মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২০

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২০
মির্জা সূচনা

ঘরটা নিঃস্তব্ধ। বাতাসে হালকা একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। চারদিকে অন্ধকার এমনই গা ছমছমে যে মনে হয় যেন আলো নিজেই ভয়ে পালিয়ে গেছে। একটা টিমটিমে বাল্ব ছাদের কোণায় ঝুলে, কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকারের বুক চিরে ফেলছে সামান্য আলো।
চেয়ারটার সঙ্গে হাত-পা শক্ত করে বাঁধা একজন লোক। মুখটা আধো আলো-আঁধারিতে স্পষ্ট নয়, কিন্তু কপাল জুড়ে ঘাম, ঠোঁট কাঁপছে। চোখদুটো ভয় আর অনিশ্চয়তায় ছলছল করছে। মাঝে মাঝে দরজার ওপাশ থেকে জুতোর শব্দ আসে— ঠক, ঠক, ঠক…

একটা ভারী দরজা ধীরে ধীরে কড়মড় শব্দ তুলে খুলে যায়।
ভেতরে ঢোকে দুটো ছায়ামূর্তি। একজন সোজা লোকটার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখে হালকা হাসি—
প্রথম থেকে রাজ।
এইবার রাজের পাশে এসে দাঁড়ায় লাবিব। মুখে ঠাণ্ডা এক চাপা হাসি, হাতে একটা ব্যাগ। শব্দ না করে সে সেই ব্যাগটা উল্টে দেয় সামনের টেবিলে।
টেবিলের ওপর গড়িয়ে পড়ে—
ছোট ছোট কিছু ছুরি, রড,হাতুড়ি, কিছু তার, কিছু ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি আর মোটা দড়ি।
লোকটা চোখ বড় বড় করে তাকায়, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে।
কী ভাবছো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

লাবিব ফিসফিস করে, যেনো কোনো বন্ধুকে দুষ্টুমি করতে আসা ছেলের মতো—
এসব খেলনার জন্য তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তাই না আঙ্কেল?তোমার কলিজা টা তো অনেক বড়! এসব খেলনা দেখি ভয় কেনো পাচ্ছো it’s not fair.. এমন করলে কিন্তু আমি খেলব না।
লোকটা তখন রীতিমতো কাঁপছে। সে রাজের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
আমাকে কেন এখানে নিয়ে এসেছো…
রাজ বাবা… বিশ্বাস করো, আমি… আমি কিছু করিনি।
রাজ ধীরে ধীরে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখটা অন্ধকারে থাকলেও চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলছে। ঠান্ডা কণ্ঠে কৌতুকের সঙ্গে বলে,
একি একি তুমি ভয় পাচ্ছো কেন ড্রাইভার আংকেল! আমি কি বলেছি যে তুমি কিছু করেছো। ব্যাপারটা এমন হয়ে গেলো না আমি বললাম ঠাকুর ঘরে কে রে? আর তুমি বললে আমি তো কলা খাইনি।
লোকটা এবার আর বেশি ঘাবড়ে গেলো!বুঝে গেছে তার আর বাঁচার পথ নেই।তাও নিজেকে বাজানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

রাজ:জানো, আমি কখনো গায়ে হাত তুলতে চাই না। কিন্তু কিছু ব্যথা না পেলে, কিছু সত্যি মুখ ফুটে বের হয় না।এটা বলেই টেবিলের উপর লোকটার হাতে রেখে হাতুড়ি দিয়ে জোরে একটা বাড়ি দিলো।
লোকটা সজরে চিৎকার করে উঠলো ব্যথায় কুকরাতে কুঁকড়াতে কাঁদতে শুরু করে, “আমি বলব! সব বলব! শুধু আমায় মারো না… প্লিজ!
লাবিব নিঃশব্দে একটা ছুরি নিয়ে হাতে ঘোরাতে থাকে। হঠাৎ থেমে রাজের দিকে তাকিয়ে বলে,
ব্রো এর এই মেয়ে মানুষের মত কান্নাকাটি আমার ভালো লাগছে না, শুরু করি?
রাজ ঠাণ্ডা গলায় বলল,
“না, আগে বলুক— কে তাকে পাঠিয়েছিল। কার অর্ডারে সে গিয়েছিল সেই রাতে… সেই নির্মমতার পিছনে কি এমন ছিলো।

লোকটা হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে,
তারা আমাকে অনেকগুলো টাকার অফার করেছিল।
রাজ ধীরে ধীরে তার মুখের সামনে এসে দাঁড়ায়।
তুই ভুল করেছিলি। আজ তোর কণ্ঠ দিয়েই বের হবে সব— নাম, ঘটনা, প্ল্যান— সবকিছু। নইলে… এই ঘর তো নিঃশব্দেই গিলে ফেলতে পারে মানুষকে।
এক মুহূর্তে ঘরের নিস্তব্ধতা গা ছমছমে হয়ে ওঠে।
লাবিব হাসে,

ভুল জায়গায় ভুল খেলাটা খেলেছো আঙ্কেল। এখন সেই ভুলের মাশুল দিতে হবে।
অন্ধকার ঘরের বাতি টিমটিম করে জ্বলছে। বাতাসে এক অদৃশ্য চাপা উত্তেজনা। কাঠের চেয়ারে বাঁধা লোকটা কাঁপছে। চোখের সামনে রাজ দাঁড়িয়ে, চোখে আগুন আর ঠোঁটে এক চাপা রাগ।
লোকটা ভেঙে পড়ে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে—
“আমি… আমি নিরুপায় ছিলাম, রাজ বাবা। আমি তো গরিব মানুষ, নুন আনতে পান্তা ফুরায়। একজন ড্রাইভার এর বেতনের কতই থাকে,ওগুলো দিয়ে আমার সংসার চলছিল না।আমার বাচ্চার ওষুধ কেনার টাকাটাও ছিল না। তখন ওরা… ওরা আমায় অনেক টাকা অফার করলো। বলল, শুধু একটা কাজ করতে হবে— কিছু ফাইল সরাতে হবে, কিছু তথ্য ওদের দিতে হবে। আমি লোভে পড়ে গিয়েছিলাম। জানতাম ভুল, কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম।
রাজ একটু নত হয়ে, লোকটার চোখে চোখ রাখে।
কণ্ঠটা ঠান্ডা, কিন্তু তীব্র—

তুমি যদি আমার বাবাকে বলতে… যদি শুধু একটা বারও বলতে, তিনি কি তোমার পাশে দাঁড়াতেন না? তুমি জানো না, আমার বাবা কতোটা হৃদয়বান মানুষ ছিলেন? না খেতে পেয়ে যখন মরে যাচ্ছিলে! আমার বাবাই তোমাকে একটা চাকরি দিয়েছিলো। সংসার চালানোর একটা উপায় দিয়েছিলো আর তুমি কিনা আমার বাবার ছি***
লোকটা মাথা নিচু করে ফেলে।
রাজ ধীরে ধীরে বলে যায়—
আমার বাবার খেয়ে, তাঁর ছায়ায় বেঁচে থেকে… সেই মানুষটার পেছনে তুমি ছুরি চালালে। টাকা নিয়েই তোমার বিবেক বিকিয়ে দিলে! বিশ্বাসঘাতকতা করেছো,মানুষের সাথে যে তোমাকে বেঁচে থাকার পথ দেখিয়েছিলো।
লোকটা কেঁদে ফেলে, মুখ লুকায় কাঁধে।
আমি দোষী, রাজ বাবা। আমি জানি আমার ক্ষমা নেই। কিন্তু আমি… আমি তখন শুধু নিজের পরিবারের কথা ভাবছিলাম।

রাজ পিছিয়ে যায়, মুখে এক রকম ঘৃণা ও দুঃখ মিশ্রিত অভিব্যক্তি।
তোমার ওই ‘নিজের পরিবার’ আজও ঠিকই আছে। কিন্তু আমারটা লাবিবের টা? আমার বাবা, আমার মা, এখন কি আমার ওই ছোট পুচকি বোনটাও আজ নেই। লাবিব ওর বাবা ওর ভাই, আমি শুধু জানতে চায়, কেন ওরা এমনটা করল! শুধুই কি আমার বাবার সম্পত্তি নাকি এর পিছনে আরো কোন কারণ ছিলো।
একটা স্তব্ধতা নেমে আসে ঘরে। ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে যায়।
লোকটা ফিসফিস করে উঠে,
হিংসা, লোভ আরে না পাওয়া ভালোবাসার জন্য।
রাজ সামনে এসে ঠাণ্ডা গলায় বলে—
মানে..?
লোকটা চোখ তুলে চাইল, আর বলল—

তোমার বাবা—একজন মহান মানুষ ছিলো, দরিদ্রদের পাশে দাঁড়াতো ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতো, ওনার উদারতার জন্য আল্লাহ হয়তো উনাকে দুহাত ভরে দিয়েছেন। খুব ভালো স্টুডেন্টও ছিল সফল তাই টিচাররা এবং আশেপাশের মানুষ সবাই অনেক অনেক ভালোবাসতো। এক বটবৃক্ষ ছিলো ওনি।কলেজ লাইফে পরিচয় হয় তোমার মার সাথে তোমার বাবার প্রথমে ভালো বন্ধুত্ব তারপর গড়ে উঠে প্রেমের সম্পর্ক।তোমার বাবার আরো দুজন বন্ধু ছিল।যারা সবকিছু জানত তারা উপরে উপরে ভালো দেখালেও ভিতরে ভিতরে তোমার বাবার সাফল্য তার মেনে নিতে পারেনি। আর তোমার মাকে— ভালোবাসত আরও একজন… কিন্তু সে কখনো সাহস করেনি বলতে। কেননা তোমার মা ভালোবেসেছিল তোমার বাবাকে, বিয়ে করেছিল তাকে। আর সে ছিল তোমার বাবারই খুব প্রিয় বন্ধু।
রাজ স্তব্ধ হয়ে যায়। লোকটার গলায় তখন অদ্ভুত এক ঘৃণা-আবেগের মিশ্রণ।

সে মানতে পারেনি, যে নারী কে সে পাগলের মতো ভালোবেসেছে, সে অন্য কারো ঘরণী হয়েছে। সে হেরে গিয়েছিল। এরপর তোমার বাবার সাফল্য, সুখী পরিবার, সন্তানদের ভালোবাসা… সব যেনো তার চোখে ঘৃণার আগুন হয়ে জ্বলতে থাকে।আর তার সঙ্গ দেয় তোমার বাবার আরেক বন্ধু।
লোকটা একটু থেমে বলে,

তোমার বাবাকে ধ্বংস করাটাই ছিল তার প্রতিশোধ। সেই প্রতিশোধের প্ল্যানেই যদি কোনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি আর আরও অনেকে,জন্য প্রত্যেকটা মানুষই আমার মত দরিদ্র ছিল তার টাকার জন্য করেছে সব। তোমার পরিবারকে ভেঙে দেওয়ার জন্য আর সব সম্পত্তি ও তাদের দখলে নেওয়ার জন্য তারা এই খেলায় মেতেছিল।
রাজ দাঁড়িয়ে, নিঃশব্দে শোনে। হৃদয়টা যেন ধীরে ধীরে জমে বরফ হয়ে যাচ্ছে।
“তোমার মা ছিলেন সেই আগুন, যাকে সে কোনোদিন ছুঁতে পারেনি। তোমার বাবার নাম ছিল সেই পাহাড়, যেটা সে কোনোদিন টপকাতে পারেনি। আর তুমি—তুমি যে বেঁচে আছো সেটা তো ওরা হয়তো জানি না ওরা ভেবেছিল সেই ধ্বংসস্তূপে তুমিও মারা গেছো।
রাজের দাঁত কিড়মিড় করে উঠল। সে জানে—এই গল্প এখনো শেষ হয়নি। সত্যি যত বেরিয়ে আসছে, ততই শেকড়ে নাড়া দিচ্ছে সব কিছু।

অন্ধকার ঘরের ভেতর বাতি নিঃশব্দে দুলছে। চেয়ারে বাঁধা লোকটার মুখ ঘামে ভিজে। রাজ শিকদার আর লাবিব— দুই চোখে আগুন, সামনে দাঁড়িয়ে। এই কথাগুলো শুনে যেনো ওদের ভিতরে প্রতিশোদের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো।
রাজ ঠান্ডা কণ্ঠে বলে ওঠে,
তোর কাছে কিছু জানতে চাইবো না। তোকে বিশ্বাস করি না। শুধু একটা জিনিস বল— আমার ছোট বোনটা কোথায়?
লোকটা কেঁপে কেঁপে উঠে। তার চোখে ভয়, কণ্ঠে হাহাকার।
“রাজ বাবা… আমি জানি না। আমি সত্যিই জানি না। আমি শুধু মামনি ম্যাডামকে নিয়ে ওদের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। তারপর কি হয়েছে, আমি জানি না। তারা শুধু বলেছিল… মামনি ম্যাডামকে যেনো ওদের কাছে দিয়ে আসি আর আমিও তাই করেছি।

চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা লাবিব হঠাৎ রাগে বিস্ফোরণ ঘটে। এক ঝাঁপে সামনে গিয়ে এক লাথিতে লোকটাকে চেয়ারে ফেলে দেয়।
তুই কি মানুষ? একটা দুধের বাচ্চাকে ওমন জালিমদের হাতে তুলে দিতে তোর বিবেকে একটুও বাধলো না? – গর্জে ওঠে লাবিব।
লোকটা মাটিতে পড়ে কাঁপতে কাঁপতে কাঁদে।
আমার নিজের ছেলেমেয়েও আছে… আমি জানি, আমি ভুল করেছি… কিন্তু ওরা বলেছিল না করলে আমার বউ বাচ্চাকপ মেরে ফেলবে… আমি ভয় পেয়েছিলাম… আমি তখন…
রাজ সামনে গিয়ে নিচু হয়ে বলে—

তুই ভয় পেয়েছিলি? তোর ভয়ের কারণে আমার বোন আজ কোথায় তা আমি জানি না?যদি ওর একটা আঁচড়ও দেখি… তাহলে তুই যে পরিবারের জন্য আমার পরিবারকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছিলি, সেই পরিবারকে আমি নিজ হাতে ধ্বংস করবো।ওদের ছায়াটাও খুঁজে পাবি না।
ঘরের বাতাস ভারি হয়ে যায়। একটা ভয়াল নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে।
সকাল দশটা। শহরের এক শান্ত, কোণঠাসা ক্যাফেতে বসে আছে মেহরিন আর চুমকি। জানালার পাশে বসে কফির মগ হাতে চুমকি বলল,

রাহি কই? সময় দিলে তো ঠিক দশটায়, এখনো নাম গন্ধ নেই।
মেহরিন হাসল, ওকে চিনিস না তুই? ও আসবে নিজের টাইমে, ঘড়ির টাইমে না!
মিনিট দশেক পরেই কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে রাহি—চিরচেনা চঞ্চলতা আর প্রাণবন্ত হাসি নিয়ে। ওর পাশে আরও এক জন—মিলি তালুকদার।
মেহরিন আর চুমকি চমকে ওঠে,
আরে মিলি আপু!তুমি এখানে হোয়াট এ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ।
রাহি হাত তুলে বলে, আমার কিন্তু আজকে বের হওয়ার কোন প্ল্যান ছিল না! মিলি আপু বলল তোমাদের সাথে দেখা করতে চাই তাই এই ক্যাফেতে দেখা করতে বললাম।
সবাই কুশল বিনিময় করে হালকা গল্পে মেতে ওঠে। ক্যাফের আলো-ছায়ার মাঝে যেন একটা ঘরোয়া, আপন পরিবেশ তৈরি হয়।

হঠাৎ মিলি ব্যাগ থেকে একগুচ্ছ কার্ড বের করে বলে,
এই জন্যেই আজ আসা, এই কার্ডটা তোমাদের দিতে এসেছি।
চুমকি আর মেহরিন হাতে তুলে নেয় গোল্ডেন এমবসড কার্ড—তার ওপরে হালকা গোলাপি ফুল আর ঝিলমিল ডিজাইন, মাঝখানে সুন্দর করে লেখা—
বর কনের নামের জায়গায়,
“মিলি তালুকদার ও শাফিন রহমান”
মেহরিন চোখ বড় করে বলে,
আপু, তুমি বিয়ে করছো!
চুমকি তো থ হয়ে গিয়ে বলে, মানে, সত্যি সত্যি?
মিলি হেসে মাথা নেড়ে বলে,

হ্যাঁ রে বাবা সত্যি। হচ্ছে, পরের মাসেই। আজ অফিসিয়ালি কার্ড দিলাম। তোমাদের কিন্তু অবশ্যই আসতে হবে। শুধু আসলেই হবে না, মেহেন্দি থেকে শুরু করে রিসেপশন পর্যন্ত প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে অ্যাটেন্ড থাকা চাই। নাইলে কিন্তু আমি খুব রাগ করব।
রাহি গলা ফাটিয়ে বলে,
“আর আমাকে Bridesmaid বানাবে কিনা, আগে সেটা বলো!”
চারদিকে হাসির রোল পড়ে যায়।
মেহরিন কার্ডটা ধরে বলে,
এই কার্ডটা শুধু নিমন্ত্রণ না, এটা একটা নতুন জীবনের শুরু—আর তার সাক্ষী হতে পারা আমাদের জন্য গর্বের ব্যাপার আপু।

মিলির চোখে তখন আনন্দ আর খানিকটা নরম আলো।
আলো-ছায়ার ভেতর এক কাপ কফির ধোঁয়া উঠছে, আর তার মাঝেই চারজন মেয়ের জীবনের এক চিরস্মরণীয় দিন তৈরি হয়ে যাচ্ছে—যেখানে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা আর এক নতুন অধ্যায়ের শুরু মিলেমিশে একাকার।
মাথার উপরে রোদ তার নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে যাচ্ছে,
রাজ আর লাবিব ঘেমে নেয়ে একাকার, ছোট একটা গলি পেরিয়ে ঢুকলো এক পুরনো বাড়ির ভেতরে। দু’জনের হাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ, নতুন জামাকাপড় আর কিছু খাবার। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু দুটো মেয়ের হাসি কানে আসে দূর থেকে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন এক ভদ্র মহিলা—মাথায় হালকা ওড়না, মুখে শান্ত একটা অভিব্যক্তি। রাজ আর লাবিবকে দেখে তার চোখ যেন জ্বলে উঠলো অদ্ভুত আনন্দে।
তোমটা আসছো রাজ বাবা, লাবিব বাবা… কেমন আছো তোমরা রুপা আপা কেমন আছে?
তার গলায় ছিল নিঃস্ব অথচ গর্বিত এক স্নেহের স্পর্শ।
লাবিব একগাল হেসে ব্যাগগুলো রেখে বলল,
“আমরা ভালো খালা আর আম্মু ও ভালো আছে। আপনাদের জন্যই তো বেঁচে আছি এখনও। কিছু জিনিসপত্র এনেছি, দেখেন তো ভালো লাগে কিনা।

রাজ হেঁটে এসে তার হাতের ওপর ব্যাগগুলো রাখে।
এই কটা জামা আপনার আর -আমাদের বোনদের জন্য। আর এখানে মাছ, মাংস, চাল-ডাল… যতটুকু পেরেছি এনেছি।আপনাকে কতবার বলেছি কোন কিছু প্রয়োজন হলে অবশ্যই! আমাদেরকে জানাবেন আমরা তো আপনার ছেলের মতই।
ভদ্রমহিলা—নাছিমা বেগম। সিকদার বাড়ির পুরোনো দারোয়ান জব্বার সাহেবের স্ত্রী। সেদিন রাতে, ওই নির্মম ও ধ্বংসকারীদের হাত থেকে জব্বার সাহেবই বাচিয়েছিল।রাজ লাবিব আর রুপা বেগমকে। ওদের বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণটা বাঁচাতে পারেনি। নিজের জীবন দিয়ে ওদের বাঁচিয়ে গেছে। জব্বার সাহেবের জন্যই আজ লাবিব রাজ বেচে আছে।

রাজ একদিন বলেছিল,
খালা, আপনি আমাদের সাথে আমাদের বাড়িতে চলুন। এখানে কষ্ট করে হবে?
নাছিমা বেগম সেদিন যা বলেছিল, আজও তা ভুলে যায়নি কেউ—
“এই ঘরে আমার সামীর নিঃশ্বাস আছে রাজ বাবা। যেদিন শেষবারের মতো হাত ছুঁয়ে বলল—আমি মরে গেলে আমার মেয়ে দুটোকে দেখে রেখো,আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি বিবি জান। আমাকে মাফ করে দিও তোমাদেরকে সুন্দর জীবন দিতে পারল না —সেই হাতের উষ্ণতা এখনও বালিশে লেগে আছে। আমি মরলেও এই ঘর ছাড়বো না।এই ঘরে যে তার ছোঁয়া আছে, কত সুন্দর স্মৃতি আছে আমাদের।
আজও তিনি রয়ে গেছেন সেই ছোট্ট ঘরে। দরজার বাঁ পাশে একটা ফ্রেমে জব্বার সাহেবের হাসিমুখ। প্রতিদিন ঝেড়ে-মুছে রাখেন।

লাবিব ধীরে এসে বারান্দার মাটিতে বসে বলে,
খালা, আমরা কিন্তু প্রতি মাসে আসবো। আপনি কিছু না বললেও আমরা আসবোই। এটা আমাদের দায়িত্ব না… আমাদের সৌভাগ্য।
নাছিমা বেগম কাঁপা হাতে দুজনের মাথায় হাত রাখেন। তার চোখে জলের দাগ, কিন্তু মুখে প্রশান্তি—
তোদের দেখলে আমার ওনাকেই দেখি… ও যে বলত—এই দুই ছেলেটা ভীষণ ভালো। আজ প্রমাণ পাই…
বাড়িটার টা প্রথমে ভাঙা থাকলেও এখন বাড়িটি বসবাস করার জন্য উপযুক্ত । রাজ যখন প্রথম বাংলাদেশে আসে এসেই খোঁজ করেছিল নাছিমা বেগমের। তারপর থেকেই নাছিমা বেগমদের যাবতীয় সব দায়িত্ব কাজে তুলে নেয়। নাছিমা বেগমের দুই মেয়ের পড়াশোনার দায়িত্ব ওদের সংসারের দায়িত্ব সব রাজ লাবিব দেখে।

২২ তারিখ সকালটা ছিল অদ্ভুত রকমের উচ্ছ্বাসে ভরা। মেহরিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে সবার ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত। আজ যে ওদের যাত্রা—ফুপি আর ফুপুর বিবাহবার্ষিকী। 30 বছর আগের এই দিনেই হাত ধরেছিলেন তারা, ভালোবাসার সাদা-কালো রঙ ছাপিয়ে একসাথে রংধনুর পথে হাঁটার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
চুমকি তো আগের রাতেই মেহরিনের বাসায় চলে এসেছিল। চুমকির বাবার কোন বোন নেই সেই সুবাদে চুমকি কোন ফুপ্পি ও নেয়।তবে মেহরিনার ফুপি চুমকিকে খুব আদর করেন সেই ছোটবেলা থেকে চুমকি আর মেহেরিন একসাথে কিনা। সেই খাতিরে চুমকিকে সবাই মেহেরিনদের পরিবারের একজনই মনে করে।ওট উৎসাহ ছিল যেনো নিজের বিবাহবার্ষিকী! বারবার বলছিল,
গ্রামের বাতাসেই যেনো আলাদা প্রেম আছে, ফুপিকে আজ ঠিক জিজ্ঞেস করব—ফুপ্পির প্রথম প্রেমের গল্পটা!
মেহরিন হেসে বলেছিল,

তোর যা খুশি জিজ্ঞেস করিস মেরি মা এখন আমার মাথা খাইস না।
সবাই রেডি বের হওয়ার আগে চুমকি বলল, এই দাঁড়াও আসল কাজেই তো ভুলে গেলাম। সবাই চুমকি দেখে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকায়।চুমকি একটা কেবলা হাসি দিয়ে বলে, আরে বাবা সবাই মিলে এত সেজেগুজে যাচ্ছি একটা সেলফি তুলবে না। কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে। এরপর সবাই একটা… দুইটা… তিনটা… সেলফি তুলে নিলো।
পরিবারের সবাই যাচ্ছে এই ভ্রমণে। মেহবুবা ছুটি নিয়েছে কলেজ থেকে, মাহির ক্যামেরা ঝুলিয়ে বলে,
এই ট্রিপে আমি অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার!
মনে মনে বলে, একটা ছবিও যদি মিস যায় একজন তো আমার গর্দান নিয়ে নেবে।
মেহরিনের মা মালিহা মির্জা হাসতে হাসতে বলে,

আর আমি হলাম আনঅফিসিয়াল তত্ত্বাবধায়ক, কেউ যেন খালি পেটে না থাকে!
একটা ছোট্ট মাইক্রোবাসে, খানিকটা ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের মত করে সবাই গাদাগাদি করে বসেছে। হাওয়া, হাসি আর টুকটাক ঝগড়ায় ভরা যাত্রাপথে চলেছে ওদের দলটা। রাস্তায় মাঝেমাঝে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে লেবু পানি, জিলাপি খাওয়া, আর চুমকির নিরন্তর গান গাওয়া—সব মিলে সময় যেনো উড়ে যাচ্ছে।
ওরা যেখানে যাচ্ছে জায়গাটার নাম হল “শান্তিপুর”—একটা সবুজে মোড়ানো, পাখির কুজন আর শীতল হাওয়ায় ভরা গ্রাম। শান্তিপুরের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী জায়গা হলো চৌধুরী জমিদার বাড়ি, যেখানে মেহরিনের ফুপি বিয়ের পর থেকেই থাকেন।

এই চৌধুরী বাড়ির লাল ইটের গাথুনি, বিশাল উঠোন, পুরোনো রাজকীয় বারান্দা—সব কিছুতেই একধরনের রাজকীয় ছোঁয়া আর স্মৃতির গল্প। গ্রামে এখনো সবাই ফুপি-ফুপুকে “চৌধুরী সাহেব আর বড়মা” বলে ডাকে।
গ্রামের সীমানা পেরিয়ে যখন ফুপির বাড়ির সামনে গাড়ি থামে, তখন বিকেল গড়িয়ে এসেছে। মাঠের ধান গন্ধ, পুকুর পাড়ে নরম রোদ, আর উঠোনে দাঁড়িয়ে ফুপির হাসিমাখা মুখ—সব যেন এক সিনেমার দৃশ্য।
ফাইজা চৌধুরী প্রথমে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরলেন, কেমন আছো ভাইজান?
ফিরোজ মির্জা,ভালো আছি তুই কেমন আছিস?

_আলহামদুলিল্লাহ ভালই আছি ভাইজান। ভাবি তুমি কেমন আছো তোমার শরীর ভালো তো? মালিহা মির্জার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন।
_হ্যাঁ আপা আলহামদুলিল্লাহ আল্লার রহমতে ভালোই আছি। আপনি কেমন আছেন? বাচ্চারা কেমন আছে? আকরাম ভাইজান ভালো আছে ?
ফাইজা চৌধুরী হাসিমুখে বললেন, সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। আসো ভিতরে আসো।
ফুপ্পি এবার এসে জড়িয়ে ধরলেন মেহরিনকে
“তুই আসবি জেনেই এ বছর একটু অন্যরকম আয়োজন করেছি।”
চুমকি ফিসফিস করে বলল,

এই আবেগ দেখে কাঁদতে ইচ্ছা করছে!
মাহির পেছন থেকে ছবি তুলে বলল,
এইটা হবে আমার ‘বেস্ট ক্যাপচার অফ দ্য ডে’!
তখন চুমকি মুখ খোলালো আর বলে আমাকে তো কেউ চোখে দেখছেই না। মুখটা কেমন করেছে যেনো দুনিয়ার যত দুঃখ তার একারই।
মেহরিনের ফুপ্পি ফাইজা চৌধুরী এগিয়ে এসে চুমকিকে জড়িয়ে ধরল।কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল,আমি কি আমার চুমকি পাখিকে বলতে পারি। আমার টুনটুনি ময়না টা কেমন আছিস রে মা।
চুমকি আল্লাদে গদো গদো হয়ে জড়িয়ে ধরল ফাইজা চৌধুরীকে। কয়েকটা চুমু খেয়ে বললাম আলহামদুলিল্লাহ।তুমি কেমন আছো?

ফাইজা চৌধুরী বললেন, ভালো আছি রে মা ।
মেহবুবা কান্না নাটক করে বলল, এখানে তো আমাকে কেউ দেখছেই না আমি বরং চলেই যাই…
সবাই হেসে দিল মেহবুবার কথায়। ফাইজা চৌধুরী এগিয়ে এসে মেহবুবা কেউ বুকে জড়িয়ে নিলেন।
মাহির বললো তোমাদের ফ্যামিলির ড্রামা শেষ হলে আমাকে জানিও। ফাইজা চৌধুরী হেঁসে গিয়ে মাহিরের কান টেনে ধরলেন, তোর বাথরুমে এখনো যায়নি তাই না?
মাহির_উফ!ফুপি ছাড়ো আমার কানটা তো ছিড়েই গেল। আমার মতো নিরীহ মাসুম বাচ্চার উপরে এত অত্যাচার কিন্তু জাতি মেনে নিবে না।

সবাই মাহিরের কথাই হেসে উঠলো এসে সবাই ভিতরে চলে গেলো।
সবার ভিতরে ঢুকতেই এক প্রকার দৌড়ে এলো আরফা। মেহরিন এর ফুফাতো বোন। এসে জড়িয়ে ধরলা মেহরিন মেহেবুবা আর চুমকিকে। তারপর ওদের নিয়ে গেলো সবার জন্য বরাদ্দ করা রুমে।
দুপুরে খেয়ে-দেয়ে সবাই সবার মত বিশ্রাম নিয়েছে।
সন্ধ্যায় উঠোনে মাদুর পেতে শুরু হলো জলখাবার আর গল্পের আসর। ফুপি ফুপুর সেই পুরোনো প্রেমের কথা বলতে গিয়ে হেসে ফেললেন—আর ফুপু বললেন,
তখন চিঠি লেখা ছাড়া আর উপায় ছিল না, এখন তো সব হাতের মুঠোয়। তবুও সেই চোখের ভাষা ছিল সেরা।
সবাই হাঁ করে শুনছিল। রাতের খাওয়ায় থাকবে ফুপির হাতের মুরগির ঝোল, আর মেহরিনের মায়ের বানানো সুজির হালুয়া।

চৌধুরী বাড়িতে যেনো বিয়ে লেগেছে এমন আমেজ।জমিদার বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান হলে পুরো গ্রামবাসীকে দাওয়াত করা হয় এটা এখানকার নিয়ম।তাই বাড়ি জুড়ে অনেক মানুষের আনাগোনা।
রাতের জমজমাট খাবার টেবিল যেন একটা মিনি উৎসব। চৌধুরী জমিদার বাড়ির বিশাল খাওয়ার ঘরটা লাল-হলুদ শালু দিয়ে সাজানো, সিলিং থেকে ঝুলে আছে রঙিন কাগজের ফেস্টুন, আর একপাশে বড় টেবিলে একে একে সাজানো রয়েছে সুস্বাদু খাবারের পংক্তি—পোলাও, রোস্ট, বিফ রেজালা, হালিম, কাবাব, বোরহানি, সালাদ, আর শেষে ফিরনি আর জর্দা।

একটা বড় লম্বা টেবিলে সবাই বসেছে মিলেমিশে—একপাশে আরশ ভাই, আরফা,ফিরোজ মির্জা আর মাহির,অন্য পাশে আকরাম চৌধুরী, তার এক পাশে মেহরিন ও অন্য পাশে মেহবুবা আর মেহরিনের পাশে চুমকি আর দাদি জাহানারা বেগম ওনি ফুপ্পির শাশুড়ী।মালিহা মির্জাআর ফাইজা চৌধুরী খাবার পরিবেশন করছেন।
জাহানারা বেগম ধীর কণ্ঠে বললেন,
—এই বয়সে এমন একসাথে বইসা খাওন খাওয়ার স্বাদই আলাদা। আমাগোর ছোটবেলায় এরকমই হইতো—পঁচিশ-তিরিশ জন একসাথে বইসা খেতাম!

চুমকি বলে, ২৫ ৩০ জন। আচ্ছা দাদি এত মানুষের সাথে টেবিল কিভাবে খেতো?
দাদি, আরে ছেমরি আমাগো সময় আমরা মাটিতে মাধুর বিছাইয়া খাইতাম বুজলি।
ফুপা আকরাম চৌধুরী নিজের গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন,
—”আমি আগেই বলেছিলাম, আমাদের বিবাহবার্ষিকীতে এইরকম মিলনমেলা চাই। এখন দেখি পরেরবার মেহরিন বা আরশ বিয়ের আয়োজনে কে এগিয়ে আসে!
এ কথা শুনে আরশ আর মেহরিন একসাথে কেশে ওঠে,
এই কথা শুনে বাকি সবাই হেসে উঠল। আরফা বলল,
—ুউফ আব্বু! আপনি না একদম সোজা কথার লোক!একদম আমার আমার মনের কথা বললা।
দাদি বলে, হ খোকা, এক্কেরে ঠিক কথাটা কইছস। পোলা মাইয়া বড় হইছে এখন বিয়া দেওয়ার ব্যবস্থা করন লাগবো।

মেহরিন চুপচাপ ছিল, চুমকি ওর কানে ফিসফিস করে বলল,
—তুই লাল হয়ে যাচ্ছিস কেন রে? ওমা! কবির নামও তো কেউ নেয়নি এখনো!
মেহবুবা পাশ থেকে বলল,
—”আরশ ভাইয়ের প্লেটে চার টা কাবাব দেখছি, উনি কার বিয়ের অপেক্ষায় জানি না, তবে বিয়ের আগেই প্লেট পূর্ণ করে ফেলেছেন!
সবার হো হো করে হাসি, ফুপি একটু হেসে বললেন,
—তোমরা হাসাহাসি করো, তবে খাবার ঠিকমতো খেতে হবে। ঘরের খাবারে যে স্বাদ, রেস্টুরেন্টে তার ছিটেফোঁটাও নেই!কিন্তু তোমাদের এটা কে বোঝাবে! সারাক্ষণ শুধু বাইরের খাবার খাও।
আরশ ভাই বলল,

—এতদিন পরে বুঝলাম কেন দাদি বলে গ্রামের মেয়ের রান্না সেরা। এ যে একদম হৃদয় দিয়ে বানানো।
আর সেই মুহূর্তে একটা দুষ্টু বাতাস, একটা চঞ্চল আলো আর এক ঝলক ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল পুরো টেবিলে।
এ যেনো খাবার নয়—এ ছিল স্মৃতি, ভালোবাসা, আর একসাথে থাকার শান্ত আনন্দের ভোজ।
রাজবাড়ীর পুরনো করিডোরে টিমটিমে আলো জ্বলছে। রাতের খাওয়া শেষে সবাই যখন চা হাতে দাওয়ায় বসে, তখন শুরু হয় নতুন পরিকল্পনা।

মাহির বলে,আপনার একটা অ্যাডভেঞ্চার করা উচিত বুঝলে! রস খেতে হবে, পুকুর পাড়ে হাঁটতে হবে, ছবি তুলতে হবে—সব একসাথে!তাহলে না ঘুরতে আসার ফিল টা আসবে।
মাহিরের প্রস্তাবটা সবারই ভালো লাগে সবাই রাজি হয়ে যায়।আরশ ভাই বলে, আচ্ছা তবে তাই হবে। কিন্তু সবাই সময় মতো রেডি থাকবি।
মেহবুবা বলে, আমি তো ভাবছি, রস খাওয়ার পর খেতের আইল দিয়ে হেঁটে নদীর পাড় অবধি যাবো। রোদ ওঠার আগেই!

আরফা তখন উত্তেজনায় বলে, তাহলে ঠিক আছে, আমি সবাইকে ডাকব। কারো ঘুম না ভাঙলে পানি ঢেলে দিবো!
সবাই হেসে গড়াগড়ি খায়।
চুমকি হঠাৎ বলে, তাহলে কাল আমাদের নাম হবে ‘ভোরের অভিযাত্রী দল!’
হাসতে হাসতে একে একে সবাই ঘুমাতে যায়। বাড়ির চারদিক নিস্তব্ধ। খোলা জানালা দিয়ে কুয়াশার হালকা পর্দা ঘরে ঢুকে পড়ে।

ভোরবেলা (ফজরের সময়)
আলোর রেখা এখনো ফুটে ওঠেনি, মাটির ঘ্রাণে ভরা ভেজা হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে আরফা দৌড়ে বেড়াতে আসে— প্রথমেই যায় মাহিরের রুমে ওই উঠ! সময় নেই, আজান হয়ে গেছে!
মাহির চাদর পেঁচিয়ে বলে, আল্লাহ্‌, আর একটু ঘুমতে দে মেরি মা।
আরফা পাড়ে গিয়ে টান মেরে চাদর সরিয়ে দেয়, উঠ কুম্ভকর্ণ কোথাকার! নিজে প্ল্যান করে এখন নিজেই ঘুমের দেশে পাড়ি দিচ্ছিস।নো ঘুম, রস আগে! মাহিরকে উঠিয়ে এবার যাই মেহেরিনদের রুমে,
মেহরিন চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে চুমকিকে বলে, তোর জন্যই ঘুম শেষ।
চুমকি হেসে ফিসফিস করে, কিন্তু ভোরটা সুন্দর হবে, দেখিস।
এক পর—

সবাই দলবেঁধে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটছে। পাশে ধানক্ষেত, পুকুরে হালকা কুয়াশা, গাছে বসে পাখির ডাক। মাটির রাস্তায় কুয়াশা জমে আছে, আর সেই পথ ধরে সবাই হাঁটছে পায়ের নিচে খসখস শব্দ তুলে।
ভোরবেলা কুয়াশায় ভেজা মাঠ আর খোলা আকাশ। দূর থেকে আজানের ধ্বনি মিলিয়ে যাচ্ছে পাখির কিচিরমিচিরে।
আরশ মাথায় গামছা জড়ানো এক লোকের সঙ্গে আসছে। লোকটার হাতে একটা মোটা দড়ি, কোমরে বাঁধা দা। চুমকি ফিসফিস করে, ওই লোক কি গাছে উঠবে?
মাহির বলল, হ! দেখ, লাইভ রস পাড়ার অভিজ্ঞতা!

খেজুরগাছের গায়ে লাগানো বাঁশের মই বেয়ে লোকটা ধীরে ধীরে ওপরে ওঠে। গাছে বাঁধা হাঁড়ি খুলে একে একে নিচে নামিয়ে দেয়—ভেতরে ঝকঝকে সোনালি খেজুর রস।
মেহরিন বিস্ময় নিয়ে বলে,এতো টাটকা!
সবাই নিজের হাতে ছোট সরায় রস নেয়। চুমকি এক চুমুক দিয়ে চিৎকার করে—
ও মা! এ যে অমৃত!
আরফা বলে, শান্তি বলতে একেই বোঝায়।

একটা কোণায় দাঁড়িয়ে মেহবুবা মোবাইলে সবাইকে ভিডিও করছে। মাহির কাঁধে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে, তোকে দেখলে মনে হয় রসের বিজ্ঞাপন হবে!
রস খাওয়া শেষে সবাই হাঁটতে থাকে ধানক্ষেতের আইল ধরে নদীর দিকে।
সূর্য তখন একটু একটু করে উঁকি দিচ্ছে। মাঠের ধারে শালিকের ডানায় রোদ পড়েছে। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কেবল পাখির ডাকে ভরপুর।

নদীর পাড়ে পৌঁছেই চুমকি চিৎকার করে—দেখো! এই নদীটা যেন আয়নার মতো! পরিবেশটা জানা একদম মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে সারা জীবন এখানেই থেকে যায়।
পাশ থেকে মাহির বলে,হ্যাঁ এখানকার এক টাকলা বুড়োর সাথে তোকে বিয়ে দিয়ে দিব চুমকি আপু চিন্তা করিস না। তারপরে এই এলাকার বউ হয়ে সারা জীবন এখানেই থাকিস।
চুমকি মাহির কে একটা ঠাস করে মেরে দেয়। তারপরে সবাই হা-হা করে ভেসে ওঠে।
নদীর পানিতে কুয়াশা পড়ে ঝাপসা একটা প্রতিচ্ছবি। দূরে নৌকা, একজন মাঝি হাল ধরা। পাড়ে কাশবন দুলছে হাওয়ায়।

আরফা ছুটে গিয়ে বলে, তাড়াতাড়ি! এখানে একটা গ্রুপ ফটো চাই!
সবার মুখে হাসি, চোখে আনন্দের ঘুম না ঘুম ভাব, আর হৃদয়ে তৃপ্তি। একে একে সবাই নদীর পাড়ে বসে পড়ে—কেউ গুনগুন করে গাইছে, কেউ শালুক তুলছে, কেউ মোবাইলে গ্রামের রোদ্দুরে ভেজা মাঠ ক্যামেরাবন্দি করছে।
এ যেনো নিছক একটা সকাল নয়—এ এক জীবনের গল্প, একসাথে কাটানো অপূর্ব মুহূর্তের স্মৃতি।
সকালের রোদটা তখন ঝিকমিক করছে, বাতাসে ভেসে আসছে শীতল জলঘ্রাণ আর দূরের শাপলার মৌন রঙিন আহ্বান। নদীর তীর থেকে একটু দূরে বাঁধা ছিলো একটা ছোট ডিঙি নৌকা। মেহরিন হঠাৎ চারপাশে তাকিয়ে বলল,
ভাইয়া, চল না নৌকায় করে একটু ঘুরে আসি?
আরশ একটু অবাক হয়ে মুচকি হেসে বলল,

তুই তো দেখি একদম অ্যাডভেঞ্চার মুডে আছিস আজ!
পাশ থেকে আরফা খুশিতে বলে উঠল,
ওই পাশে অনেক পদ্মফুল আছে! একবার ওদিকটা দেখলে মন ভালো হয়ে যাবে!
ব্যাস! পদ্মফুল শুনেই আর কারো মন থেমে থাকেনি। কিন্তু মাহির বলল,
না না, আমি তো যাব না, নৌকা উল্টায় ফেলবি শেষে!
মেহবুবা বলল,আমরা সবাই যাবো কেউ পরবো না তুই পরে যাবি?বাদরামি বন্ধ করে চল।
ততক্ষণে মেহরিন, আরফা আর আরশ নৌকায় উঠে পড়েছে। চুমকি একটু দ্বিধায় থাকলেও শেষ পর্যন্ত না যেতে না পেরে, কানের দুল ঠিক করতে করতে লাফিয়ে উঠল নৌকায়। মাহির আর মেহবুবা তখন নৌকার ধারে দাঁড়িয়ে থেকে শুধু বলছে,

সাবধান! জল পড়িস না আবার!
আরশ খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৈঠা দিচ্ছিল। তার গম্ভীর ভঙ্গি দেখে মেহরিন হঠাৎ বলে উঠল,
আরশ ভাইয়া, এই পোজে তুই যেনো কোন নদীর রাজা!
আরফা সাথে সাথে বলল,
তাহলে আমি নদীর রানী!
চুমকি খিলখিল করে হেসে বলে,
আর আমি হই তার দাসী?

এই কথা শুনে আরশ হঠাৎ একদিকে হালকা কাত করে নৌকা চালাতে লাগল, পানি একটু একপাশে ঢলে পড়ল—আর মেয়েগুলো চিৎকার শুরু করে দিল।
ভাইয়া! ঠিক করে চালা! পড়ে যাবো তো।
এই যে চুমকি, দাসী বলার ফল!
চুমকি মুখ বাঁকায়, এমন দুষ্টুমি করতে করতে ওরা পদ্ম ফুলের দিকে চলে যায়। জায়গাটা সত্যিই অসম্ভব সুন্দর, মন ভালো করার মত জায়গা।
মাঝে মাঝেই পদ্মফুলের দিকে হাত বাড়িয়ে কেউ তুলতে চাইছে, কেউ আবার বসে বসে সেলফি তুলছে, কেউ আবার বলছে,
এই ফুলটা কি সুন্দর !
এই ফুলটা তো তোর পোস্টের জন্য!

হঠাৎ একটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে নৌকায় উঠে পড়ে। আরফা এক চিৎকার দিয়ে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে—আর মেহরিন ওর চেয়ে জোরে চেঁচায়। চুমকি পাশ থেকে হেসে গড়াগড়ি। আরশ হাসতে হাসতে বলল,
তোরা যা, আমি ব্যাঙকে একটু নৌকায় চড়িয়ে নিয়ে যাই!
নৌকা তখন ধীরে ধীরে বিলের মাঝখানে। পদ্ম ফুলে ভরা জলে চারপাশটা যেন এক টুকরো স্বর্গ। ভাই-বোনের দুষ্টামি, ফাইজলামি আর আনন্দে মুহূর্তটা যেনো বাঁধা পড়ে গেলো সময়ের পাতায়।
সবাই যখন দুষ্টুমি ফাইজলামিতে ব্যস্ত! এমন সময় মাহির বেছে বেছে মেহরিনার পিক গুলো হোয়াটসঅ্যাপে একটা নাম্বার সেন্ড করে।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ১৯

নিচে একটা এসএমএস পাঠাই, হ্যাপি।
ওপার থেকে জবাব আসে,
Verry ! That’s exactly why I like you so much, Salababu!(খুব ভালো! এই জন্যই তো তোমাকে এত ভালোলাগে, সালাবাবু)

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২১