মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬১

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬১
মির্জা সূচনা

হেলিকপ্টারে উঠে রাজ মেহরিনকে নিজের কোলেই বসিয়ে রাখে।
মেহরিন বলে—
আমাকে বসতে দিন।
রাজ বলে—
“একদমই না।”
মেহরিন আর কিছু বলে না।
চুপচাপ রাজের গলা জড়িয়ে ধরে।
দুজন চোখে চোখ রাখে।
অনেকক্ষণ ধরে।
এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন বহু বছর পর দেখা…
কিন্তু প্রিয় মানুষের দিকে তাকানোর তৃষ্ণা কি কখনো মেটে?
জীবনের যতবারই দেখা হোক না কেন,
তবুও সেই ‘আর একটু তাকাই’ —চোখের কোণে জমে থাকা ভালোবাসার খরস্রোত।
মেহরিন মুচকি হেসে বলে—
বড় একা একা লাগে তুমি বিহনে..!
বড় শুন্য শুন্য তোমার কারনে…!
রাজ কপাল ঠেকিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে—
তাই?

মেহরিন মুচকী হেহে আবার বলে—
এক নজর না দেখিলে বন্ধু,
দুনিয়া অন্ধার হয়…
পাশে তোমায় না পাইলে বন্ধু,
দম যেন মরে যায়…
ও বন্ধু তুমি কই কই রে…
প্রাণ বুঝি যায় রে…”
এটুকু গাইতেই,
রাজ মেহরিনের ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়।
মেহরিন চোখ বন্ধ করে নেয়।
ভালোবাসার ঘ্রাণে চোখের কোণ ভিজে ওঠে।
দুটো নোনা জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে গালের কিনারে।
দু’মিনিট পর রাজ ধীরে আলতো করে মেহরিনকে ছেড়ে দেয়,
আরো একবার কপালে চুমু খেয়ে চোখে চোখ রেখে বলে—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমার মন খারিল রে…
কেমনে বুঝাইতাম, আমার জান কারিল রে…”
তারপর হঠাৎ আরও একটা চুমু খেয়ে হাসি মুখে বলে—
“ওরে ও রঙ্গিলা কও তাবিজ করলা কিলা?
আমি তোর লাইগা ওখন বন্ধু আদা পাগলা!”
মেহরিন হেসে ওঠে, কিছু একটা বলবে, এমন সময়—
হঠাৎ…
মেহরিনের পেটের নিচে তীব্র ব্যথা শুরু হয়।
হাসোজ্জ্বল মুখ মুহূর্তেই বেদনাতে কুঁচকে যায়।
রাজের শার্ট চেপে ধরে বলে—
“কবি….সাহেব…”
রাজ ঘাবড়ে যায় মেহরিনের এমন ভাবে ডাকায়।
তার চোখে ভয়, মুখে বিভ্রান্তি।
হাত দিয়ে মেহরিনের গালে হালকা চড় দিয়ে বলে—

“এই! এই! কী হয়েছে বউ? কী হয়েছে?
ব্যথা করছে? পানি খাবি?”
মেহরিন ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে।
রাজ তাকিয়ে আছে অসহায়ভাবে…
মেহরিন ফিসফিস করে বলে—
“সময় হয়ে গেছে…”
রাজ কিছু না বুঝে বলে—
কিসের সময়? কী বলছো তুমি?
মেহরিন এবার চিৎকার করে উঠে—
ব্যথা, রাগ আর আবেগে একসাথে!
তুই কী গাধা! সময় হয়ে গেছে—তোর বাচ্চা আসতেছে!
তোর সন্তানের জন্মের সময় হইছে!
হাসপাতালে নিয়ে চল!

