মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩০

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩০
মির্জা সূচনা

বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ। এবার সেই কঠিন মুহূর্ত—
বিদায়ের পালা।
একটা মেয়ের বিয়ের পর বাড়ি ছাড়ার সময়টা যেনো হাজারো স্মৃতি এসে বুকে আঘাত করে।
মিলি কাঁদছে ফুপিয়ে ফুপিয়ে।
ওর চোখের জল যেনো আজ আর থামার নামই নেয় না।
জাফর তালুকদার—একজন কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ সেনা অফিসার, কিন্তু আজ তিনিও নীরবে চোখ মুছছেন।বড় ভাই রেদওয়ান তালুকদার ডাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

শামিমা মুখ ফিরিয়ে চুপিসারে কাঁদছেন।সাবিহা তালুকদার ও কান্না করছে বাড়ির প্রত্যেকটা ছেলে মেয়ে তার নিজের ছেলে মেয়ের মত কেউ কারো থেকে কম নয় সবার যত আবদার যে তারিকাছে।
রামিমকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্না করে। রামিমা বোনকে জড়িয়ে ধরে,কপালে একটা চুমু খায় তারপর নিজের কান্না লুকাতে চলে যায়।
মিলি কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরে রাহি আর নুপুর-কে। তিন বোন একাকার হয়ে যায় কান্নার স্রোতে।
ঠিক সেই সময় রিদ এগিয়ে আসে।
মিলি তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে বুক ভেঙে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রিদ মাথায় একটা কোমল চুমু খায়, যেনো বোনকে নিজের হৃদয়ের গভীর থেকে বিদায় জানায়। বোনকে বিদায় দেওয়ার সময় যে একটা ভাইয়ের কলিজায় কতটুকু আঘাত লাগে তা শুধু ভাইয়েরাই জানে।
রিদ এগিয়ে গিয়ে মিলি-র বর শাফিনের চোখে চোখ রেখে বলে—
—আমার কলিজার টুকরো বোনটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম। ওকে কষ্ট দিয়ো না। অন্যায় করলে শুধু বোঝাবে —ভালোবাসা দিয়ে ঠিক করবে।কখন ওর গায়ে হাত তুলবে না। মনে রেখো, ওর দুই ভাই আছে। পরিবার আছে। যদি কোনোদিন মনে হয় ও তোমার কাছে বোঝা হয়ে গেছে, তাহলে আমাদের জানাবে ওর সাথে বাজে ব্যবহার করবে না —আমরা আছি। গিয়ে নিয়ে আসবো।

তবে বিশ্বাস করি, তুমি ওকে ভালোবাসবে আমাদের চেয়েও বেশি।
শাফিন সম্মানসূচক মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। তারপর মিলি-কে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
দূর থেকে দাঁড়িয়ে মেহরিন, চুমকি আর মেহবুবা চুপচাপ দেখছে এই দৃশ্য।
তাদের চোখেও জল।
হঠাৎ চুমকি আর মেহবুবা দুজনেই মেহরিন-কে জড়িয়ে ধরে বলে—
—তুই আমাদের ছেড়ে একদিন এমন করেই চলে যাবি তাই না রে? আমাদের অসহ্য কষ্ট হবে তখন। আমরা কিবাবে থাকবো তোকে ছারা।

মেহরিন কিছু বলতে পারে না। শুধু চোখের কোনায় জমে থাকা জলটুকু গড়িয়ে পড়ে।
বিদায়ের এই মুহূর্ত, প্রতিটা হৃদয়ে গেঁথে যায় আজীবনের জন্য।
বিয়ের আনন্দ শেষে ঘরে ফিরেছে মেহরিন’রা।
চুমকি আজ আর ওর বাড়ি যায়নি অবশ্য এই বাড়িও চুমকির নিজের বাড়ির মতই। মেহরিন, চুমকি, মাহবুবা ও মাহির ওরা এখন একসাথে বসে আছে ড্রইং রুমের সাদা সোফায়। কারো মুখেই হাসি নেই। মিলি-র বিদায়ের কান্না যেনো এখনও কান থেকে সরেনি। মনে হচ্ছে, একটা বড় শূন্যতা এসে বসেছে ওদের মাঝখানে।
সেই সময় মেহরিন-এর বাবা, ফিরোজ মির্জা একা বসে আছেন বারান্দার সোফায়।
তাঁর মুখে চিন্তার রেখা, চোখে যেনো কিছু হিসাব কষা চলছে।
হঠাৎ তিনি ফোনটা হাতে নিলেন।

