মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৫
মির্জা সূচনা
ঝরনার পাশে এসে মেহরিন থামে। কুয়াশাভেজা বাতাসে তার চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। রাজ ধীরে ধীরে পাশে এসে দাঁড়ায়। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু ঝরনার শব্দটা যেন ভিতরকার আবেগগুলোকে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
মেহরিন নিচু গলায় বলে,
“কবি সাহেব, জানেন… এত সুন্দর মূহুর্ত আমি শুধু গল্পেই পড়েছিলাম… ভাবিনি কেউ আমাকে এভাবে এত আপন করে, এত নিখুঁত করে আমার স্বপ্ন পূর্ণ করবে।”
রাজ একটু চুপ থেকে বলে,
তোমাকে নিয়ে আমার সবকিছুই নিখুঁত মনে হয় আরিওনা… কারণ তুমি আছো বলেই,আমার পৃথিবিটার প্রতি এখনো মায়া আছে বেঁচে থাকার তাগিদ আছে! মানে পেয়েছি আমি নতুন করে বাঁচার।
মেহরিন রাজের চোখে চোখ রেখে বলে,
কখনও কি ভয় করেন? আমি যদি হারিয়ে যাই… যদি আর না থাকি…
তার গলায় কাঁপন।
রাজ এক হাত বাড়িয়ে মেহরিনের মুখের চুলগুলে সরিয়ে দেয়। তারপর বলে,
ভয় তো পাই… খুব। কিন্তু জানো, তোমাকে আমি কেবল ভালোবাসি না—আমি তোমার জন্য বাঁচি। তুমি না থাকলে আমি নিজেকেই চিনতাম না। হারানোর ভয় আছে, কিন্তু তোমাকে ভালোবাসার সাহস তার থেকেও বড়।
মেহরিন একটু কাঁপা কণ্ঠে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আপনি না থাকলে আমি বুঝতামি না, আমার বুকের ভেতর এত আবেগ কোথা থেকে আসে… আমি তো এমন ছিলাম না… এমন দুর্বল, এমন আবেগী…তো আমি কখোনও ছিলাম না।
রাজ হাসে, একটু এগিয়ে গিয়ে তার কপালে একটা নরম চুমু দেয়।
তুমি দুর্বল না, ম্যাডাম। তুমি আমার শক্তি। আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর যুদ্ধ তুমি। আমি এই ভালোবাসার কাছে মাথা নত করি, কারণ তুমি আছো তাতে।
ঝরনার শব্দ আরও গভীর হয়ে ওঠে। চারপাশের নিস্তব্ধতায় ওদের নিঃশব্দ চোখাচোখিতে যেনো সময় আটকে যায়।
মেহরিন ধীরে ধীরে রাজের বুকে মাথা রাখে।
আর রাজ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে… যেনো এই রাত্রি আর শেষ না হয় কখনো।
রূপকথার মতো রাত্রিটা যেনো মেহরিনের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
প্রকৃতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ মেহরিন দাঁড়িয়ে আছে এক ঢালু ঘাসে মোড়া পাহাড়ি টিলার উপর। ঝরনার শব্দ পেছনে থেকে আসছে, আর সামনে অসীম আকাশ জুড়ে তারা ঝিকিমিকি করছে আর চাঁদ তার আলো ছড়াচ্ছে ভুবনে। হঠাৎ রাজ ধীরে ধীরে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। মাথা একটু ঝুকিয়ে মেহরিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে যায়।
রাজ ধীরে গলায় বলে,
