মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৭

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৭
মির্জা সূচনা

সকাল ১১ টা
সবাি রেডি হচ্ছে মিলির গায়ে হলুদে যাবে বলে।আজ মিলির গায়ে হলুদ।
মেহরিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওড়না ঠিক করছে। কালো রঙের জামা, গলায় একটা লকেট, কানে ছোট টপ এই অল্প সাজেও—দেখতেই যেন স্বপ্নের মতো লাগছে।
চুমকি (চোখ টিপে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে):
—এই ওড়না পরে কী ফায়দা যদি সেটা শেষমেশ কবি সাহেবর ঘড়িতে গিয়েই না আটকায়?
মেহবুবা (এক লাফে যোগ দেয়):

—আরে না না! ঘড়িতে আটকে গেলে তো ভাগ্যবান ঘড়ির ব্যান্ডটাই ভাইরাল হয়ে যাবে, বুঝলি? তখন সবাই সেই ঘড়ি কিনতে ছুটবে।
মেহরিন ঘুরে তাকায়, তারপর মুখ বাঁকিয়ে বলে,
_তোরা দুইজন না, তোদের দুই নমুনা কে নিয়ে আর পারি না। তোরা থাকলে আমার আর কষ্ট করে মোবাইল বা টিভিতে নাটক দেখতে হয় না। তোদের নাটক দেখতে দেখতেই আমার জীবন শেষ।
চুমকি আর মেহবুবা হো হো করে হাসে। মেহরিন তখন রাগের ভান করে পাশে রাখা বালিশটা তুলে ছুঁড়ে মারে ওদের দিকে।
মেহরিন হাসতে হাসতে বলে:

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— তুই বরং একটা সিনেমার চিত্রনাট্যই লিখে ফেল, দুষ্টু প্যাকেজ!
চুমকি বালিশটা ঠেকাতে গিয়ে নিজের খোঁপা এলোমেলো করে ফেলে, আর মেহবুবা লাফ দিয়ে খাটের অন্যদিকে চলে যায়, বলে—
মেহবুবা:
— ওরে বাবা! ওড়নার রাণী খেপে গেছে, পালা রে পালা!
তিনজনের হাসি-মজায় ঘরটা ভরে ওঠে। গায়ে হলুদের আগে এই ছোট্ট মুহূর্তটা যেনো হয়ে ওঠে সারাজীবনের মনে রাখার মতো এক দুষ্টু, মিষ্টি স্মৃতি।
রাহিদের বাড়িতে সাজসাজ রব। চারপাশে সুন্দর করে সাজানো, ফুলের সাজ আর হাসির ঝলকানি। রাহি বারবার ফোন করে যাচ্ছিল মেহরিনদের, মুখে একটু চিন্তার রেখা।
রাহি ফোন কানে নিয়ে চটপট হেঁটে বেড়ায়:

— আরে এরা আসছে না কেন! আমি তো একাই পঞ্চাশটা কল করে ফেললাম! সেি কখন বললো বসছি এখনো কেনো আসছে না এরা।
ঠিক তখনই গেটের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। দরজা খুলেই বেরিয়ে আসে মেহরিন, চুমকি আর মেহবুবা—তিনজনেরই মুখে হাসি।
রাহি দূর থেকেই চিৎকার করে ওঠে,
— অতঃপর! শেষমেশ রাজকুমারীরা হাজির!
তার সাথে সাথে পাশে দাঁড়ানো নুপুরও হেসে বলে,
— আর পাঁচটা মিনিট দেরি করলেই রাহি নিজের চুল নিজেই ছিঁড়ে ফেলতো চিন্তাই আমি দেখছিলাম!
রাহি আর নুপুর দৌঁড়ে যায় মেহরিনদের দিকে, তারপর আদর করে একেকজনের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসে। বাড়ির ভেতর গায়ে হলুদের সাজে আলোকসজ্জা, ফুল, আর ঘুঙরু শব্দে পুরো পরিবেশটা যেনো এক রূপকথার রাজ্যে রূপ নিয়েছে।
রাহি হেসে মেহরিনের হাত চেপে ধরে:

