মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৪

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৪
মির্জা সূচনা

“মেহরিন”
রাজের তীব্র, কষ্টভরা চিৎকারে দৌড়ে আসে চুমকি, মেহবুবা, মাহির, আরফা, আরশ ও লাবিব।
—কি হয়েছে রাজ ভাইয়া?মেহবুবার কণ্ঠ কাঁপছিল।
— মে *মে*মেহরিন… এখানে ছিল, আমি অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। কিন্তু এখন নেই… কোথাও নেই! রাজের কণ্ঠ ভেঙে পড়ে।
চুমকি এক দৌঁড়ে যায় বাগানের শেষ প্রান্তে।
মাহির চোখ বড় বড় করে বলে, আপু তো বলেছিল এখানেই থাকবে!
রাজ মাটিতে পড়ে থাকা শালটা তুলে ধরে—
এটা ওর।

এক মুহূর্তে পুরো পরিবেশ বদলে যায়। লাবিব তখনই ফোন বের কাউকে কল করে বলে,—
“তাড়াতাড়ি লোক পাঠাও, আমার বোনকে কেউ কিডন্যাপ করেছে। রিসোর্টের বাইরের খোজ লাগাও, আশে পাশে খুজো সিসিটিভি ফুটেজ ঘেঁটো ফাস্ট। ১০ মিনিট এর ভিতর কোন গাড়ি বেরিয়েছে কিনা খোঁজ করো। ৫ মিনিটের মধ্যে আমার সকল ইনফরমেশন চাই।
আরশ রাজকে শক্ত করে ধরে, তুই ঠান্ডা হ ভাই, খুঁজে পাবো।
কিন্তু রাজ যেনো নিজের শরীরেই নেই—চোখে রাগ, ভয়, এবং নিজের ওপর অপরাধবোধ।
আমি পাঁচ মিনিট দেরি করলাম… আর এই পাঁচ মিনিটেই…!
সে পাগলের মতো ছুটে যায় রিসোর্টের চারপাশে—জঙ্গলের দিকে, রাস্তার দিকে, গেটের পাশে। সবার কণ্ঠ তখন একটাই—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মেহরিন!
চুমকি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
কোথায় গেলি মেহু? কে নিলো ?আমাদের তো কোন শত্রু নেয়।
মেহবুবা আর আরফা কান্না করছে।
আকাশে মেঘ জমে আসছে।
হাওয়া ভারী হয়ে উঠছে।
আর রাজ দাঁড়িয়ে আছে রিসোর্টের গেটের সামনে, নিজের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে শুধু একটা কথাই বলছে—
আমি খুঁজে আনবো বের করবোই তোমায় আরিওনা। এই রাজের দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে,তোমার শরীর একটা আচর ও পরতে দিবা না। কিছু সময় নিজেকে সেভ করো আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে পৌঁছাব। আমি শুধু ভালোবাসা জানি না…আমার ভালোবাসার মানুষ কে জয় করতেও জানি। কার এতে বড় সাহস যে আমার এই রাজ শিকদারের কলিজার হাত দেয়?ওর কলিজা আমি জঙ্গলের কুকুর কে খাওয়াবো আই সয়ের।
রাজ যখন মেহরিনের খোঁজে ঘুরছে, তখন হঠাৎ তার চোখ পড়ে একটি জুতার ওপর।

এটা মেহরিনের জুতা, জুতা দেখে রাজের হৃদয় মুচড়ে ওঠে। সে চুপচাপ এগিয়ে যায়, এবং সেখানে কিছু দূর থেকে একটি কার্ড দেখতে পায়। রাজ হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে সেটি তুলে নেয়।
কার্ডটি খোলার পর রাজ দেখে, তাতে কিছু লেখা ছিল:
তোমার প্রিয় একজনকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি। যদি তাকে ফিরে চাও, তাহলে আমাদের শর্ত মেনে চলতে হবে।
রাজের রাগ তীব্র হয়ে ওঠে, কিন্তু সে বুঝতে পারে যে, সময় নষ্ট করা যাবে না। মেহরিনকে ফিরে পেতে তাকে যা করা উচিত, তা করতে হবে।
সে অবিলম্বে লাবিবকে ফোন করে, এটা একটি ট্র্যাপ, মেহরিন আমাদের আশে পাশেই কোথাও আছে। কিছু একটা হচ্ছে। সিসিটিভি ফুটেজ চেক কর লাবিব ফাস্ট।
রাজ তখন নিজে প্রস্তুত হয়ে বলে, চিন্তা করো না আরিওনা খুব তাড়াতাড়ি তোমার কবি সাহেব তোমার কাছে পৌঁছাবে বিশ্বাস রাখো।
সে আবার একবার চোখ বন্ধ করে মেহরিনের মুখ মনে করে, যেনো তাকে সঙ্গী করার শক্তি পায়।

