মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭০
মির্জা সূচনা
“ও মা গো… আমার কোমর! আহহ…
আমার মা… মা… মাথা”
মাথায় আঘাত লাগার কারণে, কথা শেষ করার আগেই আরফা অচেতন।
ওই যে একটা কথা আছে না,
ওভাগা যেদিকে যায়, সাগর সেদিকেই শুকায়!
আরফারও হয়েছে তাই।
বেচারির মন ভাগা দুঃখে,
বেছে নিয়েছিল আত্মহত্যার পথ।
কিন্তু আল্লাহ তো সেরা পরিকল্পনাকারী,
তিনি যা আমাদের ভাগ্যে লিখে রেখেছেন তাই হবে—
আমাদের কি সেই পরিকল্পনাকে ঠেকানোর সাধ্য আছে?
তাই তো,
যেই ওড়না দিয়ে নিজেকে শেষ করতে চেয়েছিল আরফা,
সেই ওড়নাটাই ছিঁড়ে পরে গেল।
কোমর আর মাথায় আঘাত পেয়ে পড়ে যায় জ্ঞান হারায় আরফা।
জীবনে কিছু মুহূর্ত আসে,
যেখানে ভালো-মন্দের তফাৎ বোঝা না মানুষ তাই ভুল পথে পা বাড়ায়।
আরফাও নিয়েছিল সেই ভুল পদক্ষেপ।
আল্লাহর দেয়া এই জীবন —
চলে তারই ইশারায়।
কাউকে তিনি ব্যর্থ করেন না,
আমরাই মাঝে মাঝে ব্যর্থ হয়ে পড়ি।
আরফা শুধু একজনের প্রতারকের ভালোবাসায় ঠকে গিয়ে সে ভুলে গিয়েছিল —
তার বাবা, মা, ভাই, আত্মীয়–স্বজন —
সবাই ওকে কত ভালোবাসে।
বাবা চোখে হারাই আরফাকে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মা তো রীতিমতো কলিজাই আগেই রাখে,
ভাই তো আরফার নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত থাকে সর্বদা …
কিন্তু, এসব একবারও মনে পড়েনি সেই নির্বোধ মেয়েটির।
কিন্তু দোষ কি শুধু আরফার?
আমরা মানুষ, বড় বেশি আবেগপ্রবণ।
কেউ একটু কেয়ার করলে, ভালোবাসা দেখালে,
আমরা তাকে ঘিরেই সব স্বপ্ন বুনে ফেলি।
সেই মানুষ ছাড়া আর কিছুই দেখি না।
ভুলে যাই,
আমরা যতটা না কাউকে ভালোবাসি,
তার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসে আমাদের পরিবার —
বাবা, মা, ভাই, বোন আমাদেরকে।
আর এই সবাইকে ছাপিয়ে —
আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন আল্লাহ।
তিনি ভালোবেসে আমাদের সৃষ্টি করেছেন,
এই সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন,
তাঁরই দেয়া এই জীবন আমরা ছোট বড় কত ভুল করি উনি ঠিক মাফ করে দেন।
আমরা জীবন নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়ি,
যে ভুলেই যাই কেন এসেছি এই দুনিয়ায়।
আসল কাজ কী আমাদের।
আমরা ভুলে যাই,
এই পৃথিবীতে আমরা ক্ষণিকের অতিথি।
আমাদের চিরস্থায়ী ঠিকানা অন্য কোথাও।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুন,
আর তাঁর পথেই ফিরে আসার তৌফিক দান করুক।
আরফার ঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল মেহরিন।
বাচ্চাদের জন্য গরম পানি নিতে এসেছিল।
হঠাৎ শুনতে পায় আরফার ঘর থেকে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ।
দৌড়ে যায় দরজার সামনে।
দরজা ভিতর থেকে বন্ধ।
মেহরিনের বুকটা ধক করে ওঠে।
কী করবে বুঝতে পারে না।
ভেতরের অবস্থা না জেনে কাউকে ডাকাও অযৌক্তিক মনে হচ্ছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
তারপর নিজের চুল থেকে কালো ক্লিপটা খুলে তার সাহায্যে দরজার ছিটকিনি খুলে ভিতরে ঢোকে।
আরফাকে পড়ে থাকতে দেখে, বুকটা মোছরে উঠে।
চিৎকার করতে গিয়ে নিজেকে সামলে নেয়।
দরজা হালকা লাগিয়ে ওর কাছে যায়।
ওয়াশরুম থেকে একটু পানি এনে ছিটিয়ে দেয় মুখে।
পানির গ্লাসটা পাশে রেখে,
আরফার মাথা কোলে তুলে নেয় মেহরিন।
হালকা হাতে গাল চােপড়ে ডাকে—
আরফু! বোন…চোখ খুল… কী হয়েছে তোর? পড়লি কী করে?
কিছুক্ষণ পর ধীরে ধীরে চোখ মেলে আরফা।
কোমরে আর মাথায় ব্যথা অনুভব করে।
চোখের সামনে প্রিয় মুখ দেখে মুখে হালকা হাসি ফুটে ওঠে।
– মেহু আপু!
– হে বোন! কী হয়েছে তোর? পড়লি কী করে? বেশি ব্যথা পেয়েছিস?
আরফা কোনো কথা না বলে মেহরিনের পেট জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে।
মেহরিন অবাক হয় ভারী —
কিন্তু কিছু বলে না।
আগলে নেয় বোনকে, মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
কি হইছে? মন খারাপ? কেউ কিছু বলেছে?
নাকি শুভ’র সাথে ঝগড়া হইছে?
শুভ নামটা শুনতেই আরফা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
মেহরিন বুঝে যায় — শুভকে নিয়েই কিছু একটা হয়েছে।
সে আর কিছু না বলে আরফাকে সময় দেয় — নিজেকে সামলানোর।
মিনিট দশ পার হয়,
কিন্তু আরফার কান্না থামার নাম নেই।
মেহরিনও বিরক্তিহীনভাবে পাশে বসে থাকে।
তবে মেহরিন বিরক্ত না হলেও, তার স্বামী রাজ শিকদার ঠিকই বিরক্ত হয়ে যায়।
২০ মিনিট ধরে বউকে খুঁজে বের করতে করতে, এক বাড়ির মধ্যেই কিন্তু তার বউ তার সাথে নেই এটা কি মানা যায়? না কোনভাবেই মানা যায় না তাই তো সে হাজির হয়।
আরফার ঘরে মেহরিনকে দেখে কিছু বলতে যায়,
কিন্তু মেহরিন তাকিয়ে ইশারায় চুপ থাকতে বলে।
রাজের ভ্রু কুঁচকে যায়।
সে ইশারায়ই জানতে চায়, কি হয়েছে?
মেহরিন মাথা নাড়ে— জানি না।
রাজ জিজ্ঞেস করে, তুমি আসবে না?
মেহরিন না বলে, আপনি যান, আমি একটু থাকি।
রাজ কিছু না বলেই, ইচ্ছা না থাকলেও, চলে যায়।
আরও ৫ মিনিট পরে আরফার কান্না ধীরে ধীরে থামে।
মেহরিন এবার মুখ খুলে —
আর কত কাঁদবি! এবার থাম!
আমার জামাটা তো নাকের পানি চোখের পানিতে শেষ করে দিলি!
আরফা হাসতে হাসতে কাঁদে,
মেহরিনও হেসে ওঠে।
আরফা উঠে বসে — কিন্তু কোমরে ব্যথা পায়।
মেহরিন দেখতে পায়, আরফার কপালের এক কোনা ফুলে গেছে।
বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে—
কি রে! তোর কপালে তো? দারা! আমি বরফ আনছি!
আরফা না করলেও মেহরিন শোনে না।
বেরিয়ে আসে, বাইরে দেখে রাজ দাঁড়িয়ে।
মেহরিন হঠাৎ নিঃশ্বাস ছাড়ে —
কি করবে সে! এই বউ পাগল জামাই নিয়ে!
সে তাড়াতাড়ি নিচে যেতে যেতে বলে—
আপনি লাবিবার ঘরে যান।
বাচ্চাদের চুমকি দেখবে।
আমি একটু আরফার কাছে থাকি।
তার হয়তো কিছু হয়েছে।
রাজ কিছু না বলে চলে যায়।
সে জানে, সময় হলে মেহরিন নিজেই সব বলবে।
মেহরিন বরফ নেওয়ার আগে চুমকিকে বলে—
বাচ্চাদের একটু দেখ আমি আরফার রুমে যাচ্ছি।
চুমকি একা না সাথে রাহিও যায় বাচ্চাদের কাছে।
বাচ্চাদের দায়িত্ব চুমকির কাছে দিয়ে মেহরিন বরফ নিয়ে আবার যায় আরফার ঘরে।
দরজা লাগিয়ে, বিছানায় উঠে বসে আরফার কপালে বরফ দিতে দিতে বলে—
কি হইসে? বলতো! ব্যথা পাইলি কিভাবে?
আরফা কান্না ভুলে ভাবে, সে ব্যথা পেল কিভাবে? মনে মনে বলে,
আমি বিছানা থেকে উঠলাম।
ওড়নাটা ফ্যানে আটকালাম,
উপর পাশটা গলায় দিলাম…
আর তখনই পড়ে গেলাম।
এই পর্যন্ত বলতেই চোখ বড় বড় করে তাকায় আরফা।
মেহরিন ঘাবরে যায় আরফা এমন করাই—
কি রে? এমন করে তাকাচ্ছিস কেন? কি হইছে তোর?
আরফা কিছু না বলে নিচে নেমে ওড়নাটা তুলে সামনে ধরে।
দেখে — ওড়না দুই ভাগ হয়ে গেছে।
ঠিক পুরোটা না, একটু লেগে আছে।
আরফা রেগে গজগজ করতে করতে বলে—
দেখলে দেখলে!
ওই বইড়া বেটা সালা মনসুর আলী আমায় একটা পচা জামা ধরিয়ে দিছে!
জানো, এই থ্রিপিস দেখেই আমার মন বলছিল — ভালো হবে না।
কিন্তু সালা ওমন গলা বাজি করে কইলো,
এইটা নাকি ইন্ডিয়ার মাল।
একদম সলিড।
রংও উঠবে না।
আর দুইজন ধরে টানাটানি করলেও ছিঁড়বে না।
আমি নাকি এই ওড়না দিয়া দোলনা বানিয়ে চড়তে পারব!
সালার পুত!
আমায় কি বোকা বানাইলো!
আমি আজ ওই বুটিকেই আগুন লাগায়া দিমু!
মেহরিন কিছু না বুঝে,শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আরফার দিকে।
আরফা মেহরিনের দিকে তাকায়,
কিছু একটা ভাবে — মেহরিনের কাছে আসে।
হাত ধরে বলে—
এই মেহু আপু… চল।
মেহরিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে—
কোথায়?
আরফা মেহরিনকে টানতে টানতে বলে—
ওই বুইড়া সালারে মারতে!
মেহরিন বলে—
কিন্তু কেন? সে কি করছে?
আরফা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে—
সালা মিথ্যা কথা বলে আমার কাছে থ্রিপিস বিক্রি করছে!
মেহরিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে—
কেন থ্রিপিসের কি রঙ উঠেছে? নাকি কোথাও ছিঁড়া?
আরফা ওড়না এনে মেহরিনকে দেখিয়ে বলে—
এই দেখো!
ওড়নাটা দুইভাগ হয়ে গেছে — পুরোটা না, একটু লেগে আছে শুধু।
মেহরিন বলে—
এটা কি কেনার সময় এমন ছিল? তুই দেখিসনি?
আরফা মুখ দিয়ে “চ!” উচ্চারণ করে বলে—
না রে! ওই সালা বুইড়া খাটাইসে!
বলে এইটা খুব মজবুত —
এই দিয়া নাকি দোলনা চড়লেও কিছু হবে না!
কিন্তু দেখলি তো — ছিঁড়ে গেছে!
মেহরিন ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে—
কিন্ত ছিঁড়ল কিভাবে?
আরফা রাগে জ্বলে উঠে বলে—
আর বলিস না!
আমি ফ্যানের সাথে বেঁধে গলায় দিয়া ঝুলতে গেছিলাম। ওমনি ছিঁড়ে গ্যালো!
আর আমি নিচে পড়ে গেলাম।
এই দ্যাখ! আমার মাথা ও কোমর ফেটে গেছে!
জামাটা একটু তুলে কোমর দেখায়,এ দেখো আমার শিলা কি জাবানীর মত এত সুন্দর কোমরটাও ভেঙে যাচ্ছিলো আর একটুর জন্য
আর কপালও ফেটেছে — যেখানটায় তুমি বরফ দিছো!
ইস! তুমি ভাবতে পারছো?
আমি মরতে গিয়ে, না মরে, উল্টো পড়ে গিয়ে এমন সিচুয়েশন তৈরি হলো!
আমার যদি কবর ভেঙে যেত বাবা মাথা ফেটে যেত?
তুমি বলো — এর দোষ কার?
বলো — ওই সালা বুইড়া মনসুর আলীর না?
এই পর্যন্ত বলতেই আরফা হঠাৎ মেহরিনের দিকে তাকায় —
দেখে, সে রাগে কানমুখ লাল করে দাঁড়িয়ে আছে।
বুকের ওপর দুই হাত বাজ করে রেখেছে।
তা দেখে আরফা জিব কাটে বোঝে —
সে বোধহয় কিছু এমন বলে ফেলেছে,
যেটা ওর বলা উচিত ছিল না।
আরফা গলা নামিয়ে, কচ্ছপের মতো ধীরে ধীরে মেহরিনের কাছে যায়।
ছোট বাচ্চাদের মতো মেহরিনের জামা ধরে বলে
মেহু আপু…
মেহরিন কড়া চোখে তাকিয়ে থাকে।
আরফা একদম কাঁদার মতো মুখ করে —
তখনই ঘর কাপিয়ে হেসে উঠে মেহরিন!
হাসতে হাসতে বিছানায় পড়ে যায়।
আবার উঠে, ওড়নাটা হাতে নিয়ে হাসতে থাকে!
এক সময় আরফাও হাসতে শুরু করে।
ধীরে ধীরে সেই হাসি উচ্ছ্বাসে পরিণত হয়।
মেহরিনের চোখে পানি চলে আসে হাসতে হাসতে।
সে উঠে এসে আরফাকে জড়িয়ে ধরে —
আর অশ্রুজল মিশে যায় হাসিতে…
হাসতে হাসতে হঠাৎ—
ঠাসসস!!
ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটলো যে আরফা কিছু বুঝে ওঠার অবকাশই পেলোনা।
আরফা গালে হাত দিয়ে, ভ্যাবাচ্যাকা চোখে তাকিয়ে আছে মেহরিনের দিকে।
হ্যাঁ, মেহরিনই থাপ্পড় মেরেছে আরফাকে!
আরফার অপর গালে আবার একটা থাপ্পড় পড়ে।
আরফা কান্নাজড়ানো গলায় বলে—
ইস্! এত জোরে কেউ মারে?
মেহরিনের হাসিখুশি মুখটা হঠাৎই গম্ভীর হয়ে যায়।
আরও একটা থাপ্পড় দিয়ে বলে—
তোর এত বড় সাহস! তুই আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলি? ছিঃ.. তুই আমার বোন! এটা ভাবতেই আমার গা গুলিয়ে যাচ্ছে। কী এমন হয়েছে, যে তুই ফুপি, ফুপা, আর আরশ ভাইয়ের কথা ভুলে মরতে গেলি? বল, জবাব দে! কি হলো চুপ করে আছিস কেন? জবাব দে?
আরফা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মেহরিনের পায়ের কাছে পড়ে যায়।
মেহরিন তাড়াতাড়ি তুলে নেয়, একটু জোরেই বলে—
Behave yourself Arfa! কী সমস্যা তোর? এমন কেন করলি তুই? আমি বুঝতে পারছি কিছু একটা ঘটেছে, কিছু না, খুব বড় কিছু। যাতে তুই গভীরভাবে আঘাত পেয়েছিস, তবুও… তুই এমন একটা সিদ্ধান্ত কী করে নিতে পারিস তুই? তোর মতো একজন এডাল মেয়ে কী করে এত হীনবুদ্ধিতার পরিচয় দিলি?
আরফা জাপটে ধরে মেহরিনকে।
মেহরিন মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে—
কি হয়েছে বল, আপু কে বল, আপু তো আছি। সব ঠিক করে দিব ইন-শা-আল্লাহ। বল, কি হয়েছে?
আরফা একে একে সব খুলে বলে মেহরিনকে।
সব শুনে মেহরিনের মাথা গরম হয়ে যায়।
চোখে রক্ত নামার উপক্রম, রাগে সারা শরীর কাঁপছে।
প্রতারক ও বিশ্বাসঘাতকতা সে সহ্য করতে পারে না!
সে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরফাকে, আর খুব শান্ত কন্ঠে বলল—
তুই আল্লাহ্কে বিশ্বাস করিস, আরফু?
আরফা নাক টেনে বলে—
হ্যাঁ, অবশ্যই আমি আমার রবকে বিশ্বাস করি!
মেহরিন মৃদু হেসে বলে—
তাহলে এটা সবসময় মনে রাখবি, আল্লাহ যা করেন আমাদের ভালোর জন্যই করেন। আমি জানি না শুভ কেন এমন করলো, বা এটা আদৌ সত্যি কিনা… সে যাই হোক, সত্যি হোক বা মিথ্যা, সব কিছুর উপরে আল্লাহ। তিনি আমাদের ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তাই হবে। এটা তো মানুষ না, আল্লাহ ঠিক করবেন কে কার হবে বা কার সাথে কার বিয়ে হবে।
আরফা মাথা নাড়ে সম্মতিতে।
মেহরিন আবার বলে—
শোন, আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে যাকে লিখে রাখেন, তাকেই আমরা পাই। জীবনসঙ্গীর বিষয়টা পুরোপুরি আল্লাহর হাতে। তোর ভাগ্যে যদি শুভ না থাকে, তুই যতই চেষ্ট কর না কেন, কিছুতেই হবে না। আর যদি লেখা থাকে, তবে পৃথিবীর কিছুই আটকাতে পারবে না তোদের এক হতে।
আরফা আবার কেঁদে ফেলে—
এই তো আমি জানি আপু, তবুও মন মানে না। মনটা তো বারবার ওই মিথ্যাবাদী প্রতারক বিশ্বাসঘাতকের জন্যই কাঁদে!
মেহরিন আরফার চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে একখানা চুমু খায়, বলে—
তুই চিন্তা করিস না, আমি খুঁজ নিচ্ছি। তবে কথা দে— যদি শুভ সত্যিই বিয়ে করে ফেলে, তুই তাকে ভুলে যাবি। যত কষ্টই হোক না কেন।তাদের মাঝে কখনো যাবি না।
আগে যাই ছিল, এখন যদি সে বিবাহিত হয়, তাহলে আরেকটা জীবন তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। তোদের দুজনের জন্য ওই মানুষটা শুধু শুধুই কষ্ট পাবে। মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান— এটা জানিস তো?
আরফা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।
মেহরিন আবার চুমু খেয়ে বলে—
আমি জানি তোর মন অশান্ত। একটা কাজ কর— গোসল কর, ওযু করে নামাজে দাঁড়া। দেখবি মন শান্ত হয়ে যাবে। কেঁদে ফেল, আল্লাহর দরবারে কাঁদ। আর যে কাজটা করবি ভাবছিলি, ওটার জন্য ক্ষমা চা। বুঝেছিস?
আরফা মাথা নাড়ে।
মেহরিন কঠোর কণ্ঠে বলে—
আর এমন করবি?
আরফা দুইদিকে মাথা নাড়ে— না!
যা, গোসল কর। সকালে আমরা এ নিয়ে কথা বলব।
মেহরিন চলে যেতে যায়, পেছন থেকে আরফা ডাকে—
মেহু আপু!
মেহরিন দাঁড়ায়।
আরফা দৌড়ে এসে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে বলে—
“You are the best sister in the world!”
মেহরিন হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে, তারপর নিজের রুমে চলে যায়।
আরফা গোসল করে, ওযু করে, জায়নামাজ বিছিয়ে দাঁড়িয়ে যায় আল্লাহর দরবারে।
নিজের সব গুনাহর জন্য কান্নায় ভেঙে পড়ে, ক্ষমা চায়।
এদিকে…
মেহরিন রুমে ঢুকেই দেখে মাহিন শুয়ে আছে তার পাশে রাহি। রাহি গল্প করছে, আর মাহিন খিলখিল করে হাসছে।
চুমকি মাহিমকে কোলে নিয়ে এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করছে— হয়তো মাহিম কান্না করছিল, তাই শান্ত করছে।
মেহরিনকে দেখে চুমকি জিজ্ঞেস করে—
কি হয়েছে বল তো?
মেহরিন মাহিনকে কোলে তুলে নেয়, ফিডিং করাতে করাতে সব খুলে বলে।
সব শুনে রাহি বলে—
আরফা অনেক কষ্ট পেয়েছে, মনের অনেক গভীরে আঘাত পেয়েছে। মনের আঘাত কতটা গভীর হলে শান্তশিষ্ট প্রাণখোলা একজন মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ভাবো একবার!
চুমকি হঠাৎ রেগে ফুসে উঠে—
সব দোষ ওই শালা শুভর!
রাহিও তাল দেয়—
ঠিক বলেছিস চুমকি আপু, সব দোষ ওই বেটার!
মেহরিন শান্ত গলায় বলে—
চিন্তা করিস না। যদি ওই ছেলে দোষী হয়, সে শাস্তি পাবেই। জানিস তো, আমি একবার যদি কাউকে ধরবো বলি, তবে তাকে ছাড়ি না।
রাহি দুষ্টুমি করে বলে—
আর যদি সে ধরা না দেয়?
মেহরিন বাঁকা হেসে বলে—
তাহলে তাকে আর কেউ ধরতে পারবে না। কারন সে এই সুন্দর পৃথিবীতেই আর থাকতে পারবে না।
মেহরিনের কথা শুনে চুমকি আর রাহি হেসে উঠে…
সকাল ৯টা, সবাই বসে আছে খাওয়ার টেবিলে। সবাই নাস্তা করেছে আর গল্প করছে। সবার মুখে হাসি থাকলেও আরফার মুখটা বিষন্ন। তা দেখে মেহরিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সবাই খাচ্ছে আর গল্প করছে।
হঠাৎ এমন সময় আরফার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠে। আরফা অজান্তেই WhatsApp-এ ঢুকে দেখে “শুভ” নামে সেভ করা নম্বর থেকে একটা ছবি এসেছে। কৌতূহল বসত শুভর ইনবক্সে ঢুকে আরফা।
আর খুলে যা দেখে, তা দেখার মতো শক্তি তার নেই।
মেহরিন পরোটা সময় আরফাকে খেয়াল করে, হঠাৎ করেই আরফার চোখে হানা দেয় বিষাদের অশ্রু । এই অবাধ্য অশ্রুর দলেরা আরফার কোনো বাধায় মানে না। তাই আরফা কোনো কথা না বলে খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে দৌড়ে চলে যায় নিজের রুমের দিকে। মেহরিনও সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে যায়, শুধু মেহরিন না, তার পিছে পিছে রাজ, মেহের, রিদ, চুমকি, শান্ত, রাহি, লামিয়া, আরশ সবাই যায়।
কিন্তু তারা গিয়ে দেখে মেহরিনকে জড়িয়ে ধরে আরফা কাঁদছে। আর মেহরিন রাগে ফুসফুস করছে। রাজ গম্ভীর ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে,
কি হয়েছে?
আরশ আর লাবিব এককে অপরের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে, কিছু জানে কি না, কিন্তু ফলাফল শুন্য কেউ কিছু জানে না।
হঠাৎ মেহরিন গর্জে উঠে,
সবার কাছে রেডি হও, আজ আমরা একটা রিসেপশনে যাবো!
সবাই মেহরিনের কথায় একেঅপরের দিকে তাকায়। চুমকি আর রাহি একেঅপরের দিকে তাকায় হয়তো তারা কিছু আচঁ করতে পেরেছে। মেহের বুঝে গুরুতর কিছু একটা হয়েছে, তাই জিজ্ঞেস করে,
কি হয়েছে?
আরও বলে,
রিসেপশন, আমার জানা মতে তো আমাদের পরিচিত কারো বিয়ে হয়নি।
মেহরিন মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলে,
আমরা বিয়ে খেতে নায়, একটা জা*নো*য়ারের বাচ্চাকে শিক্ষা দিতে যাবো।
মেহের বুদ্ধিমান, আরফার কান্না আর মেহরিনের এমন কথায় ও আরফার একটা প্রেমের গুঞ্জন সে শুনেছে এই সব কিছু পাশে পাশে রেখে একে একে দুই করে বোঝে যায়।
মেহের শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
কি করেছে?
মেহরিন আরফার ফোনটা মেহেরের কাছে দেয়। মেহের ফোনের দিকে একবার তাকায়, তো আরেকবার কান্না করতে থাকা আরফার দিকে। আবার তাকায় মেহরিনের দিকে মেহরিনকে চোখের ইশারায় কিছু জিজ্ঞেস করে, মেহরিনও তার উত্তর ইশারাতেই দেয়।
আসল কাহিনি বুঝতে পেরে মেহের ভয়ঙ্কর রাগে গর্জে উঠে বলে,
আরফা, কান্না বন্ধ কর! আমার মেজাজ গরম হলে কিন্তু খবর আছে..
আরফা আরও জোরে কাঁদতে থাকে।
রাজ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।
কাল রাতে এই মেহরিন সব রাজকে বলেছিলো।
রাজ মেহেরের কাছ থেকে ফোনটা নেয়,আর যা দেখে তা….
দেখেই রাজ মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে আর বলে,
লাবিব…..!
লাবিব সঙ্গে সঙ্গে রাজের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
রাজ বলে,
ছেলেদের খবর দে, রেডি থাকতে বল। আমরা বের হবো সবাই।
লাবিব কোন কথা না বলেই সাব্বিরের নম্বরে কল করে বেরিয়ে যায়।
আরশ সবার রাগের কারণ বুঝতে না পারলেও এটা বুঝতে পারে তার বোনকে নিয়ে কিছু হয়েছে। আরশ এগিয়ে আসে, হাত রাখে আরফার মাথায়।
আরফা ভাইয়ের স্নেহের হাত মাথায় পেয়ে মেহরিনকে ছেড়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে, বোনের কান্না মিশ্রিত মুখ দেখে আরশের বুকটা ধক করে উঠে।
আরশ ভয় পায়,কত আদরের এই বোন তার ওর কিছু হলে যে আরশ নিজেই বাঁচবে না। আরশ অস্থির হয়ে উঠে জিজ্ঞেস করে,
কি হয়েছে বোন? কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন? কে কি বলেছে বল ভাইয়াকে? কিছু লাগবে?
ভাইয়ার এমন পাগলামি দেখে আরফা আরও জোরে কাঁদতে থাকে।
আরশ অসহায় হয়ে সবাইকে দেখে।
মেহরিন আরশের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আস্থা দিয়ে বলে,
চিন্তা করো না, কিছু হয়নি। একটু কান্না করতে দাও, হালকা লাগবে।
তখন মেহের খেঁকিয়ে উঠে,
সান্ত্বনা, কিসের সান্তনা হ্যাঁ ?
এই আরফা, কান্না থামা। তুই কেন কাঁদছিস? কান্না তো ও করবে, ওই কু*কু*রের বাচ্চা!
আরশ চিৎকার করে উঠে,
তোরা কি কিছু বলবি আমাকে কী হয়েছে, ও কান্না করেছে কেন? আর ফোনে তারা এমন কী দেখলি যে সবাই রেগে যাচ্ছিস?
মেহরিন রাজকে ইশারা করে,
রাজ আরশ, শান্ত, রিদকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।
হয়তো রাজ সবাইকে বুঝিয়ে বলবে।
মেহরিন আরফার সামনে এসে বলে,
চুপ করবি? তুই কী বোকা আরফু? ও তো তোকে দুর্বল করতে এমন একটা ছবি দিয়েছে, তুইও সেটা জানিস। তারপরও কেন কাঁদছিস?
কেন ভেঙে পড়েছিস বল। ওর মূল উদ্দেশ্য তোকে কষ্ট দেওয়া ভেঙে দেওয়া আর তুই এগুলো জেনেও ওকে সুযোগ করে দিচ্ছিস?
আরফা মনের কষ্ট ও দুঃখে কান্না করতে করতে বলে উঠে,
এটা কি আমার জন্য মেনে নেওয়া খুব সহজ মেহু আপু? আমি যাকে ভালোবাসি, যার সঙ্গে সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না-ভাগাভাগি করেছি, তিন বছর, যার বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর স্বপ্ন দেখেছি, সেই মানুষটাকে আমি আমার মনে করে নিয়েছি।
সে মানুষ এখন অন্য কারো, যার বুকে মাথা রাখার কথা আমার ছিল, সেই বুকে এখন অন্য কেউ মাথা রাখছে। যার সঙ্গে আমার ছোট্ট সংসার করার কথা ছিল, তার সংসার হয়েছে, কিন্তু সেই সংসারে আমি কোথাও নেই।
যে মানুষটাকে ঘিরে আমার এত শত ছোট্ট কাল্পনিক স্বপ্ন ছিল, সেই মানুষের বুকে এখন শুয়ে রয়েছে তার বউ।
আর তা আমাকে দেখতে হচ্ছে। এটা কি আমার জন্য মেনে নেওয়া এতই সহজ?
মেহু আপু, আমার প্রিয় মানুষের বউয়ের বেজা চুল দেখার ক্ষমতা আমার নেই।
আমি কেন এই পৃথিবীতে এমন কোনো মেয়ের এমন শক্তি নেয় যে তার প্রিয় মানুষের বউয়ের বেজা চুল দেখবে?
কতোটা অসহনীয় যন্ত্রণা আমার হচ্ছে সেটা আমি বুঝাতে পারছি না কাউকে।
আমি ভাবতেও পারি না যে, যে মানুষটার সবটা জোরে আমি আমার বিচরন চেয়েছিলাম তার মন ও ঘরে আজ রাজ করছে অন্য নারী। তিন তিন টা বছরে একটু একটু করে বুনা আমার প্রতিটি সপ্ন প্রতিটি আশা ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো একটি দিনের ব্যবদানে এই কষ্ট আমি কাকে দেখাবো বল?
সবাই চুপ করে যায় কারণ সবাই তো ভালোবাসার মানুষকে পেয়ে গেছে, ভালোবাসার মানুষকে অন্যের পাশে দেখা তো তারা কল্পনাও করতে পারে না।
কথা শেষ। আরফা আবার কাঁদতে থাকে।
এটা সত্যি যে যেকোনো মেয়ের কাছে কষ্টসাধ্য যে তার প্রিয় মানুষ অন্য কারো, তার ওপর আবার প্রিয় মানুষের বউয়ের বেজা চুল নিজের চোখে দেখা।
এটা ছোট কোনো বিষয় নয়। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বোধ হয় এমন অবস্থাকে কেন্দ্র করেই হয়।
আহা, কেউ যত্ন করে ভালোবাসে কতো ছোট্ট কাল্পনিক স্বপ্ন নিয়ে কত কল্পনা জল্পনা করে, মনেই একটা ভালোবাসার সংসার গড়ে তুলে, আর কেউ এসে তা এক নিমিষেই টেনে ছিঁড়ে ফেলে নিজের অধিপত্য স্থাপন করে।
কেউ হাজার কেঁদে ও পায় না, আবার কেউ না চাইতে ও পেয়ে যায়—এটা আসলেই ভাগ্যের খেলা।
আরফার কি ছিল না? রূপবতী, গুণবতী।
বাবা-দাদার নাম ডাক জমিদারের নাতনি।
শিক্ষিত, সুন্দরী কোনোদিক দিয়ে তো কম ছিল না।
তবে কেন সে পেল না তার প্রিয় মানুষকে?
অনেক সময় রূপবতী গুণবতী হেরে যায় ভাগ্যেবতীর কাছে।
এটাই চিরন্তন সত্য যে আমাদের ভাগ্যে যা আছে, তাই হবে, ভাগ্যে যে আসার সেই আসবে।
এখন দুপুর ১২টা। সবাই সেজে উঠেছে কালো পোশাকে।
জমিদার বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আছে সাতটা গাড়ি।
সব কাপালরা ম্যাচিং ড্রেস পরে আছে—মেহরিন, রাজ, মেহের, রিদ, চুমকি, শান্ত, আরশ, লামিয়া, লাবিব, মেহবুবা, রাহি, আর আরফা। সবাই একই ড্রেসে। সব কাপলদের মাঝে শুধু রাহি আর আরফা ব্যতিক্রম তাই তাদের দুজনের ড্রেস একদম সেম
তবে রাহি কালো পরেছে আর আরফা পরেছে নীল।
এটা অবশ্য মেহরিনের কথায় হয়েছে,মেহের যখন মেহরিন কে জিজ্ঞেস করেছিল কালো রং কেন?
উত্তরে মেহরিন বলেছিল,
কাল হচ্ছে শোখের প্রতীক। এই যাত্রাটা আমাদের জন্য শুভ হলেও আমাদের আগমন অন্য কারো জন্য অশুভ হবে তাই আমাদের পোষাক হবে কালো। সবাই খুব সুন্দর ভাবে সেজেছে তবে আরফাকে অস্বাভাবিক সুন্দর সাজে সাজিয়েছে।
মেহরিন এমন ভাবে আরফাকে তৈরি করেছে যে একবার দেখলেই যে কেউ প্রেমে পড়বে তার পড়বে বললে ভুল হবে পড়তেই হবে।
আরফার সৌন্দর্য যেন চোখ জ্বলসে যায় কিছু নরবিশ্বাসের সেই সৌন্দর্যে ঝলমল করছে এখন আরফা। মোহিত হওয়ার মতো সুন্দর লাগছে আরফাকে ইস কারো নজর না লাগে আবার। মেহরিন নিজের চোখ থেকে একটু কাজল নিয়ে আরফানের ঘরের পিছনে লাগিয়ে দিল যদিও এগুলো কুসংস্কার তারপরও কেন যেন মেহরিনের একটু এটা করতে ইচ্ছা করলো।
সবাই রেডি এখন বের হওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
মহিন ও মাহিম তার নানী-দাদীর কাছে থাকবে।
যদিও চুমকি যেতে চায়ছিলো না বাচ্চাদের জন্য কিন্ত না চাইলেও মেহরিনের দমকা দমকিতে রেডি হয়ে গেছে।
সবাই একে একে নেমে গাড়িতে উঠে বসে।
রাজ- মেহরিনরা ও রাজের লোকেরা মিলে সাই সাই করে চলে যাচ্ছে পাশের গ্রাম শান্তি নগর, এহসান ভিলায়।
ধুলো উড়িয়ে, সাতটা গাড়ির লম্বা কনভয় এসে থামল পাশের গ্রাম—‘এহসান ভিলা’র সামনে। গেটের কাছে আগে থেকেই রাজের লোক দাঁড়িয়ে ছিল, ভারী চোখে চারপাশে নজর রাখছে। তারা গাড়ির দরজা খুলে দিল, আর একে একে গাড়ি থেকে নামতে লাগল সবাই—পূর্ণ অ্যাটিটিউডে, যেন সিনেমার পর্দা থেকে নেমে এসেছে কতগুলো তারকা।
সবাই নেমে গেলে, শেষ গাড়ি থেকে নামল আরফা—গর্জিয়াস ড্রেস, চোখে সানগ্লাস। দেখে মনে হচ্ছিল নায়িকা-নায়কদের মিলনমেলা চলছে, আর কাউকেই যেন একে অপরের চেয়ে কম লাগছে না। আরফাকে মাঝখানে রেখে, তার চারপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল বাকি সবাই।
রিসেপশনে ঢুকতেই অতিথিদের চোখ বড় হয়ে গেল। নবদম্পতির প্রতি যে মনোযোগ থাকার কথা ছিল, তা চলে গেল মেহরিন ও তার সাথীদের দিকে। ওরা একদম এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল শুভ ও তার স্ত্রীর সামনে—যেখানে তারা বসে ছিল। শুভ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আরফার দিকে, যেন পলক পড়ছে না।
আরফা হেসে রাজ আর মেহরিনের দিকে তাকাল, মেহরিন ও রাজ ও ইশারা করল। তাদের ইশারা পেয়ে আরফার ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি খেলে গেলো। ঠিক তখনই শুভ উঠে দাঁড়িয়ে, অজান্তেই বলে ফেলল,
Wow! You are looking so beautiful…!
আরফা হেসে উত্তর দিল,
— Oh really?
— হুম,” শুভ মাথা নেড়ে বলল।
পাশে ফিসফাস শুরু হয়ে গেল—
নতুন বউটার চেয়ে এই নীল ড্রেস পরা মেয়েটা অনেক সুন্দর, আহা! একদম পুতুলের মতো!
এসব শুনে নতুন বউ মাথা নিচু করে ফেলল।
আরফা আবার সেই বাঁকা হাসি হাসল, তারপর এগিয়ে গিয়ে নতুন বউয়ের মুখটা তুলে বলল,
— বাহ, খুব মিষ্টি তো দেখতে তুমি। ওহ খালি হাতে তো আবার নতুন বউয়ের মুখ দেখতে নেই। এটা নাও।
আরফা একটা বক্স ধরিয়ে দিল নতুন বউয়ের হাতে, মাথায় হাত রেখে বলল,
— ভালো থেকো বোন, ওর যত্ন নিও। সে আমার ভীষণ প্রিয়।
নতুন বউ কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আরফা ঠোঁটে আঙুল দিয়ে থামিয়ে দিল।
— উঁহু, কোনো কথা নয়। একটু ফিসফিস করেই বলল,
নতুন বউদের বেশি কথা বলতে হয় না চুপচাপ থাকতে হয় বুঝলে।
এ কথা বলে আরফা চলে গেল শুভর সামনে—যে এখনও চোখ না সরিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। আরফা হেসে উঠল, হাসিটা ধীরে ধীরে অট্টহাসিতে পরিণত হল। শুভ সেই হাসিতে মুগ্ধ হয়ে সে নিজেও হাসতে লাগল।
হঠাৎ আরফার হাসি থেমে গেল। পুরো হল কাঁপিয়ে, সে এক চড় বসিয়ে দিল শুভর বাঁ গালে! শুভ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
— এটা আমার সাথে প্রতারণা করার জন্য! বলে আরফা আরেকটা মারল ডান গালে
—এটা আমার অনুভূতি নিয়ে খেলা করার জন্য!
শুভর বাবা-মা আর কয়েকজন ছুটে আসতে চাইলো, কিন্তু রাজের লোকেরা তাদের আটকে দিল। আরফা ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে শুভর কানের কাছে ঝুঁকে বলল,
কি ভেবেছিলে? আমি খুব দুর্বল? পাশে কেউ নেই? তুমি জানো না আমি কে… আমি আরফা চৌধুরী—জমিদারের নাতনি, জমিদারের মেয়ে।
আরে তুমি তো আমার লেভেলই নাই,সামান্য একটা বিজনেস ম্যানের ছেলে তুমি আর কোথায় আমি জমিদারের মেয়ে। আমি চাইলে তুমি শুধু কেন তোমার পুরো পরিবারকে ছেলের ভাত খেতে পারি আবার … একটু থেমে মুচকি হাসি দিয়ে আরফা বলে,
আবার চাইলে তোমাদের সবাইকে টপকে ও দিতে পারি।
শুভ মাথা নিচু করে রাখল। আরফা ফিসফিসিয়ে বলল,
— আর একটা কথা শোনবে… আমি গ্যাংস্টার মিস্টার শিকদারের বোন।
এ কথা শুনে শুভর গলা শুকিয়ে গেল। ঠিক তখনই আরফা আরও এক থাপ্পড় মারল, এর পর বাঁ হাতে ধরা সানগ্লাস চোখে পরে, অ্যাটিটিউডের সাথে চুলগুলো পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে চলে আসে—পুরো হলের সামনে শুভকে অপমানিত করে। কিন্তু আফসোস কারো কিছু করার সাধ্য নেয়।
মেহরিনরা দৃশ্যটা দেখছিল আর হাসছিলো, হঠাৎ এক মেয়ে এসে মেহরিনের হাত ধরে ফেলল। মেহরিন তাকাতেই, মেয়েটা ঠোঁটে ঠান্ডা হাসি ফুটিয়ে কিছু না বলে ঠাস করে কোল্ড ড্রিঙ্কস ছুঁড়ে মারল মেহরিনের মুখে।
মেহরিন শান্ত হাসি হেসে পাশে থাকা টিস্যু নিয়ে মুখ মুছে নিল। রাজের ছেলেরা এগিয়ে যেতে চাইলো, কিন্তু মেহরিন হাত তুলে থামিয়ে দিল। মুখ মুছা শেষ করে মেহরিন বলল,
— এর কারণ?
মেয়েটা চিৎকার করে বলল,
— যে মেয়ে আমার ভাইকে থাপ্পড় মেরেছে, তুই তার সাথেই এসেছিস। তার মানে তোকে আর তোর সাথীদের জুতোপেটা করব!
মেহরিন বাঁকা হাসল। চুমকি রেগে উঠল তেরে আসতে চাই,
— তোকে তো আমি…!
কিন্তু লামিয়া আর রাহি চুমকিকে থামিয়ে দিল। মেহরিন ধীরে ধীরে মেয়েটির কাছে গিয়ে, পাশে থাকা টেবিল থেকে গরুর মাংসের বাটি তুলে নিয়ে ঢেলে দিল তার মাথায়! মাংসের ঝোল মুখে-চোখে লাগতেই মেয়েটি চিৎকার করে উঠল।
মেহরিন টিস্যু দিয়ে হাত মুছল ঝোলের বাটি ধরায় তারা আত্মীয় কিছুটা লেগেছে কিনা, তারপর পাশে থাকা ২ লিটারের ৭আপ বোতল খুলে তা ঢেলে দিল মেয়েটার মাথায়। মেয়েটি পালাতে চাইলে, মেহরিন চুলের মুঠি চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলল,
— তোর সাহস দেখে আমি অবাক। আর মানুষ পেলি না লাগার জন্য? শেষে কী না আমার সাথে লাগতে আসলি? আমি লাগলে পারবি তো ওই হেডাম আছে? মানুষ পেটানো আমার পেশা ও নেশা দুইটাই মানুষ বুঝে লেখতে আসবি তো। তুই কি জানিস আমি মানুষ মেরে লবন মরিচ লাগিয়ে দেই?সে যাই হোক পরের বার কারো সাথে লাগতে গেলে মানুষ বুঝে লাগবি সবাই আমার মতো দয়ালু না। আজ নেহাতই মন ভালো বলে ছেড়ে দিলাম।
এ কথা বলে মেহরিন তাকে ছেড়ে দিল।
কিন্তু ঠিক তখনই, ভিড়ের মধ্যে থেকে এক ছেলে এগিয়ে এসে—
ঠাসসসসসস…!
মেহরিনকে এক থাপ্পড় মারল…
মেহরিন কে মারায় মেহের, চুমকি, মেহবুবা, লামিয়া ও রাহি সবাই ক্ষনিকের জন্য অবাক হয়ে যায়।
মেহরিন কি আর চুপ করে থাকার মানুষ! প্রথমেই ওই মেয়েটা কে ওই ছেলের সামনে আরও দু চারটা থাপ্পর মারে। যতটুকু বুঝতে পেরেছি এই ছেলেটা ওই মেয়েটাই কিছু হয়। এর পর এক সঙ্গে তিন-চারটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল সেই ছেলেটার গালে,শুধু তাই নয় সাথে দিল দুই চারটি ঘুষি সবশেষ একদম জায়গা মত মেন পয়েন্টে একটা কিক । ছেলেটা মাটিতে পরে কাতরাতে লাগল।
মেহরিনার এমন পারফরম্যান্সে হাসি ফুটে ওঠে মেহের,রাহে, চুমকি, মেহবুবা ও লামিয়ার মুখে।
ঠিক তখনই রাজ আসে— মেয়েরা কেন বের হচ্ছে না এটা দেখতে এসেছিল সে কিন্ত কেন যেন পৌঁছতে একটু দেরি হয়ে গেলো মনে হচ্ছে। মেহরিনের ঠোঁটে লেগে থাকা রক্ত দেখে রাজের মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। তার দৃষ্টি পড়ল মাটিতে পড়ে থাকা ছেলেটার উপর—এক মুহূর্তে সব বুঝে নিল।
ঝড়ের বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজ সেই ছেলের উপর। মুহূর্তেই ছেলেটার বুকের উপর চেপে বসে একের পর এক ঘুষি মারতে লাগল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ছেলেটার মুখ রক্তাক্ত হয়ে গেল, শ্বাসটা ও নেওয়ার সময় পাচ্ছে না সেি ছেলেটা।
রাজের হাত থামার নাম নেই। তার চোখে আগুন ঝরছে আর-মুখে শুধু একটাই কথা—যে আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছে, তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
রাজের মনে পড়ল—বিয়ের এতগুলো দিন হয়ে গেল, সে নিজে কখনো তার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলেনি। অথচ আজ এক অচেনা মানুষ সাহস দেখিয়েছে! এই হাত না ভাঙা পর্যন্ত শান্তি তার নেই। শুধু হাত নয়—আজ এই ছেলেটা বেঁচেও ফিরবে না, সেটা রাজ নিশ্চিত করে ফেলেছে।
রিদ, শান্ত ও আরুশ—তিনজন মিলে অনেক কষ্টে রাজকে টেনে তুলল। কিন্তু তখনও রাজ গর্জে উঠল—
You bastard! তোর সাহস কী করে হয় রাজ শিকদারের স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার!
ঠিক তখন লাবিব ছুটে আসে আর সব কিছু বুঝতেই সেই ছেলেটাকে লাথি-ঘুষি মারতে শুরু করল। গর্জে উঠে বলে,
কুকুরের বাচ্চা! মানুষ চিনিস না? কার গায়ে হাত দিলি ভাবিস নি? জীবনের মায়া নেই তোর! এই বাস্টার্ড কার গায়ে হাত দিয়েছিস তুই?
সাব্বির এসে লাবিবকে জাপটে ধরল, আর মেহবুব লাবিবকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। রাজ বলল সাব্বিরকে,
—সাব্বির, আমি এই জা*নো*য়ারের বাচ্চাটাকে গুদামে চাই।
— Yes, Sir. — সাব্বির উত্তর দিল।
রাজ শেষবারের মতো এক ঝাড়া মেরে নিজের শরীর যেনো ধুলো ঝাড়ল, তারপর মেহরিনের কাছে গিয়ে তার ঠোঁটের রক্ত মুছে দিল। গর্জে উঠল,
— ফার্স্ট এইড বক্স।
রাজের লোক দৌড়ে এসে হাতে ধরিয়ে দিল। সেখানেই দাঁড়িয়ে রাজ মেহরিনের ঠোঁট পরিষ্কার করে একটা ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিল। মেহরিন হাসে।
চুমকি আর রাহি মুখ ফসকে বলে উঠল—
— “How romantic!”
সবাই হেসে উঠল, শুধু রাজ আর লাবিব ছাড়া। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সাব্বির সেই ছেলেটাকে আর তার সাথে আসা মেয়েটিকে তুলে নিয়ে গেল। কেউ কিছু বলা বা করার সাহস পেল না।
শুভর বাবা পুলিশ ডাকার ভয় দেখিয়ে নানা রকম কথা বলল। সব শোনার পর রাজ শুধু ঠান্ডা গলায় বলল,
—তোরা আমার কোন বাল ছিঁড়তে পারিস, ছিঁড়ে দেখাস। ব্যাপারটা আমার দিকে গেলে আমি ছেড়ে দিতাম। কিন্তু এটা আমার স্ত্রী আর বোনের ব্যাপার—এতে no compromise.
কথা শেষ করেই রাজ এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। সবাইকে নিয়ে মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে সেই জায়গা ত্যাগ করল।
রাজরা চলে গেছে—এমনটা ভাবা ভুল হবে।
সাতটা কালো গাড়ির বহর ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে থামল, এহসান ভিলার থেকে কিছুটা দূরত্বে। যেখানে দাঁড়িয়ে এহসান ভিলার ধ্বংস দেখা যাবে।
এমন একটা অবস্থাতেও রাহি আর লামিয়া দুই বোন তর্ক করছে তর্কের বিষয়বস্তু হলো রাজ এখনই কিছু করবে কি না?
রাহি বলছে, এখন কোন ঝামেলা করবে না।
লামিয়া বলছে, এখানই কিছু হবে।
তাদের তর্ক চলছে।
তবে তাদের বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হয়নি কিছুক্ষণের ভিতরেই —
ঠাসসসসসসসসসসসসসসস….!
একটা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দ যেন পুরো এলাকা কাঁপিয়ে দিল। মুহূর্তেই রিসেপশন পার্টি হয়ে উঠলো মরণ বান, বাতাস জমে গেল, নিস্তব্ধতা নেমে এল।
লামিয়া হাত তালি দিয়ে বলে,
দেখলি আমি বলেছিলাম না এখনই হবে।
রাহি মুখ বার করে রাজকে বলে,
যাও তুমার জন্য হেরে গেলাম।
রাজ দুই বোনের কান্ড দেখে হাসে।
মেহরিন ও মেহের একে উপরের দিকে তাকায় দুজনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কারণ এমন কিছু হবে তা তারা আগে থেকেই ভেবেছিল।
এর পেছনে যে হাত রাজের আছে, তা বোঝা কঠিন নয়—এটা রাজ শিকদারের কাজ।
স্বাভাবিকও বটে—যে জায়গায় রাজ শিকদারের স্ত্রীর রক্ত ঝরেছে, সেই জায়গা সে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে, তাতেই তো তার স্বভাব এটাই স্বাভাবিক নয় কি?
ওই জায়গায় একজনও নির্দোষ মানুষ ছিল না। রাজের লোকেরা আগেই সবাইকে বের করে দিয়েছিল। কারণ শুধু মেহরিনের গায়ে হাত তোলাই নয়, ওই ভিড়ের অনেকেই মেহরিনের দিকে কু-দৃষ্টি দিয়েছিল, বেপরোয়া ভাবে তাকাচ্ছিল যা চোখের এরাই নি রাজের। তাই রাজের তরফ থেকে সামান্য উপহার তাদের জন্য। রাজের বউয়ের দিকে তাকিয়েছে আর রাজ তাদের উপহার দিবে না এটা কি কখনো হয়?
বিস্ফোরণের গর্জন থামতেই রাজ আর লাবিবের মুখে ফুটে উঠল পরিপূর্ণ তৃপ্তির হাসি।
রাজ ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গ মাখিয়ে সিটি বাজাল
রাজ মনে মনে বলে,
আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা তো দূর
কেউ যদি তার দিকে চোখ তোলেও তাকাই,
আমি রাজ শিকদার সেই চোখ উপরে কুকুরকে খাওয়াবো।
সে শুধু আমার। আমার বউয়ের গায়ে হাত দেওয়া ও তার দিকে কুদৃষ্টি দেওয়ার শাস্তি এর থেকেও ভয়াবহ হবে পরেরবার।
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৬৯
যে সীমা অতিক্রম করবে,
সে এই দুনিয়ায় বাঁচার যোগ্য থাকবে না।
কিন্তু মুখে বলে,
চলো, আজ আমরা পার্ক থেকে ঘুরে আসি।
এক কথাতেই সবাই রাজি হয়ে গেল।
তারপর সবাই হই হই করতে করতে রওনা দিল পার্কের পথে…