— আজকে আমাদের যেমন দায়িত্ব, তেমনি তোমাদেরও! তোমরা আর একটুও দেরি করলে আর ফোন না ধরলে আমি কিন্তু আসলেই হাউমাউ করে হাত পা ছড়িয়ে কেঁদে ফেলতাম!
চুমকি:
— আরে আজই তো গায়ে হলুদ, এতেই যদি এমন করিস তোর কান্নায় বাড়ি ঘর ভেসে যাবে, বিয়েতে তো নৌকা ডুবাবে?
সবাই হেসে ওঠে। বাড়িটা যেনো মুহূর্তেই প্রাণবন্ত হয়ে যায়।
গায়ে হলুদের রঙিন আয়োজনের মাঝেই একসময় রাহির মা সাবিহা তালুকদার ও কাকিমনি শামিমা তালুকদার এসে হাজির হন। দু’জনের মুখেই প্রশান্ত হাসি। মেহরিন, চুমকি, মেহবুবা—তাঁদের দেখে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখিয়ে সালাম করে।
রাহির মা হাসিমুখে এগিয়ে এসে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরেন।

— আহা, আমাদের মেহরিনটাকে কত্ত সুন্দর দেখাছে ! একদম ফুলের মতো।
মেহরিন লজ্জা মাখা গলায় মুচকি হেসে
—মানে আন্টি এভাবে বলবেন না আমি অতটাও সুন্দর নয়। আপনি এভাবে বললে আমার লজ্জা করে।
রাহির মা তখন মেহরিনের মুখে তাকিয়ে, তার থুতনিতে নরম করে একটা আদরভরা চুমু খেয়ে বলেন—
— ওরে আমার লজ্জাবতী লতা রে।
আচ্ছা তোমার আব্বু-আম্মু এলেন না যে মা?
মেহরিন একটু হেসে বলে

— আসবেন আন্টি। আব্বুর অফিস থেকে ছুটি মেলেনি। বলেছেন বিয়ের দিন সরাসরি চলে আসবেন।
রাহির মা মেহরিনের গালটা আলতো করে ছুঁয়ে বলেন:
—তোমার বাবা মা ওনে ভাগ্যবান তোমার মত একটা মেয়ে পেয়েছে। তোমাকে একবার দেখলে দেখতেই ইচ্ছে করে।
শামিমা তালুকদার পাশে দাঁড়িয়ে হেসে বলেন:
— তাই তো! এই মেয়েটা কে দেখলে মন ভরে যায়।কী মায়া ভরা মুখখানা।
রাহির মা তারপর বলেন:
— আচ্ছা , এখন তোমরা মিলির কাছে যাও। ও তো তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছে। সব্বাই ওকে একটু একটু করে সঙ্গ দাও,মন মরা হয়ে বসে আছে মেয়ে টা।

চুমকি বলে,
আন্টি ফিকার নেহি হাম লোগ আগয়ি হু না আব কিসিকা ভি মুড অফ নেহি রাহেগি।
চুমকির কথাই সবাই হেসে ফেলে। শামিমা তালুকদার চুমকির গাল টেনে বলে, দুষ্ট বুড়ি।
পাঁচজনেই হাসতে হাসতে ভিতরের দিকে এগিয়ে যায়। বাড়িটার উষ্ণতা, ভালোবাসা আর আনন্দ যেনো এক মায়াবী ছায়ায় ঢেকে রাখে তাদের চারপাশ।
রাহি, নুপুর,মেহরিন, চুমকি আর মেহবুবা মিলে ধীরে ধীরে মিলির ঘরের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢোকে।
ঘরের মাঝখানে একটা আয়নার সামনে বসে আছে মিলে। শরীরে উজ্জ্বল হলুদের শাড়ি, গায়ে হালকা গয়না, চোখে-মুখে এক অপার লজ্জা আর আনন্দের ছোঁয়া। যেনো একেবারে সোনার পুতুল।
চুমকি চোখ বড় বড় করে বলে উঠে—

