফ আর না পেরে বলে উঠলো _ মেঘা কে এই ছেলেটা,আর এতো সকালে কোথায় যাচ্ছিস।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আলিফের কথায় মেহমিদ ভ্রু কুঁচকে আলিফের দিকে তাকালো। মেঘা কিছু একটা বলতেই যাবে তখনি মেহমিদ বলে উঠলো _ তা দিয়ে আপনার কি?
মেহমিদের মুখে এমন প্রশ্ন শুনে আলিফ কেন জানি মনে মনে ভিশন জ্বেলাস ফিল করতে লাগলো। তারপর আলিফ বলে উঠলো _ এই যে ভাই! আমি কি আপনাকে জিগ্গেস করেছি? আর তাছাড়া মেঘা কে আপনার থেকে আমি বেশি ভালো চিনি, এবং মেঘা আপনার থেকে আমার কাছের কেউ।
মেহমিদ এটা শুনে আর না পেরে জোরে হেসে দিল _ আর বলতে লাগলো _ তাই নাকি, আমার থেকে আপনার কাছের কেউ, আপনার কি হয় শুনি?

আলিফ কিছু বলতেই যাবে পাশে তিশা কে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে আলিফ কথা এড়িয়ে বলতে লাগলো _ সেটা আপনাকে বলতে বাধ্য ন‌ই? আর মেঘা তোকে কি জিগ্গেস করছি, কার সাথে? কোন ছেলের সাথে বের হয়েছিস তোর চাচী জানে? জবাব দিচ্ছিস না কেন। ( রেগে ধমক মেরে)
এবার মেঘা বলে উঠলো সেটা আপনাকে বলতে যাবো কেন মিস্টার আরিফ? আপনি কে, আপনি কখন কাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন তা আমি জিজ্ঞেস করেছি কখনো, আপনি আমার পার্সোনাল ব্যাপারে নাক গলানোর কে? মানুষের গায়ে পড়ে এতো কথা বলতে আসেন কেন? একটা মানুষের অত্যান্ত নিম্নমানের হলে ও কমনসেন্স এবং লজ্জা দুটোই থাকা উচিত। আপনার তো দুটোই হাড়িয়ে গেছে দেখছি।

আর জানতে চাচ্ছেন না উনি কে? উনি হচ্ছেন আমার বাগদত্তা। মানে fiance. আশা করছি বুঝতে পেরেছেন, আমি বাংলা এবং ইংরেজী দুটো ভাষায় বলে দিয়েছি, এখন বাকিটা বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব আপনার বলেই জুতা খুলে পানিতে পা ডুবিয়ে দিয়ে চুল গুলো ছেড়ে মেহমিদের কাঁধে মাথা রেখে সূর্য উঠা দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল মেঘা। মনের সব রাগ ক্ষোভ ঝেড়ে এখন কিছুটা শান্তি লাগছে মেঘার।
মেঘার মুখে এসব শুনে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে থম মেরে বসে ছিল মেহমিদ, পরক্ষনেই মুচকি হেসে মেঘার সাথে বসে এই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।

এদিকে রাগে অপমানে আলিফের চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। ইহজম্মে ও এভাবে কেউ অপমান করেনি আলিফ কে। সেখানে মেঘা কি না এতো বড় অপমান করলো? আজকাল মেঘা কে চেনা বড় দায়, ভিশন পরিবর্তন হচ্ছে মেঘা, ভিশন পরিবর্তন, সেটা হয়তো মেঘা ও বুঝতে পারছে না। আসলেই নারীর পরিবর্তন বড়‌ই ভয়ানক। একবার কাউকে মন থেকে উঠিয়ে ফেললে কখনোই সেই ব্যাক্তিটি আর সেই মনে প্রবেশ করতে পারে না।

এদিকে রাহিমা বেগম সকাল সকাল মেঘা কে না পেয়ে মাটি কে বিছানা থেকে টানতে টানতে উঠানে নিয়ে এলো। রাহিমা বেগম, চিৎকার করতে করতে বাড়ি মাথায় করে ফেলেছে এতোক্ষণে। আনোয়ার হোসেন বাজারে চলে যাওয়া মাত্র‌ই মেঘা কে সকাল সকাল কোথাও না পেয়ে মাটি কে বিছানা থেকে উঠিয়ে টেনে হিছরে এনে উঠানে ফেললো।
মাটি উঠানের ফ্লোড়ে পড়ে হাতের কনুই ছিলে চামড়া উঠে যাওয়াই মাগো বলে চিৎকার করে উঠলো।
রাহিমা বেগম রেগে বলে উঠলো _ বল তোর বোন কোথায় মেহমিদের সাথে কোথায় গিয়েছে।
মাটি হাত চেপে ধরে রেগে বলে উঠলো _ আমি জানি না। আমাকে যেতে দাও।

তখনি অনু সিরি দিয়ে নামতে নামতে বলে উঠলো _ তুই সব জানিস, ভালোই ভালোই বল, নয়তো খবর আছে।
মাটি রেগে বলে উঠলো _ আমি জানি না আর জানলে ও বলবো না। দেখি আমার কি খবর হয়। এই বলে মাটি হাত ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালো।
তখনি অনু বলে উঠলো _ আচ্ছা বলবি না তাইতো, তাহলে বাড়ির সমস্ত কাজ তুই করবি।
রাহিমা বেগম বলে উঠলেন _ সারাদিন কাজ না করে তো খেয়ে পড়ে ভালোই গতর বানিয়েছিস। এখন থালা বাসন ধুয়া,হাড়ি পাতিল মাজা থেকে শুরু করে সব গুছিয়ে রাখ যা।

মাটি বলে উঠলো _ কেন নিজের মেয়ে দুটো কে খাইয়ে পড়িয়ে যে হাতির মতো বানিয়েছো দেখতে পাচ্ছো না। আমি কাজ করলে ওরা ও করবে দ্যাটস ইট।
সাথে সাথে অনু রেগে গেল। তেরে এসে মাটির মুখ চেপে ধরে বলে উঠলো _ বোনের মতো খালি বড় বড় কথা,আজ মেরে মুখটা ভেঙে দিব। আর বোন আসলে তার তো কি অবস্থা করি দেখতেই পাবি। এই বলে মাটি মুখটা আরো জোরে চেপে ধরলে মাটি ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো। মাটি দুই হাত দিয়ে অনুর হাতে নখ বিঁধিয়ে দিলে অনু সাথে সাথে আহ করে মাটির মুখ ছেড়ে দেয়, সেই সুযোগে মাটি রেগে অনুর হাতে জোরে কামড় বসিয়ে দেয়।

সাথে সাথে অনু আম্মু গো বলে চিৎকার করে উঠলে,মাটি ছেড়ে দিয়ে বলে উঠলো _ কাউকে দুর্বল ভাববে না অনু আপু। এর পরের বার হাত উঠাতে আসলে আপু বলে যেই সম্মান টা পাচ্ছো তাই আর পাবে না।
অনু রেগে যেই থাপ্পর মারতে যাবে তখনি মাহিদ এসে অনুর হাত ধরে ফেলে। মাহিদ বলে উঠলো _ অনু নিজের সিমানা অতিক্রম করো না। তাহলে পরে পস্তানোর সময়টুকু পাবে না।
এই বলে মাহিদ অনুর হাত ধরে উপরে নিয়ে গেল।
অনু রেগে বলে উঠলো _ দেখলে মা দেখলে, মাঝখানে একটু ছাড় পেয়ে কত বাড় বেড়েছে।
রাহিমা বেগম _ হুম দেখলাম, আর বেশিদিন নেই এরা চলে গেলেই এদের ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।

মাহিদ রুমে এসে মাটি কে বিছানায় বসিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। মাটি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলে উঠলো _ খাবো না রেখে দিন।
মাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো _ আমার উপর রাগ দেখাচ্ছো কেন। আর এসব কবে থেকে সহ্য করছো।
মাটি বলে উঠলো _ সেটা আপনাকে ভাবতে হবে না, আপনি বরং পাশের বাসার আনিশার সাথে বাইকে করে ঘুরে বেড়ান সেদিনের মত।।
মাহিদ কপাল কুঁচকে বলে উঠলো _ আচ্ছা, এইজন্য আমাকে ইগনোর করা হচ্ছে? সেই জন্য কেউ জ্বেলাস হতে পারে আমি তখন ভেবে দেখেনি, বেচারির পরিক্ষার সময় হয়ে গিয়েছিল তাই পৌঁছে দিয়েছি ভার্সিটি তে। তাই বলে এটাকে ঘুরা ঘুরি বলে?

মাটি _ আমি মুটেও জ্বেলাস না, আর কেউ সমাজসেবা করে বেড়াক তাতে আমার কি।
মাহিদ এবার ক্লান্তিমাখা ফেস নিয়ে বলে উঠলো _ আচ্ছা im sorry, এখন থেকে আমার বাইকের পেছনের সিট একজনের জন্য‌ই বরাদ্দ। কেউ জেনো রাতে পড়তে আসে, আমি অপেক্ষা করবো।
এই বলে মাহিদ টেবিলে পানির গ্লাস রেখে রুমে চলে যায়।
মাহিদ চলে যেতেই মাটি ফিক করে হেসে দেয় আর সাথে সাথে মুখে ব্যাথা পেয়ে আহ করে মৃদু শব্দ করে। মাটি বিছানা ছেড়ে উঠে মাহিদের রাখা পানি খেয়ে, ওয়াশ রুমে চলে যায় গোসল করতে।

