মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৯
মির্জা সূচনা
মিষ্টি আলোয় ঘরটা তখনো হাসি আর আলোর রোশনিতে ঝলমল করছিল। চারপাশে মেহেদির গন্ধ, ফোটানো চায়ের সুবাস, আর মেয়েদের খিলখিল হাসি যেন একটা উৎসবকে আরও রঙিন করে তুলেছিল। কিন্তু এর মধ্যেই এগুলো আনন্দ চোখ দিয়ে যেনো আগুনের লাভা বের হচ্ছে ।
মেহরিন হঠাৎ সবার সামনে এসে বলল চুমকি মেহবুবা
চলো, বাড়ি ফিরবো।
চুমকি প্রথমে কিছুটা অবাক, তারপর মেহবুবা মেহরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। কারণ তার মুখে তখনকার অভিব্যক্তি একেবারেই অচেনা। নাক, কান, মুখ—সব লাল হয়ে আছে রাগে। চোখ যেনো আগুন ছুঁড়ে মারছে! চুমকি ফিসফিস করে মেহবুবার কানে বলল,
মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়ে গেছে… ওর এই রাগ দেখে ভয় লাগছে।মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে যাতে ও ভয়ঙ্কর রেখে গেছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মেহবুবা মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল। কেউ কিছু না বলে, একটা কথাও না বলে, ওরা দু’জনই চুপচাপ উঠে দাঁড়াল।
রাহী তখন সামনে এসে দাঁড়িয়ে একটু হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করল,
বাড়ি যাবে মানে? আজ রাতেই? কাল তো বিয়ে… আজকের রাতটা থাকো না?
ওর কথা শুনে পাশে থাকা নুপুর আর মিলিও একটু তাকাল, কিছু বলল না, শুধু চোখে ছিল কৌতূহল।
মেহরিন তখন নিজের রাগ সামলে একটু স্বাভাবিক মুখ করে বলল,
না, আজ যাচ্ছি। কাল ঠিক সময়মতো চলে আসবো। চিন্তা করিস না।
আর কোনো ব্যাখ্যা দিল না সে। মেহবুবা আর চুমকির হাত দুটো শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। চোখে মুখে ছিল সিদ্ধান্ত আর রাগ—একসাথে জ্বলতে থাকা আগুন আর অভিমান।
মেহরিন, মেহবুবা আর চুমকি তিনজনেই দরজার দিকে এগোচ্ছিল চুপচাপ। রাগে ফুঁসতে থাকা মেহরিন সামনে, আর দুজন পাশাপাশি। সবার চোখে স্পষ্ট অস্বস্তি। কিন্তু তখনই—
পথ আটকে দাঁড়ালেন দুজন নারী।
একদিকে সাদামাটা কিন্তু দৃঢ় মুখে শামীমা তালুকদার, আর অন্যদিকে তালুকদার পরিবারের গর্বিনী বড় বউ সাবিহা তালুকদার।
সাবিহা চোখ সরু করে কড়া গলায় বললেন,
কোথায় যাচ্ছো তোমরা?
