মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ১৪

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ১৪
লেখিকাঃ দিশা মনি

ফাহিম বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে ছিল। নিজের ভাইয়ের চিন্তায় সে একটুও শান্তি পাচ্ছিল না। একটু আগেই পুলিশ স্টেশন থেকে ফিরল সে৷ কেসটা অনেক জটিল হয়ে গিয়েছে। অনলাইনে এই নিউজটা ভাইরাল হয়ে গেছে যে একজন ম্যাজিস্ট্রেট একজন পথচারীকে ধা’ক্কা দিয়ে চলে গেছে। পথচারী মেয়েটি হাসপাতালে ভর্তি, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। সবাই এটা নিয়ে সমালোচনা করছে। অনেকে রাজপথে নেমে আন্দোলনও করেছে। এসবের জেরেই মূলত ফারহানকে এত দ্রুত গ্রেফতার করা হয়েছে, যাতে জনরোষ ঠেকানো যায়।

আজ বৌভাত উপলক্ষে অনেক আত্মীয় স্বজন এসেছিল। তাদের সবার সামনে পরিবারের মান সম্মান ধুলোয় মিশে গেছে পুরো৷ সবাই ফারহানকে নিয়ে নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করেছে। অতঃপর সকল আত্মীয়ই বিদায় নিয়েছে। এজন্যই বোধহয় বলে বিপদে কেউ পাশে থাকে না। ঝর্ণা যদিওবা থাকতে চেয়েছিল কিন্তু তার মা-বাবার জোরাজুরিতে চলে যেতে বাধ্য হয়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফারজানা বেগম এসব শুনে অসুস্থ হয়ে গেছেন। নিজের মায়ের কথা মনে আসতেই ফাহিম বিছানা থেকে উঠে বসলো। অতঃপর দ্রুত পায়ে হেটে রওনা দিলো নিজের মায়ের রুমের দিকে। রুমে গিয়ে দেখতে পায় ইভানা ফারজানা বেগমের মাথার কাছে বসে আছে। ফাহিম হন্তদন্ত করে রুমে প্রবেশ করে বলে,
‘আম্মু কেমন আছে এখন?’

‘শু,,, আস্তে কথা বলুন। উনি একটু আগেই ঘুমিয়েছেন। ঘুমানোর আগে অব্দি অনেক উত্তেজিত ছিলেন। বারবার বলছিলেন আপনার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে চান।’
‘না জানি এটা কি হচ্ছে আমাদের সাথে। এত সমস্যা আমি একা কিভাবে সামলাবো?’
‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আছি আপনার পাশে।’

ফাহিম অনেক ভরসা পায় ইভানার কথায়। যখন আমরা বিপদে পড়ি তখন নিজের কাছের মানুষের সমর্থন আশা করি। তাদের একটা সামান্য কথা ❝আমি তোমার পাশে আছি❞ আমাদের অনেক ভরসা দেয়।
ফাহিম কিছুক্ষণ ইভানার দিকে তাকায়৷ তাকেও ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। এমনিতে গতকাল সারারাত জেগে পড়েছে। আজকেও এসবের মধ্যে ঠিকঠাক বিশ্রাম নিতে পারে নি।
ফাহিম বলে,

‘তুমি এখন রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। আমি আছি আম্মুর পাশে।’
‘জ্বি, আচ্ছা। কোন প্রয়োজন হলে আমায় অবশ্যই ডাকবেন। আমি চলে আসবো।’
ইভানা ফারজানা বেগমের রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের দিকে রওনা দেয়। রুমে এসে শুতে নিবে এমন সময় তার ফোন বেজে ওঠে। ইভানা বিরক্তি নিয়ে টেবিল থেকে নিজের ফোনটা হাতে তুলে নেয়। তোহা তাকে ফোন করেছে। ইভানা ফোনটা রিসিভ করে নেয়। বিপরীত পাশ্ব হতে তোহা বলে,

‘হ্যালো ইভানা? কি অবস্থা? ওদিকে সবকিছু ঠিক আছে তো?’
‘কিচ্ছু ঠিক নেই আপাই। তুই তো দেখেই গেলি এদিকে কি পরিস্থিতি। আমার শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’
‘হুম বুঝতে পারছি। বাট তোকে একটা কথা জানানোর ছিল।’
‘কি কথা?’

‘ফারহানের গাড়ির সাথে কার এক্সিডেন্ট হয়েছে জানিস?’
‘না। কার হয়েছে?’
‘আনহার।’
‘কি?! এটা কিভাবে সম্ভব? আনহা তো,,,’
‘আনহা তোর বিয়ের দিন এসেছিল ঠিকই কিন্তু ওর বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিয়ের আগেই মাঝপথে ও চলে যায়। তখনো ফারহান বিয়ে থেকে উঠে যায়নি। এরপর ফারহান বিয়ে করবে না বলে চলে যায়, আর যাওয়ার পথেই আনহার সাথে দূর্ঘটনাটা ঘটে যায়।’

‘আনহা কেমন আছে এখন?’
‘আনহার চিকিৎসা চলছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজেই ভর্তি আছে ও। আজকে আমি মেডিকেলে গিয়ে সব জানতে পারলাম।’
‘ঠিক আছে আপাই। কাল আমি একবার গিয়ে ওর সাথে দেখা করে আসব। রাখছি এখন।’
‘আচ্ছা বাই। নিজের খেয়াল রাখিস।’
বলেই ফোন কে’টে দেয় তোহা। ইভানা অনেক ক্লান্ত ছিল, এখন তার খুব টেনশনও হচ্ছে। সে আর বেশি চিন্তা করতে পারল না। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোরের আকাশ ভেদ করে সূর্য উকি দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে। ইভানা আজ বেশ সকালেই ঘুম থেকে উঠলো। অতঃপর নামাজ আদায় করে নিলো। সে জায়নামাজ গুছিয়ে নিতে নিতে ফাহিমও মসজিদ থেকে নামাজ আদায় করে বাসায় ফিরলো।
ফাহিমের পরণে সাদা পাঞ্জাবি। ফাহিমের শুভ্র শরীরে বেশ মানিয়েছে পাঞ্জাবিটা। ইভানা কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইল ফাহিমের দিকে। মনে মনে বললো,
‘মাশাল্লাহ, কারো নজর না লাগুক।’

ফাহিম বাসায় ফিরেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। গতকাল রাতে ঠিকভাবে ঘুমাতে পারে নি তাই এখন ঘুমাতে চায় সে। ইভানাই জায়নামাজ সঠিক স্থানে রেখে এসে ফাহিমের পাশে শুয়ে পড়ল। ফাহিম চোখ বুজেছে অনেক আগেই। ইভানা ফাহিমের দিকে তাকালো। বড্ড মায়াবী লাগছে তাকে। এভাবে একসময় ইভানায় চোখ বুজে ঘুমালো।

ভোর গড়িয়ে সকাল ৮ টা বেজে গেল৷ বাড়ির সকলে যথারীতি ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত। ফারজানা বেগম আগের থেকে কিছুটা স্বস্তি বোধ করায় তিনিও এসেছেন। ইভানা সকলকে খাবার দিয়ে নিজেও খেতে বসে পড়লো।
ফারজানা বেগম ভীষণ উদ্বীগ্ন ছিলেন তার বড় ছেলেকে নিয়ে। তাই তিনি ফাহিমকে বললেন,
‘তোর লগে কি ফাহিমের কথা হয়নাই? কাল তো তুই থানায় গেছলি। কি কইল ফারহান? ‘

‘আম্মু ভাইয়া বলেছে, ভাইয়া গাড়ি চালিয়ে আচ্ছিল এমন সময় ঐ মেয়েটিই নাকি ভাইয়ার গাড়ির সামনে চলে এসেছিল। ভাইয়ার কোন দোষ ছিল না এতে। এখন শুধু মেয়েটার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা। জ্ঞান ফিরলেই মেয়েটা যদি স্বীকারোক্তি দেয় তাহলে ভাইয়াকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’
‘তাই যেন হয়। আমার পোলাটা যেন ছাড়া পায়।’
ইভানা মনে মনে ভাবছিল,