অন্যদিকে,
ধীরে ধীরে মেহরিনের চোখ খুলতে শুরু করে। প্রথমে ঝাপসা লাগছিল চারপাশ, মাথাটা ভারী মনে হচ্ছিল। কপালের পাশে যন্ত্রণা হচ্ছিল, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল কিছু একটা দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরা হয়েছিল।
সে চোখ খুলে আশেপাশে তাকায়। একটা ঘর—নতুন, পরিচ্ছন্ন, কিন্তু অপরিচিত। দেয়ালে ঝোলানো একটা পেইন্টিং, জানালাগুলো বন্ধ, আলো হালকা হলুদ হয়তো ডিম লাইট জালানো—একটা গুমোট ভাব।
হঠাৎই সবকিছু মনে পড়ে যায়। বাগানে দাঁড়িয়ে রাজের জন্য অপেক্ষা, তারপর হঠাৎ পিছন থেকে কেউ মুখ চেপে ধরে… আর কিছু মনে নেই।
মেহরিন হঠাৎই আতঙ্কে বিছানা থেকে উঠে বসে, দরজার দিকে ছুটে যায়।
সে দরজায় ধাক্কা দেয়, চিৎকার করে ওঠে,
কে আছো! দরজা খোলো! আমাকে এখান থেকে বের হতে দাও! কেউ আছো?আমাকে এখানে কেনো আনা হয়েছে? খোলো?

তখনই দরজার ওপাশ থেকে এক মেয়ে আসে—চেহারায় অদ্ভুত রকম শান্ত ভাব।
সে হালকা গলায় বলে,
ম্যাম, আপনি একটু শান্ত হোন। স্যারকে খবর দিচ্ছি, উনি আসছেন আপনার সাথে দেখা করতে।
মেহরিন হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। স্যার? কে স্যার? কী চায় এই লোক?
ভয়ের সঙ্গে জেগে ওঠে একরাশ প্রশ্ন… আর তার মাঝে রাজের মুখটা যেন হঠাৎ মনে পড়ে যায়—একটা শান্তির মতো অনুভূতি বুকের মধ্যে।
চোখে অজান্তেই জল চলে আসে। সে ফিসফিস করে বলল,
কবি সাহেব… তুমি কোথায়?
অন্ধকার ঘরে হালকা হলুদ আলো—চারদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। মেহরিনের বুকের ভেতর ধুক ধুক করছে। জানে না ঠিক কোথায় আছে, জানে না কেন এসেছে, শুধু জানে সে বিপদে পড়েছে। দরজার ও পাশে মেয়েটার কথাগুলো আরও ভয়ের জন্ম দিচ্ছে।

“স্যার আসছেন…”
এই কথাটা মাথায় বাজতে থাকে।
মেহরিন পেছনে তাকায়—ঘরে কোথাও ফোন নেই, জানালাগুলো বাইরের দিক বন্ধ, শুধু একটা ছায়াময় আয়না—যেখানে নিজের বিবর্ণ মুখটা দেখে সে আরও আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।
হঠাৎই বাইরে থেকে দরজার ফুটস্টেপ ভেসে আসে। জুতোর শক্ত আওয়াজ। ধীর পা… কিন্তু ভয়ের মতো ভারী।
মেহরিন ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়, গলার আওয়াজ হারিয়ে ফেলে।
কেট কেট শব্দে… দরজার লক ঘোরে। মেহরিনের নিঃশ্বাস আটকে আসে।
দরজা খোলে ধীরে… আর প্রবেশ করে একজন লোক—চেহারা অচেনা, চোখে হালকা একটা ঠান্ডা হাসি।
সে সামনে এগিয়ে এসে বলে,