baby is coming……….
রাজ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
মেহরিন কষ্টে মুখ কুঁচকে শুয়ে আছে, ব্যথায় শরীর মোচড়াচ্ছে।
রাজ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেহরিনের দিকে। মেহেরিনের বলা কথার অর্থ সে বুঝতে পারছে না তারপর হঠাৎ?
একটা মুহূর্ত… দুটো… তিনটে।
তারপর যখন সে ধরতে পারে এর অর্থ তখন ধীরে মাথা নেড়ে ইশারায় জানতে চায় রাজ সে যা বুঝেছে তাই কী না—
কাপা কাপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“স…..সত্যি?
এই প্রশ্ন শোনামাত্র,
মেহরিন ব্যথা ভুলে গিয়ে এক ঝটকায় উঠে বসে,
রাগে গাল ফুলিয়ে, চোখে আগুন নিয়ে—
থাপ্পড় মেরে রাজের চুল টেনে ধরে বলে—
“আমি ব্যথায় মরে যাচ্ছি আর তুই জিজ্ঞেস করিস সত্যি কিনা!
গাধা কোথাকার! তুই কি আমার বেয়াই লাগস যে তোর সাথে মজা করব বেয়াদব হ্যাঁ, তোকে বলছি—তোকে!
তোরই সন্তান আসতেছে!
আর তুই এখনে ‘সত্যি কিনা’জিজ্ঞেস করছিস?
আহহহহ…
তোর বাচ্চা….
baby is coming………

রাজ আঁৎকে উঠে।
এই মুহূর্তে যেন সময় তার বুকের ঠিক মাঝখানে আঘাত করে! বুক ধুক ধুক করছে জোরে জোরে, আনন্দ, ভয়, খুশি, কষ্ট মিশ্র একটা অনুভূতি হচ্ছে হাত পা কেমন কাপছে অসার হয়ে আসছে ।
তারপর একটা প্রচণ্ড চিৎকার—
“হেলিকপ্টার জুড়ে উড়াও! হসপিটালে চলো! ফাস্ট……
রাজের গর্জনে পুরো হেলিকপ্টার থমকে যায়।
পাইলট মুহূর্তেই বুঝে যায়,
এই আদেশ সময়ের আগে নয়, সময়ের গভীর চাপে জাগা একটা হুংকার! আর রাজের আদেশ মতো না চললেই জীব বগার’পার পাইলট নিজের কেরামতি দেখেয়।
রাজ মেহরিনকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে,
তার কপালে ঘাম, মুখে আতঙ্ক আর মনে হাজার প্রার্থনা।
আর মেহরিন কষ্টে, চোখ বন্ধ করে।
রাজ মেহরিনকে বলে,
“আমি পাশে আছি, কিচ্ছু হবে না…
আমি পাশে আছি…”

মাত্র পাঁচ মিনিটের মাথায় হেলিকপ্টার থামে সিটি হসপিটালের সামনে।
তার আগেই হাসপাতালজুড়ে হুলস্থুল পড়ে গেছে।
রাজ আগেভাগে ফোন করে বলে দিয়েছে হসপিটালের ওনার কে —
সব রেডি চাই! আমার বউ আসছে! তার যেনো কষ্ট না হয়। আমার বউয়ের কোন কষ্ট হলে আমি রাজ শিকদার পুরো হসপিটাল জালিয়ে দিবো।
হেলিকপ্টার থামতেই রাজ মাটিতে লাফিয়ে নামল।
কোথায়? কোথায় তোমরা? কে আছো?
রাজ গর্জে উঠল।

তৎক্ষণাৎ এক নার্স চাকা লাগানো হুইলচেয়ার নিয়ে এগিয়ে এলো।
কিন্তু রাজ ওতে মেহরিনকে বসাল না।
সে নিজের কোলে তুলে নিল তার পৃথিবীটাকে তার ভালোবাসার মানুষ—মেহরিনকে।
আর চিৎকার করতে করতে ছুটে চলল ভিতরে—
পথ ছাড়ো! পথ ছাড়ো! আমার বউয়ের সময় হয়ে গেছে!
আশে পাশের লোকেরা অবাক চোখে চেয়ে আছে।
রাজের লোকেরা আগে থেকেই রাস্তাটা ফাঁকা করে রেখেছিল। তাউ সে বলছে পথ ছাড়ো আমার বউয়ের সময় হয়ে গেছে।

কেউ রাজকে থামাতে পারল না।
ডাক্তাররা দৌড়ে এলো।
মেহরিনকে নিয়ে গেল ওটি-র দিকে।
আর মেহরিন নিজে চেষ্টা করছিল শক্ত থাকার,
কিন্তু রাজের সামনে তা আর ধরে রাখতে পারছিল না। রাজ যা শুরু করেছে, তাতে ধরে রাখাও যায় না।
ডাক্তাররা চাইল নরমাল ডেলিভারি করাতে,
আর মেহরিনও তাতে রাজি।
কিন্তু রাজ?
সে মানছে না আজব ব্যাপার না ডক্টর রাজি পেসেন্ট রাজি কিন্তু রাজ রাজি না।
সে যেন পাগল হয়ে গেছে—
না! না না না!
নরমালে রিস্ক আছে!

