মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩১
মির্জা সূচনা
নিজের ঘরে ঢুকেই দরজা টা চাপিয়ে দিলো মেহরিন। চারপাশের নীরবতাটা যেনো হঠাৎ করেই ভীষণ চিৎকারে ভরে উঠল তার ভেতরে।
গলায় যেনো আওয়াজ নেই, চোখে কেবল নোনতা জলের ভার। বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে দিল সে। শুরু হল নিরব কাঁদার এক লুকোনো লড়াই।
কান্না করতে করতে বলতে লাগল মেহরিন—
কেনো করলেন এমনটা কবি সাহেব? আমার ভালোবাসায় তো একটুকুও খাদ ছিল না।
আমি তো শুধু আপনার বউ হতে চেয়েছিলাম। শুধুই আপনার কবি সাহেব।
দেখুন না? আমি সাজব বউ, কিন্তু আপনার জন্য না… অন্য কারো জন্য।
আমি হাতে মেহেদি পরব… কিন্তু তাতে আপনার নাম থাকবে না।
আমার গায়ে হলুদ হবে… কিন্তু তাতে আপনার ছোঁয়া থাকবে না।
কারো হাত আমাকে ছুঁবে… অথচ সেই ছোঁয়ায় আপনি থাকবেন না।
মেহরিনের চোখে অঝোর অশ্রু। কণ্ঠরুদ্ধ কান্না গিলে গিলে সে বলে চলে—
কবি সাহেব, ও কবি সাহেব আপনি শুনছেন? কেউ আমাকে ছুঁয়ে দেবে, কিন্তু সেই ছোঁয়া আপনার হবে না…
কবিতা লিখে আপনি হাজার বার আমার মন ছুঁয়েছেন,
কিন্তু আমি? আমি যে হৃদয় নিয়ে আপনাকে ভালোবেসেছি,
সেই হৃদয় আজ নিজের বুকেই হাহাকার করে যাচ্ছে।
আপনি যদি সত্যিই শুনতে পেতেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তাহলে বুঝতে পারতেন— আমি ভিতর ভিতর কতটা মরছি!
সে আবার বলে ওঠে —
কবি সাহেব, আমার চোখের পানি তো আমার সয্য হতো না কিন্ত দেখুন আপনিই আমাকে বেশি কাদালেন, আপনার জন্যই আমার চোখের পানি বেশি ঝড়লো…
আপনার তো সহ্য হত না, তাই না?
আপনার তো কোলজায় আঘাত লাগত,হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হত, তাই তো বলতেন…
‘তোমার কান্না আমার রক্ত ঝরায়’
তবে আজ? আজ আমি কাঁদছি…
এতটা কাঁদছি… কিন্তু আপনি নেই।
নিঃশব্দে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে মেহরিন। চারপাশ নিস্তব্ধ।
শুধু তার কান্নার শব্দ, আর বুক ফেটে আসা যন্ত্রণার সুর বাজে চারপাশে।
আমি যে আপনাকে ভুলতে পারছি না কবি সাহেব,
খুব বড় কি ক্ষতি হতো যদি আপনি সত্যি আমাকে ভালোবাসতেন?
এই পৃথিবী কি ধ্বংস হয়ে যেতো? বলুন না কবি সাহেব কেউ কী মরে যেতো আমায় ভালোবাসলে?তবে কেনো ভালোবাসলেন না আমায়? কেনো কবি সাহেব, কেনো বাসলেন না..আপনার শূন্যতা যে আমাকে খুব পোরাচ্ছে।
এক ফোঁটা পানি তার চোখ বেয়ে বালিশে পড়ে।
মাথার পাশে হাত রাখে সে, যেনো কবি সাহেবের কোনো কবিতা জড়িয়ে আছে তার চুলে।
আমি হয়তো বিয়েটা করব কবি সাহেব…
হয়তো আমার সংসার ও হবে, তবে সেই সংসার টা আপনার সাথে হলে কী খুব ক্ষতি হতো?