মেহরিন একটু থেমে বলল,
আন্টি, বাড়ি যাচ্ছি। কাল সকালে আবার চলে আসব।
সাবিহার মুখ শক্ত হয়ে গেল। চোখে ছিল এক অদৃশ্য কঠোরতা।
কোথাও যাচ্ছো না। কেউই না। চুপচাপ ভেতরে ফিরে যাও।তার কণ্ঠে ছিল নির্দেশের চেয়েও বেশি কিছু—গোটা পরিবারের গাম্ভীর্য যেনো নামিয়ে এনেছেন।
এবার শামীমা তালুকদার শান্ত কিন্তু ছুঁয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললেন,মিলি তোমার আপন বোন হলে আজকে এই রাতে তুমি ওকে ফেলে যেতে পারতে? ওর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাত এটা, মেহরিন।
এই কথাটা যেনো বিদ্যুৎ হয়ে আঘাত করল মেহরিনের মনে। কথাটা ছুরির মতো গেঁথে গেল বুকের ভেতর। রাগের আগুন নিভে গিয়ে সেখানে একটা অপরাধবোধের ছায়া নেমে এলো।
তিনজন কিছু না বলে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
তারপর মেহরিন মাথা নিচু করে বলল,
ঠিক আছে, আমরা থাকব।
সাবিহা তালুকদার মাথা নাড়লেন, চোখে রইল স্বস্তির ছায়া। শামীমার মুখেও ফিরে এলো মায়া।
তিনজন মেয়েই আবার ঘরের দিকে ফিরে গেল—কিন্তু এবার রাগ নয়, মনের ভিতরে ছিল এক ভারী চাপ… আর ভবিষ্যতের এক অজানা আলোড়ন।
নিশি রাত। চারপাশ নিস্তব্ধ।
বাড়ি ভর্তি অতিথিরা। সব মেয়েরা মিলে আজ মিলির ঘরটাই হয়ে উঠেছে এক বিশাল ঘুমঘর। কার্পেট, ফ্লোর, বিছানা—যেখানে জায়গা পেয়েছে সবাই সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাত প্রায় ২টা বাজে। খাওয়া-দাওয়া, হাসি-ঠাট্টা, মেহেদি, ছবি—সব শেষ। চারপাশে শুধু নিঃশব্দ নিঃশ্বাসের আওয়াজ।
কিন্তু মেহরিনের চোখে ঘুম নেই।
তার ভেতরের অস্থিরতা যেনো ঘুমকে আগেই তাড়িয়ে দিয়েছে। এতকিছুর মাঝেও, আজকের সেই মুহূর্তটা বারবার ফিরে আসছে মনে। সেই ছোঁয়া… সেই অপমান… আর তার চেয়েও বেশি—তার কবি সাহেবের মুখ।
চুপচাপ উঠে সে বারান্দার দিকে চলে আসে। রাতের হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় চুলগুলো ওড়ার চেষ্টা করছে। ফোনটাই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে।
তারপর একটুখানি দম নিয়ে ডায়াল করে সেই এক নম্বরে…
কবি সাহেব।
কল রিং হচ্ছে…
একটা… দুইটা…
“হ্যালো…”
ওপাশে ভরাট গলা, একটু ভেজা ঘুমঘুম ভাব কানে আসে।
মেহরিন নিঃশ্বাস ফেলল।তার কবি সাহেবের এই গুন গুন করলে শুনে মেহরিন আরেক দফা ক্রাশ খেলো।এই ঘুম ঘুম কথা যে কি মারাত্মক তাহারে হাড়ে টের পাচ্ছে মেহরিন।
মেহরিন কিছু বলে না, শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসে।
রাজ ধীরে, গভীর কণ্ঠে বলতে শুরু করে—
আজ তোমার হাতে মেহেদী রাঙ্গা হাত গুলো আমি দেখিনি কিন্তু কল্পনা করছি, বিশ্বাস করো আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে হাত দুটো যদি সারা জীবন ধরে রাখতে পারতাম…
তোমার নখে লেগে থাকা আলতায় যদি আমার নাম লিখে দিতে পারতাম..
