মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭১
মির্জা সূচনা
৭টি গাড়ি ছুটে চলেছে, ধুলো উড়িয়ে। তবে তার মাঝে ৩টি গাড়ি ছুটছে এঁকে বেঁকে, কে কার আগে যেতে পারে সেই প্রতিযোগিতাতেই। মূলত ৩ গাড়ির রেস হচ্ছে।
কিছুক্ষণ আগে সবাই যে যার মতো, যার যে গাড়িতে ইচ্ছে সেই গাড়িতে উঠে পড়েছে। এখন মূলত কার রেস হচ্ছে—৩ যুবকের। ৩টা গাড়ি ছুটে চলেছে দুরন্ত গতিতে, কে কার আগে যেতে পারে তা নিয়ে এক রণক্ষেত্র শুরু হয়ে গেছে।
এই ৩টি গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে তিন তরুণ—রাজ, লাবিব ও রিদ। এই রেসের সূত্রপাত ঘটেছে মিনিট পাঁচ আগে, যা এখনো চলমান। ৩টি গাড়ি ছুটছে সমান তালে, কেউ কার থেকে কম নয়। লড়াই চলছে হাড্ডাহাড্ডি—একবার রাজ এগিয়ে যাচ্ছে, তো আরেকবার রিদ। আবার ওই দুজনকে পেছনে ফেলে ছুটে চলে লাবিব।
ওরা রেস করে মজা পাচ্ছে, তবে নারীগণ বেশিরভাগই বিরক্ত। তারা এসেছে ঘুরতে, আর এখানে এই তিনজন কি না ছোট বাচ্চাদের মতো খেলায় মেতেছে!
না, আর সহ্য হচ্ছে না—কিছু একটা করতেই হবে। আরও মিনিট দুই দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে নারীগণ।
তিন তরুণের পাশে তিন রমণী—রাজের পাশে বসেছে তার অর্ধাঙ্গিনী, যে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে আর মাঝেমধ্যে রাজের দিকে ‘খেয়ে ফেলা’র মতো নজর দিচ্ছে। রাজ আড়চোখে তা দেখলেও কিছু বলছে না। এখন তার স্ত্রী রাগে আছে, এই সময় কিছু বলা মানেই গরম তেলে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ফ্রাই হওয়া। রাজ এখন সেটা করতে চায় না।
ওদিকে রিদের পাশে বসেছে তার আতঙ্ক, তার নীলয়োনী, তার সহধর্মিণী—যে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, পলক না ফেলে। রিদ জানে, তার বাঘিনী তার দিকেই তাকিয়ে আছে, তাই সে স্ত্রীর দিকে না তাকিয়ে ড্রাইভিংয়েই মন দিচ্ছে।
আর লাবিব? এদিকে ইতিমধ্যে দুই-তিনটা থাপ্পড় ও কিল খেয়ে ফেলেছে সে তার পাশে বসা হবু বউ হাতের। আপাতত মারামারি বন্ধ করে সিটের ওপর দুই পা তুলে বাবু সেজে বসে আছে মেহবুবা।আর তার দিকে চোখ দিয়ে গিলে খাওয়ার মতো লুক নিয়ে বসে আছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
লাবিব জানে, তার কপালে এমন মাইর সারা জীবনই আছে, তাই সে ‘বেহায়ার’ মতো দাঁত বের করে হাসছে আর ড্রাইভ করছে। আর যাই হোক, সবাইকে তো বোঝানো যাবে না যে সে হবু বউয়ের হাতে ওঠতে বসতে কেলানি খায়।
পিছনের গাড়িগুলোতে বাকিরা ওদের মতো আড্ডা দিচ্ছে, আর ওদের রেস উপভোগ করছে। রাহি আর আরফা এরই মধ্যে খাওয়া-দাওয়া শুরু করে দিয়েছে। তারা চকোলেট খাচ্ছে আর কে জিতবে সেই নিয়ে কথা বলছে।
পিছনের সিটে বসা কাপলরা ঝগড়া করছে। এর মধ্যে ঝগড়া করতে করতে কয়েক দফা মারও খেয়ে ফেলেছে আরশ বেচারা। তবুও বেকুবের মতো দাঁত বের করে হাসছে আর তর্ক করছে।
যখন ওদের ঝগড়া একটু বাড়ে, তখন সামনের সিটে বসা রাহি আর আরফা রাগি চোখে তাকায়, তখন একটু কমে।
