মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৩

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৩
মির্জা সূচনা

বাস চলছে আপন গতিতে, জানালার পাশে হালকা রোদ পড়েছে। হঠাৎ করেই রাকিব, মুখটা হালকা কুটিল হাসিতে মুড়ে, পাশে বসা রাহির দিকে ঘুরে বলে—
রাহি, বলো তো দেখি, তোমার মাথায় এত শয়তানি বুদ্ধি আসে কোত্থেকে?
রাহি তখন ঠোঁট ফুলিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, কথাটা শুনেই চোখ বড় বড় করে বলে—
মানে?

তুমি কি আমাকে অপমান করলে?
রাকিব হেসে দুই হাত সারেন্ডার করার মত তুলে বলে,
না না বিশ্বাস করো আমার ঘাড়ে একটাই মাথা। অকালে সেটা হারাতে চায় না। আমি তো প্রশংসা করলাম। এমন চালাকি তো সব মেয়ের পক্ষে সম্ভব না!তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি ?
রাহি এক ঝটকায় ঘুরে বসে বলে—
শুনো রাকিব ভাইয়া, আমার মাথায় শয়তানি না, ওটা হচ্ছে ‘ক্রিয়েটিভ মাইন্ড’। ওটা আপনি বুঝবেন না—আপনার তো সোজা পথে হাঁটার অভ্যাস। বাঁকা পথের সৌন্দর্য চোখে পড়ে পরবে না। তাহলে তো আবার আপনার কানা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
বাসে সবাই হেসে ওঠে।
রাকিব চুপচাপ হাসে।
রাহি আরও এক ধাপ এগিয়ে বলে—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আর এই চাল, এই প্ল্যান—এই তোদের হাসি ফোটানোর জন্য! একঘেয়েমি যাত্রা কার ভালো লাগে? আমি না থাকলে আজ রিদ ভাইয়া কি ওইখানে বসতো?
চুমকি পিছন থেকে বলে—
সত্যি বলছি রাহি, তোর মাথায় কোনো যাদু আছে!
রাহি গলা তুলে বলে—
মাথায় যাদু, মুখে ছড়া, চোখে আগুন! আমি যেখানে যাই ওইখানেটাই যায় জমজমাট করে তুলি,কারন আমার সবাইকে হাসিখুশি দেখতে ভালো লাগে।
মেহরিন লজ্জা পেয়ে মুখ লুকায়, আর রিদ পাশে বসে হালকা মুচকি হেসে রাহির দিকে তাকায়—
অভিমানে না, মজা পেয়েই।
এটা সত্যি রাহি যেখানেই যাই সবাইকে হাসি খুশিতে মাতিয়ে রাখে।
রাকিব মাথা নেড়ে বলে—

আল্লাহ, এই মেয়ের স্বামীর মন ও জীবনের মাগফেরাত কামনা করছি। এই মেয়েকে সামলানো কারও কাজ না!
রাহি চোখ টিপে বলে—
ভাইয়া, সামলানোর দরকার নাই—আমি নিজেই নিজের রাস্তা বানিয়ে নেই!
বাসের ভেতর আবার হাসির ঝড়।
তিন দিনের সফর শুরু হয়েছে মাত্র—কিন্তু মজার স্মৃতি তো প্রথম ঘণ্টাতেই জমে উঠেছে!
বিকেল তিনটা
হাসি মজা করতে করতে সবাই চলে এসেছে নিজেদের গন্তব্যে।বাস থেকে সবাই একে একে নেমে পড়ে, ওরা যেখানে উঠেছে জায়গাটা খুব সুন্দর।

বাস থেকে নামার পর সবাই যখন ক্লান্ত চোখে চারপাশের অপরূপ দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত, তখন স্যার গলা তুলে বললেন
সবাই একটু চুপ করো! আমরা অনেকটা পথ জার্নি করেছি। এখন আগে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও সবাই। আজ আর আমরা রিপোর্ট বানাতে যাবো না।তবে বিকেলে সবাই একসাথে ঘুরতে বের হবো।রিসোর্টে রুম সংখ্যা সীমিত, তাই প্রতি রুমে ৪-৫ জন করে থাকতে হবে। তোমাদের নাম অনুযায়ী লিস্ট তৈরি করে রুম ভাগ করা হয়েছে। এক্ষুণি তোমরা চাবি নিয়ে যার যার রুমে চলে যাও।”
পাশে থাকা ম্যাডাম হাতে তালিকা নিয়ে ডাকতে শুরু করলেন।
Room 203 — Mehrin, Rahi, Chumki, Sathi, Mow.
Room 204 — Rid, Shanto, Rakib, Rafsan, Suhan.
এভাবে একে একে সবাইকে বলে দেওয়া হল কে কোন রুমে থাকবে আর কারা কারা থাকবে।
চুমকি এক লাফে বলে উঠলো,
আমরা রিদ ভাইয়ার পাশের রুমে? ও মা, এখন একটু বেশি গলার আওয়াজ করলে সমস্যা হবে না তো?
রাহি হেসে বলে,

চুমকি আপু তোর গলার আওয়াজ তো এমনিতেই পাঁচটা রুমে পৌঁছে যায়, এখন কি আর কিছু হবে?
রুম ১০৩ বেশ আরামদায়ক। একটা বড় জানালা, ২ টা খাট , আর কাঠের আলমারি। মেহরিন চুপচাপ বিছানায় বসে, চারপাশ দেখছে। রাহি আয়নায় চুল ঠিক করে নিচ্ছে, সাথী আর মৌ ফ্রেশ হতে গেছে আর চুমকি লাগেজ খুলে জামা বের করছে।মেহরিন জানলার দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক পাশের রুম ১০৪-এ রিদ ব্যাগ থেকে বই আর ডায়েরি বের করে রাখছে। শান্ত জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিচের লনে তাকিয়ে থাকে। আর রাকিব হেসে বলছে—
দোস্ত, দ্যাখ, পাশের রুমেই তোর স্পেশাল টার্গেট।
রিদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়।

