মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৩
মির্জা সূচনা
সময় তখন ঠিক ১১টা।
সাই সাই করে চারটি গাড়ি এসে দাঁড়ায় শিকদার বাড়ির দোয়ারে।
এক এক করে সবাই নেমে আসে গাড়ি থেকে।
গাড়ি থেকে নামতেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে সকলে শিকদার বাড়ির দিকে।
বাড়ির রূপটাই যেনো পাল্টে গেছে!
রাজকীয় ভঙ্গিতে সাজানো হয়েছে পুরোটা বাড়ি থেকে শুরু করে বাড়ির আঙিনা।
আর হবেই বা না কেন?
কত বছর পর শিকদার বংশে দুই ‘রাজপুত্র’ আগমন হয়েছে। যারা শিকদার বংশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তারা যে এসেছে এই ভুবনে।
সেই দুই রাজপুত্র—রাজ আর মেহরিনের মাধ্যমে এসেছে শিকদার পরিবারে।
জীবনের কত ঝড়-ঝঞ্ঝা পার করে আজ তারা নিজের ঘরে ফিরেছে।
সূর্য-চাঁদের আলো মিলে যেনো আল্লাহ নিজ হাতে আঁকিয়ে দিয়েছেন মুখ দুটো।
মুখ দুটো দেখলেই হৃদয় জুড়িয়ে যায়।
মেহরিনের কোল এক রাজপুত্র, আরেকজন চুমকির কোলে।
সবার চোখ যায় রাজের দিকে।
রাজ হেসে বলে,
— এগুলো স্রেফ আমার রাজকুমারদের গ্রহপ্রবেশের আয়োজন।
শিকদার পরিবারের নতুন সদস্যদের গৃহপ্রবেশ বলে কথা। আয়োজন— কোনো কমতি থাকলে চলবে নাকি??
সবাই হেসে ওঠে।
ঠিক সেই মুহূর্তে ক’জন সাংবাদিক সামনে এগিয়ে আসে।
তারা রাজকে দেখে বলে,
— স্যার, আপনার অনুভূতি কেমন? এত ঝড়-ঝাপটা পেরিয়ে দু’পুত্রকে নিয়ে আবার নিজের বাড়িতে ফিরতে পেরে??
রাজ সৌম্য মুখে বলে ওঠে,
— অবশ্যই, এই অনুভূতি প্রকাশের মতো নয়।
যারা বাবা-মা হওয়ার মতো এই মিষ্টি অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত, শুধু তারাই জানেন এই অনুভূতির মাহাত্ম্য।
এই অনুভূতি আসলে কোনো শব্দে বোঝানো সম্ভব না।
এরপর এক সাংবাদিক প্রশ্ন করে মেহরিনকে—
— ম্যাম, আপনি একজন সাহসী নারী। আমরা শুনেছি আপনার সাহসিকতার কথা।
আপনি কীভাবে লড়াই করেছেন নিজের সন্তানদের জন্য?
মেহরিন মিষ্টি হেসে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— একজন নারীর চেয়ে একজন মায়ের শক্তি বেশি, এটা তো সবাই জানেন।
একজন নারী জানে, সন্তানের জন্মের সময় জীবন ঝুঁকির মধ্যে থাকে,
তারপরও সে মা হওয়ার জন্য সেই ঝুঁকি নেয়।
তাহলে বুঝুন, একজন মায়ের শক্তি কতটা!
একজন মায়ের দেহে প্রাণ থাকা অবস্থায় সে তার সন্তানকে রক্ষা করতে থাকে—
সেটা বলার কিছু নেই।
আমি আশাবাদী ছিলাম, আর আমি সেই মায়েরই প্রতিনিধি,
যে তার সন্তানদের জন্য সব কিছু করতে পারে।
সবার মুখে তখন আনন্দ-ভাসা হাসি।
প্রায় ৫ মিনিট ধরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রাজ এবার ভীষণ সংযতভাবে বলে—
— আপনারা যদি প্রশ্ন শেষ করে থাকেন, তাহলে আমরা এখন যেতে চাই।
এতগুলো অসুস্থ মানুষকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না।
সাংবাদিকরাও সম্মতি জানায়।
এরপর সবাই ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরের দিকে এগিয়ে যায়।
সবাই যখন গৃহপ্রবেশের আনন্দে ব্যস্ত, তখনই হঠাৎ এক সাংবাদিক সাহস করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
স্যার, যারা আপনাদের এত বড় ক্ষতি করতে চেয়েছে, আপনার পরিবারকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল,আপনার অনাগত সন্তান কে পৃথিবীর আলো দেখতে দিতে চাইনি, তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন না?
