মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৭

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৭
মির্জা সূচনা

মেহরিন বাসায় ফিরে দরজা খুলেই সোজা নিজের রুমে ঢুকে যায়। মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে শুধু বলেছিল, “একটু পরে কথা বলি, মা”—তারপর ফ্রেশ হয়ে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। তিন দিনের ট্যুর আর সব উল্টাপাল্টা অনুভূতির মাঝে সে একরকম ক্লান্ত। চোখ বুজতেই যেন চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে আসে, কিছু না ভেবেই ঘুমিয়ে পড়ে।
অন্যদিকে…

রিদ আর রাহি এসে পৌঁছায় তালুকদার ভিলাতে। গাড়ি ঢুকতেই দারোয়ান সালাম দেয়, রিদ শুধু মাথা নেড়ে সাড়া দেয়। রাহি তো একেবারে গলগল করে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করতেই দেখতে পায় সবাই সেখানে বসে আছে। রেদওয়ান তালুকদার, সাবিহা তালুকদার , জাফর তালুকদার, শামিমা তালুকদার , মিলি, রামিম, এমনকি ছোট আরিফ পর্যন্ত সবাই উপস্থিত।
রাহি হঠাৎ বলে উঠলো— আরে এত জটলা কিসের? আবার কি বিয়ে-শাদি টাদি কিছু প্ল্যান হইছে নাকি?
রাহিকে দেখে সাবিহা তালুকদার খুব খুশি হয় উনি বলেন এসেই ভাদ্রমা শুরু করে দিয়েছো, চুপচাপ এখানে এসে বস রাখি ভদ্র মেয়ের মতো গিয়ে বসে পড়ে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তালুকদার ভিলার ড্রয়িংরুমে আজ একটু অন্যরকম ব্যস্ততা। সাজানো-গোছানো রুমের পরিবেশে হালকা একটা উত্তেজনার ছাপ। সবাই একসাথে বসে আছে—রেদওয়ান তালুকদার সামনের সোফায় গম্ভীর ভঙ্গিতে, পাশে সাবিহা তালুকদার, জাফর তালুকদার আর শামিমা তালুকদার এক পাশে, আর বাকিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। মিলি এক কোণে একটু নিচু হয়ে বসে আছে, লাজুক মুখে চোখ নামিয়ে রেখেছে।
রাহি ফিসফিস করে রামিমকে জিজ্ঞেস করলো,
এই কিরে, সবাই এমন করে বসে আছে কেন? কেউ মারা গেছে নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে?
রামিম চাপা গলায় বলল,

বিয়ে! বড় বাবার ফ্রেন্ড এসেছিলেন, মিলিকে দেখে পছন্দ করে ফেলেছেন, আর আজকেই নাকি বিয়ের দিন ঠিক করে গেছেন—সামনের মাসের ১২ তারিখ!
রাহির চোখ গোল গোল—কি বলিস! এত তাড়াতাড়ি! আপু তো এখনো স্টাডি করছে।
এই সময় রিদ রুমে ঢোকে। রাহি তো সরাসরি চেঁচিয়েই উঠলো,
বাবা রে! বিয়ে বিয়ে গন্ধ পাচ্ছি! মিলি আপু লাজুক হয়ে বসে আছেন, মানে নিশ্চিত কিছু একটা হয়েছে! দাদাভাই তুমি ও কী পাচ্ছো?
রামিম মনে মনে বলে,কি ধরিবাজ মেয়ে রে বাবা! মাত্রই বললাম আমি বিয়ের কথা! আর কী নাটকটাই না করলে ও নাকি গন্ধ পাচ্ছে চাপাবাজ।

রেদওয়ান তালুকদার তখন মুখ তুলে বলে উঠলেন,
রাহি, চুপচাপ বসো। বড়দের আলোচনা হচ্ছে।
কিন্তু সাবিহা তালুকদার হাসিমুখে বলে ফেলেন,
আসলে তোমার বাবার কলেজ ফ্রেন্ড মিস্টার সায়েম তার ছেলে শাফিনকে নিয়ে এসেছিলেন, মিলিকে দেখে ভালো লেগেছে। মিলি মা ও রাজি, তাই আমরা ভেবে দেখেই সামনের মাসের ১২ তারিখ বিয়ের দিন ঠিক করে ফেলেছি।
মিলির মুখে হালকা লজ্জা, রাহি ফিসফিসিয়ে বলে—
ও মা! এবার তো দুলাভাইরে একটু দেখা যায় নাকি!
আরিফ হঠাৎ বলল—
তবে একটা সমস্যা আছে…
সবাই তাকাল ওর দিকে।

