মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৫ (২)
মির্জা সূচনা
আমাদের দিনগুলো তখন সত্যি সত্যি যেনো একটা রূপকথার রাজ্যে কাটছিল। আমরা তিন বান্ধবী—আমি, ফারজানা আর সাবিহা—জীবনের সেই পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে দুঃখ কষ্ট বলে কিছু নেই। রাজ রিদ হবার বছর ২ পর আমার লাবিব হয় আমরা ঢাকায় চলে আসি, সবাই প্রায় পাশাপাশিই থাকতাম। আমাদের তিন বান্ধবীর জীবন সুন্দরভাবে কাটছিল, হাসি, আনন্দ, আর সুখে ভরা।
রাজ, রিদ আর লাবিব—এই তিন বন্ধুই যেনো ছোট্ট একটা জগত তৈরি করেছিল। ওরা একসাথে খেলতো, স্কুলে যেত, আর আমাদের বাচ্চাদের মধ্যে একটা আলাদা বন্ধন গড়ে উঠেছিল। আমার বড় ছেলে হাবিব ওদের তিনজনকেই খুব ভালোবাসতো। রাজ আর রিদের বয়স দশ বছর আর লাবিব তখন আট। তখনই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে—আমরা তিন বান্ধবী একসাথে গর্ভবতী হই। এটা যেনো আমাদের জীবনে আরেকটা খুশির স্রোত নিয়ে আসে।
এই সময়েই সায়েম তার স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসে। ওরা আমাদের এলাকাতেই বাড়ি নেয়, আর রুদ্রর সাথে ব্যবসায় যোগ দেয়। রাদওয়ান, আসলাম, সায়েম—সবাই মিলে একটা বড় ব্যবসা শুরু করে, আর সেই আনন্দে রুদ্র একটা গেট টুগেদার আয়োজন করে। আমরা সবাই সেখানে যাই, সময়টা ছিল সত্যি অসাধারণ। সবার চোখে মুখে খুশি, বাচ্চাদের হাসাহাসি, আর তিন বান্ধবীর জীবনে যেনো সুখের জোয়ার।
অনুষ্ঠান শেষে যখন সবাই চলে গেল, তখনও আমরা থাকি। ঠিক করি, আজ সবাই মিলে একসাথে থাকবো, পুরনো দিনের মত এক রাত। প্ল্যানটা জমে যায়, হাসি, গল্প, খাওয়াদাওয়া—সব মিলিয়ে দারুণ একটা রাত ছিল সেটা যেখানে শুধুই আমরা বন্ধুরা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কিন্তু রাত ১২টার পর হঠাৎ ফারজানার ব্যথা উঠল। আমরা সবাই তাড়াহুড়ো করে ওকে নিয়ে চলে যাই হাসপাতালে। আল্লাহর অশেষ রহমতে ফারজানা একটা পরীর মতো মেয়েকে জন্ম দেয়। আমরা সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই—তিন বান্ধবীর পরম মুহূর্ত যেনো পূর্ণতা পায় ওই মুহূর্তে।
তিন দিন পর ফারজানাকে আমরা বাড়ি নিয়ে আসি। রাজ, রিদ, হাবিব, লাবিব—ওরা সবাই খুব খুশি।ওরা বলে আমাদের একটা বোন এসেছে। শিশুটিকে ঘিরে ওদের কতো আনন্দ! সবাই মিলে ওর নাম দিল পুচকি, আদুরে একটা নাম। ওরা সারাক্ষণ ছোট্ট পুচকির আশপাশেই ঘুরঘুর করতো—ও যেনো ওদের রাজকন্যা।
আর আমাদের পুতুল সোনার (মানে ছোট্ট মেয়েটির) সপ্তম দিনে রুদ্র তিনটা গরু জবাই দিয়ে আকিকা দেয়। শুধু পরিবারের জন্য না, পুরো এলাকার গরিব-দুঃখীদের জন্য রান্না করে খাওয়ায়।
ওই দিনই মেয়েটির নাম রাখা হয়—রাইসা শিকদার।
অলক্ষ্যে চোখে পানি চলে আসে সবার রাইসার আগমনে যেনো নতুন আলো এসে পড়ে শিকদার পরিবারে। গরিব-দুঃখীরা খেয়ে দোয়ায় ভরে উঠে তাদের মুখ, ছোট্ট রাইসার জন্যও আর রুদ্রের জন্যও। কারণ, রুদ্র সবসময় গরিবের পাশে ছিল, সাহায্য করতো নিঃস্বার্থভাবে।
এই দিনগুলো যেনো আমাদের জীবনের সোনালি অধ্যায়। এইসব মুহূর্ত এক জীবনে ক’বার আসে বলো?
ওইদিনই সাবিহার ব্যথা উঠল হঠাৎ করেই। রুদ্র তখন সঙ্গে সঙ্গে রেদওয়ানকে বলে, ড্রাইভারকে নিয়ে এখনই বেরিয়ে যা তুই আমরা আসছি এদিকটা সামলে। রেদওয়ান আর দেরি না করে সাবোহাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। তখন রিদ ছিল আমাদের কাছেই। কিছুক্ষণ পর রেদওয়ানের বোন রাহেলাও চলে আসে, ওর সাথেই রিদ হাসপাতালের দিকে রওনা দেয়।
সাবিহার একটা মেয়ে হয়, কিন্তু অবস্থাটা ভালো ছিল না একদমই। খবরটা শুনে আমরা সবাই ছুটে যাই হাসপাতালে। শুধু ফারজানাই যেতে পারে না—ওর শরীর তখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি। তাই রুদ্র ওকে সঙ্গে নেয়নি, ফারজানা তখন একা বাড়িতে ছিল। পাশে ছিল শুধু হাবিব,সে পুচকিকে তো কিছুতেই ছেড়ে যাবে না তাই ওদের দুজনকে রেখে আমরা বাকিরা বেরিয়ে যাই।
রাজ আর লাবিব ছিল আমাদের সঙ্গে। আমরা যখন হাসপাতালে পৌঁছাই, তখন দেখি রেদওয়ান নেই। চারদিকে ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়, রুদ্র তখন সবকিছু সামলাচ্ছে। আমার মনটা হঠাৎ কেমন কেঁচে উঠলো— রেদওয়ান এখানে কেনো নেয় বার বার এই প্রশ্নটাই মাথায় আসছিলো।
রেদওয়ান না থাকাটা যেনো আমার বুকের ভিতর এক ধরনের ভয় ও আশঙ্কা এনে দেয়।আমার মন টা খচ খচ করতে থাকে আমি একাধিকবার ফোন দিই ফারজানাকে—কিন্তু সে ফোন তোলে না।এতে আমার ভয় আরও বেড়ে যায় হাঁসফাঁস করে উঠে আমার মন, আর কিছু না ভেবে আসলামকে বলি, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। ফারজানা একা আমার মন টা কেমন করছে।
প্রথমে আসলাম রাজি হয়নি, বলেছিল:
তুমি বেশি চিন্তা করছো।
কিন্তু আমার জেদ আর অস্থিরতায় শেষমেশ হার মানে ও।
আসলাম তখন আমাকে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়…
আমরা আমাদের বাড়ি না গিয়ে সোজা চলে যাই ফারজানাদের বাড়ি। গিয়ে দেখি সায়েমের গাড়ি আগেই দাঁড়িয়ে আছে গেটের সামনে। এটা দেখে আমার ভিতরে তখন কেমন একটা অজানা ভয় জমে উঠছিল— বার বার মনে হচ্ছিলো কোনো অশুভ কিছু যেনো অপেক্ষা করছে।
আমি আসলামের দিকে তাকিয়ে বলি,
তুমি গাড়ি পার্ক করে এসো, আমি আগে যাই।