একটু থেমে এক নম্বরে ডায়াল করলেন।
কলটি রিসিভ হতেই তিনি শান্ত গলায় বললেন
—তুমি যা বলেছিলে তাই তো হলো। এখন বলো, আমি কী করবো?
ওপাশে কেউ কিছু বললো, কিন্তু ফিরোজ মির্জা ছাড়া অন্য কেউ শুনলো না। শুধু শুনতে পাওয়া গেল মেহরিন-এর বাবার একপ্রস্থ হাসি।
তিনি আবার বললেন—

—ঠিক আছে… তবে একটা কথা… মেহু কি রাজি হবে?
ওপাশ থেকে আরও কিছু বলা হলো। এবার তিনি আবার হেসে উঠলেন, একেবারে প্রাণখোলা হাসি।
—তুমি সত্যি, পাকা খেলোয়ার,আচ্ছা আমি রাখছি এখন ভালো থেকো।
ফোনটা কেটে দিয়ে তিনি চুপচাপ বারান্দার আকাশপানে তাকালেন। মুখে হাসি, চোখে একরাশ প্রত্যাশা।

অন্যদিকে, ড্রইং রুমে মাহবুবা, মেহরিন, চুমকি আর মাহির বসে আছে চুপচাপ।
মিলি-র বিদায়ের মুহূর্ত এখনও সবার মনে বাজছে। কারোই মন ভালো না।
একজনও হাসছে না।
কোনো কথা নেই, শুধু নিস্তব্ধতা।
কথা নেই, হাসি নেই—ঘরটা যেনো নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে।
সেই নীরবতার মাঝখানেই হঠাৎ আলোর ঝলকানি নিয়ে হাজির হয় মাহির। মুখে একরাশ কৌতুকের হাসি, চোখে দুষ্টুমির ঝিলিক।

—একদিন তোরও বিয়ে হবে, বুঝলি মেহু আপু! তখন তুইও এমন করে এই বাড়ি ছেড়ে বিদায় নিবি।
সবাই চমকে তাকায় ওর দিকে। মেহরিন, মেহবুবা, চুমকি—তাদের চোখে জল, মুখে ম্লানতা। মাহির থামে না।
— আাহা, তখন তোর রুমটা আমি নিয়ে নেব, হাহা! কবে যাবি বল তো,আপদটা বিদায় নেয়, তাহলে মজাই মজা! তখন আম্মুর কাছে আমার নামে কেউ কিছু লাগবে না, কেউ আমায় বকা দেবে না।কথায় কথায় কেউ বকাবকি করবে না,তখন আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারব কেউ বাধা দিবেনা, তকন আমি হবো এই বাড়ির রাজা হাহাহহা।
চুমকি মুখ চেপে হাসে, মেহবুবা চোখ মুছে নেয়। আর মেহরিন? সে তাকিয়ে থাকে ভাইটার মুখের দিকে। সেই ছোট ভাইটা যে কষ্টের মুখে হাসির রং মাখাচ্ছে।
মেহরিন মৃদু হেসে বলে ওঠে—

— তাই আমি চলে গেলে তুই সত্যি খুশি হবি, তাই তো? আমি না থাকলে কে তোর assignment করবে? কে দেরি করে বাড়ি ফিরলে দরজা খুলে দেবে? কে তোকে বাঁচাবে আম্মুর বকুনি থেকে?কার ব্যাগ থেকে টাকা নিবি? কার কাছে এসে বায়না করবি এটা খাব এটা করে দে, আমি চলে গেলে সারাদিন কাকে জ্বালাবি তুই?
এই প্রশ্নগুলোতে লুকিয়ে থাকে এমন এক ভালোবাসা, যা শব্দে ধরা যায় না। কথা বলার ফাঁকে সবার চোখের কোণে জল জমে ওঠে।
হঠাৎ মাহির ছুটে আসে, মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে—