তবে আপনি বিশ্বাস করুন, আমি আসলে আপনার ভালোবাসার মধ্যেই ধীরে ধীরে মরব।
আপনাকে না পাওয়ার আক্ষেপ আমার রয়ে যাবে চিরকাল।
চোখের জল মুছবার শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই।
শুধু ঘরের নিঃশব্দ অন্ধকারে আরেকটি প্রেমিক হৃদয় নির্বাক হয়ে পড়ে থাকে…
কবি সাহেবের ভালোবাসা না পাওয়ার আক্ষেপে।
ঘরের নীরবতা যেনো ভাঙার নয়। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মেহরিন। বালিশের কোণে মাথা গুঁজে নিঃশব্দে ফোঁপাচ্ছে সে। হঠাৎ দরজায় টুক করে ঠেলা, তারপর নিঃশব্দে কফির মগ হাতে ঘরে ঢুকল মেহবুবা।
দরজা খুলেই বোনের চোখ ফোলা মুখ দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠল তার।
মগটা তাড়াতাড়ি টেবিলে রেখে ছুটে গেল ছোট বোনের দিকে।
মেহু… কী হইসে তোর?
চিৎকার নয়, আশঙ্কা মিশ্রিত আকুতি মিশে গেছে কণ্ঠে।
মেহরিন কোনো উত্তর দিল না, শুধু চোখ তুলে চেয়ে পরক্ষণেই উঠে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল বুক ভাঙা কান্নায়।
আমি ভালো নেই মেহবুবা… আমি একদম ভালো নেই।
তার গলা কাঁপছে, বুক কাঁপছে, শ্বাসও কাঁপছে।
কেন করলো এমনটা কবি সাহেব?
এমন তো হবার কথা ছিল না… এমন তো হবার কথা ছিল না, বল না, বল— কেন?
মেহবুবা শক্ত হাতে বোনকে ধরে রাখে। চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। বড় বোনের কষ্ট যে তার সহ্য হচ্ছে না ,বুক টা ছিরে যাচ্ছে।
তুই চিন্তা করিস না মেহু, সব ঠিক হয়ে যাবে।সব ঠিক হবে। তুই একটু শান্ত হ…”
কিন্তু মেহরিন তখনই বোনকে ছেড়ে সরে এসে বসে পড়ে মেঝেতে। মুখের চোখের পানি হাত দিয়ে মুছে নেয়।
না… না… কিছুই ঠিক হবে না রে মেহবুবা। কিছু না।
এই কথা বলতে বলতে হঠাৎ তার চোখ পড়ে হাতের আঙুলে। যেখানে এখনো চকচক করছে সেই আংটিটা— রাজের দেওয়া আংটি।
এক মুহূর্তের মধ্যে রাগে, দুঃখে, অবহেলায় ও ঘৃণায় খুলে ফেলে আংটিটা। একটা তীব্র ছোঁড়ায় সেটা গড়িয়ে পড়ে ঘরের কোণে।
আমি পরের কোনো কিছু রাখি না।
ওটা আমার না… কারো অন্য কারো প্রাপ্য…
বলে কোনো কিছু না শুনেই উঠে দাঁড়ায়, দ্রুত পায়ে ওয়াশরুমের দিকে হেঁটে যায়।
মেহবুবা মেঝে থেকে সেই আংটিটা তুলে নেয়। হাতের ওপর রাখে। গভীর এক দৃষ্টি দিয়ে দেখে তারপর মুচকি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
আশ্চর্য সেই হাসিতে যেনো এক অভয়, যেনো এক প্রতিজ্ঞা— এই গল্প এখানেই শেষ নয়।
ঘরের ভেতর পড়ে থাকে শুধু নিঃশ্বাস গুলোর শব্দ,
আর ওয়াশরুমের পানির শব্দে ঢাকা পড়ে যায়— মেহরিনের কষ্টে ভেজা কান্না।
ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়ায় মেহরিন। তার চোখ এখনো লাল, মুখটা ফোলা, কিন্তু সেই চোখেই আজ এক অদ্ভুত তীব্রতা।
নিঃশব্দে তাকায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে।
তারপর হঠাৎ হালকা একটা হাসি ঠোঁটের কোণে— তাচ্ছিল্য মেশানো, নিজের প্রতি বিদ্রুপের হাসি।
তুইই তো মেহরিন, তাই না? তুইই কাঁদিস একটা বিশ্বাসঘাতকের জন্য? ছি… মেহু, ছি।
কণ্ঠস্বর ঠাণ্ডা, কিন্তু শাণিত। যেনো নিজের বুকেই ছুরি চালাচ্ছে সে।
তুই দুর্বল হচ্ছিস?