— আল্লাহ্‌! মিলি আপু,তোমাকে তো পুরাই নায়িকা লাগছে।
মেহরিন মুগ্ধ হয়ে বলে—
— যা বলেছিস কি সুন্দর লাগছে গো তোমাকে।সত্যি বলছি, তোমাকে দেখলে মনেই হচ্ছে না এই বিয়ের মধ্যে কোনো ক্লান্তি আছে। একেবারে যেনো হলুদের রানী।
মিলি আয়না থেকে চোখ সরিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে—
— তোমরা এসেছো তাহলে এতখনে আসার সময় হলো বুঝি? তোমাদের দেখে কী যে ভালো লাগছে। আমি তো ভাবছিলাম, বুঝি আসবেই না তোমরা।
চুমকি হেসে বলে,
—আরেহ আপু! তোমার বিয়ে, আর আমরা আসব না? সেটা কি সম্ভব।
মেহরিন কাঁধে ঝোলা ব্যাগটা খুলতে খুলতে বলে—
— না আসলে তো আমাদের বউরানীর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনের সাক্ষী হওয়াই হত না।
মেহবুবা পাশে বসে হাত ধরে বলে—
— চলো এবার কিছুক্ষণ বসে জমিয়ে আড্ডা দিই। তারপর না হয় হলুদের আনুষ্ঠান এ যাওয়া যাবে।
সবাই একসাথে মিলির বিছানায় বসে পড়ে, শুরু হয় একেকটা গল্প, পুরনো কথা, হাসি, আর কৌতুকের খুনসুটি।
এই মুহূর্তগুলো যেনো বন্ধন হয়ে থাকে চিরদিনের জন্য।

তালুকদার বাড়ির বিশাল গার্ডেনকে যেনো স্বপ্নের রাজ্য বানানো হয়েছে।
চারদিক ঝালর ও রঙিন লাইটে সেজে উঠেছে। মঞ্চে সোনালি ও হলুদ কাপড়ের ব্যাকড্রপ, সামনে রজনীগ্ধা আর গোলাপের মেলায় ঢেকে রাখা একটি রঙিন আসন— মিলিকে ঘিরে তৈরি এক পরীর রাজ্য বানানো হয়েছে।
রিদ, পাশে শান্ত আর রাকিবকে নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে পুরো সেটআপটা দেখছিল।
রিদ হালকা হাসি দিয়ে বলে—
—দেখিস, মিলি আজকে একেবারে রাজকন্যা লাগবে।
শান্ত হেসে বলে—

— রাজকন্যা তো অবশ্যই। তবে তার থেকে বড় কথা, আজকের এই পরিবেশটাই জাদুর মতো।আর সব আয়োজন তো মিলির জন্যই।
ঠিক তখনই,দরজা খুলে যায়।
দড়ির মতো বাঁধা লাইটের নিচে এক এক করে নেমে আসে মেহরিন, চুমকি, রাহি, মেহবুবা, নুপুর আর সবার মাঝে একেবারে কেন্দ্রে— মিলি।
মিলির গায়ে হলুদ রঙা জমজমাট শাড়ি,পরনে ফুলের গহনা, ব্রাইডাল সাজে ঠোঁটে মিষ্টি হাসি।
চেনা সেই মিলিকে যেনো আজ চেনাই যাচ্ছে না— ও যেন এক আলাদা আলোয় ঝলমল করা কনের ছায়া।
রিদ চোখ সরাতে পারছে না মিলির দিক থেকে। শান্ত একবার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলে—
— ওই ভাই! এবার চোখ সামলা, চোখে বেশি পানি জমলে আবার সবাই বলবে তালুকদার সাহেব কাঁদছে!
রিদ একটু হেসে বলে—