—না না না… তুই কোথাও যাবি না! তুই চলে গেলে আমার কী হবে? আমি তোকে কোথাও যেতে দেবো না, আপু… তুই আমার কাছেই থাকবি! আমিতো শুধু তোরদের কে হাসানোর জন্য বলছিলাম। আমি সত্যি সত্যি বলি নাই রে আপু তোরা ছাড়া যে আমার দুনিয়া অন্ধকার। আমার ভালো লাগা খারাপ লাগা হাসি দুঃখ খুশি সবজি তোদেরকে ঘিরে। আমি কেমনে থাকব তোকে ছাড়া, তোকে আমি কোথাও যেতে দিব না ।
চুমকি আর মেহবুবা ওদের দু’জনও এসে জড়িয়ে ধরে ওদের। কান্না আর ভালোবাসার সে এক অপরূপ দৃশ্য।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ওদের মা। এতক্ষণ ধরে ওদের কাহিনী দেখছিলো এতক্ষণের জমে থাকা চোখের জল গুলো এখন চোখ বেয়ে নেমে আসে নীরব অশ্রু। চোখে অশ্রু নিয়েও হেসে দিলেন ওদের ভালোবাসা দেখে।
এই কান্নার মাঝেই জন্ম নেয় ভালোবাসার হাসি। এই কান্না কোনো বিদায়ের নয়, এই কান্না আটকে রাখা ভালোবাসার।

চোখের পানি মুছে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যায় মালিহা মির্জা—
—আমি কি বাদ পড়বো নাকি? আমি-ও তো আছি!
সে এগিয়ে এসে সবাইকে জড়িয়ে ধরে। আর সেই মুহূর্তে কান্না আর হাসিতে ভেসে যায় পুরো ঘরটা। যেনো এক মুহূর্তে মিলেমিশে যায় সমস্ত ব্যথা, সমস্ত শূন্যতা।
এখানে কেউ একা নয়, কেউ দূরের নয়। এই ভালোবাসার বাঁধনে সবার হৃদয় এক হয়ে যায়।

সবাই যখন আবেগে ভেসে যাচ্ছে, তখনই মেহরিনের মা গলা তুলে বললেন,
—আরে বাবা, অনেক তো কান্নাকাটি হলো! এখনি তো আর কেউ কোথাও যাচ্ছে না। সবাই আমাদের সাথেই থাকছে। তাই সবাই হাসি খুশিতে থাকো। আমার বাচ্চারা কাঁদবে না, হাসবে। তো এবার চলো, খেতে চলো সবাই।
তার কথায় যেনো হঠাৎ করেই বাতাসটা হালকা হয়ে গেল। সবার মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটে উঠল। একে একে সবাই খাবার ঘরে গিয়ে বসল—হাসি, মজা আর দুষ্টুমির মধ্যেই ডিনার শেষ হল। এরপর সবাই ধীরে ধীরে নিজেদের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।
এদিকে চুমকি ব্যস্ত ফোনে শান্ত’র সাথে কথা বলতে, আর মেহবুবা যেনো কিছু বলতে চায়—তবু মুখ খুলে পারছে না। মেহরিন ওর ভাবভঙ্গি দেখে বলল,

— এই, কি রে কি খিচুড়ি পাকাচ্ছিস মনে মনে! পেটে যা আছে বলে ফেল। না হলে পেটে খিচুড়ি ব্লাস্ট করে মরে যাবি, অত রিস্ক না নিয়ে বলে ফেল।
মেহবুবা হেসে ফেলল মেহরিনের কথা শুনে, তারপর একটু থেমে বলল,
— আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
— “বলে দে” বলল মেহরিন, গা এলিয়ে।
মেহবুবা একটু ইতস্তত করে বলল,
— রাগ করবি না তো?
মেহরিন চোখ পাকিয়ে বলল,
— দ্যাখ, আগে থেকেই বলে রাখছি, রাগ করব। তবুও বল।
মেহবুবা একটু হাসল, তারপর গম্ভীর মুখে বলল,

—কাল কী হয়েছিল? তুই এত রেগে গিয়েছিলি কেন?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেহরিন সব কথা খুলে বলল। কি ঘটেছিল, কেন এত রেগে গিয়েছিল—সব। মেহবুবা মনোযোগ দিয়ে শুনল। তারপর একটু থেমে বলল,
—তুই আরাফ ভাইয়াকে মেরেছিস?
এই কথা বলেই মেহবুবা এমনভাবে হেসে ফেলল, যেনো হাসির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে
মেহরিন লজ্জায় আর রাগে বালিশ ছুঁড়ে দিল ওর দিকে।
ঘরের ভেতর আবার হাসির রোল উঠল।

একটা বিয়ের আনন্দের দিন শেষ হলো এমন হেসে, এমন আপন হয়ে। কান্না, দুঃখ, অভিমান—সব পেরিয়ে আবার তারা ফিরে এল একটাই ছায়ায়—ভালোবাসায়।
ঘরের কোণায় তখনও হাসির রেশ। মেহরিন, আর মেহবুবা দুষ্টুমি আর মজায় ব্যস্ত। এমন সময় চুমকি হঠাৎ করেই জোরে একটা হাততালি দিয়ে বলে উঠল,
— বাহ্! জানু বাহ্ আমার এই না হলে বেস্টটু ওই শালাকে তুই শুধু থাপ্পড় দিলি কেন বা*ল।দিতি একেবারে শালার হাত পা ভেঙে ! কত্তো বড় সাহস? আমার জানুর হাত ধরে।
মেহরিন হেসে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলল,

— হইছে, থাম। যে থাপ্পড় খাইছে, সেই সারাজীবন মনে রাখবে! আর তুই এত উত্তেজিত হোস না তো।
চুমকি ও মেহবুবা একসাথে হেসে উঠল। হাসির ফোয়ারা যেনো আর থামতেই চাইছিল না।
তারপর সবাই নানা গল্পে মেতে উঠল—পুরনো প্রেম, ক্লাসের মজার স্মৃতি, আড্ডার ঢেউ…
ঠিক তখনই মেহরিনের ফোনটা ‘বিপ’ করে উঠল।
মেহরিন ফোন তুলে দেখল, এসএমএস এসেছে। প্রেরক—রাজ। মানে মেহরিনের কবি সাহেব।
ঠিক তখনই মেহরিনের ফোনটা ‘বিপ’ করে উঠল।
মেহরিন ফোন তুলে দেখল, এসএমএস এসেছে।
একটা আবেগে ভরা, গভীর অনুভূতিসম্পন্ন বার্তা:

> “তোমার চোখে আজকের হাসির ছায়া,
তবুও কি সেখানে লুকোনো কষ্টের ব্যথা?
জানি না, কিন্তু জানি এইটুকু—
তুমি যেমন, তেমনই থাকো।
কারণ, তুমি হাসলে আমার কবিতা বাঁচে।”
মেহরিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ফোনের দিকে।
চোখের কোণে একফোঁটা অচেনা জল জমল না, কিন্তু হৃদয়টা একটু যেনো গলে গেল। ওর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। চুমকি তখনও গল্পে ব্যস্ত, মেহবুবাও ঠিক পাশে।
মেহরিন এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ফোনটা পাশে রেখে বলল,
— কবির ভাষায় কিছু কথা শুধু হাওয়ার মতো—ধরা যায় না, কিন্তু ছুঁয়ে যায় মন…”
চুমকি তাকিয়ে বলল,

— কী রে! তুই দেখি কবির মতো কঠিন কথা বলছিস কাহিনী কি?
মেহরিন কিছু না বলে শুধু হেসে দিল।
আবার একটি এসএমএস
**“তোমাকে বলে দিই— আমি সেই পাগল, যে চাঁদকে দেখে ভাবে, তোমার কপালের টিপ।
আমি সেই উন্মাদ, যে বাতাসে খোঁজে তোমার চুলের গন্ধ।
আমি প্রেম লিখি না,
আমি প্রেমে তুমি হয়ে যাই।”**
মেহরিনের মুখে তখন অদ্ভুত এক অনুভবের হাসি।
চুমকি তখন পাশে এসে বলল,
— কে এসএমএস করলো?
মেহরিন মুচকি হেসে বলল,
— একজন পাগল…
যে প্রতিটা লাইনে আমায় ভালোবাসে,
আর প্রতিটা শব্দে আমায় আঁকে…।
চুমকি চোখ বড় বড় করে বলল,