মানুষ তোকে ভাঙতে চাইবে, কাঁদাতে চাইবে, কিন্তু তুই যদি ভাঙিস, তবে তো ওদের আনন্দ।
তুই কি ওদের আনন্দের খোরাক হবি?
চোখে চোখ রেখে আয়নাতে বলে চলে—
না, তুই দুর্বল হবি না।
দুর্বলরা কষ্ট পায়, আর কষ্ট দেখে কিছু লোক সুখ পায়।
তাদের সে সুখ তুই দিস না মেহরিন।
তুই তো ও রকম না!
আয়নার ভেতর থেকে যেনো সেই পুরোনো, চঞ্চল মেহরিন তাকিয়ে বলে—
তুই তো সেই মেহরিন, যে সবসময় হাসে, সবাইকে হাসায়।
তুই তো কান্না করিস না— তুই তো লড়িস।
এক দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে চোখের পানি ঝরে পড়ে, কিন্তু এবার আর সেই চোখে কষ্ট নেই— আছে আগুন, প্রতিজ্ঞা।
যার জন্য এত কষ্ট, সে তো একজন প্রতারক।
যে ভালোবাসার নামে ছলনা করে— তার জন্য চোখের জল? না… আর না।
আজ থেকে আর কষ্ট না।
আর না কোনো চোখ ভেজা রাত।
আজ থেকে তুই আগের মতো, আবার সেই মেহরিন— হাসিখুশি, শক্ত যা চাইলেই ভাঙা যায় না।
বুক ভরে এক নিশ্বাস নেয় সে, তারপর ঠাণ্ডা জলে মুখ ধুয়ে ফেলে। নিজের সেই ক্লান্ত মুখটায় জল ছিটিয়ে দেয়, যেনো পুরোনো সব জ্বালা ধুয়ে মুছে ফেলে দিতে চায়।
চুলটা গুছিয়ে, ঠোঁটে একটুখানি মৃদু হাসি এনে বেরিয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে।
আর সেই মুখে লেখা—
আমি আবার ফিরে এসেছি। এইবার কান্না নয়… এইবার হবে যুদ্ধ ভালো থাকার যুদ্ধ।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই মেহরিন ফোনটা হাতে তুলে নেয়। চোখদুটি এখন ঠান্ডা, কিন্তু তাতে কোনো জল নেই, নেই আর কোনো কাঁপুনি।
তার আঙুল ধীরে ধীরে স্ক্রিনে চলে— “কবি সাহেব” নামে সেভ করে রাখা নামটা খুঁজে বের করে।
এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে সেই নামটার দিকে।
তাকে ছুঁয়ে দেয়ার আগেই, হারিয়ে ফেললো, তার হৃদয়টা যেনো আবার একটু ফেটে যেতে চায়।
কিন্তু না— আর সে ভাঙবে না।
নামটার পাশে “Block Contact” অপশনটায় ক্লিক করে।
এক ক্লিক।
একটা সম্পর্কের মৃত্যু।
একটা বিশ্বাসের শেষ চিহ্নটাও যেনো মুছে দিলো।
তারপর এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস—
একটা চাপা, ব্যথায় জর্জরিত, কিন্তু সুরক্ষিত নিঃশ্বাস।
নিজেই নিজের সঙ্গে বলে ওঠে—
সে আমার না-হওয়া পাখি।
সে আমাকে না ছুঁয়েও খুন করে দিলো।
আমি, মেহরিন— যে কিনা এতটা শক্ত, তাকেও আজ ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলো।
তার চোখ এখন আকাশপানে।
শোনো কবি সাহেব…
তুমি ভালো থেকো।
তুমি যাকে চেয়েছিলে, তাকে নিয়ে থাকো সুখে।
আমার ভালো থাকা তুমি কেড়ে নিয়েছো,
কিন্তু আমার দোয়া থেকে তোমাকে বঞ্চিত করবো না।
তুমি সুখী হও।
আর মেহরিন নামক এই মেয়েটি?
