মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৫৭

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৫৭
মির্জা সূচনা

এখন সময় দুপুর বারোটার মতো বাজে। মেহরিন ছুটে চলেছে শিকদার বাড়ির দিকে। রূপা বেগমের জরুরি তলব—বলেছেন, কেউ একজন এসেছে, মেহরিনের সঙ্গে দেখা করতে।
বাড়ির কাজকর্ম গুছিয়ে মেহরিন রওনা দেয় নিজ বাড়ির দিকে। সাথে রাহিও আছে, একা একা নাকি তার বোর লাগবে—তাই মেহরিনের সঙ্গেই যাওয়া। রিদ মেহের কে নিয়ে বেরিয়েছে।না বের হয়েই বা কী করবে বেচারা? গত রাতের খাট ভাঙা নিয়ে কি যে যে শুরু করেছিলো সবাই!! কী পচানোটাইনা পচালো বেচারাকে!অবশেষে মেহরিনই এই বুদ্ধিটা দিল—ঘুরে আসাই ভালো। মেহরিনের কথাটা রিদের মনে ধরে,বউকে নিয়ে সময়ও কাটানো হবে আবার এদের হাত থাকে বাচাতেও পারবে। রিদ-কে তো ঘরে রাখা দায়! বিশ মিনিটের মধ্যেই সে বউ নিয়ে হাওয়া। রাজ, লাবীব অফিসে। শান্ত, রাকিবও নিজেদের মতো বেরিয়ে গেছে। আর মেহরিন-রাহি শিকদার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যায় তারা।
বাড়িতে ঢুকেই দেখে, একজন মেয়ে সোফায় বসে আছে। বয়স হবে হয়তো ২৪-২৫। পোশাকে আধুনিকতার ছোঁয়া, দেখতে বেশ সুন্দরী ও স্মার্ট। মেহরিনকে দেখেই সে একরকম করে তাকায়। তার চোখের দৃষ্টিতেই কেমন যেন একটা প্রশ্ন জড়ানো।
মেয়েটিকে দেখে মেহরিনের কপাল কুঁচকে যায়। মনে মনে ভাবে, এ আবার কে?
রাহি পাশ থেকে ফিসফিস করে বলে,
এইটা কে,মেহু আপু?
মেহরিনও ফিসফিস করে উত্তর দেয়,
জানি না রে, হয়তো মামনি ওনার কথাই বলছিল। চল, আমার সাথে ফ্রেশ হবি।
বলে ওরা সোজা ওপরে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নিচে নামে মেহরিন। সবার আগে যায় রূপা বেগমের ঘরের দরজায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মামনি, আসবো?
রূপা বেগম গম্ভীরভাবে বলেন,
হুম আসো বউমা।
হাসিমুখে এগিয়ে যায় মেহরিন। রূপা বেগমের মুখ গম্ভীর দেখে জিজ্ঞেস করে,
মামনি, কী হয়েছে? আপনাকে এমন লাগছে কেন? শরীর খারাপ কি?
রূপা বেগম বলেন,
না বউমা, কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।তুমি চিন্তা করো না।
তবে মেহরিন চিন্তিত। কারণ, রূপা বেগম এমন গম্ভীর স্বভাবের না। সবসময় তার মুখে মিষ্টি হাসি। আজকের এমন চেহারার মানে নিশ্চয়ই কিছু আছে।
কি হয়েছে মামনি?
রূপা বেগম বলেন,

আসার সময় একটা মেয়েকে দেখেছ নিশ্চয়ই?
মেহরিন মাথা নাড়ে—মানে, হ্যাঁ।
ওর নাম জেসি। রাজ বাবা যে কোম্পানির সঙ্গে প্রায় দুই বছর ধরে কাজ করে, মি. জাফরের একমাত্র মেয়ে জেসি। তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।
মেহরিন ভ্রু কুঁচকে বলে,
আচ্ছা, তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনো কারণে চিন্তিত। মামনি, দয়া করে বলুন না কি সমস্যা?
রূপা বেগম মেহরিনের হাত ধরে বলেন,
তুমি বুদ্ধিমতী, সবকিছু সামলে নেবার ক্ষমতা আছে। আমার মন বলছে, এই মেয়েটা এমনি এমনি আসেনি। ওর কোনো উদ্দেশ্য আছে।
মেহরিন এবার মুখ শক্ত করে বলে,