—হায় হায় কি বলিস? তুই আজকাল পাগলের সাথেও কথা বলা শুরু করেছিস। এই খবরদার আর কথা বলবি না।দে আমাকে পাগলের নাম্বারটা দে, আমি ওকে খুঁজে বের করে পাবনা রেখে আসি?
মেহরিন জানালার বাইরে তাকিয়ে মুচকি হেসে শুধু বলল,
— ওকে দেখানো যায় না,
ওকে বুঝতে হয়…
বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে মেহরিন। রাত গভীর, তবুও মনটা কেমন যেনো অস্থির। হঠাৎ করেই সে একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠিয়ে ফেলে—
আপনি কোথায় এখন? অফিসে, না বাসায়? আর খাবার খেয়েছেন তো?
যেনো সাধারণ খোঁজখবর, তবুও এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক টুকরো যত্ন, এক চিমটে অধিকার।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রিপ্লাই আসে।

> ইস্… এভাবে বলো না, Moonbeam!
তোমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আরও বেড়ে যায়।তখন মনে হয় সবকিছু ছেড়ে ছেড়ে তোমার কাছে চলে যাই।কবে এমন দিন আসবে যেদিন আমি অফিস থেকে ফিরে দেখব তুমি আমার অপেক্ষায়, একটু দেরি করে ফিরলে বকাবকি করবে তারপর আদর করে সেটা আবার পুষিয়ে দিবে ভালোবাসায়।
তোমার এই কথাগুলো জানি, যেনো কেমন বউ বউ ফিল আসে…
না, আমি আর পারছি না বউ ছাড়া থাকতে।
আজকেই তোমার বাবাকে বলব—দাঁড়াও তুমি!তোমাকে ছাড়া থাকাটা আমার জন্য অসহ্যকর হয়ে যাচ্ছে। তুমি বলো এই বয়সে কি বউ ছাড়া থাকা যায় ?
মেহরিন চোখ বড় বড় করে ফোনের দিকে তাকায়। মুখে লালচে আভা, চোখে খানিকটা অবিশ্বাস—কিন্তু ঠোঁটে হাসির রেখা টানাটানি করে।

সে চোখ নামিয়ে কাঁথার কোণে মুখ গুঁজে ফিসফিস করে লিখে—
>আপনি কি পাগল? সবসময় এই এক চিন্তা কেন ঘুরে আপনার মাথায়।সারাক্ষণ শুধু বউ বউ করেন, শয়তান, নির্লজ্জ ব্যাটা মানুষ।আপনি আর এসএমএস দিবেন না আমাকে গুড নাইট।
মেসেজটা লিখে সে ফোনটা পাশে রেখে দুই হাতে মুখ ঢাকে। কাঁথার ভেতর থেকেই নিচু স্বরে বলে—
>ইসস্… এই লোকটা আমায় লজ্জা দিতে দিতে একদিন মেরেই ফেলবে!
তবু তার গালে তখনো সেই চিরচেনা মুগ্ধতা,
আর চোখে স্বপ্নের আলো… যেনো কেউ তার খুব আপন হয়ে উঠছে।
দুপুর দুইটা।

রাস্তার ধারে একটা ছায়াঘেরা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে মেহরিন। সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপ গায়ে লাগছে, তবুও সে বারবার মোবাইল স্ক্রিনে তাকাচ্ছে। বিরক্তিতে মুখ ভার করে ফেলেছে অনেক আগেই।
এই চুমকি রে…
তোকে যদি পাই…
দাঁতে দাঁত চেপে ফোঁস ফোঁস করছে মেহরিন।
চুমকি বলেছিল, সে ইউনিভার্সিটিতে যাবে একটা জরুরি কাগজ জমা দিতে। বেশি সময় নেবে না—বলে রেখেছিল,তাই মেহরিন আর যায়নি সাথে ভেবেছিল খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে চুমকি কিন্তু এই বজ্জাত মহিলার এখনো দেখা নাই। গরমে মেহরিন যাতে বের না হয়, সে ঠাণ্ডা কিছু নিয়ে চলে আসবে। অথচ এখনো তার দেখা নেই।
মেহরিন আরেকবার ফোন হাতে নিয়ে কল দেয়।

—এই চুমকি! কোথায় তুই? আর কতক্ষণ? আমি চলে যাব কিন্তু একা!
ওপাশ থেকে চুমকির গলা, স্বভাবসুলভ ঢংয়ে বলে, জানু রাগ করিস না তো! আসছি, দুই মিনিট…
মেহরিন বিরক্ত গলায় বলে, ওকে আয়। তাড়াতাড়ি আয়।
কল কেটে পাশে তাকায়, গাড়ি-ঘোড়া যাচ্ছে, রোদে ঝলসে যাচ্ছে চারদিক।
ঠিক তখনই—
তার চোখ আটকে যায় একটা দৃশ্যে।
হাঁটছে এক ছেলে আর এক মেয়ে। ছেলেটা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। তারা একটা রেস্তোরাঁর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মেহরিনের বুকটা “ধক” করে কেঁপে ওঠে।
চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে মুহূর্তে। কারণ ছেলেটা—
রাজ।
তার কবি সাহেব।

