মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১০
মির্জা সূচনা
অতীত
যেদিন রিদ প্রথম মেহরিনকে দেখেছিলো।
সকালটা ছিল ঝকঝকে রোদে ভরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক ধরে ভেতরে ঢুকল দুই বান্ধবী—চুমকি আর মেহরিন।
ওদের হাসির রিনরিনে শব্দ বাতাসে মিশে এক আলাদা উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে দিল।
আর ঠিক তখনই, গেটের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিদ তালুকদারের চোখ পড়ল তাদের দিকে।
আর পর মুহূর্তেই… আটকে গেল।
মেহরিন।
সেই নাম তখনও সে জানত না, কিন্তু মেয়েটিকে দেখেই মনে হলো, যেন বহুদিন ধরে সে এই মুখটাই খুঁজছিল।
সাদামাটা পোশাকের ভেতরেও মেয়েটির উপস্থিতি ছিল চমকে দেওয়ার মতো।
তার গায়ের রঙটা মেঘলা সকালের মতো কোমল, যেন হালকা আলো ছুঁয়ে গেছে।
চোখ দুটো গভীর—মায়াবী।
যেন একবার তাকালেই কেউ হারিয়ে যেতে পারে সেই দৃষ্টির গভীরে।
আর সেই চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছিল প্রাণচাঞ্চল্যে, উৎসাহে।
তার ঠোঁটের নিচে ছিল একটা ছোট্ট কালো তিল—একটা ছোট্ট চমক, যা তার হাসিকে করে তুলেছিল আরও অনন্য।
আর সেই হাসি?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
একদম মিষ্টি—নির্ভেজাল, মন থেকে আসা।
এমন হাসি, যেটা দেখে মনে হয় পৃথিবীর সব কষ্ট কিছুক্ষণের জন্য দূরে সরে যেতে পারে।
চুলগুলো ছিল এলোমেলোভাবে বাঁধা, তবুও যেন প্রতিটা স্রোত বলে দিচ্ছে, সে নিজেই নিজের মতো, নিজের ছন্দে চলা এক নরম ঝড়।
রিদ তাকিয়ে রইল।
এই প্রথম, কোনো মেয়েকে দেখে তার মনে হলো—
ও হাসছে, সেই হাসিতেই রিদ থমকে গেল।
রিদ তালুকদার সাধারণত মানুষকে খুব একটা খেয়াল করে না। তার মনটা থাকে নিজের জগতে—গম্ভীর, চিন্তাশীল, নিজের মতো।
কিন্তু আজ… আজ কিছু যেন ভিন্ন।
মেহরিনকে দেখার সেই এক মুহূর্তেই তার ভেতরের নিরাবেগ দেয়ালটা যেন খানিকটা নড়ে উঠল।
সে বুঝতেই পারল না, কেন এতটা সময় ধরে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে।
হয়তো সেই চোখের গভীরতা ওকে টেনে নিয়েছে।
হয়তো সেই ছোট্ট কালো তিলটা, যা হাসির ফাঁকে চমকে দিচ্ছে।
অথবা হয়তো সেই হাসিটাই, যেটা অনেকদিন পর ওর ভেতরের কঠিন চেহারাটাকে গলিয়ে দিচ্ছে।
নিজেকে বকলো সে—কি করছিস রিদ? তুই এমন করিস না তো কখনও!
কিন্তু মনে মনে একটা স্বীকারোক্তি ঠিকই ধরা দিল—
এই মেয়েটা আলাদা। একদম অন্যরকম।
এই প্রথম রিদ এমন একটা কাজ করলো যা ও জীবনে কোনদিন করেনি নিজের অজান্তেই মেহরিনার একটা ছবি তুলে রাখলো।
তার বুকের গভীরে যেন চুপচাপ একটা কিছু বীজ হয়ে পড়ল।
একটা অজানা আকর্ষণ, একটা অদ্ভুত টান।
সেই মুহূর্তে কিছু না বলে, কিছু না বুঝে—
রিদ তালুকদার বুঝে গেল,
এই মেয়েটিকে সে মনে রাখবে।
যেভাবেই হোক।
মেহরিনকে দেখার পর থেকে রিদের ভেতরে একটা অস্থিরতা শুরু হলো।
সে জানত না মেয়েটার নাম, জানত না কোন বিভাগে পড়ে, এমনকি বন্ধু তালিকায়ও কেউ ছিল না যাকে জিজ্ঞেস করা যায়।
তবে এই অনুভূতিটা ওর নিজের স্বভাবের সঙ্গে একদম মেলে না।
রিদ তালুকদার—যে ছেলেটা সাধারণত নতুন কারো সঙ্গে সহজে মেশে না, অচেনাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখে,
সে হঠাৎ করে কারও সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য এতটা ব্যাকুল?
