মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৫
মির্জা সূচনা
তিনদিন যেন চোখের পলকেই কেটে গেল। ঘোরাঘুরি, হাসাহাসি, শীতল বাতাসে মিশে থাকা নরম বন্ধুত্ব আর চুপিসারে গড়ে ওঠা না বলা আবেগ—সব মিলিয়ে মুহূর্তগুলো যেন জাদুর মতো।
এখন সেই জাদু ফুরিয়ে আসছে।
সন্ধ্যার আলোটা ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে আসছে। মোহাস্তান গড়ে দিনভর ঘোরাঘুরি আর রিপোর্ট তৈরির ব্যস্ততায় সবাই ক্লান্ত, কিন্তু মনটা অদ্ভুতভাবে হালকা। রিসোর্টে ফিরে এসে ব্যাগ গোছানোর হালকা গুঞ্জন চলছে রুমে রুমে। কারো জামা খুঁজে পাচ্ছে না, কেউবা চুলে ফুল গুঁজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেষ এক ঝলক ছবির জন্য তৈরি।
ঘরের বাতি জ্বলছে। দরজা আধখোলা। শান্ত পায়চারি করছে বারবার, একবার জানালার কাছে, আবার দরজার দিকে। চোখেমুখে অস্থিরতা, হতাশা, রাগ আর একটুকু অভিমান।
ফোনটা বারবার হাতে নিচ্ছে, খুলে দেখছে চুমকির মেসেজ—সিন দেওয়া, কিন্তু কোনো উত্তর নেই। ফোন দিলে রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
একবার নিজের চুল টেনে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ রাকিব চুপিচুপি দরজায় এসে দাঁড়াল।
মুখ দেখে বুঝে গেল—বন্ধুটা ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছে।
তুই আবার এভাবে গুমরে মরছিস কেন রে ভাই?—রাকিব জিজ্ঞেস করল।
শান্ত গভীর শ্বাস ফেলে বলল,
ও আমার সাথে কথা বলছে না রে, ফোন ধরছে না, শুধু সিন দিচ্ছে। জানি রাগ করে আছে, কিন্ত কি নিয়ে রেগে আছে সেটাই বুজতে পারছি না,এভাবে চুপ করে থাকলে তো আমি পাগল হয়ে যাবো!
রাকিব দরজার কড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠল,
এতো ভাবা ভাবির কি আছে ভাই? সোজা গিয়ে বলে দে আমি কি করেছি জানিনা তবুও আমি মাফ চাইছি আমি দুঃখিত। আর তা না হলে তুই যে ওকে ভালোবাসিস সেটা বলে দে।
শান্ত মেঝের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
ভয় পাই রে… যদি ও ফিরে না আসে? যদি আমি বলার পরই সব হারাই?
রাকিব হেসে বলল,
হারাবি না ভাই, বরং তোর চুপ থাকাটাই তোকে দিনে দিনে হারাচ্ছে। আজ না বললে আর কবে বলবি? কাল সকালের বাসেই তো চলে যাচ্ছি আমরা!
শান্ত আর কিছু বলল না। একবার মুঠোফোনটা শক্ত করে ধরল। চোখ দুটো বন্ধ করে গভীর একটা শ্বাস নিল।
এবার বোধহয় সত্যিই বলার সময় হয়ে গেছে।
বাগানের শেষ মাথায় ছোট্ট একটা বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে চুমকি। মুখে থমথমে ভাব, চোখে একরাশ অভিমান। ঠোঁট দুইটা এমনভাবে চেপে রেখেছে যেন কেউ প্রশ্ন করলেই রাগে বিস্ফোরণ ঘটাবে।
মাথায় ফ্লোরাল প্রিন্টের ওড়না ঝুলে আছে, কিন্তু ওর পুরো মুড—কালবৈশাখীর মতো।
মেহরিন আর রাহি দূর থেকে ওর মুখের অবস্থা দেখে আর সামলাতে পারল না। দুজনেই ধীরে ধীরে বেঞ্চির পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
রাহি একবার মেহরিনের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
ভাইরে, মুখখানা দেখ মেহু আপু, মনে হচ্ছে কাশ্মীরের পাহাড়ে কেউ বরফ ছুঁড়ে মেরেছে।
মেহরিন চোখ টিপে হেসে বলল,
শান্ত ভাইয়া গঠিত কেস ভাই, ভালোবেসে কষ্ট পেলে এমনই হয় বোন। মেলা দিন ধইরা হেসে ফুসে ভালোবাসি না বলা প্রেম, এখন প্রেমে ফুসফুসে আগুন!
চুমকি ওদের দিকে তাকাল না পর্যন্ত। নিচু গলায় বলল,
তোরা দুজন যা তো, একটুও ভালো লাগছে না এখন এসব হাসাহাসি।
মেহরিন এবার সিরিয়াস হলো। পাশে বসে বলল,
শান্ত ভায়ার সাথে কী হয়েছে বল তো? আজ তো দেখি তুই একেবারে ঝড় তোলার মুডে!
চুমকি চুপ করে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“আজ বিকেলে দেখলাম ও ক্লাসের ঐ খুশি মেয়েটার সাথে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কীসব বলছে! আরে ভাই, ওটা ক্লাসমেট হলে হোক, হেসে হেসে চোখে চোখ রেখে বলার কী আছে?
রাহি তখন আর না পেরে হেসে উঠল,
হ্যাঁ, হ্যাঁ তাইতো এটা তো শান্ত ভাইয়ার ঘোর অন্যায় —চোখে চোখ রাখা মানেই বিপদ! মনোজগতে সাইরেন বেজে উঠেছে বুঝি?