গলা শুকিয়ে আসে। মাথার ভেতর যেনো সব খালি হয়ে গেছে। শরীরে একটুও শক্তি নেই, যেনো এখনই পড়ে যাবে তবুও… সে থেমে থাকে না। চুপিচুপি পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় রেস্তোরাঁর দিকে। ভিতরে চোখ রাখে।
রাজ বসে আছে মেয়েটার একপাশে। মেয়েটার চোখে চোখ রেখে হেসে হেসে কী যেনো বলছে। আর মেয়েটা ওর হাতে হাত রেখে হালকা গলায় কিছু বলছে।
মেহরিন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সে ওই টেবিলের বিপরীত দিকে, এমনভাবে বসে যে রাজ আর মেয়েটার মুখের দিক না তাকিয়ে কেবল শব্দ শুনতে পারে। যেনো এক অভিশপ্ত শ্রোতা, যে কষ্ট পেয়েও শুনে যেতে বাধ্য।

—তোমাকে এতদিন খুব মিস করেছি।
—আমিও একটা এতগুলো মিস করেছি তোমাকে।
—এবার কিন্তু আর যেতে দিবোনা এবার আমার সাথে থাকতে হবে ঠিক আছে।
মেয়েটি রাজের হাত ধরে বলে, আগে বলো আমি যা বলেছি তা তে তুমি রাজি?
রাজ হেসে বলে, অবশ্যই মহারানী। আপনি যা বলবেন তাই হবে। মালোশিয়া তেও আপনার কথা চলতো এখন বাংলাদেশে এসোও আপনার কথাই চলবে।আমি কি পাইলাম জীবনে সবসময় আপনার কথাই শুনতে হয় আমার।
মেয়েটি হেসে ফেলে।
আরও কিছু মধুর কথোপকথন ভেসে আসে কানে।
আর মেহরিন…

তার বুকের ভেতর জমে থাকা বিশ্বাস যেনো চুরমার হয়ে যাচ্ছে একেকটা শব্দে।
গাল ভিজে যাচ্ছে অঝোর অশ্রুতে।
সে নিঃশব্দে চোখ নামিয়ে ফেলে। কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইলটা ধরে।
রাজের নামের পাশে একখানা খালি চ্যাটবক্স।
কিছু লিখবে, না মুছে দেবে—
তা বুঝে ওঠার আগেই চোখ বেয়ে পড়ে অশ্রু।
মনে মনে ফিসফিস করে—
আপনি যদি সত্যি আমার কবি সাহেব হতেন, তবে অন্য কারো কখনো হতে পারতেন না, আপনাকে অনেক আগে থেকেই অন্য কারো কবি সাহেব আমিই থার্ড পারসন ছিলাম।

দুপুরের সেই মুহূর্তের পর থেকে মেহরিন আর নিজের ঘরের দরজা খোলেনি। ঘরটা নিঃশব্দ, আলো-আঁধারির খেলায় এক অদ্ভুত নির্জনতা তৈরি হয়েছে।
বাইরে সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে, কিন্তু মেহরিনের ঘরের জানালায় সেই আলো পড়ে না। তার মায়ের ডাক, দরজায় টোকা—কিছুতেই সাড়া মেলেনি। শুধু একটা কথা বলে রেখেছে সে,
মাথাব্যথা… একটু ঘুমাবো।
মেহবুবা আর মাহির অনেকক্ষণ ঘুরঘুর করেছে কিন্তু কোন পাত্তা না পেয়ে আবার নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়েছে তারা ।

