মায়াবতী পর্ব ১৫
ইসরাত জাহান ইকরা
মেঘার রাগে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে, এখানে না আসলে হয়তো এতো কিছু হতো না। মাটি কে এভাবে হাড়াতে হতো না, এখন নাকি মামাতো ভাই সৌরভ কে বিয়ে করতে হবে? যাকে কখনো মেঘা দেখেইনি আজ পর্যন্ত।, মামার বাড়ির আবদার নাকি? হ্যা এটা তো মামার বাড়ি ই, কিন্তু আমার মতামতের কোন দাম নেই নাকি, এসব ভাবতে ভাবতে মেঘা খেয়াল করলো ঘরের দরজা বাইরে থেকে লাগানো, দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে, দরজা খুলার চেষ্টা করলো, কিন্তু কোন লাভ হলো না।
আর এতো রাতে মেঘা যাবে কোথায়, কিন্তু মাটি কে বাঁচাতে হলে তো ওই সৌরভ কে বিয়ে করতে হবে, না হলে আমাকে কোথাও ওরা যেতে দেবে না। এসব ভাবতে ভাবতে মেঘার হঠাৎ মেহমিদের কথা মনে পড়লো, দেখি মেহমিদ আমার টেক্সট এর রিপ্লাই দিয়েছে কি না, এই ভেবে মেঘা বিছানার কাছে যেতেই মেঘার মোবাইল খুঁজে না পেয়ে,পুরো বিছানা অগোছালো করে ফেললো। তাহলে কি তার মামা ফোনটা নিয়ে গেছে। ভাবতেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো মেঘা। এ কোথায় ফেঁসে গেল সে। এখন মাটি কোথায় আছে কি করছে সেটা ও মেঘা জানে না। এখন কি বাধ্য হয়ে ওই সৌরভ কে বিয়ে করতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতে মেঘা ফ্লোড়ে হাঁটুর উপর মাথা ঠেকিয়ে কান্না করতে লাগলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাত ১১ টা………….
একটা ব্রিজের কাছে এসে বাইক থামালো মাহিদ। মাটি দুহাত মেলে মুক্ত বাতাসে শান্তির নিশ্বাস নিতে লাগলো। এতো রাতে ও এভাবে মানুষের আনাগোনা, প্রতিটি বড় বড় বিল্ডিংয়ে লাইট, গাড়ীর জ্যাম দেখে অবাক হলো মাটি। সে তো গ্ৰামের বাইরের জগৎ টা কে এভাবে দেখেনি, আজ তার সাথে যা হচ্ছিলো ভাবতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে । ভাগ্য সহায় ছিল তাই তো বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। তখনি মাটি মাহিদের কিছু কথা শুনে থমকে গেল।
মাহিদ ফোনে বলছে _ ভাইয়া তোমাকে কতগুলো কল দিয়েছি, তুমি ধরোনি কেন? জানো কি হয়েছে এদিকে…..
ওপাশে মেহমিদ রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলো _ মাহিদ আমি একটা বিজনেস মিটিং এ ছিলাম তাই কল ধরতে পারিনি। তোকে যে,মেঘার সমস্ত খবরাখবর দিতে বলেছি দিয়েছিস? ওও আমাকে টেক্সট করেছিল কিন্তু তখন আমি বিজি ছিলাম, ওর নাম্বার টা দে তো? আর গুড নিউজ, আমাদের অফিসিয়ালি কার্যক্রম সব শেষ আমি খুব শিগগিরই ফিরছি।
মাহিদ _ যতো তাড়াতাড়ি পারো চলে আসো, মেঘা কে নাকি তার মামাতো ভাই কি যেনো নাম বললো, ওহ হ্যা সৌরভ,তার সাথে তার চাচার বিয়ে ফিক্সড করেছে। আর কাকিয়া জানো আজকে কি করেছে ( তারপর মাটির কাহিনী সব খুলে বললো)
মেহমিদ সব শুনে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো _ তাই নাকি, আমি দুইদিনে চলে আসাতে না আসতেই এতো কিছু হয়ে গেল। আচ্ছা ঠিক আছে তুই মাটি কে আর ওই বাড়িতে পাঠাস না,ওটা ওর জন্য নিরাপদ নয়। আর বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি। এই বলে মেহমিদ কল কেটে দিলো।
মেহমিদ কল কেটে দিতেই মাটি মাহিদ কে জিজ্ঞেস করলো, আপুর সৌরভ ভাইয়ার সাথে বিয়ে হবে মানে,এই আপনি কি আপুর সাথে কথা বলেছেন? কখন কথা বললেন আমাকে কেন দিলেন না?.
মাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো _ এতো প্রশ্ন করলে উত্তর দিব কয়টা বলো। প্রথম প্রশ্ন, তোমার আপুর সাথে কথা বলে যা বুঝলাম তাতে তোমার মামা বাধ্য করে মেঘা কে বিয়ে দিতে চাইবে এবং তা খুব শিগগিরই, । আর দ্বিতীয় প্রশ্ন, হ্যা তোমার আপুর সাথে কথা হয়েছে কিন্তু তুমার সাথে দেখা হোওয়ার আগে।
মাহিদের কথা শুনে মাটি মন খারাপ করলো, তারপর বললো আপু কে একটা কল দেন না আমি কথা বলি। আমার এখন খুব মনে পড়ছে আপু কে।
মাহিদ মাটির এমন ইনোসেন্ট ফেস দেখে মুচকি হেসে মেঘার নাম্বারে কল দিল। কিন্তু বার বার কল দিয়ে ও লাভ হলো না, নাম্বার সুইচ অফ বলছে।
মাহিদ মাটির দিকে তাকিয়ে বললো তোমার বোনের নাম্বার বন্ধ বলছে। মনে হয় ফোন চার্জ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সাথে সাথে মাটি বলে উঠলো _ না না না, আপুর নাম্বার তো বন্ধ থাকার কথা নয়, ফোন তিন পর্যন্ত চার্জ থাকে, চার্জে না লাগালে ও। মনে হয় আপু কোন বিপদে পড়েছে চলুন না যাই আপুকে নিয়ে আসি।এই বলে মাটি মাহিদের হাত ধরে টানতে লাগলো। মাহিদ মেঘার এমন বাচ্চামো দেখে হেসে ফেললো। মাহিদ হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,_ হ্যা যাবো তো, কিন্তু তোমার মামার বাড়ি কোথায় জানো?
সাথে সাথে মাটি দাঁড়িয়ে পড়লো,আর বলতে লাগলো _ না তো, একবার অনেক পিচ্চি থাকতে গিয়েছিলাম কিন্তু এখন মনে পড়ছে না। বলে গালে হাত দিয়ে মাটি ভাবতে লাগলো।
মাহিদ গাল টেনে দিয়ে বলে উঠলো _ হইছে আর ভাবতে হবে না,ভাইয়া বলছে বাকিটা দেখে নেবে, সো নো টেনশন এখন এখান থেকে চলো।
বলে মাহিদ বাইকে উঠে বসে মনে মনে হাসতে লাগলো। মাটি খুশিতে গোলগোলা হয়ে বলে উঠলো _ তাহলে তো মেহমিদ ভাইয়া আসলে কোন কথায় নেই। এই বলে মাহিদের বাইকের পেছনে উঠে বসলো।
বাইক চলতে লাগলো আপন গতিতে,তখনি মাটি বলে উঠলো _ আপনি জানেন আপু না মেহমিদ ভাই কে অনেক ভালোবাসে?
মাহিদ _ আচ্ছা, তোমাকে মেঘা বলেছে?
মাটি _ বলবে কেন আমি তো দেখেছি।
মাহিদ _ আচ্ছা তাই! ভালোবাসা দেখা ও যায়?