মেহরিন, অবশেষে দেখা হলো। এত সহজে তোমাকে পাওয়া যাবো ভাবিনি।
মেহরিন পেছনে সরে যায়, তার হাত বিছানার ধারে রাখা জিনিসপত্রে পড়ে। কিছু একটা খুজছে মেহরিন যা দিয়ে আঘাত করা যায় লোক টা কে কিন্তু কিছু নেই, কিছুই নেই।
লোকটা বলে,
চিৎকার করে লাভ নেই। এখন তোমার প্রিয়জনরা খুঁজছে ঠিকই, কিন্তু সময় এখন আমার হাতে।
এই কথায় মেহরিনের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। সে চিৎকার করে ওঠে,
তুমি জানো না, রাজ আমাকে খুঁজবে… আর ও যখন আসবে…
লোকটা হেসে বলে,

তাই তো… রাজ… দেখা যাক, কে আগে পায় কাকে…
ক্যামেরা বাইরে চলে যায়… রাতের আঁধারে রাজ পাগলের মতো ছুটে চলেছে, হাতে মেহরিনের একটি জুতো আর একটা কার্ড এই কার্ডটা এই মাত্র পেয়েছে রাজ।
কার্ডে একটাই কথা লেখা:
“তোমার ভালোবাসা এখন আমার হাতে… দেখাও কতটা ভালোবাসো তাকে।”
চোখে আগুন, মুখে নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা—রাজ ফিসফিস করে,
আমি আসছি, আরিওনা…
রুমটা নিস্তব্ধ, মেহরিনের বুক ধড়ফড় করছে। ঘড়ির টিকটিকি শব্দটাও যেনো কান ফাটিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় দরজাটা আবার খোলে।

এবার যে লোকটা ঢুকল, তার চেহারায় কোনো ভয় নেই, বরং চোখে গভীর আত্মবিশ্বাস। পরনে ফরমাল ড্রেসআপ, মুখে হালকা দাড়ি, কিন্তু চোখে একরকম স্থিরতা। লোকটা এসে ধীরে ধীরে সামনে বসে।
মেহরিন তাকিয়ে থাকে—লোকটা চেনা নয়, কিন্তু তার আচরণে অদ্ভুত একটা অচেনা পরিচিতি লুকিয়ে আছে।
লোকটা একটা ঠান্ডা হাসি দিয়ে বলে,
তুমি মি. শিকদারের?
মেহরিন কিছুটা থমকে যায়। শিকদার? সঙ্গে সঙ্গে রাজের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে গলা শক্ত করে উত্তর দেয়,

হ্যাঁ… আমি উনার কাজিন।
লোকটা মুচকি হাসে, চোখে একটু চমক নিয়ে বলে,
হুম, কাজিন… বেশ।
তারপর একটুখানি ঝুঁকে এসে বলে,
আমি আসলে আরও কিছু জানতে চাই। শুধুই ‘কাজিন’ হিসেবে নয়, বরং… ‘বিশেষ’ কিছু সম্পর্কে।
মেহরিনের মুখটা থমকে যায়, গলা শুকিয়ে আসে। লোকটার এইভাবে কথা বলাটা ওকে কাঁপিয়ে তোলে। কিন্তু নিজের ভয়টা ওদের সামনে প্রকাশ করে না। বরং আত্মবিশ্বাসের সাথে জোর গলায় বলে,
আপনি কে? কী চান?” মেহরিন সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
লোকটা এবার একটু গম্ভীর হয়। মুখটা কাছে এনে নিচু গলায় বলে,

আমার পরিচয়টা এখনই জানলে মজা থাকবে না, মিস মেহরিন। আগে দেখি… তুমি কতটা জানো মি. শিকদারকে।
একটা ঠান্ডা শিরশিরে হাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। মেহরিন টের পায়, এ খেলা সাধারণ কিছু নয়। ওর ভালোবাসা নিয়ে কেউ এক অদ্ভুত ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।
ঘরটা মুহূর্তে যেনো রূপ পাল্টে নেয়।
মেহরিন এবার আর কাঁপছে না—দুচোখে আত্মবিশ্বাস ও অদ্ভুত আগুনে জ্বলছে। সে ধীরে ধীরে সামনে রাখা চেয়ারটায় পায়ের উপর পা তুলে বসল, যেনো এই ঘরটা এখন তার নিজের এলাকা। চুলগুলো এক ঝটকায় কাঁধের পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
আপনারা তো দেখছি আমাকে চিনেন, আমার নামও জানেন। আবার মি. শিকদারকেও চেনেন—সেটা বেশ। ওসব ঘুরপাক কথা বাদ দিন। আসল কথা বলুন—