আসলে ঘুম নয়, ছিল অশ্রুতে ভেজা একঘেয়ে কান্না। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, নিজেও টের পায়নি মেহরিন। চোখ মুখ ফুলে গেছে, ক্লান্তিতে মুখটা বিবর্ণ, কিন্তু মনটাও যেনো তার চেয়েও বেশি ভেঙে পড়েছে।
মহিলা মির্জা এসে দরজায় কড়া নাড়েন।
মেহু, দরজা খোল! আজান পড়ে গেছে। এই সময় শুয়ে থাকা ভালো না। আমি চা দিচ্ছি, খেয়ে নে—মাথাব্যথা কমবে।
মেহরিন ধীরে ধীরে চোখ খোলে। যেনো স্বপ্নের ভেতর থেকেও মনটা এখনও কেঁদে চলেছে। কষ্ট আর অভিমান মিলিয়ে বুকটা ভারী লাগছে তার।
সে উঠে পড়ে, ধীর পায়ে ওয়াশরুমে যায়। হালকা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে নেয়। আয়নায় নিজের মুখ দেখে অবাক হয়—এ কেমন মেহরিন?
অবশেষে, নিঃশব্দে দরজা খুলে দেয়।

মহিলা মির্জা দরজা খোলার শব্দে তাকান, তারপর চোখ আটকে যায় মেহরিনের মুখে।
কি হইছে রে তোর? চোখ মুখ তো ফোলা কাঁদছিলি?
মেহরিন কষ্ট লুকিয়ে, এক গাল হালকা হাসি দিয়ে বলে—
না মা, আমি কাদবো কোন দুঃখে একটু বেশিই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মনে হয় তাই এমন লাগছে। কিছু না… ছাড়ো এসব, আমায় একটু পাস্তা করে দাও না? অনেক খিদে পেয়েছে।
মহিলা মির্জা ধীরে ধীরে কাছে এসে মেহরিনের কাঁধে হাত রাখেন। একটা মায়ামাখা স্পর্শ।
তিনি কিছু না বলে কিচেনের দিকে এগিয়ে যান, আর মেহরিন ধীরে ধীরে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, চারদিক নরম আলোয় ঘেরা। আর তার ভিতরে, এক অদৃশ্য কান্নার ছায়া।
রাজের সেই মুখটা, সেই চোখের চাহনি, আর পাশে বসে থাকা মেয়েটির হাসি—সবকিছু এখনও ওর চোখের সামনে ভাসছে।

তবু সে নিজেকে শক্ত করে। কারণ সে মেহরিন। সে ভেঙে পরতে পারে না—বরং ভেতরে ভেতরে লড়াই করে।
সোফায় বসে চুপচাপ খাচ্ছে মেহরিন। মুখে খাবার গেলেও মনে তার ঝড়। একের পর এক চিন্তার ঢেউ আছড়ে পড়ছে মাথায়।
কবি সাহেবটা আমায় কেন ধোঁকা দিল? কেন এমন করল?
ওর ভিতরে হঠাৎই এক জেদ জেগে উঠেছে। একরাশ কষ্ট আর অভিমানে চোয়াল শক্ত করে ও বলে উঠল মনে মনে
“কি ভেবেছিলো? আমাকে ঠকাবে, আমায় ভেঙে দেবে? আমি কাঁদব? আপনার পায়ে পরে বলবো থেকে যেতে? তাহলে ভুল ভেবেছেন। আমি মেহরিন মির্জা—ভেঙে পড়া আমার স্বভাব নয়।

“যেভাবে আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা কে আগলে রেখেছি,যেভাবে আমার ভিতরে আপনার জন্য ভালোবাসাকে লালন পালন করতাম, সেভাবেই আপনার প্রতি আমার ভালবাসাকে গলা টিপে মেরে ফেলব। কারণ আমার ভালবাসা দুর্বলতা নয়—প্রতিজ্ঞা। কোনো প্রতারককে আমি আমার ভালোবাসা নিয়ে খেলতে দিব না।কোন বিশ্বাসঘাতক প্রতারকের আামাকে ভালোবাসার বা আমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা নেয়।
মেহরিনের মুখ শক্ত। খাওয়া শেষ করে প্লেটটা পাশে রেখে পেট টা করে ঘষে ঘষে ধুয়। মনে হচ্ছিলো ভেতরের আগুন যেনো একটু শান্ত হয়েছে।
ঠিক সেই সময়ই ভেতরের দিক থেকে মেহরিনের বাবার ডাক শোনা গেল—
মেহু… একটু এদিকে আয় মা…
মেহরিন বলে, আসছি বাবা।

দু’কাপ চা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল মেহরিন।দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে ফিরোজ মির্জা গলা তুলে বললেন,
আয় মা, ভেতরে আয়।
চুপচাপ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে মেহরিন বাবার দিকে তাকাল। চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে সেই চিরচেনা হাসি।
ফিরোজ মির্জাও মেয়েকে দেখে হালকা হেসে বললেন,
আমার মেয়ে, দুই কাপ চা নিয়ে এসেছে!
মেহরিন বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা কাপ তাঁর হাতে দেয়, অন্যটা নিজের হাতে রেখে শান্ত গলায় বলল,
বলো বাবা, তুমি কিছুর জন্য ডেকেছিলে আমাকে?