সে আর কখনো তোমার পথের প্রহরী হয়ে দাঁড়াবে না।
না কোনো কলের অপেক্ষা করবে, না আর কোনো স্বপ্নে তোমার ‘গিন্নি’ হবার আকাঙ্ক্ষা রাখবে।
আজ, এই মুহূর্ত থেকে…
তুমি হারিয়ে গেলে আমার জীবন থেকে—
এক আকাশসম ভালোবাসার মানুষের বিদায়…
এই কথা বলেই সে ফোনটা পাশে রেখে দেয়।
ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ে, মাথা রাখে বালিশে।
চোখ বন্ধ করে আর কোনো শব্দ করে না, শুধু নিঃশব্দে একেকটা স্মৃতি বুকের ভিতর গুঁড়িয়ে যেতে থাকে।
আজ মেহরিন তার সমস্ত ভালোবাসার কবর দিলো—
নিজের বুকের গভীরে, স্থির নিঃশ্বাসে।
সাতদিন পর
মেহরিন আমার আগের সেই চঞ্চল, প্রাণবন্ত মেয়ে। হাসছে, কথা বলছে, পরিবারের সবার সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু কেউ জানে না, এই সাতদিনে সে ভেতরে ভেতরে কতবার ভেঙেছে।
চুমকি যখন সব জেনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো,মেহরিন তাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলেছিল—
তুই কাঁদিস না চুমকি, আমি ঠিক আছি।তুই কেনো কষ্ট পাচ্ছিস।
চুমকি জানে, এটা অভিনয়। ওর প্রিয় বন্ধুটা অভিনয়ের আড়ালে একটানা কাঁদছে প্রতিটা নিঃশ্বাসে। চুমকি সেদিন রাজ কে অনেক গাল মন্ধ করেছিলো।
আজ মেহরিনের এনগেজমেন্ট।
ঘরজুড়ে সাজসজ্জা, আলোর ঝলকানি, হাসছে সবাই।
রুমে ব্যস্ততা তুঙ্গে— মেহবুবা, রাহি, নুপুর আর চুমকি মিলে মেহরিনকে প্রস্তুত করছে।
রাহি হেসে বলে, আজ তোকে দেখে মনে হচ্ছে রাজকন্যা!
নুপুর গলার হারটা ঠিক করে দিয়ে বলে,দাদাভাই তো দেখে চোখ সরাতে পারবে না আপু।
চুমকি শুধু চুপ করে তাকিয়ে থাকে মেহরিনের চোখের দিকে— জানে, এই চোখে আজ কোনও প্রেম নেই, কেবল একটা চাপা সুরে বেজে চলেছে বিদায়ের দীর্ঘশ্বাস।
ওদিকে তালুকদার পরিবার থেকে এসেছে শুধুই অল্প কয়েকজন—
রেদওয়ান তালুকদার, সাবিহা তালুকদার, রাহেলা খান, শামীমা তালুকদার ও তাঁদের সন্তানরা, এবং শান্ত-রাকিব—
বাকি কারো আসা হয়নি, কারণ এটা পারিবারিক ও শান্ত-নিভৃত এক আয়োজন।
রিদ যখন প্রথম শুনলো মেহরিন রাজি, প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি।
রিদ কখনো মেহরিনের চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখেনি,শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখেছে ভালোবাসে না।
কিন্তু সেইদিন সাবিহা তালুকদার যখন বললেন,
তোকে বিয়ে করতে মেহরিনের কোন আপত্তি নেই জানিয়েছে বাবা,
রিদ যেনো হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তাদের বাড়িতে শান্ত, রাকিব— এই তিন বন্ধু মিলে সে রাতে একসাথে অনেকক্ষণ গল্প করেছিল, হাসি আর উচ্ছ্বাসে ভরে তুলেছিল সেই রাতটাকে।
তবু কোথাও একটা শূন্যতা রয়ে গেছিল রিদ-এর ভিতরে।
মেহরিন কি নিজ ইচ্ছাই রাজি হয়েছে নাকি বাবা-মার কথা রাখতে শুধু।
আজ রিদ-এর চোখ দুটো শুধু একটাই মুখ খুঁজছে— মেহরিন।
মনে হচ্ছে, একটা উত্তরের অপেক্ষা—
একটা চোখে চোখ রাখার, একটিবার প্রশ্ন করার,
তুমি কি সত্যিই চাও এটা?