এদিকে নৌকা এসে একটা ঘাটে থামলে আলিফ আর তিশা নেমে পড়ে। মাঝি মেহমিদ এর উদ্দেশ্য বলে উঠলো _ আপনারা নামবেন না ভাইজান?
মেহমিদ মেঘার দিকে একনজর তাকিয়ে দেখতে পেলো,মেহমিদের কাঁধে মেঘা পরম শান্তিতে চোখ বন্ধ করে আছে। আর বাতাসে মেঘার চুল গুলো মুক্ত পাখির ন্যায় উড়ছে। এতোক্ষণ পুরোটা সময় মেঘা এই মুক্ত সময়টা নিজের মতো করে আনন্দ করছিলো, সারাদিন রাত চার দেয়ালে থেকে থেকে প্রকৃতির এতো কাছে থেকেও তা উপভোগ করতে পারেনি। আজ মেঘা তা অনুভব করতে পারছে, নিতে পারছে স্বাধীনতার স্বাদ।

এসব ভেবে মেহমিদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠলো _ না মাঝি নামবো না।
মাঝি বলে উঠলো _ তয় কোথায় যাবেন।
মেহমিদ বলে উঠলো _ কোথায় যাবো জানি না, তুমি চলতে থাকো তারপর তোমার ভাড়া না হয় পুষিয়ে দিব।
মাঝি _ ওইপাড়ে একটা মেলা ব‌ইবো একটু পর যাবেন?
সাথে সাথে মেঘা খুশিতে উঠে বসলো তারপর বলে হ্যা যাবো মাঝি, নিয়ে চলেন।
মেহমিদ মজার ছলে বলে উঠলো _ দেড়ি হয়ে যাচ্ছে,চাচী বকবে না?

মেঘা _ একবার বের হয়েছি যখন ফিরবো দেড়ি করেই, পরে চাচীর ব্যাপার টা দেখা যাবে।
মেহমিদ মাঝির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো _ মাঝি নিয়ে চলেন।
তারপর নৌকা ঘুড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলো মেলায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। দূর থেকে তা একজোড়া চোখ রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে র‌ইলো।
সারাদিন মেলায় ঘুরা ঘুরি করে, এক জোড়া কানের দুল, চুড়ি,আর একটা পায়েল কিনে মেঘা আর মেহমিদ রোওনা দিল বাড়ির উদ্দেশ্যে।

দুপুর ১২ টা……
মেঘা মেহমিদ বাসায় প্রবেশ করে কাউকে উঠানে দেখতে না পেয়ে যে যার রুমে চলে গেল।
মেঘা ঘরে মাটি কে দেখতে না পেয়ে,ভাবলো হয়তো স্কুলে চলে গেছে। ঘরে স্কুল ব্যাগটা ও নেই।
মেঘা জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল। বিছানায় মেহমিদের কিনে দেওয়া জিনিস গুলো বিছানায় রেখে।
গোসল সেরে এসে দেখতে পেলো, অনু সেই জিনিস গুলো খুলে বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। মেঘা তাড়াতাড়ি করে এসে, সবগুলো গুছিয়ে রাখতে গিয়ে দেখতে পেলো পায়েল টা নেই।

মেঘা চারপাশে পায়েল খুঁজতে শুরু করলে, অনু তার পা উঁচিয়ে বলতে লাগলো _ এটা খুঁজছিস?
মেঘা শান্ত হয়ে বলতে লাগলো _ অনু আপু আমার পায়েল টা দাও।
অনু রেগে বলে উঠলো _ এসব মেহমিদ দিয়েছে তাই না, তোকে না বারন করেছি মেহমিদের সাথে মিশবি না।
মেঘা অনুর কথার জবাবে বলে উঠলো _ মেহমিদ ভাইয়া কারো কোন পার্সোনাল প্রপার্টি নয় যে তার সাথে মিশতে পারবো না। ভালোই ভালোই আমার পায়েল টা দিয়ে দাও বলছি।
অনু মেঘার চোখ মুখ দেখে কিছুটা স‌ংঙ্কিত হয়ে পড়লো, আগে তো এমন করতো না মেঘা তবে আজ কি হলো,ভর দুপুরে জ্বীন ভর করলো নাকি।

মায়াবতী পর্ব ১০

অনু একটা ঢুক গিলে বলে উঠলো _ দিব না, এটা আমি নিয়ে যাচ্ছি, এই বলে অনু চলে যেতে নিলে। মেঘা খপ করে অনুর পা টেনে হিচরে পিছানায় চেপে ধরে পা থেকে পায়েল টা এক টানে খুলে ফেললো, এতে অনুর পায়ে পায়েলের আচর পড়ে লাল হয়ে গেল। সাথে পায়েলের এক অংশ ছিঁড়ে গেল।
যা দেখে অনু কিছুটা ভরকে গেল।

মায়াবতী পর্ব ১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here