আমি এখানে কেন? আমাকে আপনারা ধরে এনেছেন কেন?
ঘরে দুজন লোককে অবাক হয় মেহরিনের ব্যবহারে দুজন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।
লোকটা প্রথমবারের মতো গলা পরিষ্কার করে। তার ঠোঁটে আর সেই আগের আত্মবিশ্বাসী হাসি নেই। চোখেমুখে একটু ধরা পড়ার ভয়।
সে বলে,
তোমার মতো মেয়ে… মানে, আমি ভাবিনি আপনি এতটা… শক্ত হবেন। তুমি একলা একটা মেয়ে এখানে আমরা দুজন পুরুষ একটুও ভয় পাচ্ছো না?
মেহরিন ঠাণ্ডা গলায় বলে,

ভেবেছেন এক মেয়েকে চোখ বেঁধে আনবেন, আটকে রাখবেন আর ভয় দেখিয়ে জিজ্ঞেস করবেন রাজ শিকদার কে? আর আমি গুটিসুটি মেরে বলবো—’ভাইয়া বাঁচান?
মেহরিন একটু ঝুঁকে এসে বলে,
ভুল মানুষ বেছে নিয়েছেন, মিস্টার।
লোকটা এবার একরকম নড়ে উঠে বসে। এত দৃঢ়তা সে আশা করেনি। কিন্তু মুখে শেষ চেষ্টা করে বলল,
তুমি কি জানো, তুমি যাকে বিশ্বাস করো, সে কী লুকিয়ে রেখেছে?
মেহরিনের চোখ এবার সরু হয়ে আসে।
মেহরিন নিচু গলায়, শীতল স্বরে বলে,

আপনি কি জানেন, আমি কী করতে পারি, যখন কেউ আমার প্রিয় মানুষদের নিয়ে বাজে খেলায় নামে?
কি ভেবেছিলেন আমি অবলা নারী আমাকে আটকে রাখবেন ভয় দেখাবেন আর আমি ভয় পাবো?
একটু হেসে আবার বলে,
আমি সেই মেয়ে নই! যে আমার উপর অত্যাচার অবিচার করবেন আর আমি মুখ বুজে তা সহ্য করবো।
মেয়েরা মায়েরজাত যেমন আপনাদের মতো কা-পুরুষদের পৃথিবীর আলো দেখাতে পারে, যেমন স্বামীর সংসার বাচ্চা সামলাতে করতে পারে,ঠিক তেমনি প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে দিতেও জানে।

আর আমি হলাম সেই মেয়ে,নরমের সাথে নরম, গরমের সাথে গরম। আমি নরম মাটি নই যে, পায়ে পিছে চলে যাবেন। আমি হলাম চোরাবালি,একবার আমার উপর পা দিলে ধ্বংস করে ফেলবো! পাতালে নিয়ে যাবো বেঁচে ফেরার রাস্তা দিবো না।
ঘরের হাওয়া যেনো জমে বরফ হয়ে যায়। লোক দুজন এবার মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
রুমের আলো যেনো একটু কমে আসে, বাতাসটাও থমথমে হয়ে ওঠে। লোকটা নীরবে মোবাইল বের করে একটা এসএমএস পাঠায়—তীক্ষ্ণ নজরে মেহরিনকে লক্ষ্য করতে করতে। তারপর মোবাইলটা পকেটে রেখে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে তার দিকে।
হঠাৎই মেহরিনের মাথায় ঠেকিয়ে দেয় ধাতব ঠান্ডা এক বন্দুক। চোখে তীক্ষ্ণতা, ঠোঁটে বিজয়ের হালকা হাসি।
লোকটা চাপা গলায় বলে,

এইবার কী করবে, অগ্নিকন্যা ?
তোমার মাথার ওপর বন্দুক। ভয় করো মেয়ে, ভয় করো। একটা টিপেই ওপরে চলে যাবে—জানো তো?
মেহরিন প্রথমে থমকে যায়, একটা মুহূর্তের জন্য যেনো ভয় ছুঁয়ে যায় তাকে। কিন্তু ঠিক তারপরেই…
তার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক চেনা, কিন্তু অচেনা রকমের দুষ্টু হাসি। চোখে ঠাণ্ডা বিদ্রুপ। চোখ তুলে সামনে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে এক চোখ টিপে দেয়।
লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
তুমি… হাসছো? ভয় পাচ্ছো না?
ঠিক তখনই ঘটল এক ঘটনা ।
মুহূর্তের মধ্যে মেহরিন সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে অবাক করে দিয়ে বলে বো***
বলেই ঝুঁকে নিজের দিকে বন্দুক ধরে রাখা লোকটার পেটে ঠেসে দেয় একটা গুতা। লোকটা আচমকা এমন হওয়ায় কুঁকড়ে যায়।

বন্দুকটা তার হাত থেকে ছুটে পড়ে মেহরিন তা তুলে নেয় হাতে।
এবার মেহরিন বন্দুকটা উল্টে ধরে লোকটার কপালে ঠেকিয়ে দেয়।চোখে আগুন।
এখন… কে যাবে ওপরে? হুম? বলুন তো? চাইলেই ট্রিগার টিপে দিতে পারি। আপনি একটু ঘুরে আসবেন নাকি উপর থেকে? আপনি চাইলে রকেট ছারাই আপনাকে চাঁদ এ পাঠাতে পারি যাবেন তাই না?
লোকটা এখন আর কিছু বলতে পারে না। চোখে বিস্ময় আর ভয়, আর একরাশ অপ্রস্তুতি। মেহরিন ধীরে ধীরে বলে ওঠে—
“ভুল করে ফেলেছেন। আমাকে শিকারের মতো ধরে, ভেবেছেন আমি দুর্বল অসহায়। কিন্তু আপনি জানেন না, আমি আসলে কী হতে পারি। আপনি তো বলেছিলেন ভয় করো মেয়ে, ভয় করো… এখন আমি বলি, ভয় পেতে শিখুন। সব মেয়ে দুর্বল নয়…”

রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা।
রুমটা থমথমে। বাতাস যেন থমকে গেছে।
মেহরিন দাঁড়িয়ে আছে একদম নিঃশব্দে, চোখে তীব্র আগুন। হাতে ধরা বন্দুকটা ঠেলে রেখেছে সামনের লোকটার কপালে। আরেকজন পেছনে দাঁড়িয়ে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, গলা দিয়ে শব্দই বের হচ্ছে না।
দুজনের শরীর কাঁপছে, মনে হচ্ছে মাটি যেনো হঠাৎই সরে যাচ্ছে পায়ের নিচ থেকে।
ঠিক তখনই—
“ঠাস!” করে দরজা খুলে যায়।
ভেতরে ঢোকে রাজ আর লাবিব। দুজনেই গম্ভীর মুখে একঝলক চারপাশ দেখে নেয়। মেহরিনকে দেখে রাজের ঠোঁটে হঠাৎ এক চাপা হাসি খেলে যায়।
লাবিব বলে, ও মাই গড…
রাজ কপালে আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে বলে,

আরিওনা,ওটা নামাও ওদের শিক্ষা হয়ে গেছে ছেড়ে দাও! ওরা আমার বন্ধু! প্রাঙ্ক করছিল শুধু।
মেহরিন ধীরে ধীরে চোখ সরায় রাজের দিকে। ঠোঁটে এক রহস্যময় দুষ্ট হাসি।
প্রাঙ্ক? তাও আমার সাথে! আপনি হয়তো জানেন আমি কেমন প্রেজেন্ট রেসপন্স দিই, তাই না বকি সাহেব?
তারপর সে হালকা ভঙ্গিতে বন্দুকটা নামিয়ে নেয়।
ওই দুই লোক যেন জীবনের সব অক্সিজেন একসাথে টেনে নেয়।
রাজ দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে মেহরিন কে,মেহরিন প্রথমে অস্বস্তি বোধ করলেও যখন ফিল করল রাজের হার্টবিট অনেক বেশি জোরে বিট করছে তখন সেও জড়িয়ে ধরল।
তখন লাবিব,কাশি দিয়ে ওদের মনোযোগ আকর্ষণ করল। দুজনেরই মনে পড়লো তারা কোথায় একে অপর কে ছেড়ে দাঁড়ালো।

উফ্…আর একটু হলে স্ট্রোক করতাম ভাই!– পেছনের লোকটা কাঁপা গলায় বলে।
আরেকজন তো দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ে, মা গো… বাঁচলাম।
লাবিব হেসে গড়াগড়ি খায়।
ভাই রে ভাই! লাইক সিরিয়াসলি মেহু আপু একাই তোমাদের দুজনকে কিস্তিমাত করে দিল। জিও সিস্টার, এই না হলো আমার ব্রো’র ম্যাডাম! আর যাই করো, ওরা হয়তো আর কখনো প্র্যাঙ্ক করো না।
রাজ মেহরিনের পাশে দাঁড়ায়, এক হাতে আগলে নেয় চোখে প্রশ্রয় আর গর্ব মেশানো হাসি।
আর ইউ ওকে ম্যাডাম?
মেহরিন মাথা নারে।

লোক দুজনের মধ্যে একজন বলে,
তুমি তো সত্যি… বিপজ্জনক সুন্দরী।
মেহরিন হালকা চোখ টিপে বলে,
বিপদে না পড়লে সেটা কেউ বোঝে না!
রুমে হালকা হাসির রোল ওঠে, কিন্তু ও দু’জন এখনো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে—জড়সড়, কাঁপা কাঁপা।
আর না ভাই,আর কোন মেয়ের সাথেই প্র্যাঙ্ক করবো না কসম করে বলছি…
রুমের পরিবেশটা একটু শান্ত হতেই রাজ মৃদু হাসে।
কাউসার হোসেন আর জীবন সরকার—রাজের দুই পাগলাটে বন্ধু—এগিয়ে এসে রাজকে জড়িয়ে ধরে।
কাউশার হাফাতে হাফাতে বলে,
ভাই… ভাইরে ভাই! কী মেয়ে পছন্দ করছিস রে রাজ! তোর ম্যাডাম তো পুরাই অগ্নিকন্যা!
জীবন চোখ বড় বড় করে বলে,

বিস্বাস কর ভাই, আর দুই মিনিট দেরি করলে আমি গুলিতে না মরে স্ট্রোক করে মরতাম! জানিস না রে রাজ কি অ্যাটিটিউডের সাথে যে সব সামলালো এভাবে কেউ চুল ছেড়ে চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে বন্দুক তাক করে রাখে নাকি! আর যেভাবে কথা বলে “ও মাই গড”।
কাউসার হোসেন বলে, যেমন দেবা তেমন দেবি! একজন সাইলেন্ট কিলার। আরেকজন বাইল্যান্ড কিলার। একদম খাপে খাপ মনসুরালীর বাপ।
রাজ হেসে উঠে, একহাতে ওদের দু’জনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
বলেছিলাম না…আমার ম্যাডাম আলাদা কিসিমের মেয়ে। একবার হিট হয়ে গেলে কেউ বাঁচে না।
কাউশার চোখ বড় করে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
কেউ না জানুক, আমরা জানে গেছি তোর ম্যাডাম কতটা ডেঞ্জারাস। এখন থেকে ওনি যেটা বলবেন ঠিক সেটাই করবো।

মেহরিন ঠোঁট চেপে হেসে বলে,
এই সাহস নিয়ে আপনারা আমাকে তুলে আনলেন, আমি শুধু ভয় পাই না, ভয় দেখাতেও জানি। আসলে প্রবলেম আপনাদের না এতদিন দুর্বল নারী দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে গেছে আপনাদের, তাই আমার মত মেয়েকে সহ্য করতে একটু কষ্ট হচ্ছে।
জীবন: হু! ভাই রে ভাই, প্র্যাঙ্ক করতে গিয়ে নিজের জীবন চলে যাচ্ছিল… আপির সামনে চুপচাপ থাকাই ভালো।
তাদের কথা শুনে রাজ, লাবিব আর মেহরিন সবাই হেসে ওঠে।
এই হাসির মাঝে রাজের চোখে মেহরিনের জন্য এক নতুন রকম গর্ব, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার ঝিলিক দেখা যায়।
তখন মূলত জীবন এসএমএস করে বলে দিয়েছিলো মেহরিন কোথায় তাই রাজ আর লাবিব সবাই কে রিসোর্টে রেখে তাড়াতাড়ি এখানে চলে আসে ।