আমার গিফটের লিস্ট অনেক বড় হবে, আগেই বলে দিলাম!
হাসির রোল পড়ে যায় ঘরজুড়ে। মিষ্টি উত্তেজনা, উষ্ণ ভালোবাসায় ভরা এক সন্ধ্যা। আর সেই সন্ধ্যার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মিলি, তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের দরজায়।
সবার মুখে একটাই আলোচনা—মিলির বিয়ে। এর মধ্যেই রেদওয়ান তালুকদার রিদকে ইশারায় ডাকলেন ড্রয়িংরুমের কর্নারে।
রিদ এগিয়ে যেতেই বাবা নিচু গলায় বললেন,

রিদ, তুমি তো এতক্ষণে বুঝেই গেছো, আমরা একটা প্রস্তাব পেয়েছি মিলির জন্য। শাফিন নাম—আমার ক্লাসমেট সায়েমের ছেলে। লন্ডনে থাকে, ভালো চাকরি করে, ব্যবহারে ভদ্র, শিক্ষিত ছেলেটা।
রিদ কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকল বাবার দিকে। এরপর ধীরে গলা নামিয়ে বলল,
বাবা, আপনি আর চাচা মিলেই তো এই পরিবারের চালিকাশক্তি। আপনারা যা ভালো বুঝেন, সেটাই করুন। আমি বিশ্বাস করি আপনারা ভুল কিছু করবেন না। তবে…
সে একটু থেমে বলে,

মিলি কি রাজি? সংসার ও করবে, আমারা না। প্রথমে ওর সম্মতি নিন। ওর ইচ্ছেটা গুরুত্বপূর্ণ।
রেদওয়ান তালুকদার মৃদু হাসলেন, ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“এটাই চেয়েছিলাম শুনতে। তুমি বাকি ভাইবোনদের মতো আবেগে নয়,বাস্তবতা দিয়ে ভাবো আই এম প্রাউড অফ ইউ মাই বয়।
রিদ মুখ নিচু করে বলল,

আমি বড় ছেলে বাবা। দায়িত্ব না নিলে কে নেবে? তবে বিয়ে মানে শুধু সম্পর্ক না, মানিয়ে নেওয়ার লড়াই। মিলি যদি তৈরি থাকে, আমি সবার আগে রাজি। আমার কাছে সব কিছু ঊর্ধ্বে আমার বোনেরা।
ঘরের পরিবেশটা ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসছে। সবার মুখে এখন একধরনের প্রশান্তি। ঠিক তখনই রিদ একটু এগিয়ে এসে বলে,
আব্বু, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
রেদওয়ান তালুকদার মাথা নেড়ে বলেন,

হ্যাঁ হ্যাঁ যাও, আরে তোমরা তো ট্যুর থেকে সোজা এসেছো, একটু রেস্ট নাও।
সাবিহ তালুকদার বলেন,
রাহি তুমি ও যাও ফ্রেশ নাও তোমরা আমি চা পাঠাচ্ছি রুমে।
রাহি শান্ত গলায় মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ায়,
“ওকে মাদার বাংলাদেশ …”
রিদ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিল। পেছন থেকে রাহি খানিকটা জোরে বলে ওঠে,
এইটা কিন্তু ঠিক না! মিলি আপুর বিয়েটা ঠিক হয়ে যাচ্ছে, আর আমাদের দাদা ভাইয়ের ব্যাপারে কেউ কিছু ভাবছে না!

সবার মুখে চাপা হাসি। কেউ চোখে চোখে ইশারা করে। রাহি থামে না,
এই বাড়িতে দাদা ভাইয়ের সাথে একেবারে অবিচার হচ্ছে! উনার বিয়েটা কবে হবে শুনি?
রিদ সিঁড়ির মাঝখানে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে কড়া চোখে তাকায়,
রাহি… behave yourself…
রাহির মুখটা ছোট হয়ে যায়,
আহা, একটু মজা করলাম …”
তার আগেই রিদ আর কিছু না বলে সোজা ওপরে উঠে যায়। আর রাহি নিজের কান চেপে ধরে এক দৌড়ে নিজের রুমে ঢুকে যায়,
উফফফ,এই বাড়িতে আমার কোন মূল্যই নাই, যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। নিজেতো মুখ ফুটে বিয়ের কথা বলতে পারবে না আমি সাহায্য করছিলাম কই একটু ধন্যবাদ দিবে তা না বকছে ! এই ভাইটারে নিয়ে আর পারি না!”
সবার মুখে হাসি, রাহির দুষ্টুমি আর রিদের গাম্ভীর্য মিলিয়ে মুহূর্তটা হয়ে থাকে দারুণ স্মরণীয়।

রাত ৮ টা
সন্ধ্যার আঁধার কেটে আসছে চাঁদের হালকা আলো, আর সিকদার বাড়ির আঙ্গিনায় ছড়িয়ে পড়ছে এক মিষ্টি নিরবতা। বাড়ির বাইরের নেমপ্লেটটি সূর্যের শেষ রশ্মির মতো আলোকিত হয়ে সোনালী রঙে জ্বলছে—“সিকদার বাড়ি”—যেনো অভ্যাগতকে জানিয়ে দেয় এখানে আসে এক শিল্পী, এক কবি, আর তার সৃষ্টির জগৎ।
বাড়ির প্রবেশপথটি প্রশস্ত, দরজা পেরিয়ে এক খোলা পথ এসে পৌঁছায় সুন্দর সাজানো বাগানে। এখানে গাছের সঙ্গে ফুলের ভিড়ে যেনো কোনও আলাদা রহস্য লুকিয়ে আছে। হরেক রকমের ফুলের গাছ সাজানো, গোলাপের মিষ্টি গন্ধ আর লেবু ফুলের শুকনো মিষ্টি সুবাস মিলে এক স্নিগ্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এখানে প্রায় রাতেই ভেসে আসে মধুর সুর, পাখিরা নিজেদের গানের সুর তুলে গান গায়, যেনো রাতের এই নিরবতা শুধু তাদের জন্য।
বাগান থেকে সোজা সিঁড়ি উঠে যায় বাড়ির পেছনে। এক পাশ দিয়ে সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি ফুটপাথ, আর অন্যপাশে ঝাড়বাতি, যেগুলো গভীর রাতে রাস্তায় লাল-নীল আলোয় আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ যেনো এক স্বপ্নপুরী, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ মনে হয় জীবনের একটা নতুন অধ্যায়।

বাড়ির ভিতরে আসা মাত্রই ছড়িয়ে পড়ে আধুনিকতার আর আভিজ্ঞান। সোজা দীর্ঘ করিডর—কাছেই চমৎকার ডিজাইনের এক বিশাল ড্রয়িং রুম, যেখানে লাউঞ্জ চেয়ার এবং উজ্জ্বল সোফা রয়েছে। প্রাচীন এবং আধুনিক জিনিসের এক মিশ্রণে সাজানো—পুরনো সিলভার টেবিল ল্যাম্প থেকে আধুনিক আর্টওয়ার্কস পর্যন্ত সব কিছুই এখানে থাকে যেনো এক কবিতার মতো, যা একে অপরকে সমর্থন করে।

এদিকে, বাড়ির এক কোণে সোনালী রঙের বাতি ঝলমল করছে, যেখানে কবি সাহেবের নিজস্ব শৈলীতে সাজানো লেখা ডেস্ক এবং বইয়ের তাক। সারা দেওয়ালজুড়ে আছে কিছু পেন্টিং—যতটুকু আধুনিক, ততটুকু ঐতিহ্যবাহী। সাদা রঙের দেয়ালে একেবারে আধুনিক এবং ফাইন আর্টের সংমিশ্রণ, সঙ্গে সঙ্গেই যন্ত্রমিউজিকের প্রলয়িত সুরের ব্যবস্থা, যেনো মনে হয় কবি সাহেব প্রতিটি শ্বাসে সৃষ্টিশীলতার আগুন জ্বালাচ্ছেন।
বাড়ির এক কোণে রয়েছে বিশাল একটা কাচের জানালা, যা থেকে পুরো বাগান এবং তার স্নিগ্ধ রূপ দেখা যায়। রাতের বেলা এখানে বসে থাকার আনন্দই অন্যরকম, যখন চাঁদের আলো গাছের পাতায় ছড়িয়ে পড়ছে, আর সেই আলোয় ছটফট করছে একদম নীরবতা। মাঝে মাঝে কপালে হালকা ঠাণ্ডা বাতাস লাগে, আর মনে হয়, জীবন নিজেই এক কবিতা হয়ে যাচ্ছে।

নিজের রুমের ব্যালকনিতে একা দাঁড়িয়ে আছে কবি সাহেব। চারপাশ নিস্তব্ধ—শুধু পাতার ফাঁকে ফাঁকে হাওয়া খেলা করে আর দূর থেকে মৃদু ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ ভেসে আসে। রাজ সিকদার, যার নামেই কাঁপে সভাকক্ষ, থেমে যায় কণ্ঠ—সেই রাজ এখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটি গভীর, তীক্ষ্ণ আর স্থির, যেন কোনও অজানা প্রশ্নে ডুবে আছে সে মনে চলছে নিজের শত্রুদেরকে ভয়ংকর শাস্তি দেওয়ার পরিকল্পনা।
ঠিক তখনই, নরম পায়ের শব্দে পিছন থেকে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় এক নারী। পরনে স্নিগ্ধ ও মার্জিত ঘরোয়া পোশাক, হাতে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ। রাজের স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভঙ্গিটা দেখে হালকা হাসলেন তিনি। তারপর মৃদু স্বরে ডাকলেন,

— রাজ বাবা… তোমার কফি।
রাজ একটু চমকে ঘুরে তাকায়। চেহারায় এক ধরনের শান্তি নেমে আসে।
ইনি মেহরিনের ‘কবি সাহেব’ — তার নাম রাজ সিকদার।
আর যিনি তাকে কফি এগিয়ে দিচ্ছেন, তিনি তার অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষ—তার মামী, রুপা বেগম যাকে রাজ “মামনি” বলে ডাকে। নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন তিনি রাজকে।
রাজ কফির মগটা হাতে নিলেন, চোখে মুখে ভেসে উঠল অদ্ভুত এক প্রশান্তি আর গোপন কিছু ভাবনার ছায়া। ব্যালকনির আধো আলো-আঁধারিতে তখন শুধু শোনা গেল মামনির মায়াবতী কণ্ঠ—
—আজকাল তুমি অনেক চুপচাপ রাজ… কে যেনো মন চুরি করে নিয়েছে, আমার রাজ বাবার তাই না?
রাজ কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে হাসলেন।

— মামনি… মন তো কবেই সে নিয়ে গেছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা… তাকে এনে তোমার সামনে দাঁড় করাবো বলে।
মামনি কফির মগটা রাজের হাতে দিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তারপর হালকা গলায় বললেন—
— আচ্ছা, তুমি কবে ওকে প্রথম দেখেছিলে? বলো তো?
রাজ হেসে বলল—

— আহা মামনি! এই প্রশ্নটা আর কতদিন করবে বলো তো? তুমি না দিন দিন বেশরম হয়ে যাচ্ছে ছেলের প্রেম কাহিনী শুনতে চাও?”
মামনি হেসে বললেন—
— শুনতে ভালো লাগে তো… নিজের চোখে না দেখে শুধু শোনেই আমি ওকে অনেকখানি চিনে গেছি। আর আমি হলাম আধুনিক মা বুঝলে।
রাজ চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত কল্পনার মেহরিনকে মনে করল। তারপর মগটা ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলল—
— মামনি, তোমার মনে আছে আমি যেদিন প্রথম বাংলাদেশে ফিরি… ওই দিনই আমি লাবিবকে নিয়ে কক্সবাজারে গিয়েছিলাম?
মামনি মাথা নেড়ে বললেন—

— হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো করেই মনে আছে। তুমি তো বলেছিলে, একটু একা থাকতে চাও…
রাজ চোখ সরু করল আকাশের তারাভরা দিকে তাকিয়ে। তারপর গলার স্বরটা একটু নরম করে বলল—
সেদিনই তো প্রথম দেখি ওকে।
অতীতে ডুব দেয় রাজ যেদিন প্রথম দেখেছিল মেহরিন কে।
৩ বছর আগে……….

সন্ধ্যার আলো তখন ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে সাগরের জলে। রোদ আর লালচে আকাশের মিশেলে পুরো কক্সবাজারের সৈকতটাকে মনে হচ্ছিল যেন কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা এক স্বপ্নলোক। হাওয়া বইছে ধীরে ধীরে, সমুদ্রের ঢেউ এসে পায়ের কাছে আলতো করে ভিজিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে।
রাজ সিকদার, বিদেশফেরত সেই কবি যুবক, দাঁড়িয়ে ছিল সৈকতের ধারে। লাবিবের সঙ্গে কোনো এক কথোপকথনে জড়িয়েছিল,লাবিব হচ্ছে রাজের অ্যাসিস্ট্যান্ট। কিন্তু লাবিবের আরেকটা পরিচয় আছে সেটা হলো লাবিব রাজার মামাতো ভাই।লাবিবের সাথে কোন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিল রাজ । কিন্তু হঠাৎই যেনো কোনো অদৃশ্য টানে থমকে গেল ওর চোখ।

দূরে, ঢেউয়ের গা ঘেঁষে দুই বোন ঝুঁকে পড়ে কিছু কুড়াচ্ছে।
— এইটা আমারটা! আমি আগে পেয়েছি!
— আবার শুরু করলে মেহু!
— হুহ! আমার জিনুকটা নিয়ে গেছো!
মেহরিন। নামটা তখনও রাজের অজানা, কিন্তু কণ্ঠটা যেন একবারেই গেঁথে গেল মনে। ছোট ছোট হাসির খিলখিল ধ্বনি, চোখের কোনায় ঝলমলে এক উচ্ছ্বাস। হাওয়ায় ওর ভেজা চুলগুলো উড়ে এসে বারবার মুখে পড়ছে, আর সে বিরক্ত মুখে সরিয়ে হাসছে। সেই হাসি যেন ঢেউয়ের চেয়েও মৃদু, অথচ গভীর।
তার পাশেই ওর বোন মেহবুবা হালকা রাগে, কিন্তু মায়ায় ভরা গলায় কথা বলছে। আর ওদের ছোট ভাই মাহির, হাসতে হাসতে সেসব মুহূর্ত বন্দি করছে ক্যামেরার ফ্রেমে।

আর ঠিক তখনই রাজের মনে হলো—সময় যেন দাঁড়িয়ে গেছে।
সে অপলক চেয়ে রইল সেই মুখটার দিকে, যে মুখে ছিল দুষ্টুমির ছাপ, আর চোখে এক ধরনের সরল স্পষ্টতা। রাজের চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে গেল, শুধু পরিষ্কার রয়ে গেল সেই মুখ, সেই চোখের চাহনি, আর হাওয়ায় উড়ে যাওয়া কিছু চুল।
ও বুঝে গেল—এই মেয়েটির হাসির ভেতরেই লুকানো আছে কিছু একটা, যেটা ও এতদিন খুঁজে ফিরেছে।
রাজ সিকদারের দৃষ্টি তখনও আটকে আছে সৈকতের ধারে দাঁড়ানো সেই মেয়েটির উপর। চোখে যেন এক ধরনের বিস্ময়, বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি—যেনো কোনও অজানা পরিচিত কেউ হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত শব্দ থেমে গেলেও, মেয়েটার হাসির ধ্বনি তার কানে বাজতেই থাকল।

ব্রো…….
লাবিবের কণ্ঠে টনক নড়ল ওর।
আরে ব্রো, কই হারিয়ে গেলে?
রাজ ধীরে চোখ সরাল, কিন্তু মনে রয়ে গেল মেয়েটির ছবি। এক গাল হেসে বলল, ঐ মেয়েটাকে দেখেছিস?
লাবিব কৌতূহলভরে তাকাল। কোন মেয়েটাকে?
রাজ চোখ ইশারা করল—নীল কামিজ, উড়ন্ত চুল, জিনুক কুড়াচ্ছে।
লাবিব হালকা হেসে বলল, ওহ! সুন্দর তো।
রাজ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আমি ওর নাম জানতে চাই। কোথায় থাকে, কী করে—সব কিছু।
-ব্রো তুই কি প্রেমে পড়েছিস নাকি?
-আমি জানি না এটা প্রেম কি না। কিন্তু আমি জানি, আমি ওকে আমি আমার রাজ্যের রানী করতে চাই।ওকে আমার চাই।

লাবিব চমকে তাকিয়ে রইল ভাইয়ের দিকে—সেই চোখে ছিল কবির ছন্দ, আর প্রথম প্রেমে পড়া এক যুবকের পাগলপারা কৌতূহল।
লাবিকে হাবলার মত তাকিয়ে থাকতে দেখে আর রাজ ধমক দিয়ে বললো এমন বেকুবের মতো তাকিয়ে আছিস কেনো স্টুপিড।যেটা বললাম সেটা কর।
লাবিব একটা কেবলা হাসি দিয়ে বললো,
ঠিক আছে ব্রো। কাজ আমার বুঝে নিলাম। আমি খোঁজ বের করব। মেয়েটার নাম, বাসা, পড়াশোনা— ডিটেইলস কালকের মধ্যে পেয়ে যাবে।

রাজ হালকা হাসল, চোখ আবার ফিরল সমুদ্রের দিকে—কিন্তু এবার ওর দৃষ্টি গিয়ে থামল সেই মেয়েটির হাসিমুখে। যেন তরঙ্গের ভেতরেই কোথাও লুকিয়ে আছে ওর নতুন কবিতার সুর।
পরদিন সকাল।
লাবিব এসে রাজের হাতে তুলে দিল একটা ফাইল তার চোখে একরাশ সার্থকতার ঝিলিক।
ব্রো , কাজ শেষ।
রাজ ফাইলটা হাতে নিয়ে নীরবে পাতা ওলটাতে লাগল। প্রতিটি লাইনে মেহরিন—তার পুরো নাম, কলেজ, সাবজেক্ট, পরিবার সম্পর্কে কিছু তথ্য, এমনকি সাথে ছিল কিছু ছবি—যেখানে সে নিজের বন্ধুদের সঙ্গে হাসছে, দুষ্টুমি করছে।
রাজ চুপচাপ ফাইলটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হালকা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
আমরা থাকবো… আরও কিছুদিন। ও এখানে যতদিন থাকবে, ততদিন আমরাও থাকবো।

লাবিব বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, ব্রো তুই এ কথা বলছিস ! আচ্ছা সামনে যাচ্ছিস না কেন?
রাজ হেসে বলল, সব ভালো লাগা সামনে থেকে বলা যায় না লাবিব… কিছু ভালো লাগা দূর থেকে দেখলেই শান্তি হয়। আর কিছু অনুভূতি ছুঁয়ে দিলে ভেঙে যায়। সামনে তো আমি অবশ্যই যাবো কিন্তু এখনই না সময় হোক।
তখন থেকে শুরু রাজের নীরব অপেক্ষা।
প্রতিদিন বিকেলে দূর থেকে দেখতো মেহরিন আর ওর ভাই-বোন কেমন হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকে, জিনুক কুড়ায়, খালি পায়ে জলের ধারে হেঁটে বেড়ায়।

মেহরিন হয়তো জানেও না, কারও চোখ তাকে এমনভাবে খুঁজে ফিরছে।
তিন দিনের ট্যুরের সময়সীমা পার হলেও রাজ থেকে গিয়েছিল আরও দু’দিন।
দূর থেকে তাকিয়ে থাকা, চুপিচুপি হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে সৈকতের এক কোণায় বসে থাকা, যেখানে মেহরিনের হাসির শব্দ ঢেউয়ের মতো ভেসে আসে তার কানে।

এই নিঃশব্দ দেখা, এই দূরের ভালোবাসা—রাজ সিকদারের জীবনের প্রথম একতরফা প্রেমের সূচনা।
পাঁচ দিনের ট্যুরটা কেটে গেল… কিন্তু রাজের জীবনের যেন এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়ে গেল সেই সমুদ্রের ধারে।
রাজ একবারও মেহরিনের সামনে যায়নি। তবে সারাক্ষণ ছায়ার মতো পাশে ছিল—এক অদৃশ্য অভিভাবকের মতো। মেহরিন বুঝতেই পারেনি, যে মানুষটা তার জীবনের সবচেয়ে নিরাপদ ছায়া হয়ে উঠছে, সে ওর একটাও কথা না বলেই প্রতিটি মুহূর্তে ওকে আগলে রেখেছে।
কখনও দূর থেকে দেখেছে মেহরিনের পথ আটকে কথা বলতে আসা কিছু ছেলেকে।
কিন্তু সেসব চলেনি বেশিক্ষণ।

রাজ তাদের ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে এমন কিছু বলে দিয়েছে যা মুখে না বললেও বোঝা যায়—“এই মেয়েটার চারপাশে থাকার অধিকার তোমাদের নেই।”
সেই ছেলেগুলো একে একে উধাও হয়ে গেছে। আর কেউ সাহস করেনি মেহরিনের পাশে ভিড়তে।
মেহরিন জানতো না, তার নিষ্পাপ হাসি রোজ কারো চোখে ভেসে ওঠে।
জানতো না, যখন সে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে বালির ওপর, তখন কেউ একজন গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তার জন্য পানির বোতল রেখে যায়।

জানতো না, সমুদ্রের পাড়ে হোঁচট খেলে তার পেছনে চোখ রেখে কেউ বুক ধুকপুক করে—এই বুঝি পড়ে গেল!
রাজ নিজেও জানতো না—কোন তাগিদে সে বারবার সেই মেয়েটার হাসি দেখতে চায়, সেই নিষ্পাপ চেহারাটার ছায়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চায়।
পাঁচটা দিন যেন উড়ে গেল চোখের পলকে।
তবে এই তিনদিনই রাজকে ভালোবেসে ফেলতে শিখিয়ে গেল—চুপিচুপি, দূর থেকে, না ছুঁয়ে, না বলেই।
মেহরিন জানত না… কোনো এক অচেনা মানুষ তাকে নিঃশর্ত ভালোবেসে আগলে রেখেছে।
যে ভালোবাসায় নেই কোনো দাবি, নেই কোন শর্ত, কেবল আছে স্নেহের ছায়া, নিরাপত্তার আশ্বাস।
সে জানত না… সমুদ্রের পাড়ে যে ছেলেটা বারবার দূর থেকে তাকিয়ে থাকত, সে আজ তার হৃদয়ের কবি হয়ে উঠবে।
আর রাজ?

সে তো কবি হয়েই এসেছিল।
হঠাৎ করেই নয়—ভেতরে ভেতরে রাজ অনেক আগেই মেহরিনের জন্য বদলে গিয়েছিল।
তার কবিতার ছত্রে ছত্রে একটাই নাম ফুটে উঠতো—
“সে”
আর এখন সেই “সে” মেহরিন হয়ে রক্ত-মাংসের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে গেছে তার মনের মঞ্চে।
রাজ জানতো না, সে কখন কবি হয়ে উঠেছে, শুধু জানতো—মেহরিনকে দেখার পর থেকেই শব্দেরা তার দিকে ছুটে আসে।
যে মেয়েটা হেসে চুল সরিয়ে দেয় কপাল থেকে, যে সমুদ্রের বালিতে বসে দুষ্টু বোনের সঙ্গে ঝগড়া করে, যে চোখ পলকে চেয়ে থাকে আকাশে—
সেই মেয়েটা এখন রাজের কবিতার আলো, নীরব প্রেরণা।
রাজ ভালোবেসেছে নিঃশব্দে।

তাকে না ছুঁয়ে, না জানিয়ে—
শুধু মনের সমস্ত জায়গা জুড়ে মেহরিনকে স্থান দিয়ে দিয়েছে।
তিনটা বছর…
রাজের জীবনের সবচেয়ে নীরব, অথচ সবচেয়ে উচ্চারিত ভালোবাসার সময়।
তিন বছর ধরে পাগলের মতো ভালোবেসেছে রাজ মেহরিনকে—
প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, প্রতিটি নিঃশ্বাসে কেবল মেহরিন।
সে ছিল না মেহরিনের কাছে, কিন্তু মেহরিন ছিল তার হৃদয়ের প্রতিটি কোণে।
রাজের দিন শুরু হতো মেহরিনকে একবার দেখার আশায়, আর দিন শেষ হতো তার মুখখানা মনে রেখে।
এক নজর দেখার জন্য রাজ কী না করত!
বইয়ের মাঝে মুখ লুকিয়ে লাইব্রেরির এক কোণে বসে থাকত,রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতো,শুধু যাতে মেহরিনকে চোখের আড়াল না করতে হয়।

বৃষ্টির দিনে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে থাকত রাস্তার ধারে, শুধু ওর ছায়া দেখার জন্য।
আর আশেপাশে যদি কেউ মেহরিনের দিকে বাড়িয়ে দিত একচিলতে আগ্রহ—
রাজ চুপিচুপি সরে যেতো না, বরং চুপচাপ সরিয়ে দিত তাদের।
দু একজন মানুষ সব সময় মেহরিন কে ফলো করে।
লেকপাড়ে যে কয়জন ছেলে মেহরিনকে বাজে কথা বলেছিল,
তাদেরকে একেক করে যেন বাতাসের মতো উড়িয়ে দিয়েছিল রাজ।
কেউ টেরও পায়নি—রাজ ওদের জীবনে কখন এসে কখন গলে গিয়ে গেছে।পরে ওদের লাশ পাওয়া যায় লেকের পানিতে।

আর সেই এক্সিডেন্টের দিন?
ঐদিন রাজ ছিল মালয়েশিয়াতে, মেহেরিনের এক্সিডেন্টের কথা শুনে পাগল হয়ে গেছিল প্রায়। সাথে সাথে ব্যাক করে বাংলাদেশ। যখন জানতে পারে মেহরুনের জন্য রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। তখন ওই দুটো মেয়েকে রাজ পাঠিয়েছিল মেহেরিনকে রক্ত দিতে।
রাজ ছিল মেহরিনের ছায়ার মতো—
সবসময় পাশে, অথচ চোখের আড়ালে।
নামহীন, দাবিহীন, কিন্তু ভালোবাসার প্রতিটি মানে রাজ বুঝে নিয়েছিল নিজের মতো করে।
মনে আছে সেই দিনটার কথা?
দিনটা ঝড়ের মতো এসেছিল। মেহরিনের এক্সিডেন্ট।
খবরটা পেয়েই রাজ ছুটে গিয়েছিল,
তবে নিজের পরিচয়ে নয়—
একজন ডাক্তার সেজে।
সাদা কোট, মুখে মাস্ক—
কেউ যেন তাকে চিনে না ফেলে।

হাসপাতালের শীতল বাতাসে সে চুপচাপ মেহরিনের পাশে বসেছিল।
তখন মেহরিন অচেতন, নিঃসাড়।
রাজ তার হাত দুটো ধরা অবস্থায় বসে ছিল অনেকক্ষণ।
তার বুকের গভীরে কেঁপে উঠেছিল এক নিঃশব্দ আকুতি—
আরেকটু যদি চোখ খুলে তাকাতে, যদি একটাবার আমায় দেখত…
কিন্তু রাজ জানত,
এই ভালোবাসা প্রমাণের জন্য শব্দের প্রয়োজন নেই,
প্রমাণের জন্য প্রয়োজন সময়ের।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসার পর রাজ আর একবারও মেসেজ করেনি,
একটাও কবিতা পাঠায়নি।
সে ইচ্ছে করেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল।

রাজ দেখতে চেয়েছিল—
মেহরিন কি আমায় ভুলে যাবে?
নাকি মনে রাখবে সেই কবি সাহেবকে,
যে কোনো দিন বলেওনি ভালোবাসি,
তবু নিঃশব্দে ভালোবেসে ফেলেছিল?
শিকদার বাড়ির রাত তখন গভীর। চারদিকে এক রকম নিরবতা নেমে এসেছে, শুধু ব্যালকনির এক কোণে রাজ আর মামনির কথোপকথন।
মামনি গভীর দৃষ্টিতে রাজের দিকে তাকিয়ে বললেন,
মেয়ে টা জানেই না, নিঃস্বার্থভাবে কতটা ভালবাসে ওকে কেউ…
এই যুগে এসেও কেউ এভাবে ভালোবাসে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসে কেউ ভাগ্যবতী নারী সে।
রাজ নিঃশব্দে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। যেন বুকের ভেতর জমে থাকা শত কথা একটা নিশ্বাসে ঝরে পড়লো।
ঠরাজ ঘুরে বলে উঠল,

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৬

মামনি… আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে, খেতে দাও।খেয়ে তোমার বৌমাকে দেখতে যাবো ম্যাডাম তো বন্ধুদের সাথে টুর দিয়ে আসলো।
মামনি মুচকি হেসে আদরের ভঙ্গিতে ওর চুলে হাত বুলিয়ে চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।
সেই রাতে, শিকদার বাড়ির বাতাসে ভেসে বেড়ায় রাজের অনকথিত ভালোবাসার গল্প,
আর এক মায়ের নিরব প্রার্থনা—
‘যেন সেই মেয়ে একদিন ঠিকই বুঝে নেয়, কতটা নিঃশব্দে ভালবেসে গেছে ওকে একজন কবি।’

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৮