বলেই হেসে দিল মাহিদ। মাটি মন্ত্র মুগ্ধের মতো তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো _ আপনি জানেন আপনার হাসিটা টা কতো সুন্দর, এটা তো দেখা যায়।
সাথে সাথে মাহিদ হাসি থামিয়ে ভ্রু উঁচু করে বললো _ খবরদার, আমার কিন্তু পিচ্চি একটা কিউট বউ আছে,এসব আর কখনোই বলবে না।
সাথে সাথে মাটি রেগে গেল। রাগ করে মাহিদের কাঁধ থেকে হাতটা সরাতেই মাফিদ জোরে ব্রেক কষলো। মাটি কিছু বলতেই যাবে তার আগে মাহিদ বলে উঠলো _ বাসায় চলে এসেছি এখন ভিতরে চলো।
এরপর মাহিদ মাটি কে ভিতরে নিয়ে যেতেই শায়লা বেগম অবাক হলেন। এতোক্ষণ মাহিদের জন্য খাবার টেবিলে বসে অপেক্ষা করছিলো। মাটি কে দেখে শায়লা বেগম বলে উঠলো _ ওমা মাটি তুমি, মেঘা কোথায় কিরে মাহিদ মাটি কে নিয়ে আসবি আগে বলবি না? তাহলে তো অনেক কিছু রান্না করতাম।
মাহিদ পরে বলবো সব, মাটি কে ওর রুমে দেখিয়ে দিও, আমি ফ্রেস হয়ে আসি। এই বলে মহিদ চলে গেল। মাটি ও ফ্রেস হতে চলে গেল তার জন্য নির্ধারিত কক্ষে।
একটু পর ফ্রেস হয়ে এসে মাহিদ দেখতে পেলো, মাটি শায়লা বেগমের একটা শাড়ি পড়েছে, দেখে তো মাহিদের চোখ কপালে,পুরো পুতুলের মত দেখাচ্ছে। এখানে কোন জামা কাপড় নেই বিধায় শায়লা বেগম নিজের শাড়ি নিজ হাতে মাটি কে পরিয়ে দিয়েছে। এই প্রথমবারের মতো শাড়ি পড়ায় লজ্জা পাচ্ছে মাটি।
মাহিদ নিচে এসে চেয়ার টেনে বসলো, শায়লা বেগম বললেন _ এবার বল কি হয়েছে, ?
তারপর মাহিদ শায়লা বেগম কে সবকিছু খুলে বললো। সব শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে শায়লা বেগম বললেন ঠিক আছে _ মাটি আজকে থেকে এখানেই থাকবে। কালকে ওর জন্য কিছু কাপড় চোপড় কিনে নিয়ে আসবি। আর আমি ওর স্কুল থেকে ট্রান্সফারের ব্যাবস্থা করছি। আমি আগে এটা করিনি কারন সে মানিয়ে নিতে পারবে কি না সেটা নিয়ে মনে একটু দ্বিধা ছিল। এখন যেহেতু পরিস্থিতি বেগতিক তবে সেটা সামলানোর অপায় ও আছে।
মাটি শায়লা বেগম কে জরিয়ে ধরে কান্না করতে লাগলো। শায়লা বেগম মাটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্তনা দিল। তারপর যে যার মতো ঘুমাতে চলে গেল।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই মেঘা দেখতে পেলো তার বিছানার পাশে কিছু শাড়ি গহনা রাখা, মেঘা এসব দেখে চিন্তা করতে লাগলো এগুলো এখানে কে রাখলো। তখনি সকালের নাস্তা হাতে নিয়ে,তার মামী হেনা বেগম তার রুমে প্রবেশ করলেন । হেনা বেগম বলতে লাগলেন, ঘুম ভাঙলো এতোক্ষণে তোমার মেঘা, নাও খেয়ে নাও খেয়ে রেডি হয়ে নাও।
মেঘা কপাল কুঁচকে বলে উঠলো _ রেডি হবো মানে? আর এই এতোসব শাড়ি গহনা কিসের?
হেনা বেগম বললেন _ কিসের মনে তুমি জানো না, তোমার মামা না বললো আজকে তোমার কাবিন করিয়ে রাখবেন।
মেঘা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো _ সৌরভ, মানে ওনি কি এসে পড়েছে?
হেনা বেগম _ হ্যা সেই কখন ভোর রাতে। নাও আর দেড়ি করো না, আমার কাজ আছে। রেডি হয়ে নাও, আমি বলেছিলাম পার্লার থেকে লোক আনতে কিন্তু সৌরভ বললো তুমি নাকি নিজেই অনেক শাড়ি পড়তে পারো।
মেঘা কপাল কুঁচকে বলে _ সৌরভ ভাই এতো কিছু কি করে জানে? আগে কি কোথাও আমাদের দেখা হয়েছিল?
হেনা বেগম থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি কাজের বাহানায় চলে গেলেন। তখনি বুড়ো আনসার রহমান মেঘার ঘরে প্রশ্ন করলেন _ সেকি তুমি এখনো রেডি হোও নি?
মেঘা রেগে বলে উঠলো _ বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে না মামা।
আনসার রহমান বললেন _ শুভ কাজে দেরি করতে নেই। এখন তুমি রেডি হোও কাজি এসে বসে আছে।
মেঘা মনে মনে বলতে লাগলো _ না এই পরিস্থিতি তে আমাকে এই মূহুর্তে শান্ত হতে হবে নয়তো পালাতে পারবো না। মেঘা শান্ত গলায় বলে উঠলো _ আমার ফোনটা কোথায় মামা?
আনসার রহমান _ তোমার বিয়ের পর পেয়ে যাবে?
মেঘা বলে উঠলো _ আমার ফোন না পেলে বিয়ে করবো না? আনসার রহমান বললেন _ ঠিক আছে তবে এই নাও তোমার ফোন। কিন্তু মনে রেখো তোমার ফোন আমি দিয়ে দিয়েছি এখন তোমার কথা তুমি রেখো বলেই চলে গেলেন।
মেঘা ফোন হাতে নিয়ে দেখতে পেলো, মোবাইলে সিম কার্ড নেই। তাই এবার মেঘা চিন্তিত হয়ে পড়লো কীভাবে মেহমিদের সাথে কন্টাক্ট করবে। তখনি মেঘা wifi লাইন কানেক্টেড করে, অনলাইনে প্রবেশ করলো। গিয়ে দেখতে পেলো মেহমিদ অনেকগুলো মেসেজ পাঠিয়েছে _মেহমিদ লিখেছে _ হ্যা মেঘা কোথায় তুমি? কি বিপদ বলো, তোমার নাম্বার বন্ধ কেন? আমাকে অনলাইনে না পেলে, তুমি এই নাম্বারে কল দিও।
মেঘার ফোনে তো সিম কার্ড ই নেই, তখনি অনুর একটা মেসেজ আসলো _ অনু টেক্সটে লিখেছে _ কিরে মেঘা,মামার বাড়ির আদর কেমন খাচ্ছিস। তোর বোনকে ও পাঠিয়ে দিলাম এমন জায়গায় যেখানে সারাজীবন আদর খেয়ে বেঁচে থাকবে।
এরকম মেসেজ দেখে মেঘার বুঝতে বাকি রইলো না ওরা কি করেছে। সাথে সাথে সেই মেসেজের স্ক্রিন সর্ট রেখে অনু কে ব্লক করে দিল। এখুনি এই মেসেজ পুলিশের কাছে নিয়ে যাবে। যেভাবেই হোক মাটি কে উদ্ধার করতে হবে,তার আগে এখান থেকে মেঘা কে বের হতে হবে। মামা চাই তো আমি সৌরভ কে বিয়ে করি, সৌরভ কে বিয়ে করলে যদি আমি এখান থেকে বের হতে পারি তবে তাই হোক আমি সৌরভ কেই বিয়ে করবো। মেঘা মাটির কথা চিন্তা করে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লো। মেঘা না খেয়ে রেডি হয়ে গেল, চোখের জলে কাজল লেপ্টে গেল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বউয়ের মতো সাজলো।
মায়াবতী পর্ব ১৪
একটু পর কাজি এসে বিয়ে পড়ানো শুরু করলো, ওড়োনার পর্দার ওপারে সৌরভ বসা, মেঘা চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে, তিন বার কবুল বলার সময় মনে হচ্ছিল নিঃশ্বাস টা বের হয়ে আসছে, অবশেষে পাঁচ লক্ষ এক টাকা দেনমোহরে মেঘার বিয়ে সম্পন্ন হলো। মেঘা পাথরের ন্যায় বসে রইলো। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো, হেনা বেগম ওড়োনার পর্দা সরাতেই মেঘা জ্ঞান হাড়ালো।