মামনি, আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, এই জেসি নামের মেয়েটা—উনাকে…
রূপা বেগম মাথা নাড়েন, হ্যাঁ। মেয়েটা বড়লোক বাবার দুলালি। সে রাজকে পছন্দ করে প্রথম দেখার পর থেকেই। কিন্তু রাজ বাবা সবসময় এড়িয়ে চলেছে। হয়তো ওর বাবার কাছ থেকেই জেনেছে রাজ বিয়ে করেছে, আর সেটা জানিয়েই এখানে এসেছে।
রূপা বেগম মেহরিনের চোখে চোখ রেখে বলেন,
তুমি বুদ্ধিমতী। জানো তোমাকে কী করতে হবে। আমি কখনোই বলব না যে তুমি ব্যবসার লাভ-লোকসান ভেবে কথা বলো। সে যাই হোক, রাজ সামলে নেবে। ও যদি কিছু উল্টাপাল্টা করে, তবে তুমি যে রাজ শিকদারের স্ত্রী, সেটা বুঝিয়ে দেবে।

বলে রূপা বেগম বাঁকা হেসে ওঠেন।
মেহরিনও বাঁকা হাসে।
উফফ মামনি, আপনি এত সুইট কেন বলুন তো?
রূপা বেগমও মেহরিনের মতো করে বলেন,
উফফ, আমার বউমাটা এত কিউট তাই!
মেহরিন হেসে ফেলে।
রূপা বেগম বলেন,
চলো, যাওয়া যাক।
মেহরিন হেসে বলে,

অবশ্যই! দেখে আসি আমার বর সাহেবের ওপর নজর দেওয়া শকুনটাকে!
রূপা বেগম হাসেন। দুই শাশুড়ি-বউমা একসাথে বেরিয়ে যায় বসার ঘরের দিকে।
তাদের হাঁটায় এক ধরনের রাজকীয় ভাব—মনে হচ্ছে যেনো কোনো রাজ্যের রাজমাতা ও রাজরাণী পদার্পণ করছেন।
রাজ সভায় নিজেদের অভিজাত্য বিস্তার করতে।
রূপা বেগমকে দেখেই জেসি নামের মেয়েটা খুশিতে গদগদ হয়ে বলে ওঠে,
আন্টি! তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে! You know, আমি কত বোরিং ফিল করছিলাম!
রূপা বেগম অসন্তুষ্ট হলেও তা প্রকাশ না করে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলেন,
ওসব কথা থাক জেসি। তুমি কিছু বলতে এসেছিলে, বলো।
জেসি হাসি হাসি মুখ টা মুহূর্তে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। জেসি একবার মেহরিনের দিকে তাকিয়ে, আবার রূপা বেগমের দিকে ফিরে বলে,

আন্টি, রাজ বিয়ে করেছে—কথাটা কি সত্যি?
রূপা বেগম মেহরিনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন,
হ্যাঁ। এই তো, আমার মিষ্টি বউমা।
রূপা বেগমের কথায় যেনো ফুসে উঠে জেসি! কটাক্ষ করে বলে,
এই মেয়েটা?! Like seriously! আন্টি! রাজের চয়েস! এত লেম! ওয়াক! Look she and look me! কেমন খেত টাইপ দেখতে!
রূপা বেগম গর্জে উঠে বললেন,
এই মেয়ে! মুখ সামলে কথা বলো!কার সামনে দাঁড়িয়ে কার সম্পর্কে কি বলছো তুমি? তোমার ওই নোংরা জবান দিয়ে যদি আর একটা নোংরা কথা আমার বৌমার উদ্দেশ্যে বের হয়!তবে সেই জিব্বা টা আমি একটানে ছিড়ে ফেলবো।