ওদিকে মেহরিনের তো ধর্য্যের বাঁধ ভাঙে যাচ্ছে—আর পারা যাচ্ছে না। এখন মন-মেজাজ সব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তার প্রধান লক্ষ্য হলো এই রেস থামানো। আর নেওয়া যাচ্ছে না, এতদিন পর একটু ঘুরতে বেরিয়েছে, আর এরা কি না রেস করে মুডটাই নষ্ট করে দিচ্ছে।
না, এর একটা বিহিত এখন হবেই হবে—যেমন ভাবা, তেমন কাজ। মেহরিন নিজের ফোন নিয়ে গার্লস গ্রুপে একটা টেক্সট দিলো, তারপর বাঁকা হাসল। মনে মনে বলল—যেমন কুকুর, তেমন মোগর না হলে চলবে না।
মেহরিন হাসিমুখ মুহূর্তেই গম্ভীর আর রাগি করে রাজের দিকে ফিরে বলল—
এই মুহূর্তে যদি এই রেস বন্ধ না হয়, আমি মেহরিন শিকদার আপনাকে এক ধাক্কা দিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেবো, মিস্টার শিকদার। ইউ নো? আমি যা বলি তা করার ক্ষমতা রাখি।
স্ত্রীর মুখে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কথা শুনে রাজ সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষল। চোখগুলো রসগোল্লার মতো গোল হয়ে গেলো, তারপর পাশে বসা তার অতি প্রিয় নারীর দিকে তাকাল।
যা দেখে মেহরিনের পেট ফেটে হাসি পেলেও সে তা আটকে রাখল। এখন কোনোভাবেই হাসা যাবে না, বাবা! সে যাই হোক, মি. মাফিয়া কি না তার স্ত্রীর সামান্য একটা হুমকিতে থেমে গেল।
এমন টানটান মুহূর্তে গাড়ি থামানো—অবশ্যই থামাবেই বা না কেন! তার স্ত্রী যা জিনিস, দেখা যাবে সত্যিই ধাক্কা মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দেবে। তার স্ত্রী সে তো আর সাধারণ স্ত্রী নয়।
ওদিকে একই সময় ব্রেক কষল রিদ। কারণ? মেহেরের মুখ থেকে শোনা কিছু অপ্রত্যাশিত কথা—যা শুনে তার ভেতর বিষম উঠে গেলো।
দুঃখে কষ্টে রিদ কাতর চোখে তাকাল পাশে বসা প্রিয়তমার দিকে। গাড়ি থামানোর জন্য মেহের রিদকে এমন একটা কথা মনে করিয়ে দিল, যা সে আজীবন ভুলতে পারবে না।
তার সেই ভয়ানক কথাটি ছিল—
এই মুহূর্তে যদি এই গাড়ি না থামে, তবে আমি মেহের তালুকদার সেই বিয়ের দিনের মতো হকিস্টিক দিয়ে পরপর তিনটা বারি দিয়ে এই কার রেসের ভূত আপনার মাথা থেকে নামিয়ে দেবো, আমার সম্মানিত স্বামী মিস্টার তালুকদার।
রিদের এমন করুণ চাহনি দেখে মেহের বাঁকা হেসে বলল—
যেই ঠাকুর, যেই ফুলে সন্তুষ্ট, তাকে সেই ফুল দেওয়াই উচিত।
দাঁড়ান দাঁড়ান, এখানেই কিন্তু শেষ নয়।
কি মনে হয়, শুধু রাজ আর রিদ এমন হুমকির মুখোমুখি হয়েছে? উঁহু! ওদের সাথে লাবিব বেচারাও আছে। আর তার তো দশা আরও করুণ—মেহবুবা, যে কিনা মেহরিন ও মেহেরের বোন, তাদের দুজনের থেকেও এক কাঠি উপরে!
মেহবুবা একই সময় লাবিবকে বলল—
তুই যদি এখনই গাড়ি না থামাস, তবে জেনে রাখ আমি মেহবুবা মির্জা তোকে পাশের বাড়ির ৫০ বছর বয়সী ফুলবানুর মার সাথে বিয়ে দেবো। যা তোর ১৪ গুষ্টির কেউ থামাতে পারবে না! সাথে এমন কেলানি দেবো, যা তুই না পারবি কাউকে দেখাতে, না পারবি সহ্য করতে।
এমন ভয়ানক কথা শুনে কি কেউ ঠিক থাকতে পারে? তেমন লাবিবও পারল না। ফলস্বরূপ ব্রেক কষল, সে আর মেহবুবারের দিকে চেয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—
তুই আমার বউ না শত্রু?
সঙ্গে সঙ্গে মেহবুবা সামনে আসা চুলগুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে বলল—
দুইটাই।
ঘটনাটা এমনই হলো যে, একই সময় তিন বোন এমন কথা বলল, আর একই সময় তিনটা গাড়ি ব্রেক কষল।
কি মনে হয়—এটা কাকতালীয় কোনো ব্যাপার? আরে না, এটা পুরোপুরি পরিকল্পিত, যার মাস্টারমাইন্ড স্বয়ং মেহরিন শিকদার।
গার্লস গ্রুপে সে বলেছিল—যেভাবে পারো এই রেস থামাও। আর তারা সবাই জানে, তাদের আশিকরা ঠিক কোন কথায় ঘায়েল হয়। সেভাবেই কাজ করেছে, আর তাতে তারা সফলও হয়েছে।
মেহরিন গাড়ির কাচ নামিয়ে মাথা বের করে দিলো। আর দেখল, আগেই সবাই গাড়ি থেকে মাথা বের করে তাকিয়ে আছে তার দিকেই।
মেহরিনকে দেখা মাত্রই রাহি, আরফা, চুমকি, লামিয়া বলে উঠল—
জিও ম্যাডাম!
মেহরিন হাসল।
ওদিকে রাজ মেহরিনের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
মনে মনে বলে—
তোর কি দিন আসলো রে রাজ! তোর বউও তোকে থার্ড দেয়!
এরপর রাজও মাথা বের করে দেখে রিদ আর লাবিবও গাড়ি থামিয়েছে। যা দেখে রাজ হাসে।
মেহের আর মাহবুবাকে দেখে মনে মনে বলে—
বউ আর শালীকা, সব একই রকম হলে যা হয় আর কি!
তবে আমার বউ তো ওদের মতো না। আমার বউ আমায় মারলেও ওদের মতো দজ্জালের মতো মারে না। ওই কয়টা চড়-থাপ্পড় এই-দেয়, মাঝেমধ্যে বেশি রাগলে দু-একটা লাথি দেয়… এই আর কী।
এরপর আবার মাথা বের করে রিদারের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি এনে ভাবে—
আর যাই হোক ওর মতো তো আর বউয়ের হাতে হকিস্টিকের বারি খেয়ে অজ্ঞান হতে হয়নি।
এরপর লাবিবের দিকে তাকিয়ে রাজের ঠোঁটের হাসি চওড়া হয়।
মনে মনে বলে—
আর যাই হোক এই বলদের মতো তো আর হবু-বউয়ের হাতে ঝাড়ুর বারি খাইনি, ওঠতে-বসতে অমন ক্যালানিও খাই না।
সব শেষে আরশের দিকে তাকিয়ে রাজের ভীষণ মায়া হয়। মনে মনে ভাবে—
আহা রে বেচারা তোর কপালে যে কী আছে, তা ভেবেই ভয় পাই আমি। তোর কপালে যে জুটছে সে যে সবার থেকে ভয়ংকর।
এমন সময় আরশ রাজের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসে। যা দেখে রাজও হাসে, বিড়বিড় করে বলে—
হাসো, হাসো… তোমার কপালে যে কী জুটেছে, যখন বুঝবে, তখন কেঁদে কুল পাবা না। ও তো সব সময় মামুর সঙ্গে থাকত, মামু যে ওকে কী শিখিয়েছে তা শুধু আল্লাহ আর মামুই জানে। যাক গে, আমাদের তো আর দোষ দিতে পারবে না, সে নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে।
ওদিকে শান্ত একটু চেঁচিয়ে বলে—
কি ভাই, থামলি যে?
রাজ এবার শব্দ করে হেসে দেয়, আবার বিড়বিড় করে বলে—
আরে এ যে আরেক বলদ, যাকে দিয়ে তার বউ ওয়াশরুম পরিষ্কার করায়।
এদিকে রাজকে বিড়বিড় করতে দেখে মেহরিন ভ্রু কুচকে বলে—
কি হয়েছে? এমন পাগলের মতো হাসছেন, বিড়বিড় করছেন কেন? পাগল হয়ে গেছেন নাকি? পাবনায় রেখে আসব?