আবার শুরু করলি?
আরে ভাই, চুমকি তো বলছিলেই, তুই নাকি তার মেহুর দিকে মাঝে মাঝে এমন তাকাস, যেন ইতিহাসের পাতার গল্প লিখতে বসিস।
রিদ হাতের কাছে একটা কুশন পেয়ে তা ছুড়ে মারে রাকিবের মুখে আর বলে জাস্ট শাট আপ।
রিদ হালকা হেসে বইটা খুলে ফেলল, কিন্তু তার চোখ বারবার চলে যায় দেয়ালের দিকে। যেন পাশের রুমের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে।
আর ঠিক তখনই…

রাহি, পাশের রুমে, দরজার কাছে এসে বলে—
হ্যালো পাশের ঘর! আমার হেব্বি খিদে পেয়েছে , কিন্তু খাওয়ার কথা ভুলে গেলে নাকি? কেউ নিচে নামবে?
রাকিব দরজার কাছে গিয়ে বলে—
আই এম এক্সট্রিমলি সরি ম্যাম, আমাদের আগেই বুঝা উচিত ছিল আমাদের সাথে মহারানী ভিক্টোরিয়া এসেছে যেকোনো সময় তার খিদে লাগতে পারে। দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন সবাই ফ্রেশ হোক দেন নিচে গিয়ে আমরা সবাই একসাথে খাবার খাই খাবো।
মেহরিনের কণ্ঠ এবার শোনা যায়—
সিনিয়ার হয়ে তো এটুকু দায়িত্ব অবশ্যই পালন করা উচিত ছিল। মানুষের খিদে তো বলে কয়ে আসেনা তাই দয়া করে সারগন আপনারা ফ্রেশন তাড়াতাড়ি ।

রিদ একটু হেসে ফেলে। দেয়ালের এ পাশে সে, ও পাশে মেহরিন—আর মাঝখানে শুধু এক ইঞ্চি দেয়াল।
কিন্তু সেই দেয়ালের ভেতরেই যেন জমে থাকে হাজারটা না বলা কথা।
সন্ধ্যা ৭ টা
বিকেলে সবাই খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়ে ছিল। রিসোর্ট এর বাগানটা খুব সুন্দর চারদিকে নানান রকমের ফুল গাছ আর লাইটিংয়ে খুব সুন্দর একটা আমেজ।
বাগানে গোল হয়ে বসেছে সবাই—রাকিব রসিকতা করে, শান্ত মাঝেমাঝে ঠোঁট গম্ভীর করে হাসে, রাহি চিপস খেতে খেতে চোখ নাচায়, চুমকি সবাইকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হাসায়। কিন্তু রিদ চুপচাপ বসে আছে, চোখ তার যেন কারও খোঁজে।এখানে সবাই উপস্থিত শুধু মেহেরিন নেই। রিদ ভাবছে মেহরিন এলো না কেন অসুস্থ হয়ে গেল নাকি এত পথ জার্নি করে এসে। নিজের কৌতুহাল দমাতে না পেরে।
একসময় রাহির পাশে বসে ধীরে গলায় বলে,

রাহি… মেহরিন কোথায়? ওকে তো দেখছি না।শরীর খারাপ করেছে নাকি?
রাহি চমকে তাকায়, তারপর মুচকি হেসে বলে,
না ভাইয়া ও ঠিক আছে। ও তো এখনো ঘুমোচ্ছে আমরা আসার সময় ডেকেছি ও বলেছে আর একটু ঘুমাবে তাই আর ডাকিনি।
রিদ চোখ নামিয়ে বলে,
থেকে ডেকে আনো ? সবাই তো এখানে… ও একা থাকবে কেন?
রাহি আর চুনকি মুখ টিপে হাসে । তারা বুঝতে পারছে মেহেরিনকে মিস করছে।
চুমকি তখন পাশে এসে বলে,
চল রাহি, আমরা একবার দেখে আসি।
রাহি হেসে মাথা নাড়ে,
হুম, চলো।

চুমকি আর রাহি দৌঁড়ে চলে যায় ভিতরে, মেহরিনকে ডেকে আনার জন্য। পেছনে বসে থাকা রিদ কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে দিকটায়, যেখানে গেট খোলা… যেন কেউ আসবে বলে অপেক্ষা করে আছে।
চারপাশে শব্দ, হাসি, আড্ডা…
আর এক কোণায় জমে ওঠা একটুখানি নীরবতা।
সেই নীরবতা—কারও না বলা অনুভবের প্রতিধ্বনি।
রাহি আর চুমকি দরজায় দাঁড়িয়ে একবার মুখ চাওয়াচ্ছে একবারে—তারপর হঠাৎ করেই চুমকি ফিসফিস করে বলে,
এই রাহি… মেহু তো রাজকন্যার মতো ঘুমাচ্ছে!
রাহি চোখ ছোট করে বলে,
তাই তো… ঘুম ভাঙাতে রাজপ্রাসাদ কাঁপানো দরকার।
বলেই সে ধপ করে বিছানায় ঝাঁপ দেয় মেহরিনের পাশে!
চুমকি তার বালিশটা তুলে মাথার কাছে ধরে বলে,
ওই রাজকন্যা… তোর প্রজারা তোকে খুঁজছে!
মেহরিন চোখ মেলে তাকায়, একদম গুমগুমে গলায় বলে,