মেহরিনের গাল গরম হয়ে যায়, হালকা হেসে ফেলে—
কবি সাহেব…
অভিমান না আবেগ—সে নিজেই জানে না।
রাজ থামে না।
গলায় এবার খানিক আবেগের চাপ—
আজ তোমার চোখে কষ্ট দেখেছি,
ভীষণ অসহায় লাগছিল নিজেকে।
তোমার একটা অশ্রু, আমার সাহসকে ভেঙে দেয় আরিওনা।তোমাকে তো কান্নায় মানায় না Moonbeam তুমি তো আমার সাহসী নারী,আমার ঝাসি কি রানী।তোমাকে কি দুর্বল হওয়া বানায় বলতো।
আমার সমস্ত যুদ্ধ, সমস্ত রাগ—তোমার একটা হাসির কাছে হেরে যায়।
আর বিশ্বাস আছে তোমার প্রতি তুমি নিজেকে প্রটেক্ট করতে জানো। তুমি যতটুকু পারো ততটুকুই হবে বাকিটা দেখার জন্য আমি আছি তোমার কবি সাহেব। আমার হৃদয়ের ফোটা এক্স স্নিগ্ধ ফুল তুমি। যাকে আমি অতি সযত্নে গোপনে, নিজের মনের কোটায় আগলে রেখেছি।
মেহরিন চুপচাপ ফোনটা চেপে ধরে।
তার ঠোঁটে মিষ্টি লাজুক হাসি, কিন্তু চোখের কোনে জমে থাকা অল্প জল যেনো বলে দেয়—
এই কণ্ঠটাই তার শান্তি, তার নির্ভরতার জায়গা।
রাজ আবার বলে ওঠে—
তুমি যখন লজ্জায় মুখ নিচু করো, তখন আমার পৃথিবী থেমে যায়।
তুমি শুধু আমার হয়ো,আরিওনা।
আর কিছু চাই না জীবনে…!
মেহরিন এবার আর সহ্য করতে পারে না, এক নিঃশ্বাসে বলে—
কবি সাহেব…. আপনি এভাবে কথা বললে কিন্তু আমি কল কেটে দিব?
রাজ_সামান্য এই কথাগুলো শুনে যদি তুমি এত লজ্জা পাও Moonbeam.. তাহলে আমি যখন তোমার কাছে থাকবো পাশে থাকবো, আর তোমার ঠোঁটে….
টুট টুট —কল কেটে দেয়।
মুঠোফোনটা বুকের মাঝখানে চেপে ধরে মেহরিন ফিসফিস করে—
এই কবি সাহেবটা একদিন আমাকে লজ্জায় মেরে ফেলবে… ইসস এভাবে কেউ বলে। কিছু আটকানাই লোকটার মুখে।
তবু, আমি চাই ওর কবিতায়ই হারিয়ে যেতে।
ওর চোখে জ্যোৎস্নার আলো, আর হৃদি জুড়ে কবিতার মৃদু স্পর্শ।
মেহরিন বারান্দা থেকে চুপচাপ ভেতরে ফিরল। ফোনটা বুকে চেপে ধরেছে, মুখে একরাশ লজ্জার ছাপ। হঠাৎ দেখতে পেল—ঘরে কেউই ঘুমায়নি! সবাই একেবারে জেগে বসে, চোখ মুখে দুষ্টুমির ঝিলিক।
চুমকি বলেই উঠল,
আসুন আসুন আপনার অপেক্ষাতেই তো পথ চেয়েছিলাম, দেখুন সবাই আমাদের ফোন প্রেমিকা ফিরে এসেছে!
মিলি হেসে বলে, এত রাতে কে কল দিলো রে?
মেহরিন গাল লাল করে, কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। তখন চুমকি হেসে আবার বলে ওঠে,
আচ্ছা মিলি আপু, তুমি তো কনে.. বল তো, তুমি বাসর রাত কি গান গাইবে?
মিলি হতচকিত—
এই এই কীসব বলিস!
চুমকি এবার মুখে গামছা চাপা দিয়ে শুরু করল এক আজব গান—
ওওওওও আঁচল ধরে টান দিও না….
লাজে মরে যাই…
প্রথম রাতে আমি তোমার,
কাছে ক্ষমা চাই …..
এই গানে পুরো ঘরে হাসির ঢেউ ওঠে।
মেহরিন, রাহি, নুপুর, সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ে।
আর মিলি? গাল পুরো টকটকে লাল, আর মাথা নিচু।
তখন রাহি নাটকীয় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে—
আর আমি কী গান গাইবো জানো?
সবার কৌতূহল তখন তুঙ্গে।
রাহি কণ্ঠে কাঁপুনি তুলে শুরু করল—
আমি দুঃখী মইরা যাই…
আমি লজ্জায় মইরা যাই …
আমার লগে প্রেম করতে চাই…
মেহবুবার জামাই ……
পুরো রুম এবার একেবারে কাঁপছে হাসিতে!
চুমকি চিৎকার দিয়ে হেসে ফেলে, নুপুর গড়াগড়ি খাচ্ছে, মেহরিন চোখে জল ধরে রেখেছে, আর মিলি রাহির দিকে বালিশ ছুঁড়ে মারে।
সবাই একসাথে, এক বিছানায়, একরাশ মিষ্টি দুষ্টুমিতে মগ্ন—
বিয়ের আগে এমন এক স্মৃতি, যা তারা আজীবন মনে রাখবে।
রাত পেরিয়ে ভোর হলো।
নরম আলোর রোদ জানালায় ভেসে আসছে।
তালুকদার বাড়িতে এক অন্যরকম ব্যস্ততা। আজ মিলির বিয়ে!
ঘরের ভেতর বাইরে সবখানে মানুষের কোলাহল, হাসি আর রান্নার গন্ধে ভরে উঠেছে চারপাশ।
চুলার পাশে রাধুনিরা ব্যস্ত—চিকেন রোস্ট, পোলাও, কোরমা, ফিশ ফ্রাই…
বাচ্চারা এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে—
চুমকি, মেহরিন, রাহি—সবাই একটু আধটু খেয়েই দৌড় দিয়েছে সাজতে।
পার্লার থেকে লোক এসেছে। কেউ আইব্রো করছে, কেউ ফেসে হালকা মেকআপ—ঘর যেনো অস্থির এক সৌন্দর্যকেন্দ্র।
মিলি এখনো চুপচাপ।
ওকে সাজাছে পার্লারের লোকেরা।
রাহি পেছন থেকে এসে বলে—
এই দ্যাখ, তোকে কনের মতো না, রীতিমতো পরীর মতো লাগছে!
চুমকি বলে ওঠে,
তাও বলো! সাজ শেষ হলে জামাইকে সাবধান করে দিতে হবে—এই বউ কোনো সাধারণ না বউ দেখে না আবার জামাই বাবাজী অঙ্গান হয়ে যায় ওই যে ওই গানের মতো বলেই গান ধরে…..
এইছে জামাই সাহেব হইয়া….
বইছে মুখে রুমাল দিয়া…
পাশ থেকে মেহরিন গায়,
ঘোমটা খোনার আগে
তোমাই করি গো সাবধান…
চাঁন্দের আলো দেইখা তুমি
হইয়ো না অঙ্গেন……
সবার মধ্যে সেই এক আনন্দ, উত্তেজনা, আর মায়ার মিশ্র অনুভূতি।
একদম নতুন দিনের আগমন। রঙিন পোশাক, উজ্জ্বল গহনা, সুন্দর মেকআপ—সব কিছু যেনো একে অপরকে এক অভিন্ন রঙে ঢেকে ফেলেছে।
মেহরিন, চুমকি, রাহি, নুপুর, মেহবুবা,মিলি—প্রত্যেকের চোখে মুখে আনন্দের আভা। পুরো বাড়ি এক উৎসবের মতো সেজে উঠেছে। নাচ-গান, হাসি-আলাপ সব কিছু যেনো এক ধরনের গুঞ্জন।
শাহরুখ খান আর সানিয়ার মতো ফিল্মি নায়িকার মেকআপ আর সাজে যেনো চমকপ্রদ লাগছে। বাড়ির মেয়েরা কেবল নয়, পুরো পরিবার যেনে একটি পরিবারের অংশ হয়ে একে অপরকে বরণ করছে।
সবাই অপেক্ষা করছে বরের, আর তখনই, হঠাৎ করে “জামাই আসছে!”—এই ঘোষণা দেওয়া হলো। ঘরের প্রতিটি কোণে মুহূর্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল।
জামাই আসছে:
রোডের দিকে চোখ রেখে বসে আছেন সবার মুখে এক ধরনের উত্তেজনা, কিছুটা কৌতূহল। জামাই আসে, একটু চমক, একটু আনন্দ ।