রাজ বউয়ের দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হাসে, মনে মনে ভাবে—
যে যাই বলুক, ওদের বউয়ের তুলনায় আমার বউ অনেক ভালো।
মেহরিন তখনও রাজের দিকেই তেছড়া চোখে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ রাজ বলে—
ভালোবাসি, বউ।
মেহরিনের ঝটপট উত্তর—
উম্ম… মরন! এসব প্রেম-পিরিতি সেঁইদে রাখুন। ভুলে যাবেন না আপনি এখন দুই বছরের বাপ!
রাজের কথাটা মোটেও পছন্দ হলো না। সে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে ওঠল—
এটা কেমন কথা বউ? আমি দুই বছরের বাপ হয়েছি বলে কি আমার প্রেম থাকবে না? শোনো বউ, আমার মনে প্রেমের সাগর বুঝলে? আমার প্রেম কোনোদিন কমবে না। দুই বাচ্চার বাপ কেন, এগারো বছরের বাপ হলেও আমি বলব—বউ, ভালোবাসি।
মেহরিন মুখ ঝামটা দেয়,যা দেখে রাজ হাসে। কারণ সে জানত, তার কথার বিপরীতে তার বউ ঠিক এমনউ করবে।
রাজ সোজা হয়ে বসে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে
এখন বলুন তো ম্যাডাম? এমন ভয়াবহ মার্কা কথা বলে আমার হার্ট অ্যাটাক করাতে চাওয়ার আসল কারণটা কী?
মেহরিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়। রাজ দুই দিকে মাথা নেড়ে বলে—
মানে বলছি, গাড়ি তো আর এমনি এমনি থামাতে বলেননি, এটা আমি জানি। এখন আসল কারণটা বলুন, যেন আমি আপনার মনমতো কাজ করতে পারি।
মেহরিন হাসে, কিন্তু রাজ দেখার আগেই তা মিলিয়ে যায়। গম্ভীর স্বরে বলে—
আমার এখন গাড়িতে ঘুরতে যাওয়ার মুড নেই।
মেহরিনের এহন কথাই রাজের কপালে ভাঁজ পড়ে, সে চিন্তিত গলায় বলে—
কেন? শরীর খারাপ লাগছে? পানি খাবে? বেশি খারাপ লাগছে? গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি যাব?
এগুলো বলতে বলতে রাজ ইতিমধ্যেই মেহরিনের কপাল, গলা সব চেক করা শেষ রাজের। মেহরিন রাজকে এত উৎলা হতে দেখে হেসে ফেলে, আর তাকে আশ্বস্ত করে বলে—
আরো দূর! আমার কিছু হয়নি। আমি বলেছি, আমার গাড়িতে করে ঘুরতে যাওয়ার মুড নেই।
রাজ বলে—তো
মেহরিনের যটফট উত্তর, আমি বাইকে করে যাব।
রাজ হাসে, বলে—
বেসস! এইটুকু আগে বলবেন না, যে আমার বউয়ের বাইকে করে ঘোরার শখ জেগেছে। কথা বলতে বলতে ফোনটা বের করে রাজ,তারপর কাউকে এসএমএস করে রাজ মেহরিনকে বলে—
জাস্ট পাঁচ মিনিট বউজান, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
মেহরিন খানিকটা অবাক হয়—
মাত্র পাঁচ মিনিটে এই মাঝরাস্তায় বাইক আসবে কোথা থেকে?
রাজ ফোনটা জায়গামতো রেখে বলে—
উফফ বউজান, এসব আপনার ভাবতে হবে না। আপনার বাইকে ঘোরার শখ হয়েছে—আর তা পূরণ হবে না, সেটা ভাবাই তো অন্যায়। আর তার থেকেও বড় কথা, বউজানের জন্য অসম্ভবকে সম্ভব করাই হলো তার হাজবেন্ড রাজ শিকদারের কাজ! বুঝলেন ম্যাডাম?
মেহরিন মুখ বাঁকায়, তবে এটা জানে—রাজ একবার বলেছে মানে, পাঁচ মিনিটে বাইকের ব্যবস্থা হবেই।
রাজ আবার বলে—
আপনি তো আর একা একা বাইকে যাবেন না, সেটা আমি জানি। পাঁচ মিনিট মতো সামনে একটা ফ্যাক্টরি আছে, ওখানেই গেলে আমরা আমাদের বাইক পেয়ে যাব। তো চলুন, যাওয়া যাক।
মেহরিন মাথা নাড়ে। রাজ আবার মাথা বের করে উঁচু স্বরে বলে—
সবাই চলো, আমরা সামনে ফ্যাক্টরির সামনে থামব!
রাজের কথামতো সবাই চলে। সবাই এসে থামে একটা ফ্যাক্টরির সামনে।
ফ্যাক্টরিটা বন্ধ, তবে ফ্যাক্টরির পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটা বাইক। তারা একে একে সাতটা গাড়ি রাস্তার পাশে সাইড করে রাখে। গাড়ি থেকে নেমে সবাই চারপাশে তাকিয়ে অবাক হয়—কারণ জায়গাটা অসাধারণ সুন্দর আর একদম নিরিবিলি।
গ্রামে হলেও এখানকার রাস্তাগুলো ভাঙা-চোরা নয়, বরং পাকা রাস্তা। জায়গাটা এতটাই মনোরম বলে বুঝানোর মত নয় সবুজে ঢেকে যেনো গেছে সব কিছু। দুই ধারে ধানক্ষেত, মাঝখানে সরু রাস্তা। রাস্তার ধারে সারি সারি গাছ, গাছের ডালপালা ফুঁড়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে—কিন্তু ডালপালার ফাঁক গলে সে নিজের তেজ পুরোপুরি দেখাতে পারছে না। ঠাণ্ডা, মনোরম বাতাস বইছে,এদিক সেদিক দেখছে আর চারপাশটার সৌন্দর্য উপভোগ করছে সবাই।
বাইক দেখে সবার মুখে হাসি ফুটলেও খুশি হতে পারল না রাহি আর আরফা। তার যথা-যুক্ত কারন ও আছে সবাই যে জোড়ায় জোড়ায়, শুধু তারা দু’জন বাদে।
আরফা হতাশ গলায় রাহিকে বলল,
তারা না হয় জোড়া জোড়া, কিন্তু আমরা?
রাহিও একই সুরে উত্তর দিল,
হ্যাঁ, তাই তো দেখছি, ওরা সব জোড়া জোড়া মাঝখানে তুই আর আমি হলাম দুই কপাল পুরা। আমি বা তুই—কেউই তো বাইক চালাতে পারি না। চালাতে পারলে একটা কথা ছিল—আমি চালাতাম, তুই আমার পেছনে বসতি, বা তুই চালাতি, আমি তোর পেছনে বসতাম।
আরফা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
চল, আমরা না হয় বাড়ি চলে যাই।
বাড়ি চলে যেতে হবে শুনে প্রথমে মনটা খারাপ হলেও মুহূর্তেই মাহিম আর মাহিনের কথা ভেবে খুশি হয়ে গেল রাহি। এই জোড়াগুলোর মাঝে কাবাব-মেহ্-হাড্ডি হওয়ার চেয়ে বাড়ি গিয়ে মাহিম আর মাহিনের সাথে বকবক করাই অনেক ভালো—যেই ভাবা সেই কাজ।
রাজ আর রিদ কথা বলছিল, তখন রাহি গিয়ে দুই ভাইয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
আমি আপনাদের মাঝে একখানা বক্তব্য রাখতে চাই, যদি অনুগ্রহ করিয়া আপনারা অনুমতি প্রদান করেন।
বোনের এমন নাটক দেখে রাজ ও রিদ একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসে। দুইজন, দুই দিক থেকে রাহির কাঁধে হাত রাখে, যেন অনেকদিনের বন্ধুকে ধরে আছে। রাহি একবার রাজের দিকে, আরেকবার রিদের দিকে তাকায়। সবার দৃষ্টি এখন এই তিনজনের দিকে, সবার মুখে মৃদু হাসির ফোয়ারা।
রাহি ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করে—
—বলবে কিনা?
রাজ ও রিদ একসাথে বলে ওঠে,
অবশ্যই, অবশ্যই! প্রিন্সেস, বলুন আপনার মহামূল্যবান কথা, আমরা শুনতে প্রস্তুত।
ভাইদের এমন আদরমাখা কথা শুনে রাহি হাসে। মাঝেমাঝে সে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করে এমন একটা ভালো পরিবার পেয়েছে, আর এমন দুই ভাই পেয়েছে যারা তাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে, ছোট-বড় সব ব্যাপারে পাশে থাকে। সব সময় প্রিন্সেস এর মত ট্রিট করে। মাঝেমধ্যে তো ভাইদের আদরে রাহির মনে হয় সে ননীর পুতুল।
রাহি হেসে হেসে মুখটা একটু দুঃখী করে বলে—
তোমরা তো সবাই জোড়া জোড়া, মাঝখানে আমি আর আরফা—দুই কপালপোড়া! তাই আমরা বাড়ি চলে যেতে চাই। আমরা বাপু কাপলদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না।
রাজ ও রিদ রহস্যজনকভাবে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসে। রিদ বলে—
আমরা সবাই একসাথে এসেছি, আর একসাথেই যাবো।
রাজ ও রিদের কথায় তালে তাল মেলায়। ওদিকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই রমণী তারা, রাজ আর রিদের দিকে শকুনি চোখে তাকায়, তারপর একে অপরের দিকে। হয়তো তারা বুঝে গেছে রাজ-রিদের কথার আসল মানে।
হঠাৎ রাজ ও রিদ রাহির কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, ফোন বের করে কাউকে একটা টেক্সট পাঠায়। হয়তো বিপরীত দিকের থাকা লোকেরা উত্তর দিলো। সেটা দেখে দুজনের মুখেই হাসি ফুটে ওঠে। তারপর তারা একসাথে বুকের কাছে শার্টে ঝুলে থাকা সানগ্লাস তুলে তাতে ফু দিয়ে একই স্টাইলে চোখে পরে, এবং একই ভঙ্গিতে ঘড়ি দেখে বলে,
—আমরা এখানে ২০–২৫ মিনিট আছি।
রাজ সবার দিকে তাকিয়ে বলে—
যেহেতু আমরা এখানে বেশ কিছুক্ষণ আছি, তাই সবাই আসো, আগে একটু বসি।
রাজের কথায় সবাই একটু অবাক হলো। মেহরিন কিছু বলতেই যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই রাহি বলে ওঠে—
কিন্তু ভাইয়া, এখানে তো বসার কিছু নেই!
রাজ রাহির চুলগুলো আলতোভাবে এলোমেলো করে দিয়ে বলে—
ভুলে যাচ্ছিস কেন? তোর ভাইয়া তোদের সাথে আছে, তোদের কোনো চিন্তা নেই। চাইলে ফ্যাক্টরির ভেতরে বসতে পারিস, বিশ্রামও নিতে পারবি।
কথা শেষ হতেই রাহি কাঁদো কাঁদো মুখে বলে—
ভাইয়া, তুমি আমার চুল এলোমেলো করে আমাকে ভূত বানিয়ে দিচ্ছো কেন?
রাজ হাসে। মেহরিন এগিয়ে এসে রাহির চুল ঠিক করে দিয়ে বলে—
ছাড় তো, ওকে বলে লাভ নেই, ও কি বোঝে এসব।
তারপর মেহরিন ভ্রু কুঁচকে বলে—
তার মানে এই ফ্যাক্টরি আপনাদের?
রাজ মাথা নাড়ে। সবাই খুশি হয়, একটু বিশ্রাম নিলে ক্ষতি নেই। লামিয়া এগিয়ে এসে বলে—
ব্রো, আমরা ভেতরে না, এখানেই বসি। জায়গাটা খুব সুন্দর, আর এখানে দারুণ বাতাস বইছে, এয়ারকন্ডিশনেরও দরকার নেই।
রাজ লামিয়ার কথা শুনে হেসে ফেলে। সে সবাইকে জিজ্ঞেস করে—
তোমরা কি এখানেই বসতে চাও?
সবাই সম্মতি জানায়। কিন্তু রিদ রাজের কাঁধে হাত রেখে বলে—
তবে একটা সমস্যা থেকেই যায় বেটা।
রাজ হেসে বলে—
কোনটা?