এই প্রশ্নটা রিদ নিজেকেই বুঝিয়ে উঠতে পারছিল না।
তবুও… মেহরিনের সেই মায়াবী চোখ আর মিষ্টি হাসিটা ওকে যেন ঘুমের মধ্যেও ডেকে বেড়ায়।
শেষমেশ রিদ নিজের গোঁ ধরে বসে গেল—
না, আমাকে ওর সঙ্গে কথা বলতেই হবে। যেভাবেই হোক।”
কিন্তু সরাসরি গিয়ে কথা বলা তা কি রিদের মানায়?
সে তো এমন না….!
তাই সে পথ খুঁজে নিল একটু ঘুরপথে।
তার ক্লোজ সার্কেলের—ওপর দায়িত্ব দিল।
শান্ত, মৌ, সাথী, রাকিব অনেক অবাকই হয়েছিলো— রাকিব তো বলেই ফেলেছিলো
তুই… কারো পিছে লাগছিস? তাও এমন করে?
রিদ একটু বিরক্ত হলেও মুখ গম্ভীর রেখেই বলল,
জাস্ট বের করে দে মেয়েটা কে। আর… যদি পারিস, ওকে আমার কাছে আন। কিন্তু সাবধানে—অতিরিক্ত কিছু করবি না।
শান্ত হেসে মাথা নেড়ে বলল,
ঠিক আছে ভাই! যেভাবেই হোক, তোমার এই অচেনা রাজকন্যার সন্ধান এনে দেব।
রিদ মুখ ঘুরিয়ে দিকে তাকিয়ে রইল মেহরিনের দিকে।
হয়তো মেহরিন আবার হেঁটে যাবে এই পথে…
আর তার ভেতরে জমে থাকা হাজার কথার প্রথমটা বলা হবে—
“তুমি কে?”
পুরো ব্যাপারটা খুব সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পনা করেছিল রিদ। তার মনে ছিল, মেহরিনের সাহসিকতাকে একটু ভেঙে দিয়ে তাকে তার কাছে নিয়ে আসবে। সে জানত, মেহরিনের মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস আছে, তবে রিদ বিশ্বাস করেছিল, নতুন পরিবেশে এসে মেহরিন হয়তো একটু ভয়ের মুখোমুখি হবে এবং তার পরিকল্পনাটি সফল হবে।
রিদ ছিল নিশ্চিত, যখন মেহরিন ভয় পাবে, সে তখন তার কাছে আসবে এবং তার সাহায্য চাইবে। সে ভাবছিল, মেহরিন যদি সাহসী হয়, কিন্তু কখনো তো ভয়ও পাবে—নতুন জায়গায় এসে এমন কিছু হবে, যা তাকে ভীত করবে। তখন আমি তাকে বুঝিয়ে দেব, এখানে কীভাবে টিকে থাকতে হয় আর ওর সাথে কথা বলার সুযোগও পাব।
তবে রিদ যে মেহরিনের সাহসের পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি, সেটাই ছিল তার বড় ভুল। মেহরিন পুরো ঘটনাটিকে অস্বাভাবিকভাবে সহজভাবে নিয়েছিল। সে জানতো, ভয় পেলে কোনো কিছু অর্জন করা যায় না। সে জানতো যে, সব পরিস্থিতিতেই নিজের সাহস ও আত্মবিশ্বাসের ওপর ভরসা রাখতে হবে।
শান্ত রা যখন তার সাহসিকতা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল, তখন রিদ তার পরিকল্পনার ভুল বুঝতে পারে। মেহরিন শুধু সাহসী নয়, সে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসীও—এমন একটা মেয়ে, যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকে।
রিদ নিজেকে একটু থামিয়ে চিন্তা করে, এটা আসলে তার জন্য একটা শিক্ষা। তাকে বুঝতে হবে, মেহরিন সহজ বা অবলা নয়, এবং তার সাহসিকতাকে কখনো underestimate করা যাবে না। এই পুরো পরিস্থিতি তার জন্য একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসল।
এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল রিদ, যে সে বুঝতেই পারেনি—মেহরিন এমন এক মেয়ে, যে ভয় পেলে তো দূরের কথা, কখনো নিজের আত্মবিশ্বাস হারায় না। যেনো সে জানতো, র্যাগিং বা অন্য কোনো চ্যালেঞ্জ আসুক, তাকে তার নিজের পথে চলতেই হবে। সাহস এবং আত্মবিশ্বাস ছিল তার মূল শক্তি।
তবে রিদ যখন দেখতে পায়, মেহরিন একটুও ভয় পায়নি, বরং সে সবার সামনে দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার নিজের সাহসিকতা নিয়ে, তখন রিদ বুঝতে পারে—তার পরিকল্পনা একদম ভুল ছিল। মেহরিন কোনোভাবেই তার কাছ থেকে সাহায্য চাইবে না। সে নিজের পথে চলতে জানে, এবং ভয়ের কোনো জায়গা নেই তার মধ্যে।
মেহরিন যখন সাহসিকতার সাথে সিনিয়রদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন রিদ বুঝতে পারে, মেহরিনের সাহসিকতা ও আত্মবিশ্বাস তাকে ভীত বা দুর্বল করবে না, বরং তাকে আরও শক্তিশালী করবে।
রিদ এর মধ্যে তার নিজের ভাবনা পরিবর্তন করে। সে জানত, মেহরিন তার কাছে আসবে না, কারণ তার ভয়ের কোন জায়গা নেই। এখন রিদ এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করছিল—এটা মেহরিনের থেকে শেখার বিষয় ছিল, তার সাহসিকতা আর আত্মবিশ্বাসই তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল।
কিন্তু যখন মেহরিন ধীরে ধীরে এক পা এক পা করে রিদ-এর দিকে এগিয়ে আসছিল। হাতে লাল গোলাপ, মুখে দৃঢ়তা আর চোখে একরকম দুঃসাহসের দীপ্তি। প্রতিটি পদক্ষেপে তার চুলগুলো হালকা বাতাসে দুলছিল, মুখে একপ্রকার জেদি নরম হাসি—যেন ভয় নয়, বরং নিজের আত্মবিশ্বাস নিয়েই সে সামনে বাড়ছে।
রিদ দূর থেকে বইয়ের ফাক দিয়ে দেখছিল তাকে। প্রথমে তার চোখে ছিল কৌতূহল, তারপর ধীরে ধীরে তা রূপ নিচ্ছিল এক অজানা আলোড়নে। তার হৃদস্পন্দন যেন আচমকা বেড়ে যাচ্ছিল। প্রতিটি ধাপে মেহরিন যত এগোচ্ছিল, রিদ তত গভীর কোনো অচেনা অনুভূতির সাথে নিজেকে আবিষ্কার করছিল।
এই মেয়েটিকে তো সে ভয় দেখাতে চেয়েছিল, ভাবছিল ভয় পেয়ে সে তার কাছে আসবে। কিন্তু এখন, মেহরিন তার কাছে আসছে ঠিকই—কিন্তু কোনো ভয়ের বশে নয়, বরং নিজের সাহসিকতার জোরে।
রিদ জানে না কেন, তার সমস্ত পরিকল্পনা হঠাৎ করে খুব শিশুসুলভ মনে হতে লাগল। বুকের ভেতর যে অনুভূতিটা কাঁপন তুলছিল, সেটা ভয় ছিল না—বরং যেন এক নতুন মোহ, এক নতুন স্বপ্নের শুরু।
সেই মুহূর্তে, বাহ্যিক গম্ভীরতা বজায় রেখেও, ভেতরে ভেতরে রিদ বুঝে গেল—এই মেয়ে অন্যরকম।
আর হয়তো সেই বুঝে যাওয়ার মধ্যেই শুরু হয়ে গেল, এক অজানা গল্পের প্রথম পৃষ্ঠা।
মেহরিন যখন রিদ-এর সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন সে কোনো দ্বিধা ছাড়াই ছন্দে ছন্দে বলে ওঠে—
তার কণ্ঠে ছিল স্নিগ্ধতা, চোখে ছিল স্পষ্ট আত্মবিশ্বাস।