সিজার করুন! আমার বউ আমার সন্তানকে আমি হারাতে চাই না! আপনারা সিজার করুন।
ডাক্তাররা বোঝানোর চেষ্টা করলো।
কিন্তু রাজের পাগলামি তখনো থামেনি।
একপর্যায়ে রাজ রেগে গিয়ে গর্জে উঠল—
বউ আমার! বাচ্চা আমার! আমি বলছি, সিজার হবে মানে হবেই। তোরা বলার কে হ্যাঁ? চুপ চাপ সিজার কর। বেশি কথা বললে সব কটা কে এখানেই পুঁতে রেখে দিব।
ডাক্তাররা চুপ।
জীবন-মৃত্যুর ভয় এক অদ্ভুত গম্ভীরতা তৈরি করল ঘরে।
কিন্তু ঠিক তখনই—

“কবি সাহেব!”
মেহরিন ডাকে।
রাজ নরম হয় বউয়ের ডাকে,দৌড়ে কাছে যায় রাজ।
আর তখনই—মেহরিন তার চুল টেনে ধরে চিৎকার করে—
আমি নরমাল ডেলিভারি করবো! বুজলি তুই? তোর বকবকানি বন্ধ কর!!
রাজ হতভম্ব!
কিন্তু বউ, রিস্ক…
রিস্ক আমি নেব!
তুই এখনই এখান থেকে বের হ,
না হলে তোর সন্তানের মুখ দেখার আগেই তোর চুল টেনে ছিড়ে ফেলবো,তোকে টাকলা বানিয়ে ফেলবো, তোর মাথা ফাটিয়ে দেবো আমি…..

রাজ বোকার মত তাকিয়ে থাকে।
অবশেষে কিছু না বলে মেনে নেয়।
ডাক্তাররা শুরু করে প্রস্তুতি।
কিন্তু রাজ?
সে ওটি’র বাহিরে যায় না সে মেহরিনের পাশে দারিয়ে থাকে নড়াচড়া না করে, একবার মেহরিনের দিকে করুন চোখে তাকায়। তো আরেকবার চোখে আগুন নিয়ে দেখতে থাকে প্রতিটি ডাক্তার-নার্সের দিকে।
আর যখন সে দেখতে পায়,
একজন ছেলে ডাক্তার মেহরিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে—
তখন রাজ উঠে গিয়ে গর্জে ওঠে—
আপনার এখানে থাকার দরকার নেই।
বাকিরা সামলাবে।

বের হন। এখনই! চলুন আমার সাথে। বলেই সে ডাক্তারের কাঁধে হাত রাখে। ডাক্তার তাকায় রাজের দিবে, কিন্তু কিছু বলার আর সাহস হয়ে ওঠে না। রাজের চোখের দিকে তাকিয়ে মিয়িয়ে যায় সে। ঢুক গিলে রাজের সাথে বেরিয়ে যায়।
ওটি থেকে রাজ বেরিয়েই দেখে—
রিদ, লাবিব, কাসেম আর মেহের দাঁড়িয়ে আছে।
রাজকে দেখেই সবাই ছুটে আসে কাছে।
রাজের চুল এলোমেলো, কুঁচকানো শার্ট, আঁচড়ের দাগ, শরীরের অবস্থা দেখেই মেহের বিস্মিত।
মেহের হঠাৎ বলে,
“ভাইয়া!”
রাজ মুখ কুঁচকে, একটু ব্যথাতুর সুরে বলে,

তোমার বোন আমায় মেরেছে…
এই দুঃখের মধ্যেও।
মেহের ফিক করে হেসে ফেলে।
কাসেম মাথা নিচু করে হাসে।
লাবিব হাসি লুকাতে পিছনে ঘুরে যায়।
কিন্তু রিদ?
সে সামনে দাঁড়িয়ে, গম্ভীর মুখে বলে,
ভাই, বেশি মেরেছে?
রাজ মুচকি হেসে বলে,
আরে না, ওই আর কী একটুখানি।
রিদ ঠোঁট কামড়ে হাসে,
বাহ্ ভাই বাহ্!
রাজ হেসে বলে,

বউ প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর যা কেলানি খেয়েছি তার কাছে—এইটা কিছুই না!
রিদর হাসি মুহূর্তেই থেমে যায়।
চোখ গোল করে তাকায় মেহের দিকে।
আর মেহের ৩২ পাটি দাঁত বের করে গর্বে তাকায়— “হ্যাঁ, আমিই মেহরিনের বোন!
রিদ ঢুক গিলে।
রাজ বাকি সবার খোঁজ নিচ্ছিলো রাজ।
ঠিক তখনই একটা মেয়েলি কান্নার গলা কানে আসে—
সবাই ঘুরে দেখে, চুমকি দৌড়ে আসছে, চোখমুখ ভেসে যাচ্ছে জলে।
পরনে সেলোয়ার, পায়ে জুতা নেই। চুলগুলো উসকো খুসকো, কান্না করতে করতে যা তা অবস্থা চেহারার।
ওর পেছনে এক লোক বলছে,

আস্তে যাও! পড়ে যাবে!
মেয়েটি এসে মেহেরকে ধরে পাগলের মত বলতে থাকে—
আমার মেহু… আমার মেহু কোথায়, ঠিক আছে তো? ও আর বাচ্চা… দুজনেই ভালো আছে তো? বলো না… প্লিজ বল মেহের! আমার মেহু…
রাজ এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।
শান্ত এসে রিদ আর লাবিব পাশে দাঁড়ায়।
মেহের চুমকিকে জড়িয়ে ধরে তার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলে—
আহা চুমকি, সোনা… চুপ কর। তোর প্রাণের সই ঠিক আছে।
তুই জানিস না, সে কতটা সাহসী!
ওর শুধু ব্যথা উঠেছিল, তাই হসপিটালে…
তুই আর আমি খালামণি হচ্ছি!
চুমকি ছোট বাচ্চার মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,

**”আমার মেহু ঠিক আছে তো? সত্যি?
মেহের মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ে,
হ্যাঁ, একদম ঠিক।
ওরা সবাই একটু স্থির হয়।
শান্ত হয়ে বসে।
ঠিক তখনই…
একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ শোনা যায়।
সবাই উঠে দাঁড়ায়।
চুমকি আর মেহের দৌড়ে যায় দরজার দিকে।
অপারেশন থিয়েটারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাজ।
তার হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার মতো অনুভূতি।
পুরো শরীরে এক ধরনের কাঁপুনি।
নিজের ভারসাম্য ফেলছে রাজ…
সে পড়ে যেতে নেয় রিদ আর লাবিব ধরে ফেলে।

কিছুক্ষণ পরেই একজন নার্স আসে। তার কোলে ফুটফুটে এক নবজাতক। সে সামনে এসে বলে,
— বাচ্চার বাবা কোথায়?
রাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। নার্স হেসে কিছু বলবে, ঠিক তখনই রাজ কাঁপা কণ্ঠে বলে ওঠে,
আমার ওয়াইফ? আমার বউ? আমার বউ ঠিক আছে তো? আমার বউয়ের যদি কিছু হয়… আমি কাউকে কিন্তু ছাড়বো না বলে দিলাম!
পাশেই থাকা রিদ তড়িৎ গতিতে সামনে এগিয়ে এসে বলে,
— রাজ! কী বলছিস তুই? সবাই ঠিক আছে, বাচ্চাটাকে কোলে নে।
রাজ কিছু বলার আগেই আরেকজন নার্স এসে হেসে জানায়,
Congratulation sir! আপনি দুটো পুত্র সন্তানের বাবা হয়েছেন।
চারপাশে যেনো এক আনন্দের হাওয়া বয়ে যায়। মেহের আর চুমকি দূরে দাঁড়িয়ে খুশির চোখে তাকায় একে অপরের দিকে তার পর দৌড়ে আসে তারা।
রাজ আবার বলে ওঠে,

— আমার ওয়াইফ? আমার বউ ঠিক আছে?
দুই নার্স একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। রাজ আর দেরি না করে ছুটে যায় ওটির ভেতর। দরজা দিয়ে বেরোচ্ছিলেন ডাক্তাররা। রাজ-কে দেখে থেমে গিয়ে বলেন,
— আপনার ওয়াইফ সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন স্যার, এবং Congratulation —আপনি আর আপনার স্ত্রী দুই পুত্র সন্তানের পিতা-মাতা হয়েছেন।
রাজ শুধু একটা শব্দ বলে,
— “Thanks…”
তারপর দৌড়ে গিয়ে মেহরিনের মাথার কাছে বসে পড়ে। মেহরিনকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস নেয়। তারপর ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
— তুমি ঠিক আছো তো, Moonbem?
মেহরিন দুর্বল শরীর আর ক্লান্ত চোখে মৃদু হাসে,
— ঠিক আছি আমি…

