মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৯

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৯
মির্জা সূচনা

ড্রোনটা ধীরে ধীরে মেহরিনের দিকে আরও কাছাকাছি আসছে। রাহি হঠাৎ মাথা তুলে ড্রোন দেখে চিৎকার করে উঠল,
আরে বাছ্! এটা আবার কে পাঠালো? কাকু? না মামা?
মেহরিন বলল,
নিশ্চয়ই পাশের বাসার বাসায় কেউ কিনেছে। কোন বাচ্চা হয়তো ভিডিও বানানোর জন্য কিনেছে, আহা কী কিউট ভিডিও হবে!
চুমকি হাসতে হাসতে বলে,

আহারে! কিউট ভিডিও নয় রে পাগলি, কারও নজর পড়ছে আমাদের বারান্দার উপর!
এদিকে ছাদে দাঁড়িয়ে রাজ ও লাবিবের মধ্যে আরেক রাউন্ড খুনসুটি চলছে।
লাবিব: ব্রো, আমি ডিসাইড করে ফেলছি। আমি তোমাকে আর ব্রো বলব না। এখন থেকে তুমি আমার ভবির জামাই!
রাজ: “তুই বাজে বকা বন্ধ করবি? কখন জানি ড্রোন নামিয়ে তোর চুলে বেঁধে দিই। সো বি কেয়ারফুল! রাগাস না আমায়।
লাবিব (অভিনয় করে মুখ চেপে): “আল্লাহ! ভাবির প্রেমে পড়ে রাজ সিকদার প্রেমিক পুরুষ হয়ে গেছে। আর আমার সাথে কেন রিনা খানের জামাইয়ের মত ব্যবহার why bro? আমার সাথে কথা বলার সময় কেন তুমি রিনা খানের মেল ভার্সন হয়ে যাও..!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওদিকে নরম আর এইদিকে গরম এটা কিন্তু জাতি মেনে নিবে না হ্যাঁ। আমি একটা জিনিস খেয়াল করছি তুমি ওই দিক এ শাবানা আর এই দিকটাই রিনা খানের মেল ভার্সন কেন হয়ে যাও?নিজেকে দেখিয়ে বলল!
রাজ: আর একটা উল্টাপাল্টা কথা যদি তুই বলিস? তবে মামনি কে তোর সিক্রেট ব্যাপারগুলো বলে দিবো।
লাবিব: ব্রো প্লিজ নো! এটার বদলে তো মশার কামড় খেয়ে চিৎপটাং হয়ে যাওয়া ভালো। এটা কিন্তু ঠিক না তুমি সবসময় আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করো।
আচ্ছা সব বাদ দাও।
ব্রো, একটা কথা বলি? ওভাবে কোমর দুলায়ে যদি মেহরিন ভাবির BCS পরীক্ষাও দিতে হয়, সোজা কাস্টমস অফিসার হয়ে যাবে। আর চুমকি আপুর তো অবস্থা আরও সিরিয়াস… কোমরে এমন রিদম আছে—চাইলে বিট বানিয়ে র‍্যাপ গান হিট করে দিতে পারবে!

রা:
Shut up, Labib.(চুপ কর, লাবিব।)
ব্রো আমি তো ****আর কিছু বলতে পারে না তার আগেই!
রাজ: One more word and I swear I’ll throw you off this rooftop!
(আর একটা কথা বললে কসম করছি তোকে এই ছাদ থেকে ফেলে দিবো!)
লাবিব নাটক করে বলে:
আল্লাহ রে! লাভ-ভাইরাসে ইনফেক্টেড রাজ শিকদার এখন ইংরেজি গ্রেনেড ছুঁড়তেছে! ভাই আমি তো মজা করলাম! কিন্তু ব্রো… সত্যি বলি, ভাবি যদি এখন হাত নাড়ায়,তুমি যে নিজেকে পাখি মনে করে ডানা ছাড়া উড়ে যাবে সেটা আমি জানি। অবশ্য লাভ ইফেক্টার তো অনেক গুন আছে তোমার পাখনা গজিয়ে যেতে পারে।
রাজ রেগে বলে:

just… leave.
Go feed the mosquitoes or jump into a pond or something.(যা গিয়ে মশাদের খাবার দে, অথবা কোনো পুকুরে লাফ দিয়ে পরে যা।)
লাবিব (হাসতে হাসতে):
“না ব্রো, আমি তো তোমার সাথে থাকতেই বেশি মজা পাই। প্রেমিকদের এই অস্থিরতা লাইভ দেখতে পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার!
রাজ (অবশেষে হালকা হাসে):

“Someday…মজার জন্য যদি তোর হাত পা ভেঙ্গে যায় বা তুই ছাদ থেকে পড়ে যাস, আমাকে দোষ দিবি না!
লাবিব চিৎকার দিয়ে বলল, নো ব্রো, তুমি এটা করতে পারো না আফটার-অল আমি তোমার একটা মাত্র ভাই।এখনো বিয়ে সাদী করি নাই! এক ডজন বাচ্চার বাবা ও হই নাই।আমি পঙ্গু হয়ে গেলে আমাকে কেউ বিয়ে করবে না।তখন আমার ডর্জন ডর্জন বাচ্চা জন্ম দেওয়ার কি হবে।
রাজ এবার হাতে থাকা কফির মুখটা ছুড়ে মারে। লাবিব সুযোগ সরে যায় তা না হলে এখনি একদম মাথা ফেটে আলুর দম হয়ে যেতো।

আকাশে হালকা রঙ ছড়িয়ে বিকেলের রোদ যেন একটুখানি স্বপ্ন নিয়ে বসে আছে। ছাদে সবাই গল্পে আড্ডায় মেতে উঠেছে। চা শেষ, খুনসুটি চলছে, এখনকার আড্ডায় মাহির ও ওদের সঙ্গে আছে।হঠাৎ মাহির গলা—
আচ্ছা নারীগণ!—তার স্বভাবসুলভ নাটকীয় ঢঙে বলে উঠল—”চলেন, একটা বাইসাইকেল রেস হয়ে যাক!নারীশক্তির লড়াই ওই যে একটা কথা আছে না যে নারী রাধে সে চুল বাধে !
তোমরা একেকজন তো একেবারে রুপে গুনে সেরা। শুধু রুপ আর গুন থাকলে হবে! মাঝে মধ্যে একটু প্রতিবাহ ও দেখাতে হয়। কি বলো হবে নাকি?
রাহী হেসে বলে, কী যে বলিস না তুই!
নুপুর এক লাফে উঠে দাঁড়ায়, “আমি তো রেডি!

চুমকি গম্ভীর গলায় বলে, তোর মতলব তো আমার ভালো লাগছে না রে মাহির।তুই তোর মাথায় কি খিচুড়ি পাকাচ্ছিস বলতো? আচ্ছা যাই হোক খিচুড়ি বানা আর বিরিয়ানি বানা ওইটা কথা না। কথা হল রুলস কী?
মাহির বলল, একদম সোজা রুলস—যে আগে পৌঁছাবে ও জিতবে। আর যে জিতবে, সে-ই সবাইকে ফুচকা খাওয়াবে।
সবাই ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ বলে উঠলো।মেহেরিন একটু ইতস্তত করলেও সবার জোরাজোরিতে শেষে বলল,ঠিক আছে।
কিন্তু এখন সাইকেল এতগুলো কোথায় পাবো ? মাহির বলল, টেনশন লেনে কা নেহি দেনে কা হে! মে হু’না । তোমরা প্রিপারেশন নাও আমি সাইকেল ম্যানেজ করছি ।
রাস্তায় পাঁচটা সাইকেল লাইন ধরে দাঁড়িয়ে। সবাই জুতা ঠিক করে, দড়ি দিয়ে স্টার্টিং লাইন টানা হলো। মাহির গলা
থ্রি… টু… ওয়ান… গো!
সাইকেলগুলো ছুটে চলল হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে। চুমকি একটু বাকা গলিতে গিয়ে আটকে গেল। নুপুর গ্যাসপ্যাঁচা খেয়ে পড়ে যেতে বাঁচল। মেহবুবা একটু সামনে গিয়ে থেমে গেল,আর সামনে ছুটছে মেহেরিন আর রাহি, হাসতে হাসতে…

রাস্তায় এখন শুধু বাইসাইকেলের চাকা আর হাসির শব্দ। সবাই অনেক আগেই ছিটকে পড়েছে—কেউ গাছের সঙ্গে, কেউ হাসতে হাসতে রাস্তার ধারে। কেবল দুটি সাইকেল একে অপরের গায়ে গায়ে লড়ছে—রাহি আর মেহেরিন।
রাহির মুখে দুষ্টু এক ঝিলিক, আপু, আমি হেরে গেলে তো তোমাকেই খাওয়াতে হবে ফুচকা!
মেহেরিন চোখ টিপে বলে, তাই বুঝি? তাহলে তোর জন্যই তো হারবো!
আসলে মেহেরিনের মনে আজ অদ্ভুত এক শান্তি—রাহির এমন আনন্দ দেখতে তার নিজের জেতার আর প্রয়োজন নেই। এক ফাঁকে হালকা ব্রেক কষে মেহেরিন একটু পিছিয়ে পড়ে। রাহি সেই সুযোগে ছুটে যায় ফিনিশিং লাইনের দিকে।

“ইয়াহু!”—রাহি চেঁচিয়ে ওঠে, সবার আগে গিয়ে দাঁড়ায়।
চুমকি, নুপুর, মাহির আর মেহবুবা ছুটে যায় রাহির দিকে, সবাই মিলে চিৎকার—
রাহি জিতেছে! এখন ফুচকা! এখন ফুচকা!
মেহেরিন ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় রাহির পাশে। রাহি তাকে জড়িয়ে ধরে, আপু, আমি জিতে গেছি! আমার জীবনের প্রথম রেস জেতা, জানো?
মেহেরিন হাসে, কপালে একটা আদর দেয়।
তোর হাসিটা দেখার জন্যই হারলাম, বোকা পাখি।
সবাই মিলে হামলা দিয়েছে স্টলে। প্লেটের পর প্লেট ফুচকা যাচ্ছে, টক জল যেন সব ক্লান্তি ধুয়ে নিচ্ছে। নুপুর মুখ ফুলিয়ে বলে,
আরেকটা রেস চাই!

মাহির বলে, “আসছে আমার রেস ওয়ালি, দেখলাম তো কেমন রেস করতে পারো,তোমার ভাগ্য ভালো যে উল্টে পাল্টে পরে যাওনি, যদি পড়ে যেতে তাহলে এখন আমরা ফুচকা খেতাম না তোমাকে নেওয়া হসপিটালে দৌড়াতাম।এখন রেস না, রেসিপি চাও! ফুচকার এমন স্বাদ আগে পাইনি!
নুপুর একটা ভিঞ্চি কাটে।
সবাই হেসে ওঠে। আর দূরে, ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা রাজ… ধীর পায়ে পেছন ঘোরে, মনে মনে ভাবে—
যার হাসিতে এমন জাদু, তাকে ভাল না বেসে থাকা যায়?
মূলত পুরোটা রেস রাজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছে। একটু দেখা পাওয়ার জন্যই তো এত কৌশল।

ফুচকার ঝাল-টক স্বাদে মুখ জ্বলে উঠলেও, সবার মুখে আজ প্রশান্তির হাসি। রাস্তায় ফিরতি পথেও হাসি, খুনসুটি, রাহি আর নুপুরের গানে সব মিলিয়ে যেন ছোটো এক উৎসব।
মেহেরিনদের বাড়িতে ফিরে সবাই জুতো খুলেই বসে পড়ে ড্রইং রুমে। চুমকি বলে, ফুচকা খেলাম, এখন চাই দুধ-চা!
মেহরিনার মা রান্নাঘর থেকে মাথা বের করে বলেন, “চা তো হবেই, তবে আগে একটু পানি খা, পেট পুরে ফুচকা খেয়ে এসেছো! কত করে বলি বাহিরের খাবার এত খাস না! শুনলে তো আমার কথা!কেউ যদি বলিস যে পেট ব্যথা করছে তখন দেখিস তার একদিন কি আমার একদিন।
ঠিক তখনই দরজার বেল বাজে।

রাহি ছুটে গিয়ে দরজা খোলে—রিদ দাঁড়িয়ে আছে স্মিত হাসি নিয়ে।
চলো, নুপুর, রাহি—নিয়ে যেতে এসেছি।
মেহবুব আর চুমকি একসাথে বলে, ভিতরে আসেন ভাইয়া।ওদের নিয়ে যাবেন ভালো কথা তাই বলে দরজা থেকে চলে যাবেন।
মেহেরিন এবার বলে ,ভিতরে আসেন ভাইয়া।
হৃদ মৃদু হেসে ঘরে ঢোকে। মেহেরিনার মা তাকে দেখে খুশি হয়ে বলেন,
আরে রিদ বাবা যে! কত ভালো লাগছে তোমাকে দেখে। কেমন আছো বাবা?
রিদ মাথা নিচু করে সালাম দেয়,

খুব ভালো আছি আন্টি। রাহি আর নুপুরকে নিয়ে যেতে এসেছিলাম, ভাবলাম আপনাদেরও একটু দেখে যাই।
রিদের কথা শুনে চুমকি মাহবুবার কানে কানে বলে, কত যে আমাদের দেখতে আসছে তা মনে হয় আর আমরা জানি না! দেখে তো আসছে মেহুকে!
মেহবুবা হেসে বলে, আস্তে বল চুমকি আপু, শুনে ফেলবে তো!
এটা বলে দুজনেই মিটিমিটি হাসে।
রিদ বললো, আন্টি ভালো থাকবেন আমি তাহলে রাহিয়ার নুপুরকে নিয়ে যাই ।
মেহেরিনার মা বলে উঠলেন,

— হ্যাঁ তা যাবে ভালো কথা,আজকে এতগুলো মেয়ে এল, আমার রান্নাও একটু বেশি হয়ে গেছে। আর মেহেরিন বলছিল, তুমিও তো বেশ ব্যস্ত থাকো, ঠিকমতো খাও না! আজ আর কোনো কথা না, তুমি আমাদের সাথেই ডিনার করবে।
তোমার আংকেল ও এখন চলে আসবে,এখনই তোমাকে দেখে খুব খুশি হবে।
রিদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। এমন আন্তরিক আহ্বানে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।
আর এদিকে রাহি, চুমকি, নুপুর এটা সেটা বলে মজা করছে মেহেরিনের সাথে, আর মেহরিন ওদের চোখ রাঙ্গানি দিচ্ছে।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা রাহি দম আটকে হাসি চেপে বলে,

— ভাইয়া না খেয়ে গেলে আন্টি আজকেই আমাদের বিয়ে দিয়ে দেবেন দেখছি!
মেহেরিনের মা হেসে বলেন,
— পাগলী, কী যে বলিস! রিদ আমার ছেলের মতোই, খাবে না?
রিদ মৃদু হেসে মাথা ঝুঁকায়।
তারপর রাহির দিকে তাকিয়ে বলে আজকালে খুব বেশি কথা বলছ রাহি তুমি। রাহি যেনো রিদের কথা শুনলোই না।
— ঠিক আছে আন্টি, আপনি যেহেতু বললেন, আজ খেয়েই যাব।
মেহেরিনের মা খুশিতে বলেন,

— “এই তো! ঠিক তাই হওয়া উচিত। মেহেরিন রিদকে চা দাও।
মেহেরিন কোনো কথা না বলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।
তখনই আবার কলিং বেল বেজে ওঠে। চুমকি বলে নিশ্চয়ই আঙ্কেল চলে আসছে! আমি খুলছি তোরা বস।চুমকি গিয়ে দরজা খুলে দেয় আসল কি কথাই ঠিক মেহরিনার বাবা এসেছে।
চুমকিকে দেখে এক গাল হাসে মেহরিনের বাবা।তারপর বলেন,আরে মামনি যে কেমন আছো আমার মামনিটা।
চুৃমকি হেসে ওনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,একদম ফিট অ্যান্ড ফাইন আছে আঙ্কেল। তুমি কেমন আছো।
ফিরোজ মির্জা ভিতরে ঢুকে বলেন, এইতো মা ভালোই আছি।
ভিতরের রিদকে দেখে অনেক খুশি হন ভদ্রলোক।রিদের সাথে কুশল বিনিময় করেন। তারপর রিদকে বসতে বলে ফ্রেশ হতে চলে যান।

মেহরিন বাবার গলা পেয়ে রিদ ও তার বাবার জন্য চা নিয়ে আসে সাথে কিছু স্নেক্স।
ফিরোজ মিজা ফ্রেশ হয়ে এসে বসে সবার সাথে। কিছুক্ষণ হাসি মজা করে সবাই ডিনার করতে বসে।
ডিনার শেষে কিছুক্ষণ আরও আড্ডা দিয়ে রিদ সবার থেকে বিদায় নিয়ে রাহি ও নুপুরকে নিয়ে চলে যায়।
চুমকি আজ বাড়ি যাইনি এটা নতুন কিছু নয় প্রায় প্রায় চুমকি মেহরিনদের বাড়িতেই থাকে সেই স্কুল লাইফ থেকে। বসে বসে গল্প করছে চুমকি আর মেহরিন। মেহবুবা ওর রুম এ পড়ছে,মাহির ওর মতো বেস্ত, ফিরোজ মির্জা আর মালিহা মির্জা হয়তো ঘুমিয়ে গেছেন।
রাত প্রায় বারোটা। শহরের কোলাহল থেকে দূরে একদম ফাঁকা, নির্জন রাস্তা। রাস্তার পাশে ঝোপঝাড়, মাঝখানে একটা চেয়ার। চেয়ারে বসে আছে রাজ—চুপচাপ, চোখে গাঢ় দৃষ্টি শিকার ধরার প্রত্যাশা। পাশে লাবিব, এক হাতে পানির বোতল, আরেক হাতে ফোন ঘাঁটছে।
লাবিব ফিসফিস করে বলল,

—ব্রো, এই রাস্তায় তো পাখিও উড়ে না…তুমি কি শিওর আমাদের শিকার এই রাস্তা দিয়ে যাবে?
রাজ গভীর গলায় বলল,
— চোখ খুলে থাকলেই সব দেখা যায় না,এ রাস্তাটা এত নির্জন বলেই এই রাস্তা দিয়েই যাবে আমাদের শিকার।
তাদের সামনে দিয়ে হঠাৎ একটা সাদা গাড়ি আসছে।চোখের পলক না ফেলে সামনের দিকেই তাকিয়ে থাকে। রাজ লাবিবকে চোখ টিপ দিয়ে বলে আমাদের শিকার কামিং।
গাড়িটা আচমকা ব্রেক কষে থেমে যায়। চালক জানালা খুলে রেগে চিৎকার করে উঠে,
— এই ভাই, রাস্তায় বসে আছেন কেন? আত্মহত্যার প্ল্যান নাকি? মরবেন ভালো কথা আমার বাড়ির সামনে এসে কেন করছেন ভাই।
লাবিব দ্রুত দৌড়ে গিয়ে বলে,

— না না ভাই, আত্মহত্যা না, নাটক চলছে… আরেকটু ধৈর্য ধরুন!
রাজ এখনো চেয়ারে বসে। বাতাস থমকে আছে যেন কারো অপেক্ষায়। লাবিব চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কিন্তু চোখে দুষ্টু এক চাহনি। হঠাৎ গাড়ির চালক জানালা খুলে তেড়ে আসে,
— ভাই, এই রাস্তার মাঝখানে বসে থাকেন কেন? মানুষ আপনি? রাস্তা কি আপনার বাপের?
লাবিব গলায় হাত দিয়ে বলে,
— এই যে, কথা কম বলেন ভাই… পেট্রোল শেষ না হলেও ধৈর্য শেষ হয়ে গেছে দেখছি! আর খবরদার বাপ তুলে কথা বলবেন না।
চালক রেগে গাড়ি থেকে নেমে আসে,চোখে রাগ। লাবিবও সামনে এগিয়ে গিয়ে তার সাথে তর্কে লিপ্ত হয়। গলার স্বর চড়া হয়ে ওঠে দুইজনের।

— তুই আমার সাথে তর্ক করবি? তোর বয়স কত রে!
— বয়সে না, বুঝে খেলেন ভাই, আমি কিন্তু এইট্টিন প্লাস পেয়ে গেছি সেই কবেই! আপনি জানেন আমার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে বিয়ে করলে এতদিন আমার ১০-১৫ হলি বাচ্চা থাকতো।
জগড়াটা বাড়তে থাকে, কিন্তু এদিকে রাজ চুপচাপ। তার চোখ শুধু গাড়ির পেছনের সিটের দিকে।
হঠাৎ… দরজার শব্দ।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে একটা লোক বয়স হবে হয়তো পঞ্চাশের কাছাকাছি। মুখে এখনো বয়সের ছাপ পড়েনি এখানো।
তারপর পরনে ফরমাল ড্রেসআপ।

লোকটা গাড়ি থেকে নেমে রাজের সামনে দাঁড়ানোর মুহূর্তেই একটা অস্বস্তি খেলে যায় তার চোখে মুখে। কার সাথে জানি রাজের চেহারার অনেক মিল খুঁজে পাচ্ছে লোকটা। লোকটা যখন নিজের ভাবনায় বিভোর তখন হঠাৎ রাজ মাথা একটু কাত করে ঠাণ্ডা গলায় বলে—
— Hi, driver uncle…
শব্দটা যেন কোনো দূর অতীত থেকে উঠে আসে। লোকটার শরীর হঠাৎ হিম হয়ে যায়। তার গলার কাছে শব্দটা আটকে থাকে। চোখ দুটো বড় হয়ে ওঠে… কাঁপতে শুরু করে ঠোঁট।
সে ধীরে ধীরে ফিসফিসিয়ে বলে—

— রা… রাজ…বা..বাবা? না না… এ কী..করে হতে পারে …
তার ঠোঁট কাঁপে, কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে —
— এই নাম তো শুধু… এ..একজন ডাকত… যাকে… আমি…
তার পা হঠাৎই দুর্বল হয়ে যায়, হাত-পা কাঁপে, পিছিয়ে যেতে চায়… কিন্তু তখনই রাজ এগিয়ে আসে এক ধীর অথচ নিশ্চিত ভঙ্গিতে। তার চোখ জ্বলছে যেন দীর্ঘদিনের জমে থাকা প্রতিশোধের আগুনে।
রাজ ঠোঁটে অদ্ভুত এক ঠাণ্ডা হাসি এনে ধীরে ধীরে বলে—
— ভাবছিলাম মনে থাকবে না। ভুলে গেছো ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখো, শুধু নামটাই তো বললাম আর তুমি চিনে ফেললে …

লোকটা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় মাটিতে। রাজ নিচু হয়ে তার কানে ফিসফিস করে বলে—
— আজ থেকে আমার দিন শুরু। একে একে পই পই করে সবকিছু হিসাব নিবো। ১৮ বছরের হিসাব নেওয়া এখনো বাকি।
তারপর ইশারা করতেই লাবিব সামনে আসে। দু’জনে মিলে নিঃশব্দে তুলে নেয় লোকটিকে।
গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলে ধীরে ধীরে ভেতরে রাখে।
লোকটার নিঃসাড় শরীরটা যেন অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যায়।
রাজ সেদিকে তাকিয়ে স্রেফ একটা বাক্য বলে—চলো, এবার গোপন জায়গায় নিয়ে যাই… ওর অনেক কিছু মনে করিয়ে দেওয়ার আছে।

রাজ লাবিবকে জিজ্ঞেস করে, ওই রাস্কেলটাকে কি করেছিস?
লাবিব একটা ডেভিল হাসি দিয়ে বলল,আমার বাপ নিয়ে কথা বলছিল ব্রো! তাই ওকে একটু আমার বাপের সাথে সাক্ষাৎ করার সুযোগ করে দিলাম।
লাবিবের কথা শুনে রাজ উচ্চ হেসে উঠে লাবিব ও যোগ দেয় সেই হাসিতে।
লাবিব হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলে, আমি ওদের কাউকে ছাড়বো না ব্রো!যাদের জন্য আমাদের ছেলেবেলাটা নষ্ট হয়ে গেল।যাদের জন্য আমাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে।যাদের জন্য পাপা,ভাইয়া, ফুপ্পি, ফুপা, আমাদের পুচকি কে হারাতে হয়েছে।কাউকে ছাড়বা না কাউকে না।
রাজ লাবিবের পিঠে হাত দিয়ে বলে, কুল ডাউন কাউকে ছাড়বো না।প্রত্যেকটা কে খুজে বের করব।আমরা ওদের জন্য দেশ ছেড়েছিলাম কিন্তু ওরা দেশ ছাড়তে পারবে না ওই রাস্তা আমি বন্ধ করে দিবো। ওরা পাতালে লোকাক বা আকাশে বের তো আমি করবই।

রাজা আর লাবিব দুজনের চোখেই প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে।
মেহরিন আর চুমকি অনেকক্ষণ গল্প করতে করতে দুই বান্ধবী ঘুমিয়ে যায়। অবশ্য ঘুমানোর আগে বেশ কয়েকবার ফোন চেক করেছে মেহরিন। কবি সাহেব কোন মেসেজ দিল কিনা কিন্তু না আজ কবি সাহেবের কোন মেসেজ আসে নি। কি আর করার চুমকির সাথে বকবক করতে করতেই ঘুমিয়ে গেছে মেহরিন।
রাত প্রায় দুইটা। চারপাশে নীরবতা এমন জমাট বেঁধেছে, যেন কেউ শব্দ করলেই সবকিছু চমকে উঠবে। ঘরের আলো নিভে গেছে অনেক আগেই, শুধু রাহির রুমের হালকা টেবিলল্যাম্পটা জ্বলছে ম্লান আলোয়। বিছানায় আধশোয়া হয়ে রাহি ফোন স্ক্রল করছে— ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব— এই অ্যাপ থেকে ওই অ্যাপে ঘুরপাক খাচ্ছে আঙুল, আর চোখ জুড়ে একরাশ অলসতা।
হঠাৎ করেই রুমের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। একটু চমকে উঠে রাহি বলে, কে?
বাইরে থেকে শান্ত গলা ভেসে আসে—

— মা, আমি… তোমার আব্বু।
রাহি সাথে সাথেই সোজা হয়ে বসে।
— আসছি বাবা, বলে সে দরজাটা খুলে দেয়।
রেদওয়ান তালুকদার, গম্ভীর কিন্তু সদা হাস্যোজ্জ্বল একজন মানুষ, মুখে ক্লান্তি আর মায়া মেশানো হাসি নিয়ে ঢুকে আসেন। হাতে ধরা একটা ফাইল থেকে একটা পাতলা কাগজ বের করেন।
— মা, একটা সাইন করে দাও তো।

রাহি চোখের পাতা মেলেই তাকায়, কিছু না বলেই কাগজটা হাতে নেয়। সে জানে— বাবার ব্যবসার নানারকম কাগজপত্রে তার মাঝে মাঝেই সই দরকার হয়। কোনটা কোন কাজে লাগে, সে জানে না, জানার চেষ্টা করে না। তার আব্বু যখন বলেন “সাইন করো”, তখন সেখানে কোনো প্রশ্ন করে না।
কালো পেনটা তুলে নেয়, নিঃশব্দে কাগজে নিজের নামটা লিখে ফেলে—
“Rahi”

একটা আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে, রাহির বাবা যখন তাকে কোন কাগজের সাইন করতে বলে তখন ওখানে শুধু রাহি লিখে।এর কারণটা আজও জানে না রাহি। বেশ কয়েকবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু বাবা বলেছে শুধু রাহি লিখলেই হবে তালুকদার লিখতে হবে না। কোন কথা বলে না। সাইন শেষ এ বাবা খুশি মনে কাগজটা আবার ফাইলে ভরে নেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন—

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৮

— ভালো থাকিস মা, তোর সইটা আমার জন্য অনেক টা আশীর্বাদের মতো কাজ করে।
রাহি একটু হেসে বলে—
—তোমার জন্য তো সবই করতে পারি আমি বাবা। একটা সই আর এমন কি?
মুচকি হেসে বাবা চলে গেলে রাহি আবার বিছানায় ফিরে আসে।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২০