অপেক্ষার এক মুহূর্ত। তারপর, মিষ্টি হাসি, গম্ভীর মুখের মাঝে কিছুটা চিন্তা—পিছনের গাড়ি থেকে জামাই নামলো।
প্রথমে কয়েকটা গাড়ি চললো, তারপর এক ব্যক্তির হাত থেকে এক নতুন আগমন।
তার সামনে আসা বা ঢোকার কিছুটা সময়ের ব্যবধানে, বাড়ির কন্যাদের উচ্ছ্বসিত হাসির ঝর্ণা বেড়ে গেল।
“জামাই আসছে! জামাই আসছে!” সবার মধ্যে কথাবার্তা, হাস্যরস।
সাবিহা তালুকদার আর শামিমা তালুকদার জামাইকে বরণ করলেন, তাদের মুখে অত্যন্ত গর্বিত হাসি।
আছাড়-ধাক্কা না, বরং একটা আচার-উৎসবের মধ্যে জামাইকে বরণ করা হচ্ছে।
এখন শুরু হবে কিছু খেলা।
মেয়েরা ও বরের পরিবারের মধ্যে একটু পর্দার খেলাধুলা—যেমন ‘কনেমুখী’ খেলা, পাকুড়-চালনা।
মেয়েদের আবদার আর বরের পাশে, বরের পরিবারের পক্ষ থেকে মৃদু প্রতিবাদ:
গেটের সামনে যুদ্ধের দামামা….
বিয়ের বাড়ি মানেই তো শুধু ফুল-আলোর উৎসব না, সঙ্গে থাকে মেয়ের পক্ষ আর বর পক্ষের ঐতিহ্যবাহী লড়াই—গেট ধরার যুদ্ধ!
বরকে বরন করা শেষ।মেয়েদের দল আগেভাগেই নিজেদের ফ্রন্টলাইন ঠিক করে নিয়েছে—সাজা পিঁড়ি, ফুল, আর মুখে বাঁকা হাসি।
শামিমা তালুকদার ও সাবিহা তালুকদার চলে যেতেই তখনই,
মেহরিন এগিয়ে এসে গেট আটকে দাঁড়ায়, দুই হাত কোমরে। মুখে ভীষণ গম্ভীর ভঙ্গি, কিন্তু চোখে-মুখে একরকম দুষ্টু হাসি লুকিয়ে আছে।
—এই যে শুনুন! ৭০ হাজার না দিলে এই গেট আজ আর খুলবে না! তাড়াতাড়ি টাকা দিন, তারপর বউ নিন!
তার সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে চুৃমকি, রাহি,নুপুর, মেহবুবা আর বাকিরা শুরু করে—
— টাকা দিন, বউ নিন!
—টাকা দিন, বউ নিন!
একটা হালকা slow wedding song বাজতে থাকে পেছনে, আর তার সঙ্গে তালে তালে করতালি দিয়ে তারা চারপাশ জমিয়ে তোলে।
বরপক্ষ হতবাক!
বরপক্ষের বড় ভাই আর কাকা তর্ক শুরু করেন,
—এইটা আবার কেমন নিয়ম! ৭০ হাজার টাকার গেট ফি শুনছি প্রথম!
আর মেয়ের দলও চুপ থাকার নয়।
চুমকি চোখে চশমা পরার ভঙ্গি করে বলে,
—সুন্দর জামাই তো দামী হয় মামা, ওনার জন্য একটু স্পেশাল চার্জ নিলেই বা কী!
তর্ক-বিতর্ক, মজার কথা, ঠাট্টা-তামাশা মিলিয়ে পুরো গেট জমে ওঠে।
রাজ আর লাবিব দূর থেকে দেখছে আর মজা নিচ্ছে, মুখে চাপা হাসি।
রাজ বলে দেখলি আমার Moonbeam এর কথার কী জোর। লাবিব আড়চোখে দেখে বলে তোমার নারী সে এমন তো হবেই।রাজ হাসে।
শেষে বরপক্ষ হেরে যায়—তারা বলে,
—আচ্ছা আচ্ছা! নেন, নেন, নিচ্ছেন তো! গেট ছাড়েন এখন!
মেয়েরা ‘ইয়াহু!’ বলে চিৎকার করে উঠে।
আর গেট খুলে যায়—মজার, আনন্দে ভরা, বিজয়ের হাসিতে মুখর সবাই।
বরের সম্মানিত আসন ও খাবার পরিবেশন
গেটের যুদ্ধ শেষ, বর টাকা দিয়ে ঢুকেছে বিজয়ীর মতো—কিন্তু আদরের মধুর ফাঁদ তো এখনো শেষ হয়নি!
বরকে বসানো হয়েছে মণ্ডপের একপাশে সুন্দর করে সাজানো আসনে। সামনে রাজকীয় খাওয়ার ব্যবস্থা—সেই সাথে কনে পক্ষের দুষ্টু হাসি আর চোরাগোপ্তা প্ল্যান!
“বরের হাত ধোয়ানো” — দুষ্টু মেয়েদের নতুন মিশন!
চুমকি একেবারে গম্ভীর মুখে বলে,
— চলুন জামাইবাবু, এবার আপনাকে হাত ধুয়ে দেই। নিয়ম জানেন তো!
মেহরিন এগিয়ে আসে পানির জগ হাতে,
চুমকি-র হাতে সাবান,
রাহি আর নুপুরের-এর হাতে হাত ধোয়ার বাটি আর তোয়ালে।
একদিকে পবিত্র নিয়ম, আরেকদিকে দুষ্টুমির রাজ্য—
মেহরিন গম্ভীর মুখে পানির জগ হাতে এগিয়ে এসে বরকে বলে,
—ভালো করে হাত দেন, সাবান না লাগলে কিন্তু মাফ নাই!
চুমকি সাবান দিয়ে একদম আস্তে আস্তে হাত ঘষতে থাকে,
আর রাহি নিচু গলায় বলে,
—এভাবে যতবার জামাইবাবুর হাত ধোওয়ানো যায়, ততবার জমে! দে ডলা যাহে আজিনের হাতের ময়লা উঠে যায়।
এই কথা আবার বরের বন্ধু শুনে বলে,
গান ধরেন বিয়ান বলে নিজেই গায়তে শুরু করে,
সাবান দিমু…. সাবান দিমু ডইল্লা…
সবাই হেসে ফেলে গান শুনে।
নুপুর তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে হেসে, মুখ ঢেকে রাখে যেনো কিছু না শুনেছে।
মেহরিন বরের হাত মুছিয়ে দিচ্ছে।তার চোখে-মুখে প্রশান্ত অথচ অভিজাত ভাব। মৃদু হাসি লুকানো হলেও, সবাই বুঝতে পারছে সে মুডে আছে।
কিন্তু এমন সময়…
পেছন থেকে হঠাৎ এক যুবক, সম্ভবত বরপক্ষের কেউ—হয়তো বরের সবচেয়ে দস্যি বন্ধু—মজা করতে এসে মেহরিন-এর হাতটা ধরে ফেলে!
চোখে মুখে ছলছলে দুষ্টামি, কণ্ঠে একরাশ মজা নিয়ে বলে, আরেহ বিইয়ান একা বরকে সব খাতির যত্ন করলে হবে,আমাদের কেউ একটু দেখুন—কিন্তু চোখে চোখ রাখতেই…
মেহরিন-এর রাগী চোখ যেনো আগুন ছুঁড়ে দিলো! মেহরিনের চোখে কিছু একটা ছিলো, যা ছেলে টাকে ভয় পাওয়াতে বাধ্য করেছে।
ছেলেটা বুঝেই গেল, সে দুঃসাহস করে ফেলেছে।
— সরি বিয়াইন,” বলেই সে হাত ছাড়িয়ে নেয়, গলা কাঁপছে সামান্য।
মেহরিন ঠান্ডা গলায় বলে,
— Next time, এমন ভুল যেন না হয়।
তারপর ধীরে ধীরে ফিরে দাঁড়ায়।
আর পেছনেই চলছে সাইলেন্ট যুদ্ধ — জুতা চুরি!
মেহরিন চোখের ইশারায় রাহিক কে ইঙ্গিত দেয়,
— “চুরি শুরু করো!”
