মায়াবতী পর্ব ৪৯

মায়াবতী পর্ব ৪৯
তানিশা সুলতানা

আড়াল থেকে অর্ণব তন্নির মলিন মুখখানা দেখে। এখনো গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে আছে। চোখ দুটো ফোলা। প্রচন্ড কান্না করার ফলে হয়েছে এমনটা। লম্বা চুল গুলো এলোমেলো। বই সামনে নিয়ে বসে আছে। জামাটা ঘামে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। সবেই এসেছে রান্নাঘর থেকে।

অর্ণবের মনে পড়ে যায় এই চুল গুলো দেখেই ক্রাশ খেয়েছিলো সে। কিন্তু তখন চুলগুলো ছিলো পরিপাটি। তন্নির চেহারায় এসেছে অনেকটা পরিবর্তন। গোলগাল মুখখানা কেমন শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি জমে গেছে। যেনো অনেকদিন রাতে ঘুমায় না। কিন্তু তন্নি তো রাতে ঘুমায়। তার শাক্ষি অর্ণব নিজে। তাহলে এমনটা কেনো দেখাচ্ছে মেয়েটাকে?
তন্নি বই বন্ধ করে দরজার দিকে তাকাতেই অর্ণবকে দেখতে পায়। শুষ্ক ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। দুই হাতে চুল গুলো খোঁপা করে এগিয়ে যায় অর্ণবের দিকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আপনি এসেছেন? আমি সবেই ভাবছিলাম কল করবো।
অর্ণব দু পা এগিয়ে এসে তন্নির দুই গালে হাত রাখে। তন্নি চোখ নামিয়ে নেয়।
” ওই ডাইনি বুড়ি মেরেছে তোমায়?
তন্নি মলিন হাসে। অর্ণবের হাত দুটো সরিয়ে দেয় গাল থেকে।
“ওই মুখে মুখে তর্ক করেছিলাম একটু। আমিও না দিন দিন কটা হয়ে যাচ্ছি। মায়ের মুখের ওপর কথা বলতে শিখে গেছি।
বাদ দেন এইসব। এবার বলুন অথৈয়ের কি অবস্থা? সারাদিন আমায় কল করলো না। সাগর ভাইয়াকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেলো?

অর্ণব খাটে বসে৷ তন্নিও পাশে বসে পড়ে।
” অথৈ ভালো আছে। কিন্তু তুমি ভালো নেই মায়াবতী।
তন্নির চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে। সে অর্ণবের হাতের উপর হাত রাখে৷
“মানুষ বলে না আমার এটা চাই, ওটা চাই

এটা নেই, ওটা নেই
আমার এসব কিছুই চায় না। আমি একটু মানসিক শান্তি চাই। আপনার সাথে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি থাকতে চাই।
আমার নিয়ে যাবেন অর্ণব আপনার সাথে? আমি আপনার সব কথা শুনবো। আমার পেছনে আপনার টাকা খরচ করতে হবে না। আমি না হয় টিউশনি নিবো দুটো। শুধু আপনার সাথে থাকতে চাই।
বলতে বলতে কেঁদে ফেলে তন্নি। অর্ণব মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

” আর কয়দিন অপেক্ষা করো। ঠিক নিয়ে যাবো।
তন্নি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। নিজের অনুভূতি বোঝাতে পারলো না অর্ণবকে। হয়ত তন্নি বোঝাতে ব্যর্থ আর নয়ত অর্ণব বুঝতে ব্যর্থ। তবে জীবনটা এমন নাহলেও পারতো।

আজকে তন্নির সাথে বেশিখন সময় কাটায় না অর্ণব। একটুখানি তন্নিকে বুঝিয়ে ভালোবাসার দুটো কথা বলে চলে যায়। ইতি বেগমকে চোখ রাঙিয়ে গেছে সে। নেক্সট টাইম তন্নির গায়ে হাত তুললে হাত ভেঙে ফেলার হুমকিও দিয়েছে। বয়সে গুরুজন আর তন্নির মা না হলে সত্যিই এই মহিলার গায়ে হাত তুলে ফেলতো অর্ণব। মহিলাটার চোখে তন্নির জন্য ভালোবাসা দেখতে পায় অর্ণব কিন্তু তবুও কেনো এতো খারাপ ব্যবহার?

দিন গুলো কাটছে ব্যস্ততায়। সবাই সবার মতো ব্যস্ত। অথৈ আর সাগরের সম্পর্ক অনেকটা উন্নতি হয়েছে। সাগর কয়েকদিন পরপর কল করে। কিন্তু মেসেঞ্জারে টুকটাক কথা হয় রোজই।
অর্ণব শত ব্যস্ততার মাঝেও একটু একটু কথা বলে তন্নির সাথে। এই মাসেই সে তন্নিকে বাড়িতে তুলবে। তাকে আর রাখবে না ওই বাড়িতে। তাই তার ব্যস্ততা শতগুন বেড়েছে।

তন্নির শরীরটা ইদানীং আরও খারাপ লাগে। কিন্তু কাউকে বলতে পারে না। কাকে বলবে? মা কে? সে তো বকা দিবে। অর্ণবকে বললে সে চিন্তা করবে। অথৈকে বললে সে পাগল হয়ে যাবে। আর রইলো পড়ে বাবা। সে কাল দেশে আসছে। তখনই বলবে।

বাবা আসার খুশিতে তন্নি কলেজে যায় নি। অথৈ তন্নিকে ভীষণ মিস করছে। তাকে ছাড়া সে ক্লাসে ঢুকে নি। মাঠের এক কোণে বসে আছে। সারাদিন তন্নির মুখটা দেখতে পারবে না?
অথৈ শপিং করার নাম করে বাবার থেকে দশ হাজার টাকা এনেছে। এই টাকা দিয়ে সে তন্নিকে ডাক্তার দেখাবে। বেশ কয়েকদিন হলো খেয়াল করছে তন্নির পরিবর্তন। কিছু একটা হয়েছে তন্নির এটা ভালো করেই বুঝতে পারছে অথৈ। টাকার জন্য বাড়িতে নিজের অসুখের কথা বলবে না এটাও জানা অথৈয়ের।

তন্নিকে আজকে ডাক্তারের কাছে নিতে পারবে না বলে অথৈয়ের চোখে পানি চলে আসে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার।
তখনই অথৈয়ের সামনে বাইক থামায় সাগর। বাইক থেকে নেমে হেলমেট রেখে অথৈয়ের পাশে এসে বসে।
অথৈ এতোখনে তাকায় সাগরের দিকে।
সাগর হেসে অথৈয়ের মাথায় টোকা দিয়ে বলে

“কি হয়েছে অথৈ রানীর? মুড অফ যে?
অথৈ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে
” তন্নির শরীর ভালো নেই। চোখ মুখ কেমন হলুদ হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম আজকে ওকে ডাক্তার দেখাবো কিন্তু ও আসলোই না।

বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অথৈ। সাগর অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখে। বন্ধুর জন্য মানুষ এতোটা সেনসেটিভ হতে পারে?
সাগর হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে অথৈয়ের চোখের পানি মুছে দেয়।
“আরে বাবা কান্না করছো কেনো? বিকেলে তন্নির বাসায় চলে যেয়ো। আর ওকে নিয়ে বেড়িও। তখন না করবে না।
অথৈ ভেবে দেখে সত্যিই তো তাই। এবার হাসি ফুটে ওঠে অথৈয়ের ঠোঁটে। সাগরও হাসে।

” সত্যি করে একটা কথা বলবেন আমায়?
“আমি কখনোই মিথ্যে বলি না অথৈ।
অথৈ খানিকটা সময় নিয়ে বলে
” তন্নিকে এখনো মিস করেন?
সাগর অথৈয়ের চোখে চোখ রাখে।

“আমাদের মিস করার মতো কোনো সম্পর্ক ছিলো না অথৈ। ওয়ান সাইড লাভ ছিলো। ভালোবাসতাম আমি তন্নিকে। বিয়ে করবো বলে ভেবে নিয়েছিলাম। একা একাই স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম।
তুমি কষ্ট পেলেও আমি বলতে বাধ্য যে আমার মনে সারাজীবন তন্নির জন্য একটা সফট কর্ণার থেকেই যাবে।
অথৈ সাগরের হাতের ওপর হাত রাখে।

” তবে তুমিও মস্তিষ্কে জায়গা করে নিয়েছো। সারাক্ষণ জ্বালিয়ে যাচ্ছো।
তোমার জ্বালা সহ্য করা যাচ্ছে না। দ্রুত তোমাকে বাড়িতে নিতে হবে।
বলতে বলতে সাগর উঠে যায়। বাইকে গিয়ে বসে। অথৈ ভাবতে থাকে সাগরের কথা। যখনই কথার মিনিং বুঝতে পারে লাজুক হাসে। নিজেও উঠে সাগরের পেছনে বসে।
দুই হাতে পেট জড়িয়ে পিঠে মাথা ঠেকায়। তারপর রিনরিন করে বলে

“আমিও ভাইয়ার মতো আমাদের বেবির নাম ঠিক করতে চাই। তাদের পাপা বলে ডাকতে চাই আমি।
” ঠিক আছে আয়রার পাপা বলে ডেকো। অনির বোন আয়রা। কিউট না?
অথৈ বড়বড় চোখ করে তাকায় সাগরের দিকে। মনে মনে বেবির নামও ঠিক করে নিয়েছে? ভালোই সেয়ানা হয়ে গেছে। শুধু অথৈয়ের সামনেই প্রকাশ করে না। খারাপ পুরুষ।
একে আর ছাড়াই যাবে না। শক্ত হাতে জাপ্টে ধরতে হবে। দ্বিগুন বেশি জ্বালাতে হবে।

তন্নি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। মনে মনে ভীষণ চিন্তিত সে। এমন কেনো হয়ে যাচ্ছে? চিরুনি ভর্তি চুল উঠে যাচ্ছে। চোখ দুটো কেমন মরা মরা লাগে। নিজেকে দেখেই নিজেই অবাক হয় তন্নি।
ইতি প্লেটে করে ভাত এনে তন্নির খাটের ওপর রাখে। তারপর তন্নির সামনে এসে দাঁড়ায়।
“কয়মাস চলছে?

তন্নি অবাক হয়। কিসের কয়মাস চলছে?
ভ্রু কুচকে মাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলে
” কিসের কয়মাস চলছে?
“একদম নেকা সাজবি না। তর সইলো না একটু? শশুড় বাড়ি যাওয়ার আগেই পেট বাঁধিয়ে বসলি? কালকে তোর বাবা এসে আমাকেই বকবে। সব দোষ আমার ঘাড়েই চাপবে। সে আর বুঝবে না তার মেয়ের কীর্তি।
তন্নি বিরক্ত হয়।

মায়াবতী পর্ব ৪৮

” তুমি যেটা ভাবছো সেটা না।
“একদম বেশি কথা বলবি না তুই। ওই বেয়াদপকে কল করে বল তোকে ডাক্তার দেখাতে। আর হাসপাতাল থেকেই শশুড় বাড়ি চলে যাবি। মানসম্মান রাখলি না আমাদের।
বলেই সে চলে যায়। তন্নি আবারও আয়নার দিকে তাকায়। এটা কি করে সম্ভব? তাদের মধ্যে তো কিছুই হয় নি। তাহলে?
অর্ণবকে কি বলবে? অর্ণব কি মনে করবে? যদি ভুল বোঝে? তখন কি করবে তন্নি?

মায়াবতী পর্ব ৫০