মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৩
মির্জা সূচনা
কেটে গেছে দু’দিন রাজ মেহরিনের সম্পর্ক আগের থেকে আরও একটু সহজ হয়েছে।
সকাল ৯ টা
সকালটা যেন রঙিন হয়ে উঠেছে জমিদার বাড়িতে। বড় ডাইনিং টেবিলে সবাই একে একে জড়ো হয়ে বসেছে। গরম গরম লুচি, মুরগীর মাংস ,পায়েস, ডিম ভাজি, আর জাহানারা বেগমের হাতে বানানো নারকেল নারু আরো নানা জাতের খাবার রাখা টেবিলে—খাওয়া আর গল্পে তুমুল ব্যস্ত সকালের খাবার সময়।
জাহানারা বেগম খেতে খেতে হঠাৎ বললেন, এই লাবিবটা, ছোট্ট বেলাই একখান বলদ আসিলো, একবার কি করছে জানো!আম চুরি করতে গিইয়া গাছত থেইক্কা পইড়া গেছিলো, চুরি করতে গেছে কিন্তু কার কার গাছ হেইয়া যানতো না। না জাইন্না নিজেদের গাছের আম চুরি করা বলদ হেই। এখন শুনি এই বলদ মালয়েশিয়া থাকত।
লাবিব হাতে কফির মগ নিয়ে বলে উঠল, “উফফ দাদিমা! সে তো শৈশবের ভুল, আর আমি চোর হলেও সৎ ছিলাম,নিজেদের জিনিস চুরি করতাম অন্য কারো তো না আর এখন আমি পুরোপুরি চালাক হয়ে গেছি ।
মেহবুবা ঝট করে বলল, হ্যাঁ, এত দিন শুনতাম চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে! কিন্তু এখন দেখি চুরি করলে বলদ থেকে চালাক হয়, তাই না?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সবাই হেসে ওঠে। লাবিব চোখ কুঁচকে তাকায়,
তুমি না লেদা-বাচ্চা না একদম বাঁদর!
চুমকি বাটির ঢাকনা তুলে হেসে বলল, ওই বাঁদরের খেলা তো টেবিলেই শুরু হলো দেখি।
এই ফাঁকে রাজ আর মেহরিনের চোখাচোখি হয়। রাজ হালকা হাসে, মেহরিন চোখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি খেলে যায়।
তখনই পাশ থেকে মাহির কাঁটাচামচ নামিয়ে বলে, সবাই দেশ-বিদেশ ঘুরতে চায়, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই… আর আমার বড় বোনের স্বপ্নের রাজ্য? সাজেক!
এক মুহূর্ত স্তব্ধতা, তারপর হেসে ওঠে সবাই। চুমকি বলে, স্বপ্ন যদি পাহাড়ে হয়, তবে সেটা তো ভীষণ রোমান্টিক আর সিনেমাটিক।
মেহরিন অপ্রস্তুত হয়ে যায়, গালটা লাল। রাজ হালকা করে নিজের কফির কাপটা তুলতে তুলতে ভাবছে—তোমার স্বপ্ন যদি সাজেক হয়, ম্যাডাম… তাহলে যে এবার সাজেকেই নিয়ে যেতে হবে। যতই হোল ম্যাডামের সপ্নের জায়গা বলে কথা।
তখনই মেহরিন মাথা উঁচু করে বলে,
আমি ঠিক দেশ-বিদেশের চমকদার জায়গায় ঘুরে মজা পাই না, আমার বরং পাহাড়, ঝর্ণা, মেঘ—এইগুলোই টানে। সাজেকের ভোরের মেঘ, বিকেলের রোদ, আর সন্ধ্যার লাল আলোয় ভেজা পাহাড়—ওখানে গেলে মনে হয় প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া যায়…
তার গলা যেন একটু কাঁপে, সেই অনুভবটা এতটা সত্যি যে টেবিলে মুহূর্তের নিঃশব্দতা নামে।
রাজ তার দিক থেকে ধীরে মাথা তোলে, চোখে একটুখানি আলোর ঝিলিক। হেসে উঠে বলে,
আচ্ছা মামু… আমি যদি বলি, মেহরিন যেখানেই যেতে চায়, আমি ওদের সবাইকে নিয়ে ঘুরে আসতে চাই, আপনি কি অনুমতি দেবেন?
আকরাম চৌধুরী চায়ের চামচ থামিয়ে তাকান, মৃদু হেসে বলেন,
তুমি বুঝদার ছেলে। আর এখন তোমাদের ঘুরা ফেরারি সময়… যেতে চাইছো যাও তবে ওদের নিরাপত্তা তোমার দায়িত্ব।আর ফিরোজ ভাই কে জিজ্ঞেস করে নিও তার অনুমতি আছে কি না।
রাজ সম্মান দিয়ে মাথা ঝুঁকায়, অবশ্যই, মামু।
রাজ এবার ফিরোজ মির্জাকে বলে, আঙ্কেল আপনি কী অনুমতি দিবেন মেহরিন, চুমকি,মেহবুবা আর মাহিরের যাওয়ার?
ফিরোজ মির্জা সবার দিকে একবার তাকায় সবার মুখে খুশির ঝলক দেখে বলেন,
ওরা যেতে চাইলে যাবে আমার কোনো প্রব্লেম নেই ওরা সবাই এখন বড় হয়েছে।
ফিরোজ মির্জার কথায় সবাই খুশি হয়।
কিন্তু পাশে বসে থাকা মালিহা মির্জা তখন মুখ একটু গম্ভীর করে বলে ওঠেন,
এত গুলো মেয়ে এতদূর যাবে, তাও রাত থাকবে বাইরে—ওদের না গেলে হয় না?
ফাইজা চৌধুরী বলেন, যাক না ভাবি বাচ্চা গুলো একটু ঘুরে আসুক।
চুমকি একটা চুমু দিয়ে বলে, ও মামনি,আমরা যায় না প্রিজ! আমরা বাচ্চা না যে হারিয়ে যাবো। আমরা একদম দুষ্টমি করবো না। যায় না মামনি প্লিজ প্লিজ প্লিজ!
মেহবুবা মুচকি হেসে হাত জড়ায় মায়ের কাঁধে, মা, প্লিজ না করো না, আমরা সবাই একসাথে যাবো, অনেক মজা হবে রাজি হয়ে যাও না প্লিজ।
মাহির ওদিকে গলা ফাটিয়ে বলে, ও মা একটু টেনে বলে_ তুমি যদি রাজি না হও আমরা এখনি অনশনে বসবো! আমাদের মতো এমন কিউট বাচ্চা গুলোর কষ্ট তুমি দেখতে পারবে বলো। আমাদের কথা বাদ দাও রাজ ভাই দেখো কি অসহায় মুখে তাকিয়ে আছে,রাজ ভাইয়ের এই দুঃখি মুখ পানে তাকিয়ে অনুমতি দিয়ে দাও প্লিজ।
সবাই হেসে ওঠে। রাজ চোখ কুঁচকে বলে,
সালা নাটক বাজ,এত চালাকি!
জাহানারা বেগম সবার হট্টগোল দেখে মাথা নাড়িয়ে বলেন,
মালিহা, রাজি হইয়া যাও। রাজ তুমার খালুর মতো ঠান্ডা মাথার, মাইয়া গুলার বাড়তি খেয়াল রাখব।
সবচেয়ে অবশেষে, অনেক টানাটানির পর মালিহা মির্জা হাল ছেড়ে বলেন,
আচ্ছা আচ্ছা, তবে একটা শর্তে—সবার ফোন চালু থাকবে, আর এক মিনিট দেরি হলেও খবর দিবে।
চুমকি সঙ্গে সঙ্গে বলে, “ডন ওকে !”
হাসির ফাঁকে রাজ মেহরিনের দিকে একবার তাকায়। মেহরিন চুপচাপ তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে। ওর চোখে তখন সাজেকের পাহাড়ের সবুজ, আর একটা নতুন রঙের স্বপ্ন। আর ভাবছে কত সহজে সবাইকে রাজি করিয়ে ফেললো রাজ।
জাহানারা বেগম লুচি ছিঁড়ে খেতে খেতে বললেন, “আগের দিনে আমরা যহন বেড়াইতে যেইতাম, খালি গরুর গাড়ি আর হাটা লাগতো! এহন তো গাড়ি-বিমানে ঘোরে, আরোও কতো কী।
চুমকি চট করে বলে উঠল, দাদি, গরুর গাড়িতেও আমরা যেতে রাজি, যদি কেউ কবিতা পড়ে শোনায়। তাই না মেহু?
মেহরিন হেসে চুমকিকে চিমটি কাটল। রাজ হালকা হেসে পাশে বসা মেহরিনের দিকে তাকালো, কিন্তু মেহরিন চোখ নামিয়ে নিল।
জাহানারা বেগম ভুরু কুঁচকে বললেন, ওই সাজেক-মাজেক বলে কি জায়গা? পাহাড়ে গিয়ে আবার পড়বি কুয়ায়, সাবধান এ থাকবি ছেমড়িরা।
মেহবুবা হেসে বলল, দাদি, আপনি চিন্তা করেন না। পাহাড়ে উঠার আগেই আমরা স্পেশাল লাঠি নিয়ে উঠব উঠবো ।
সবার হাসাহাসি শুরু হয়ে যায়।
লাবিব বলল, তো আমাদের সাজেকের প্ল্যান ফাইনাল তাই তো। তাহলে আজ রাতেই যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলি কি বলো সবাই।
সবাই ইয়াহু বলে উঠে।
মেহরিন চোখ নামিয়ে ছোট্ট করে হাসলো। রাজ মনেমনে ভাবলো, ম্যাডাম, আপনার সাজেক যাওয়ার স্বপ্ন? এবার সেটা সত্যি হবেই।
বাড়ির চারপাশ যেন গুনগুন করে গাইছে—সাজেকে যাওয়ার আনন্দে! সবার চোখে মুখে একরাশ উচ্ছ্বাস, যেনো একটা নতুন অভিযানে বেরিয়ে পড়ার অপেক্ষা।
ডাইনিং রুম থেকে শুরু করে বারান্দা, কেউ কোথাও স্থির নেই। কেউ জামা গুছাচ্ছে, কেউ সানগ্লাস খুঁজছে, কেউ আবার ব্যাগের চেইন টেনে টেনে চেক করছে সব ঠিক আছে কিনা।
আজ রাতেই ওরা রওনা দিবে বলে সকাল সকাল সবাই শপিং নিয়ে গিয়েছিলো,সবার প্রয়োজনীয় জিনিস সামগ্রী সব কিনে নিয়ে এসেছে।
মেহরিন নিজের ঘরে ব্যাগ গোছাতে ব্যস্ত, আর পাশে চুমকি আর মেহবুবা ঠিক সেই চিরচেনা দুষ্টু মুডে—
এই শুন, সাজেকে যদি ঝড় বৃষ্টি হয়, তখন তুই রাজ ভাইয়ের কাঁধে ভর করে পাহাড়ে উঠবি না তো? চুমকি হাসতে হাসতে বলে।
মেহবুবা হেসে যোগ দেয়, তখন রাজ ভাই বলবে, ম্যাডাম মেঘে ভেজার আগে একটা কবিতা হোক না!
মেহরিন মুখ ফুলিয়ে বলে, তোরা দুজন চুপ করবি! তোদের কী আমার পিছনে লাগা ছাড়া আর কোন কাজ নাই?
চুমকি সঙ্গে সঙ্গে বালিশ ছুঁড়ে মারে মেহরিনের দিকে, আচ্ছা বল, ব্যাগে পারফিউম নেছিস তো? রাজ ভাইয়ের নাকি ফ্রেশ ঘ্রাণ পছন্দ করে!
চুমকি!বলে মেহরিন এবার উঠে ওকে ধাওয়া করে।
ঘর জুড়ে শুরু হয় দৌড়া দৌড়ি আর বালিশ যুদ্ধ—মাঝে মাঝে হাসির ফোয়ারার মতো আওয়াজ, আর মাঝে মাঝে খিলখিল করে গড়িয়ে পড়া ফ্লোরে।
মেহবুবা হেসে হেসে বলে, আচ্ছা এভাবে ব্যাগ গোছালে না সাজেক নয়, আমরা সরাসরি গোপালগঞ্জ পৌঁছে যাবো!
চুমকি তখন হঠাৎ দাঁত কেলিয়ে বলে, “আর যদি সাজেকে গিয়ে রাজ ভাই কবিতা পড়ে ‘পাহাড়ে হারানো এক মনভোলা মেয়ের নাম মেহরিন…’
এইবার মেহরিন নিজেই হেসে ওঠে। মুখ লাল, চোখ ভেজা, কিন্তু মনে খুশির ঢেউ। সাজেকের স্বপ্নে, পাহাড়ের মেঘে, আর কে জানে—রাজের চাহনিতে লুকিয়ে আছে কোন নতুন অধ্যায়?
রাতের নরম আলোয় গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে, সাজেকের উদ্দেশে রওনা দেবে আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই। সবার মাঝে উত্তেজনা আর হইহুল্লোরে ভরা একটা উৎসবমুখর পরিবেশ।
দুইটা গাড়ি ঠিক করা হয়েছে, দুটোই বেশ আরামদায়ক SUV। প্রথম গাড়িটা রাজ নিজেই চালাবে। সামনে বসেছে মেহেরিন। তাদের পেছনের সিটে চুমকি আর আরফা— তিনজনেই টকাটুকি আর হাসাহাসিতে মেতে আছে।
দ্বিতীয় গাড়ির ড্রাইভিং সিটে লাবিব, আর পাশে বসে আছে মেহবুবা— যাকে লাবিব সযত্নে ‘ম্যাডাম’ বলে ডেকে ডেকে মুখে ছানা তুলে ফেলছে। পেছনের সিটে আরশ আর মাহির একদিকে হেলান দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে, মাঝে মাঝে সবার কথায় হেসে উঠছে।
গাড়িতে উঠেই চুমকি বলে উঠলো,
— এই দ্যাখো! মেহেরিন আপা রাজ ভাইয়ার পাশে বসেছে! সাজেক যাওয়ার আগেই রোম্যান্টিক সাজেক শুরু হইছে!”
আবার হেসে বলে,
— সামনে পাহাড়ের রোমান্সের চেয়ে সামনে যারা বসে আছে, তাদের রোমান্সই দেখি আগে!
আরশ জানালার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে,
— এই ট্যুরটা মনে হয় ভ্রমণ না, প্রেমভ্রমণ হবে।
রাজ হালকা হাসে, মেহেরিন একটু মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু ঠোঁটের কোণে লুকানো একটা হাসি যেন ধরা পড়ে যায়।
সবার কাছে বিদায় নিয়ে,
দুইটা গাড়ি একসাথে ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে অজানার পথে— পাহাড়, মেঘ আর ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায়ের দিকে।
সাজেক যাওয়ার পথটা যেনো শুধু মেঘ, পাহাড় আর আনন্দে মোড়া এক স্বপ্নযাত্রা।
গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে দূরের সবুজ পাহাড়, মাঝে মাঝে মেঘ এসে গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। প্রথম গাড়িতে রাজ মাঝে মাঝে মেহেরিনের দিকে তাকায়। মেহেরিন নিজের মনেই মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি দেখছে, কিন্তু রাজের চোখের কোনা থেকে সেই মুগ্ধতা অচেনা থাকে না।
চুমকি, আরফা কখনও গান গায়, কখনও গল্প বলে, হঠাৎ হঠাৎ এমন হাসির ফোয়ারা ফোটে যে গাড়ি যেন আনন্দে ভেসে যায়।
পেছনের গাড়িতে মেহবুবা হেডরেস্টে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলেও, লাবিব হালকা মিউজিক বাজিয়ে দিচ্ছে, আরশ জানালায় হাত রেখেছে, যেনো নিজের ভাবনার মধ্যে হারিয়ে আছে। আর মাহির একটু পর পর এটা সেটা বলে সবাইকে হাসাচ্ছে।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নাগাদ ওরা সাজেক পৌঁছে যায়।
পাহাড়ের কোলে ঘেরা রিসোর্ট, ছাউনি ঘেরা ছিমছাম কাঠের কটেজগুলো যেনো ছবির মতো সাজানো। চারদিকে কুয়াশা, বাতাসে মেঘের গন্ধ, আর নীরব এক সৌন্দর্য।
সবাই যেনো থমকে যায়।
মেহেরিন নিঃশ্বাস টেনে বলে,
— ইস! এমনটা কল্পনাও করিনি! মনে হচ্ছে যেনো আকাশের মধ্যে এসে পড়েছি!
চুমকি আরফাকে নিয়ে ছোটাছুটি করে, মাহির আরশ একসাথে রিসোর্টের উঠোন ঘুরে দেখে। রাজ দাঁড়িয়ে শুধু মেহেরিনের মুগ্ধতা উপভোগ করে।
মেহবুবা রুমে ঢুকে বলল,
— এই ট্যুরে কেউ প্রেম না করলে খুব অবাক হবো আমি!
চুমকি হেসে বলে,
— তাহলে আপনি রাজি আছেন ম্যাডাম?
সবাই হেসে উঠে। হালকা ঠান্ডা, কুয়াশা, পাহাড়ের নীরবতা আর প্রিয়জনের উপস্থিতি— সাজেকের প্রথম দিন যেন এক নিঃশব্দে ভালোবাসার রঙে ভরে উঠছে।
সাজেক রিসোর্টে পৌঁছানোর পর একেকজন যেনো একেকভাবে হারিয়ে গেছে সৌন্দর্যে।
সবার ঘরে ঢুকে একে একে ফ্রেশ হয়ে নেয়। গরম গরম ভাত, দেশি মুরগির ঝোল, টাটকা সবজি আর ইলিশ মাছ দিয়ে সাজানো দুপুরের খাবার — পাহাড়ে এসেও যেনো ঘরের স্বাদ। সবাই মিলে খেতে খেতে চলছে হাসি-ঠাট্টা।
চুমকি মুখ ভরে খেতে খেতে বলে,
— এই খাওয়া শেষে আমি বিছানা ছাড়া কিছু চিন্তাও করতে পারছি না!
মাহির হেসে বলে,
— তুই না ঘোড়ার মত না খেয়ে মানুষের মতো খা! বিছানার কথা ও ভাবিস আবার ঘুরতেও চাইবি!
মেহবুবা বলে,
— সবাই একটু বিশ্রাম নাও, বিকেলের আলো পড়লে বের হব। সাজেকের বিকেল না দেখলে সাজেক দেখা অপূর্ণ থেকে যাবে!
একটু পর সবার রুমে নিস্তব্ধতা।
কেউ বিছানায় শুয়ে বিশ্রামে, কেউ জানালায় দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখে, কেউ শুধু নিঃশ্বাসে মিশিয়ে নিচ্ছে নতুন জায়গার গন্ধ।
বিকেল পড়তেই…
মেহেরিন চুপিচুপি চুমকিকে বলে,
— চল বের হই… মনটা খুব টানছে ওই পাহাড়ের দিকে…
একটু পরই সবার রুম থেকে ব্যাগ আর হুডি নিয়ে বের হওয়া শুরু।
রাজ, লাবিব, আরশ মাহির — সবাই রেডি। আরফা কানের দুল ঠিক করে বলল,
— আজকে ছবি তুলে ইনস্টা ভরিয়ে দেবো!
সাজেকের বিকেলের হাওয়ায়, ওরা হাঁটবে পাহাড়ি পথে, মেঘের ছায়া আর সূর্যের ঝিলমিলে ঢাকা প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে।
বিকেলের রোদটা তখন পাহাড়ের গায়ে গায়ে সোনালি চাদর হয়ে বসে আছে।
চমৎকার একটা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে, পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদের রেখা পড়ছে। সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত, কেউ কেউ হাঁটছে, আবার কেউ বসে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ।
চুমকি আর মেহবুবা তো একরকম ছবি তোলার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
আরফা মোবাইল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাহাড়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাজের একটা candid ছবি তুলে ফেলল,
— Caught you, Mr. Tall Dark!
রাজ হেসে বলল,
— এই হাইটের মানুষ candid-ই ভালো আসে!
ওদিকে মেহরিন একা একা একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সামনে শুধু সবুজ পাহাড় আর দূরে ছুটে চলা মেঘ। ওর চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে, চোখে একধরনের ভাবুকতা।
রাজ বুঝতে পারে, এই মুহূর্তে মেহরিন একা থাকতে চায় না।
ও চুপচাপ পেছনে এসে দাঁড়ায়। কোনো শব্দ না করে মেহরিনের পাশে দাঁড়িয়ে।
মেহরিন ধীরে ধীরে বলে,
— এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেও… মনটা কেন জানি কেমন কেমন করছে..
রাজ ধীরে বলল,
— মন খারাপ হলে এমন জায়গাগুলোকে আর বেশি সুন্দর লাগে না… কিন্তু পাশে কেউ থাকলে— সবকিছুই ঠিক হয়ে যায়।
মেহরিন মুখ ফিরিয়ে চুপ করে ওর দিকে তাকায়।
রাজ ওর দিকে না তাকিয়ে বলে,
— এই পাহাড়, এই আলো, এই হাওয়া… সবকিছুর মধ্যে যদি কিছু একটাকে বেছে নিতে বলা হয়, আমি বলব— ‘তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা।’
মেহরিন লজ্জায় নিচু করে চোখ, ওর ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি।
ঠিক তখনই পেছন থেকে চুমকির চিৎকার,
— মেহরিন! রাজ ভাইয়া! এক্ষুনি এসো! সূর্য ডুবতে শুরু করেছে! আমাদের গ্রুপ ফটো তুলতে হবে!
মেহরিন ঘুরে দাঁড়াতেই রাজ হালকা গলায় বলে,
— ম্যাডাম, সূর্য তো রোজই ডোবে… কিন্তু আজকের সূর্যটা একটু অন্যরকম।
মেহরিন রাজের বাহুতে এক থাপ্পড় মেরে হেসে দৌড়ে চলে যায়। রাজ পেছনে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে— সেই হাসিটাই ছিল তার সবটুকু রোদ।
সূর্য ডুবে গেছে, পাহাড়ের গায়ে গায়ে নেমে এসেছে গাঢ় লাল অন্ধকার।
চারপাশে হালকা কুয়াশা, বাতাসে একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ছোঁয়া। পাহাড়ের ঢালে খোলা জায়গায় একটা ছোট ক্যাম্পফায়ার জ্বলছে। তার চারপাশে গোল হয়ে বসে আছে সবাই।
চুমকি বলল,
— এই রকম ক্যাম্পফায়ারে না গান না হলে হয় না… লাবিব! শুরু করো!
লাবিব গিটারে টুং টাং করে একটা সুর তোলে, তারপর গাইতে শুরু করে “চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে…
চারপাশটা মুহূর্তেই শান্ত হয়ে যায়। সবাই গানের মধ্যে ডুবে যায়।
আরশ পেছন থেকে গলা মেলায়, আর আরফা টুকটাক বাজায় কাঠের টুকরো দিয়ে তাল।
মেহরিন ধীরে ধীরে সুরে ভাসে, ওর চোখে জ্বলজ্বলে আলো, মৃদু হাওয়ায় চুল উড়ছে।
রাজ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ও কিছু বলে না, শুধু ওর চোখ বলছে— এই মেয়েটাকে নিয়েই আমার পৃথিবী।
চুমকি চুপিচুপি মাহিরকে বলে,
— তোর বোন তো দেখি পুরোটাই রাজের কবিতা হয়ে গেছে!
মাহির হেসে বলে,
— হ্যাঁ, কিন্তু কবিতা পড়ার অনুমতি এখনো আমি দেইনি!
সবার মাঝে চমৎকার একটা হাসি-ঠাট্টা, গল্প আর গান চলতে থাকে।
হঠাৎ চুমকি বলে,
— আচ্ছা! সবাইকে একটা করে কথা বলতে হবে— সাজেকে এসে তোমার সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত কোনটা!
আর তখনই রাজ বলে,
— আমার? আমি বলব না… আমার সুন্দর মুহূর্তটা এখনো আসেনি… আমি ওটা বানাবো।
সবাই ‘উহু উহু’ করে ওঠে।
মেহরিন কাঁধে একটা চাদর জড়িয়ে হালকা হেসে বলে,
— এই লোকটা চুপচাপ থাকলে ভালো, বেশি কথা বললে বড্ড ঝুঁকি থাকে!
রাজ চোখ টিপ মারে,
— ঝুঁকি থাকলে তো ইন্সুরেন্স আছে… আমি সব কভার করব ম্যাডাম!
রাতটা এইভাবে গান, হাসি আর গল্পে কেটে যায়। কেউ গায়, কেউ ছবি তোলে, কেউ পাথরের ওপর বসে আকাশ দেখে।
শেষে মেহবুবা বলে,
— আজকের রাতটা আমরা মনে রাখব, ঠিক?
সবাই একসাথে মাথা নাড়ে। চারদিকে পাহাড় আর আকাশ মিলেমিশে একাকার, আর তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে সাতটা প্রাণ— হেসে, ভালোবেসে, জীবনটাকে অনুভব করছে।
ভোর পাঁচটা।
সাজেকের আকাশে ধীরে ধীরে রঙ ছড়াচ্ছে।
একটা নরম আলো পাহাড়ের গায়ে গায়ে নামছে। চারদিকে হিমেল বাতাস, কুয়াশা এখনো জড়িয়ে রেখেছে চারপাশ।
রাজ চুপচাপ উঠে এসেছে ছাদে। হাতে দু’কাপ গরম কফি।
ওর চোখ খুঁজে নেয় মেহরিনকে— আর হ্যাঁ, মেহরিন একা দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ধরে, চাদর গায়ে জড়ানো।
রাজ ধীরে ধীরে পেছন থেকে এগিয়ে গিয়ে এক কাপ মেহরিনের পাশে বাড়িয়ে দেয়।
মেহরিন কফির কাপ নেয়, কিছু বলে না। শুধু চোখ তুলে একবার তাকায়। সেই চোখে কুয়াশার চেয়েও নরম কিছু আছে।
রাজ হেসে বলে,
— সাজেকের ভোরটা তোমার চোখে এতটা সুন্দর হবে, ভাবিনি।
মেহরিন হালকা হেসে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, যেনো কিছু না শুনেছে।
রাজ আবার বলে,
— তুমি বলেছিলে না, ‘রাতের সাজেক’ দেখতে ইচ্ছা করে? তাই ভাবলাম, ভোরটা একসাথে দেখি। কারণ… ভোর মানেই তো নতুন শুরু।
মেহরিন এবার চুপ করে দাঁড়ায়। রাজ পাশে এসে রেলিংয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়।
হালকা বাতাসে দু’জনের চুল উড়ছে, সময় থেমে গেছে যেন।
মেহরিন হঠাৎ বলে,
— আপনি এত… কাব্যময় কথা বলেন কীভাবে?
রাজ মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
— কারো জন্য মনটা কবি হলে, কথা তো এমন আপনিই হয়ে যায়।
মেহরিন এবার আর কিছু বলে না। কফির কাপটা ধরে, চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেয়। রাজও চুপচাপ তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
সেদিনের সূর্য তাদের দুজনের মাঝখানে আর কোনো ছায়া ফেলেনি—শুধু হালকা উষ্ণতা মেখে দিয়ে গেছে সেই নিঃশব্দ ভালোবাসার মুহূর্তে।
জায়গায়—“হামহাম ঝরনা পয়েন্ট”। যদিও এটি মূল সাজেক ভ্যালির মধ্যে না, তবে গল্পে একটি কাল্পনিক জায়গা বানানো যাক যার নাম হবে:
“চন্দ্রধারা ঝরনা”
(একটা পাহাড়ি ঝরনা, যেখানে সূর্যের আলো পড়লে পানিতে চাঁদের আলো পড়ে যেন ঝিকিমিকি করে)
সকাল ৯ টা বাজে।
সবাই ব্যাগ প্যাক করে রেডি। কনটাক্ট লেন্স, সানস্ক্রিন, ক্যামেরা, স্নিকার্স—সব ঠিকঠাক করে একে একে সবাই নিচে নামে।
লাবিব হেঁকে বলে—
— চলো বাহিনী, পাহাড় ডাকছে!
গাড়িতে বসার পর ওরা পাড়ি দেয় সাজেকের গভীর এক পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে, যেখানে আছে “চন্দ্রধারা ঝরনা”।
এটা এমন এক জায়গা, যেটা স্থানীয় লোকজন বলে— “ভোরের আলো আর দুপুরের রোদে এর রূপ পাল্টে যায়। ঝরনার ধারে গেলে সময় থেমে যায়!”
রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটছে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে। এক পাশে গভীর খাদ, অন্য পাশে সবুজে মোড়ানো পাহাড়। গাড়ির জানালা দিয়ে বাতাস এসে ওদের চুল উড়িয়ে দিচ্ছে।
মেহরিন একদম জানালার পাশে বসে, হালকা হেসে বলে—
— কী অসাধারণ দৃশ্য… এমন জায়গায় সারাদিন থাকতে ইচ্ছা করে।
মেহবুবা বলে—
— তবে তোকে রেখে যাই এখানে, আমরা নিচে গিয়ে ফটো তুলব।
চুমকি হেসে বলে—
— আর রাজ ভাইয়া থাকবে পাহারাদার!
রাজ ঠোঁটে একচিলতে হাসি টেনে মুচকি হেসে বলে—
— ম্যাডামের পাহারা দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
আরশ আর মাহির সামনে বসে খুনসুটিতে ব্যস্ত। আরফা আর লাবিব হাসতে হাসতে ভিডিও বানাচ্ছে। পাহাড়ি পথ ধরে চলতে চলতে অবশেষে ওরা পৌঁছায় চন্দ্রধারা ঝরনার ধারে।
ঝরনার জল পাহাড় বেয়ে পড়ছে টুপ টুপ করে, আশপাশে পাথর আর সবুজে ঘেরা এক মায়াবি দৃশ্য। সূর্যের আলো ঠিক জলরাশিতে পড়ছে, যেন ঝিকিমিকি করছে চাঁদের আলোয়।
মেহরিন চোখ বড় বড় করে বলে—
— ইশ! এর নাম চন্দ্রধারা কেন, এখন বুঝলাম। জল তো সত্যি আলোয় চকচক করছে!
রাজ পাশে এসে দাঁড়ায়, হালকা গলায় বলে—
— তোমার চোখের আলোয় ও তো কিছু কম না এই ঝরনার সৌন্দর্যের চেয়ে।
মেহবুবা চুপচাপ এ দৃশ্য দেখে হাসে, চুমকি আবার রাজকে খোঁচা দেয়—
—উফ, কবিতার খনি আপনি ভাইয়া!
সবাই হেসে ওঠে।
তারপর সবাই মিলে ঝরনার ধারে বসে, পায়ে জল ছুঁয়ে, ছবি তুলে, গল্প করে, আর পাহাড়ের নীরবতা ও সৌন্দর্য উপভোগ করে— একটা নিঃশব্দ কিন্তু গভীর বন্ধনের মুহূর্ত তৈরি হয়।
ঝরনার ধারে যখন বাকিরা কেউ ছবি তুলছে, কেউ পাথরের ওপর বসে পা ডুবিয়ে রেখেছে, ঠিক তখন মেহরিন একটু দূরে এক বড় পাথরের ওপর বসে ঝরনার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চুলে বাতাস খেলা করছে, মুখে এক রকম প্রশান্তি, কিন্তু চোখে যেনো এক গভীর ভাবনা।
রাজ ধীরে ধীরে পাশে এসে দাঁড়ায়, কিন্তু চুপচাপ। মেহরিন কিছু বলে না, শুধু জানে সে পাশে দাঁড়িয়েছে। একটু পরে রাজ বলে—
“তোমার মনটা ঠিক এই ঝরনার মতো, আরিওনা। বাইরের জলরাশি যতই কোলাহল করুক, ভেতরে কোথাও একটা চিরস্থায়ী প্রশান্তি লুকিয়ে আছে।
মেহরিন রাজের দিকে তাকায় না, কেবল বলে—
কীভাবে বুঝেন এতকিছু?
রাজ হেসে বলে—
ভালোবাসলে মানুষ অনেক কিছু বুঝতে শিখে যায়।
মেহরিন এবার রাজের দিকে তাকায়। চোখে একধরনের কোমল বিস্ময়। রাজ আবার বলে—
তোমার সাথে এই নির্জন জায়গায় আসবো, এমনটা ভেবেছিলাম ঠিক সেই মুহূর্তে, যেদিন তুমি বলেছিলে রাতের সাজেক কেমন দেখতে। তখনই বুঝেছিলাম—তোমার চোখে সাজেক মানে শুধু পাহাড় না, মানে একটা অনুভূতি। আমি চাই, তুমি সেই অনুভূতি আমার সাথেই খুঁজে পাও…
মেহরিন চোখ নামিয়ে ফেলে, গাল লাল হয়ে উঠছে। তারপর একটুখানি হাসে, কিন্তু তার হাসিতে লজ্জা, প্রশান্তি আর ভালোবাসা সবই মিশে থাকে।
ঠিক তখনই পেছন থেকে চুমকির চিৎকার—
হাই হাই! দেখ চুমকি দ্য স্পাই এসেছে! কবি সাহেব আর ম্যাডাম প্রেমালাপ করছেন!
মেহবুবা হেসে চুমকিকে বলে—
চুপ! দাও ওদের একটু মূহূর্ত… কিন্তু একদম সিনেমার সিন চলছে ওখানে!
রাজ হেসে বলে—
সিনেমা নয় মহারানীগন, জীবনটাই গল্প হয়ে গেছে।
সবাই মিলে আবার হেসে ওঠে। আর মেহরিন চুপচাপ রাজের দিকে একবার তাকিয়ে নেয়—একটা গভীর বিশ্বাস নিয়ে।
ঝরনার ধারে হেসে খেলে সময় কাটানোর পর সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তোলার জন্য জড়ো হয়। পাথরের পাশে, ঝরনার পেছনে সবুজ পাহাড়, আর চারদিকে পাখির ডাক—একদম স্বপ্নের মতো একটা পরিবেশ।
মেহবুবা বলে,
ঠিক মতো দাঁড়াও সবাই! আরফা তুই মাঝখানে, মেহু সামনে বসো, রাজ ভাইয়া একটু পেছনে যাও, ছায়া পড়ছে!
লাবিব একটু বিরক্ত মুখ করে বলে,
আরে বাহ! আমি কী চুনোপুঁটি নাকি? আমাকেও মাঝখানে দাও!
মেহবুবা চোখ গোল করে বলে,
তুমি মাঝখানে দাঁড়ালে পুরো ছবি দেখতে কুয়াশা পড়ে যাবে!
মানে?! আমার হ্যান্ডসাম লুকই তো হাইলাইট! – বলে লাবিব গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
চুমকি খিকখিক করে হেসে বলে,
দুইজনের ঝগড়া না হলে দিনটাই অপূর্ণ থাকে!
আরশ ফোটো তুলছে, আরফা এক হাতে ফোন, এক হাতে সানগ্লাস ঠিক করছে, মাহির আবার ক্যামেরার দিকে পোজ দিতে দিতে হঠাৎ পেছনে হোঁচট খেয়ে চুমকির ওপর পড়ে যায়।
চুমকি চেঁচিয়ে ওঠে—
ওহে নায়ক বাবা জি! ড্রামা কমাও।
সবাই একসাথে হেসে ওঠে। ঠিক সেই মুহূর্তেই আরশ ছবি তুলে ফেলে—একটা নিখুঁত মুহূর্ত, হাসির, ভালোবাসার আর বন্ধুত্বের গল্প বলা একটা ছবি।
রাজ আর মেহরিন একটু দূরে, দুজনেই হালকা হাসছে। রাজ কানে কানে বলে,
এই ছবিগুলো হয়তো ফ্রেমে বাঁধানো হবে, কিন্তু আমার স্মৃতিতে বাঁধা থাকবে তুমি…
মেহরিন মুখ গোমড়া করে বলে,
আর এসব সংলাপ বলবেন না তো শুধু ক্যামেরার সামনে, বাস্তবে চুপ!
রাজ হাসে।
তাদের পিছনে আবার শোনা যায়—
আবার ফটো! আরেকটা, সবাই জাম্প করো এবার!
আর রাজ-মেহরিন, মেহবুবা-লাবিব, চুমকি-মাহির, আরফা-আরশ… সবাই মিলে একসাথে উল্লাসে এক ঝলক জাম্প করে—ঝরনার শব্দে মিশে যায় তাদের সেই মুহূর্তের হাসি।
দিনের আলো আস্তে আস্তে কমে আসছে। সাজেকের পাহাড়ি বাতাসে একটা হালকা শীত মিশে গেছে। সবাই যার যার ঘরে একটু রেস্ট নিয়ে বের হতে শুরু করেছে। আকাশের ওপরে রঙ বদলে যাচ্ছে—কমলা, লাল আর হালকা নীলের এক অপূর্ব মিশ্রণ।
চুমকি আর আরফা বাইরে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে, মাহির আর আরশ মজা করে কার কার ক্যাম্পফায়ারে সবচেয়ে সুন্দর গলা বাজবে সেই নিয়ে বাজি ধরেছে।
কিন্তু মেহরিন তখনও একটু চুপচাপ। করিডোরের কিনারায় বসে সূর্য ডোবার দৃশ্য দেখছে। চোখে সেই পুরোনো স্বপ্নগুলোর রঙ মিশে আছে। রাজ ধীরে ধীরে এসে পেছনে দাঁড়ায়।
ম্যাডাম, আমি ভেবেছিলাম তোমার মুখটা শুধু রোদে ঝলমল করে, এখন দেখি সন্ধ্যাবেলায়ও আলাদা একটা জ্যোতি আছে।—রাজের কণ্ঠে হালকা মজা, কিন্তু চোখে গভীরতা।
মেহরিন হেসে বলে,
সন্ধ্যা মানেই তো অন্ধকার শুরু স্যার… তার আগেই একটু আলো জমিয়ে রাখি মনে হয় বুঝলেন স্যার।
রাজ মুচকি হেসে বসে পড়ে ওর পাশে, একটু দূরে—তবু যেন খুব কাছেই।
তোমার ভেতর এত রঙ থাকে, আরিওনা… আমি একটা করে খুঁজে নিচ্ছি… যত খুঁজছি, তত হারিয়ে যাচ্ছি।
মেহরিন এবার একবার তাকিয়ে থাকে, রাজের চোখে। সেই চোখে আজ কোনো দুষ্টুমি নেই, শুধু একরাশ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। মুহূর্তটা থমকে থাকে, নিঃশব্দে।
ঠিক তখনই দূর থেকে লাবিবের চিৎকার—
কেউ একজন চড়ুই পাখির জোড়াকে বলো, ক্যাম্পফায়ারে না এলে আমরা গান শুরু করে দিচ্ছি!
রাজ উঠে দাঁড়ায়, হাত বাড়িয়ে বলে,
তবে চলুন, ম্যাডাম। এবার তো গানের রাত… আর আপনার সঙ্গে আজ আমার প্রথম গান শোনার মুহূর্ত!
মেহরিন একবার একটু ভেবে ওর হাতটা ধরে নেয়, হালকা হাসে।
পাহাড়ের কোলে সূর্য তখন পুরোপুরি ডুবে গেছে, কিন্তু এক জোড়া চোখে আলো জ্বলছে—নতুন সম্পর্কের আলো।
সবার ঠোঁটে হালকা উত্তেজনার হাসি, গায়ে সোয়েটার বা শাল জড়িয়ে সবাই গোল হয়ে বসেছে কাঠের তৈরি গোল টেবিল ঘিরে। মাঝখানে আগুন জ্বলছে, লাল শিখা নাচছে হাওয়ায় হাওয়ায়। পাহাড়ি ঠান্ডা হাওয়ার মাঝে সেই উষ্ণতা যেন এক আলাদা অনুভূতি।
চুমকি গিটার হাতে নিয়ে বলে,
তাহলে শুরু করি? আজকের মিউজিক্যাল নাইট!
আরফা বলে,
হ্যাঁ, তবে প্রথমে একটা হালকা প্রেমের গান দাও তো চুমকি, দেখি কার কার মনে ঢেউ তোলে!
চুমকি হেসে রাজ আর মেহরিনের দিকে একবার তাকায়, মেহরিন চোখ নামিয়ে ফেলে।
গান শুরু হয়—সবার চোখে তখন আনন্দের ঝিলিক।
“তুমি রবে নীরবে…”
চুমকির কণ্ঠে গান যখন ভেসে আসে, রাজ একপাশে বসে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে থাকে চুপচাপ।
আর মেহরিন? ওর চোখে তখন অদ্ভুত এক চঞ্চলতা, যেনো নিজের অজান্তেই গানটার প্রতিটি শব্দ ওর হৃদয়ে ধাক্কা দিচ্ছে।
গান শেষে মাহির বলে,
এত প্রেম-ভালোবাসা চলছে… কেউ যদি একটু বিয়ে করে ফেলতো, তাহলে আমরাও শান্তি পেতাম! পেট পুরে খাওয়া দাওয়া সাথে আমাদের লাইন টাও ক্লিয়ার হবে।
লাবিব হেসে বলে,
তোর বোন আর আমাদের কবি ভাই তো ধীরে ধীরে ঠিক সেদিকে হাঁটছে।
মেহবুবা হালকা হেসে বলে,
চুপ করে খাবারের দিকে নজর দিন! তা না হলে ঝগড়া লেগে যাবে আবার!
লাবিব মুচকি হেসে বলে,
তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে ঝগড়া করতে মন চায় না… তবে তুমি যা বলবে আমি তাই করব, রাজি?
মেহবুবা মুখ ঘুরিয়ে রাখে, কিন্তু গাল লাল। সবাই হেসে উঠে।
চুমকি বলে,
ওই, ক্যাম্পফায়ারে প্রেম শুরু হলে পাহাড়েও আগুন ধরে যাবে!
আরশ বলে,
আগুন তো আগেই ধরেছে… শুধু প্রকাশের অপেক্ষা!
লাবিব বলে মেহবুবা তুমি একটা গাব বলো না!
মেহবুবা শয়তানি হাসি দিয়ে বলে আচ্ছা আমি আপনার জন্য একটা গান গায় ওকে?
লাবিবের খুশি দেখে কে বলে হে বলো বলো।
মেহবুবা গাইতে শুরু করে,
গুলিস্তানের মোড়ে বইসা বন্ধু বেঁচে পান…
ক্যাসেট বাজাইয়া শুনে মমতাজেরি গান…
তার সাথে বিয়ের কথা হইছে ফাইনাল….
সবাই তারে আদর করে ডাকে জয়নাল….
গান শুনে লাবিবের মুখ টা দেখার মতো ছিলো। বেচারা কত আশা করে ছিলো আর কী করলো এটা.. মেহবুবা ৩২ পাটি বের করে একটা হাসি দিয়ে বলে, কেমন লাগলো হুম !
লাবিব বলে মেহবুর বাচ্চা…… বলেই মেহবুবা কে দৌড়ানি দেয়। মেহবুবা দৌড়ে চলে যায় লাবিব ও ছোটে মেহবুবার পিছনে।
এইসব হাসি-মজার মাঝে রাজ একটু ধীরে উঠে দাঁড়ায়। ওর হাতে ছোট একটা প্যাকেট, সবার উদ্দেশে বলে,
সাজেকে আসার জন্য কার সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব? জানো?
সবাই অবাক।
রাজ মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমাদের মিস ড্রিমার মেহরিন। ওর মুখে প্রথম শুনেছিলাম সাজেকের গল্প। তাই আজকের রাতটা ওর নামে উৎসর্গ করা উচিত, কী বলো?
সবাই বলে,
“হ্যাঁ! হ্যাঁ!”
মেহরিন কিছু বলার আগেই রাজ মেহরিনকে হাতে ছোট একটা কাঠের ব্রেসলেট দেয়, তাতে লেখা—
“স্বপ্নরঙ।”
মেহরিন এক মুহূর্তে থমকে যায়। চোখে জল চলে আসে, কিন্তু সে আড়াল করে নেয়।
রাজ বলে,
“এটা তোমার জন্য। কারণ এই ট্রিপটা স্বপ্নরঙেই রঙিন হচ্ছে…”
সন্ধ্যার আলো তখনো পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। রিসোর্টের বাগানের এক কোণে, গাছগাছালির আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল মেহেরিন। এক হাতে হালকা শাল, চোখে একটা অস্থিরতা—রাজ বলেছিল, “পাঁচ মিনিটে আসছি।” সেই অপেক্ষার পেছনে ছিল যত্নে লুকোনো ভালোবাসা।
বাগানের পাশে ছোট্ট একটা ছায়া-ঢাকা পাথরের বেঞ্চ। বাতাসে ফুলের গন্ধ আর এক ধরনের অজানা কাঁপুনি। মেহেরিন একটু পিছন ফিরে দেখে, কেউ নেই।
কিন্তু ঠিক তখনই…
পেছন থেকে একজোড়া মোটা হাত মুখ চেপে ধরে ওর। মেহেরিন আর্তচিৎকার করতে চাইলেও, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। চোখ বড় বড় করে চারপাশে তাকায়—দুইজন লোক, কালো মুখোশ পরা, নিঃশব্দে ওকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করে পাশের গলিপথে।
মেহরিনের শরীর ধীরে ধীরে ঢলে পড়ে—চেতনা হারাচ্ছে। একজনে পকেট থেকে বের করে ছোট একটা ইনজেকশন—এক মুহূর্তেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে মেহরিনের দেহ।
ওরা শব্দহীনভাবে হেঁটে চলে যায় বাগানের পাশের একটা কালো গাড়ির দিকে।
ঠিক তখনই রাজ রিসোর্টের রিসেপশনে এসে জিজ্ঞেস করে—
এখানে একজন ছিলো ওনি কোথায়?
রিসেপশনিস্ট বলে—
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২২
ওনি তো কিছুক্ষণ আগে বাগানের দিকে গিয়েছিল, স্যার।
রাজ দ্রুত বেরিয়ে আসে বাইরে। বাগানে এসে চারপাশে তাকায়—কেউ নেই।
কিছু একটা অস্বাভাবিক ঠেকে তার।
বেঞ্চের পাশে মাটিতে পরে থাকা একটা সাদা শালের কোণা…
রাজের চোখ এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায়। তারপর দৌঁড়ে ছুটে যায় শালের দিকে।
“মেহেরিন?”
চিৎকার করে ওঠে রাজ।