বেশ কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা।
সবার মুখ থেকে যেনো হাসির আলো মুছে যায়, এক মুহূর্তেই পরিবেশ পাল্টে যায়।
রাজ ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে দাঁড়ায়। চোখ দুটোয় লাল আভা।
তার মুখের চোয়ালে জোর টান।
রাজ বলে—
— Good question. হ্যাঁ, অবশ্যই আমি তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলব।
তারপর পেছন থেকে কয়েক পা এগিয়ে আসে। ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়ায়।
তার মুখে তখন এক অদ্ভুত ‘ডেভিল হাসি’।
চোখে চোখ রাখে ক্যামেরার দিকে। তারপর বলে—
— পেছন থেকে আঘাত না করে পারলে সামনে আসুন।
সম্মানের সাথে আপনাদের জায়গা মতো পৌঁছে দেব—
চিরদিনের মতো। কার পরিবারের দিকে হাত বাড়িয়েছেন তা বুঝিয়ে দিবো।
তারপর আরেকটু ঝুঁকে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে ওঠে—
— Ready হন। অনেক হয়েছে লুকোচুরি। এবার যা হবে সব সামনাসামনি।
এতোদিন ছেড়ে দিয়েছি— কারণ সব ছিল আমার ওপর।
কিন্তু এবার আপনারা হাত দিয়েছেন আমার ‘কলিজায়’।
সেই হাত ভেঙে গুড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমি—
আমি রাজ শিকদার— শান্তি পাব না।
তার কণ্ঠস্বর যেনো হিমশীতল। উপস্থিত সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনে।
তারপর আচমকা ভিন্ন টোনে মুখ তুলে বলে—
— আর হ্যাঁ, কাল দিন পর মানে দু’দিন পর আমার রাজপুত্রদের নামকরণ হবে।
সাথে ৭টা গরু জবাই করে আকীকা হবে।
আপনাদের নিমন্ত্রণ রইল।
আসবেন কিন্ত—
গরু জবাই হবে দিনে… আর রক্ত ঝরবে রাতে।
একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে রাজ হেসে ফেলে।
তবে সে হাসিতে কোনো উষ্ণতা নেই।
সেই শীতল, জ্বালাময়ী হাসি দেখে সংবাদিকরা কেমন কেঁপে ওঠে।
কেউ আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস পায় না।
রাজ ঠান্ডা মুখে বলে—
— আশা করি, আপনাদের কাজ শেষ। এবার আসতে পারেন।
রাজের বলা মাত্রই আশপাশে থাকা রাজের মানুষগুলো সাংবাদিকদের খুব দ্রুত আর শিষ্টতার মধ্য দিয়েই বের করে দেয়।
এরপর সবাই ধীরে ধীরে প্রবেশ করে শিকদার ভোগসরের সেই ঐতিহ্যবাহী বাড়ির ভেতরে।
বিকেল চারটা।
শিকদার বাড়ির নতুন সদস্যদের তখন ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে মেহরিন আর চুমকি।
চুমকি তখন আপন মনে বাবুকে ঘুম পাড়ানোর প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে।
কি যেনো ফিসফিস করে বলছে ছোট্ট বাবুকে—
চুপচাপ শুয়ে থাকো সোনা পাখি টা আমার… চোখ বন্ধ করো, বন্ধ করো সোনা… আমার সোনো বাবু, দুষ্টুমি করলে কিন্ত চুলে তেল দিয়ে একদম তেলের রাজা বানিয়ে দিবো হুম হুম বানিয়ে দিবো। তখন কী হবে বলো তো?? তখন তোমাকে কোন মেয়ে পাত্তা দিবে না… বলবে এ তো তেলের রাজা। তোকন কী হবে আমার সোনা বাচ্চাটার হুম?? কী হবে তখন?? হুম হুম..
তার মুখভঙ্গি, আদর করার ভঙ্গিমা দেখে যেনো মনে হয়,
সে এই শিশুটার জন্মদাত্রী।
মেহরিন মনে মনে ভাবে—
কে বলে মা হওয়ার জন্য সন্তান জন্ম দিতে হয়?