তার প্রতিটি শব্দে যেন মিশে ছিল কোমল এক সাহস আর অদ্ভুত মাধুর্য।
রিদ শুনছিল… শুনছিল ঠিকই, কিন্তু শব্দগুলো আর কানে যাচ্ছিল না—
সে যেন হারিয়ে গিয়েছিল এক অন্য জগতে।
মেহরিনের সেই প্রেমময় ছন্দ আর সৌম্য মুখাবয়ব তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল এক অজানা অনুভবের দিকে,
যেখানে কোনো র্যাগিং, কোনো ইগো, কোনো প্ল্যান নেই—
শুধু এক নিষ্পাপ, অপ্রত্যাশিত মোহ।
তার হৃদয় ধীরে ধীরে নিঃশব্দে কবিতা হয়ে উঠছিল,
আর সে নিজেই হারিয়ে যাচ্ছিল মেহরিনের প্রতিটি উচ্চারণে।
সে জানত না এই মেয়ে কে, কোথা থেকে এল—
কিন্তু এটুকু বুঝে গেল, এই মেয়েটি তার সেই পরিচিত জগৎ নয়…
এই মেয়েটি এক রহস্য,
আর সেই রহস্যেই সে হারাতে চাইছে।
সেই দিনের পর থেকে মেহরিন যেন রিদের ভেতর ঢুকে বসলো।
প্রথমে ছিল কৌতূহল—এই মেয়েটা কে? এত সাহস কোথা থেকে আসে?
তারপর আস্তে আস্তে সেই কৌতূহল রূপ নিতে থাকল আসক্তিতে।
আর সেই আসক্তি প্রতিদিন একটু একটু করে গাঢ় হতে লাগল।
রিদ খেয়াল করল, মেহরিন শুধু সাহসী নয়, ওর যুক্তিগুলোও ঠিক লক্ষ্যভেদী।
তাকে কেউ কথা বলার সুযোগ দিলে, সে শুধু বলে না—বোঝায়।
রিদ যার কথা শুনে কখনোই থামে না, সে নিজেই নিজেকে বারবার থামিয়ে দেয় মেহরিনের কথা শুনতে।
মেহরিনের হাঁটায় ছিল ছন্দ, হাসিতে ছিল ছায়া,
আর চোখে ছিল এমন এক দৃঢ়তা—যা রিদ আগে কোনো চোখে দেখেনি।
রিদ নিজেকে আর ঠিকভাবে চিনতে পারছিল না।
সে, যে সম্পর্ক থেকে দূরে থাকে, আবেগে কখনো জড়ায় না—
সে আজ চুপচাপ অপেক্ষা করে, যদি করিডোরের মোড়ে মেহরিনকে এক ঝলক দেখতে পায়।
দিন যেতে লাগল।
রিদ বুঝে গেল, এটা কেবল আসক্তি নয়।
সে প্রেমে পড়ছে। ধীরে ধীরে, কিন্তু গভীরভাবে।
মেহরিনের সাহস আর সরলতা মিশে এক রকমের আলো ছড়াচ্ছিল,
আর সেই আলোতেই রিদের ভেতরের সব অন্ধকার, সব অহংকার গলে যেতে লাগল।
রাহির বার্থডেতে প্রথম রিদ মেহেরিনকে শাড়ি পরা অবস্থায় রেখেছিলো। আর হারিয়ে গিয়েছিল এক অজানা অনুভূতির অন্য জগতে।
তারপর সেই নবীন বরণে মেহরিন কে দেখে তো রিদ একপ্রকার পাগল হয়ে গিয়েছিল।সেদিন ইচ্ছে করেই ওই মেয়েটাকে আসতে দেওয়া হয়নি যার গান গাওয়ার কথা ছিলো।হৃদ জানতে পেরেছিলাম মেহরিন অনেক সুন্দর গান গায়।আরে সেই গান শোনার জন্যই এক নিখুঁত পরিকল্পনা ছিলো। সেদিন রিদ মেহরিন এর উদ্দেশ্যে গিয়েছিলো সেই গান। আর মেহরিন এর গান শুনে তো সেদিন রিদ আবার প্রেমে পড়েছিল।
আর তারপর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সেদিন রেদ দেখেছিল অন্য এক মেহরিনকে।যে শুধু কথা বা যুক্তিতে নয়,নিজের সম্মান রক্ষার্থে হাতে ও চালাতে পারে।যখন রিদ জানতে পারে মেহেরিন এর গায়ে কেউ টাচ করেছে, খুব রাগ নিয়ে এসেছিল সেই ছেলেগুলোকে ধরতে। কিন্তু মেহরিন এর সেই রূপ দেখে থমকে গিয়েছিল।রিদ প্রতিদিন ক্ষণে ক্ষণে মেহরিন প্রেমে পড়েছে।
