মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৫
মির্জা সূচনা
রাত প্রায় ১২ টার ছুই ছুই …!
ছাদের কোণে বসে থাকা মেহরিনের চুলগুলো উড়ে উড়ে চোখে পড়ছিল। সে আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল, মেহবুবা আর তুমি কি ঘুমিয়ে গেছে। ওর মন ভালো না তাইন মনে বসে আছে ছাদে রাখা দোলনাই যেন কোনো উত্তর খুঁজছে। হঠাৎ, ফোনটা টিং করে বেজে উঠল।
স্ক্রিনে লিখা…
কবি সাহেব
মেহরিন একটু চমকে উঠল।
“কবি সাহেব”
“চুপচাপ বসে থাকলে মন ভালো থাকে না, আরিওনা।
তুমি হাসলে মনে হয় পৃথিবীটা ক্লান্তিহীন।
তোমার মন খারাপ হলে আকাশটাও কাঁদে।
আমি না হয় দূরে থাকি,
তবু জানি, কেউ একজন আছে বলে
রাতগুলো আমার এত সুন্দর হয়।”
মেহরিন একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে…
সে কি আজ উত্তর দেবে?
আবার একটা এসএমএস আসে….
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কবি সাহেব”
“তুমি জানো আরিওনা,
আকাশের চাঁদ যত দূরেরই হোক না কেন, আলো ঠিক এসে পড়ে কারো চোখে…
তুমি আমার সেই দূরের আলো।
তুমি হয়তো জানো না,
যখন তুমি চুপ করে থাকো,
আমি হাজার শব্দ লিখে ফেলি।
তোমার একটা হাসির জন্য
আমি রাত জেগে স্বপ্ন আঁকি।
প্রতি রাতে তুমি আমার কবিতার প্রথম শব্দ,
আর প্রতিটা ভালোবাসার শেষ লাইন।
মন খারাপের ছাদে বসে থাকা মেয়ে,
তোমার চুপচাপ চোখের কথাগুলো আমি শুনতে পাই…
আর সেইখানেই, আমি প্রতিদিন একটু একটু করে তোমাকে ভালোবেসে ফেলি।”
মেহরিন সেই মেসেজটা পড়ে কেমন যেন চুপ মেরে গেল। চোখে হালকা জল, ঠোঁটে একটু অস্পষ্ট হাসি।
হাতটা ফোনের কিবোর্ডে গেল…
একটা মাত্র শব্দ লিখল—
“কেন?”
“কবি সাহেব”
“ভালোবাসা মানে কী, জানো মেহরিন?”
ভালোবাসা মানে কোনো দাবি নয়,
ভালোবাসা মানে— কারো চুপ থাকা শুনে ফেলা,
হাসির ভেতরের কান্নাটা পড়ে ফেলা।
ভালোবাসা মানে—
তোমার পাশে না থেকেও তোমার জন্য অপেক্ষা করা,
তোমার সবকিছু না জেনেও তোমাকে বুঝে ফেলা।
ভালোবাসা মানে—
তোমার খেয়ালি রাগটাকেও যত্নে বুকে আগলে রাখা।
ভালোবাসা মানে আমি নয়— তুমি।
তোমার হাসি, তোমার স্বপ্ন, তোমার মন খারাপের দিনগুলোকেও ভালোবেসে ফেলা।
ভালোবাসা মানে,
তুমি নিজের মতো করে বাঁচো—
আর আমি ছায়ার মতো পাশে থাকি, কিছু না বলে।
আমার জানা না জানা, বলা না বলা— সব কিছুর মাঝখানে
তুমি থাকো, মেহরিন।
আর আমি, সেই কবি সাহেব,
তোমার প্রতিটা না দেখা চাহনিতে নিজেকে খুঁজে নিই।”
তোমাকে ভালবাসি কারণ “মেহরিন” নামের মতই গভীর, স্বপ্নভরা আর ছুঁয়ে যাওয়ার মত কোমল।
এই কথাগুলো মেহরিন পড়ার পর,
সে আর বসে থাকতে পারে না…
ছাদের ধারে উঠে দাঁড়ায়…
হাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে—
“তুমি কে কবি সাহেব?
এত গভীর করে আমায় কেমন করে চেনো?”
আবার একটা এসএমএস আসে…
“কবি সাহেব”
আরিওনা….
“মেহরিন,”
ছোট করে লিখে.. বলুন
“কবি সাহেব”
আজ একটু অন্যরকম হলে কি খুব সমস্যা হবে ?
তোমার এই মন খারাপটাকে পাশে বসাও,
আর আমার জন্য একটু সাজো।
একটা নীল শাড়ি পরো,
হাত ভরে নিও কাঁচের চুড়ি দিয়ে,
চোখে দাও হালকা কাজল—
যেন তোমার দৃষ্টি আমার হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
তারপর ছাদে এসো।
চুপ করে দাঁড়াও, কিছু বলো না।
আমি শুধু দেখব—
আকাশের চাঁদটা কে কি আমার পাশে দাঁড়িয়ে
আরও একটা চাঁদকে দেখার সুযোগ দেবে…”
তুমি আসবে তো আরিওনা?
আজ শুধু আমার জন্য—
নিজের সব কষ্টের ভেতর থেকেও একটু আলো হয়ে উঠবে?”
এই মেসেজটা পড়ে মেহরিন আর সামলে রাখতে পারে না। এমন আকুতি ভরা অনুরোধ ফিরিয়ে দেওয়া যায়…
রাত প্রায় ১টা।
ছাদে হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছে, আকাশ জোছনায় ধুয়ে গেছে।
মেহরিন ধীরে ধীরে ছাদে উঠে আসে…
পরনে নীল শাড়ি, চোখে কাজল, হাতে কাঁচের চুড়ির মৃদু টুংটাং শব্দ বাতাসে হারিয়ে যাচ্ছে ।
চারদিকে নীরবতা…
তবে সেই নীরবতার মাঝে তার ভেতরে যেন হাজারো শব্দ বাজছে।
আর ঠিক তখনই,
ফোনে ভেসে ওঠে কবি সাহেবের মেসেজ—
“আরিওনা,
এই রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে,
তুমি যেন স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছো এই ছাদে।
আমার মনে হচ্ছে কল্পনার রাজকন্যা স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে বাস্তবে দেখা দিয়েছে —
নীল শাড়িতে, হাওয়ায় উড়তে থাকা চুলে,
আর চোখে এমন এক অভিমানী ভালোবাসা নিয়ে—
যেটা দেখে পৃথিবীর সব রাত থেমে যায়।
তুমি জানো?
আজ আকাশের চাঁদটা একটু নীচু হয়ে তাকিয়ে আছে—
কারণ, আজ সে আর এক চাঁদকে দেখতে পেয়েছে…
তুমি আসবে বলেছিলে…
তুমি এসেছো—
এই রাতটা এখন পূর্ণ।”**
মেহরিন চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
তার মনে হয়, সে সত্যিই কারো প্রার্থনায় ছিল…
আর এই শহরের ঘুমন্ত আকাশের নিচে
তাকে কেউ শব্দহীন ভালোবেসে যাচ্ছে।
মেহরিন ছাদের রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে।
আলোর দিকে তাকিয়ে, খুব আস্তে বলে ওঠে—
“আপনি তো আপনার মনমতো করে দেখে নিলেন আমায়…”
“কিন্তু আমি…
আমি যে এখন দিন দিন আপনাকে দেখার তৃষ্ণায় পুড়ছি—
সে পিপাসা কি কোনোদিন মিটবে না?”
তার গলায় ছিল না কোনো অভিমান,
ছিল শুধুই এক চুপচাপ অপেক্ষার ব্যথা।
মোবাইলের স্ক্রিন নিঃশব্দ হয়ে থাকে কিছু সময়…
তারপর ভেসে ওঠে কবি সাহেবের উত্তর—
**“তৃষ্ণা যখন মন থেকে জাগে,
তা শুধু চোখ দিয়ে মেটে না, আরিওনা।
তোমার চোখে আমি শুধু রূপ খুঁজি না—
আমি তোমার অভিমান, নিরবতা, আর না বলা কথাগুলো দেখি।
তুমি যদি দেখতে চাও আমায়,
তবে চোখে নয়—
মন খুলে চাও।
তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি—
তোমার প্রতিটা শব্দে, প্রতিটা নিঃশ্বাসে।
তুমি শুধু বলো—
তোমার চোখের সামনে হয়ে উঠবো কি?”**
মেহরিন এবার থেমে যায়।
তার ঠোঁটে খুব আস্তে একটা হাসি খেলে যায়।
সে বুঝে যায়—
ভালোবাসা কেবল দেখা নয়,
এ এক অনুভব—যা শব্দের ভেতরেও ছুঁয়ে যায় হৃদয়কে।
মেহরিন হঠাৎ ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
তারপর টাইপ করে—
“আচ্ছা শুনুন, এই যে
আপনি আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেন—
এইটা তো একরকম ক্রাইম, তাই না?
আপনার বিরুদ্ধে যদি মামলা করি তাহলে?”
“আপনার এই চুপচাপ দেখা,
এই মন ভালো করে দেওয়া মেসেজ,মন খারাপের সঙ্গ দেওয়া, আর
এই অচেনা ভালোবাসা—
সব কিছুর জন্য আমি আপনাকে কোর্টে টেনে নিতে পারি!”
“তখন?”
কবি সাহেবের উত্তর আসে খুব অল্প সময়েই—
যেন অপেক্ষায় ছিল সে।
“জেল যদি হয়, তোমার মন
তাহলে আমি চাই—তোমার মনে আমি আজীবন বন্দি থাকি।
সেই মামলায় রায় যদি হয়,তোমার মন
তবে আমি খুশি মনেই যাবতজীবন সাজা ভোগ করতে রাজি—
শুধু তুমি সাক্ষী দিও এই কথার,
তোমার চোখের আদালতে আমি দোষী!”
মেহরিন এবার ফোনের স্ক্রিনে একটানা তাকিয়ে থাকে।
তার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি, আর চোখে একধরনের জোনাকির মতো আলো।
সে চুপ করে বলে ওঠে—
“এই দোষীটাকে একবার সামনে আনতে ইচ্ছে করছে…
দেখি তো, আসলেই তার চোখে সেই অপরাধবোধ আছে কিনা—
নাকি ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই নেই।”
আবার আসে এসএমএস
‘কবি সাহেব ‘
“আরিওনা…”
“ভালোবাসা সবসময় হাতে হাত রেখে হাঁটে না,
কখনো সে দূর থেকে দেখে—
চোখের আড়ালে থেকেও হৃদয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।”
“আমি একদিন আসব, হয়তো এক রাতে, হয়তো এক ভোরবেলায়…
অপ্রত্যাশিত এক অনুভূতি হয়ে।
না বলে, না চেয়ে—
তোমার পৃথিবীর অলস বাতাসে মিশে যাব।”
“কিন্তু তার পর?
তারপর কখনোই আমি আর হারিয়ে যাব না।
তোমার চোখের পাতায় থাকব, থাকব
তোমার অভিমানে, তোমার হাসিতে—
আর সবচেয়ে বেশি…
তোমার নিঃশব্দ অপেক্ষার ঠিক পাশে।”
“আমার নাম যদি না-ও জানো,
তবু তুমি ঠিক চিনে যাবে—
কারণ, আমি সেই অচেনা কবি,
যার প্রতিটা লাইন তোমাকে ছুঁয়ে যায়…
আর তোমার একটুখানি দেখা পাওয়ার জন্য
হাজার কবিতা লিখতেও রাজি হয়ে যায়।”
মেহরিন ফোনটা বুকের কাছে চেপে ধরে।
তার চোখে জল নেই, তবু মনটা জলের মতো নরম হয়ে আসে।
সে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু ফিসফিস করে বলে—
“তুমি যদি এতটাই আপন হও,
তবে তুমি অচেনা কেন?”
আর সেই অচেনা কবি হয়তো এই রাতের বাতাসেই তার চুলে হাত বুলিয়ে বলে—
“কারণ, ভালোবাসা সবসময় নাম নিয়ে আসে না…
কখনো কখনো সে শুধু অনুভব হয়ে থাকে।”
এরপর মেহরিন রুমে গিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয় চোখ বন্ধ করে রাখে ঠিক তখনই ।
ঠিক তখনই… দূর কোথাও থেকে হালকা হাওয়ার সাথে মিশে ভেসে আসে গিটারের সুর।
আর তারপরে ধীরে ধীরে—
“দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা আচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না”
আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম,
মন যে আর মানে না…..
কাছে আইসো আইসো রে বন্ধু
প্রেমের কারনে..!!
ভালোবাসো বাসোরে বন্ধু
আমায় যতনে..!!
মেহরিন শুয়ে চোখ বন্ধ করে বলে—
“আপনি তো দূরে ছিলেন,
তবু কেন এত কাছে এলেন…
এই গানটায় আমি আছি,
আর আমি আপনাকে গেয়ে যাচ্ছেন ভালোবেসে…”
একটা সুন্দর দিনের সূচনা ধরণীতে সূর্যের রক্তিম আলো ছড়িয়ে পড়েছে।
আজ রাহির জন্মদিন।
চুমকি বললো কি রে বেক্কল বেডী,আছে রাহির বার্থডে বলে গেছিস হতচ্ছারি, আর এগুলো কি
“তুই এই প্যান্ট টিশার্ট পরে যাবে ভাবছিস? সোজা যা… একটা শাড়ি পর!”
মেহরিন টানটান ভ্রু কুঁচকে বলে—
“শাড়ি? আমি শাড়ি পড়তে যাব কোন দুঃখে বার্থডে পার্টিতে যাচ্ছি বিয়ে বাড়িতে না !”
চুমকি ধমক দিয়ে বলে—
“আজ তোর অজুহাত চলবে না। রাহির জন্মদিন, আমরা প্রথম যাচ্ছি আজ । অ্যাটেনশনাল ব্যাপার আছে না, আজ তুই পরবি একটা কালো শাড়ি, আর আমি পরব নীলটা—ব্যাস!”
কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা রেডি হয়ে যায়—
মেহরিনের পরনে কালো জর্জেট শাড়ি,
চুল খোলা, চোখে হালকা কাজল, ঠোঁটে পিঙ্ক নোট লিপস্টিক মেহরিন এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে ওর ঠোঁটের নিচে থাকা তিলটা । ওকে দেখে স্বর্গীয় অপশন লাগছে…
চুমকির পরনে নীল রঙের সিল্ক শাড়ি, কানে দুল, ঠোঁটে নরম হাসি ওকে দেখতেও খুব সুন্দর লাগছে।
দুজনেই যেন গল্পের পাতা থেকে উঠে এসেছে—
রাহির বাড়ির দরজায় যখন ওরা দাঁড়ায়ে বেল বাজাই—রাহি এসে দরজা খুলে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এর পর মুহূর্তেই চিৎকার করে ওঠে—
“আল্লাহ্! আমাদের বাড়িতে পরি নামছে নাকি?”
“তোমরা কোথায় ছিলে এতদিন? মেহরিন আপু গো তোমাকে যেন সিনেমার নায়িকা লাগছেন আজকে!”
মেহরিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, তারপর কোনরকম নিজেকে সামলে ….
হেসে বলে—
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৪
“তোমার জন্যই তো এমন করে সাজা, বুঝলে?”
আর চুমকি পেছন থেকে বলে—
“আর আমার জন্য কেকটা বড় করে কাটা লাগবে, মনে থাকবে!”
রাহি আনন্দের সহিত ওদের নিয়ে যায় ভিতরে ।