এই চুমকি, যে কিনা নিজের প্রাণ দিয়ে আদর করছে আমার বাচ্চাকে—
সে তো মায়ের চেয়েও বেশি মা।
মেহরিন যতটা না সজাগ
মেহরিন, চুমকির দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে।
চুমকি আপন মনে বকবক করছে বাবুর সাথে, আর তাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে।
মেহরিন চুপচাপ দেখছে, আর ভাবছে…
আচ্ছা, কে বলে— জন্ম না দিলে মা হওয়া যায় না?
এই যে চুমকি, মেহরিনের বাচ্চাটাকে মেহরিনের চেয়েও বেশি আগলে রাখছে।
ওকে কি মা বলা যায় না?
একজন মা যেমন হয়, চুমকি ঠিক তেমনিই হয়ে গেছে।
বাচ্চা জন্ম না দিয়েও, সে যেনো সত্যিকারের মা হয়ে উঠেছে।
বাবু একটু কেঁদে উঠলেই চুমকি সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হয়—কেউ কোলে নিতে আসলেি তার সতর্ক বার্তা মুখো মুখি হতে হয়,
এই যে, হাত ধুয়ে আসো,আগুন আর সেঁক নিয়ে আসো, একদম ঠিক করে কোলে নাও বাবু যেন ব্যথা না পায়।
বাবুকে নিয়ে একদম দর্জাপ না— চুপচাপ বসে থাকো।
মেহরিন নিজেও হয়তো এতটা সতর্ক নয়, যতটা চুমকি।
সবাই নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছে, আর চুমকি শুধু বাচ্চাদের খেয়াল রাখছে।
নিজে কিছু খেয়েছে কি না, সন্দেহ—
অথচ মেহরিনকে একটু পর পর খাইয়ে দিচ্ছে।
তার একটাই কথা,
তুই না খেলে বাচ্চারা খাবে কী করে?
দেখ, আমি বেবিদের ব্যাপারে একদম গাফিলতি সহ্য করবো না।
তুই জন্ম দিয়েছিস বলেই তুই একা ওদের মা না। আমিও ওদের মা।
ভুলে গেছিস নাকি আমাদের ছোটবেলার কথা?
চুক্তি ছিল—
তোর আগে যদি আমার বেবি হয়, তুই হবি ওদের দ্বিতীয় আম্মু।
আর তোর আগে বেবি হলে, আমি হবো ওদের দ্বিতীয় আম্মু।
চোখে-মুখে যুদ্ধ ঘোষণা করে বলে দিল চুমকি,
আমি এক জন মা হয়ে, বাচ্চাদের ব্যাপারে কোনো ফেরফার সহ্য করবো না— বলে দিলাম!
মেহরিন এসব মনে করেই হেসেই যাচ্ছে।
চুমকি ভ্রু কুঁচকে বলে,
কি রে, তোরে কি জিনে ধরলো?
এমন কারণবিহীন হাসছিস কেন?
মেহরিন এবার শব্দ করে হেসে ফেলে।
বাবুকে কোলে নিয়ে এগিয়ে আসে চুমকির পাশে। চুপচাপ বসে পড়ে।
একটু পরে বলে,
না রে, জিনে ধরে নি।
আমি আমার বেয়াইনকে দেখছি।
সে কি সুন্দর!
তার মেয়ের জামাইকে বক বক করে ঘুম পারাচ্ছে!
চুমকি হেসে বলে,
হ্যাঁ, সেই তো!
আমার মতো শাশুড়ি কি এই দুনিয়ায় কেউ পাবে?
যে কিনা তার মেয়ের জামাইকে ছোট থেকে পেলে, পুষে বড় করে,
আর পরে নিজের মেয়েকে তার গলায় ঝুলিয়ে দেবে!
মেহরিন হাসতে হাসতে বলে,
তুই কি আর ভালো হবি না?
চুমকি দাঁত বের করে হেসে বলে,
অপতত তো হতে পারছি না,
তবে হয়ে যাবো— বিশ্বাস কর,
যেদিন আমার মেয়ে আর তোর ছেলের বিয়ে দেব,
সেদিন একেবারে ভালো হয়ে যাব!
দু’জনের হাসাহাসি আর খুনসুটি তখনো চলতে থাকে…
উপরে ঘরে এই নরম কোমল সময় কাটছে। রাজ, রিদ আর শান্ত বেরিয়ে।
আর বাকিরা নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছে—
না না, আড্ডা বললে ভুল হবে তারা রিতি মত ঝগড়া করছে।
তারা দুইটা রাজপুরের নাম ঠিক করছে।
না নাম ঠিক করছে না…
রীতিমতো মারামারি লাগিয়ে দিচ্ছে নাম নিয়ে!
নিচে চেঁচামেচি, হই হট্টগোল হচ্ছে! কেউ কাঁদছে না, চিৎকার করছে!
শিকদার বাড়ির নিচতলায় যেনো রাজপুত্র নামকরণের অনুষ্ঠানে নয়, কেউ যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
মেহরিন শোনে সেই আওয়াজ।
চুমকিকে বলে,
— চল, নিচে যাই। গিয়ে দেখে আসি, কী নিয়ে আবার লাগল!
চুমকি হেসে ফেলে, আর দু’জন বান্ধবী মিলে দু’জন রাজপুত্রকে নিয়ে নিচে নামে।
ওদের নিচে নামতে না নামতেই মালিহা মির্জা আর ফাইজা চৌধুরী চলে আসে।
দু’জনেই ওদের নিয়ে নেয়, নানুদের কুলে।
দু’জন রাজপুত্র তখন নিজ নিজ খেয়ালে হাত-পা ছুঁড়ে খেলছে।
তা দেখে চুমকি আর মেহরিন হেসে ফেলে।
নানুরা নাতিদের নিয়ে চলে যায় রুপা বেগমের রুমের দিকে।
তারপর মেহরিন আর চুমকি এগিয়ে যায় পরিস্থিতি দেখতে।
আর দেখে যা যা বুঝল…
“কেস পুরা যন্ডিস!”
মানে একেবারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে!
একদিকে লামিয়া আর আরশ দাঁড়িয়ে, হাত নেড়ে নেড়ে ঝগড়া করছে।
লামিয়া বলছে,
— আমি যেটা বলেছি, সেটাই হবে!
আরশ বলছে,
— না! আমি যা বলেছি, তাই হবে!
অন্যদিকে রাহি আর রাকিব তো রীতিমতো মারামারির জোগাড়ে।
রাহী বলছে,
— আমি বলেছি মানে, এটায় হবে!
রাকিব বলছে,
— হে! মামা বাড়ির আদর তাই না!
আমি স্বাধীন দেশে থাকি,
আমি ওদের হবু-ফুফা।
তাই আমি যা বলব, তাই!
আরফা আর মাহির তো হাতাহাতিতেই নেমে পড়েছে!
মাহির আরফাকে কিল মেরে বলছে,
— আমার ভাগ্নেদের নাম আমি রাখব!
আর আরফা মাহিরের চুল টেনে বলছে,
— আমি ওর খালামণি + ফুফি।
আমি যা বলব, ওদের নাম তাি হবে!
অন্যদিকে মেহবুবা আর লাবিব দাঁড়িয়ে, মুখোমুখি।
দু’জনেই রাগে ফুসফুস করছে।
হঠাৎ মেহবুবা লাবিবের চুল খামচে ধরে বলে,
— আমি যা বলব, তাই হবে!
লাবিব কিছু না বুঝেই সেও মেহবুবার চুল টেনে ধরে বলে,
— আমি ওর চাচু + আঙ্কল!
আমি ঠিক করব ওদের নাম!
মেহবুবা বলে,
— আমার চুল ছাড়! নইলে মেরে দেব কিন্ত বাঁদর !
লাবিব বলে,
— মেরে দেখাও! আমিও মারব আজ ল্যাদা বাচ্চা, যানো আমি জীম করি?
মেহবুবা বলে,
— তোর জীমের মাইরে লাল সালাম। চুল ছার নয়ত মেরে দেব সত্যি?
লাবিব বলে,
— মেরে…..
এটা বলার সাথে সাথেই—
থাসসসসস!
একটা থাপ্পড়! লাবিবের গালে!
লাবিব কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।
তারপর মেহবুবার দিকে তাকিয়ে কাঁতর গলায় বলে,
— আমি তোমার স্বামী জান…আমি তোমার অর্ধাঙ্গ…আমি তোমার জান, প্রাণ, কলিজা, ফুসফুস, কুসকুস… সব!
আর সেই তুমি কিনা আমাকে মারলে?
Jan… it’s not fair!”
মেহবুবা দু’হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে বলে,
— বেশ করেছি!
আমার মুখের মুখে কথা বলবি আর?
আমি না তোর বউ?
তুই আমার সব কথা না শুনে তর্ক করছিস!
বাঁদর!
লাবিব বলে,
— ল্যাদা বাচ্চাাাাাাাাাাাাাাাা….
মেহবুবা রাগে তাকায়।
লাবিব গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
— কি জোরেই না মারলি!
ল্যাদা বাচ্চা… ইসস!
তোর থাপ্পড় খেয়ে আমার জীবন যৌবন শুকিয়ে কিসমিস হয়ে যাওয়ার জোগাড়!
কিডনি খুইলা গলায় আটকে যাওয়ার জোগাড়! আর Heart গিয়া উঠে বসে পড়েছে আমার মাথায়!
মেহবুবা ফুসফুস করছে রাগে।
চুমকি আর মেহরিন একে অপরের দিকে তাকাল।
এদিকে চুমকি আর মেহরিন একে অপরের দিকে তাকায়।
চারপাশের এই দৃশ্য দেখে হঠাৎ তাদের চোখ গিয়ে পড়ে মেহের-এর ওপর।
সবার যখন যুদ্ধাবস্থা, সবাি যেকানে নাম নিয়ে মারা মারি কিলা কিলী করছে তখন সে এক কোণায় বসে পপকন খাচ্ছে!
আর চোখ গোল করে যুদ্ধ উপভোগ করছে!
মেহরিন চুপিচুপি গিয়ে মেহেরের পাশে বসে পপকন নিয়ে মুখে পুরে।
চুমকিও পেছন পেছন এসে বসে।
তিনজন মিলে লাইভ শো দেখতে দেখতে হঠাৎ মেহরিন বলে উঠল—
— ধুর! মজা পাচ্ছি না! ভালোভাবে মারামারি লাগ তো।
মেহরিনের কথায় সব যুদ্ধরত সদস্য ঘুরে তাকায় তার দিকে।
আর মেহরিন তাদের দেখে বলে—
— আমার দিকে তাকিয়ে কী করো? মারামারি করো ঠিকমতো!
আমরা তো টিকিট কেটে বসে আছি! আরে, ভালো ঝগড়া না হলে মজা কই?
শালার মারামারি ভালো হচ্ছে না দেখে, পপকন খেয়েও মজা পাচ্ছি না।
সবাই তখন একসাথে বলে উঠল—
— “এএএএএএএ!!
মেহরিন তখন পপকন মুখে নিয়ে আয়েশ করে বসে।বলে ওঠে—
— এএএ না… হ্যাঁ নাও, শুরু করো সবাই!
ঠিক তখনই ঘরে প্রবেশ করে রাজ, রিদ আর শান্ত। তারা সবাইকে চুপচাপ দেখে।
রিদ বিড়বিড় করে বলে,
—আবার কোন ড্রামা শুরু করেছে এরা কে জানে…
রাজও একই সুরে বলে,
— কিছু তো একটা হয়েছে দেখ,
সব কয়টার মুখ কেমন যেনো…
মুরগির পশ্চাতের মতো করে রেখেছে!
রিদ হেসে ফেলে।
শান্ত রাজের কথা না বুঝে বলেই ফেলে,
— ভাই, মুরগির পশ্চাত মানে কী?
রাজ শান্তর দিকে ফিরে তাকায়।
রিদ এক গাট্টা মেরে বলে,
— “মুরগির পাছা! শালা..
শান্ত “মুরগির পশ্চাতের” মানে শুনে হঠাৎ সবার মুখের দিকে একবার তাকায়,
তারপর হা হা হি হি করে হেসে ওঠে!
সবার চোখ এবার শান্তর দিকে।
শান্ত হাসি থামাতে পারছে না কিছুতেই।
মাঝখানে চুপচাপ উঠে দাঁড়ায় চুমকি।
শান্তর সামনে গিয়ে গম্ভীর মুখে বলে—
— এমন বেক্কলের মতো দাঁত বের করছো কেন? খুব হাসি বের হচ্ছে মুখ দিয়ে তাই না?
দিবো নাকি, এক গ্লাস‘কোরোলার শরবত’ করে!
শান্তর হাসি মুহূর্তেই থেমে যায়।
সে গলা নামিয়ে বলে,
—প্লিজ না…
আমি আর হাসব না।
তাও ওসব অখাদ্য কুখাদ্য খেতে বলো না…
এই কথা শুনে এবার সবাই একসাথে হেসে ফেলে!
শান্ত সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
— হাসো হাসো…
তোমাদেরই সময়! আমার বউকে তো আর চিনো না, দেখতে এই টুকু হলে কী হবে,
কিন্তু তার অনেক পাওয়ার!
চুমকি ভ্রু কুঁচকে বলে—
— বেশ খয় ফুটেছে মুখে, আনবো নাকি?
শান্ত তখন দু’হাত তুলে বলে—
— মাফ করো ম্যাডাম!
আমার এই মুখে তালা দিলাম।
রাজ তখন গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো,
— সবাই একসাথে এমন মারামারি, ঝগড়া-বিবাদের কারণ কী?
বলতে বলতে সে গিয়ে বসে ।
তার পাশে আয়েশ করে বসে পড়ে রিদ আর শান্ত।একজন কাজের লোক আসে, ওদের হাতে একে একে শরবত দিয়ে যায়।
বাকিরা সবাই এসে রাজের কাছে নালিশ দিতে শুরু করে।
রাজ একমনে শরবত খেতে খেতে সব শুনে।
তারপর এক দমে বলে—
— বুঝলাম, আমার ছেলের সংখ্যা মাত্র দু’জন,
আর তাদের নাম রাখতে গিয়ে এতগুলো জন মারামারি করছে!
এখন কী করা যায় বলো তো?
সবাই তখন চুপচাপ রাজের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাজ মিষ্টি হেসে বলে—
— কারো মারামারি করার দরকার নেই।
আমার বাচ্চাদের মা তো এখন একজন নয়,
দু’জন।
একজন — মেহরিন শিকদার,আমার বউজান।
আরেকজন — আমার বোনু, মানে শান্তোর আতঙ্ক!
চুমকি সঙ্গে সঙ্গে বলে—
— ভাইয়্যা!!”
রাজ হেসে বলে—
— না মানে, শান্তোর বউ!
সবার মুখে তখন খিলখিল হাসি।
রাজ উঠে দাঁড়িয়ে বলে—
— তাহলে বাচ্চাদের নাম রাখার দায়িত্বটা আমরা ওদের মায়েদের ওপরেই রাখি নাকি?
সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তারপর একসাথে বলে উঠে—
— হেহেহে… ঠিক ঠিক!!
মেহরিন আর চুমকি একে অপরের দিকে তাকায়,
তারপর একসাথে বলে—
— “না-আআআআ!!”
সবাই এবার ওদের দিকেই তাকায়।
মেহরিন আর চুমকি একসাথে বলে—
—ওদের নাম রাখবে কোনো হুজুর!
বলা শেষেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে!
দু’জনের কথা যে এক দিকেি গড়াবে,
তা ওরা নিজেরাও ভাবে নি!
ওদের কথার মাঝেই রূপা বেগম এসে দাঁড়ান।
ওদের কথা শুনে হাসতে হাসতে বলেন—
— একদম ঠিক বলেছো তোমরা।
নাম রাখা উচিত কোনো হুজুরকে দিয়ে।
সবাই মুখে তখন হাসি।
সবার প্রস্তাবটাই এবার সবাই পছন্দ করলো।
এত হট্টগোলের পরে যেনো একটুখানি প্রশান্তির বাতাস বইলো।
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ।
সবাই যার যার রুমে চলে গেছে।
চুমকি কিছুক্ষণ আগেই নিজের রুমে গেছে,
না সে যেতে চাইনি শান্ত রীতিমতো টেনে নিয়েছে তাকে।
বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেছে।
মেহরিন বাচ্চাদের কাপড় গোছাচ্ছে।
রাজ সবে মাত্র গোসল সেরে বেড়িয়েছে,
পরনে সেই আগের মতো— কেবল একটা টাওজার।
মেহরিন এক নজর রাজের দিকে চেয়ে থেকে বলে—
—আপনার কি একটুও লজ্জা করে না?
রাজ মাথা মুছতে মুছতে বলে—
— আমার লজ্জা কবে ছিল বলো তো?
মেহরিন হতাশ হয়, তারপর আবার বলে—
—আপনি এখন দুই বাচ্চার বাবা। ভুলে গেছেন নাকি?
রাজ স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়—
— ভুলে যাবো কেন? এই তো সামনেই শুয়ে আছে আমার দুই রাজপুত্র।
মেহরিন দাঁত কিড়মিড় করে বলে—
— তাহলে এখনও এমন উদাম গায়ে আমার সামনে ঘোরাঘুরি করেন কেন?
রাজ তোয়ালেটা ছুঁড়ে মারে এক পাশে, মেহরিনের কাছে গিয়ে বলে—
— কেন, আমাকে এভাবে দেখলে কি তোমার কিছু কিছু হয়?
মেহরিন রাজের চোখে চোখ রেখে বলে—
— আপনার লজ্জা করে না?
দুই বাচ্চার মাকে আপনি seduce করছেন!
রাজ বুক ফুলিয়ে বলে—
— আমি কি পরনারীকে কিছু বলেছি নাকি?
আমার যা দেখার, সবই তো আমার বউ।যা করার তাই করার সবই আমার বউকে।
যা খাওয়ার,তাও আমার বউ।
মেহরিন চোখ বড় বড় করে বলে—
— মানে?
রাজ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে—
— ছিঃ বউ,
তোমার মাইন্ড এত খারাপ কেন?
আমি তো আমাকে দেখার কথা বলেছি,
আর চুমু খাওয়ার কথা বলেছি।
মেহরিন দিক-বিদিক তাকিয়ে বলে—
—আপনি খুব নির্লজ্জ।
রাজ হাসে—
— তা শুধুই একজনের কাছেই,
তোমার কাছেই শুধু আমি এমন।
বাকি সবার কাছে আমি এখনো সৎ পুরুষ।
এই বলে মেহরিনের গালে একটা চুমু খায়।
মেহরিন বলে—
— উম্ম… মরন-সরণ তো দেখি!
বাচ্চারা উঠে যাবে।
রাজ কাতর সুরে বলে—
—বউ আমার না বউ…বউ পাচ্ছে!
মেহরিন বলে—
— এখনো আপনার ‘বউ বউ’ পায়?
আমি এখন দুই বাচ্চার মা।
আগের মতো সুন্দরীও না। আগের থেকে মোটা হয়ে গেছি আমি এখন আর…
হঠাৎ করেই রাজ মেহরিনকে শক্ত করে ধরে বলে,
— নেক্সট টাইম যেন এমন কথা তোমার মুখে না শুনি।
তুমি মোটা হও বা চিকন,
তাতে আমার কিছু আসে যায় না।
তুমি যখন বুড়ি হয়ে যাবে, তোমার চামেড়া ঝুলে যাবে,তখনো আমি তোমাকে সেই প্রথম দিনের মতোই ভালোবাসবো।
এখন যতটা ভালোবাসি,
ঠিক তার থেকেও বেশি ভালোবাসব। বুঝলে?
মেহরিনের চোখে তখন আনন্দ অশ্রু।
রাজ ধীরে ধীরে ওকে ছেড়ে দেয়,
গভীর শ্বাস নেয় দুবার, তারপর বলে—
—আর কখনো এমন কথা বলবে না।
এই বলে সে সরে যায় আর শার্ট বের করে পরতে শুরু করে।
মেহরিন বুঝে, তার বলা একটা কথায় রাজ— তার ‘কবি সাহেব’— একটু না বেশ অনেক টা অভিমান করেছে।
সে চুপিচুপি পেছন থেকে গিয়ে রাজকে জড়িয়ে ধরে। নরম গলায় বলে,
— সরি কবি সাহেব… আমি ওভাবে বলতে চাইনি।
রাজ হালকা হেসে পেছন ফিরে মেহরিনকে সামনে নিয়ে আসে। চোখে চোখ রেখে বলে,
— আর বলবে না তো?
মেহরিন দুদিকে মাথা নাড়ে,
— একদমই না।
রাজ হেসে মেহরিনের কপালে একটা মৃদু চুমু খায়—
সেই চিরচেনা, স্নেহময়, প্রেমমাখা চুমু।
আর মেহরিন চোখ বন্ধ করে অনুভব করে,
জীবনের যত ব্যস্ততা, অভিমান, কষ্ট—
সবকিছুর ঔষধ যেনো এই একটামাত্র চুমু।
মেহরিন রাজের শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে,
মেহরিন হঠাৎ বলে,
আপনি আমাকে এত ভালো কেনো বাসেন কবি সাহেব?
রাজ মিষ্টি হেসে মেহরিনের চুল গুলো গুছিয়ে দিয়ে বলে,
ভালোবাসতে কোনো কারণ লাগে না-লাগে না কোনো স্বার্থ।
যে ভালোবাসায় কারণ থাকে,যে ভালোবাসায় শর্ত থাকে—
তা আর যায় হোক ভালোবাসা নয়,
তা তখন সৌদা হয়ে যায়।
ভালোবাসা এমন এক অনুভূতি—
যেটা আপনা-আপনি আসে। তার জন্য ব্যাখ্যা খুঁজতে হয় না,
তার পেছনে যুক্তি চলে না।
ভালোবাসা গরিব বা ধনী দেখে হয় না,না হয় শিক্ষিত বা অশিক্ষিত দেখে,আর না হয় রূপ বা গুণ বিচার করে।
ভালোবাসা হয় মনের এক বিশাল কোন থেকে।
আর সেই মনের কোনো কোণায়
যদি কেউ দাগ কেটে যায়—তাকে ভালো না বেসে থাকা যায় না।
তুমি আমার স্ত্রী,
আমার জীবন, আমার আত্মার সাথী।
তুমি এমন একজন—
যাকে আমার হৃদয়ের বাঁকা হাড় দিয়ে গড়া হয়েছে…
শুধুই আমার জন্য।
তোমাকে তো আমি ভালোবাসি না।
আমি ভালোবাসি আমার সেই ‘আমি’কে—
যে আমি, তোমার ভেতরে বাস করে।
তুমি এখন আর ‘তুমি’ নও,
তুমি মিশে গেছো আমার অস্তিত্বে।
তুমি জড়িয়ে আছো আমার শ্বাসপ্রশ্বাসে।
তবে বলো…
আমি কি তোমাকে ভালোবাসি?
নাকি ভালোবাসি নিজেকেই—
কারণ তুমি তো এখন আমি।
মানুষ যেমন অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে পারে না,
আমিও ঠিক তেমনই—
আমিও তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।
হ্যাঁ মানছি,
বাঁচতে হলে অক্সিজেন লাগে।
আমারও লাগে।
কিন্তু অক্সিজেনের সঙ্গে যদি তুমি না থাকো—
তাহলে আমি নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যাই।
আর তুমি তো জানো,
নিঃশ্বাস না নিলে মানুষের মৃত্যু অনিবার্য।
ঠিক তেমনই—
তুমি না থাকলে, আমার মৃত্যুও অনিবার্য।
ভালোবাসি, বউজন।
কারণে, অকারণে,
ভালোবাসি আমার আরিওনাকে…
ভালোবাসি আমার Moonbem কে..
ভালোবাসি শুধু ভালোবাসি আর ভালোবাসি আমার বউজানকে।
ভালোবাসি আমার দুই রাজপুত্রের মা আমার মহারানীকে।
মেহরিন হেসে জড়িয়ে ধরে রাজকে।
তারপর বলে,
ইসসস আমার বরটা আমাকে কত্ত ভালোবাসে।আমিও আমার বরকে এত এত এতগুলা ভালোবাসি। ভালোবাসি আমার বাচ্চার বাবাকে।
ভালোবাসি আমার কবি সাহেব কে।
ভালোবাসি আমার ভাই বোনদের দুলাভাইকে।
ভালোবাসি আমার প্রানের স্বামীকে।
ভালোবাসি তাকে যার জন্য আমার হৃদয়ের পুষ্প ফোটে।
ভালোবাসি তাকে যাকে এক নজর দেখার জন্য চাতক পাখির মতো ছটফট করে আমার এই মন।
রাজ হেসে বলে এত ভালোবাসা রাখো কই??
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬২
মেহরিন হেসে বলে বালিশের নিচে।
রাজ এবার শব্দ করে হেসে ফেলে।
তখনই বাচ্চারা এক সাথে কেঁদে উঠে।
রাজ মেহরিনের দিকে তাকায়, মেহেরিন হেসে ফেলে, রাজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
তোরা আমার প্রেমে বাগড়া দিচ্ছিস বাপ! এটা কি ঠিক বল??