সন্ধ্যার আলো একটু একটু করে গাঢ় হচ্ছে। ঘরের সবাই যেনো ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে। অতিথিদের ব্যস্ততা, সাজসজ্জার উজ্জ্বলতা— সব মিলিয়ে ঘরটা যেনো গানের মতো গুঞ্জন তুলেছে।
মেহরিন আর চুমকি রয়ে গেছে উপরে।
চুমকি মেহরিনের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে,
এই বিয়েটা করে কি তুই সত্যি সুখী হবি, মেহু?
মেহরিন একটু হেসে তাকায়। ঠোঁটে হাসি থাকলেও চোখে ধরা পড়ে একরাশ ধোঁয়া।
সবাই খুশি হলে, আমি কেনো হব না বল? — শান্ত স্বরে উত্তর দেয় সে।
চুমকি কেমন চুপ হয়ে যায়। তারপর ধীরে বলে,
আমি ‘সবাই’র কথা বলছি না, আমি তোর কথা বলছি।
মেহরিন চুপ করে যায়। চোখ নামিয়ে নেয়। খানিক বাদে মুখ তুলে বলে,
আমায় দুর্বল করিস না চুমকি… যদি পারিস, সাহস দে।
চুমকি কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে,
তুই কি ভুলতে পারলি তাকে, মেহু?
মেহরিন মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকায়। বাইরে গোধূলির আলোয় গাছের ছায়া নড়ে ওঠে। হঠাৎ গলায় গুনগুনিয়ে ওঠে একটা পুরোনো গান—
ও যত বলি ভুলে যেতে মন কথা শোনে না… চোখেরি আকাশে সে বৃষ্টিকে যে থামেনা…
চুমকির চোখে পানি চলে আসে।
মেহরিন অন্যদিকে ফিরে নিজের চোখের পানি টুকু মুছে নেয়, চুমকির গালে হাত রাখে বলে,
তুই কাঁদছিস কেন? তোর তো বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে। হ্যাপি হবি!কত মজা করবি তা না বসে বসে কাঁদছিস।
তারপর নিজেই হেসে বলে,
বল তো, কত মজা করা বাকি আমাদের! তোর বরকে দেখে তো এখনও ঝাড় খাওয়া হয়নি!
একটু বলে হেসে ওঠে,
আর তুই ছোটবেলায় বলতি, আমার জামাইকেই বিয়ে করবি, আমার সতীন হবি… মনে আছে?
মেহরিন আর চুমকি দু’জনেই হেসে ওঠে। সেই পুরনো দিন, সেই বোকা বোকা স্বপ্ন যেনো আবার এক মুহূর্তে ফিরে আসে।
হঠাৎ বাইরে থেকে মহিলা মির্জা এসে দাঁড়ান দরজার চৌকাঠে।
মেহরিনকে হেসে হাসতে দেখে ওর মুখে প্রশান্তির রেখা পড়ে যায়।
তিনি চুমকির দিকে তাকিয়ে বলেন,
চুমকি, মেহুকে নিচে নিয়ে আয়। সবাই অপেক্ষা করছে।
চুমকি মাথা নাড়ে,
তুমি যাও মামনি, আমি ওকে নিয়ে আসছি।
মহিলা মির্জা মাথা নাড়িয়ে চলে যান।
চুমকি মেহরিনের হাতটা ধরে বলে,
“চল।”
মেহরিন ধীরে উঠে দাঁড়ায়। একবার আয়নার দিকে তাকায়—
চোখের কোণে যেই ক্ষতটা ছিল, চুমকি সেইখানে হাত রেখে বলে,
সব ঠিক হয়ে যাবে।
দু’জনে একসাথে নিচে নেমে যায়—
একটা নতুন অধ্যায়ের শুরুতে পা রাখে মেহরিন, কষ্টের ছায়া পেছনে রেখে।
সিরি বেয়ে নামছে মেহরিন আর চুমকি।
মেহরিনের পরনে আজ নীল শাড়ি— এমন এক নীল, যেনো আকাশ থেকে উঠে আসা কোনো নরম মেঘ, কিংবা নীল অপরাজিতার ফুল।
মুখে তেমন কোনো প্রসাধনী মাখিনি,কেবল চোখে কাজলের ছোঁয়া, ঠোঁটে হালকা লিপবাম, আর কপালে একটি টিপ।
চুলগুলো খোলা— হাওয়ার ছোঁয়ায় ওরা নেচে উঠছে অবাধ্যে।
মেহরিনের মুখে প্রশ্ন নেই, উত্তেজনা নেই—
তবু কেমন যেনো শান্ত একটা সৌন্দর্যে ঝলমল করছে পুরোটা চরিত্র।
সামনের সোফায় বসে আছে শান্ত, রিদ ও রাকিব।
ওরা গুঁতো দেয় রিদকে,
দেখ, দেখ, কী অবস্থা রে ভাই!
রিদ তাকায় সামনের দিকে।
আর সেখানেই… এক মুহূর্তে যেনো থেমে যায় ওর সময়।
মেহরিন।
নীল শাড়িতে এক নিঃশব্দ বিস্ময় হয়ে ধরা দিয়েছে ওর সামনে।
রিদ চোখের পলক ফেলার কথাও ভুলে যায়। মুখে কিছু না থাকলেও চোখে সব কথা স্পষ্ট।
রাকিব আর শান্ত মুখ চাপা দিয়ে হাসে।
রাহি, পাশে দাঁড়িয়ে, রাকিবকে এক গুতো দেয়। চোখের ইশারায় চুপ করায়।
রাকিব ঠোঁটে আঙুল রেখে হেসে ওঠে।
নুপুর আসে ওদের পাশে। শান্তকে বলে,
সাইড দাও, আমি বসব।
শান্ত সাইড দিলে সে বসে পড়ে, রিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
সুন্দর লাগছে তাই না?
রিদ হঠাৎ নিজের অজান্তেই বলে ফেলে,
সুন্দর না… অসাধারণ ভয়ংকর সুন্দর লাগছে।
সবাই মুখ চাপা দিয়ে হাসে।
নুপুর কাঁধে হেলিয়ে বলে,
কিন্তু! শাড়িটাই মানায়নি মনে হচ্ছে!
রিদ চোখ সরিয়েই বলে ওঠে,
কে বলেছে? একদম নীল পরির মতো লাগছে!
নুপুর মুখে খুনসুটির হাসি।
সে বলে,
বাবা গো! নজর লেগে যাবে কিন্তু!
রিদ চুপ করে থেকে বলে,
নজর না লাগুক…
তারপর থেমে যায়।
চারপাশে হাসির ঢেউ উঠলেও রিদ বুঝে যায়—
সে কী বলে ফেলেছে।
সে হঠাৎ নুপুরের কান ধরে বলে,
“খুব পেকে গেছিস তুই!”
নুপুর লাফ বলে,
উফ দাদাভাই! ছাড়ো তো! আর বলব না কিছু!
রিদ হেসে ওকে ছেড়ে দেয়।
চারপাশে যেনো উৎসব, হাসি, রঙ আর আলো—
তবু রিদের চোখে আজ শুধুই একজন,
সেই নীল শাড়ির পরি…
মেহরিন।
সাজসজ্জা, আলো আর হাসি খুশি হওয়া কোলাহলে ভেসে আছে।
মেহরিনকে আনা হয় বসানো হয় রিদের পাশে।
সে নীচের দিকে তাকিয়ে, যেনো চোখ মেলাতে ভয় পাচ্ছে কারও দিকে।
তার ভিতরটা টালমাটাল— বুকের ভেতর ঢুক ঢুক শব্দ তুলে বাজছে স্মৃতির ঢেউ।
রিদের পাশে বসতেই হালকা একটা কম্পন ছড়িয়ে পড়ে তার শরীরে।
রিদের নিজেরও কেমন একটা লাগছে, কিন্তু সেটা প্রকাশের বদলে সে চোখ সরিয়ে বাবার দিকে তাকায়।
রিদ, মেহরিন মা’র হাতে আংটিটা পরিয়ে দেও,বললেন রেদওয়ান তালুকদার।
এই একটি বাক্যে যেনো মুহূর্ত থেমে যায় মেহরিনের কাছে।বুকের ভেতরটা মোছরে উঠে।
সে রাতটার কথা মনে পড়ে যায় তার—
যে রাতে রাজ তার হাতে আংটি পরিয়ে বলেছিল,
“তুই আমার, শুধু আমার।”
মেহরিনের গলা শুকিয়ে আসে, কান্না যেনো ঠিক গলায় আটকে ঘুরপাক খায়।
সে মাথা আরও নিচু করে নেয়, চোখ বেয়ে নামে এক ফোঁটা জল।
চুপিচুপি।
এদিকে সাবিহা তালুকদার এসে রিদের হাতে আংটির ছোট্ট বক্সটা দিয়ে যান।
রিদ নরমভাবে সেটা নেয়, চোখে একরাশ আবেগ আর দ্বিধা।
সে মেহরিনের দিকে হাত বাড়ায়।
মেহরিনের সমস্ত শরীর যেন নিঃশব্দে কেঁপে ওঠে।
তার হাত কাঁপছে—
রিদ সেটা টের পায়, কিন্তু ভাবে ও হয়তো শুধু নার্ভাস।
রিদ ধীরে ধীরে মেহরিনের হাত ধরে,
মেহরিন চোখ বন্ধ করে ফেলে— যেনো নিজেকেই বোঝাচ্ছে কিছু না ভাবতে।
রিদ আংটি পরিয়ে দেয়।
কিন্তু ঠিক পরেই—
চমক।
যেই না রিদ মেহরিনের হাতটা ছেড়ে দেয় অমনি আংটিটা ওর হাত থেকে খুলে মেঝেতে পড়ে যায়।
সবাই চমকে ওঠে।
রাকিব বলে,
যা পড়ে গেল ?
চুমকি একটু অবাক হয়ে বলে,
আংটিটা তো মনে হচ্ছে বড় হয়ে গেছে!
সেই মুহূর্তে যেনো কেউ শ্বাস নেয় না।সবার মাঝখানে একটা অস্থির অস্থির ভাব,
কিন্তু চুমকি এবার পরিস্থিতি সামাল দেয় এক বুদ্ধিদীপ্ত হাসি নিয়ে।
আচ্ছা, কোনো সমস্যা নেই! এক মিনিট…!
সে দৌড়ে যায় মহিলা মির্জার ঘরে।
একটা সুতোর গুটি নিয়ে আসে।
সবাই দেখে— কিভাবে ছোট্ট করে সুতোর এক পাক দিয়ে চুমকি আংটির ভিতরটা সামান্য আঁটোসাঁটো করে নেয়।
তারপর নিজেই মেহরিনার হাতে পরিয়ে দেয় আংটি।
আর বলে, ব্যাস হয়ে গেলো।
এবার ঠিক আছে ।
আংটি ঠিকঠাক বসে যায়।
চারপাশে হাসির রোল পড়ে যায়।
সাবিহা তালুকদার মুখে হাত দিয়ে হেসে বলেন,
চুমকি তো দেখি পুরো গৃহিণী মার্কা বুদ্ধি রাখে!
মেহরিন ম্লান হাসে।
তবে তার চোখে এখনো একটা আলো-আঁধারি খেলা করে যায়।
রিদ মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে—
আজ আংটি পরানো হলেও,
মেহরিনের মনের একটা দরজা এখনো বন্ধ।
তবু,
আজকের মুহূর্তটা,
এই চেষ্টাটা,
এই হাসিগুলো—
সব কিছু একসাথে বলছে…
এই গল্পটা শেষ না। এই শুরু।
সবকিছু ঠিকঠাক শেষ হয়েছে মনে হচ্ছিল।
এবার মহিলা মির্জা নিজ হাতে একটি নকশা করা রিং বক্স তুলে দিলেন মেহরিনের হাতে।
এইবার তুই পরাবি,
মির্জার কণ্ঠে মায়া মেশানো দৃঢ়তা।
রিদ হাত বাড়িয়ে দেয়।
মেহরিনের কাপা কাপা হাত তুলে আনে—
তবে এবার আর কাঁপা দেখিয়ে কিছু বোঝাতে চায় না সে।
মেহরিনের কাপাকাপি দেখে রিদ মুচকি হাসে
রিদ চুপ করে নিজেই পড়ে নেয় রিংটা।
তালি বেজে ওঠে।
কথার ফুলঝুরি, হেসে ওঠে চারপাশ,
কিন্তু ওদের চোখে থাকে শুধু একে অপর।
বড়রা বলে ওদের দু’জনকে কিছু সময় আলাদা করে কথা বলার।
দুই পায়ে পায়চারি করতে করতে ওরা উঠে আসে ছাদে।
নিচের শব্দ, আলো আর গন্ধ থেকে একটু দূরে, কেবল হাওয়ার মাঝে নিজেদের মতো।
রিদ চুপ করে তাকিয়ে থাকে মেহরিনের দিকে অনেকক্ষণ।
তারপর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে—
মেহু, তুমি কি এই বিয়েতে রাজি না?
মেহরিন তাকায় রিদের চোখে।
খুব গভীর, খুব সোজা।
তারপর ধীরে বলে,
আপনার এমন টা কেন মনে হলো?
রিদ একটু ভেবে নেয়, তারপর কাঁধ ঝাঁকায়।
তুমি কেমন জানি মন মরা। মনে হচ্ছে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে সব করছো। যেন কেবল কারও দায়িত্বে পড়ে এই বিয়ে…
মেহরিন একটু হেসে ফেলে—
একটা ক্লান্ত, ম্লান হাসি।
আসলে বাবা-মাকে ছেড়ে যেতে হবে— সেই ভাবনাটাই হয়তো এমন মন খারাপের কারণ। এমন কিছু না।
রিদ একটু এগিয়ে আসে, কণ্ঠে আলতো আশ্বাসের ছোঁয়া—
চিন্তা কোরো না। তোমার যখন ইচ্ছা হবে তখনই আসতে পারো, কথা দিচ্ছি।
এইসব কিছু নিয়ে ভাবো না, প্লিজ। এই তো নিয়ম— সব মেয়েকেই একদিন যেতে হয়।
মেহরিন মাথা নাড়ায়।
হ্যাঁ, এই তো বাস্তবতা।
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩০
তবু সে জানে, তার যাওয়া আর এই যাওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক।
রিদ হঠাৎ আরও এক ধাপ এগিয়ে আসে।
তার হাত বাড়িয়ে দেয় মেহরিনের দিকে—
হয়তো ধরবে বলে, হয়তো সান্ত্বনার একটা স্পর্শ দিতে চায়।
কিন্তু ঠিক তখনই—
ঠাসসসস!!
একটা বিকট শব্দ।