ফিরোজ মির্জা চোখে একরাশ মায়া নিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
তুই তো আমার ছোট্ট পুতুল ছিলি রে, কবে যে এত বড় হয়ে গেলি, বুঝতেই পারিনি। এখন তো ইউনিভার্সিটিতে পড়িস, নিজের মত করে চিন্তা করিস…ওই তো সেদিন আমার হাত ধরে হাটা শিখলি, ফোক্লা দাঁতগুলো বের করে হাসতি, আদর সারে বাবা বাবা বলতি। সেদিনও তো আমার কাঁধে চরে পুরো এলাকা ঘুরতি। আর আমার সেই ছোট্ট পুতুল মা টা এখন একটু বড় হয়ে গেছে।
মেহরিন মুচকি হাসে। কিন্তু বাবার চোখে আজ কিছু বেশি গভীরতা।
আয়, আমার পাশে এসে বস,

বলে ফিরোজ মির্জা তাকে একদম পাশে ডাকেন। মেহরিন নিঃশব্দে বাবার পাশে গিয়ে বসে।
তিনি মেয়ের হাতটা আলতো করে ধরে বলেন,
আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই তোকে… রিদের বাবা, মানে রেদওয়ান তালুকদার ও তার স্ত্রী.. ওরা তোকে উনাদের ছেলে রিদের বউ হিসেবে চায়। আমি এখনো কোনো উত্তর দিইনি, কারণ আমি চাই, প্রথমে তুই কী বলিস তা জানতে, সংসার তারামি করবো না তুই করবি তোর মতামত টা আমার কাছে বেশি ইম্পরট্যান্ট। অবশ্য আমি জানি, আমার মেয়ের চোখে চোখ রেখে আমি সত্যি শুনতে পারি।আমি এমন কোন কাজ করবে না যাতে আমি নিরাশ হই।

মেহরিন নিঃশব্দে বাবার দিকে তাকায়। বাবা আমাকে কত বিশ্বাস করে কত আস্থা আমার উপর বাবার, কিন্তু আমি হৃদয়ে তখন ঝড়। বাবার আত্মবিশ্বাসী কথা আর রাজের উপর রাগ, অভিমান, ভালোবাসা, ঘৃণা—সব একসাথে কাঁদছিল ভেতরে। রাজের প্রতারণা, সেই দুপুরে রেস্টুরেন্টের ছুরির মতো ক্ষত, এক মুহূর্তে সব মনে পড়ে যায়।
কিন্তু বাবার ওই নির্ভরতায় ভরা চোখ দুটো… মেহরিন জানে, এই বিশ্বাস সে ভাঙতে পারবে না। সে চুপচাপ ভাবে,
তুমি যাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করো বাবা, সে কীভাবে তোমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে?
তারপরে মেহরিন চোখ নামিয়ে শান্ত গলায় বলে,

আমার কোনো আপত্তি নেই, বাবা। তুমি ‘হ্যাঁ’ বলো। আমি রিদ ভাইয়াকেই বিয়ে করব।
এইটুকু বলেই সে উঠে যায় ধীর পায়ে, যেনো নিজের মনের প্রতিটা ভার সে পায়ের শব্দে চাপা দিয়ে রেখে যাচ্ছে।
মেহরিন ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ফিরোজ মির্জা ফোন তুলে নেন। স্ক্রিনে নাম ভেসে ওঠে—”Riduwan Talukdar “।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ২৯

কলটি রিসিভ হতেই বলেন,
ভাই সাহেব, আমরা রাজি… আমার মেয়ে রাজি।
ফোনের ওপাশে রেদওয়ান তালুকদারের আবেগ চাপা গলায় শুধু একটাই শব্দ শোনা যায়—
“আলহামদুলিল্লাহ।”

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩১