মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১১
মির্জা সূচনা
কয়েকটা দিন যেন কেটে গেছে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতায়। হাসিখুশি, সবসময় মুখে রঙধনু আঁকা মেয়েটা—মেহরিন, হঠাৎ করেই নরম হয়ে গিয়েছিল। শরীরটাও যেন তার মন মতো চলছিল না। কেমন নিস্তেজ, নিঃশব্দ হয়ে গিয়েছিল সে।
ডাক্তারের পরামর্শে কিছুদিনের হলো বাড়ি ফিরে এসেছে মেহরিন। ঘরের পরিবেশ, মা-বাবার যত্ন,চুমকি মাহির আর মেহবুবার শাসন-ভরা আদরে ধীরে ধীরে মেহরিন আবার আগের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
আর চুমকি? সে কি থাকতে পারে মেহরিন ছাড়া? ক্লাস, রুটিন, এমনকি নিজের ছোট ছোট ব্যস্ততা ফেলে, সে একদম মেহরিনের বাড়িতে চলে আসে। দুজনের হাসাহাসি, একসাথে গল্প করা, জানালার পাশে বসে বিকেল দেখতে দেখা—সবকিছু যেন আবার ফিরে আসে সেই পুরনো ছন্দে।
মেহরিন এখন অনেকটা’ই সুস্থ। তবে তার চোখে যেন এখনো গভীরতা এসেছে। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনও যেন অসুস্থ হয়ে উঠেছে। চুপিচুপি, কোথাও যেন সে কাউকে খুঁজছে… হয়তো সে নিজেও জানে না, ঠিক কাকে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেহরিন জানালার পাশে বসে ছিল চুপচাপ। বিকেলের আলো তার মুখে পড়ে যেন রং তুলির দাগ এঁকে দিচ্ছে। চোখদুটো অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে ফোনের পর্দায়। সেই নম্বরটা—যেখান থেকে একসময় কবিতার মতো শব্দ এসে পড়ত তার জীবনে।
তবে আজ… অনেকদিন হয়ে গেল, সেদিনের পর আর কোনো বার্তা নেই। না কোনো কবিতা, না কোনো “তুমি কেমন আছো আরিওনা?” প্রশ্ন।
এই নিস্তব্ধতাই আজ মেহরিনের মনে সবথেকে বেশি আওয়াজ তুলছে।
সে বারবার ভাবছে—
তাহলে কি কবি সাহেব আমাকে ভুলে গেলেন?
কবি সাহেব, যে তার শব্দ দিয়ে মেহরিনের মনে গভীর দাগ কেটেছিল। যার প্রতিটি বাক্য মেহরিনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল এক অজানা অনুভবে। সেই অচেনা মানুষটা কি সত্যিই চেনা হয়ে উঠার আগেই দূরে সরে গেল?
মেহরিন সারাদিন এই এক ভাবনাতেই ডুবে থাকে। কথায় না বলে, স্পর্শ না করে, কেবল শব্দ দিয়েই কেউ যদি কারো মনে এমন গভীরভাবে ছুঁয়ে যেতে পারে—তাহলে তার নীরবতা এতো তীব্র কেন লাগে?
তার মনের কোণে একটাই প্রশ্ন— “কবি সাহেব, আপনি কি জানেন—আপনার একটুখানি না বলা কথার অপেক্ষায় কেউ প্রতিদিন আপনাকে খোঁজে?”
যদিও কবি সাহেব এখন নীরব, তবু মেহরিনের চারপাশটা একেবারে নিঃশব্দ নয়। একজন মানুষ আছে,
রিদ তালুকদার। যার মুখে সবসময় গাম্ভীর্যের ছায়া, যার কণ্ঠে ছিল না কোনো বাড়তি শব্দ, যার চোখে সবসময় এক অদ্ভুত শীতলতা খেলা করত। সেই রিদ—এক সময় মেহরিনকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলত। যেন মেয়েটার সরলতা, তার চঞ্চলতা, তার কথা বলার ভঙ্গি—সব কিছুই রিদকে বিরক্ত করত।
কিন্তু এখন?
রিদ বদলে গেছে। হয়তো আস্তে আস্তে, একটু একটু করে—কিন্তু বদলটা সত্যিই দৃশ্যমান।
মেহরিন এখন অসুস্থতা থেকে ধীরে ধীরে সেরে উঠছে। আর এই সময়েই রিদ যেন নীরবে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন নিয়মিত খোঁজ নেয় সে,
ঔষধ খেয়েছো?
ঘুম ঠিকমতো হচ্ছে তো?
চুমকি বাইরে গেলে তুমি একা থাকবে না, ঠিক আছে?
এই শব্দগুলো হয়তো খুব সাধারণ। কিন্তু রিদ যখন বলে, তখন যেন প্রতিটি শব্দ মেহরিনের মনে ভালো লাগা তৈরি করে।
মেহরিন ভেবে পায় না—এই কি সেই রিদ? যে একসময় তার চোখে চোখ রাখত না? যে হঠাৎ সামনে পড়লে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিত? সেই রিদ এখন মেহরিনের জন্য অপেক্ষা করে, চিন্তা করে, এবং এক নিঃশব্দ যত্নে তাকে আগলে রাখে।
এই বদলে যাওয়া রিদকে দেখে মেহরিনের হৃদয়ে এক অচেনা আলো জ্বলে ওঠে। সে জানে না—এই কেয়ার,শাসন, অধিকার এগুলো কে ঠিক কি নাম দেওয়া যায় শুধুই বন্ধুত্ব নাকি অন্য কিছু । কিন্তু জানে, রিদ আর আগের মতো নেই।
আর সে নিজেও, দিন দিন এই নতুন রিদকে দেখে অজান্তেই বদলে যাচ্ছে।
আজ সকালেই রাহি এসেছে, সঙ্গে একগাদা হাসির মালা গাঁথা। মেহরিন বাড়ি আসার পর থেকে রাহি দুদিন পরপরই দেখতে চলে আসো মেহরিনকে।মেহরিন বিছানায় বসে আছে, মুখ গম্ভীর। চুমকি তখন হাতে ভাতের বাটি নিয়ে মেহরিনকে খাওয়ানোর ট্রাই করছে।
রাহি ওদের দুইজনকে দেখে আনমনেই হাসে ওদের বন্ধুত্বটা দেখে ওর খুব ভালো লাগে।আজকাল এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
রাহি ঢুকেই বলল,
হ্যালো বিউটিফুল লেডি’স। omg মিস চুমকি যে…. তা আপনার খাওয়ানোর পর্ব কতদূর? তার পর দুষ্ট হাসি দিয়ে বলে,
চুমকি আপু, আজকে আমি একটা প্রশ্ন এনেছি।
চুমকি বিরক্ত হয়ে বলল,
তোর প্রশ্ন মানেই তো বিপদ। ঝেরে কাশো মেরি মা যা বলার সোজা বল।
রাহি হেসে বলল,
আচ্ছা, যদি একজন ছেলে মেয়েকে বলে, তোমার চোখে আলু আছে —তাহলে সেটা কমপ্লিমেন্ট নাকি অপমান?
মেহরিন চোখ বড় বড় করে চুমকির দিকে তাকালো। চুমকি বলল,
তুই কি পাগল? চোখে আলু কেন থাকবে?
রাহি গম্ভীর গলায় বলল,
কারণ ছেলেটা রান্না করে না, তাই সে চোখে আলু দেখছে, তার মানে—ওই মেয়েটা রান্না করতে জানে। এবং সে বিয়ের জন্য পারফেক্ট!
চুমকি বাটি নামিয়ে দিয়ে বলল,
মেরি মা তুই কী খেয়েছিস সকালে? সত্যি করে বলতো ঘাস না পাতিলের ঢাকনা?
রাহি বলল,
না গো আমার শ্রদ্ধেয় আপু, আমি খেয়েছি বুদ্ধির ঝোল।
মেহরিন হাসতে হাসতে বলল,
তোর বুদ্ধির ঝোল দেখে তো আমার মনে হচ্ছে সেটা জলের বদলে পাগলামিতে সেদ্ধ হয়েছে!
এবার চুমকি আর রাহি একসাথে এমন এক নাটক শুরু করল—
রাহি বলল,
মেহরিন আপু, তুমি যদি আজকে ভাত না খাও, আমি চুমকি আপুকে দিয়ে তোমাকে প্রেমপত্র পড়াতে বাধ্য করব!
চুমকি চিৎকার করে উঠল,
ওই মেরি মা না প্লিজ ! আমার প্রেমপত্র তো ২০০৮ সাল থেকে ‘ড্রাফট’ অবস্থায় আছে, সেন্ডই করিনি!
রাহি বলল,
ভালোই তো! আজকে সেন্ড করো—প্রাপক: আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই শান্ত।
চুমকি এবার রাহির দিকে চোখ গরম করে তাকায়। কিন্তু রাহী গায়ে মাখল না।
মেহরিন এতক্ষণে হেসে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে, বলছে,
প্লিজ, বন্ধ কর।আমার পেট ব্যথা করছে! আর একটাও বলিস না।
রাহি থামছে না, আবার বলল,
আর জানো? চুমকি আপু ছোটবেলায় এক ছেলেকে প্রোপোজ করেছিলো এই বলে,
‘তোমার নাম চঞ্চল, কিন্তু তুমি আমার হৃদয়ে একদম স্ট্যাবিলাইজার!’
চুমকি লাফিয়ে উঠে বলল,
রাহি! আমি বলছি, তোর এই মুখে আমি তেল মাখিয়ে চিপা দিয়ে ডিম ভাজা করে ফেলব!!
তারা তিনজন হাসতে হাসতে এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে মেহরিন এক হাতে পেট চেপে, আরেক হাতে চুমকিকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
“তোমরা দুইজন মিলে আমাকে মারার প্ল্যান করতেছো, হাসিয়ে হত্যা! এটা কিন্তু জাতি মেনে নিবে না।
রাহি আর চুমকি ক মিলে এক বিপজ্জনক প্ল্যান করলো। রিদকে প্রাঙ্ক কল করবে।একথা শুনেই মেরিন বলল আমি ভাই এই সবে নাই রিদ ভাইয়া অনেক রাগী যদি রেগে রেগে যায়। রাহি আর চুমকি পাত্তাই দিল না মেহেরিন এর কথা।
প্রাঙ্ক কল মিশন: রিদ তালুকদার!
রাহি আর চুমকি মিলে এমন একটা প্ল্যান বানিয়েছে, যেটা শুনলেই মনে হবে ওমা, এরা সত্যিই বেঁচে আছে কিভাবে? এত শয়তানি বুদ্ধি নিয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারে? আচ্ছা এরা রাতে ঘুমায় কিভাবে এত বুদ্ধি নিয়ে? ভাগ্য ভাল কোন সাংবাদিক এদের বুদ্ধি সম্পর্কে জানেনা। জানলে হয়তো কবে এই দুইজনকে জাদুঘরে নিয়ে রাখতো।
চুমকি চোখ ছোট করে বলল,
শোন রাহি, রিদ ভাই একটু গম্ভীর টাইপের মানুষ। ওকে ফোন দিয়ে হাস্যকর কিছু বললে যদি রেগে যায়?
রাহি বলল,
তুমি চিন্তা করো না। আমি গলা পাল্টে ফোন করব। বলব—‘আমি ম্যাডাম শেফালী, প্রেম প্রফেশনাল, আপনার জন্য একটা লাভ কনসালটেন্সি ওপেন করেছি!’
মেহরিন বিছানায় বসে মুখে বালিশ চেপে হাসছে। সে জানে এই দুইজন মিলে পৃথিবীর যেকোনো শান্ত পরিবেশকে জঙ্গল বানাতে পারে।
রাহি ফোন নিল, গলা বদলে বলল,
হ্যালো স্যার, আমি শেফালী। আজকে আপনার ভাগ্যে প্রেম লেখা আছে – এক গোলাপ, এক বিরিয়ানি আর এক মিষ্টি মেয়ে!
ওপাশ থেকে রিদ কিছুক্ষণ চুপ। তারপর বলে,
…কি বলছেন তাই নাকি?তা আর কী কী আছে আমার ভাগ্যে ?
তুমি কি আর রাহি একে অপরের দিকে চাইলো তারপর শয়তানি হাসি দিলো।
রাহি গম্ভীর গলায় বলে,
স্যার, আমি আপনার লাইফের এক্সট্রা প্রেম। আপনি বলুন, আপনি কার প্রেমে গাইবেন,
তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি— “না” তুমি বিরিয়ানি তাই খেয়ে থাকি?
রিদ এবার খুব ঠাণ্ডা গলায় বলে,
তুমি যদি রাহি হও, তাহলে চুমকি তোমার পাশে। আর মেহরিন নিশ্চয়ই পাশে বসে হাসছে। আমি ঠিক বললাম?
এক সেকেন্ড নিঃশব্দ।
তারপর হঠাৎ চুমকি বলে উঠল,
ওরে বাবা! রিদ ভাই তো গুপ্তচর বের হল!
মেহরিন মুখে বালিশ চেপে হাসতে হাসতে বিছানার এক পাশে গড়িয়ে পড়ল। রাহি হাল ছেড়ে দিল,
“ওকে দাদাভাই, তুমি যেহেতু দূরে ফেলেছো, আমি প্রেম বেচা বাদ দিলাম!”
রিদ একটু হেসে বলল,
তোমাদের হাসি ভালো লাগছে শুনে… carry on. আর মেহরিন, তুমি সকালের ওষুধ খেয়েছ তো?
মেহরিন তখনো হাসির ঘোরে, ‘হ্যাঁ’ বলল।
রাহি বলল,
“ওষুধ তো খায়, কিন্তু আমরা ওকে হেসে-হেসে সুস্থ করে দিচ্ছি!”
রিদ এবার শান্ত গলায় বলল,
তোমাদের মতো বন্ধুই হলে, ডাক্তার লাগে না…
তিনজন কিছুক্ষণ চুপ। তারপর হঠাৎ চুমকি বলে উঠল,
ভাই, কথাটা প্রেমে গেলো নাকি চিকিৎসায় গেলো, একটু পরিষ্কার করেন প্লিজ!
রিদ একটু হেসে বলল তোমরা যা ভাবো এরপর বাই বলে কলটা কেটে দিলো।
কলটা কাটার পর রিদ বলে,
তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও মেহরিন পাখি। তোমার অসুস্থতা যে শুধু তোমাকে নয় আমাকেও পোড়ায়।
রাহি হঠাৎ চোখ গোল করে ঘোষণা দিল,
সবাই থামো! আমার কাছে একটা গুপ্ত গরম খবর আছে!
চুমকি বলল,
তুই আবার খবর নিয়ে গবেষণা শুরু করলি নাকি? আগেরবার তো বলেছিলি রাস্তার কুকুর বিয়ে করছে!
রাহি গম্ভীর গলায় বলল,
এইটা কিন্তু আসল খবর। আমার দাদা ভাই প্রেমে পড়েছে!
মেহরিন অবাক হয়ে উঠে বসে,
কী! রিদ ভাই? আর প্রেমে?
রাহি মাথা নাড়ে,
হ্যাঁ। আর আমি নিশ্চিত, ওর চোখে এখন হালকা গ্ল্যামার ফিল্টার, হাওয়ায় হালকা রোমান্টিক মিউজিক!
চুমকি আস্তে বলল,
আমি আগেই বলেছিলাম, গম্ভীর মানুষরা প্রেমে পড়লে এমন হয় যেন শোরষের মধ্যে ভূত ঢুকে গেছে!”
মেহরিন হাসতে হাসতে বলে,
মানে?
রাহি তখন গলায় ঝাঁজ এনে বলল,
আমি যদি ভুল বলি, তাহলে কাল থেকে আমি লাউয়ের পাতার ফেস মাস্ক পরে ঘুরবো !
ঠিক তখনই দরজায় টুকটাক শব্দ—ঢুকছে মেহবুবা ! সে চারদিকে তাকিয়ে বলে,
কি রে, এত হাসির উৎস কী প্লিজ দয়া করে ব্যাখ্যা মি?
রাহি দৌড়ে গিয়ে বলে,
আরে মেহবুবা জানু, ভাবো তো, দাদাভাই কাউকে প্রেম নিবেদন করে এই বলে—
তুমি ওষুধের মতো, প্রথমে তিতা, পরে আরাম!
মেহবুবা হো হো করে হেসে পড়ে,
“আল্লাহ! ওরে প্রেমিক ভর্তা বানিয়ে ফেলেছে!
চুমকি পেছন থেকে বলে,
আর ওর প্রেমিকা হবে নিশ্চয়ই একেবারে ডাবের পানি’— ঠান্ডা, শান্ত, মিষ্টি আর সোজা হৃদয়ে! গিয়ে ধক ধক…
মেহরিন তখন বলে,
রিদ ভাইয়ের প্রেম মানেই তো “দমকা ধুমকি -ঝাড়ি দেওয়া মতো হিসেবের খাতা!
চারজন এমন হাসছে যে, কেউ একে অন্যকে দিচ্ছে বালিশ পেটা, কেউ হাসতে হাসতে বিছানা থেকে পড়ে যাচ্ছে।
রাহি এক হাতে পেট চেপে বলে,
আমি আর বলবো না! আমার হাঁচির সাথে সাথে হাসিও বের হয়ে আসছে!
মেহবুবা হেসে বলল,
এই বাড়িতে প্রেম হোক না হোক, হাসির প্যান্ডেমিক শুরু হয়ে গেছে!
হাসতে হাসতে ক্লান্ত চারজন মেয়েই তখন বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। রাহি বালিশ মুখে চেপে ফুঁসছে, মেহবুবা পানির বোতল খুঁজছে, আর মেহরিন চুপচাপ জানালার দিকে তাকিয়ে। এমন সময় চুমকি এক দৃষ্টিতে মেহরিনের মুখের দিকে তাকায়।
হাসিমুখ, কিন্তু চোখে হালকা ভাবনার ছায়া।
মনে মনে বলে ওঠে,
আমি এতদিন যা ভেবেছি, সেটা যদি সত্যি হয়… তাহলে রিদ ভাই মেহরিনকে ভালোবাসে।
চুমকির মনে সিনেমার মতো একেকটা মুহূর্ত ভেসে ওঠে—
রিদ ভাইয়ের সেই নিঃশব্দ চোখের চাওয়া, মেহরিনের প্রতি তার যত্ন, বারবার খোঁজ নেওয়া, আর সেই দৃষ্টি… যেন মেহরিনকে হারানোর এক অদৃশ্য ভয় সবসময় ওর চোখে লেখা থাকে।
চুমকি চুপচাপ বলে উঠল,
আমি রিদ ভাইয়ের চোখে দেখেছি… একটা ভয়… হারিয়ে ফেলার ভয়। আর সে ভয় কেবল তখনই হয়, যখন কেউ কারো জন্য সত্যিকারের অনুভব করে।
একটু পর মেহরিন চুমকির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। হয়তো কিছু বুঝতে পারে, হয়তো না।
চুমকি কিছু বলেনি আর—শুধু মেহরিনের চোখে তাকিয়ে নিজের মনে বলল,
দেখি, এই গল্পটা কোথায় গিয়ে থামে… নাকি শুরু হয় একদম নতুন করে!
এমন সময় ট্রিং ট্রিং করে ওর ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে নামটা দেখে হঠাৎ এক গাল হেসে উঠে দাঁড়ায়—
শান্তু কলিং…
চুমকি তড়িঘড়ি করে বলল,
আমি একটু ব্যালকনিতে যাচ্ছি!
রাহি ভ্রু কুঁচকে বলল,
আরে ব্যালকনি? হঠাৎ এত রোম্যান্টিক হাওয়া কোথা থেকে?
চুমকি কিছু না বলে হালকা হেসে বেরিয়ে গেল।
রাহি চট করে মেহবুবার হাত চেপে বলল,
চল, মিশন: প্রেম গোয়েন্দা! ব্যালকনির পাশে জানলার ফাঁক দিয়ে সব শুনবো।
মেহবুবা চোখে নাটকীয় ভাব এনে বলল,
আমার তো মনে হচ্ছে ব্যালকনি না, ওটা এখন রোম্যান্স রেডিও স্টেশন।
দুজনে আস্তে আস্তে পা ফেলে দরজার ফাঁক থেকে কান পাতলো। ব্যাকগ্রাউন্ডে মৃদু বাতাসের শব্দ, আর চুমকির নরম কণ্ঠ:
— তুমি কি একদিনও বলতে পারো না শান্ত, তুমি কেমন অনুভব করো?
ওপাশ থেকে শান্ত বলে — তুমি জানো, আমি ঠিক বলতে পারি না এসব… কিন্তু তুমি ছাড়া সব কিছু যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সব কথা কি মুখেই বলতে হয় চুমকি?
রাহি মুখ চেপে ধরে, মেহবুবা চোখ বড় করে ফিসফিস করে,
ও মা! ডায়লগ শুনলি? যেন হিন্দি সিরিয়ালের রিপিট টেলিকাস্ট!
মেহরিন জানলার ধারে বসে ছিল—সব দেখছে।
ওর ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি, মনের কোণে একটুখানি শান্তি।
চুমকি, যে কখনও হাসির রাজত্বে রানি, আজ সে নিজেই কারো ভালোলাগার সপ্নের রানী।
মেহরিন ধীরে বলে,
এরা তো একেকজন প্রেমের ল্যাবরেটরি চালাচ্ছে… আমি রোগী, ওরা ডাক্তারের জায়গায় কেউ প্রেমে পড়ে গেছে! আবার কেউ তাকে কাঠি করছে।
আর হঠাৎই রাহি আর মেহবুবা চুপচাপ ফিরে এসে বলে,
হাসছো কেন ?
মেহরিন বলে,
হাসছি এই ভেবে… ভালোবাসা সত্যি খুব সুন্দর জিনিস—যদি চুপিচুপি কাউকে ভালো লাগেও, ওরা কেউ জানুক আর না জানুক… আশপাশে কেউ না কেউ ঠিক বুঝে ফেলে!
মেহরিন বলে,
আচ্ছা রাহি, প্রেম মানে কি মশার মতো? একবার কামড় দিলেই সব জায়গায় ছড়ায়!
রাহি বলে,
না না, প্রেম মানে হলো…
‘একটা হৃদয় আরেকটা হৃদয়ের সাথে চুপিচুপি চিপায় গিয়ে Wi-Fi কানেকশন খোঁজা!
চারদিকে আবার হাসির ঝড়, আর চুমকি শুধু মাথা নিচু করে বলে,
এই মেয়েগুলা একদিন আমার বিয়েতেও হইচই করে বর কে দৌড়াতে বাধ্য করবে!
রাহি আজ মেহেরিন দের বাসায় থাকবে। বাসায় কোন প্রবলেম হবে না কারণ রাহি বাসায় বলে এসেছে আজ এখানে থাকবে। তারপরেও রিদকে কল করে বলে দিয়েছে।
রাতের খাবার পর, চারপাশে একটু নিরবতা। রাহি কায়দা করে চুমকিকে কফি আনতে পাঠিয়েছে। তুমি কি কে বলে? চুমকি আপু এখন যদি তোমার এ হাতের এক কাপ কফি না খেতে পারি? তাহলে আমার জীবনটাই বৃথা চুমকি ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে কফি আনতে গেল ।
রাহি হঠাৎ মেহবুবার পাশে বসে বলে,
শুনো, আমি একটা সিরিয়াস মিশন শুরু করতে চাই।
মেহবুবা ভ্রু কুঁচকে বলে,
মিশন? নতুন প্রেমে পড়ছিস নাকি?
রাহি গম্ভীর গলায় বলল,
না… মিশন ‘চুমকি-শান্তর প্রেম উদ্ধার অভিযান।
মেহবুবা অবাক,
ওদের প্রেম কি হারিয়ে গেছে নাকি?
মেহরিন জানলা দিয়ে চেয়ে বলল,
না হারায়নি… কিন্তু মুখ দিয়ে ‘ভালবাসি’ কথাটাই বের হয় না! দুজনেই একে অপরকে ভালোবাসে বলদ দুইটা , কিন্তু বলার বেলায় মুখে তালা।
তখন তিনজন মিলে টেবিলে বসে একটা ‘প্রেম পরিকল্পনা’ শুরু করল।
মিশন নাম:
ভালবাসা মুখ ফুটিয়ে বলাও একধরনের সাহসিকতা!
পরিকল্পনা নম্বর ১: প্রেমের নাটকীয় উত্তেজনা
রাহি বলল,
চুমকি আপু হঠাৎ শান্তকে বলবে— ‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে’। দেখা যাবে, শান্ত ভাইয়া ওভার ড্রামা করে এসে বলে— “না” এ হতে পারে না তুমি আমার না হলে আমি আর কারো হতেও দিবো না।
মেহবুবা হেসে গড়িয়ে পড়ল,
“তখনই প্রেমের কনফেশন না হয়ে গীত গাওয়ার অনুষ্ঠান হয়ে যাবে!”
পরিকল্পনা নম্বর ২: চিরকুট ফাঁদ
মেহরিন বলল,
চুপিচুপি শান্তর ব্যাগে একটা চিরকুট ঢুকিয়ে দেবো— ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’ লেখা থাকবে। শান্ত ভাববে চুমকি দিয়েছে, খুশিতে মেসেঞ্জারে লিখে বসবে— তোমার কথাটা আমি অনেকদিন ধরে শুনতে চেয়েছিলাম।
রাহি চিৎকার করে বলে,নাাাাা…
তখন চুমকি বলবে— আমি তো কিছু দেইনি আর শান্ত ভাইয়া অবসাদে তপস্যায় বসে যাবে!
পরিকল্পনা নম্বর ৩: প্রেমীয় নাটক খেলার আয়োজন
মেহবুবা হঠাৎ মাথা ঠুকে বলল,
সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে— আমরা একটা ছোট নাটক আয়োজন করব, যেখানে চুমকি-শান্ত থাকবে লিড রোলে। স্ক্রিপ্টেই থাকবে শেষ সিনে শান্তকে বলতে হবে— ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’। ব্যস!
রাহি তালি মেরে উঠে বলল,
এটা পারফেক্ট! নাটক শেষ, কনফেশন রিয়েল।
মেহরিন হেসে বলে,
আর যদি ও কনফেশনের সময় হঠাৎ হকচকিয়ে যায়, তখন আমি ব্যাকগ্রাউন্ডে গেয়ে উঠবো—
এই প্রেম প্রেম খেলা নয় ভাই… মুখে বললে তবেই হয় হানিমুনে যাওয়া তাই!
তিনজন এমন হাসছে, এমন সিরিয়াস প্ল্যান করছে যেন চুমকি-শান্তর প্রেম কনফেশন না হলে ওরা রাষ্ট্রপতি ভবন ঘেরাও করবে।
রাহি কে মাহির ডেকে নিয়ে গেছে ওদের দুইজনের খুব ভাব দুজনেই গেম প্লেয়ার কিনা। দুজন মিলে মাহিরের রুমে গেম খেলছে।
মেহরিন তখন বিছানায় চুপচাপ বসে, বালিশে হেলান দিয়ে একটা চিপসের প্যাকেট নিয়ে গম্ভীর মুখে ভাবছে—
এই জীবনটাই একটা ট্র্যাজেডি… কবি সাহেব কোথায় যেন উধাও।
চুমকি আর মেহবুবা তখন পাশে বসে নাটক করছে—
ও চুমকি আপু, তুই বল তো, কবি সাহেব আবার বিয়ে শাদী করে ফেললো না তো ?
চুমকি বলে, কি জানি হলে হতেও পারে। আর কি কবিতা পাঠাবে? এখন তো স্ত্রীকে পাঠাবে— গিন্নি, তেল, মাছ, বাজার নিছে আসবো।নাকি তুমি শুধু আমার ভালেবাসা খেয়ে থাকতে পারবা। ওদের ভালোবাসা খাওয়ার চক্করে কবিতা তো গেল গাঙ্গে!
ওদের কথায় মেহেরিন খুব বিরক্ত হয়। মনে মনে বলে আমি মরি আমার জ্বালায় আর ওরা এসে মজা লয়।
এই সময় টিং! করে ফোনে একটা মেসেজ।
মেহরিন চিপস মুখে তুলছিল, হাত থেমে গেল।আবার এসএমএস?
মনে মনে বাজে—
হয়নি তোরে ভোলা… কবিতা এখনও গায় মন… কবি সাহেব! আপনি?
আচমকা উঠে বসল, ফোন হাতে।
চোখে একরাশ উত্তেজনা। ধীরে ধীরে খুলে…
রিদ ভাইয়া : “Dinner korso, ? Ar Rahi beshi dustomi korche na to?
মেহরিন তিন সেকেন্ড চুপ, তারপর এমন চিৎকার—
“হায়রে কপাল! এ তো কবি সাহেব না, রিদ ভাই! আর আমি ভাবছিলাম ‘চাঁদের আলোয় লেখা প্রেমপত্র’ আসবে!”
মেহবুবা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে,
কবি সাহেব না, রিদ সাহেব আজকাল প্রেম-পত্রে চিপসের খোঁজ নেয়!
চুমকি বলে উঠল,
তোর এই ‘poetic expectation’ এর জন্যই তোর প্রেম হবে না। তুই সোজা মেসেজের মধ্যেও কবিতা খুঁজিস!
মেহরিন ফোন বুকে চেপে বলে—
তাই তো! এখনকার কবি সাহেবরা ডিনার-লাভার মেসেজ দেয়!
তবে রিদ ভাই কবে জানি বলে— খাবার গিলেছো, মেডিসিন গিলেছো ?