তোরা কী কেউ পাগল নাকি?এমন বাঁদরের মতো লাফাচ্ছিস কেন, একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দিবি না নাকি ?
রাহি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়,
হ্যাঁ, পাগল হয়েছি মেহু আপু তোর জন্যে! আয় এবার, নিচে সবাই বসে আছে, শুধু তুই নাই।
চুমকি হেসে বলে,
সবার সামনে তোকে না নিয়ে গেলে ওরা ভাববে তোকে বেঁধে রেখেছি!
মেহরিন চোখ কচলে উঠে পড়ে—চুল এলোমেলো, চোখে ঘুমের ছাপ, মুখে একটু বিরক্তি আর খানিক ঘোরলাগা হাসি।

মেহেরিন বলে তোরা দুই মিনিট ওয়েট কর আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। এই বলে মেহরিন ওয়াশরুমে ঢুকে, ফ্রেশ হয়ে আসে। তবুও ওর চোখে মুখে ঘুমের আভাটা লেগে আছে।
ওরা তিনজন একসঙ্গে নিচে নামতে শুরু করে। মেহরিন সবে জুতো পরছে, চুমকি আর রাহি ওকে টেনে নিচে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

তখনই রিসোর্টের বাগানে আলো ছড়িয়ে রয়েছে, রিদ পাশে দাঁড়িয়ে, হালকা কথা বলছে শান্ত আর রাকিবের সঙ্গে।
মেহরিনকে নামতে দেখে ওর চোখ আটকে যায়।
মেহরিনের মুখে তখনও ঘুমের আবেশ, মুখে পানি যা মুখ তোর ধানার মত চকচক করছে লাইটের আলোই, চোখ ঘুম ঘুম ভাবটা রয়ে গেছে , চুল উড়ছে হাওয়ায়, হালকা অসহায় মুখে ও এগিয়ে আসছে—রাহি আর চুমকির দুষ্টু টানে।
এক মুহূর্তের জন্য রিদ স্থির হয়ে যায়। কথা বন্ধ, চোখ বড় হয়ে তাকিয়ে থাকে।
শান্ত তাকিয়ে বলে,

কিরে, হঠাৎ থেমে গেলি কেন?
শান্ত আর রাকিব রিদের চোখ অনুসরণ করে তাকাই ওইদিকে থেমে যাওয়ার আসল কারণটা বুঝে দুজনেই হাসে।
রিদ ধীরে বলে,
ঘুমভাঙা কাউকে এমন ভয়ংকর সুন্দর লাগে বুঝি!
ওর চোখে তখন নীরব বিস্ময়, ভেতরের আলো জ্বলে ওঠার ঠিক আগ মুহূর্ত।
তিনজন নিচে নেমে আগের জায়গায় গিয়ে বসল। চারপাশে সবাই জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে, কিন্তু মেহরিন একটু চুপচাপ। মাথাটা হালকা নিচু, চোখে এখনো পুরো জাগরণ আসেনি। রাহি আর চুমকি তার দু’পাশে।
চুমকি হঠাৎ লক্ষ্য করল মেহরিনের কপালে এ স্লাইসের করছে, মনে হয় ঘুমে থেকে উঠার কারনে মাথা ব্যথা করছে।
চুমকি ধীরে বলল,
তুই ঠিক আছিস ?মাথা ব্যথা করছে কি ?
মেহরিন ধীরে মাথা নাড়িয়ে বলল,
ঘুমটা ভাঙল হঠাৎ করে… আর এখন কেমন জানি লাগছে, মাথাটা একটু ভার ভার লাগছে।
চুমকি চিন্তিত মুখে বলে উঠল,

কফি খেলে হয়তো ভালো লাগবে,আমি এনে দিচ্ছি।
মেহরিন একটু ক্লান্ত মুখে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।
চুমকি উঠে দাঁড়ায় ঠিক তখনই, পাশ থেকে রিদ সামনে এসে দাঁড়ায়। তার হাতে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ কফি।
রিদ দূর থেকে দেখছিল মেহরিনার হয়তো মাথা ব্যথা করছে সেটা বুঝেই কফিটা নিয়ে আসে।
চুমকি থেমে যায়। রাহিও একটু চোখ ছোট করে তাকায়।
রিদ কিছু না বলে মেহরিনের সামনে কাপটা বাড়িয়ে ধরে।
তোমার মনে হয় কফি টা দরকার। গরম আছে এখনো। খেয়ে নাও।
স্বরে কোনও বাড়তি ভাব নেই, কিন্তু চোখে একরকম স্নিগ্ধ দৃঢ়তা।
মেহরিন একটু অবাক হয়ে তাকায়, তারপর ধীরে কাপটা নেয়। চোখ নামিয়ে বলে,