জেসি অবাক হয় রুপা বেগমের ব্যবহারে।
মেহরিন বাঁকা হেসে বলে,
উফফ মামনি, এত উত্তেজিত হবেন না। আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। এমন ছোটখাটো বিষয়ের জন্য আপনার ভাবতে বা চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি আছি তো, আমি ঠিক সামলে নেব।
রূপা বেগম একটু শান্ত হন। তবে চোখ দিয়ে যেনো আগুন ঝরছে। যে আগুনে জেসিকে পুড়িয়ে দিচ্ছে যেনো।
জেসি মেহরিনের কাছে এসে বলে,

এই মেয়ে! তুমি ঠিক কী করেছো বলতো? আমার মতো শিক্ষিত, স্মার্ট, বংশধারী মেয়েকে ছেড়ে তোমার মতো এমন সস্তা মেয়েকে কী করে পছন্দ করতে পারে রাজ? উমম… I think…
বাকিটা বলার আগেই মেহরিন হেসে বলে,
আসলে কী বলুন তো! আমার হাসবেন্ডের একটা প্রতিভা আছে, যে খাঁটি হীরা চিনতে পারে। কাঁচ আর হিরের তফাত বুঝেই বলেই আপনি ওখানে, আর আমি এখানে।
জেসি মেহরিনের সূক্ষ্ম খোঁচাটা বুঝে যায়। রাগে গজ গজ করে বলে,
এই মেয়ে! মুখ সামলে কথা বলো!
মেহরিন হেসে বলে,
একটা কথা জানেন তো? কুকুরের পেটে যেমন ঘি-ভাত হজম হয় না, তেমনই সত্য কথা অনেক মানুষের সহ্য হয় না।

জেসি হেসে বলে,
Look me and you! কী আছে তোমার মধ্যে, যা আমার মাঝে নেই? তোমার থেকে সুন্দরী আমি। টাকা-পয়সা, অভিজাত্যেরও কোনো কমতি নেই আমার। তোমার থেকে শিক্ষিতও আমি! So?
মেহরিন হেসে বলে,
আপনি হয়তো জানেন না, আপনার থেকেও সুন্দরী মেয়ে আছে যারা বাজারে নাচে। সুন্দর চেহারা বা কারো ধন-সম্পত্তির প্রতি আমার বরের কোনো লোভ নেই। আর বাকি রইল শিক্ষাগত যোগ্যতা—সেটাও না হয় করে নেবো, সময় এখনও বহু আছে। আর আমার হাসবেন্ড আমাকে সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করে। আমার হাসবেন্ড আমাকে ছাড়া অন্য কোনো নারীর দিকে তাকায় না। আশা করি এতদিনে বুঝেই গেছেন, কম তো আর চেষ্টা করলেন না!
জেসি যেনো মেহরিনের ইঙ্গিতটা বুঝে যায়। আর তাতেই সে ফুসে উঠে মেহরিনকে বলে,

“Blady bitch!”
বলে থাপ্পড় মারতে যায়!
মেহরিন তার হাতটা মুচড়ে ধরে বলে,
উঁহু, উঁহু! এত বড় সাহস দেখানোর ধৃষ্টতা করবেন না। আপনি হয়তো জানেন না, আমার মুখটা কন্ট্রোল করতে পারলেও, হাতটাকে কোনো মতে কন্ট্রোল করতে পারি না।কিছু মানুষ দেখলেই চুলকাতে থাকে মারার জন্য।
বলে সে একটা ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দেয় জেসিকে।
চেঁচামেচির শব্দে নিচে নেমে আসে রাহি। দৌড়ে এসে মেহরিনের পাশে দাঁড়ায়।
জেসি বলে,

এই মেয়ে! এই! তুমি আমার গায়ে হাত তোলার সাহস পাও কী করে? তুমি জানো আমি কে? কী করতে পারি তোমার!
মেহরিন বাঁকা হেসে বলে,
Oh really? Okay! আপনি আমার কী করতে পারেন, করুন। আমিও দেখবো!
জেসি রূপা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
আন্টি! তুমি কিছু বলবে না?!
রূপা বেগম পায়ের উপর পা তুলে বসে বলে,
হ্যাঁ বলবো তো!
এটা বলেই সে মেহরিনের দিকে ফিরে বলেন,
বউমা, তোমার কাছে এমন কিছু আশা করিনি… এই নষ্ট মেয়েটা তোমার গায়ে হাত তুলতে চেয়েছিল, তুমি ওর দেহ থেকে হাতটা আলাদা না করেই ছেড়ে দিলে?

রাহী চোখ বড় বড় করে তাকায় রূপা বেগমের দিকে।
জেসি যেনো আকাশ থেকে পড়লো, কথা বলার মত কোন শব্দ খুজে পেল না।যে রূপা বেগম সবসময়ই হাসি খুশিতে মেতে থাকতো, অল্পতে মানুষকে আপন করে নিত। সে মানুষটার এমন রূপ যেন জেসি মেনে নিতে পারছে না।
মেহরিন বাঁকা হেসে বলে,
উফফ মামনি, আমি তো আদর্শ বউমা! আপনার অনুমতি না পেলে কিছু বলবো কী করে!
রূপা বেগম বলেন,
হুম… অনুমতি দেওয়া হলো।
তারপর দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলল,

জানো, অনেকদিন হলো অ্যাকশন মুভি দেখি না। খুব ইচ্ছে হচ্ছে লাইভে দেখার!তুমি কি সেই সুযোগ খানা করে দেবে বৌমা?
মেহরিন হেসে বলে,
অবশ্যই!
জেসি কিছুই বুঝতে পারছে না—আসলে হচ্ছে টা কী?

জেসি বলে উঠলো,
আন্টি! এসব কী বলছো তুমি?
মেহরিন হেসে বলল,
মামনি বলছেন, আপনার এই সুন্দর দেহ থেকে হাতখানা আলাদা করে দিতে।
জেসি ভয়ানক রেগে গিয়ে বলল,
এই! তুই জানিস কার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস? তোর কোনো ধারনা আছে? আমি কী করতে পারি তোর! তোর এই রূপ যা দেখিয়ে রাজকে ফাঁসিয়েছিস, সেই রূপ আমি অ্যাসিড দিয়ে পুরিয়ে দেব! এমন হাল করব, যে কারো কাছে মুখ দেখাতে পারবি না।
মেহরিন হাসে। আর রাহির যেনো মাথা ফেটে যায় রাগে, সে গর্জে উঠে বলে,
মুখ সামলে কথা বলুন! কাকে কী বলছেন আপনি?
মেহরিন বলে,

আহা, চুপ কর। আচ্চা রাহি সেনা একটা কাজ করতে পারবি?
রাহি জেসির দিকে আগুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
হ্যাঁ, বল কী করতে হবে?
মেহরিন বলে,
আমার রুমে গিয়ে কাভার্ডটা খুলে তোর ভাইয়ার একটা বেল্ট নিয়ে আয়।
রাহি বাঁকা হেসে বলে,
“অবশ্যই।”
বলে দৌড়ে যায়।
জেসি হাসে,

তুই কী ভাবছিস? তোকে আমি ভয় পাবো? Like seriously! আমি জেসি! তোর মতো একটা সস্তা মেয়েকে আমি ভয় পাবো?! অত দূরদিনও আমার আসেনি!
মেহরিন হাসতে থাকে, ধীরে ধীরে তার হাসির তীব্রতা বাড়ে। সে এমন জোরে হাসে, যে রূপা বেগমও হেসে ফেলেন। জেসি ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বুঝতে পারছে না—এ হাসির অর্থ কী! রাগ করা উচিত ছিল, কিন্তু সবাই হাসছে!
ঠিক তখনই রাহি দৌড়ে এসে সিঁড়িতে থেমে বলে,
মেহু আপু! কেছ!
মেহরিন ধরে ফেলে। রাহি হেসে নাচতে নাচতে নামে। মেহরিন রাজের বেল্ট হাতে চাবুকের মতো নিয়ে বলল,
জানিস তো রাহি, এই ভদ্র মহিলার চরিত্রে সমস্যা আছে। এই মহিলার ছোকছোকানি আছে আমার বরের উপর! কী করা উচিত বলতো?
রাহি হেসে বলে,

তোর স্পেশাল কিছু করা দরকার!
জেসি মেহরিনের দিকে তেরে এসে বলে,
তোকে তো আমি…!
জেসি কিছু করার আগেই মেহরিন বাঁ হাতে এক চড় মেরে বলে,
তোকে কী কেউ ভদ্রতা শেখায়নি?এত যে শিক্ষাগত যোগ্যতার বড়াই দেখাস! এই শিক্ষার ছিরি, আমি তোকে আপনি করে বলেছি—তুই আমাকে তুই তুকারি করছিস? হারামজাদি!!
চড় খেয়েই জেসির মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। তবে সেও কম যায় না! সে মেহরিনকে ধরতে যায়। গর্জে উঠে বলে,
তোর এত বড় সাহস!
মেহরিন সরে যায়। ফলস্বরূপ, জেসি গিয়ে পড়ে যায়—সরাসরি রূপা বেগমের পায়ের কাছে! মুখ তুলে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই—
রূপা বেগম এক লাথি মেরে বলেন,

যা! সর মুখ পুড়ি!
জেসি লাথি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় মেহরিনের পায়ের কাছে। মেহরিন মুখ দিয়ে “চুঁ চুঁ” শব্দ করে বলে,
আহারে! আলালের ঘরের দুলালীর এই অবস্থা!
জেসি ব্যথায় কুঁকড়ে যায়—একদিকে মেহরিনের শক্ত-পক্ত চড়, তার ওপরে রূপা বেগমের এই লাথি! রাগে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে সে। হুংকার ছেড়ে বলে,
“You—”
বলে দাঁড়িয়ে এক ফুলদানী তুলে ছুঁড়ে মারে মেহরিনের দিকে।
মেহরিন সময় মতো সরে যায়। আর সেই ফুলদানী গিয়ে পড়ে রাহির পায়ের কাছে! গায়েই লাগতো, সঠিক সময়ে সরে যাওয়ায় লাগেনি। সেটা দেখেই রূপা বেগম আর মেহরিন দুইজনেই রেগে আগুন!
রূপা বেগম গিয়ে একটা কষিয়ে চড় মেরে বললেন,
তোর এত বড় সাহস! আমার বাড়ির মেয়ে, বউয়ের গায়ে হাত তুলিস?
ঠিক তখনই হাওয়ার গতিতে মেহরিন এসে আরেক গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো—
তুই আমার বোনের ওপর, ননদের ওপর হাত তুলিস?! হারামজাদি!
রূপা বেগম রাহিকে বলেন,

মা রাহি!
রাহী বলে,
“হ্যাঁ মামনি!”
“দরজাটা লাগা তো!”
রাহি বলে,
“অবশ্যই!”
বলে দরজা আটকে দেয়।
জেসি ঘাবড়ে যায় আর তোতলিয়ে বলতে থাকে,
“কি… কি… কী করছো তোমরা! দেখো! খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!!
রূপা বেগম বললেন,

খারাপ তো এখন তোর হবে! তোর কত বড় সাহস! আমার বাড়িতে এসে, আমার বউমার সম্পর্কে বাজে কথা বলিস! আমার রাজ বাবার পছন্দ নিয়ে আঙুল তুলিস! এই কীসের দেমাগ তোর?! এই সাদা চামড়ার?! আমার রাজ বাবা তোকে দেখে তো কখনো ফিরেও তাকায় না!কতবার তো সিডিউস করার চেষ্টা করেছি পেরেছিস কি? তোর কি মনে হয় তুই কি কি করেছিস আমি কিছু জানি না?? তোর প্রতিটা নোংরামির কথা আমি জানি?
তিনি আরো বললেন,
আর কোনোভাবে যদি রাজ জানতে পারে, তুই ওর বাড়িতে এসে, ওর বউকে বাজে কথা বলেছিস—তোর এই সুন্দর শরীরটাকে ‘পিস পিস’ করে কেটে বুড়ি গঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেবে, বুঝলি?
মেহরিন হেসে বলে,

মামনি, এই ছোটখাটো বিষয়গুলো আমি-ই দেখে নেব। আপনি উত্তেজিত হবেন না। অসুস্থ হয়ে যাবেন তো। আর আমি চাই না এমন ছোটলোকের জন্য আমার এত কিউট সাসুমা অসুস্থ হয়ে যাক।
মেহরিন রাজের বেল্টটা সামনে এনে বলল,
খুব শখ ছিল না, আমার বরকে ছোঁয়ার? তোকে আজ আমি আমার বরেরই ছোঁয়া দেব!একদম সারা শরীরে এমন ভাবে ছোঁয়া দিব যে তুই নাগীন ডান্স দিবি।
বলে সে বেল্ট দিয়ে মারতে শুরু করে।
জেসি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে, চিৎকার করতে থাকে, আর এদিক-ওদিক ছোটে।

রাহি ফোনে ভিডিও করছে—আর রূপা বেগম সোফায় বসে দেখতে দেখতে হাসছেন।
পাকা দশ মিনিট ধরে মারার পর, মেহরিন বেল্টটা ছুঁড়ে ফেলে। জেসির কাছে গিয়ে তার মুখটা চেপে ধরে বলে,
তোর এই নোংরা মুখটা যেনো আর কোনোদিন আমার সামনে না দেখি, আর না দেখি আমার বরকে আশে পাশে ঘুর ঘুর করতে! নষ্ট মেয়ে মানুষ কাকে বলে জানিস! বিবাহিত পুরুষদের দিকে যারা নজর দেয়, যাদের চরিত্রেই সমস্যা থাকে। তবে তোর চয়েস ভালো কিন্ত কপাল খারাপ। তুই যার দিকে হাত বাড়িয়েছিস সে মানুষ কেবল আমার। আমি বাদে সব মেয়ে ওর জন্য হারাম।তার মনে শুধু আমার বিচরন অন্য কারো প্রবেশ তো দূর আশে পাশে আশাও মানা। তার মনের অলিতে গলিতে শুধু মেহরিন নামক নারীর চলাচল।বাকি নারীর নিঃশ্বাস তার জন্য বিষাক্ত। সেখানে শুধু তুই কেন? বিশ্ব সুন্দরী আসলেও লাভ নেয়।

জেসি কান্না করতে করতে বলে,
আমাকে ছেড়ে দাও…
মেহরিন বাঁকা হেসে রাহির দিকে তাকিয়ে বলে,
রাহি, দরজাটা খুলে দে।
রাহী দরজা খুলে দেয়।
এক প্রকার ঘার ধাক্কা দিয়ে জেসিকে বের করে দেয় মেহরিন। দরজাটা ঠাস করে ওর মুখের উপর লাগিয়ে দেয়।
পাশ ফিরে তাকিয়ে মেহরিন হেসে ফেলে।
তার সঙ্গে হেসে ওঠে রাহি আর রূপা বেগম।
রাহী বলে,

যা দিলি না মেহু আপু… I am purai fida!
তারপর রূপা বেগমের দিকে ফিরে বলে,
মামনি, তোমার কিকটা কিন্তু আরও জোস ছিল!
বলে তিনজন মিলে এমনভাবে হেসে ওঠে।
এখন সন্ধ্যা ৭টা।
সবাই মিলে আড্ডা বসিয়েছে শুধু রাহি ঘুমাচ্ছে। হাসি মজা খুনসুটিতে আড্ডা জমে উঠেছে।
দুপুরে খাবার খেয়েই মেহরিন আর রাহি ফিরে আসে আবার লাবিবের ফ্লেটে। তারপর একে একে সবাই এসে গেছে। আজকের আড্ডায় আরও একজন আছে—সে হল মেহবুবা। সবাই যে এত মজা করছে শুনে সে আর থাকতে পারেনি, চলে এসেছে—তবে সেটা নিছকই একটা অজুহাত।
বাস্তবে সে এসেছে, তার প্রিয় মানুষের কাছাকাছি থাকার লোভে।
ভালোবাসা—এক অদ্ভুত রোগ।
এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষ কখনো হয় কখনো আবেগী, কখনো অভিমানী, কখনো হিংস্র, কখনো বা শিশুর মতন সরল।

ভালোবাসা বড়ই অদ্ভুত বটে,
ভালোবাসা পেলে তা হয় পরিপূর্ণতা—আর না পেলে অপরিপূর্ণতা।
এই ছোট জীবনে ছোট ছোট চাওয়ার ভেতরে ভালোবাসা এক অনন্য চাওয়া। যা সবাই চায়।
যে পায় সে ভাগ্যবান, যে হারায় সে দুর্ভাগা।
আড্ডা চলছে… হাসি-ঠাট্টা, খুনসুটি, প্রেম, খোঁচা—সব মিলে বৃষ্টির মতো মজার এক সন্ধ্যা।
হঠাৎ লাবিব বলে,
—আমার ভালো লাগছে না রে, তোমরা আড্ডা দাও, আমি একটু রেস্ট নিই।
বলে সে উঠে দাঁড়ায়।
রাজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
— অফিসে তো মাথা খেয়ে ফেলছিলি, বাসায় এসে আজ নাকি আড্ডা দিবি। আড্ডা দিতে দিতে তোকে মুরগির বদলে তুই আন্ডা পারতে বললেও পারবি, এখন তোর আরমোরামের ব্যামো হয়ে গেলো?
রাজের কথায় সবাই হেসে গড়াগড়ি।
লাবিব মনে মনে বলে,

— নিজে প্রেম করবে, তা কিছু না। আমি একটু প্রেম করতে গেলেই তার বাগরা দেওয়া শুরু। এমন বড় ভাই থাকলে কপালে প্রেম, বিয়ে, বাসর, হানিমুন—এসব কিছুই জুটবে না। এগুলোতো আর মুখে বলার সাহস হবে না তাই
কিন্তু মুখে বলে,
— মাথা ধরেছে, আর বুকে একটু ব্যথাও করছে।
মেহরিন চিন্তিত গলায় বলে,
— লাবিব তুমি বরং যাও, তুমি রুমে যাও। আমি কফি পাঠাচ্ছি, রেস্ট নাও।
রাজ বলে,
—যাও বাপ, যাও! তুমি যে কোন রেস্ট নিতে চাও আমি জানি! এখন রেস্ট নেওয়ার নাম করে রুমে যাবি আর তোর ভাবিকে বলবি কফি পাঠাতে—আর ভাবি নিশ্চয়ই আমার ছোট শালিকাকে দিয়ে পাঠাবে। সেই সুযোগে তুই রসলীলা করবি, হ্যাঁ?
লাবিব চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে,

— যা সালা, বুঝেই গেল! প্ল্যানটা মাঠে মারা গেল…
তারপর দাঁত বের করে বলে,
— আরে ভাই, উলটো-পালটা ভাবছো! আমি তো…
রাজ হাত তুলে বলে,
— থাক বাপ, আমাকে আর বলতে হবে না! তোর ভাবনার দূর কোন পর্যন্ত, তা আমি বেশ ভালো করে আমি জানি। একটু ও সাহস হলো না তোর এখনও ছেহ —এই তুই আমার ভাই আমার এসিস্টেন্ট! আমাকে দেখে কিছু শিখ ব্যাটা! আমার যখন প্রেম পাই, দাড়ায় বলি—বউ, রুমে চলো, আমার বউ বউ পাচ্ছে!
মেহরিন রাজের বাহুতে কিল মারে।
বাকিরা হেসে গড়ায়।
রাজ আবার বলে,

— তোর থেকে তো রিদ এই ভালো! বাসর রাতে খাট ভেঙে দিল!
এই কথা শুনেই মেহের কাশতে শুরু করে।
রাজ তা দেখে বলে,
— বাহ বইন বাহ! তোরা করবি দোষ না, আর আমি বললেই কাশি উঠে যায়! বাহ বইন বাহ মানবতা আজ কোথায়।
রাজ রিদকে বলে,
— রিদ বাপ, তোকেও বলি—হারি যায়! এত পাওয়ার তোর!
রিদ ঠাণ্ডা গলায় বলে,
— অন্তত তোর থেকে কম ভাই! আমি অন্তত তোর মতো নৌকায় উল্টে পড়িনি!
রাজ বলে,
— ওটা তো একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিলো, ভাই! নৌকায় প্রব্লেম ছিল… সালার নৌকা ও আমার সঙ্গে বেইমানি করল! কি বলবো আর দুঃখের কথা সালার কারো মধ্যে মানবতা আর নেই।
রিদ দুঃখী দুঃখী কন্ঠে বলে,

— ভাই, আমারও সেই একি দুঃখ! খাট বেইমানি করল… তুই নৌকা উল্টে পড়লি আর আমি খাট ভেঙে।
ওদের কথায় সবাই হেসে ওঠে।
মেহরিন আর মেহের কেশে উঠে।
রাজ এগিয়ে আসে, হাতে দুই গ্লাস পানি।
একটা মেহেরকে, আরেকটা মেহরিনকে দিয়ে বলে—
— খাও, এত কশা-কাশির কী আছে? আমরা কি পরকীয়া করছি? বিয়ে করে যা মন চায় করছি—কারো কিছু চিরে যাবে না, বুঝো নাই?
মেহরিন চুপচাপ পানিটা মুখে তোলে, ঠিক তখনই…
রাজ একটা দার্শনিক ভঙ্গিতে বলে ওঠে—

— বুঝলি, তোরা নৌকা উল্টে যাওয়ায় মনে করেছিলাম—আমার সব সপ্ন, সব কষ্টই বুঝি শেষ… সব বুঝি মাঠে মারা গেলো।
কিন্তু আমি তো আর সেটা হতে দেইনি!
— ঝর্ণার ধার টাকেই খাট বানিয়ে নিলাম… না আছে ভয় খাট ভাঙার, না পানিতে ডোবার!
— আহা! কী যে শান্তি ছিল ভাই! প্রকৃতির মাঝে… ঝর্ণার কলকল শব্দ আর ঝিজি পোকাদের ডাক!
মেহরিনের মুখভর্তি পানি উঠে যায় নাক-মুখ দিয়ে!
সাথে সাথেই কাশতে শুরু করে।
রাজ পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,

— সাট সাট.. অত কাশি কাশি করার কী আছে বউ কথা তো সত্যি।
মেহরিন চোখে জল, হাতে মুখ চাপা দিয়ে দৌড়ে যায় পাশের ঘরে।
ওকে দৌড়াতে দেখে সবাই হাসতে হাসতে লুটোপুটি খায়।
রিদ ঠাণ্ডা গলায় বলে,

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৫৬

— হ্যাঁ ভাই,কী যে একটা বল মার্কা ফিলিং! খাট ভেঙে পড়ে যাওয়া ছিল—কাজ শেষ করার আগেই সব শেষ!
এইটা শুনে…
মেহের আর মেহবুবাও আর সহ্য করতে না পেরে উঠে পড়ে। পালিয়ে বাঁচে হাসির হাত থেকে।
আর বাকিরা হাসতে হাসতে শেষ।

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৫৮