রাজ তার কপালে চুমু খায়। গালে ঘষে পড়ে সুখের এক জল কনার চিহ্ন—মানুষ শুধু দুঃখ পেলে কাঁদে না, অতিরিক্ত সুখেও কাঁদে। যেমন এখন মেহরিন কাঁদছে, তার যে মাতৃত্বের স্বাদ মিলেছে।
আজকের এই আনন্দ যেনো পৃথিবীর সব সুখকে হার মানায়। নিজেকে কেমন সুখী সুখী লাগছে, অবশ্য মেহরিন নিজেকে একজন খুব সুখী নারী’ই মনে করে।বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধু—সব দিক দিয়ে সে সুখী। আর স্বামীর দিক দিয়েও সে সুখী। জীবনে যতটুকু সুখ থাকলে মানুষ আল্লাহর সামনে দু’হাত তুলে শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারে না, মেহরিনের আজ ঠিক ততটাই সুখী নিজেকে মনে করছে। তবে এইসব সুখ ছাপিয়ে যে সুখে সুখী সে তা হলো মা হওয়ার অনুভূতি।

পুত্র সন্তান হলে নাকি স্বামীরা তার সন্তান নিয়ে হইচই লাগিয়ে দেয়। বংশের প্রদীপ মনে করে পুত্র সন্তানকে। তাকে নিয়ে কত আদিক্ষেতাই না করে। তখন সন্তান নিয়ে তাদের কত রকমের আহাল্লাদ থাকে, সন্তানের খোঁজ নিতে নিতে বউয়ের খোঁজ তারা নেয়ই না। তবে রাজ তাদের মধ্যে পরে না। মেহরিন জানে
রাজ কিন্তু এখনও সন্তানের মুখ দেখেনি। স্ত্রীকে দেখতে ছুটে এসেছে। ক’জন পুরুষ এমন করে?
মেহরিন হাসতে হাসতেই বলে,

—সন্তানদের না দেখেই চলে এলেন, কবি সাহেব? এই সন্তানদের নিয়ে আপনি কত স্বপ্ন দেখেছেন এই করবেন সেই করবেন আর এখন ওরা যখন এসেছে—তাদের না দেখেই চলে এলেন? এটা কি ঠিক হলো?
রাজ মৃদু হেসে ওর চুল গুছিয়ে দিয়ে পরপর কয়েকটা চুমু খায়। এক গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,
— এই পৃথিবীতে আল্লাহ আর নবীর পরে আমি যদি কাউকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি—সে হচ্ছে আমার বউজান। আমার বাবা-মা নেই, কিন্তু তাদের ভালোবাসাটাও আমি তোমার মাঝে পাই। বাবার শাসন, মায়ের স্নেহ—সবই তোমার মাঝে পাই। তোমার যদি কিছু হয়ে যেত, আমি মরে যেতাম বউ… একদম মরে যেতাম! তুমি থাকলে আমি সন্তানের বাবা হতে পারবো। কিন্তু তোমার কিছু হলে আমি কী করে বেঁচে থাকবো বল?
মেহরিন বলল,

—এইসব অলক্ষণে কথা বলবেন না! আমি ঠিক আছি। যান, সন্তানদের কোলে নিন।
রাজ হেসে নিজের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
— তুমি আমাকে অনেক মেরেছো বউ… আমার সোক মিটে গেছে। আমরা আর বাচ্চা চাই না।
মেহরিন মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,
— আমি ফুটবল টিম বানাবো!
রাজ বলে,

— ঐ বউ… না প্লিজ!!
মেহরিন হেসে ফেলে।
রাজ আরেকটা চুমু খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। মুচকি হেসে বলে,
— অনেক হয়েছো বউ সোহাগ! আমি আবার অতটা বউপাগল না, বুঝলে ? আমি তো স্রেফ একটু দেখতে এসেছিলাম… দেখা শেষ এখন বরং আমি যাই, আমার বাচ্চারা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
তারপর মুচকি হেসে আবার বলে,
— আর শোনো, Moonbem…
মেহরিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
রাজ অ্যাটিটিউড নিয়ে বলে,

— আমি কিন্তু মোটেও তোমার টানে আসিনি। আমি এসেছি, মানে… আমনি এসেছিলাম একটু দেখতে—না মানে, আমার সন্তানদের এই পৃথিবীতে যে এনেছে তাকে তো একবার দেখা উচিত, তাই না? তাই আরকি… একটু মানবতা দেখাতে এসেছিলাম। আমার তো আবার মানবতা অনেক বেশি, জানোই তো!
মেহরিন হেসে বলে,
— নাটকবাজ! কোথাকার।
রাজ ওর কথা নকল করে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,
— “হুমমম…”
তারপর হেসে বলে,
— আমি এখন আমার সন্তানদের কাছে যাবো।
বলে বেরিয়ে যায়। বায় বায় বউয়ের এখন দরকার নাই টাটা।
মেহরিন চোখ বুজে হাসে।
ওদিকে রাজ বেরিয়ে দেখে তার রাজপুত্ররা দু’জন, দুই খালামণির কোলে। একজন মেহেরের কোলে, তো অন্যজন চুমকির কোলে।
রাজ-কে দেখেই তারা দুজন এগিয়ে আসে।
রাজ দুজনকে দেখে জোরে বলে ওঠে,

— “মাস-আল্লাহ!”
বলেই সে দুজনকে একসাথে কোলে তুলে নেয়।
একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে তাদের দুজনের কানে আজান দেয়।
তারপর দুজনের কপালে চুমু খেয়ে বলে,
— আমার সুখ, আমার শান্তি আমার সন্তান।
তোমরা এসে আমার জীবনটা পরিপূর্ণ করে দিলে বাবারা! তোমাদের বাবা তোমাদের অনেক ভালোবাসে,বলে আবারও চুমু খায়।
সবার চোখে-মুখে তখন খুশির জ্যোতি আর আনন্দের জলকণা।
রাজ কাসেমের সামনে গিয়ে বলে,

—এই দেখুন, আপনার দুই ভাগ্নে। আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না। তবে ওদের জীবন রক্ষার জন্য আল্লাহ আপনাকে উসিলা করে পাঠিয়েছে। আপনার ভাগ্নেদের কোলে নিবেন না?
কাসেম চোখে পানি নিয়ে তাকায় রাজ-এর দিকে।
রাজ হাসে ইশারায় বলে কোলে নিতে।
কাসেম কোলে নেয় এরপর দুজনের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে বলে ওঠে,
— আমার ভাগ্নেরা… দোয়া করি আল্লাহ ওদের অনেক বড় করুক। সবসময় ভালো রাখুক।
সবার মুখে তখন একসাথে একটা কথা—

— “আমিন!”
রাত তখন ঠিক ৪টা বেজে ৪৩ মিনিট।
মেহরিন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার দুই পাশ ঘিরে ঘুমোচ্ছে তার রাজপুত্ররা—একজন বাঁদিকে, অন্যজন ডানদিকে। তাদের মুখে প্রশান্তির ছায়া, যেনো স্বর্গের কোনো শান্তিময় পরশে ঘুমোচ্ছে তারা।
কেবিনের আলো নিভে আছে। শুধু জানালার ফাঁক গলে আসা এক চিলতে হালকা চাঁদের আলো, মেহরিনের কপালে আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে।
রাজ কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়েছে কেবিন থেকে। মেহের, চুমকি মেহবুবার কেবিনে।
রিদ,লাবিব,শান্ত আর কাশেম—সবাই বাইরে বসে বসেই ঘুমাচ্ছে ক্লান্তিতে।
ঠিক সেই সময়…

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬০

নিভৃতে, নিঃশব্দে কেউ একজন ঢোকে মেহরিনের কেবিনে।
অতিদ্রুত কিন্তু নিঃশব্দ পায়ে দরজাটা খুলে দেয় সে।
কপাটের মৃদু শব্দেও কেউ জাগে না, কেউ টের পায় না।
তার হাতে চকচকে, ধারালো একটা ছুরি।
একটা নিঃশব্দ মৃত্যু যেনো এগিয়ে আসছে।
ধীরে ধীরে, নিঃশ্বাস আটকে রেখে সে মেহরিনের বিছানার দিকে এগিয়ে আসে।
তার চোখে ঘৃণা, ঠোঁটে একটা বিকৃত হাসি।
ধারালো ছুরিটা উঁচিয়ে তোলে সে—
ঠিক তখনই…

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬২