মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৫ (৩)

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৫ (৩)
মির্জা সূচনা

জব্বার আমাদের ওর নিজের বাড়ি নিতে চাইছিল।
কিন্তু আমি থামিয়ে বলি।
না জব্বার ,তোমার বাড়ি নয়। ওরা যদি তোমাকে না পায়,তোমার বাড়িতেই যাবে—তোমার স্ত্রী-সন্তান,এমনকি তোমাকেও মেরে ফেলবে। আমাদের বাড়ি চলো, তবে অন্য রাস্তা দিয়ে।
জব্বার কিছু না বলে মাথা নেড়ে নেয়।
চোখে ছিল শুধু ভয়, তবু মুখে দৃঢ়তা।
আমরা আমাদের বাড়িতে যাই।
আমি তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দরকারি কাগজপত্র, কিছু টাকা, কিছু জামাকাপড় নেই।
তারপর কল দিই বড় ভাইজান আকরাম চৌধুরীকে।
ভাইজান, আজ রাতের মধ্যে আমাদের দেশ ছাড়তে হবে। দয়া করে কিছু একটা করেন।
ভাইজান বারবার জানতে চাইছিল,

কী হয়েছে? কারা করেছে?আমার আসলাম আমার বোন তুমি তোমরা ঠিক আছো।
কিন্তু আমি সেদিন কিছু বলতে পারিনি।
চোখে শুধু একটাই ছবি ভাসছিল—ফারজানার নিথর দেহ, রুদ্রর ফেটে যাওয়া কপাল, রক্তাক্ত হাবিব আর আমার আসলামের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন মাথা।
আমি ভাইজানকে যতটুকু বলা সম্ভব বলি, বাকিটুকু গিলে ফেলি কান্নার সাথে।
ভাইজান সব ব্যবস্থা করে দেয়।
রাতের আঁধারে আমরা আমাদের প্রিয় শহর, প্রিয় ঘর ছেড়ে রওনা হই এয়ারপোর্টের দিকে।
লাবিব আর রাজ বারবার জানতে চাইছিল, কোথায় যাচ্ছি..
রাজ,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ও মামনি আম্মু কোথায় ? পুঁচকি কোথায়? রেদু কাকু কেন আম্মুর কাপড় খুলছিল? রক্ত বের করছিল কেন ? মামু কেউ মেরেছে জানো ? ও মামনি আমরা কোথায় যাচ্ছি আমরা হসপিটালে যাব না … আম্মু তো রক্ত বের হচ্ছিল মামুর ও হাবু ভাইয়ের ওতো.. আমরা যাব না ওদেরকে নিয়ে ডক্টর দেখাতে মামনি?
লাবিব,
আম্মু আব্বু কোথায়? রেদু কাকুটা না খুব পচা? ভাইয়াকে মেরেছে.. ফুপ্পির কাপড় খুলে নিয়েছে কাপড় খুলা তো পচা তাইনা আম্মু?? রেদু কাকু না আব্বুকে মেরেছে জানো?? আব্বুর মাথা দিয়ে কি কি বের হচ্ছিল??
আমরা এখানেই থাকি না কেন? আমাদের সাথে আব্বু হাবু ভাই পুচকি রুদ্র বাবা আপনি যাবে না ??? কেন পালাচ্ছি আমরা?

আমি তখনও কিছু বলতে পারিনি।
শুধু চুপচাপ চোখের পানি ফেলেছি।
ভোর ৫টা, আমাদের মালয়েশিয়ার ফ্লাইট ছিল।আমাদের জন্য নিরাপদ স্থান এয়ারপোর্টটাই ছিল। সারারাত আমরা এয়ারপোর্টেই ছিলাম ভোর পাঁচটায় আমরা উঠে পড়ি সেই ফ্লাইটে।
যেনো এক চিরন্তন আলোর খোঁজে অন্ধকার পেরিয়ে চলেছি।
ভাইজান আর জব্বার আমাদের সঙ্গে ছিল এয়ারপোর্ট পর্যন্ত।
ভাইয়ের চোখে ছিল দায়িত্ব আর আশ্বাস,
আর জব্বারের চোখে ছিল অদ্ভুত এক শান্তি—
যেনো তার কর্তব্য সে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পালন করেছে।
কিন্তু যখন আমরা মালয়েশিয়া পৌঁছাই, খবর আসে—
জব্বারকে ওরা মেরে ফেলেছে।

কারণ…
জব্বার জানতো সব।
সে যদি বেঁচে থাকতো, ওদের মুখোশ খুলে যেত।
ওরা চেয়েছিল জব্বারও আগুনে ছাই হয়ে যাক।
কিন্তু সে বাঁচিয়ে দিয়েছিল আমাদের।
তার আত্মত্যাগেই বেঁচে আছে আমার কলিজার টুকরো রাজ আর লাবিব।
আমরা মালয়েশিয়ায় পৌঁছাই,
কিন্তু হৃদয় তখনও পড়ে থাকে ওই জ্বলন্ত শহরে।
রুদ্র, ফারজানা, আসলাম—সবার রক্তে ভেজা সে রাত আমাদের তাড়া করে বেড়ায়।
মালয়েশিয়ায় আশার সাথে সাথেই এক চোর আমাদের সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যায়.. আল্লাহ দুর্যোগ যখন দেয় সব দিক দিয়েই দায় হয়তো.. আল্লাহর বান্দার পরীক্ষা নাই এই পরীক্ষার উপর দিয়েই যাচ্ছি আমাদের দিন ।
অন্যদিকে…

ওরা চুপ করে বসে থাকেনি।
ভাইজানের কারখানায় আগুন লাগিয়ে দেয়।
সব কিছু শেষ করে দেয় ওরা।
ওরা জানতো, ভাইজান কখনো চুপ করে বসে থাকবে না খোঁজ লাগাবে কি করে কি হলো এসবের । তাকে শেষ করে দিয়ে একদম নিঃস্ব করে দেবে—সেটাই ছিল তাদের ছক।
ভাইজান সব হারিয়ে চুপ হয়ে গিয়েছিল।
আর ওরা?
শিকদার বাড়িতে আগুন দিয়ে পুরো পরিবারটাই শেষ করে দেয়। আর যার দিকে ছড়িয়ে দেয় যে..
সবাই মারা যায় আগুনে।
চারদিকে শুধু পুড়ে যাওয়া ঘ্রাণ আর মানুষের কান্না।
তারপর…
ওরা মিডিয়ায় কান্নাকাটি করে সবার সামনে
বলে—

রুদ্র, ফারজানা, রুপা, আসলাম… এরা সবাই আমাদের বন্ধু ছিল।ওরা আরো বলে হয়তো কোন শত্রুর কাজ এটা এদিকে বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে আর ওইদিকে ভাইজানের কারখানায় আগুন লাগার ব্যাপারটাও সবার সামনে বাস্তবায়ন করে তুলে ধরে শত্রুর কাজ বলে।
মানুষেরা বিশ্বাস করে।
চোখের পানি দেখলে মানুষ আর বিচার খুঁজে না।ওদের চোখের পানি দেখে গলে যায় সবাই ওদের মুখোশের আড়ালের সেই নিকৃষ্ট চেহারা গুলো কেউ দেখতে পায়নি।
আর আমরা তখন…
অচেনা এক দেশে নিঃসঙ্গ, নিরুপায়।
ভাইজান চেয়েছিলেন আমাদের রক্ষা করতে,
কিন্তু ওরা তাকে নিঃস্ব করে দিল।
ভাইজান বলেছিলেন,

সব খরচ আমি চালাবো…
কিন্তু এখন তার নিজেরই কিছু নেই।
শুধু থেকে গেছে একটা পোড়া মন, আর একটা কাঁচা প্রতিজ্ঞা—
একদিন… এই আগুনেরই জবাব আগুন দিয়ে দেবে কেউ ইনশাআল্লাহ।
অচেনা একটা দেশ,
ভাষা বুঝি না, নিয়ম জানি না—
আর সাথে দুইটা ছোট বাচ্চা।
আমি… একটা অসহায় মা তার উপর গর্ভবতী।
রাজ আর লাবিব—তারা তো কিছু বোঝে না।
শুধু যখন ক্ষুধার কষ্টে কাঁদে, তখন আমি বুঝি—
আমি কিছুই করতে পারছি না তাদের জন্য কতটা অসহায় আমি সময়ের কাছে।এক সময় যেই হাত দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে খাইয়েছি। এখন সেই হাত দিয়ে নিজের সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছি না।
মাথার উপর ছাদ নেই,

পরনে কোন ঠিকঠাক কাপড় নেই,
একটা কাজ নেই—পেট ভরানোর মতো সামান্য টাকাও নেই।
প্রথম দুই দিন,
আমরা পথে পথে ঘুরেছি।
সাহায্যের আশায় মানুষজনের দিকে তাকিয়েছি—
কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।
আমি তখন আমার সমস্ত গর্ব, লজ্জা পেছনে ফেলে
রাস্তার পাশে বসে হাত পেতেছি—
বাঁচাতে চেয়েছি রাজ আর লাবিবকে।
ফুটপাতে বসে ভিক্ষা করেছি।
কিছু টাকা হাতে পেয়ে
একটু খাবার কিনে তিনজনে ভাগ করে খেয়েছি।

তাদের মুখে খাবার তুলে দিতে পেরে
আমার নিজের খিদে যেনো হার মানে,
কিন্তু মনের ভেতরের যুদ্ধ…
সেইটা তো থামে না।
আমার ভিতরে একটা প্রশ্ন বারবার ধাক্কা দেয়—
এভাবেই কি চলবে?
আমি কি পারবো ওদের বাঁচাতে?
নাকি আমরা একটা দিন ক্ষুধার যন্ত্রণায় নিস্তেজ হয়ে যাব?
ফুটপাতেই ঘুমিয়েছি আমরা।
বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থেকেছি শুধু।
ভিক্ষা করেই খাবার জুটেছে—তাও প্রতিদিন নয়।একদিন খেলে দুইদিন না খেয়ে থেকেছি।
একদিন—এক ভয়ংকর দিন—
আমার পেটে হঠাৎ তীব্র ব্যথা ওঠে।
রাস্তার ধারে পড়ে যাই, কাতরাই, চিৎকার করি ব্যথায়।
কেউ কাছে আসে না—

শুধু আমি আর আমার আল্লাহ।
ঠিক তখনই, যেনো আসমান থেকে পাঠানো এক মানুষ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়।
এক তরুণী, হয়তো বাংলাদেশি—
তার চোখে ভয় ছিল, কিন্তু মনটায় দয়া।
আল্লাহই যেনো তাকে পাঠিয়েছিলেন আমাদের বাঁচাতে।
ওই মেয়েটি আমাকে সাহায্য করে,
নিজের কাঁধে ভর করে নিয়ে যায় তার চাচার বাসায়।
তার চাচা-চাচি ছিলেন অপূর্ব মানুষ—
চাচা একজন স্কুলশিক্ষক, গম্ভীর অথচ মমতাময়।
সব শুনে বললেন,
এদের এখানে থাকতে দাও। খেতে দাও। ওদের জন্য কিছু কাজ জোগাড় করবো।
আর সেইদিনই,
আমার ছোট্ট মেয়েটা জন্ম নিলো—লামিয়া।
রাজ আর লাবিব—যারা বহুদিন পেটভরে খায়নি,
তারা হামলে পড়ে খাবারের উপর।
চাচি কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

আল্লাহ ওদের অনেক কষ্ট দিয়েছেন, এখন শান্তি দিন।
চাচার বাড়িতে আশ্রয় পেয়ে
আমরা যেনো একটু নিঃশ্বাস নিতে পারলাম।
চাচা আমার জন্য ছোট্ট একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন—
তার স্কুলের পাশে একজন বৃদ্ধার বাসায় দেখাশোনার কাজ।
মাইনেটা খুব বেশি না, কিন্তু সম্মান ছিল।
এই প্রথম আমি কারো কাছে হাত না পেতে, নিজে রোজগার করলাম।
একটা বছর শান্তিতে কেটেছিল আমাদের।
চাচা-চাচির আশ্রয়ে আমরা একটু নিশ্বাস নিতে পেরেছিলাম।
রাজ আর লাবিবকে ভর্তি করাই চাচার স্কুলে।
ওরা আবার বইয়ের সাথে ঘর বাঁধে,
আর আমি জীবনের সাথে।
কিন্তু,

শান্তির সেই স্বপ্নভঙ্গ হয় খুব নিষ্ঠুরভাবে।
চাচার ছেলে—এক অমানুষ—
তার নোংরা চোখ পড়ে আমার উপর।
প্রথমে এড়িয়ে গেছি,
চোখের ভাষা বুঝেও চুপ থেকেছি…
শুধু মাথা নিচু করে নিজের ইজ্জতকে আগলে রেখেছি।
কিন্তু একরাতে,
ওই জানোয়ারটা জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে।
আমি তখন ঘুমিয়ে ছিলাম
লাবিব, রাজ আর লামিয়াকে বুকে নিয়ে,
একটা ছোট্ট ঘরে।
ঘুম ভেঙে দেখি—
সে দাঁড়িয়ে আমার সামনে।
চোখে লালসা, অন্ধকার ঘর।
আমি বাধা দিই।
চিৎকার করি।
রাজ জেগে উঠে, তার চোখে আগুন।
লাবিবের চোখে ঘৃণা।

ওরা দু’জন মিলে
টর্চলাইট দিয়ে মাথায় মারে সেই অমানুষটার।
সে লুটিয়ে পড়ে। রক্তে লাল হয়ে যায় মেঝে।
পরদিন সকালে—
আমার নামে মিথ্যে অপবাদ দেয়া হয়।
বলে—আমি নাকি চাচার ছেলের সাথে খারাপ কাজে লিপ্ত হতে চেয়েছিলাম। তারা তো নিজের ছেলের কথাই বিশ্বাস করবে আমার মত অসহায় মায়ের কথা কি বিশ্বাস করবে? তারাও করেনি।
চাচা কিছু বলতে পারেন না,
চাচি মুখ ঘুরিয়ে নেন।
আমাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় ওরা।
আমরা আবার রাস্তায়…
কোনো ঠিকানা নেই, মাথার উপর ছাদ নেই।
শুধু আমি, রাজ, লাবিব আর ছোট্ট লামিয়া।

রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই আমরা,
কোনো কাজ নেই, মাথার উপর ছাদ নেই,
শুধু তিনটি অবুঝ শিশু আর আমি—এক বিধ্বস্ত মা।
রাতে ফুটপাতে শুয়ে ছিলাম…এই ফুটপাত ছাড়া তো আর কোন জায়গা আমাদের কপালে জোটে নেই তখন.. লামিয়া কি বুকে নিয়ে আল্লাহ এবার আজকে জাপটে ধরে শুয়ে ছিলাম ফুটপাতে।
হঠাৎ শুরু হয় গুলির শব্দ।
ভয়ে আমরা দৌড়ে একটা ভাঙা গাড়ির পেছনে লুকাই।
কিছুক্ষণ পর গোলাগুলি শব্দ থেমে যায়।
সব থেমে গেলে ধীরে ধীরে বের হই।
পুনরায় পিচঢালা রাস্তার বুকে শুয়ে পড়ি ক্লান্ত শরীরে।
ঠিক তখনই একটা গুঙানির শব্দ—
রাজ এগিয়ে যায়,সাথে যায় লাবিব আমি বারবার মানা করি।
সে শোনে না।

আমি লামিয়াকে নিয়ে পিছনে পিছনে যাই…
একজন রক্তাক্ত মানুষ পড়ে আছে মাটিতে।
রাজ সেই লোকটির মাথা কোলে নেয়।
আমি, লাবিব পাশে বসে পড়ি।
লোকটি বলার চেষ্টা করে কিছু একটা।
শব্দগুলো অস্পষ্ট।
রাজ কানের কাছে নিয়ে যায় মাথা, শুনে নেয় তার শেষ ইচ্ছা।
আমার ফোন বের করো… একটা নম্বরে কল দাও…
রাজ ফোন থেকে নম্বর ডায়াল করে।
কল রিসিভ হয়, রাজ ফোনটা লোকটার কানে দেয়।
লোকটি মালয়েশিয়ান ভাষায় কী যেনো বলে…
আমরা কিছু বুঝি না।

শুধু তার চোখে জমে থাকা পানির ঝিলিক দেখি।
লোকটা বারবার পানি পানি করতে থাকে.. ইচ্ছে করে একফোঁটা পানি লোকটাকে খাওয়াতে কিন্তু কোথা থেকে পাবো আমরা যে নিরুপায় আমাদের নিজেরই তো খাবার কিছু নেই।
তারপর রাজ বলে,
মামনি, তুমি বসো। আমি পানি আনছি।
রাজ দৌড়ে যায়।
একজন লোক যাচ্ছিল পাশ দিয়ে,
রাজ তার কাছে পানি চায়।
লোকটা ধাক্কা দেয় রাজকে।
রাজ পাশের রাস্তায় পড়ে থাকা কাচের বোতল তুলে নেয় আর দৃঢ় কণ্ঠে বলে—
পানি দে!
লোকটা ভয় পেয়ে পানি দেয়।

রাজ সেই পানি এনে লোকটাকে খাওয়ায়।
হঠাৎ একটা গাড়ি আসে।
চুপচাপ লোকটাকে তুলে নিয়ে যায়।
আমরা আবার ফিরে যাই আমাদের পুরনো জায়গায়…
আবার রাস্তায়, আবার রাত, আবার অনিশ্চয়তা।
কিছুক্ষণ পর আরেকটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়।
একজন নামি গলায় বলে—আপনারা একটু আমাদের সঙ্গে আসুন।
আমার বুক কেঁপে উঠে।
ভয়ে হাতজোড় করে বলি,
আমাদের ছেড়ে দিন, আমাদের কিছু কইরেন না।
তখন এক ভদ্রলোক এগিয়ে আসে,
বলে—

আপারা ভয় পাইয়েন না।
আপনারা একটু আগে যাকে বাঁচাইছেন,
উনি আমাদের বস।
তিনি নিজেই আপনাদের ডেকেছেন।
আপনাদের কোনো ক্ষতি হইবো না।
লোকটার কথা একটু বর্ষাপাই
আমরা চুপচাপ গাড়িতে উঠি,
অজানার পথে, অচেনা রক্ষার আশায়।
সত্যিই, সেই লোক আমাদের কোনো ক্ষতি করে না।
বরং… সে আমাদের আশ্রয় দেয় মাথা গোজার।
গাড়ি আমাদের যে জায়গায় নিয়ে যায়,
সেটা বিশাল এক বাড়ি।
ওরা আমাদের খেতে দেয়, থাকতে দেয়।
ভরপেট খাওয়া, একটা বিছানা, একটা নিরাপদ রাত—এসব যেনো স্বপ্ন মনে হচ্ছিল।
তবে তখনও জানতাম না,
এই মানুষটা কে?

কেন সে আমাদের এতটা সাহায্য করছে?
পরে জানতে পারি—
সে একজন মাফিয়া।
বড়লোক নয়,
শুধু টাকার পাহাড়ে বসে থাকা নয়—
সে ভয়ঙ্করও।
এই কথা শুনেই আমার শরীরের রক্ত যেনো জমে আসে।
ভয় লাগে।
আমি পালাতে চাই ওখান থেকে।
কিন্তু পারি না।ধরা পড়ে যায় তার লোকেদের কাছে।
তখনই সে আসে,
চুপচাপ আমার পাশে বসে,
আমার মাথায় হাত রেখে বলে—
আমি রাজিব সওদাগর এই দুনিয়ায় আমার কেউ নেই।
আজ থেকে তুই আমার বোন।

এই ভাইয়ের জীবন যদি কিছুতে কাজে লাগে,তবে আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও তোদের সাহায্য করবো।
আমিও চাই তোর পাশে দাঁড়াতে।
নিবি না এই ভাইয়ের সাহায্য?
আমি চুপ হয়ে যাই।
আমার চোখে জল আসে,
কারণ সত্যিই…
আমাদের একটা আশ্রয় দরকার ছিল,
একটা ছায়া দরকার ছিল,
একটা মানুষ দরকার ছিল যে রক্ষা করবে।
আল্লাহর রহমতে, আমরা পেয়ে যাই তাকেই।
তারপরের দিনগুলো ভালো কাটতে থাকে।
রাজ, লাবিব, আর লামিয়ার মুখে হাসি ফিরে আসে।
আমি আবার নতুন করে বাঁচতে শুরু করি।
একদিন সেই ভাই আসে,

আমার কাছে বসে জিজ্ঞাসা করে আমারা এ দেশে কেনো এসেছি..কেনো ফুটপাতে ছিলাম আমি সব খুলে বলি ভাইকে সব শুনে ভাই বলে..
তুই এখানে থাকবি কতোদিন?
তুই ওদের বিচার করবি না?
আমি বলি—
এখন না ভাই।
আমি আমার রাজ আর লাবিবকে মানুষ করব।
ওরাই নেবে ওদের প্রতিশোধ।
ভাই আমার কথা শুনে কিছু না বলে উঠে যায়।
তবে ওর চোখে বুঝি—সে আমাকে বোঝে।
তারপর,
রাজ আর লাবিবকে আবার স্কুলে ভর্তি করি।
সাথে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণও শুরু করিয়ে দিই।
আমি জানি,

একদিন ওদেরই দাঁড়াতে হবে সামনে—
সত্যের জন্য,
বিচারের জন্য।
সময় গড়ায়।
রাজ আর লাবিব বড় হতে থাকে—
চোখে আগুন, মনে বজ্র প্রতিজ্ঞা।
ভুলতে পারে না, কীভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল তাদের শৈশব।
আর ওরাও হার মানে না।
ভাইয়ের ছায়ায় গড়ে ওঠে ওদের জীবন।
দিনের আলোয় ব্যবসায়ী,
রাত্রির আঁধারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীক লড়াকু।
তাদের দল গড়ে ওঠে।
অন্যায়ের প্রতিবাদে,
অবিচারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অসহায়দের পাশে দাঁড়ায়।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়,
একদিন যারা পথের ধুলো ছিল,
আজ তারা আলো—

আর অন্ধকারকে পুড়িয়ে দেয় নিজ আগুনে।
রাজ ছিল একেবারে রুদ্রোর মতো।
চোখে দৃঢ়তা, মগজে কৌশল।
ওর প্রতিটা পরিকল্পনা সফলতা এনে দিত।
যা হাতে নিত,
তা-ই পূর্ণতা পেত।
আর ভাই…
সে তার সবটা দিয়ে প্রস্তুত করে লাবিব আর রাজকে। সে তার সব কিছু লিখে দেয় রাজ, লাবিব আর লামিয়ার নামে।
তার এক কথা—
এইরাই আমার আপন।
তাদের হারালে, যেনো আমার জীবন বৃথা।
যদি সেই ভাই না থাকতো,
তবে হয়তো আমরা এখনো পথেই পড়ে থাকতাম—
নিঃশ্বাসহীন হয়ে।
“বড় ভাইজান”
আক্রম চৌধুরী—

সে আমাদের খোঁজ করে গেছে কিন্তু?
আমরা দেইনি,
চাইনি, দরকারও পড়েনি।
আমরা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য লিখে চলেছি।
নিজেদের মতো করে,
নিজেদের রক্ত-ঘামে।
এভাবেই সময় কাটতে থাকে।
আমরা দিন গুনতে থাকি—
না, আর কোনো হারানোর নয়,
এইবার ফিরে যাওয়ার।
বাংলাদেশে ফিরে যাবার।
পুরোনো ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে,
তাদের মুখোমুখি হবার দিন গুনতে থাকি।
সেই প্রতীক্ষার অবসান ঘটে।
অনেকদিন পর, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে,
আমরা ফিরে আসি—বাংলাদেশে।
সব বলার পর,

সব ক্ষত খুলে দেবার পর,
রূপা বেগম চোখ মুছে তাকান মেহরিনের দিকে।
মেহরিন কান্না করে যাচ্ছে নিরবে।
নরম কণ্ঠে বলেন,
কান্না করো না বউমা…
আমার রাজ বাবাটা জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে।
এতদিন ও শুধু সহ্য করেছে…
তুমি যদি কষ্ট দাও,
তবে এবার ও মরে যাবে…
মেহরিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।
সে ঝাঁপিয়ে পড়ে রূপা বেগমের বুকে।
হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে—
না মামণি… আর কোনো কষ্ট ওকে আমি দেবো না।
কখনও না… ক-খনও না…
রূপা বেগম মেহরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন।
একটু পর,বলেন—
তুমি কি জানো বউমা,

আমার রাজ বাবাটা তোমাকে কতদিন থেকে ভালোবাসে?
মেহরিন নাক টেনে ফিসফিস করে বলে,
না মামণি… তবে যেদিন আমি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই,
সেদিনই সে আমাকে প্রথম এসএমএস করে…
রূপা বেগম হেসে বলেন,
তিন বছর আগে…
তুমি তোমার পরিবার নিয়ে কক্সবাজার গিয়েছিলে… মনে আছে?
মেহরিন মাথা তুলে চোখ বড় করে বলে,
হ্যাঁ, আমরা সবাই গিয়েছিলাম, একসাথে।
রূপা বেগম মাথা নেড়ে বলেন—
“হ্যাঁ…

সেই তখনই রাজ বাবা তোমাকে প্রথম দেখে।
আর সেইদিন থেকেই সে তোমাকে ভালোবাসে…
মেহরিন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে রুপা বেগমের দিকে।
রুপা বেগম আবার বলে,
এই তিন বছর তোমাকে নিয়ে ওর যে কত শত পাগলামি আমি সহ্য করেছি জানো না… যতক্ষণ বাড়িতে থাকতো ততক্ষণ তোমার ব্যাপারে বলতো।তোমাকে সেদিন প্রথম দেখে ওই দিনে আমাকে বলেছিল মামনি আমি ওকে চাই ওকে ভালোবাসি বেসে ফেলেছি মামনি ওকে আমি তোমার বৌমা করতে চাই তুমি কি মেনে নেবে। হঠাৎ হঠাৎ চলে যেতো রাব্বিরতে তোমাকে দেখতে.. কত বিপদ থেকে তোমাকে আগলে রেখেছে রক্ষা করেছে দূরে থেকে.. রোদ বৃষ্টি ঝড় বাতাস কিছু ওকে থামাতে পারিনি।

মেহরিন নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে।
তার চোখের ভেতরে যেন হাজারটা প্রশ্ন,
হাজারটা উত্তরের উথালপাথাল ঢেউ।
আর ঠোঁটে কাঁপা কাঁপা একটা হাসি—
ভালোবাসার, অপরাধবোধের, আর অনন্ত বন্ধনের।

রূপা বেগম মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন
লামিয়াকে ওভাবে তোমার সামনে উপস্থাপন করার কারণটা কী জানো?
মেহরিন দুদিকে মাথা নাড়ল—অর্থৎ না।
রূপা বেগম তাকে জড়িয়ে ধরলেন।
তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন—
কারণ… রাজ বাবা এটা চেয়েছিল
রেদওয়ানের মিডিয়ার সামনে অপমান হোক…
তার মাথা হেট হোক সবার সামনে।
“আর,”
তিনি একটু থেমে বললেন—

রেদওয়ান তোমার বাবাকে তোমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দেয়…
তোমার বাবা তখনই রাজ বাবার কাছে জানায় সব।
রাজ যেটা চায়, তোমার বাবাও সেটাই করেন।
মেহরিন হতবাক হয়ে বলে—
তাহলে… মানে… বাবা সব জানতেন?
রূপা বেগম মাথা নাড়লেন।
হ্যাঁ, জানতেন। কারণ তোমরা শান্তিপুরে থাকতেই রাজ বাবা তোমার আব্বুর কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখে। এবং তোমার আব্বু সে প্রস্তাবে রাজি হন।
আর তুমি যে রাজ বাবাকে ভালোবাসো, রাজ বাবা যদি অমন কিছু না করতো তাহলে কি তুমি রিদকে বিয়ে করতে রাজি হতে?

মেহরিন ধীরে মাথা নাড়ে—না, কখনও না।
রূপা বেগম হেসে তার কপালে চুমু দিয়ে বললেন—
এইজন্যেই তো… সবটা এমন সাজানো হয়েছে।
বুঝেছো এখন?
মেহরিন একটুখানি মাথা ঝাঁকায়।
তার চোখে একসাথে বিস্ময় আর অশ্রু।
হঠাৎ সে মাথা তোলে,
ধীরে প্রশ্ন করে—
আচ্ছা মামণি…
তাহলে রিদ? সে আসল না কেন?
তা হলে কি… সবটাই ওর প্ল্যান ছিল?
রূপা বেগম চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ।
তার চোখে যেনো দুঃখ আর দ্বিধা জমে আছে।
তারপর ধীরে মাথা নাড়েন—

“হ্যাঁ…
ওর প্ল্যান ছিল।
কিন্তু ও এখন কোথায়, কেমন আছে…
সেটা নিয়ে আমরাও চিন্তিত।রাজ বাবা রিদয়ের সঙ্গে দেখা করে। এবং সবকিছু বলে দেয় রিদকে। সবকিছু শুনে রিদ অনেক ভেঙে পড়েছিল। আর তারপরেই কাউকে কিছু না জানিয়ে রাজের প্ল্যান মত কাজ করে চলে যাই দেশ থেকে।
তখনই রাজ আবার ডাকে,
Moonbeam একটু শোনে যাও।
রূপা বেগম হেসে বলে—যাও আমার বউ পাগল ছেলে, তার বউকে ডাকতে ডাকতে পাগল হয়ে গেল। রুদ্রও এমনই করতো এখন ফারজানা ফারজানা করতো।মাঝেমধ্যে তো ফারজনা রেগে গিয়ে এটা সেটা বলেও দিতো কিন্তু তাতে রুদ্রের কোন কিছু আসতো যেতো না।
এটা বলে হেসে ফেলেন রূপা বেগম।
মেহরিনও হেসে ফেলে।
তারপর রূপা বেগম বলে—যাও।
মেহরিন মাথা নেড়ে বেরিয়ে যায়।
রুমে ঢুকে দেখে রাজ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।
মেহরিন ডাকে—কবি সাহেব!

রাজ ফিরে তাকায়—কতদিন পর তার বউ তাকে ‘কবি সাহেব’ ডাকলো।
রাজ খুশিতে গদগদ হয়ে বলে—বউ তুমি…
কথা শেষ হওয়ার আগেই মেহরিন ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজের বুকে।
রাজ অবাক হয় মেহরিনের কাজ দেখে।
মেহরিনকে আগলে নিয়ে রাজ বলে—এই বউ, কি হইছে? কাঁদছো কেন? কি হয়েছে বলো Moonbeam?এই আরিওনা বউ, কি হয়েছে বলো।
মেহরিন কিছু বলে না, শুধু কান্না করে যায়।
রাজ অস্থির হয়ে ওঠে।
মেহরিন কাঁদতে কাঁদতে বলে,
অনেক ভালোবাসি আপনাকে কবি সাহেব… অনেক, অনেক, অনেক ভালোবাসি।
রাজ থেমে যায়।

মেহরিনের মুখ তুলে নিয়ে নিজের দু’হাতের আড়ালে নিয়ে আদরে সুরে বলে।
কি হয়েছে আমার বউটার? এত কান্না কেন করছে আমার বউ টা? আমার বউটা কি জানে না, তার চোখে পানি মানে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়? এটা যেনেও আমাকে কষ্ট দিচ্ছে আমার বউ আমাকে। এটা কি ঠিক বউ বলো?
রাজের এমন আদুরে কথা শুনে মেহরিন হেসে ফেলে।
রাজও হেসে ফেলে। তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মেহরিনকে। অনেকক্ষণ ওভাবেই থাকে।
তারপর রাজ হঠাৎ করে বলে—
আমার বউ-এর রাগ উড়ে গেল! কেমন করে?আমি তো ভাবছিলাম বউ-এর রাগ ভাঙাতে ভাঙাতে আমি বুড়ো হয়ে যাবো!

মেহরিন রাজকে ছেড়ে বুকে থাপ্পড় দিয়ে বলে—
হলে হবেন, তাতে কি সমস্যা? আমার জন্য বুড়ো হতে প্রোবলেম কোথায়? না কি সারাজীবন এমনই তাগড়া যুবক থাকতে চান, যাতে মেয়েরা নজর দেয়?
রাজ দুই হাত ওপরে তুলে বলে—
আস্তাগফিরুল্লাহ! দুনিয়ার সব মেয়েদের আমি লামিয়ার মতো বোন আর মামনির মতো মামনি’র চোখে দেখি।
মেহরিন মুখ জমটা দেয়।
আর রাজ বলে—
এই বউ এই, তুমি আমার সামনে মুখ জমটা দিও না।
মেহরিন ভ্রু কুঁচকে বলে—
কেন?

রাজ দাঁত বের করে বলে—
আমার চুমু খেতে মন চায়।
বলে মেহরিনের ঠোঁট নিজের দখলে নিয়ে নেয়।
মেহরিন আজ আর বাধা দেয় না। নিজেও সঙ্গ দেয় রাজকে।
বেশ কিছু সময় এভাবেই কেটে যায়।
তারপর রাজ মেহরিনকে ছেড়ে দেয়।
মেহরিনের দুই হাত ধরে বলে—
বউ, আমার একটা আবদার রাখবা?
মেহরিন মাথা নাড়ে।
রাজ বলে—

তোমার কোলে মাথা রেখে আমাকে একটু শুতে দেবে?
মেহরিনের চোখে পানি চলে আসে।
এই সামান্য একটা কথা কিন্তু মেহরিনের মনে অনেক বড় একটা আঘাত হানে। কী অবুঝ আবদার!
এই আবদার কি করে মেহরিন ফিরিয়ে দেবে?
আঁধার কাটে যেমন আলো আসে, তেমনি রাতে সেদিন আসে আরে এভাবেই শুরু হয় একটা নতুন দিনের শুরু।
আজ রাজ আর মেহরিনের রিসেপশন। বাড়ির চারপাশে সাজসাজ রব, অতিথি আসার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। সকালে খুব ভোরেই মেহরিন উঠে পড়ে। রান্নাঘর থেকে শুরু করে ঘরের প্রতিটা কোণ সে নিজের হাতে গোছাতে থাকে।

তবুও আজ তার মনটা যেনো অন্যকিছু খুঁজছে। রাজের দিকে তাকিয়ে সে বায়না ধরে,
— আমি পার্লারে যাবো, আমার রিসেপশন, আমি নিজের মতো সাজবো।
রাজ একটু অবাক হয়ে বলে,
— পার্লারের লোক তো বাসায় আসবেই, তোমাকে সাজাবে ঠিকঠাক মতো।
কিন্তু মেহরিন জেদি কণ্ঠে জানিয়ে দেয়,
— না, আমি যাবো মানে যাবোই!
রাজ বোঝে, এই রাগী বউয়ের সাথে তর্ক করে লাভ নেই। শেষে সে রাজি হয়ে যায়।
তবে শর্ত দেয়,
— তাহলে অন্তত চুমকির সঙ্গে যেও, একা নয়।
মেহরিন মাথা নাড়ে, আর রাজ হাসে,

— বউয়ের কাছে আমি একেবারে বিরল প্রজাতির প্রাণী।এই আল্লাহর বান্দী যেভাবেই হোক আমাকে ছলে বলে কৌশলে ঠিক নিজের বশ করে ফেলে।
কিন্তু মেহরিন তখন অন্য পরিকল্পনায়। সে চুমকিকে কিছু না বলে, সরাসরি চলে যায় এক জায়গায়—
রেদওয়ান তালুকদারের অফিসে।
রেদওয়ান তালুকদার, রাজনীতির মুখোশে ঢাকা এক ভয়ঙ্কর পিশাচ, এখনো জানে না আজ তার ভাগ্য কী লিখে রেখেছে।
মেহরিন ভিতরে যায়।
রেদওয়ান খুশি হয়ে বলে,
— আরে মেহরিন আম্মু! এসো, বসো বসো!
মেহরিন চেয়ারে বসে, চোখে তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাকায়।
এই লোকটার চেহারায় যে এত কুৎসিত রূপ লুকিয়ে আছে, সেটা মেহরিন স্পষ্ট দেখতে পায়।
মনে মনে সে বলে,
এই লোকটাকে যদি এখনই টুকরো টুকরো করে কুকুরকে খাওয়াতে পারতাম!
মুখে বলে,

রিদ ভাইয়া আমাকে কেন করলা আংকেল?
রেদওয়ান তালুকদার দুঃখ নিয়ে বলে,
জানিনা আম্মু কেন যে এমন করল সেটাই বুঝতে পারছি না।
মেহরিন সাথে সাথে বলে ওঠে,
— আপনার ওই নোংরা মুখে আমায় ‘আম্মু’ বলবেন না! রিদ ভাইয়া আপনার মতো জানোয়ার হয়নি, এটাই অনেক।
রাদওয়ান গর্জে ওঠে,
— মেহরিন।
মেহরিন দ্বিগুন জ্বরে চেঁচিয়ে বলে,
— এই…….

আওয়াজ নিচে।আপনার মত ধর্ষক বিশ্বাসঘাতক প্রতারক বেইমানদের উঁচু গলা মানায় না।
তারপর সে আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে বলে,
—আমার শাশুড়ি ভুল করেছিলো, যখন আপনাকে মানুষ ভাবার ভুল করেছিল। আপনি যখন তার সম্মানে আঘাত করেছিলেন, তখনই আপনার মাথা কেটে ফেলার দরকার ছিল।কিন্তু আফসোস তখন আমার শাশুড়ি অসুস্থ ছিল আর সেই সুযোগটাই আপনার মতো নিয়েছিল।
রেদওয়ান চুপ। চোখে রাগ, হতাশা আর ভয় একসাথে মিশে যায়।
মেহরিন চেয়ারে পা তুলে বসে বলে,
— বলুন, রাজের ছোট বোন কোথায়?কোথায় রেখেছেন তাকে?
রেদওয়ান চুপ করে। সে বুঝে যায়, আজ আর গোপন রাখা যাবে না।
— বেরিয়ে যাও এখান থেকে, সে ফোঁস করে বলে।
মেহরিন হেসে উঠে দাঁড়ায়,

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৫ (২)

— আরে বাহ, আমার শ্বশুড়ের সাম্রাজ্য থেকে আমাকে বের করে দিচ্ছেন! সামান্য একজন কর্মচারী হয়ে।
একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বলে,
— প্রস্তুত থাকুন রেদওয়ান তালুকদার, আপনার পতনের দিন খুব কাছে। আর এই খেলায় আমি থাকবো, আমার স্বামীর পাশে।
বলে সে দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে যায়— মাথা উঁচু করে, চোখে আগুন।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৩৬