রাজ রা আবার সবাই সেই রিসোর্টে ফিরে আসে সাথে কাউসার এর জীবন এসেছে।
রিসোর্টের বাগান পেরিয়ে একটু নীচু পথ ধরে হাঁটছে রাজ আর মেহরিন। সবাই ভেতরে ব্যস্ত, আর চারপাশে কুয়াশার মতো নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে। ঝিঁঝিঁ পোকার মৃদু ডাক, পাতার নড়াচড়া আর এক অন্যরকম নিস্তব্ধতা।
রাজ হঠাৎ থেমে যায়।
“আরিওনা…”
মেহরিন তাকায় আর ছোট করে বলে, হুম?
রাজের চোখে গভীর কিছু, গলার স্বর শান্ত—

আজকের ঘটনায় আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। মনে হচ্ছিল… যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো… আমি কিছু করতে পারতাম না।আমার নিজেকে খুব হেল্পলাইন্স লাগছিলো, বারবার মনে হচ্ছিল আমি তোমাকে সেভ করতে পারিনি।
মেহরিন একটু চমকে তাকিয়ে থাকে। রাজ ধীরে ধীরে তার হাত ধরে।
তুমি শুধু সাহসী না, তুমি আমার শান্তির কারণ, মেহু। আজকে যখন তোমাকে ঐরকম দেখলাম… আমি আবার নতুন করে তোমায় চিনলাম। ভালোবাসলাম। আরও গভীরভাবে।আমি জানি তুমি খুব সাহসী তুমি নিজেকে সেভ করতে পারো।তারপর আমার খুব ভয় হচ্ছিল বারবার মনে হচ্ছিল তোমাকে যদি হারিয়ে ফেলি আমি তো মরেই যাবো।আমার কেউ নেই মেহরিন বাবা -মা ভাই -বোন। এখন তুমিও যদি হারিয়ে যাও আমি কি নিয়ে বেঁচে থাকব।
মেহরিন নিচু স্বরে বলে,

আমি আছি, আর থাকবো।পৃথিবী একদিকে আর একদিকে যদি আপনি থাকেন আমি আপনাকে বেছে নিবো।আমি আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আপনার সাথে থাকবো। এই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কথা দিলাম আমি আপনাকে।
রাজ হালকা করে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় এক নরম চুমু।
চারপাশে সন্ধ্যার আলো জমে উঠছে, দু’জন মানুষের হৃদয় যেনো আরও একটু কাছাকাছি চলে এলো।
রিসোর্টের চারপাশে বাতাসে শীতের নরম ছোঁয়া, আকাশ জুড়ে তারার মেলা। এই নিস্তব্ধ রাতে রাজ আর মেহরিন খুব সুন্দর একটা মুহূর্ত।

রাজ এক হাতে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলে,
আমি যদি তোমায় কোথাও নিয়ে যেতে চাই… তুমি যাবে?
মেহরিন একটু থমকে, চোখে মুগ্ধতা মাখিয়ে বলে,
হুম… আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন আমি সেখানেই যেতে রাজি।
রাজ হঠাৎ করে ওকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তারপরে কপালে একটুকরো নরম চুমু এঁকে দিয়ে বলে,
তাহলে চলো…
দু’জন ধীরে ধীরে রিসোর্টের পেছনের গেট পেরিয়ে হেঁটে চলে যায়। পথটা নির্জন, গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো পড়ে রূপোলি ঝিলিক ফেলছে।
কয়েক মিনিট পর হঠাৎ রাজ থেমে যায় এক পুরনো গোডাউনের সামনে। মেহরিন কপালে ভাঁজ ফেলে তাকায়।
এখানে কেন?

রাজ মুচকি হেসে বলে,
একটু ধৈর্য ধরুন ম্যাডাম…
হঠাৎ গোডাউনের পাশ থেকে একটা কালো ঘোড়া বেরিয়ে আসে, মাথায় একটা হালকা ফুলের মালা বাঁধা। ঘোড়ার পিঠে দুজনের বসার মতো জায়গা করা।
মেহরিন বিস্ময়ে তাকিয়ে বলে,
ঘোড়া? আপনি এটা কবে…!
রাজ হাসে,
তোমার জন্য চাঁদের আলোয় ঘোড়ায় করে পথ পেরোনোর একটা স্বপ্নের অংশ রাখতে চেয়েছিলাম। এখন সময় হয়েছে সেটা শুরু করার।
মেহরিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখে জল চিকচিক করে ওঠে, হালকা করে বলে—
এটা একেবারে… রূপকথার মতো। জানেন আমার এমন একটা মূহুর্তের খুব শখ।আমি প্রায়ই স্বপ্নে দেখতাম, আমার রাজকুমার আমায় নিয়ে ঘোড়ায় চরে তার রাজ্যে নিয়ে যাচ্ছে।
রাজ মেহরিনের কানের কাছে এসে বলে,আই নো এভরিথিং।
তার পর রাজ হাত বাড়িয়ে বলে,

তাহলে রূপকথার রাজকুমারীর মতো হাতটা দাও, প্রিন্সেস…
মেহরিন হাস মুখে হাত বাড়িয়ে দেয়, রাজ ওকে সাহায্য করে ঘোড়ায় উঠতে। এরপর ও নিজেও উঠে বসে, দুজন পাশাপাশি। ঘোড়ার চিৎকার, রাতের আকাশ-বাতাস আর দুজনের নিঃশব্দ ভালোবাসায় শুরু হয় এক নতুন রাত্রিকালীন যাত্রা… এক অনন্ত গল্পের দিকে।
রাত আরও গভীর, কিন্তু সেই গভীরতাকে ছাপিয়ে যেনো আলো ছড়িয়ে পড়ছে রাজ আর মেহরিনের চারপাশে।
ঘোড়ার টকবক ছন্দে ওরা উঠে এসেছে এক পাহাড়ি পথ পেরিয়ে এক নির্জন, মোহময় জায়গায়।
চাঁদের আলোয় ঝিরঝির করে পড়ছে এক পাহাড়ি ঝরনা। চারপাশে গাছেরা নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে, পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝিকমিক করছে শত শত জোনাকি পোকার আলো। যেনো আকাশের তারা মাটিতে নেমে এসেছে। ঝরনার পানির শব্দ আর জোনাকির নাচ মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক স্বপ্নঘেরা সুর।
মেহরিন ঘোড়া থেকে নেমে চারপাশে তাকিয়ে থমকে যায়। চোখ বড় বড় করে বলে,
এইটা… এইটা কি সত্যি? কবি সাহেব… নাকি আমি সপ্নে দেখছি, এই জায়গাটা তো…আমার সপ্নের থেকে ও সুন্দর একদমরূপকথার মতো…

তারপর হঠাৎ আবেগে ভেসে এসে রাজকে জড়িয়ে ধরে। গলায় এক শিশুর আনন্দ মিশিয়ে বলে—
থ্যাংক ইউ! থ্যাংক ইউ সো মাচ, এত সুন্দর একটা জায়গা দেখানোর জন্য!
রাজ মৃদু হেসে বলে,
তোমার চোখে এই জায়গাটাই সবচেয়ে সুন্দর লাগছে কিন্তু আমার কাছে এই জায়গার থেকে ও বেশি সুন্দর লাগছে তোমার এই হাসি।
মেহরিন এবার নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে যায় ঝরনার দিকে। পাথরের উপর দাঁড়িয়ে দু’হাত মেলে ঘুরতে থাকে, যেনো এই নিস্তব্ধ রাতের রাণী সে।

কবি সাহেব! দেখুন না কত সুন্দর… এত জোনাকি আমি জীবনে দেখিনি!
সে হেসে হেসে ছুটে চলে গাছের ফাঁকে জোনাকিদের আলোয় ভেসে থাকা পথে।
রাজ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেহরিনের সেই খুশির ঝলকানিতে তার মন ভরে যায়।
তারপর সে নিজেও হেসে উঠে বলে,

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৩

দাঁড়াও, আমি আসছি প্রিন্সেস!
দৌড়ে যায় মেহরিনের পেছনে। ঝরনার কুয়াশা, জোনাকির আলো, আর তাদের দৌড়ে চলা পদচিহ্ন—এই নিঃশব্দ জায়গাটাকে পূর্ণ করে তোলে এক অসমাপ্ত প্রেমকথায়।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৫