শুধু এইসব দেখলে হবে ম্যাডাম! আপনার জন্য যে আরো অনেক কিছু অপেক্ষা করছে, চলো তোমাকে আরেকটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাই… শুধু আমাদের জন্য সাজানো।
মেহরিন অবাক হয়ে তাকায়, তারপর একটুও না ভেবে হেসে বলে,
চলুন।
দুজন নীরবে হেঁটে চলে যায়। পাহাড়ি পথ ধরে রাজ মেহরিনকে নিয়ে আসে এক নদীর পাড়ে। রাতের আলোয় নদীর জলে রুপালী চাদেঁর আভা ছড়িয়ে আছে। মাথার ওপরে হাজার তারা, মাঝখানে এক চাঁদ— আর চারপাশে জোনাকি পোকা সব মিলিয়ে যেনো স্বপ্নময় এক দৃশ্য। সেই নদীর ঘাটে বাঁধা আছে একটি নৌকা।
নৌকাটি ফুল দিয়ে সাজানো—গোলাপ, বেলি, গন্ধরাজের মালায় মোড়ানো পুরো কাঠের গায়ে। চারপাশে ছোট ছোট ফানুস ঝুলছে, তার আলো নদীর জলে প্রতিফলিত হয়ে জাদুর মতো এক পরিবেশ তৈরি করেছে।
মেহরিন থমকে দাঁড়ায়, চোখ বিস্ময়ে ভরে ওঠে।
তারপর হঠাৎ রাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ… আজ আপনি আমার এক বিশেষ স্বপ্ন সত্যি করে দিলেন। আমি কখনো ভাবিনি—স্বপ্নেও না—এইরকম কিছু আমার জীবনে হবে।
রাজ হাসে, মেহরিনের মাথায় হাত রাখে।
তোমার এই হাসিটাই আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার, মেহরিন।তোমার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমি সব করতে পারি। বুঝলে ম্যাডাম।
তারপর দুজন ধীরে ধীরে নৌকায় উঠে বসে। চাঁদের আলোয় ঝলমল করে উঠছে চারপাশ। জোনাকি আর ফুলের ঘ্রাণ মিশে যাচ্ছে বাতাসে।
চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু জলের কলকল আর জোনাকিদের মৃদু ঝিকিমিকি আলো। হাওয়ায় মেহরিনের চুল উড়ে যাচ্ছে—রূপকথার রাজকুমারীর মতো লাগছে তাকে।মেহরিন রাজের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে তারপর,
মেহরিন হাসতে হাসতে বলে,
কবি সাহেব!আপনি কী নৌকা চালাতে পারেন?
রাজ চোখ টিপে বলে,
হুম চালাতে পারি… তাও শুধু আপনার জন্য, ম্যাডাম।আপনার জন্য তো সব করতে পারি সামান্য নৌকা চালাতে পারবো না।
এই বলে সে চট করে দাঁড়িয়ে বৈঠা হাতে নেয়, নৌকাকে একটু নদীর মাঝে নিয়ে গিয়ে ধীরে থামিয়ে দেয়।
তারপর মেহরিনকে উঠে দাঁড়াতে বলে মেহরিন বিনা বাক্যে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। মেহরিনকে দাঁড় করিয়ে হাতে দেয় একটি ছোট কৌটো—ছোট্ট কাচের বয়াম, যার ভেতরে উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠছে।
মেহরিন বিস্ময়ে বলে,
এটা কী?
রাজ মৃদু গলায় বলে,
তোমার জন্য ধরা কিছু রঙিন প্রজাপতি আর জোনাকি পোকা… এবার ইশারায় বলে,**
খুলে দাও কৌটোটার মুখ।
মেহরিন হাত কাঁপতে কাঁপতে বয়াম খুলে দেয়। মুহূর্তেই উড়ে যায় অসংখ্য প্রজাপতি আর জোনাকি। চারপাশে জ্যোৎস্নার সাথে মিশে এক স্বপ্নময় আলোয় ভরে ওঠে পুরো নদী আর আকাশ।
মেহরিন আনন্দে হাত দুটো ছুঁড়ে বলে,
ওহ মাই গড… কবি সাহেব… এটা তো জাদু… আমি যেনো কোনো পরির দেশে আছি!