“ধন্যবাদ…”
রিদ বলে,
কিছু প্রয়োজন হলে জানাবে।
চুমকি পাশ থেকে ফিসফিস করে বলে,
তোর মাথা ব্যথা কিন্তু খুব কিউটলি কেমনে যেন ঠিক হয়ে যাচ্ছে আজকাল।
রাহি মুখ চেপে হাসে।
রিদ কফি দেওয়ার পর মেহরিন কাপটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। ওর পাশেই রাহি আর চুমকি একে অপরের চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসল।
রিদ চলে যাবে এমন সময়
রাহি মুখটা গম্ভীর করে বলল,
আরে, এ কেমন কথা! শুধু মেহরিন আপুর জন্য কফি? আমাদের জন্য কিছু না? এটা কিন্তু একেবারেই ঠিক না!
চুমকি সঙ্গে সঙ্গে সায় দিল,
হ্যাঁ! রিদ ভাইয়া, আপনার কাছে আমরা কি পর? শুধু মেহরিন কফি পাবে?
রাহির কণ্ঠে হালকা নাটকীয়তা,

এটা তো স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব! আহা, কী করুণ দৃশ্য!
রিদ একটু থমকে দাঁড়াল, চোখে একটুখানি বিরক্তির ছায়া, ও বুঝতে পারছি এই দুইটা ওর পিছনে লাগার জন্য এগুলো বলছে। রিদ মুখে কিছু বলার আগেই…
এইযে আপনাদের কফি,
দূর থেকে ভেসে এল রাকিবের গলা।
রাকিব আর শান্ত দু’জনে এসে হাজির, হাতে দুই কাপ গরম কফি।
রাকিব হাসতে হাসতে বলল,
এই যে, দুই রানীর জন্য কফি! কেউ যাতে অভিযোগ না করে।
ওরা দূর থেকে দেখছিলে সব ওরে ঠিক আন্দাজ করেছিল রাহি আর চুমকি রিদের পিছনে লাগবে তাই ওরা আগেভাগেই কফি নিয়ে আসে ।

শান্ত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
রিদ তো আগে থেকে বুঝে গেছিল যে মেহরিনের দরকার কফি, তাই ওটাই আগে দিয়েছে। এখন তোমাদেরটা আমরাই দিলাম, ঠিক আছে?
রাহি আর চুমকি মুখে চেপে হাসে। রিদের মুখটা একটু কঠিন হলেও চোখের গভীরে কী এক অদ্ভুত প্রশ্রয়।
রাহি মজা করে বলে ওঠে,
ঠিক আছে, আপাতত অভিযোগ তুলে নিলাম। তবে কফির বদলে যদি চকোলেট দিতেন তাহলে আর কিছু বলতাম না।
সবাই হেসে ওঠে।

রিদ একবার মেহরিনের দিকে তাকায়। মেহরিন নিঃশব্দে কফিতে চুমুক দেয়, আর ওদের কাহিনী দেখে মুখে মৃদু হাসি—যেই হাসির রিদ মুগ্ধ হয়ে দেখে।
রিসোর্টের বাগানের এক কোণায় সবাই গোল হয়ে বসেছে। সন্ধ্যার নরম আলো, হালকা হাওয়া, আর গাছপালার মাঝে ছড়িয়ে থাকা নিস্তব্ধতায় এক চিলতে দুষ্টুমির ছায়া।
শান্ত চারপাশে তাকিয়ে বলল,
Sir-ra toh এখনো এলেন না… চলো না সবাই মিলে কিছু খেলা খেলি?কি বলো সবাই।
সবাই হই হই করে উঠলো সবাই রাজি ।
রাহি চোখ টিপে বলল,
Truth and Dare, কী বলো?
রাকিব হেসে বলল,

“ভাই, এই খেলায় তো আসল রহস্য বের হয়ে পড়ে!”**
চুমকি খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলে,
তাই তো ভালো! কে কাকে পছন্দ করে, কে কার জন্য কাঁদে, কে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাকে দেখে—সব বের হবে!
রাহি বলল,
আর কে কার নাম ভেতরে ভেতরে মনের কাগজে লিখে রেখেছে, সেটাও বের হবে আজ!
সঙ্গে সঙ্গে সে একবার চোখ ছোট করে রিদের দিকে তাকায়।
মেহরিন পাশে বসে হালকা হেসে মাথা নিচু করে।
রিদ গম্ভীর মুখে বলে,
নাটক কম কর, রাহি। এই খেলা কেউ সিরিয়াসলি না নিলেই ভালো।
চুমকি মুচকি হেসে বলে,
আপনি তো খুব ভয় পাচ্ছেন দেখি!
রাহি দমকা হেসে বলে,

হুম… ভয় না থাকলে, খেলার মজা কোথায় ভাইয়া?
সবাই গোল হয়ে বসে, মাঝখানে একটা বোতল ঘোরানোর জন্য রাখা হয়। শর্ত ঠিক হয়—একবার যে Truth নেবে, পরের বার তাকে Dare নিতে হবে, আর ভুল করলে শাস্তি!
রিসোর্টের বাগানের রাত ঘনিয়ে এসেছে, আকাশে জ্যোৎস্না ঝিকিমিকি করছে, আর চারপাশে এক দুষ্টু রোমাঞ্চ ছড়ানো হাওয়া বইছে। আলো-আঁধারি সেই পরিবেশে খেলাটা শুরু হল।
বোতল ঘোরানো শুরু…

সবার দম আটকে থাকা চোখের সামনে বোতলটা ধীরে ধীরে থামল চুমকির দিকে।
রাহি সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল,
হায় রে চুমকি আপু রে প্রথমেই বলির পাঠা কিনা তুই হোলি!
রাকিব হেসে বলে,
ওকে, Truth না Dare?
চুমকি বলল,
আমি কি ভয় পাই নাকি?

Dare! আজকেও নতুন কিছু করে ফেলি।
শান্ত একটু ভেবেই বলল,
ওকে, Dare আমি দিবো।
সবাই শান্তর দিকে তাকিয়ে আছে। শান্ত একটু ভেবে বলে। আমরা মেহেরিনের গান শুনেছি মেহেরিনের বান্ধবী যেহেতু চুমকি তাহলে ওকে নাচতে হবে । আমরাও দেখি মেহরিন যেমন সুন্দর গান গায় চুমকি তেমন নাচতে পারি কিনা?
সবাই একসাথে হেসে উঠে চুমকি চিৎকার করে বলল,

উফফ শান্ত, এটা কি বললে আমি তো নাচতেই পারি না এখন আমার কি হবে ?
মেহরিন মুখ টিপে হাসছে, কারণ মেহেরিন জানে চুমকি নাটক করছে মেহেরিন যেমন সুন্দর গান গাইতে পারে চুমকি তেমন অনেক সুন্দর নাচতে পারে ।
চুমকি দাঁড়ায়, মোবাইল থেকে মিউজিক সিলেক্ট করে রাহির হাতে দেয়।
তারপর মেহরিন এর সামনে গিয়ে চোখ টিপে বলে তোর হেল্প লাগবে? মেহরিনার কিছু বলেনা মুচকি হেসে ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়।

তারপর রাহিকে ইশারা দেয় গান বাজাতে। রাহি গানটা প্লে করে ন্যানো বালো নেহি হিন্দি গানটা ভিডিও উঠে ।
মেহরিন আর চুমকি ওদের নাচ শুরু করে।
চুমকি আর মেহরিন শরীরের নরম মুভমেন্টে একটা অদ্ভুত আবেশ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। হাতের ভঙ্গিমা, মুখের এক্সপ্রেশন আর চোখের ঝিলিক যেন পুরো মুহূর্তটাকে আবেগে ভরিয়ে তোলে।
সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখে,
রাহি ফিসফিসিয়ে বলে,

“শান্ত ভাইয়া, তুমি তো একেবারে হিরোদের মতো Dare দিলে, চুমকির মধ্যে তো নায়িকা লুকিয়ে ছিল! আর সাথে মেহেরিন আপু যে এত সুন্দর নাচতে পারে তাও আমরা দেখে নিলাম ।
শান্ত একটু হাসে, কিন্তু কিছু বলে না—চোখে এক অদ্ভুত প্রশংসার ছায়া।
আর রিদ সে তো হা হয়ে তাকিয়ে আছে মেহরিননের এদিকে। মনে মনে ভাবছে এই মেয়ের আর কত প্রতিভা আছে আর কত কত ভাবে আমাকে মুগ্ধ করবে এই মেয়ে।
নাচ শেষ হতেই সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে, হরতালির শব্দে রিদের ধান ভাঙ্গে।
চুমকি মেহরিন নেচে হাঁপিয়ে গেছে ধপ করে বসে পড়ে নিজেদের জায়গায় ।
রাহি বলে, তোরা আগে বললি না, তোরা এতো ভালো নাচিস?
চুমকি হেসে বলে,

“আজ না হয় একটু চমক দিলাম!”
চুমকির আর মেহরিনের নাচে সবাই এখনো মুগ্ধ। হাসিঠাট্টা চলছে, কেউ কেউ প্রশংসায় ব্যস্ত, কেউ আবার পরের বোতল ঘোরানোর জন্য অধীর হয়ে আছে।
বোতল আবার ঘোরে… ধীরে ধীরে থামে রাকিবের দিকে।
রাহি সঙ্গে সঙ্গেই বলে,
ওহহ, এবার তো মজাই হবে! রাকিব ভাইয়া, Truth না Dare?
রাকিব হালকা হাসে, গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে,
Truth. চ্যালেঞ্জ নেব, দেখি কী প্রশ্ন করেন আপনি মেম।
রাহি চোখ টিপে বলে,

একদম সোজা প্রশ্ন দিব না ভাইয়া। আমার প্রশ্ন হইল…
তারপর সবার দিকে তাকিয়ে, নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে—
আপনি কি কোনোদিন কাউকে লুকিয়ে পছন্দ করেছেন? আর যদি করে থাকেন, তাহলে সে কে? নাম না বললেও একটু হিন্ট দিতে হবে।
সবাই একসাথে—
উইউউউউ!!!

রাকিব খানিকটা অবাক, আবার লাজুক হাসি দেয়।
লুকিয়ে… মানে ঠিক লুকিয়ে না, বলার সুযোগ হয় নাই। আর হ্যাঁ, পছন্দ করতাম না এখনো করি। তবে হয়তো কখনো বলার সাহস দেখাবো না। সে যা আকাশে চাঁদের মত তাকে দেখা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না। ও খুব হাসিখুশি, বুদ্ধিদীপ্ত।
রাহি সঙ্গে সঙ্গে বলে,
তাইলে নাম টাম না বললেও, ওই মেয়ে কি আজ এই খেলায় আছে?
রাকিব মুখে কিছু না বললেও, চোখের কোণে এক মিষ্টি হাসি—যেন অনেক কিছু বলে দিল চুপচাপ।
রাহি হাততালি দিয়ে বলে,
ধরা খাইছো রাকিব ভাইয়া! আমিই ধরে ফেলব কে সে!
মেহরিন আর চুমকি একে অপরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে—
তুই বুঝলি?

আরে হ্যাঁ, আমি তো আগেই সন্দেহ করছিলাম!
রিদ আর শান্ত একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে ব্যাপারটা ওরাও জানে যে রাকিব কাউকে পছন্দ করে। কিন্তু কে সেই মেয়ে এটা এখনো কেউ জানে না যতবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে রাকিব এই ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে। রাকিব বলতে চায় না দেখে ওরাও কেউ কখনো জোর করেনি।
রাকিবের রহস্যময় উত্তরের রেশ কাটতে না কাটতেই, আবার ঘোরে বোতল।
সবাই চুপ করে তাকিয়ে আছে, বোতল ধীরে ধীরে ঘুরে গিয়ে থামে শান্তর দিকে।
রাহি সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠে বলে—

এইবার শান্ত ভাইয়া! Truth না Dare?
শান্ত হালকা হেসে, ঠাণ্ডা ভঙ্গিতে বলে—
Dare.
রাহি চোখ টিপে বলে,
ঠিক আছে, Dare দিলে তো Dare পাবেই!
সে চারদিকে একবার তাকায়, সবাইকে একটু রোমাঞ্চে রাখে, তারপর বলে—
তোমাকে এখনই কারো দিকে তাকিয়ে এক মিনিট চোখ না সরিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু যাকে তাকাবে, সে যদি চোখ সরিয়ে নেয় বা লজ্জা পায়—তুমি জিতবে। আর যদি তুমি নিজেই চোখ নামিয়ে ফেলো—তুমি হেরে যাবে। আর পানিসমেন্ট নিতে হবে।
মেহরিন মনে মনে বলে রাহি যে বিচ্ছুর বিচ্ছু চুমকি তুই শেষ তিরটা ঘুরেফিরে তোর দিকেই আসবে । আই এম সিওর ।

শান্ত হেসে বলে—
চ্যালেঞ্জ নেওয়া যায়।
রাহি বলে,
তাহলে বেছে নাও—কার চোখে তুমি এক মিনিট তাকিয়ে থাকতে চাও?
**শান্ত একবার চারপাশে তাকায়… তারপর ধীরে চোখ স্থির করে চুমকির দিকে।
চুমকি চোখ বড় বড় করে বলে—
আমি!?
রাহি বলে—

তাহলে শুরু হোক। One… Two… Three… Go!
সবার সামনে এক রহস্যময় মুহূর্ত।
চুপচাপ তাকিয়ে আছে শান্ত আর চুমকি।
চুমকি প্রথমে শক্ত ভাবে তাকালেও, ১৫ সেকেন্ড না যেতেই ওর চোখ কাঁপতে শুরু করে। মুখ লাল হয়ে উঠেছে, ঠোঁট কামড়ে হাসি চাপছে।
৩০ সেকেন্ড…
৪৫ সেকেন্ড…
৫৫ সেকেন্ড…
এক মিনিট পূর্ণ!
রাহি চিৎকার করে—

শান্ত ভাইয়া উইন! চুমকি লজ্জায় পুরাই টমেটো!
সবাই হেসে লুটোপুটি। চুমকি মুখ ঢেকে হাসে, বলে—
এই রাহি, তোদের দোষ! এত সব Dare তোর মাথায় আসে কীভাবে?
রাহি বলে—
আরে দোষ না, বস খেলায় যদি রহস্য মজা না থাকে তাহলে ওটা কিসের খেলা !

চুমকির হাসির রেশ কাটতে না কাটতেই আবার ঘুরতে থাকে বোতল। রিদের একটা কল আশায় ও একটু সাইডে যায়।
ধীরে ধীরে থেমে যায়— রাহির দিকে।
সবাই একসাথে—
ওহহহ! রাহির পালা!
চুমকি সাথে সাথে বলে—
এতক্ষণ সবাইকে অনেক জ্বালিয়েছিস মেরি মা, এবার তোর পালা বল
Truth না Dare, রাহি?
রাহি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে মিষ্টি হেসে বলে—
Truth.
চুমকি হালকা বাঁকা হেসে বলে—

তাহলে বল, তুই কি কাউকে ভালোবাসিস? বা… Love at first sight টাইপ কিছু হইছে?
চারপাশ হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
রাকিবের বুকের ভিতর ঢং ঢং করে বাজতে থাকে। মুখে হাসি থাকলেও, ভেতরে কেমন এক অজানা ভয়— যদি রাহির ভালোবাসার মানুষ থাকে? রাকিব জানে ও কখনো রাহিকে পাবেনা তাইতো এতো ভালোবাসার পরেও কখনো মুখ ফুটে বলেনি। সেই ছোট্টবেলা থেকে রাহি কে ভালোবাসে। যৌবনে পা রাখার পর রাহি এক মেয়ে যাকে দেখে রাকিবের বুকের ভিতর ধুকধুক করেছিল, এই হাসি খুশি মেয়েটা তার মন কেড়েছে বহু বছর আগে। রাকিব নিজের মনের কথা না বললেও নিজের ভালোবাসার মানুষের মুখে অন্য কাউকে ভালোবাসে এটা শোনা খুব যন্ত্রণার।
সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে রায়ের দিকে।
**রাহি চোখ তুলে একদম সোজা রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলে—

“Love at first sight বললে, হয়ত কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু হয়েছে।
খুব সাদামাটা একটা ছেলে তবু এই সাদামাটা ছেলে টার ভিতরেই আমি হারিয়ে গেছি বহুদিন আগে।
সবার চোখ রাহির দিকে, আর রাহির চোখ তখন শুধু রাকিবের দিকে।
সে বলে—
তবে হ্যাঁ, আমি এটা আগে কখনও বলিনি। আজ বললাম। Truth তো!
রাকিব আর নিজেকে সামলাতে পারে না। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে, কিন্তু হাসি চেপে রাখে। মনে মনে বলে—
তোমাকে তো আমি পাব না সেটা জানি তবুও তোমার জীবনে কেউ আছে শুনে আমার কেন এত যন্ত্রণা হচ্ছে, ভিতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে, নাম না যেনা এক ঝড়ে আমার ভিতরটা তছনছ হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক তখনই পাশের দিক থেকে রিদ ফিরে আসে।

