মায়াবতী পর্ব ১২

মায়াবতী পর্ব ১২
ইসরাত জাহান ইকরা

বিকেল বেলায় পুকুর পাড়ে বসে মেঘা পায়েল টা জোরা লাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই সেটা জোরা লাগছে না, তা দেখে ভিশন মন খারাপ হলো মেঘার, তখনি মাটি এসে মেঘার পাশে বসলো, মেঘা মাটির দিকে একবার তাকিয়ে বলে উঠলো _ কিরে স্কুল ড্রেস আর ব্যাগ নিয়ে এখানে বসে আছিস কেন যা ঘরে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আয়,এই বলে আবার পায়েলের দিকে মেঘা মনযোগ দিতেই সাথে সাথে মাটির মুখের দিকে ফট করে তাকালো। মেঘা বলে উঠলো _ কিরে তোর মুখে দাগ কিসের, স্কুলে মারামারি করেছিস?

মাটি _ ধুর স্কুলে মারামারি করতে যাবো কোন দুঃখে , আগে বল সকাল বেলায় কোথায় চলে গিয়েছিলি। যার জন্য এতো মাইর আমার কপালে জুটছে।
মেঘা _ চাচী মেরেছে?
মাটি _ না অনু আপু, আমার গাল চেপে ধরেছিল, আমি ও দিয়েছি কামড়, সেটা বাদ দে , এখন বল কোথায় গিয়েছিলি?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেঘা মুচকি হেসে সবটা খুলে বললো। মাটি আফসোসের সুরে বলল ইসস আমি ও যদি তোর সাথে বেড়াতে যেতাম, বাইরে ঘুরতে আমার ভিশন ভালো লাগে। আর আমার জন্য কিছু নিয়ে আসিস নি।
মেঘা _ হ‌ইছে, আমিই তোকে একদিন ঘুরতে নিয়ে যাবো। আর আমি কিছু নেয়নি মেহমিদ ভাই তোর জন্য চকলেট,আর টেডি কিনে আনছে, সারপ্রাইজ দিবে বলেছিলো বাট আমি তোকে বলে দিলাম মন খারাপ করবি বলে।
মাটি _ আচ্ছা যা আমি কিছু শুনিনি। এখন মেহমিদ ভাই কোথায় বল?

মেঘা _ বাজারে গেছে চাচার সঙ্গে, কাল বাদে পরশু তো আমাদের বাসায় বাবা মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া মাহফিল আছে,আর মাহিদ গেছে হুজুর বলতে।
মাটি আর কিছু না শুনে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। ড্রয়ার থেকে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে চুপিচুপি রান্নাঘরে গেল। ফ্রিজ থেকে একটা ডিম ভেজে খেতে বসলো, দূর থেকে রাহিমা বেগম,অনু দেখলো ঠিকিই কিন্তু কেউ কিছু না বলে নিজেদের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। তাদের এমন আচরণ দেখে মাটি অবাক হয়ে গেল। তারা কখন কি ফন্দি আঁটে তা বুঝা বড় দায়, এখন আবার এদের কি হলো,এসব ভেবে খাওয়া শেষ করে রুমে চলে গেল মাটি।

রুমে এসে চেয়ার টেনে বসে ব‌ই খুলে বসলো। তখনি বেলকনি থেকে মেঘা বলে উঠলো _ কি ব্যাপার আজ নিজ উদ্যোগে পড়তে বসলি যে?
মাটি _ সামনে পরিক্ষা।
মেঘা _ হুম, সারা মাসে একবারো পড়তে দেখি না,অথচ পরিক্ষা আসলে এর আগের দিন ব‌ই নিয়ে পড়তে বসা।
মাটি _ শুধুই পরিক্ষার জন্য নয়,ভাবছি ভালো মতো পড়াশোনা করবো, তারপর পুলিশের জব করবো, এরপর সকল অপরাধীদের শাস্তি দিব। বিশেষ করে যারা অবলা ছেলে মেয়েদের উপর নির্যাতন করে, তাদের তো ৩০ দিনের রিমান্ডে রাখবোই।

মেঘা _ হ‌ইছে, আমার নতুন আইনের আবিষ্কারক, এখনকার জেনারেশনে টাকার পাওয়ার বুজছিস,ওইসব আইন ফাইন কিচ্ছু না।
মাটি _ আচ্ছা আপু আজ চাচী ,অনু আপু এতো চুপচাপ কেন বলতো ‌। ওদের আচরণ কেমন সন্দেহ লাগছে।
মেঘা মাটি কে দুপুরের ঘটনা খুলে বললো,। মাটি সব শুনে অবাক হয়ে গেল। মাটি ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো _ যাক অবশেষে আমার নীতিবান বোনের মাঝে প্রতিবাদী একটা ভাব চলে এসেছে। সব মেহমিদ ভাই এর কামাল।।
মেঘা _ একটা দিব মাইর, পড়।
তখনি বাইরে গেঁটের কাছে গাড়ির হর্নের শব্দ ভেসে এলো। মাটি আর মেঘা উঁকি দিয়ে দেখলো শায়লা বেগম আর মোশারফ হোসেন চলে এসেছে।

বাড়ির উঠানে গর্ত খুঁড়ে চুলা বানিয়ে বড় বড় হাড়ি পাতিলে রান্না করা হচ্ছে। মেহমিদ এসব দেখবাল করতে করতে ঘেমে একাকার। আজ শাহিন হোসেন এবং মিতু বেগমের মৃত্যুবার্ষিকী। তাই আজ গ্ৰাম বাসি, আত্মীয় স্বজন দের নিমন্ত্রন করা হয়েছে।
দুপুরে জুমার নামাজের পর খাওয়া দাওয়া শেষ করে দোয়ার মাধ্যমে মাহফিল শেষ করা হলো। আবারো যে যার মতো কাজে চলে গেল।

ডেকোরেটরের লোকজন এসে হাঁড়ি পাতিল থালা বাসন উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল।
সারাদিন এসব কাজ করে মেহমিদ একটা চেয়ারে বসতেই শায়লা বেগম বললেন _ মেহমিদ রেডি হয়ে নাও,একটু পর আমরা বাসায় ব্যাক করবো।
মেহমিদ না চাইতে যেতে সম্মতি জানালো। মাহিদ, লাগেজ গাড়ির পেছনে রেখে এসে,মেহমিদের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। দুই ভাই দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে দুইজনেই কিছু একটা রেখে শহরে চলে যাচ্ছে।
তখনি আনোয়ার হোসেন মোশারফ এবং শায়লা বেগম উদ্দেশ্য বলে উঠলো _ সবেই তো কালকে এলেন, আর দুইটা দিন থেকে গেলে হতো না।

শায়লা বেগম কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাহিমা বেগম বলে উঠলেন _ আর তুমি এতো কথা বলছো কেন, ওরা কি সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছে নাকি, এখানে তো আসতেই হবে, কেননা কিছুদিন পর আমাদের‌ই কুটুম হতে যাচ্ছে।

শায়লা বেগম রাহিমা বেগমের কথায় কান না দিয়ে বলে উঠলো _ না আনোয়ার আমাদের যেতেই হবে, মেহমিদ এর বাবা শহরে গিয়ে সেই মিটিং করে একটা কম্পানির সাথে ডিল করেছে, তাই সেই কাজের জন্য এখন অ্যামেরিকায় যেতে হবে, মেহমিদের বাবা অসুস্থ তাই মেহমিদ কে পাঠাবো ভাবছি অ্যামেরিকায়। ওর বাবার বিজনেস টা তো ওকেই ধরে রাখতে হবে।

শায়লা বেগমের কথায় আনোয়ার হোসেন আর কিছু বললেন না। তখনি উপর থেকে এক বুক ফাটা চিৎকার ভেসে এলো, মেহমিদ মাহিদ, শায়লা বেগম সবাই উপরের দিকে ছুটলেন।
সবাই গিয়ে দেখতে পেলো, মাটি আর মেঘা বাবা, মায়ের ছবি নিয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। মেঘা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো _ মাগো কেন আমাদের আজকের দিনে এভাবে ছেড়ে চলে গেলে। কেন আমাদের দুই বোন কে অসহায় বানিয়ে এতিম করে চলে গেলে।

আজকে কেন আমরা চার দেয়ালে বন্দী, আমাদের আবদার শুনার মতো কেউ নেই, আমাদের বায়না ধরার মতো কেউ নেই। আমাদের স্নেহ করে বুকে টানার মতো কোনো মা নেই, আমাদের ছায়ার মতো আগলে রাখার মতো কোনো বাবা নেই। আমাদের মা ও নেই বাবাও নেই। মাগো তোমার মতো করে আদর কেউ না, সবাই পর মা, এখানে সবাই পর, দোয়া করি তোমরা যেখানে আছো ভালো থাকো, আল্লাহ তোমাদের জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক। মা বাবা তোমরা দোয়া করো আমরা দুই বোন যেনো সকল বাধা বিপত্তি পেরিয়ে তোমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারি।

মেঘার লম্বা চুল গুলো ফ্লোড়ে বিছিয়ে আছে, গায়ের ওড়োনা এক পাশে রাখা,মাটি কে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে,, তাদের কান্না শুনে সবার চোখে পানি চলে এসেছে, রাহিমা বেগম অনু কে টেনে সেখান থেকে নিয়ে চলে গেল, তাদের এসব নাটক দেখার সময় নেই। শায়লা বেগম মেঘা আর মাটি কে ধরে বিছানায় উঠালো, একে একে চুমুতে মেঘা আর মাটির কপাল ভরিয়ে দিল।মেহমিদ পেন্টের পকেটে হাত দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে রইলো। শায়লা বেগম বলে উঠলেন _ বোকা মেয়েরা, অযথা কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। কে বলেছে মা নেই। আমি মা তো, আমার মেয়েদের জন্য আমি আছি, ,মাগো তোমাদের সাথে করে নিতাম এখন বলো তোমরা কি পরিক্ষা ফেলে যেতে চাও।

সাথে সাথে মাটি আর মেঘা মাথা নাড়িয়ে না সূচক ইঙ্গিত করলো। তাই শায়লা বেগম বললেন আর কয়টা দিনের ব্যাপার ইতো, তারপর পরিক্ষা শেষ হলেই তোমাদের এখান থেকে নিয়ে যাবো। আর এতো দিন যা যা প্রয়োজন তা তা পেয়ে যাবে। যখন মনে পড়বে এর মাঝে আমি এসে আমার মেয়েদের আদর করে দিয়ে যাবো। আজ তবে যাই, একটা ইনপোরর্টেন্ট কাজে আজকে আমাদের ব্যাক করতে হচ্ছে, সেই কাজের উদ্দেশ্যে মেহমিদ কে অ্যামেরিকায় পাঠাতে হবে,তাই আজকেই আমাদের রোওনা দিতে হচ্ছে।

সাথে সাথে মেঘা হকচকিয়ে মেহমিদের দিকে তাকালো। দেখতে পেলো মেহমিদ এক দৃষ্টিতে মেঘার দিকে তাকিয়ে আছে, মেহমিদ চলে গেলে যোগাযোগ হবে কি করে, মেঘার তো কোন মোবাইল নেই, মোবাইল থাকলে ও মেহমিদের নাম্বার নেই, মেঘা কিছু না বলে শায়লা বেগমের কথায় সম্মতি জানালো। কি আর করার। আচ্ছা মেঘার মেহমিদের জন্য এতো পুরায় কেন, কি নাম দিবে এই যন্ত্রনার।

সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে, সন্ধ্যা হোওয়ার আগ মুহূর্তে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে, সাদা শার্ট সাথে কালো প্যান্ট চোখে কালো সানগ্লাস পড়ে, একদম রেডি হয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে মেহমিদ। আনোয়ার হোসেন গাড়ির পেছনের ডিকিতে ব্যাগ পত্র তুলে দিচ্ছে।
মেহমিদ মেঘা কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে,এক পলকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললো মেহমিদ, মেঘায় ওই চাহনি যেনো বুকে এসে ডিরেক্ট ঘায়েল করছে। এভাবে মেঘার চোখের দিকে তাকালে এখান থেকে যেতে পারবে না তাই মেঘা কে পেতে হলে আগে এখান থেকে যেতে হবে। মেঘার দিকে তাকিয়ে এক রহস্যময় হাসি দিয়ে মেহমিদ গাড়িতে উঠে বসলো, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি রোওনা দিল নিজ গন্তব্যে।

এদিকে মাটি একটা ইজি টু ম্যাথম্যাথিছের খাতা নিয়ে মাহিদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে র‌ইলো। মাহিদ যাওয়ার সময় মাটির হাতে এই খাতা ধরিয়ে দিয়ে এটিটিউড দেখিয়ে চলে গেছে। আর যাওয়ার আগে বলে গেছে এই খাতাটা একবার হলেও মেলে দেখো আমায় অনুভব করতে পারবে। তাহলে আর মেট্রিক ফেইল করতে হবে না। তাহলে সহজেই পুলিশ হয়ে যে কাউকে ত্রিশ দিনের রিমান্ডে রাখতে পারবে। বলে হাসতে হাসতে চলে গিয়েছিল মাহিদ।
মাটি এই খাতা খুলে না দেখে রেগে আছাড় মেরে টেবিলের উপর রেখে মন খারাপ করে বেলকনিতে বসে র‌ইলো। পর মূহুর্তেই মনে পড়লো মেহমিদ তো তার হাতে একটা গিফট বক্স ধরিয়ে দিয়ে গেছে,বলেছে মেঘা কে দেওয়ার জন্য।

মাটি দৌড়ে গিয়ে মেঘা কে ছাদ থেকে টেনে নিয়ে এলো, এতোক্ষণ গাড়িটি যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত তাকিয়েছিল মেঘা। গাড়িটি চোখের আড়াল হতেই মাটি মেঘা কে টেনে নিয়ে এসেছে।
মাটির এভাবে টানাটানিতে মেঘা রেগে জিগ্গেস করলো,কি হয়েছে মাটি এভাবে টানছিস কেন। এমনিতেই মন ম্যাজাজ ভালো না। তখনি মাটি মেঘার হাতে গিফট বক্স তুলে দিয়ে বলে উঠলো মেহমিদ ভাই তোকে দিতে বলেছে।
মেঘা মেহমিদের কথা শুনে আগ্ৰহ নিয়ে গিফট বক্স খুলতে লাগলো।

মায়াবতী পর্ব ১১

বক্স টা খুলতেই দেখতে পেলো সেখানে একটা নতুন মোবাইল ফোন। যা দেখে মেঘা হা হয়ে গেল।
মেঘা আগ্রহ ধমাতে না পেরে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখতে পেলো ফোনটা সিম টিম লাগিয়ে সবকিছু সেট করে দিয়েছে মেহমিদ। কন্ট্রাক্ট নাম্বারের লিষ্ট সবার নাম্বার সেভ করা অথচ মেহমিদের নাম্বার ই নেই, যা দেখে হতাশ হয়ে গেল মেঘা। তবে ব্যাপার না নাম্বার কালেক্ট করতে কতোক্ষণ।

মায়াবতী পর্ব ১৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here