রাজ মুগ্ধ নয়নে শুধু মেহরিনকে দেখে যাচ্ছে।
নদীর মাঝখানে ভেসে আছে নৌকাটি নিঃশব্দে। চারপাশে জোনাকির আলো, প্রজাপতির ডানায় জ্যোৎস্নার ছাপ। আর মেহরিন দাঁড়িয়ে আছে নদীর মাঝে সেই রূপকথার রানির মতো, এক হাতে জোনাকির কৌটো, আরেক হাতে স্বপ্নের আলো।
রাত ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় মেহরিনের সামনে তারপর,
রাজ ধীরে ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে। নদীর জলের প্রতিচ্ছবিতে জ্বলছে তার চোখের দীপ্তি। মেহরিনের দিকে তাকিয়ে সে বলে—
এই পৃথিবীতে সবচেয়ে পবিত্র বন্ধন যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা হলো স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন।
জানো আরিওনা,
একজন নারী—একজন স্ত্রীর সৃষ্টি আল্লাহ করেছিলেন একজন পুরুষের পাঁজরের হাড় দিয়ে। বুকের ঠিক কাছ থেকে, হৃদয়ের নিচ থেকে—
তাকে এমন জায়গা থেকে গড়া হয়েছে যেনো তিনি হৃদয়ের কাছেই থাকেন, সম্মানের জায়গায়।
না মাথার উপর থেকে, যাতে শাসন না করেন—
না পায়ের নিচ থেকে, যাতে পদদলিত না হন—
তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে ভালোবাসার জন্য, পাশে থাকার জন্য…
তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে, ভালোবাসায় হারিয়ে যাওয়ার জন্য।
মেহরিনের চোখ জলে ভরে ওঠে। রাজ একটু এগিয়ে আসে, আর বলে—
তুমি আমার জীবনে আলোর মতো এসেছো।
তোমাকে আমি শুধু ভালোবাসতে চাই না,
তোমাকে আমি সম্মান করতে চাই,
তোমার পাশে থেকে জীবনটা কাটাতে চাই।
তারপর এক নিঃশ্বাসে বলে—
So My Moonbeam…
Will you walk beside me in this journey called life?
(তাহলে আমার চাঁদের কিরন…
এই জীবন নামক যাত্রায় তুমি কি আমার পাশে হাঁটবে?)
Will you laugh with me, cry with me, dream with me…
(তুমি কি আমার সাথে হাসবে, কাঁদবে, স্বপ্ন দেখবে?)
Will you marry me?
(তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?)
রাজ তখন হাতে তুলে ধরে হীরের আংটির বক্স। জোনাকির আলো ঠিক তখনই যেনো এক রূপালী বৃত্তে ঘিরে নেয় তাদের।
মেহরিন এগিয়ে এসে রাজকে জড়িয়ে ধরে—তার চোখের জল ঝরে পড়ে রাজের কাঁধে, আর মুখে ফুটে ওঠে সেই চিরন্তন উত্তর:
আমি আপনার স্বপ্ন হবো,
আপনার কল্পনার প্রতিচ্ছবি হয়ে পাশে হাঁটবো সারাজীবন।
আপনার অন্ধকারে আলো হবো, আর আলোর মধ্যে ছায়া।
আপনি যে বন্ধন চেয়েছেন, আমি তাতেই বাঁধা পড়তে চাই… চিরতরে।
Yes Kobi shaheb…
I will marry you.
Not just today, but in every life God blesses me with.
(হ্যাঁ কবি সাহেব…
আমি তোমাকে বিয়ে করবো।
শুধু এই জন্মে নয়,আল্লাহ্ আমাকে যত জীবন দেবেন, সব জীবনেই।)
নিশ্ছিদ্র নীরবতা আর নৌকায় ঝিম ধরা ঢেউয়ের মাঝে সেই রাতটা হয়ে ওঠে যেনো এক স্বপ্নের পৃষ্ঠা…
রাজ ধীরে ধীরে মেহরিনের অনামিকা আঙুলে রিংটা পরিয়ে দিল,তারপর সেই আংটির উপর একটা চুমু খেলো। রিংয়ের হীরেটা জোনাকি আলোয় ঝলমল করছিল, ঠিক মেহরিনের চোখের মতো। মেহরিন এক দৃষ্টিতে রিংটার দিকে তাকিয়ে ছিল—আশ্চর্য, বিস্ময় আর ভালোবাসায় ভরা।
তারপর তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। জোনাকিগুলো যেনো চারপাশে নাচতে লাগলো, বাতাসটা একটু হিম, কিন্তু রাজের বাহুতে মেহরিনের জন্য ছিল সবচেয়ে উষ্ণ আশ্রয়।
রাত গভীর হতে হতে তারা নৌকায় বসেই হারিয়ে যায় এক নিঃশব্দ ভালবাসার বুদবুদে। দূরের আকাশে তারা জ্বলছিল, আর নদীর ঢেউয়ে বাজছিল মৃদু সুর।