বলে আমি রাজ আর লাবিবকে নিয়ে দ্রুত বাড়ির ভিতরে ঢুকে যাই। আমি তখন গর্ভবতী, হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। বুকের ভিতরটা যেনো বারবার কেঁপে উঠছিল। প্রতি পদক্ষেপে একরাশ ভয় আমার হৃদয়টা জাপটে ধরছিল। মুখে চুপচাপ, কিন্তু মনে কেবল একটাই কথা ঘুরছিল—আল্লাহ, কিছু খারাপ যেনো না হয়।
বাড়ির ভিতরে ঢুকেই একটা শব্দ পাই—একটা কান্না যেনো কিন্তু চাপা। আমি আগাতে থাকি সেই দিকেই।
গিয়ে যা দেখি, তাতে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে—কাজের মেয়েটা মাটিতে পড়ে আছে। হাত-পা, মুখ বাধাঁ, গায়ে ব্যথার চিহ্ন। আমি দ্রুত কাছে গিয়ে বসে পড়ি, ততক্ষণে রাজ আর লাবিব কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু আমি তাড়াতাড়ি তাদের মুখ চেপে ধরি আর ফিসফিসিয়ে বলি,
চুপ, কথা বলবে না।
ওরা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি মেয়েটার বাঁধন খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করি—
কে করেছে এটা? কী হয়েছে সব বল।
মেয়েটা তখনো কাঁপছিল, মুখ তুলে তাকাতে পারছিল না…
মেয়েটা তখন কাঁপতে কাঁপতে বলল,
আপা… আপা, আপনি তাড়াতাড়ি ভাইজানরে খবর দেন… ওরা ভাবিজানের সাথে খারাপ কিছু করব… হাবিব বাবারে…
তারপরেই সে ঢলে পড়ে, আর কিছু বলতে পারে না।
আমার মাথায় কিছু কাজ করছিল না। শরীর যেনো হিম হয়ে গেছিল। সঙ্গে সঙ্গেই আমি রুদ্রকে ফোন দিলাম—
রুদ্র, তুই তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আয় এখনই কিছু ব্যাখ্যা করার সময় নেই।
তারপর ফোন না কেটে আসলামের নাম্বারে ডায়াল করলাম। কিন্তু ফোন ধরছে না।
একটুও সময় নষ্ট না করে আমি সোজা উপরে ফারজানার রুমের দিকে যাই।
কিন্তু রুমে ঢুকে দেখি… রুম ফাঁকা। কোথাও ফারজানা নেই, রাইশা নেই, এমনকি হাবিবও না। ঘরটা জায়গায় জায়গায় অগোছালো, জানালাটা আধা খোলা। রুমের সব কিছু এলো মেলো।
আমার বুকটা তখন চুপসে যেতে চায়, বেরোতে যাবো এমন সময়—হঠাৎ নিচের দিক থেকে গঙ্গানির শব্দ আসে। আমি দৌড়ে ছুটে যাই শব্দের উৎসের দিকে। গিয়ে যা দেখি…
হাবিবের হাত, পা, মুখ বেঁধে রাখা হয়েছে, মাথা থেকে রক্ত ঝরছে।
আমার বুকে যেনো কেউ ছুরি বসিয়ে দিল।
আমার বড় ছেলে—আমার কলিজার টুকরোর—এই অবস্থায়!
আমার মনে হচ্ছিলো পায়ের থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, তাও আমি কোনো শব্দ করি না।
রাজ আর লাবিব কিছু করতে যায়, কিন্তু আমি চোখে তাকিয়ে ইশারা দেই—না, এখন না।
আমি নিজে গিয়ে হাবিবের বাঁধন খুলতে থাকি।
হাবিব কাঁপতে কাঁপতে বলে,
আম্মু, তাড়াতাড়ি চলো! ওরা ফুপি (ফারজানা) কে নিয়ে গেছে! আর পুচকি…কেও নিয়ে গেছে আমি… আমি জানি কোথায় নিয়ে গেছে
আমি ওর মুখে হাত রেখে বলি,
চুপ, কাঁদে না মা, আমরা যাব। তুমি বলো ওরা কোথায়? কে এসেছিলো কি হয়েছে বলো আম্মুকে।
হাবিব মাথা নাড়ে, জানায় সব।
রেদু কাকু আর সায়েম কাকু আসে। আর ফুপ্পির কাছ থেকে পুচকিকে নিয়ে গাছে ড্রাইভার কাকু আর ওরা ফুপ্পিকে টেনে নিয়ে যায়।আমি বাধা দেওয়াই আমকে বোতল দিয়ে মেরে বেধে রেখে যায়।
তারপর আমরা চারজন—আমি, রাজ, লাবিব আর হাবিব—ছুটে যাই সেই দিকেই।
চিলেকোঠার দিকে যেতেই দেখি সিঁড়িতে রক্তের দাগ…
আমার বুকটা যেনো মোচড় দিয়ে উঠে—আমার কলিজা টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকে।
আমি পা টিপে টিপে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, বুকের ভিতর কেবল একটাই ভয় ওদের কোনো ক্ষতি না করে ওরা, আমার ফারজানার কিছু যেনো না হয়।
আমরা সিঁড়ি ঘরে পৌঁছে যা দেখলাম, তা দেখার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না।
ফারজানা মাটিতে পড়ে আছে, চারপাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ফারজানার কাপড় খোলার চেষ্টা করছে রেদওয়ান।
রাজ সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠল—
“আম্মু!!”
আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। ঠিক তখনই সায়েম আর রাদুয়ান ফিরে তাকায়, ওরা হয়তো বুঝতেই পারেনি আমরা এখানে চলে এসবো।
আমি আর দেরি না করে এগিয়ে যাই, আর রেদওয়ানকে এক ঝটকায় পাশে সরিয়ে দিয়ে বলি—
কুত্তার বাচ্চা! তোর এত বড় সাহস বলেই একটা চড় কষিয়ে দিই।
চড় খেয়েই রেদওয়ান আমার চুল মুঠি করে ধরে একটা ধাক্কা মারে।
আমি পড়ে যেতাম, যদি না সায়েম আমাকে ধরে ফেলত।
গর্ভবতী ছিলাম বলে পড়লে হয়তো প্রাণটাই চলে যেতো…
হাবিব, রাজ আর লাবিব ছোটে আমাদের দিকে।
কিন্তু ওরা তো তখনো ছোট—কি আর করতে পারে!
তবু হাবিব এগিয়ে আসে, আর একেবারে রাগে কাঁপতে কাঁপতে
রেদওয়ানের বুক বরাবর একটা লাথি মারে।
চিৎকার করে বলে—
জানোয়ারের বাচ্চা তুই আমার আম্মুকে ধাক্কা মারলি কেন! আমার ফুপ্পির সাথে কী করতে চাইছিলি।
রেদওয়ান তখন এক পাশ থেকে একটা লোহার রড তুলে নেয়,
আর হাবিবের মাথায় একটা বারি মারে। লাবিব লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।
রাজ আর লাবিব হাবিবকে ধরে ফেলে, ওর মাথা থেকে রক্ত পড়ছে…
আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
আমি দৌড়ে যেতে চাই হাবিবের কাছে—কিন্ত পারি না।
সায়েম আমাকে ধরে রাখে।
শরীরে তখন আর সেই শক্তি নেই। শুধু কান্না, হাহাকার, অসহায়তা।
রেদওয়ান তখন রাজ আর লাবিবকে এক এক করে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। তার পর ধরি দিয়ে বেঁধে ফেলে।
রাজ বলে,
রেদু কাকু, তুমি হাবু ভাইকে মারলা কেনো? মামনির চুল ধরলা কেনো মামনি তো ব্যাথা পায়। তুমি আম্মুর কাপড় কেনো খুলছিলে? আম্মুর শরিরে রক্ত কেনো?আম্মু কথা বলছে না কেনো?
রেদওয়ান একটা চড় মেরে বলে একদম চুপ।
আর সায়েম আমার মুখ বেঁধে দেয় একটা কাপড় দিয়ে,
আর আমাকে একটা চেয়ারে বেঁধে ফেলে।
আমার গর্ভে সন্তান, আমি চিৎকার করতেও পারছি না…
আমার চোখের সামনে আমার সন্তান, আমার বন্ধু…
আর আমি অসহায় আর রাজের কথা গুলো চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছিল —এটাই কি আমাদের শাস্তি? কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছে আল্লাহ.. আমরা তো কারো ক্ষতি করিনি তাহলে কেনো এমন হচ্ছে।
ফারজানা তখন অচেতন ছিল।
কিন্তু হঠাৎ করেই ওর জ্ঞান ফিরে আসে—
চোখ মেলে তাকায় সোজা আমার দিকে।
আমার চোখে জল, বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে।
আমি চেয়েও কিছু করতে পারছি না, শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওর দিকে।
আমার অবস্থা দেখে ফারজানা উঠে দাঁড়ায়।
যেনো কোথা থেকে এক অলৌকিক শক্তি ওর শরীরে এসে পড়েছে!
পায়ের কাছে হাবিবকে পড়ে থাকতে দেখে, রাজ আর লাবিবকে ব্যথায় কাতরাতে দেখে,
ফারজানা—আমার ফারজানা—একদম বাঘিনীর মতো গর্জে ওঠে!
“বিশ্বাসঘাতক!”—চিৎকার করে ওঠে।
আমার মেয়ে কোথায়?? কুত্তার বাচ্চা, আমার পুতুল কোথায় বল?
রেদওয়ান হেসে ওঠে, একটা ঠাণ্ডা নিষ্ঠুর হাসি
আর সেই হাসি দেখে ফারজানার রাগ আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে!
সে এক ঝাঁপয়ে পড়ে রেদওয়ানের ওপর।
চুলের মুঠি ধরে, নখ দিয়ে আঁচড়াতে থাকে, আঘাত করতে থাকে—
এক মা, এক বোন, এক স্ত্রী যখন হিংস্র হয়ে ওঠে,
কিন্তু ঠিক তখনই পেছন থেকে সায়েম আসে।
ওর চুল টেনে ধরে টান দেয়, বলে—
এখনো এতো তেজ কোথা থেকে পাস রে তুই?
ফারজানা তাকায় সায়েমের দিকে, চোখে আগুন।
ধীরে ধীরে বলে—
তুইও? ছি! বন্ধুর মুখোশ পরে থাকা পশু তোরা।জানোয়ারের দল।
এই বলেই মাথা দিয়ে আঘাত করে সায়েমের কপালে!
সায়েম ব্যথায় এক ধাক্কা দিয়ে ফারজানাকে ফেলে দেয়।
ফারজানা পড়ে যায় মাটিতে।
আর সেই পড়ে যাওয়া দেখেই—
রেদওয়ান ঝাপিঁয়ে পড়ে ওর ওপর…
নিজের লোভ আর লালসায় পাগল হয়ে উঠেছে রেদওয়ান।
একটা জানোয়ারের মতো ফারজানার শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিচ্ছে।
আমি অসহায়ের মতো চোখ বন্ধ করে শুধু আল্লাহকে ডাকছিলাম,
হে আল্লাহ, কেউ একটা আসুক… রক্ষা করুক আমার ফারজানাকে…”
আর পাশে দাঁড়িয়ে লাবিব আর রাজ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। লাবিব বলছে,
ও রেদু কাকু আমার ফুপ্পি ব্যাথা পাচ্ছে তো ছেরে দাও।
রাজ বলছে,
রেদু কাকু তুমি আমার কাপড় খুলে নাও আমার আম্মুকে ছেরে দাও না.. আম্মুকে ছেরে দাও দেখো আম্মুর অনেক ব্যাথা করছে রক্ত বের হচ্ছে একটু ডক্টরকাকু কে ডাকো না গো..
ওদের কথা গুলো আমায় গুড়িয়ে দিচ্ছিল ভিতর থেকে তাও যে আমরা কিছু করতে পারছিলাম না ।
আমরা সবাই অসহায়, চোখের সামনে এক বীভৎস দৃশ্য চলছে—
আর সেই নরপিশাচ থেমে নেই।
ফারজানা লড়ছে… নিজের সতীত্ব, নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করতে লড়ছে—
কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আবার জ্ঞান হারায়…
আর তখনই—
দরজায় দাঁড়িয়ে যায় আসলাম।
তার চোখে ভয়, তার মুখে বিস্ময়…
আর মুহূর্তেই সেই বিস্ময় রূপ নেয় আগুনে!
“কুত্তার বাচ্চা!”—চিৎকার করে উঠে দৌড়ে যায় সামনে
এক লাথিতে রেদওয়ানকে ছিটকে ফেলে দেয়।
আর ঠিক তখনই সায়েম পেছন থেকে এসে আসলামকে ধরে ফেলে।
কিন্তু আসলাম এবার আর থেমে নেই—
চোখে শুধু একটাই দৃশ্য—
ফারজানার লাঞ্ছিত শরীর, আর তার চারপাশে রক্ত বোনের এমন বিপর্য অবস্থা দেখে শরীর ছেড়ে দেয় আসলাম।
রেদওয়ান উঠে গিয়ে আবার সেই রডটা তুলে নেয়।
আর একের পর এক বাড়ি মারতে থাকে আসলামের মাথায়।
তুই কী ভেবেছিলি, আমরা তোদের চাকর? সুন্দরী মেয়ে, টাকা-পয়সা, দাপট—সবই তোদের। আর আমাদের কিচ্ছু নাই… কিচ্ছু না!
রডের আঘাতে আসলামের মাথা ফেটে যায়, মগজ ছিটকে বেড়িয়ে আসে। রাজ লাবিব এসব দেখে জ্ঞান হারায়।
আমি নিজের চোখে আমার স্বামী সন্তানের মৃত্যুদৃশ্য দেখলাম—
আর কিচ্ছু করতে পারলাম না…
আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী ফারজানাকেও বাঁচাতে পারলাম না।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়—
ফারজানার নিস্তেজ দেহের ওপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই পশু… নিজের লালসা মেটাতে থাকে।
রক্তে ভেসে যায় চারপাশ…
আর ফারজানা… ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়।
ঠিক তখনই সায়েম আমার দিকে এগিয়ে আসে, মুখে বিকৃত এক হাসি—
এবার তোর পালা… তোকে নিয়েই ছিল আমার লম্বা অপেক্ষা… কত সুন্দর করে ওই দিন তোকে আমি বলেছিলাম আমি তোকে ভালোবাসি। কিন্তু তুই কি করলি আসলাম জমিদারের ছেলে বলে ওর গলায় ঝুলে পড়লি।
আমি শুধু আল্লাহকে ডাকছিলাম।
আর সেই মুহূর্তে—
চিড়িঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে রুদ্র..
এক লাথিতে সায়েমকে ছিটকে ফেলে দিয়ে গর্জে ওঠে:
তোদের আমি বন্ধু ভেবে কাছে এনেছি… আর তোরা আমার বিশ্বাসকে খুন করলি?বিশ্বাসঘাতকের দল।
রুদ্র একের পর এক ঘুষি মারতে থাকে সায়েমকে।
তখনই রেদওয়ান উঠে আসে…
আর পকেট থেকে বন্দুক বের করে ঠেকিয়ে দেয় রুদ্রর কপালে।
খুব হিরো হিরো খেলছিস, তাই না? আজ তোকে শেষ করেই ছাড়বো…
রেদওয়ান বন্দুকটা রুদ্রর কপালে ঠেকিয়ে বলল,
বিশ্বাসঘাতক বললি? হ্যাঁ, আমি বিশ্বাসঘাতক!
কিন্তু তোরা কী করেছিলি? ছোটবেলা থেকে আমাদের সাথে চাকরের মতো ব্যবহার করেছিস।
তোর বাপের টাকা দেখে তোর সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম…
আর তুই? তুই তোর সেই টাকা নিয়ে ফকিরদের সাহায্য করিস, ফুটপাতের মানুষদের খাবার দিয়েসিস—আমাদের কিচ্ছু৷ দিসনি
তার চোখ রক্তবর্ণ, রাগে, হিংসায় উন্মত্ত।
তুই সব পাবি কেন? সুন্দরী বউ, টাকা, কোম্পানি, নামডাক—
আর আমরা তোর পেছনে সারাজীবন পা চাটবো? না, আজ সব শেষ।
আজ তোদের সবাইকে মেরে পুড়িয়ে ফেলবো।
কেউ তোদের লাশও পাবে না। আর তোর সব কিছু—তোর বউ, তোর সম্পত্তি, তোর ব্যবসা—
সব কিছু আমি নিয়ে নেব আমি।
রুদ্র হেসে ওঠে—একটা কষ্টের, কিন্তু আত্মবিশ্বাসে ভরা হাসি।
তুই কিছুই পাবি না, রেদু।
কারণ আমি আমার সব কিছু… আমার সন্তানের নামে লিখে দিয়েছি।
তারা যদি না থাকে, তাহলে সব কিছু সরকারের হাতে চলে যাবে।
তুই কিছুই পাবি না।
রেদওয়ান ক্ষেপে গিয়ে বলে,
ঠিক আছে, তাহলে অন্তত একটা কাজ করে যাই.. কিছু না পেলে ও তোকে বাচিয়ে রাখবো না।
এই বলে সে ঠাস করে গুলি চালায়।
রুদ্রের কপাল ফেটে যায়। রুদ্রের দেহটা পড়ে যায় নিচে। আমি নিজের চোখের সামনে এতগুলো প্রিয় মানুষের খুন হতে দেখলাম তারপরও কিছু করতে পারলাম না…
তারপর… পুরো বাড়ি জুড়ে কেরোসিন ছিটিয়ে দেয়। আগুন লাগিয়ে দেয় ওরা।
আমি চোখ বন্ধ করে প্রাণভরে কালেমা পড়তে থাকি। মৃত্যুই যে আমার নিয়তি?
ঠিক তখনই, ফেরেশতার মতো হাজির হয় বাড়ির দারোয়ান জব্বার। শরীর রক্তাক্ত, চোখে কান্না, মুখে ভয়। কিন্তু সোজা এসে আমার হাত-পা খুলে দিলো। রাজ আর লাবিবকে দুই কাদে তুলে বলল,
আপা, আমার সাথে চলেন। পেছনের দরজা দিয়ে যাই। সামনের গেট তারা আগেই বন্ধ করে রেখেছে।
আমি চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার পা যেনো চলছিল না স্বামী সন্তান বোনের মত বান্ধবী ভাইয়ের মতো বন্ধু সবাইকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যেতে মন মানছিল না। তবুও লাবিবার রাজের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার চলে যেতে হয় —
আমার প্রিয় বান্ধবী ফারজানা,
আমার হাবিব
আমার হৃদয়ের মানুষ আসলাম…
ভাইয়ের মত রুদ্র সবাইকে রেখে আমার চলে যেতে হচ্ছে।
আমি ওদের দিকে ফিরে বললাম, তোমাদের মৃত্যুর বদলা আমি নেবো আজ আমি লাবিব আর রাজকে রাখার জন্য চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি আবার ফিরব সেদিন সব কিছু হিসাব নিব শুধু আমি নই সেদিন হিসাব নেবে আমাদের ছেলেরা
জব্বার বলল,
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৫
আপা, সময় নাই। চলে আসেন।
আমি শেষবারের মতো চোখ ভিজিয়ে তাদের দেখে নিলাম।
তারপর… বেরিয়ে এলাম সেই জ্বলন্ত ভেঙে-পড়া বাড়ি থেকে।
জব্বার ভাই কষ্ট করে একটা ভ্যানে আমাদের তোলে, লাবিব আর রাজকে শুইয়ে দিয়ে আমাকে বসায় পাশে। তারপর নিঃশব্দে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হয়…