‘এমনো তো হতে পারে ফারহান যা বলছেন তা মিথ্যা। আমাকে হাসপাতালে গিয়ে আনহার খোজ নিতে হবে। যদি সত্যিই ফারহান দোষী হয় তাহলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে।’
খাওয়া শেষ করে সবাই উঠে। ফারজানা বেগম নিজের রুমে চলে যাওয়ার পর ইভানা ফাহিমকে বললো,
‘শুনুন আপনার সাথে কথা আছে।’

‘হুম, বলো।’
‘আমি আজ একটু ঢাকা মেডিকেলে যাব।’
‘হঠাৎ মেডিকেলে কেন?’
‘আমার এক বান্ধবী ওখানে ভর্তি আছে। ওর সাথে দেখা করতে।’
‘কিন্তু আম্মু তো বলেছিল আজ তোমাকে সাথে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে যেতে। এটা নাকি নিয়ম।’
‘বাড়িতে পরে যাওয়া যাবে, আগে হাসপাতালে যাওয়াটা জরুরি।’
‘ঠিক আছে। তুমি তৈরি হয়ে থেকো। আমি তোমাকে নিয়ে যাব।’

ইভানা মেডিকেলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলো। ফাহিম ইভানার জন্যই অপেক্ষা করছিল। ইভানা তৈরি হতেই দুজনে একটি ক্যাবে করে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়।
ঢাকা মেডিকেলে পৌছে ক্যাব থেকে নামার সময় ইভানা হঠাৎ করে উ*ষ্ঠা খেয়ে পড়ে যেতে নেয়। ফাহিম সেই সময় নিজের শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় ইভানাকে। ইভানা ততক্ষণে ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। ফাহিম আলতো হেসে বলে,

‘সাবধানে চলাফেরা করো। সবসময় আমি থাকবো না তোমাকে বাচানোর জন্য।’
ইভানা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। ফাহিমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। না না বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ফাহিম ইভানাকে বলে,
‘আমি এখানেই আছি। তুমি যাও গিয়ে তোমার বান্ধবীর সাথে দেখা করে এসো।’
‘কেন আপনিও চলুন না!’

‘না থাক। আমি গিয়ে কি করবো? তুমি দ্রুত গিয়ে দেখা করে এসো। এখান থেকে তোমাকে তোমার বাড়িতে রেখে আবার আমাকে থানায় ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যেতে হবে।’
ইভানা আর কথা বাড়ালো না। ধুপধাপ পা ফেলে চলল ভেতরে। ফাহিম ইভানার যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে পরে ফোন বের করে ফোন টিপতে লাগল।
ইভানা ঢাকা মেডিকেলে ঢুকে তোহাকে ফোন করে। অতঃপর তোহার সাথে দেখা করে। দুজনে মিলে আনহার কেবিনের দিকে যায়। ইভানা তোহার মাধ্যমে জানতে পারে আনহার জ্ঞান ফিরেছে। ইভানা খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে আনহার সাথে দেখা করার জন্য।

আনহার কেবিনে প্রবেশ করার পর তারিকুল ইসলামকে দেখতে পায় ইভানা। নিজের বাবাকে দেখে বেশ অবাক হয়ে বলে,
‘আব্বু তুমি এখানে!’
‘হ্যা, আমি আনহার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। যেহেতু আমি এখানকারই ডাক্তার সেই সুবাদে ওর অসুস্থতার কথা শুনে চলে এসেছি।’
ইভানা আর কথা না বাড়িয়ে আনহার কাছে আসে। আনহার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
‘তুই কেমন আছিস এখন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ বেচে আছি।’

‘আঙ্কেল আন্টি কেউ আসে নি তোর সাথে দেখা করতে?’
আনহা অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে,
‘কেন আসবে? আমার সৎমায়ের কথা কি বলবো আমি ম’রলেই তো তার শান্তি। বাবাও তো অসুস্থ। আমার খোজ নেওয়ার মতো আর কেউ আছে নাকি?’

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ১৩

‘তুই চিন্তা করিস না আনহা। আমরা সবাই তোর পাশে আছি৷ আচ্ছা একটা কথা বল, এক্সিডেন্টটা কিভাবে হলো?’
‘যা বলার আমি পুলিশের সামনেই বলব।’
ইভানা দমে যায়। সে ভালোই বুঝতে পারে আনহা কিছু বলতে চাচ্ছে না।

মিষ্টিমধুর প্রতিশোধ পর্ব ১৫