মেহরিন রাজের বুকের ওপর মাথা রেখে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে বলল—
“এই রাতটা যেন কখনো শেষ না হয়…”
রাজ তার কপালে আলতো চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল—
তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা রাতই এমন করে চিরকাল থাকুক—স্বপ্নের মতো, শান্তির মতো, ভালোবাসার মতো…
সেই নৌকা, সেই নদী, সেই আকাশ—সবাই সাক্ষী ছিল এক রূপকথার শুরুতে…
চাঁদের আলো মেহরিনের মুখে পড়ে। রাজের বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে থাকা মেয়েটার মুখে এক প্রশান্তির ছায়া। চারপাশের নীরবতা, নদীর ঢেউয়ের মৃদু শব্দ, আর নৌকার দোলায় যেনো একটা পরিপূর্ণ রূপকথা রচিত হচ্ছিল।
এই রাতটা ছিল না কেবল কোনো সাধারণ রাত—এটা ছিল মেহরিনের নিজের তৈরি করা স্বপ্নের মতোই এক ছবি।
মেহরিনের এই রাতটা, সত্যি বলতে—তার নিজের ‘স্বপ্নরঙ’-এর মতোই কেটেছিল।
একটা রূপকথার মতো, একটুখানি জোনাকির আলো, একটু প্রেম, আর চিরদিনের জন্য মনে রাখার মতো একটা মুহূর্ত।”
আর এই রাতের পর, মেহরিনের গল্পে রঙগুলো যেনো আরও গভীর হয়ে উঠলো…
এই রূপকথার মতো মুহূর্তে নৌকার চারপাশে আবার ছড়িয়ে পড়ে জোনাকি পোকার আলো, আর নরম বাতাসে ভেসে আসে নদীর ঢেউয়ের মৃদু সুর। যেনো প্রকৃতিও রাজ-মেহরিনের ভালোবাসায় আশীর্বাদ জানায়।
নৌকার হালকা দোলার মাঝে ধীরে ধীরে শীত শীত অনুভবে রাজের চোখ খুলে যায়। মৃদু আলোয় চোখে পড়ে—মেহরিন তার বুকের উপর গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে, নিঃশ্বাসের তাল মিলিয়ে তার শরীরটাও হালকা কাঁপছে। রাজ হেসে ওঠে, নিঃশব্দে… যেনো হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা এক শান্তির হাসি।
সে হাত বাড়িয়ে মেহরিনের এলোমেলো চুলগুলো স্নেহভরে সরিয়ে দেয়, কপালে একটা আলতো চুমু খায়।
তারপর রাজ আস্তে করে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে—সকাল ৭টা বাজে। চারপাশে আলো ঢুকছে একটু একটু করে। সে হালকা গলায় বলে—
ম্যাডাম, উঠুন। সারা জীবন কি নৌকার উপরে থাকার প্লেন আছে নাকি? রিসোর্টে ফিরতে হবে। সবাই চিন্তা করবে তো।
মেহরিন ঘুম ঘুম কন্ঠ বলে,
উমহু….আর একটু ঘুমাই না প্লিজ।একদম বাচ্চাদের মতো করে বলল কথা টা মেহরিন।
রাজ মেহরিনের বাচ্চামো দিকে হাসে, বুঝলো মেহরিন এভাবে উঠবে না। যে হাতে কাল রাতে আংটি পড়েছিলো সেই হাতটা মুখে সামনে নিয়ে চুমু খেতে থাকে রাজ।
মেহরিন তড়াক করে চোখ খুলে ফেলে,তারপর বলে কি করছেন?
রাজ আরে কিছু মুখে বলে, তুমি তো উঠছিলে না তাই তোমার ঘুম ভাঙালাম।
মেহরিন চোখ মেলে ভালো করে তাকায় রাজের দিকে, হাসে আর বলে—
আর একটু এভাবে থাকতে দেন না। খুব শান্তি লাগছে আমার আপনার বুকের ওপর মাথা রেখে… এমন মনে হচ্ছে যেনো পুরো পৃথিবীটাকে ভুলে যাই।
রাজ তার ঠোঁটে আঙুল তুলে বলে—
শান্তির ঠিকানাটা যদি আমি হই, তাহলে সারা জীবন এভাবেই থাকবেন, ম্যাডাম। এখন উঠুন ম্যাডাম।রিসোর্টে ফিরতে হবে তো নাকি? এতক্ষণে হয়তো আমাদের খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে ।
রিসোর্টে ফিরে সকালটা যেনো এক অন্যরকম উত্তেজনা আর হাসির আবহে ভরে যায়।
মেহরিন আর রাজ যখন ফিরে আসে, তখন সবাই প্রায় টেবিলে বসে নাস্তা করছে। চুমকি প্রথমে ওদের দেখে চিৎকার করে ওঠে—
আল্লাহ! এইবার কোথায় ছিলে তোমরা? সারারাত?