— না, চোখে পানি না… এটা গর্ব আনন্দ ও বোন কে পরের বাড়ি পাঠানোর কষ্ট । আমার ছোট বোনটা আজ সত্যি বড় হয়ে গেল।
নিচে দাঁড়ানো সকলে বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। আর মেয়েরা মিলিকে ঘিরে রেখেছে, যেনো ফুলের দল একটা মধুর মৌমাছিকে রক্ষা করছে।
মেহরিন, চুমকি, রাহি, মেহবুবা আর নুপুর মিলে মিলিকে সাজিয়ে নিচে নামছে পাশে আরও কিছু মেয়ে। চারদিকে সবার চোখ তখন কনের দিকে, কিন্তু কারও চোখে যেনো ধরা পড়ছে এক ভিন্ন রঙ।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রিদ, মঞ্চের গেটের পাশে কী যেনো কাজ করছিল। সাদা-পান্জাবি, তার ভিজে গেছে, তার চোখ তখন স্থির… এক দৃষ্টিতে।
সে তাকিয়ে আছে একদিকে—
মেহরিনের দিকে।

হলুদ রঙের শাড়িতে মোহময় রূপ, মুখে কোনো গা-জমানো প্রসাধন নেই, কেবল চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে একটু লিপস্টিক আর কানে পাশে গুঁজে রাখা লাল টুকটুকে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল।
খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, আর রাহির সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে মাথা একটু হেলিয়ে রেখেছে। সেই হালকা হাসির ছায়ায়, ওর ঠোঁটের নিচের ছোট্ট তিলটা চোখে পড়তেই রিদের নিঃশ্বাস আটকে যায়।
রিদ নিজের অজান্তেই একবার গলা ভিজিয়ে নেয়। সে জানে না কেন, কিন্তু চোখ সরাতে পারছে না। তার মনটা ঠিক যেনো… থেমে গেছে। কেউ যেনো আর নেয় চারপাশে, শুধু সেই মেয়ে আর তার শাড়ির হলুদ আলো।
রিদ মনে মনে বলে…

এতোটা অপূর্ব… কেউ কিভাবে হতে পারে?
ঠিক তখনই মেহরিন চোখ পড়ে রিদের দিকে
রিদ মনে মনে বলে…
“এতোটা অপূর্ব… কেউ কিভাবে হতে পারে?”
ঠিক তখনই মেহরিন চোখ পড়ে রিদের দিকে। একটু চমকে উঠে, কিন্তু তেমন পাত্তা দেয় না হেসে আবার রাহির দিকে ফিরে চায়। আর সেই হাসিতে, রিদ আরও গভীর ডুবে যায়।
রিদ তখনো মেহরিনের দিকে তাকিয়ে। পাশেই দাঁড়িয়ে শান্ত আর রাকিব। ওরা প্রথমে কিছুই বলে না, কিন্তু রিদের স্থির চোখ দেখে একটু হেসে তাকায় ওর তাকানোর গন্তব্যে।
আর ঠিক তখনই…

শান্তর চোখ গিয়ে পড়ে চুমকির দিকে—
একটা মিষ্টি রঙের শাড়ি পরা চুমকি, চুল খোঁপা করা, তার মাঝে একটা জাঝবেরা ফুল গোঁজা, চোখে কাজল, কপালে ছোট্ট টিপ, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক।
শান্ত থমকে যায়। বুকের বাঁ পাশটা যেনো হঠাৎ মোচড় দেয়। সে নিজের হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে—চোখ সরাতে পারছে না।
পাশেই রাকিব তাকিয়ে ছিল অন্যদিকে—
সেই দিকেই আসছে রাহি—

লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, খোলা চুল, চুলে গোঁজা এক গুচ্ছ গোলাপ ফুল, ঠোঁটে রাঙা লিপস্টিক, কপালে টিপ।
রাকিবের গলা শুকিয়ে আসে, সে ঢোক গিলে নেয়। চোখে যেনো বিস্ময়ের ঢেউ।
ঠিক তখনই রাহি চোখ তুলে দেখে রাকিবকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে।
সে চোখ টিপে দিয়ে একবার হেসে ফেলে। তারপর মিষ্টি ভঙ্গিতে রাকিবের দিকে এগিয়ে আসে চাই।
রাকিব চমকে উঠে—চোখ ফিরিয়ে নেয়, তবুও হেসে ফেলে।
এই দৃশ্য দেখে রিদ আর শান্ত একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসে।
শান্ত বলে,

-এইটা কি ভাই? প্রেমের গন্ধে তো পুরো মঞ্চ ভিজে যাচ্ছে!
রাকিব জবাব দেয়,
_আমরা হালকা খাইছি মনে হয়…
ফিসফিস করে,
–ভাই, ও যদি তাকায়, আমি আর তাকাতে পারবো না।
এভাবেই…
তিন বন্ধুর চোখে ধরা পড়ে তিনটা রঙ—হলুদ, গোলাপি আর সাদা।
আর ভালোবাসার আলোয় চারপাশ যেনো এক স্বপ্নের রঙে ভরে ওঠে।

মিলিকে সুন্দর করে সাজিয়ে এনে মঞ্চে বসানো হয়েছে। শাড়ি, গয়না, মেকআপে একদম নববধূর মতো লাগছে ওকে। মুরুব্বিরা বলে না বিয়ের পানি পরলে মেয়েদের রূপ খুলে যায় তেমনি জানা হয়েছে মিলির ক্ষেত্রে। মেয়েটা এমনি সুন্দর কিন্তু বিয়ের আমেছে যেন আরো বেশি সুন্দর লাগছে।চারপাশে সবাই ব্যস্ত, কিন্তু মুখে হাসি।
এক এক করে বাড়ির বড়রা এসে মিলির গায়ে হলুদ লাগাচ্ছেন—
হলুদ, চন্দনের গন্ধে ভরে গেছে চারপাশ।
ঠিক তখনই রাহি একটু হলুদ নিয়ে হেসে হেসে এগিয়ে আসে মেহরিনের দিকে।
মেহরিন কিছু বোঝার আগেই—

চপাক!
রাহি হেসে মেহরিনের গালেই একটু হলুদ মেখে দেয়!
মেহরিন অবাক,
–এইটা কী করলি তুই?
রাহি মুচকি হেসে বলে,
–বিশেষ প্রথা রে! বৌয়ের হলুদ কাউকে লাগালে নাকি পরের বিয়েটা তারই হয়।
এ কথা শুনেই চুমকি বলে,
–তাইলে তো, মেহু সোনা…তোর বিয়ের ঘন্টা বাজল রে!
আর সবাই—ঠাট্টা, হাসি, বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়ে।
মেহরিন লজ্জায় মুখ লুকাতে যায়,
আর চুমকি আবার বলে,

– ওরে ওরে আমার লজ্জাবতী দেখি ব্লাশ করছে। তবে কথা কিন্তু সত্যি, বউয়ের হলুদ বউয়ের পরে যার গায়ে পড়ে তার কিন্তু বিয়ের ঘণ্টি বেজে যায়।
এইবার রাহি চোখ টিপে, চুমকির দিকে ইঙ্গিত করে বলে,
–তা হলে তো তোকেও আজ রঙে রঙিন করতে হবে চুমকি আপু বলেই চুমকেও হলুদ লাগিয়ে দেয়।
হাসির রোল, টিপ্পনী, আর দুষ্টু কথায় শুরু হয় মিলির গায়ে হলুদের এক অন্যরকম রঙিন আনন্দ!
চারপাশে গায়ে হলুদের উৎসবের ব্যস্ততা। হাসি, গান, আর হলুদের গন্ধে ভরপুর চারপাশ। রাহি একটু চুপচাপ হয়ে সবার আড়াল থেকে হাতভরা হলুদ নিয়ে এগিয়ে যায়—

লক্ষ্য: দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাকিব।
রাহির মুখে চেনা দুষ্টু হাসি, ধীরে ধীরে কাছে যায়। গিয়েই রাকিবের গালে হলুদ লাগিয়ে দেয়। গালে হলুদ লাগিয়ে যেই না দৌড় দিবে,
ঠিক যখনই সে রাকিবকে হলুদ মাখাতে যাবে, রাকিব আচমকা তার হাত চেপে ধরে!
রাহি চমকে উঠে—
– র..রাকিব ভ..ভাই এই! কী করছেন?
রাকিব চোখ ছোট করে হেসে বলে,
–তুমি আমায় মেরে ফেলার প্ল্যান করছো, তাই না? মেয়ে কী সাহস তোমার।আমাকে মারার জন্য কত বড় ষড়যন্ত্র তেমার।
রাহি চোখ বড় বড় করে বলে,

–কি…ব..বলছেন আমি তো কিছু করিইনি, শুধু একটু হলুদ…
কথা শেষ করার আগেই—
রাকিব তার গালটা নিয়ে রাহির গালে ঘষে দেয়।
দুইজনের গালেই এখন হলুদ আর লাজের রঙ!
রাহি অবাক, মুখ তুলে তাকাতেই রাকিব হাসতে হাসতে বলে,
–নাও পারফেক্ট।ফিফটি ফিফটি! এখন কেউ কাউকে দোষ দিতে পারবে না।
চিস বাজাতে বাজাতে চলে যায় রাকিব।
অন্যদিকে,

শান্ত ঘুরঘুর করছে চুমকির পেছনে।
কখনো একটু কাশে, কখনো হাসে—
কিন্তু চুমকি যেনো দেখেও দেখছে না।
একবার শান্ত বলে উঠল,
–এই শাড়িটা অনেক সুন্দর, তুমিই তো পরেছো, তাই না?
চুমকি একটুও না তাকিয়ে বলে,
–কেন আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না চোখ নেই আপনার।বাই দ্যা ওয়ে ধন্যবাদ, আপনার দৃষ্টি এত তীক্ষ্ণ! কিন্তু আমি একটু ব্যস্ত, পরে কথা হবে।
শান্ত মুখটা গোমড়া করে ফেলে,
–এই মেয়েটা তো পুরো কেয়ার না দেওয়ার চ্যাম্পিয়ন।কি অ্যাটিটিউড তার আমার জন্য নাকি তার সময়ই নেই।আচ্ছা আচ্ছা সময় আমারও আসবে তখন সুদে আসলে গোসল করে নিবো।
সবকিছু মিলিয়ে হলুদের দিনটা শুধু গার্ডেনে নয়, ভালোবাসার দুষ্টুমিতে রঙিন হয়ে যায়।

বাতাসে হালকা হলুদের গন্ধ, উৎসবের মাঝেও মেহরিন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে।
ওর কণ্ঠে কোমলতা—
হুম, পরে কথা বলি… ভালো থাকবেন কবি সাহেব।
কল কেটে মুখটা নিচু করে কিছু ভাবছে, ঠিক তখনই—
রিদ এসে পড়ে সামনে।
ওর চোখ কুঁচকে যায়, কপালে যেনো দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
–”মেহু!”
মেহরিন চমকে তাকায়।
– র..রিদ ভাইয়া… কিছু বলবেন?
–সবাই তো ওখানে, তুমি এখানে একা?
মেহরিন মুচকি হেসে বলে,
–একটা কল এসেছিলো, এখনই যাচ্ছি।
-মেহু….

চলে যাচ্ছিলো রিদের ডাকে,মেহরিন ঘুরে দাঁড়ায়।
-জী কিছু বলবেন?
রিদ চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকে, হেসে বলে,
– তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।
মেহরিন হেসে হালকা মাথা নেড়ে বলে,
–ধন্যবাদ। আপনাকেও পাঞ্জাবিতে ভালো লাগছে।
বলেই মুচকি হেসে চলে যায়।

রিদ দাঁড়িয়ে থেকে চেয়ে থাকে মেহরিনের চলে যাওয়ার দিকে, মুখে একটুকরো দুঃসহ আকাঙ্ক্ষা—
–এই মেয়েটা… মিষ্টি একটা ফুল। আর আমি… আমি এই ফুলটাকে আমার করে চাই।
স্টেজে হালকা আলো, মিউজিক বাজছে—পুরো বাড়ি জুড়ে উচ্ছ্বাস।
প্রথম কালা চশমা নাচ শুরু করে রাহি আর মেহবুবা।
ওদের নাচ শেষ হতেই রাহি মেহরিন আর চুমকি কে নাচতে বলে।
সবার জড়াজড়িতে গানের ছন্দে ওরা মঞ্চে এসে দাঁড়ায়,
চুমকি প্রথম একটু নাটক করে বলে,
–মেহু, ভুল স্টেপ নিস না কিন্তু!
মেহরিন তুমি কি নাটক দেখে হাসে।
তারপর চুমকি আর মেহরিন সারারাসারা গানে নাচে ওদের নাচ দেখে সবাই অবাক।
তারপর একটা নাচ দেই সবাই মিলে,

গান বাজে—একটা হালকা, মজার বিয়ের গান।
ওদের পাঁচজনের দারুণ কোরিওগ্রাফি—হাসি, নাচ, ঘুরে যাওয়া, গালে হলুদের ছিটে লেগে থাকা।
গান শেষ হতেই পরের গানে শুরু হয় বিগ এন্ট্রি—
রিদ, শান্তো আর রাকিব মঞ্চে আসে একে একে, সবার গায়ে রঙিন পাঞ্জাবি, মুখে দুষ্টু হাসি।
রিদ চোখাচোখি করে মেহরিনের সঙ্গে,
শান্তো মিষ্টি চাহনি দেয় চুমকির দিকে,
রাকিব একটু ঢং করে রাহির পাশ দিয়ে নাচে।

দিলডুবা দিলডুবা….
দিল আখোমে ইয়ে দিলডুবা…
মেহবুবা মেহবুবা..
বাছ ইয়ে জানলে মেহেবুবা….
গানটা জমে ওঠে!
দুইপক্ষ মিলে শুরু হয় একটা ডান্স ব্যাটেল!
– চুমকি শান্তোকে দেখে চোখ কপালে তোলে,
– রাহি রাকিবকে ধাক্কা দিয়ে বলে, স্টেপ ঠিক করো!
–মেহরিন হেসে হেসে রিদের সামনে ঘুরে দাঁড়ায়।
সবার হাসিমুখ, হাততালি, হলুদের উজ্জ্বল আলোয় ভেসে যায় সন্ধ্যা—
আর মিউজিকের ছন্দে একটা অদৃশ্য ভালোবাসার বন্ধন আরও গাঢ় হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে
নিজের রুমে বসে রাজ চুপচাপ মেহরিনের নাচ দেখছিল।
মুখে কিছু না বললেও চোখে ছিল দৃষ্টি গাঁথা শুধু মেহরিনে।
হঠাৎ মিউজিক বদলালো,
রিদ এসে যোগ দিল মেহরিনের পাশে।
নাচতে নাচতে ওদের দুজনের একসাথে হাসা, চোখে চোখ রাখা…
রাজের বুকের ভেতর যেনো কিছু একসাথে ভেঙে পড়ে।
মেহরিন আজ মিলির গায়ে হলুদে যাবে এটা রাজ জেনে ওখানে নিজের লোক সেট করেছিল যেনো মেহরিনের খোজ প্রতিমুহূর্তে লাগতে পারে।
রাজ উঠে দাঁড়ায়—চোখ লাল, শ্বাস ভারী।
হঠাৎ ঘরের পাশে যা পায়,
ভাঙতে শুরু করে:

– তুই যদি আমার কাছের কেউ না হতি রে রিদ,
কসম খোদার, তোকে আমি এমন মৃত্যু দিতাম,
যে মৃত্যু শব্দ শুনেই লোকে কাঁপত!
একটা ফুলদানির টুকরো মেঝেতে ছিটকে পড়ে, কাচ ছড়িয়ে যায়।
চেয়ার উল্টে যায়, টেবিলের ওপরের সবকিছু পড়ে যায় ছিটকে।
ঠিক তখনই দৌড়ে আসে রূপা বেগম, রাজের মামনি।
–রাজ বাবা! কী করছো এ কী করছো!
দেখে স্তব্ধ হয়ে যান তিনি।
রাজের শরীর কাঁপছে রাগে, চোখ লাল—আর মুখ থেকে যেনে আগুন ঝরছে।
রূপা বেগম তার দিকে এগিয়ে গিয়ে দুহাতে রাজকে ধরে বলেন,
–আমার বাবাটা কেনো এমন করে ভাঙচুর করছে? কিসের জন্য? কী হয়েছে বাবা। মামনি কে বলো।
রাজ হঠাৎ থমকে যায়, চোখ নামিয়ে নেয়।
রূপা বেগমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
রাজ হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যায়, যেন নিজেকে সামলে রাখার শেষ চেষ্টা করছে।
রাজ গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলে:

– মামনি… ওরা… ওরা তো আমার সব কিছু কেরে নিলো…”
– আমার তো এখন শুধু আমার Moonbeam আছে। ওকে দেখেই তো আমি বাঁচি মামনি।
তার গলা কাঁপছে, চোখে জল চিকচিক করছে।
–এখন ওর দিকেও নজর দিচ্ছে কেন ওরা, মামনি? কেনো?
–আর কতটা একা করবে ওরা আমাকে? আর কত?
আমার তো এখন কেউ নেই,আমার বাবা মা এমনকি ছোট্ট দুধের বাচ্চা বোনটাকেও নিয়ে গেল। এখন আবার আমার Moonbeam কেউ কেরে নিতে চাইছে মামনি। কেনো?
রূপা বেগমের চোখেও জল চলে আসে।
তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দেন রাজের।

–শান্ত হ, বাবা… তুমি এখন আর সেই ছোট্ট রাজ নেয়।তখন তুমি ছোট ছিলে তাই ওরা তোমার কাছ থেকে সবাইকে কেড়ে নিতে পেরেছে। কিন্তু এখন, এখন তুমি বড় হয়েছো নিজের জিনিস নিজের করে রাখতে জানো। প্রয়োজনের ছিনিয়ে নিবে তাও নিজের জিনিস ছেড়ে দিবে না। আমি তো তোমাকে দুর্বল করে তৈরি করিনি।তোমার জিনিসের দিকে কেউ হাত বাড়ালে প্রয়োজনে সেই হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিবে।

মনে রেখো তোমাদের জীবন সহজ ছিল না,অনেক সংগ্রাম করে তোমাদের বাঁচিয়ে রেখেছি আমি।তোমাদের জীবন বাঁচানোর জন্য নিজের দেশ নিজের মাটি ছেড়ে থেকেছি অন্য দেশে।এই দিন দেখার জন্য নয় রাজ। যে সেই পুরনো দিনের মতো তোমরা আবার কষ্ট পাও প্রয়োজনে অন্যকে কষ্ট দিবে তাও নিজে কষ্ট পাবে না।
যে তোমাদের কষ্ট দিতে আসবে ক্ষতি করতে আসবে প্রয়োজনে তার বংশ নির্বংশ করে দাও।তারপরও তোমরা টিকে থাকবে। আমি আমার দুই ছেলেকে রাস্তার কুকুর বানাইনি বানিয়েছি সিংহ।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৬

একটা কথা মনে রেখো সিংহ জঙ্গলে থাকুক বা খাঁচায় সিংহ কিন্তু সিংহই হয় সে রাজা।
তোমার Moonbeam তোমারই থাকবে। প্রয়োজনের লাশ পড়বে কয়েকটা তা পড়ুক।কিন্তু তুমি পিছিয়ে যাবে না তোমার ভালবাসাকে তুমি জয় করবে।
রাজ তার বুকের ভেতর জমে থাকা সব চাপা কষ্ট, কান্না যেনো এক মুহূর্তে ছেড়ে দেয়।
তবু মুখে আর কিছু বলে না।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৮