রিদ মেহরিনকে ভালোবাসে—এ সত্যটা তার নিজের কাছেই ছিল একরকম স্বীকারোক্তি,
কিন্তু মেহরিন যেন কখনো তা না জানে,
এই চেষ্টাতেই সে নিজেকে গুটিয়ে রাখত।
মেহরিন যখন ক্লাসের করিডোরে হাঁটত,
রিদ ঠিক তখনই অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিত।
মেহরিনের হাসির শব্দ যখন বাতাসে ভেসে আসত,
রিদের হৃদয়ে একটুকরো কম্পন ছুঁয়ে যেত,
তবু সে সেই হাসির দিকে ফিরে তাকাত না।
শান্তরা যতই ওর সাথে মিশতো কিন্তু রিদ তেমন একটা আশেপাশে থাকতো না।
অন্য বন্ধুরা যখন বলত,
মেহরিন… দেখতে পাচ্ছিস, কেমন প্রাণবন্ত?
রিদ চোখে-মুখে গাম্ভীর্যের মুখোশ পরে বলত—
আমার এসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
কিন্তু সত্যি হলো,
মাথাব্যথাটা শুধু ছিল মেহরিন নিয়েই।
কখনো আড়াল থেকে দেখত,
কখনো লাইব্রেরির কোনায় বসে দূর থেকে শুনত মেহরিনের কণ্ঠ,
তার হাসি, তার তর্ক—সবকিছু।
সে মেহরিনের খুব কাছেই ছিল,
তবু সবসময় একটু দূরে।
পালিয়ে যেত, শুধু এই ভয় থেকে যে—
মেহরিন যদি বুঝে ফেলে…
যে সে তাকে ভালোবাসে,
তাহলে?
তাহলে তো সেই নির্ভেজাল চোখের সামনে নিজেকে আর লুকাতে পারবে না সে।
রিদ চাইত না মেহরিন তাকে বুঝে ফেলুক—
সে শুধু চেয়ে থাকতে চাইত,
ভালোবাসতে চাইত—নিঃশব্দে।
আর অপেক্ষা করতো সঠিক সময় আসার।
রিদ ভালোবাসে—ভীষণ গভীর আর নির্মল এক ভালোবাসা।
কিন্তু সে জানত, মেহরিন কেবল এক ক্রাশ বা পছন্দ বা আসক্তি নয় —
সে এমন একজন,
যাকে সে চায় জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে পাশে রাখতে,
সম্মান দিতে, আগলে রাখতে।
তাই সে চেয়েছিল মেহরিনকে হালাল পথে,
পরিচয়ের এই অধ্যায় থেকে একদিন পৌঁছাতে—
নামাজের পর “আমিন” বলা স্ত্রীর মতো করে আপন করে পেতে।
সে বুঝে গিয়েছিল—মেহরিন সাহসী, যুক্তিবাদী, আর অদ্ভুত রকমের সুন্দর একজন মেয়ে,
তাকে কোনো অস্পষ্ট বা লুকানো সম্পর্কের খাঁচায় রাখা অন্যায়।
তাই তো সে দূরে থেকেছে,
তাকে ভালোবাসার পরও ছুঁয়ে দেখেনি,
তাকে চেয়ে থেকেছে, কিন্তু কখনো দাবি করেনি।
সে অপেক্ষা করেছে সেই দিনের,
যেদিন সে মেহরিনের চোখে চোখ রেখে বলতে পারবে—
“তোমাকে চাই, আল্লাহর দেওয়া হালাল অধিকার নিয়ে।”
বর্তমান
হাসপাতালের করিডোরে একপাশে বসে আছে রিদ। চোখের নিচে কালি, মুখে ক্লান্তির ছাপ, তবু দৃষ্টিটা অপলক দরজার দিকে।
শান্ত আর রাকিব ওর পাশেই বসে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর শান্ত হালকা গলায় বলে উঠল,
শান্ত:
দোস্ত, মেহরিন এখন স্টেবল। ডাক্তার বলেছে, ঝুঁকির কিছু নেই।
তুই এখন বাড়ি গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে আয়। তোর কি নিজের খবর আছে? আয়নায় নিজেকে দেখেছিস? একদম ভেঙে পড়েছিস!
রিদ:
(চোখ নামিয়ে আস্তে)
আমি একটু ওকে দেখতে চাই, শান্ত… ওকে একটু দেখি একটু কথা বলে তারপর।
শান্ত: তখন তো সবাই গেল তুই কেন গেলি না? আর এখন এভাবে বসে চিন্তা করছিস। দেখ আমরা তোর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি তুই যদি একদম ভেঙে যাস, ওর পাশে তখন কে থাকবে ঠিক করে?
রাকিব:
ভাই, ভালোবাসার মানে শুধু পাশে থাকা না… নিজেকে ঠিক রাখাটাও দরকার, যেন ওর জন্য সবসময় দাঁড়াতে পারিস।
রিদ কিছু বলে না। মুখটা আরও গম্ভীর হয়, কিন্তু চুপ করে উঠে দাঁড়ায়।
দরজার দিকে তাকিয়ে সে বলে—
ও খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যাক তারপর ওকে এক নজর দেখে দেন আমি বাড়ি চলে যাব।
এদিকে মেহরিনের কেবিনে এখন চুমকি আর মেহরিন। চুমকি মেহরিনের মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বলেছে, মামনি, বাড়ি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো, এখন আমি আছি। চুমকি এক হাতে মেহরিনের হাত ধরে, অন্য হাতে ফোন স্ক্রল করছে।
মেহরিন কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকে, তার মুখে যেন কিছু অপ্রকাশিত চিন্তা জমে ছিল। কিছু সময় পর সে আস্তে করে বলে, চুমকি আমার ফোনটা একটু দে তো।
চুমকি ফোন হাতে দিয়ে বলে, ফোন দিয়ে কি করবি?
মেহরিন রেগে গিয়ে বলে, উফ! এত কথা না বলে দেন না।
চুমকি মৃদু হাসে, তারপর ফোনটা দিয়ে দেয়। মেহরিন ফোন হাতে নিয়ে দ্রুত কবি সাহেব লিখা ইনবক্সে। সে কবি সাহেবের এসএমএস চেক করছে। চোখে এক ধরনের আশা ছিল, কিন্তু যখন দেখল কোন এসএমএস আসেনি, তখন তার মনটা এক অদ্ভুত বিষাদে ভরে উঠে। যেন কোনো আশা আর বাকি নেই, যেন কিছু একটা হারিয়ে গেছে। সে ফোনটা চুপচাপ রেখে দেয়, কিন্তু তার চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা।
মেহরিন চুপচাপ ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। চোখের পেছনে লুকিয়ে থাকা ক্লান্তি আর হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা একরাশ প্রশ্ন যেন ওকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তার মনে শুধু একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে—
কবি সাহেব কি তবে আমাকে ভুলে গেলেন? এত কথা, এত ভালোবাসার ইশারা… সবই কি তাহলে মিথ্যে ছিল?
এক ধরনের কষ্ট বুকের মাঝে চেপে বসে, সে চেষ্টা করেও তা সরাতে পারছে না। দু ফোটা চোখের জল না চাইতেও চোখের কার্নিশ হয়ে পড়ল।
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৯
আর এদিকে চুপচাপ পাশে বসে থাকা চুমকি একদৃষ্টিতে মেহরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে ভাবছে,
মেহরিন তো কবি সাহেবের প্রতি কতটা আসক্ত… অথচ ও জানেই না রিদ ভাই ওকে কতটা ভালোবাসে। যদি একদিন সত্যিটা জানতে পারে, তখন কী হবে ওর অবস্থাটা?
হাসপাতালের নিস্তব্ধ বাতাসে দুজনের মনের ভাবনা যেন এক অদৃশ্য ভার হয়ে জমে আছে, কেউ কাউকে কিছু বলছে না, তবুও নিঃশব্দে অনেক কিছু বলা হয়ে যাচ্ছে।