সে বসে পড়তেই রাহি হাসিমুখে বলে—
কই গিয়েছিলে দাদদভাই খেলা তো একদম ড্রামাটি হয়ে গেছে।
রিদ হেসে বলে—
তুই থাকলে প্রতিটা Truth, Dare আর ড্রামাই জমে যায়।
তালুকদার ডিলার ড্রামা কুইন ।
রিদের কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে। কিন্তু একজনের মনে বইছে ঝড়।
চোখেমুখে উত্তেজনা, হাসির ফোয়ারা… Truth and Dare এবার জমে উঠেছে একেবারে!
বোতল ঘুরছে আবার… ধীরে ধীরে…

এইবার থামে— রিদ-এর দিকে!
সবাই মিলে বলে—
ওহহ! রিদ ভাইয়ার পালা Truth না Dare?
রিদ গম্ভীর কন্ঠে বলে—
Truth. কোন আজেবাজে প্রশ্ন করবা না।
রাহি সাথে সাথেই বলে—
ভাল্লাগছে! এইবার আমার পালা— আমি একটা স্পেশাল প্রশ্ন করবো!
সে হালকা এক রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে—
দাদা ভাই , তুমি কি কাউকে পছন্দ করো?
মানে… এমন কেউ আছে কি, যাকে দেখলে তোমার চোখ আটকে যায়, যার আশেপাশে থাকলে তুমি হাসিখুশি থাকো?

রিদ চুপ করে যায় কিছুক্ষণের জন্য। সবার চোখ ওর দিকে।
তার চোখ একবার পাশের দিকে যায়,
সেই পাশেই চুপচাপ বসে থাকা মেহরিন।
সে ও চেয়ে আছে, তবে চোখের কোণে কৌতূহল লুকোচ্ছে না।
রিদ হালকা হেসে বলে—
পছন্দ করা মানে যদি হয়— এমন কাউকে, যার বোকামি ভালো লাগে,
যার হাসির পেছনে লুকানো কষ্ট বোঝার চেষ্টা করি…
যার চুপ করে থাকা মানেই মন খারাপ বুঝি…
তাহলে হ্যাঁ, আছে।
একজন আছে।
রিদ চোখে ঠান্ডা দৃষ্টি রেখে আবার বলে—
কিন্তু তাকে এটা কখনো বলবো না… সময়মতো তাকে আমার ঘরে তুলে আনবো—এইটুকুই জানি।
সবাই চমকে উঠে—
চুপচাপ হয়ে যায় সবাই।
রাহির মুখ থেকে একটু দুষ্টু হাসি হারিয়ে গিয়ে পড়ে কৌতূহলের ছায়া।
সে আবার জিজ্ঞেস করে—

কে সে ভাইয়া?
রিদ এবার হালকা হেসে বলে—
এই খেলায় প্রশ্ন ছিল একটা।
উত্তরও একটা।
তারপর সে হালকা এক দৃষ্টিতে একবার তাকায় মেহরিনের দিকে—
একদম নিরব, অথচ সব বলার মতো এক দৃষ্টি।
মেহরিনের বুকের ভিতর যেন একটু ধক করে উঠে, কিন্তু সে কিছু বলে না।
শুধু মুখে এক অদ্ভুত লাজুক হাসি খেলে যায়।
রাহি বলে—
ওহহহ! এইটা তো পুরাই cinematic!
আর চুমকি ঠেলে দেয় মেহরিনকে—
তুই এমন ব্লাশ করছিস কেন মেহু ব্যাপার কি বলতো ?
Truth & Dare-এর হাসাহাসি, চিৎকারে মুখর চারপাশ। সবাই নিজেদের আনন্দে ডুবে। কিন্তু মেহরিন—সে সবার মাঝে থেকেও যেন একা।
বাইরের কোলাহল আর নিজের মনের ভেতরের নীরবতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মেহরিন বারবার ভাবছে রিদের কথাগুলো—

তাকে পছন্দ করি… কিন্তু কখনো বলবো না, সময় হলে আমার ঘরে তুলে আনবো।
এই কথাগুলো শুধু খেলার অংশ নয়, মেহরিনের মনে অদ্ভুত এক অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়। মেহবুবার সেই পুরোনো কথাটাও ফিরে ফিরে আসে—
“তুই খেয়াল করিস, রিদ ভাইয়ার চোখে তোর জন্য একটা আলাদা দৃষ্টি আছে।”
সব কথা, সব ইঙ্গিত একসাথে এসে যেন গেঁথে যাচ্ছে ওর হৃদয়ে।
কি এটা? পছন্দ? ভালোবাসা? না কি শুধুই কল্পনা?না কি ওর মনের ভুল?
অস্থির মন নিয়ে একবার চোখ তোলে মেহরিন।রিদের দিকে। টিক তখনি রিদ ও তাকাই মেহরিনের দিকে।
দু’জনের চোখ একসাথে আটকে যায় কিছু মুহূর্তের জন্য।
সেই চোখে এমন কিছু ছিল,

যা মেহরিনের হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়।
সে তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে নেয়। নিজেকে সামলাতে না পেরে, পাশে বসা রাহির আর চুমকির দিকে হেলে পড়ে বলল—
আমি একটু রুমে যাচ্ছি… মাথাটা কেমন জানি করছে।
রাহি অবাক হয়, আরে কি হইলো হঠাৎ?
“না তেমন কিছু না, একটু বিশ্রাম দরকার মনে হয়… তোরা কি যাবি আমার সাথে?
বলেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় মেহরিন।
রাহি আর চুমকি ও কিছু না বলে সঙ্গে উঠে পড়ে।
Truth & Dare-এর কোলাহলের মাঝেও যেন একটা নীরব বিদায় বাজে।
রিদ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে,

আর মেহরিন ধীরে ধীরে সরে যেতে যেতে ভাবে—
এই ছেলেটা… সত্যিই কি ওকে ভালোবাসে?
নাকি এও একরকম স্বপ্নরঙ।
রাত তখন বারোটা পেরিয়ে গেছে।
রিসোর্টের নিঃস্তব্ধতা যেন ঢেকে রেখেছে সারাদিনের কোলাহল।
সবাই ডিনার সেরে যার যার ঘরে শুয়ে পড়েছে, কিছুটা ক্লান্ত, কিছুটা খুশিতে ভরা।
কিন্তু রাকিবের ঘুম আসেনি।
চুপচাপ রিসোর্টের ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে আছে সে, অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে।
হাত দুটো জিন্সের পকেটে। চোখে একরাশ চিন্তা।
Truth & Dare-এর খেলায় হাসির মাঝে কেউ বুঝতেই পারল না—রাহির এক উত্তরের নিচে কীভাবে যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে একজন।
রাকিব।

রাহির সেই চোখে চোখ রেখে বলা—
হ্যাঁ, Love at first sight হয়েছিল।
এই বাক্যটা যেন বিদ্যুতের মতো বিঁধে গেল রাকিবের বুকে। সে রাহির চোখে খুঁজছিল নিজের ছায়া,
কিন্তু রাহি তো তখন তাকিয়ে বলছিল—
হয়েছিল…
কিন্তু কাকে দেখে হয়েছিল? কাকে দেখে চোখ আটকে গিয়েছিল ওর?
এই প্রশ্নগুলো ঝড়ের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল রাকিবের ভেতর।
চোখে কিছুটা হতাশা, কিছুটা ভয়, আর প্রচ্ছন্ন ঈর্ষা।
সে চুপচাপ দারিয়ে, হাসে—মুখে কিছু বলে না।
কিন্তু মন যেন এক এক করে সব ভেঙে পড়ছে।
“রাহি যদি অন্য কাউকে পছন্দ করে… তবে আমি কোথায় দাঁড়াই?”
এই অনুভূতিতে সে নিজেই হারিয়ে যাচ্ছে,
আর নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছে—
“তোর তো কিছু বলার অধিকার নেই রাকিব…
তুই তো কখনো কিছু বলিস নি।

তোর ভালোলাগা তো তোর ভেতরেই মরে আছে।”
একটা না বলা অনুভব
আর একটা বলা সত্যর মাঝে হেরে যাচ্ছে কোনো এক শান্ত, অভিমানী মন।
রাকিব ভাবছে,
রাহির মুখে ওই কথাটা… সত্যিই কি কারও জন্য ছিল?
নাকি শুধুই খেলায় বলা কথামাত্র?
কিন্তু ওর চোখ তো বলছিল অন্য কথা…”
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে রাকিব।
মনে মনে ভাবে, আমি কেন এভাবে ভাবছি? ও কি সত্যিই কখনো বুঝবে?
ঠিক তখনই পিছন থেকে আস্তে ভেসে আসে এক চেনা কণ্ঠ—
এখানে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছো, নাকি কষ্ট লুকাচ্ছ?

রাকিব ঘুরে দেখে—রাহি।
পরনে একটা প্লাজো আর একটা টি-শার্ট ওর চোখে এখনো ঘুমটুকু মাখা, কিন্তু কণ্ঠে কৌতূহল।
রাহি এসে তার পাশে দাঁড়ায়।
ঘুম আসছে না?— রাহি জিজ্ঞেস করে।
রাকিব একটু হেসে মাথা নাড়ে—
না, শুধু… কিছু ভাবছিলাম।
বুঝেছি, ভাবছিলে আমি যাকে বলেছি, সে কে…তাই না?
রাহি এবার সরাসরি চোখে চোখ রাখে।
রাকিব চমকে যায়, কিন্তু কিছু না বলে মাথা নিচু করে।
রাহি আবার বলে,

“ভাবো তাতে ক্ষতি নেই… কিন্তু একটা কথা বলি?
ভালোবাসা কখনো একপাক্ষিক হয় না, যদি সেটা সত্যি হয়।
রাকিব তাকায় রাহির দিকে।
একটু আলো পড়ে ওর মুখে—চোখ দুটো গভীর, অথচ কোমল।
কিছু বলার আগেই রাহি ঘুরে যেতে যেতে শুধু বলল,

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১২

ভালোবাসা বুঝতে সময় লাগে রাকিব ভাইয়া,তবে তার সাথে প্রয়োজন বলে দেওয়ার সাহসটুকু। কিছু কিছু সময় রিক্স নিতে হয়।কিন্তু সাহসটুকুই যেন ঠিক সময়ে আসে। সময় কিন্তু কারো জন্য থেমে থাকে না, তাই সময় থাকতেই সময়ের কাছে সময় করতে হয়।
কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না রাহি দৌড়ে চলে যাই ওখান থেকে। আর এই দিকে রাকিব আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছে।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৪