মেহবুবা চোখ টিপে বলে—
আরে চুমকি আপু, মুখ দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে—রূপকথার রাজ্য ছিল দুজন!
মাহির এক গাল হেসে বলে—
রাজ ভাই, আপনি তো একেবারে রোমান্স কিং!বাই দা ওয়ে আপনি তো অনুমতি নেন নাই আমার কাছে! আপনি আমার ভোলা বালা বোনটাকে কি বুঝে নিয়ে গেলেন হ্যাঁ?
রাজ কপাল কুচকে বলে, তোর বোন ভোলা ভালা? তোর বোন এখন এডাল্ট সে নিজের ইচ্ছায় আমার সাথে গিয়েছিল। আর চিন্তা করিস না থেকে ফিরেই তোর বোন সারা জীবনের জন্য আমার কাছে চলে আসবে।
লাবিব হেসে বলে—
আর আমাদের রানী? দেখো তো চোখ-মুখে কেমন রোদের আলো মিশে গেছে!
মেহরিন একটু লজ্জা পায়, কিন্তু রাজ পাশে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত গলায় বলে—
সবাই তো দেখে, কিন্তু সবাই স্বপ্নকে ছুঁতে পারে না। আমি শুধু আমার স্বপ্নটাকে একটু ছুঁয়ে এসেছি।
ততক্ষণে আরফা আর আরশ এসে ওদের দুই পাশে বসে পড়ে।
আরফা কানে কানে বলে—
রাজ ভাই কি হাঁটু গেঁড়ে বসেছিল?
মেহরিন শুধু হাসে, আর চোখে-মুখে জ্বলতে থাকে এক অপার্থিব আলো।
চা-নাস্তার মাঝে, দুষ্টামি, হইহুল্লোড় আর মাঝে মাঝে মেহরিনের দিকে রাজের চোখ—সব মিলে সকালটা ছিল একেবারে পূর্ণতা-ভরা।
এটাই ছিল সেই সকাল—যে সকালে মেহরিন বুঝেছিল, তার ‘স্বপ্নরঙ’ শুধু রাতে নয়, দিনে, আলোতেও ঠিক ততটাই রঙিন।
রিসোর্টের সেই রোদের ঝলমলে সকালে, নাস্তার পর সবাই রোদে পাতা চেয়ারগুলোতে বসে দুষ্টামি করতে শুরু করে। মেহরিন আর রাজ একটু দূরে চুপচাপ বসে, আর ওদের দেখেই শুরু হয় আসল ফাইজলামি।
মেহবুবা হঠাৎ বলে—
এই যে স্বপ্নের রানীমা, একটু বলো তো—ঘোড়া না নৌকা, কোনটায় বেশি ‘ইমোশনাল হেলথ’ ভাল হয়?
সবাই হেসে লুটোপুটি খায়।
চুমকি সাথে সাথে বলে—
আর ঘোড়া? সেটা তো হনহনিয়ে প্রোপোজের সাক্ষী!
মেহরিন লজ্জায় মুখ লুকায় রাজের কাঁধে, আর রাজ চোখ টিপে বলে—
না প্রতিটা জোনাকি সাক্ষী হয়েছিলো।ঘোড়া তো আমাদের গন্তব্যের শুধু পৌঁছে দিয়েছিলো।
এবার শুরু হয় মেহবুবা আর লাবিবের বাচাল যুদ্ধ।
মেহবুবা বলে—
চোখের পলকে আমার বোনকে রাজপংখির মত ঘোড়া দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে গেল, আর আপনি বসে ছিলেন ছাগলের মত। আপনি তো দেখেছিলেন ওদের যেতে তাহলে বললেন না কেন? তাহলে আমরা যেতাম পিছু পিছু দেখতাম ওরা কি করছে।
লাবিব হেসে বলে—
হ্যাঁ আমার তো আর খেয়ে কাজ নেই! ব্রো ওর প্রেমে ব্যাগরা দেয়, আর ব্রো আমাকে চ্যাংদোলা করে ঝুলিয়ে রাখুক।ভুলেই তুমি কি আমার শত্রু হ্যাঁ সব সময় শুধু আমাকে বাঁশ খাওয়ানোর তাহলে থাকো। আমি ছাগল? আপনি তো দাঁড়িয়ে ছিলেন যেনো ‘মালিক’ হয়ে ঘোড়ার লাইসেন্স চাচ্ছেন! আপনি কিছু করলেন না কেন হ্যাঁ। পারেন তো শুধু আমার সাথে খ্যাট খ্যাট করতে।
মেহবুবা তেরে এগিয়ে যায়, কোমরে হাত রেখে বলে কি বললেন আপনি আমি খ্যাট খ্যাট করি?
লাবিব কেবলা হেসে বলে,না গো তুমি খ্যাট খ্যাট করবে কেন! আমি করি আমি আমি।
মেহবুবা হেসে বলে, গুড গুড।
আরশ হেসে বলে—
দুইজনের ঝগড়ায় আবার প্রেমের গন্ধ পাইছি!
আরফা বলে—
চুপ কর, এইবার প্রপোজ নাও একে অন্যকে!
লাবিব বলে অবশ্যই বলেই,
লাবিব একটা খালি কফির কাপ নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে—
মেহবুবা মেম, Will you fight with me forever?
মেহবুবা উত্তর দেয়—
Yes! যতদিন বাঁচি, ঝগড়া করে যাবো!
সবাই হাসিতে গড়িয়ে পড়ে।
রোদেলা সকালের উচ্ছ্বাস ভরা মুহূর্তটা হঠাৎ করেই থমকে গেল…
চুমকির ফোনটা বেজে উঠলো —
স্ক্রিনে ভেসে উঠলো পরিচিত নামটা — “Shanto Calling…”
চুমকির মুখে তখনো এক চিলতে হাসি, কিন্তু চোখের ভেতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠলো।
সে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো… তারপর ধীরে ধীরে ফোনটা কেটে দিল।
চোখের পলকে হাসিটা উধাও হয়ে গেল তার মুখ থেকে।
ফোনটা হাতে নিয়েই হঠাৎ করেই অফ করে দিল।
সবকিছু খেয়াল করছিল মেহরিন।
চুপিচুপি কাছে এগিয়ে এসে হাতে হাত রাখে, কাঁধে মাথা রাখে।
কি হয়েছে রে, চুমকি? এত চুপচাপ কেন? বলবি না আমাকে?কি হয়েছে তোর?খবরদার একদম মিথ্যা কথা বলার চেষ্টা করবি না।
চুমকি প্রথমে কিছু বললো না, শুধু তাকিয়ে রইলো মেহরিনের চোখে… তারপর হঠাৎ করেই মেহরিনকে জড়িয়ে ধরলো।
চোখের জল থামাতে পারলো না আর, কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো —
আমি ভালো নেই রে মেহু… একদম ভালো নেই…
মেহরিন স্তব্ধ। চুমকির কান্নায় বুকটা হু হু করে উঠলো।সব সময় হাসি খুশিতে থাকা মেয়েটা যদি কান্না করে এটা মেনে নেওয়া খুব কষ্টের।
কি হয়েছে রে বল না… শান্ত ভাইয়া কিছু বলেছে তোকে?
চুমকি কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে কাঁদে…
এতদিন হাসিমুখে থাকা চুমকির এমন ভেঙে পড়া দেখে মেহরিনের ভেতরটা কেমন ছিঁড়ে যাচ্ছে।
সে চুমকির পিঠে হাত রেখে আস্তে আস্তে বলে —
সব ঠিক হয়ে যাবে রে… তুই একা না… আমি আছি তোর পাশে।তুই কান্না করলে আমার একটুও ভালো লাগে না সোনা।
চুমকির কান্না একটু থেমেছে, কিন্তু চোখের লাল রেশ এখনো ফিকে হয়নি।
মেহরিন তাকে নিয়ে একটু দূরে,এক পাশের এক শান্ত কোণায় চলে এল।
গাছের পাতার দোলায় যেনো দু’জনের কথাগুলো আরও গভীর হয়ে উঠলো।
মেহরিন আস্তে করে চুমকির হাত ধরে বলে —
একটু খুলে বল তো সোনা, আসলে কি হয়েছে? শান্ত ভাই কল দিচ্ছে, তুই ধরছিস না কেন?
চুমকি একটু সময় নেয়, তারপর ফুঁপিয়ে উঠে ধীরে ধীরে বলে —
ফুপি’দের বাসায় আসার আগের দিন… হঠাৎ একটা মেয়ে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে নক দেয়।
নাম জানি না, কিন্তু সে আমাকে কয়েকটা ছবি আর ভিডিও পাঠায়…
ওখানে শান্তর সাথে তার ছবি…
আর সাথে লেখে — ‘আমি যেনো শান্তর লাইফ থেকে সরে যাই।
ও বলেছে ওদের নাকি অনেক দিনের সম্পর্ক। আমি নাকি ওদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে চলে এসেছি। বিশ্বাস কর মেহু! আমি এত মানুষের মাঝে থেকেও একা থেকেছি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি তারপর থেকে শান্তর কল ধরি নাই… কোনো কথা বলি নাই…
কিন্তু আমি খুব কষ্টে আছি মেহু…
চুমকির কণ্ঠ ভেঙে যায়।
মেহরিন করে চুপ করে শোনে সবটা।
তারপর একটুখানি থেমে বলে —
তুই শান্ত ভাইকে সব কিছু খুলে বলিস না কেন?
তুই জিজ্ঞেস করিস না ওর সাথে ওই মেয়েটার কী সম্পর্ক?
তুই নিজের মনেই এত কষ্ট নিয়ে বসে থাকলি, ও তো জানবেই না তোর ভেতরে কি ঝড় বইছে…
চুমকি কিছু বলে না, শুধু চুপ করে।
মেহরিন এবার তার দুই গাল ধরে বলে —
চুপ করে থাকিস না।
ভালোবাসলে, বিশ্বাস রাখতেও শেখ।
ভয় পাস না। মুখোমুখি হ… সোজা চোখে তাকিয়ে সত্যিটা খুঁজে বের কর।
আমি সবসময় তোর পাশে আছি, এখানে দোষ যদি শান্ত ভাইয়ার হয় তাকে আমি ছেড়ে দিব না। আমার জানু টা কে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি তাকে পেতে হবে।
এই মুহূর্তে চুমকির মনে ভর করে দ্বিধা, কষ্ট আর প্রশ্নের ভার…
কিন্তু মেহরিনের কথা যেনো আলোর মতো একটুখানি সাহসের ছোঁয়া দেয়।
মেহরিন চুমকির গালে একটা আলতো করে থাপ্পর দিয়ে বলে, বেয়াদব মহিলা একা একা কষ্ট পেলি আগে জানালি না কেন।সব সময় মাথায় শয়তানি বুদ্ধি কিলবিল করে আরে সিম্পল বিষয়টা আসলে না মাথায়।
মেহরিনের চোখে তখন চিন্তার ছাপ। চুমকির কষ্ট তাকে ছুঁয়ে গেছে গভীরে।মেহরিন কিছু একটা ভেবে হঠাৎ বলে, আরে আমরা এত ভাবছি কেন? আমরা তো ডাইরেক্ট রিদ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করতে পারি। উনি তো শান্ত ভাইয়ের ছোটবেলার ফ্রেন্ড। চুমকি চোখ মুছে তাকায় মেহরিনের দিকে।
সে এক মুহূর্তও দেরি না করে ফোনটা বের করে রিদের নাম্বারে ডায়াল করে।
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৪
টুট…টুট…
দিকনির্দেশনাহীন অপেক্ষা। তারপর ওপাশ থেকে রিদের গম্ভীর কণ্ঠ —
হ্যালো, মেহরিন?
মেহরিন একটু দ্বিধা নিয়ে বলল,
হ্যাঁ রিদ ভাইয়া… একটা ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলতে চাই।