রাহি ব্যস্তভাবে বুঝে ফেলে। একটা চোখ টিপে উত্তর দেয় মিশনে নামল।
বরের জুতা তখন বরের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পাশে রাখা।
রাহি আস্তে করে গিয়ে পাশে বসে পড়ে, মাথা একটু নিচু করে, মুখে সেই চিরচেনা কিউট হাসি—
— “হাই বিয়াই”
ছেলেটা একটু চমকে তাকায়, তারপর দাঁত বের করে হাসে—হয়তো বুঝতে পারেনি রাহির আসল উদ্দেশ্য!
রাহি হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বলে,
—আমি রাহি।
যেই ছেলেটা হাত বাড়ায় পরিচয়ের জন্য, ঠিক সেই সময় রাহি সেই হাত দিয়ে ফট করে জুতো তুলে নেয়!
— ধরা খেয়েছো ভাই!
বলেই রাহি দৌড়!
পেছনে হতভম্ব যুবক, আর সামনেই মেহরিন, যিনি সব দেখে হাসি চেপে রাখতে না পেরে দাঁত বের করে হেসে ওঠে।
—ওহে বরপক্ষ, এইবার কষ্ট করে টাকা গুনে গুনে নিয়ে এসো!
“টাকা দিন,জুতা নিন।
বিয়ের বাড়ির হইহুল্লোড় চলছে পুরো দমে।
রঙিন শাড়ি, আতরের সুবাস, হালকা সাজে কনে পক্ষের মেয়েরা চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাসি, গান, আর দুষ্টু-মিষ্টি খুনসুটি—সব মিলিয়ে এক উজ্জ্বল উৎসবমুখর পরিবেশ।
ঠিক এমন সময়, বাড়ির গেটের দিক থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছান মেহরিন-এর বাবা-মা আর মাহির।
তাদের চোখে-মুখে গর্ব, মমতা আর আনন্দ মিলিয়ে এক অনন্য অভিব্যক্তি।
চুমকি, মেহবুবা আর মেহরিন দূর থেকে চোখে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে তারা ছুটে যায় তাঁদের দিকে।
— বাবা! মা! —মেহরিন আনন্দে বলে ওঠে। এতো দেরি করলে কেনো আন্টি বার বার জিজ্ঞেস করছিলো কখন আসবে।
মেয়েদেরকে দেখে-মা আবেগে জড়িয়ে ধরেন।
ওরা স্নেহের পরশে একাকার হয়ে যায়।
এই সময় সাবিহা তালুকদার আর রেদওয়ান তালুকদার ওদের দিকে এগিয়ে আসেন।
সাবিহা তালুকদার বলেন,
—আপনারা এসেছেন দেখে খুব ভালো লাগল। তার পর মেহরিনের মা কে বলে, আপা আপনার মেয়েরা কিন্তু আমাদের হৃদয়ের খুব কাছের।
মেহরিন-এর মা হাসেন—
—আপনারা যেভাবে ওদেরকে নিজের করে নিয়েছেন, আমরা নিশ্চিন্ত।
রেদওয়ান তালুকদার -বলেন, আহা এখানেই সব বলবে নাকি?
— ভেতরে আসুন, আপনারা।
ওনারা সবাইকে নিয়ে ভেতরে চলে যান।
আর এদিকে…
মাহির এগিয়ে এসে রিদ-এর পাশে দাঁড়াতেই, রিদ চেনা ভঙ্গিতে চোখ টিপে বলে—
— আরে এই যে আমার ছোটা প্যাকেট! কেমন আছো?
মাহির মুচকি হেসে বলে—
— ভালো ভাইয়্যা। আপনের সঙ্গে দেখা হইল অনেকদিন পরে!
রিদ তার পিঠে হাত রাখা আর মনে মনে বলে—
— এইবার তো দেখা হইবই, তুমি তো এখন আমার future brother-in-law! হবে।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব চলছে।
বিয়ের হুল্লোড়ের মাঝে অনেকেই একে একে খাবার টেবিলের দিকে যাচ্ছে। পোলাও, রোস্ট, কোরমা, বোরহানি—সাজানো থালায় সবার সামনে।
রিদ চোখ বুলিয়ে দেখছে, কিন্তু তার মন পড়ে আছে অন্যদিকে। সবাই একানে ওরা কোথায়?
চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে শেষমেশ ওদের একটা কোণায় বসে টিপটিপ করে কথা বলতে দেখে।
রিদ সোজা গিয়ে বলে,
— তোমরা এখানে? আরে খেতে চলো না! খাও, তারপর আবার মজা করো। সারাদিন তো শুধু ব্যস্ততা আর হাসাহাসি করেছো। এসব করার জন্য তো এনার্জি দরকার চলো আগে খাবে ।
রিদ-এর কথায় সবাই চুপ করে তাকিয়ে থাকে, তারপর হেসে মাথা নাড়ে।
রিদ নিজের হাতে ওদের প্লেট সাজাতে শুরু করে।
সঙ্গে আছে শান্ত আর রাকিব ও রামিম, যারা একটু দূর থেকে রিদ-এর হাসিমুখের কাজকর্ম দেখছে আর ইশারায় হাসাহাসি করছে।
অন্যদিকে,
বাড়ির এক শান্ত কক্ষে
রিদওয়ান তালুকদার ও সাবিহা তালুকদার মেহরিন-এর বাবা-মাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন।
বিয়ের ব্যস্ততার মাঝেও এই একান্ত আলাপচারিতার প্রয়োজন ছিল। চারজনেই সোফায় বসেছেন। কথা চলছে—পরিবার, সম্পর্ক আর জীবন ঘিরে।
সাবিহা তালুকদার হালকা করে স্বামীর দিকে তাকিয়ে ইশারা করেন।
রেদওয়ান তালুকদার ইঙ্গিতটা বুঝে মাথা নাড়েন, একটা দৃঢ় সিদ্ধান্ত যেন দীর্ঘদিন ধরে বুকের মাঝে পুষে রেখেছিলেন, এবার সেটাই প্রকাশ করার সময়।
তিনি ধীরে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন—
— ভাই সাহেব, একটা কথা বলতে চাই আপনাকে। কিছু চাওয়ার আছে আপনার কাছে।
মেহরিন-এর বাবা হেসে, কোমল স্বরে জবাব দেন—
— অবশ্যই ভাই সাহেব, বলেন কী বলতে চান।
রেদওয়ান তালুকদার মুখ তুলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন—
আমি আপনার মেয়ে মেহরিন মা কে আমার ঘরের বউ করে আনতে চাই। আমার ছেলে রিদ-এর জন্য আমরা ওকে চাই। আমার স্ত্রী আর আমি দুজনেই মেহরিন মা কে খুব পছন্দ করি। আমরা চাই, মেহরিন হোক আমাদের ঘরের লক্ষ্মী।
এক মুহূর্তের নীরবতা।
মেহরিন-এর মা ও বাবা একে অপরের দিকে তাকান।
চোখে কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা আনন্দের ছায়া। একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে দায়িত্বশীল চিন্তা।
তারপর মেহরিন-এর বাবা ধীরে বলেন—
—ভাই সাহেব, আপনারা আমাদের যে সম্মান দিলেন, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা অবশ্যই পারিবারিকভাবে আলোচনা করে আপনাদের জানাবো।
সাবিহা তালুকদার সঙ্গে সঙ্গে বলেন—
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৮
—অবশ্যই, আমরা অপেক্ষা করবো। আপনারা যেনো মন খুলে আলোচনা করেন। আমরা চাই সবকিছু হোক সবার সম্মতি পারিবারিক আলোচনা আর ভালোবাসার মধ্য দিয়ে।
বেদন তালুকদার মাথা নাড়েন সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে। চারজনের মাঝেই তখন এক অদৃশ্য বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে।
এই আলোচনা শেষে রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময়, ভবিষ্যতের এক নতুন অধ্যায়ের সুর যেনো বাতাসে মিশে থাকে।