চুমকি চোখ পাকিয়ে তাকাল ওর দিকে,
তুইও হাস! তোর তো এমন মিষ্টি মিষ্টি ভাইয়েরাও আছে, কালকে দেখি কার কার সঙ্গে তারা হাসে!
মেহরিন এবার শান্ত করে বলল,
আচ্ছা ঠিক আছে। কাল সকালে ফিরে যাচ্ছি, তার আগে অন্তত সব অভিমান রেখে হাসিখুশি হয়ে ঘুমা। কাল না জানি আবার কবে এমন করে একসাথে সময় কাটাতে পারবি!
চুমকি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
ভালোবাসা এমন জিনিস, একটু হাসিও যদি অন্য কাউকে দেয়, বুক ফেটে যায়।
রাহি হালকা করে বলল,
তাহলে কাল সকালে উঠেই দে একখান ঝাড়… মানে স্পষ্ট কথা—‘তুই হাসছিলি ক্যান?
রাহির কথা শুনে চুমকি আর না হেসে পারলাম না।
তিনজন একসাথে হেসে উঠল। অভিমান ভেঙে গিয়ে ঝিরঝির করে আবার সেই বন্ধুতার রোদ উঠল।
চুমকি হঠাৎ হাসি থামিয়ে। বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গলা নামিয়ে গরগর করে বলে উঠল,
আচ্ছা বল তো, এদের সমস্যা কী? মানে রীতিমতো একটা জাতীয় রহস্য!
রাহি আর মেহরিন দুজনেই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়।
চুমকি হাঁটাহাঁটি করতে করতে বলে,
শান্ত ব্যক্কেলটা আমাকে ভালোবাসে—এইটা আমি কাচের মতো পরিষ্কার বুঝি। কিন্তু মুখ ফুটে বলবে না! কেন? বললে কি ওর বুকের ভেতরে কেউ বোমা মেরে দিবে?
মেহরিন আর রাহি মুখ টিপে হাসে। চুমকি থামে না, আগুনে আরও জ্বালানির মতো যুক্তি দিয়ে যেতে থাকে—
আর আমাদের রাকিব ভাই! রাহির হাত একটুখানি একটু ধরেছে বলে ও যেনো চোখ দিয়েই ছেলেটাকে পুড়িয়ে দেবে! হায় রে প্রেম! কিন্তু মুখ ফুটে বলবে না—‘রাহি, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ না, সে কথা মুখে আসে না! হাবভাব দেখে পাড়া-বাড়ি বুঝে গেছে, শুধু ও ছাড়া!
রাহি গালে হাত দিয়ে বলে,
আরে ছাড় তো ওই গাধাটার কথা। ওইটা একটা বলদ বুঝলি এক নাম্বারে গাধার বাচ্চা।
চুমকি এবার আর চুপ করে না, আকাশের দিকে তাকিয়ে দম নিয়ে বলে,
তাও একটা রেহাই ছিল যদি শুধু ওরা দুজন হত! এইদিকে আমাদের রিদ ভাই… উনি এত মেপে ভালোবাসেন, যেনো প্রেমটা হিরে, তালাবন্ধে রেখে দিলে দাম বাড়বে! যাকে ভালোবাসেন, তাকেও বলেন না। শুধু বলেন, ‘সময় হলে তুলে নিয়ে যাব।’ মানে কী! প্রেম নাকি গাছের আম, পাকলে পেড়ে নিয়ে যাবে?
মেহরিন রীতিমতো হেসে কুঁজো হয়ে যায়, আর রাহি বলে,
চুমকি আপু, তুই একটা নাটক বানা.. একেবারে নাট্যশিল্পী!
চুমকি তখন নাক উঁচু করে বলে,
না রে, আমি নাটক নই, আমি কেবল প্রেমে পড়ে থাকা একটা সাধারণ মেয়ে… যে একটু সাহস করে বলতে জানে, ভালোবাসি মানে ভালোবাসি। মুখে বলাটা অন্যায় নয়!
মাঝরাতে বাগানে সেই মুহূর্তে যেন একটা আবেগঘন হাওয়া বয়ে যায়, আর তিন মেয়ের হাসি-ঠাট্টায় ঢেকে যায় তাদের মনের ভেতরের শত কষ্ট।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। চুমকি মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো চোখ পাকাল। ফোনে আবার শান্ত’র নাম ভেসে উঠেছে।
কল দেকে যেনো আবার সেই রাগটা গা’চারা দিয়ে উঠলো।
দেখ… আবার কল দিচ্ছে!” — বলেই মুখে এমন এক অভিব্যক্তি নিল, যেন ওর সামনে শান্ত নিজেই দাঁড়িয়ে।
রাহি আর মেহরিন ওর দিকে তাকিয়ে ছিল চুপচাপ। চুমকি এবার রীতিমতো গর্জে উঠল,
সা’লা! ধরবোই না কল। যে যার হাসি লুকাতে না পেরে দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে ক্লাসে মেয়েদের সঙ্গে গল্প করিস, তার আবার মুখ দেখা লাগে? যার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গালের খুঁটির মতো দাঁত দেখাচ্ছিলি, তার কাছেই যা!
ফোনটা কেটে দিয়ে ও বলল,
আমার মতো মানুষকে কেউ এভাবে মিস করে? নাহ! আরে, ভালোবাসিস তো বল, না পারিস তো সর—এমন ঝুলিয়ে রাখিস ক্যান? আমি কি ঘুড়ির নাটাই?
রাহি হেসে বলল,
তুই তো আজ এক্কেবারে আগুন লাগাইয়া দিলি, আই এই খুশিতে তোর একটা চুমু দেই।
মেহরিন মুখ টিপে বলল,
ওর মতোন প্রেমিকা থাকলে, ছেলেরা সোজা হয়ে প্রেম শিখবে!
চুমকি ভোঁতা গলায় বলল,
তার শেখার ইচ্ছা থাকলে তো! শুধু দাঁত কেলানোতে ব্যস্ত!
আবার হাসির রোল পড়ে যায়। চুমকি রাগে কাঁপছে, কিন্তু ওর রাগেই যেনো একটা অদ্ভুত মিষ্টি ব্যথা মিশে থাকে—যেটা শুধু ওর প্রেমটাই বোঝায়, আর কিছু না।
রাত তখন প্রায় এগারোটা। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কিন্তু রিসোর্টের একটি ঘরের বাইরে পায়চারি করছে এক তরুণ। শান্ত। মুখে চিন্তার ছাপ, ফোনটা একবার হাতে নিচ্ছে, একবার পকেটে রাখছে—চুমকির কোনো উত্তর নেই।
ডিনার টেবিলে চুমকি একবারে জন্য তাকায়নি ও পর্যন্ত শান্তর দিকে।এটা নিয়ে শান্তর চিন্তা আরও বেরে গেছে বুঝে গেছে যে চুমকি খুব বেশি রেগে গেছে।
হঠাৎ ফোনে ‘পিং’।
রাহি:
ভাই, আপনার মহারানী কিন্তু আগুন হয়ে আছে আজ। ক্লাসের ওই খুশি নামে মেয়েটার সঙ্গে হাসাহাসির হিসেব চাইতেছে। বলতেছে, ওই মেয়েটা না কি হেসেই আপনাকে ছিনতাই করে নিবে!
তাই একটা ভালো বুদ্ধি দিচ্ছি—আজকেই প্রোপোজ করে ফেলেন। না হলে বিয়ের আগেই বিদোবা হয়ে যাবেন আপনি!
আসলে আপনার প্রেমের গল্পটা তো থ্রিলার, আমার তো ট্রেলার দেখেই দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!
মেসেজটা পড়েই শান্ত থেমে গেল। একটু হেসে উঠলো—মুখে প্রশ্রয়ের হাসি, চোখে দৃঢ়তা।
অন্তত এটা তো জানল চুমকি কেন রেগে আছে।
রাহির পাঠানো এসএমএসটা সবার আগে দেখল শান্ত। পড়েই বুঝে গেল, রাহি ঠিকই ধরেছে পরিস্থিতি—আজ রাতেই চুমকির রাগ ভাঙাতে না পারলে সে হয়তো আর কথা বলবেই না।
শান্তর পাশেই তখন দাঁড়িয়ে ছিল রাকিব আর রিদ।
রাকিব চোখ টিপে বলল,
বাহ! বুদ্ধিটা তো একদম ফাটাফাটি রে!
রিদ একটু গম্ভীর গলায় বলল,
বুদ্ধি খারাপ না… কাজেও লাগবে। তবে প্ল্যানটা যতটা নিখুঁত হবে, ততটাই বেশি কাজ করবে।
রিদ একটু থেমে বলল—
রাহিকে বল, চুমকিকে যেন কিছু একটা বুঝিয়ে মেহরিনকে নিয়ে আমাদের রুম এ আসে… আমরা এখানে বসেই প্ল্যানটা একদম সেট করে ফেলি।প্লেনে অবশ্যই ওদের হেল্প লাগবে আমাদের।
রাহিকে শান্ত জানাল,
তোদের হেল্প লাগবে চুমকিকে কিছু একটা বুঝিয়ে তুই আর মেহরিন আমাদের রুমে আয় ফার্স্ট চুমকি যেনো কিছু না বুঝে।
রাকিব হেসে বলল,
আজ চাঁদ উঠবে প্রেমের সাক্ষী হয়ে… আর কাল সকালের আগেই শান্ত হবে এই দুই গাঁয়েব প্রেমিক-প্রেমিকার ঝগড়া।
তিনজনের চোখে তখন একটাই দৃঢ়তা—আজকের রাতটা হবে একটা স্মরণীয় রাত, ভালোবাসার।
চুপচাপ রুমে বসে আছে চুমকি। মুখ গোমড়া করে। মেহরিন বসে বসে চুমকির মিনিট এ মিনিট এ পালটে যাওয়া মুখো ভঙ্গি দেখছে, আর মিটি মিটি হাসছে। করছে ঠিক তখনই রাহি বলল,
চুমকি আপু, তুই শান্ত ভাইয়ের গুষ্টি উদ্ধার করতে থাক। আমি আর মেহু আপু তোর জন্য কোল্ড কফি নিয়ে আসি। তোর টেম্পার তো এখন হট, টেম্পার কুল করার জন্য একটা জম্পেশ কোল্ড কফি দরকার। আমরা বরং নিয়ে আছি হুম।
চুমকি তাকাল না পর্যন্ত। মুখের ভাব এমন, যেনো ‘তোর সাথে কথা শুনার সময় নেই আমার’।
মেহরিন রাহির দিকেই চেয়ে ছিল, কি করতে চায় বুঝতে পারছিল না।
রাহি আবার বলল—
আমরা যায় তাহলে কেমন?
চুমকি কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আর তখনই রাহি মেহরিনের হাত ধরে হালকা টান দিয়ে বলল—
চল মেহু আপু ওরা ওয়েট করছে আমাদের জন্য।
মেহরিন একটু চমকে গেলেও কিছু বলল না। ও বুঝে গেছে, আজ রাতে কিছু একটা স্পেশাল হতে চলেছে।
ওরা দু’জনে বেরিয়ে গেল, আর চুমকি জানলও না—আজ রাতেই তার চোখে মুখে হাসি ফোটাতে চলেছে যার জন্য এই সব অভিমান!
রিদ দের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটু দম নিল রাহি। তারপর ঠক ঠক করে দুইবার কড়া নাড়ল।
ভিতর থেকে দরজা খুলল রাকিব। দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাহির দিকে এক ঝলক তাকিয়েই তার চোখ কপালে।
রাহি তখনই হালকা মুখ বাকালো, যেনো অনেক অভিমান জমে আছে, ঠোঁটটা একটু ফুলিয়ে বলল—
“Hmh!” — একটা মুখ ঝামটা দিয়ে সটান ভেতরে ঢুকে গেল।
রাকিব হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এমন রাহিকে সে আগে দেখেনি।
আর ঠিক তখনই দরজার পিছন থেকে দেখা দিল মেহরিন। ওর চোখে-মুখে রীতিমতো হাসি। রাকিবের অবস্থা দেখে মেহরিন মুচকি হেসে বলল—
রাকিব ভাইয়া ভিতরে আসতে কি আমারও একটা মুখ ঝামেলা দিতে হবে? মেহেরিনের কথাই ছিল কৌতুক। রাকিব খানিক মাথা চুলকে বলে না না তার দরকার নেই একজনেরটাই সহ্য করতে পারছিনা। আসো আসো ভিতরে আসো।
রিদ তখন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল, ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকাল মাত্র।
শান্ত বসে ছিল বিছানার এক কোণে, মৃদু টেনশনে চোখে মুখে কিছুটা অস্থিরতা।
রাহি ও মেহরিন এসে বসতেই রাকিব আবার দরজা বন্ধ করে বলল—
নে এবার শুরু কর তোরা।
রাহি মুখ ভার করে বলল,
শান্ত ভাইয়া তোমাকে দেখে আমি ভেবেছিলাম তুমি অনেক সাহসী। তুমি যে এমন বলদ আমি তা আগে জানতাম না, ভালবাসতে পারো আর মুখে বলতে পারো না কেন গো! বললে কি ফোসকা পড়ে যায়, পুরুষ মানুষ হয়ে ভালোবাসার কথা স্বীকার করতে পারো না কেমন পুরুষ তুমি?
শান্ত দুই হাত সামনে এনে বলে, চুপ হোজা মেরি মা! আমার ভুল হয়ে গেছে। আমার উচিত ছিল আরো আগেই বলে দেওয়া। এখন আমাকে বকা না দিয়ে প্ল্যান দে।
রাহি শান্ত কে কিছু বলতে যাবে তখন চুপ করল রাকিবের দিকে, দেখে রাকিব ডেপ ডেপ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রাহি আরেকটা মুখ ঝামতে দিল। রাকিব হেসে ফেললো রাহির কাজে।
রিদ ওদের কাহিনী দেখে অন্য দিকে মুখ করে চুপচাপ একটা হালকা হাসি দিল—তবে ওর চোখে এখনও একটা ছায়া, যেন সবকিছু ঠিকঠাক হোক, ওটাই শুধু চায়।
শান্ত আর মেহরিন তো উচ্চস্বরে হেসে দিলো।
রাহি আর মেহরিন যখন রিদদের রুম থেকে বের হলো, তখন তাদের চোখে মুখে এক রকম উত্তেজনা। প্ল্যান স্পষ্ট।
রাত গভীর হলেও আবহাওয়ার মাঝে যেন একরকম শিহরণ। চাঁদের আলো ছাদের গায়ে পড়ে রহস্যময় একটা আবহ তৈরি করেছে।
রাকিব, রিদ আর শান্ত তখন হালকা সাজগোজ শুরু করেছে। ছাদের একপাশে ছোট ছোট কিছু লাইট টাঙানো, মাটিতে গোল গোল পাথর দিয়ে ঘিরে রাখা। মাঝখানে রাখা একটা ছোট্ট টেবিল, যেখানে শান্ত লুকিয়ে রেখে দিয়েছে একটা ছোট্ট বক্স—চুমকিকে দেয়ার জন্য তার প্রস্তাবের প্রতীক।
মাঝে মাঝে রিদ চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়। রাতটা যেন এক অদ্ভুত সুন্দর কোনো কিছুর পূর্বাভাস দিচ্ছে।
আর এদিকে—
রাহি আর মেহরিন পৌঁছাল চুমকির রুমে।
চুমকি তখনও একটু গোমড়া মুখে বসে ছিল। কিন্তু রাহি ঢুকেই বলল—
চুমকি আপু, আর কত রাগ করবে? আয় তোকে একটা জিনিস দেখাই। আজ তোর জন্য আমাদের একটা সারপ্রাইজ আছে!
চুমকি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কিসের সারপ্রাইজ?
তোরা না কোল্ড কফি আনতে গেলি?মেহু তোর হাতে ওটা কি?
মেহরিন এগিয়ে এসে বলল,উফ এত প্রশ্ন করছিস কেন?এই দেখ, তোকে আজ চাঁদের রানী বানাব আমরা! আয়, এই শাড়িটা পরে ফেলতো জটপট, শান্ত ভাই নিজে দিয়েছে… বলেছে আজকের রাতটা স্পেশাল।
চুমকির চোখ এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। মনেই হলো না কিছু বলার। শুধু নিঃশব্দে শাড়িটা হাতে নিল।
রাহি চুপিসারে মেহরিনের কানে ফিসফিসিয়ে বলল—
বাকি কাজটা শান্ত ভাইয়ের…
মেহরিন মুচকি হেসে বলল—
আর আমরা শুধু আলোর পথ দেখিয়ে দিলাম!
চুমকি শাড়িটা পরে আসতেই রাহি আর মেহরিন দুজনেই হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল।
উফফ, চাঁদের মতো লাগছে তোকে! আজ তোকে দেখলে শাওনের কবিতাও হার মানে যাবে,মেহরিন মুগ্ধ হয়ে বলল।
চুমকি একটু হাসে।
তোকে তো সত্যি সত্যি রানী লাগছে চুমকি আপু!” — রাহি চোখ বড় বড় করে বলল,
কিন্তু রানী হলেও তো রাজ্যে ঢোকা যাবে না চোখ খোলা রেখে!
চুমকি একটু ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
মানে?
রাহি ঝট করে একটা মৃদু রঙের সিল্ক কাপড় বের করে বলল,
এই চোখে একটু কাপড় বাঁধতে হবে। চমকের সৌন্দর্য একবারে পেতে হয় না, ধীরে ধীরে পেতে হয় সোনা!
চুমকি প্রথমে একটু ইতস্তত করলেও রাহির মুখের শিশুসুলভ উত্তেজনা দেখে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।
মেহরিন সযত্নে কাপড়টা বাঁধতে বাঁধতে বলল,
বিশ্বাস কর, আজকের রাতটা তোর জীবনের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি হয়ে থাকবে।
চুমকি হালকা হেসে বলল,
তোদের দুজনকে আজ কেমন অদ্ভুত লাগছে,কিন্তু আমি তোদের অনেক বিশ্বাস করি।
অদ্ভুত না, ম্যাজিক!—হেসে রাহি বলেই মেহরিনকে ইশারা করল।
তখনই দুজন মিলে চুমকির হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে এল।
বিয়ের আমেজ না থাকলেও আজ চুমকিকে দেখে মনে হচ্ছিল কোনো নববধূকে স্বপ্ন সাজিয়ে কেউ নিতে এসেছে।
তারা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ছাদের দিকে, যেখানে আলো, নীরবতা আর অপেক্ষার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ভালোবাসা…
রাহি কাউন্ট করে ওয়ান… টু… থ্রি….
চুমকির চোখের সামনে এক মুহূর্তে পরিবর্তন আসল। রাহি ধীরে ধীরে চুমকির চোখের কাপড় খুলে দেয়। কাপড় সরতেই চুমকি দেখতে পেল, তার চারপাশটা একেবারে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে—গোলাপি রঙের বাতি, হালকা সুরেলা গান এবং মৃদু আলোয় ভরা একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে রিসোর্টেড ছাদে।
চুমকি অবাক হয়ে চারপাশে তাকিয়ে থাকে। তার চোখে অন্ধকারের মাঝে আলো ফুটে উঠেছে, আর তার হৃদয়ে সেই আলোটি যেন মিশে যাচ্ছে। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হচ্ছিল, আজ সে এক রাজকন্যা—সাজানো, মায়াজালে আটকানো।
ঠিক তখনই, সুরেলা এক গান ভেসে আসে, মৃদু কণ্ঠে বাজছে, তুমি রবে নীরবে…।
চুমকি রাহির দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলে, সন্ধ্যায়ও তো কিছুই ছিল না, এমন পরিবেশ তো দেখিনি!
রাহি এক হাত দিয়ে চুমকির কাঁধে হাত রাখে এবং বলে, তুমি তো একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ! এই পরিবেশটা তোমার অপেক্ষা করে ছিল সোনা, এখন শুধু তুমিই আছো এখানে!
ঠিক তখনই, ছাদের দরজা খোলে। শান্তো ঢুকল, পরনে সাদা একটি পাঞ্জাবি, মুখে মিষ্টি হাসি। তার চোখে যেন একটি গভীর মমতা ছিল, যা চুমকিকে দেখে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
রাতের শীতল হাওয়ায় চাঁদের আলোকমাখা আলো ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ছাদ জুড়ে। চারপাশে এক ধরনের নিস্তব্ধতা ছিল, আর সেই নিঃশব্দতার মাঝে শান্ত আর চুমকি দাঁড়িয়ে ছিল। ছাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া গোলাপের সুগন্ধ তাদের চারপাশে। একদিকে শান্তর দৃষ্টি ছিল চুমকির চোখে, অন্যদিকে চুমকির দৃষ্টি ছিল পৃথিবীকে ভুলে যাওয়ার মতো শান্তর মধ্যে।
শান্ত ধীরগতিতে চুমকির কাছে এগিয়ে আসে, যেনো সে এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে যাচ্ছে, একটি অনুভূতি নিয়ে, যা কোনো শব্দে প্রকাশ করা যায় না। তার হাত চুমকির হাতে পৌঁছায়। চুমকির কাঁপতে থাকা আঙুলের মধ্য দিয়ে শান্তর শক্ত হাতে আলতো চাপ সৃষ্টি হয়। চুমকি কেঁপে উঠল শান্তর স্পর্শে।যেনো তার হৃদয়ের প্রতিটি ধ্বনি শুনতে পেল।
শান্ত এক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়, তারপর তার গভীর চোখে তাকিয়ে বলে, তুমি জানো চুমকি, আমি যতবার তোমাকে দেখি, ততবার আমার মনে হয়, আমি যেনো নতুন করে প্রেমে পড়ছি।
চুমকি তার চোখে অদ্ভুত এক আলো দেখতে পায়। তার হৃদয়ও কাঁপতে শুরু করে, সে অনুভব করতে পারে যে শান্তর কথাগুলো শুধুই শব্দ নয়, সেগুলো যেনো তার অন্তরের গহীনে তৈরি একটি নতুন জীবনের সূচনা।
শান্ত তার হাত ধীরে ধীরে চুমকির হাতে রাখে, তার একেবারে কাছে চলে আসে। চুমকি, তুমি যখন আমার সামনে থাকো, তখন আমি কিছুই চাই না। শুধু তোমার সঙ্গে থাকতে চাই।
চুমকি শান্তর এই কথায় কিছুক্ষণ নীরব থাকে। হালকা এক শ্বাস ফেলে, তার চোখে এক টুকরো জলকণা আসে, যা সে চোখের কোনে লুকিয়ে ফেলতে চায়। তার কণ্ঠ নরম হয়ে ওঠে, আমি জানি, শান্ত.. আমি জানি।
শান্ত ধীরে ধীরে তার আঙুল দিয়ে চুমকির চুলের ওপর হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর সে মাথা নিচু করে, চুমকির কানের কাছে softly ফিসফিস করে বলে, তুমি আমার পৃথিবী চুমকি। তোমার সাথে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাটাতে চাই।
চুমকি চোখে চোখ রেখে সোজা তাকায়, তারপর তার হাত শান্তর হাতে আরও শক্তভাবে জড়িয়ে নেয়। আমিও, শান্ত। মুখে একটি মিষ্টি হাসি চলে আসে, যার মধ্যে শুদ্ধ ভালোবাসার প্রতিফলন ছিল।
তাদের চোখে এক রকম নীরব চুক্তি ছিল, যেনো তারা একে অপরকে বুঝতে পেরেছে, আর তাদের মধ্যে থাকা সব কিছু একে অপরকে প্রমাণ করার অপেক্ষায় ছিল। শান্তর ঠোঁটের কোণে একটি হালকা হাসি ফুটে ওঠে, যখন চুমকি তার চোখে চোখ রেখে হালকা হাসে, যেনো সমস্ত পৃথিবী তাদের চারপাশে ঘুরে ফিরে আসছে।
এভাবে, চুমকি আর শান্ত একে অপরের মধ্যে হারিয়ে যায়, আর তারা জানে, তাদের ভালোবাসা এই পৃথিবীর সব কিছুর থেকে বড়।
রাহি ফোনে ভিডিও করছো এই মুহূর্তটা।
পাশ থেকে তখনই রাকিব একটু বিরক্ত গলায় বলে ওঠে, আরে গাদা,তোদের ওসব চোখে চোখে কথা পরে বলিস, আগে আসল কাজটা করে ফেল!
শান্ত ওজনকে হুঁশ ফিরে, চুমকি লজ্জায় আশফাশ করছে।শান্ত হেসে মাথা ঝাঁকায়, নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে চুপচাপ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে চুমকির সামনে। হাত বাড়িয়ে দেয় তার দিকে।
বক্স থেকে রিংটা বের করে বলে,
চুমকি… আমি আজ আর কিছু বলব না শুধু জানতে চাই—তুমি কি হবে আমার সারাজীবনের সাথী?
চুমকির চোখ ছলছল করে ওঠে, হঠাৎ তার গাল বেয়ে টুপটাপ করে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সে মাথা নাড়ে, কাঁপা কণ্ঠে বলে—হুম্…
শান্ত একটু হাসে, সম্মতি পেয়ে সাথে সাথে চুমকির হাতে রিংটা পরিয়ে দেয়। রিং পরিয়ে রিং এর উপরে একটা চুমু খায়।
রাহি তখন পাশে দাঁড়িয়ে আর চুপ থাকতে পারে না।
রাহি আর মেহরিন এক সাথে বলে উঠে,
ইয়া হু*****
বলে চিৎকার করে ওঠে, সাথে রাকিব ও হাততালি দিয়ে বলে—অসাধারণ! অবশেষে গাদার মাথায় বুদ্ধি এসেছে!সাব্বাস বেটা।
রাহি ঝামটা দিয়ে বিড়বিড় করে বলে, নিজে গাধার নানা হয়ে আরেকজনকে গাথা উপাধি দিচ্ছে।
বিড়বিড় করে বললেও রাকিবের কান পর্যন্ত পৌঁছে যায় রাহির কথা গুলো।
রাকিব কেশে উঠে রাখি কথা শুনে।
সবাই খুশিতে হাসছে, চারপাশে আনন্দ আর ভালোবাসার জোয়ার।
আর ঠিক তখনই একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রিদ—চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।
তার চোখ শুধু একদিকে—মেহরিন।
দুষ্টুমি খুনসুটির মধ্যে হঠাৎ
রিদ গম্ভীর গলায় বলল,
চলো সবাই, ওদের এখন একা ছেড়ে দেওয়া উচিত।
সবাই সম্মতি দিল কিন্তু হঠাৎ,
রাহি বাচ্চাদের মতো উল্টিয়ে বলল,
দাদা ভাই। আমার তো একটুও ঘুম আসছে না,মেহু আপুর ও আসছে না আমি জানি।চলোনা… আমরা একটু হেঁটে আসি?
তার গলায় একধরনের বাচ্চাসুলভ আবদার, কিন্তু চোখে টুকরো টুকরো দুষ্টুমি।
রাকিব হেসে ফেলল,
মনে মনে বলে,
মহারানীর সব সময় কিছু না কিছু চাই!
রিদ একমুহূর্ত চুপ করে থেকে ধীরে মাথা নেড়ে বলল,চলো।
চারজন বেরিয়ে এলো রিসোর্ট থেকে একটু দূরের দিকে হাঁটতে। রাতের হাওয়ায় একধরনের ঘোর লাগা শীতলতা, চারপাশ নিস্তব্ধ, মাঝে মাঝে পায়ের শব্দই একমাত্র আওয়াজ আর জ্যোৎস্না রাত।
মেহরিন একটু পেছনে পড়ে গেল ইচ্ছে করেই—চুপিচুপি। তার মনে ছিল, রাহি আর রাকিবকে একটু সময় দেওয়া দরকার।
মেহরিন কে দারাতে দেখে রিদ ব্যাপারটা বুঝলো তাই সেও মেহরিনার পাশে দাঁড়িয়ে গেল।
রাহি নন স্টপ বকে যাচ্ছে, সে কথা বলতে এতই ব্যস্ত যে পাশে মেহরিন নেয় তাও বুঝলো না।
চুমকি আপু তো কেঁদেই দিয়েছিল রে, শান্ত ভাইর কথাগুলো শুনে… এতদিন যা না বলার ছিল, সব একসাথে বলে দিল! আহা! রোম্যান্টিকেরও একটা সীমা থাকে!
রাকিব হাসে রাহির কথা শুনে,
রাহি তখন চোখ বড় করে বলে ওঠে,
কিন্তু জানিস মেহু আপু, শান্ত ভাই যেটা পারলো… সেই কাজটা রাকিব ভাই কক্ষণো পারবে না!
রাকিব হক-চকিয়ে গেল কি বলবে বুঝতে পারলাো না, তাই চুপ থাকলো কি বলে পরবর্তীতে শোনার জন্য।
রাহি একটু থেমে, গা ঝাঁকিয়ে আবার বলে,
রাকিব ভাই যদি ভালোবাসার কথা বলতেই না পারে, তাহলে এত পজেসিভ হয় কেন? কেউ হাত ধরলেই চোখ রাঙায়, একটু অন্য কারো সাথে হেসে কথা বললেই মুখ কালো!
রাকিব মুচকি মুচকি হাসছে রাখি কথা শোনে।
রাহি এবার গলা নামিয়ে দন্তবিকাশ ভঙ্গিতে বলে ওঠে—
ওই রাকিব ভাইটা একটা ‘নভেল প্রাপ্ত গাদা’! এক নাম্বার হতচ্ছাড়া!একেবারে গাধা নানা, গন্ডার একটা।
রাকিবের মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে এর আগের কথা শুনে। চোখগুলো ছানাবড়া হয়ে গেছে।
কোন সারা শব্দ না পেয়ে,
এক মুহূর্তে থেমে যায় রাহি। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘোরায়।
আর ঠিক তখনই পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রাকিব ঠাণ্ডা গলায় বলে ওঠে—
নভেল প্রাপ্ত গাদা, আমি?
রাহির মুখ এক নিমেষে শুকিয়ে যায়।
আমি… মানে… আসলে… তুমি তো পেছনে ছিলে।
রাকিব ঠোঁটে একটুখানি বাঁকা হাসি নিয়ে বলে—
তুমি তো ভেবেছিলে, আমি শ্রোতা নই। অথচ আমি শ্রোতা এখন থেকে নয় সেই বকবকানি শুরু করেছো থেকে।
রাহি মুখটা গম্ভীর করে ফেলে।
কি আমি বক বক করি?
রাকিব রাহির একদম কাছে চলে আসে, হটাৎ এত কাছে আশায় রাহি ঘাবড়ে যায়।রাকিব কখনো এত কাছে আসেনি।
রাহির বুকের ভিতর যেনো কেউ হাতুড়ি পিটাচ্ছে। হার্ট বিট খুব ফাস্ট বিট করছে।
হালকা বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ে এসে পড়ে গালে আর কপালে।
রাকিব নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে চুলগুলো যত্ন করে কানের পেছনে গুঁজে দেয়। ওর আঙুলের ছোঁয়া রাহির গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
তারপর রাকিব মুখটা একেবারে নিচু করে আনে রাহির কানের কাছে। গলা নরম, কিন্তু গভীর—
আমি গাদা কিনা… সেটা সময় মতোই বুঝিয়ে দেবো। My little princess…..
রাহি যেন পুরোপুরি জমে গেল। রাহিরা অবস্থা দেখে রাকিব মুখ টিপে হাসছে।
মেহরিন একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল। রাহি আর রাকিবের সেই রোম্যান্টিক মুহূর্ত চোখে পড়তেই ওর মুখে এক চিলতে হাসি। কিন্তু হঠাৎই অনুভব করল, কেউ ওকে দেখছে।
চোখ ফিরিয়ে দেখল—রিদ ভাইয়া।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকেই। চোখে এক অদ্ভুত গভীরতা, যেন ওর ভেতরটা পড়ে ফেলছে।
মেহরিন হঠাৎই অস্থির হয়ে পড়ে।
না… উনি যেন কিছু না দেখে, হাজার হলেও উনি রাহির বড় ভাই…” — মনে মনে ভাবে।
সেই মুহূর্তে ও যেন নিজেরও অজান্তে সামনে এগিয়ে যায়,কি করে ভেবে পাচ্ছি না হঠাৎ করেই, রিদ হাতটা ধরে ফেলে।
রিদ চমকে ওঠে—
প্রথমবার!
প্রথমবার মেহরিন ওকে স্পর্শ করল।
মেহরিন নিচু গলায় বলে—
রিদ ভাইয়া… চলেন, আমরা ওইদিক টাই যাই।
রিদ অবাক, এক মুহূর্তে কিছু বলতে পারে না। ওর চোখে স্পষ্ট বিস্ময়।
মেহরিন মাথা নিচু করে আছে, কিন্তু হাতে ওর স্পর্শটা শক্ত করে ধরে রেখেছে।
রাহি আর রাকিব ওখানে দাঁড়িয়ে।
রিদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, আর মেহরিন ওকে টেনে নিয়ে যায় অন্ধকার ছায়ার দিকে, যেখানে দু’জন ছাড়া কেউ নেই।
হঠাৎ *****
মৃদু শব্দ হয় গাছের পিছন থেকে। হালকা আলোতে দেখা যায়—একটা লোক গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে। পরনে কালো প্যান্ট, ধুসর শার্ট, চোখে চশমা, চকচকে দৃষ্টি। হাতে ফোন।
লোকটা ব্যস্তভাবে ফোন করে কাউকে। হালকা ফিসফিসে কণ্ঠে বলে—
স্যার, আমি নজর রাখছি। ওরা আলাদা হয়ে গেছে। আমি ভিডিওটা পাঠাচ্ছি, আপনি দেখে নিন।
ফোনের ওপাশের মানুষটা কি বলল শোনা গেল না।
গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা নিচু গলায় বললো,
স্যার, ম্যাম এখনো আমার চোখের সামনেই আছে। আমি নজরে রাখছি। আপনি চিন্তা করবেন না।
ফোনের ওপাশের মানুষটা একটা অন্ধকার রুমে বসে আছে,তাকিয়ে আছে সামনে থাকা ল্যাপটপের দিকে,
স্ক্রিনে তখন স্পষ্ট দেখা যায়—মেহরিনের হাত ধরে রিদ ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে দূরে।
ভিডিওটা দেখামাত্রই ল্যাপটপটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো ফোনের ওই পাশের মানুষটা।
একে একে ঘরে সব কিছু ভেঙে তছনছ করে ফেলে, গভীর নিঃশ্বাস ফেলে, সে নিচু গলায় নিজের মনে এক কবিতা আওড়ায়—
শব্দগুলো যেনো বাতাসে মিশে যায়,
তবুও সেই শুদ্ধ উচ্চারণে জ্বলে উঠে অন্য এক আলো…
**”তুমি হেঁটেছিলে আলোয়—
আর আমি চুপিচুপি হাঁটছিলাম অন্ধকারে,
তোমার হাসি পেছন ফিরে কখনো তাকায়নি,
তবুও মনে হয়েছিল—
একটা দিন তোমার চোখে আমার ছায়া ফুটবে।
তুমি জানো না —
তোমার চুপি চুপি হাঁটা,
তোমার কপালের সেই চুল সরানো,
তোমার রাগ করে মুখ ফুলিয়ে রাখা—
আমার নিঃশ্বাসে আগুন ধরায়।
তুমি হয়তো তাকাও ওর দিকে—
যে ছুঁয়ে বলে, ‘চলো’,
কিন্তু আমি তাকাই তোমার দিকে—
যে কখনো ছুঁয়ে বলিনি,
তবুও প্রতিটা পদক্ষেপে
তোমার ছায়া হয়ে থেকেছি পাশে…”**
একটু থেমে লোকটা বলে ওঠে,
“তুমি হয়তো কোনোদিন জানবেই না,
তোমার নামেই আমার প্রতিটা কবিতা শেষ হয়…”
সেই লোকটা এবার নিঃশব্দে একটু এগিয়ে আসে, দেয়ালে টাঙানো মেহরিনের ছবিটার দিকে। তার চোখে যেন আগুন জ্বলছে—ভালবাসার, না বলা আবেগের। এক মুহূর্ত, সে থেমে গিয়ে নিচু গলায় বলে ওঠে—
**”তুমি…
তুমি শুধু আমার আরিওনা।
শুধু আমার।
তোমার হেসে ওঠা, তোমার অভিমান,
তোমার ঝাঁকড়ানো চুলে ছুঁয়ে থাকা হাওয়া—
সব কিছুই শুধু আমার।
তুমি যদি কারো হও,
তাহলে সেই ‘কারো’ আমি হব—
আর যদি না হও,
তবে সারা দুনিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলব—
তুমি শুধু আমার, সদাই আমার,আমার আরিওনা।”**
তার গলায় স্পষ্ট এক দাবি, এক অদ্ভুত অধিকারবোধ,
যেন নিজের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে সে বলছে—
“তোমার চোখে তাকিয়ে কেউ যদি দেখে স্বপ্ন,
তবে সেটা কেবল আমি হব—
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৪
কারণ, তুমি,
তুমি শুধু আমার, সদাই আমার…
You are M little Moonbeam… only mine, always mine.”(তুমি আমার ছোট্ট চাঁদের কিরণ… কেবল আমার, চিরকাল আমার)