তিনজন এমন হেসে উঠল, যে পরের তিন মিনিট কেউ কিছু বলতে পারল না।
আর ওদিকে অপেক্ষায় মেহরিনের রিপ্লাই এর
মেসেজের পর কয়েক মিনিট পেরোয়নি, হঠাৎ করেই মেহরিনের ফোনটা বাজে।
“Rid Talukder calling…”
মেহরিন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে।
চুমকি পাশ থেকে বলে,
এই তোর কবি সাহেব এসএমএস করছে না! তাই বলে কী অন্য কেউ নাই নাকি হুম ধর ধর, না হলে ভাববে তুই ডিনার করিসই নাই!
মেহরিন তাড়াতাড়ি ফোনটা কানে তোলে, গলা পরিষ্কার করে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে।
“আসসালামু আলাইকুম…”
ওপাশ থেকে রিদ একটু হালকা গলায় বলে,
ওয়ালাইকুম সালাম… কেমন আছো?
মেহরিন ঠোঁট কামড়ে ধরে হেসে ফেলে,
জি ভালো আছি। আপনি?
রিদ বলে: হুম ভালো।
কি করছো এখন? ওষুধ খেয়েছো তো?
মেহরিন যেন একটু থমকে গিয়ে হাসল,
হ্যাঁ, এখনই খেয়েছি। একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।
ওপাশে রিদ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে,
রাহি আজ একটু বেশি দুষ্টুমি করছে মনে হয়।
মেহরিনও হেসে ফেলল এবার,
না না তেমন কিছুই করেনি।
রিদ হালকা গলায় হেসে বলে,
রাহিকে সামলানো কঠিন… কিন্তু তুমিও তো খুব কম না।
মেহরিন থতমত খেয়ে যায় কথাটায়। কী বলবে বুঝে না।
তখনই রিদ বলে,
**আচ্ছা তাহলে রাখি… বিশ্রাম নাও।
কল কেটে গেলে মেহরিন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তার বুকের ভেতর কেমন একটা অজানা নরম স্পর্শ খেলে যায়।
চুমকি খিলখিল করে বলে উঠে,
“এইবার বুঝলি তো, কবি সাহেব ছাড়াও পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে খোঁজ-খবর নেওয়ার।
মেহরিন মুখ ঘুরিয়ে রাখে, কিন্তু তার গালে লালচে ছায়া স্পষ্ট।
কারণ এটা সত্যি আজকাল রেদ মেহেরিনের খুব যত্ন নেয় সব খোঁজ খবর রাখে।
এদিকে….
কল কেটে যাওয়ার পর…
রিদ ফোনটা বুকের কাছে চেপে ধরে। চোখ বুজে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। তারপর খুব ধীরে, যেন মেহরিন শুনছে এমন করে নিজের মনের কথা বলে—
“তোমাকে আমি আমার বুকের বাঁ পাশে রাখি, মেহরিন পাখি…
তুমি জানো না, কিন্তু আমার প্রতিটা নিঃশ্বাসে এখন তুমি জড়িয়ে আছো।
তোমায় একটু দেখতে চাওয়ার যে তৃষ্ণা, তা আমার দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছে।
তোমার মুখটা দেখলে কন্ঠটা শুনলেই যেন সারা দিনের সব ক্লান্তি মিলিয়ে যায়।”
তার চোখের কোণে একটুখানি মায়া খেলে যায়,
“তবে খুব বেশি দিন না…
খুব তাড়াতাড়ি তোমায় আমার জীবনের একমাত্র পরিচয় করে নিয়ে আসব—
আমার ঘরের বউ হিসেবে, আমার জীবনের ছায়া করে তুমি হবে আমার বুকের বাঁ পাশরের বাঁকা হার। আমার হৃদয়ের বাঁকা হরিণী।
সকালে ঘুম ভাঙলেই তোমায় দেখব পাশে—তোমার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখি আমি হৃদয়ের সকল তৃষ্ণা মেটাবো,
রাতে অফিস থেকে ফিরলে তোমার মুখটা দেখলেই আমার সকল ক্লানি গ্লানি কেটে যাবে।আর তুমি এসে বলবে বলবে,
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১০
আজ আমি আপনার পছন্দের সব রান্না করেছি…’এটাই হবে আমার প্রাপ্তির খাতায় বর প্রাপ্তি।
তুমি সেই মেহরিন পাখি—
যার জন্য আমার এই কঠিন মনটা নরম হয়ে যায়।
তোমার জন্যই বেঁচে থাকাটা এত সুন্দর লাগে।