রিদ বলে,
এটা তো রাস্তা গাড়ি আসা-যাওয়া করবে, যদি কোনো লফঙ্গা এসে কিছু বলে? যদিও আমরা আছি, প্রটেক্ট করবো, তারপরও…
রাজ বলে—
চিন্তা করিস না। যতক্ষণ আমরা এখানে আছি, কোনো গাড়ি বা মানুষ আসবে না।
রিদ বলে, কিন্ত?
রাজ হেসে বলে,
কিন্তু কি এটাই তো, যে আমরা যদি রাস্তা ব্লক করে রাখি তাহলে সাধারণ জনগণের ভোগান্তি হবে ?
রিদ মাথা নারে। রাজ রিদের কাঁধে হাত রেখে বলে,
আমাদের জন্য কারো কোন ভোগান্তি হবে না ব্রো, আমার লোকেরা অন্য রাস্তা দিয়ে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।
রাজের কথায় সবার মুখে হাসি ফোটে। মেহরিন রাজের দিকে তাকিয়ে হাসে, মনে মনে ভাবে—এই মানুষটার সব দিকে নজর। নিজের পরিবারের কে সব দিক দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা সবসময় করে।
মেহরিন কে রাজের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে, চুমকি দুষ্টুমি হাসি দিয়ে মেহরিনের বাহুতে ঠেস দিয়ে বলে
এভাবে কি দেখছিস বইন? ওটা তোরই জামাই কেউ নিয়ে যাবে না। বাড়ি গিয়ে মনপ্রাণ উজাড় করে দেখিস, কেউ কিছু বলবি না, আপাতত আমাদের দিকেও একটু তাকা সোনা দেখ কি সুন্দর করে সেজেছি আমি।
মেহরিন রাগী চোখে তাকায় চুমকির দিকে চুমকি হাসে। কথাটা চুমকি আস্তে বলেও রাজ ঠিকই শুনে ফেলেছে।
তারপর চুমকির উদ্দেশ্য বলে ওঠে—
বুঝলে তো বোনু, তোমার বান্ধবী আমাকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসলেও তা প্রকাশ করে না। এমন ভান করে যেন আমাকে দেখতেই পারে না। কিন্তু সে তো জানে না, রাজের চোখে পড়ার ক্ষমতা আছে। মুখে যত যাই বলুক না কেন, তার চোখ বলে দেয় সে আমার প্রেমে জ্বলে পুড়ে ছারখার।
চুমকি মাথা নেড়ে বলে—
হে হে, তাই তো এ তো ভীষণ অন্যায়! কি রে মেহু? তুই কেমন করে আমার এমন ভুলো-ভালা ভাইয়ার সাথে এমন অন্যায়ের অবিচার করিস। যেখানে তুই নিজেই দুই বছর আগে তাকে না দেখেই প্রেমে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলে।
মেহরিন দুজনের কথায় দুই হাত উঁচু করে বলে,
দয়া করে ক্ষমা দে, মেরি মা! এখন আবার তুই শুরু করিস না, এক কবির জ্বালায় বাঁচি না।
মেহরিনের কথায় সবাই হেসে ওঠে।
সবাই আড্ডা দিলেও লাবিব কাজে লেগে গেছে। লাবিবের একটা গুণ হলো—সে জানে কখন কি করতে হবে। সে ভাবে—এভাবে সবাই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি বসার ব্যবস্থা তো করতে হবে? তাই ইশারায় ছেলেদের ডেকে নিয়ে কাজে লেগে যায়, আর নিজের কাছে থাকা ফ্যাক্টরির আলাদা চাবি দিয়ে বলে—ভেতর থেকে চেয়ার-টেবিল বের করো।
ছেলেরাও আদেশ পেয়ে কাজে লেগে পড়ে। মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে ১০–১২ জন মিলে সুন্দর রাস্তাটার মাঝখানে গোল করে চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে ফেলে। বসার ব্যবস্থা শেষ হতেই এক বাইকে করে এক ছেলে খাবার, স্ন্যাকস আর কোল্ড ড্রিঙ্কস দিয়ে যায়। ওগুলো টেবিলে সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেয়।
কী ভাবছেন নিশ্চয়ই—ফ্যাক্টরিতে চেয়ার-টেবিল? আসলে রাজের ফ্যাক্টরিতে সবই পাওয়া যায়, কারণ যত জায়গায় রাজের ফ্যাক্টরি আছে, সেসব জায়গায় খাওয়া-দাওয়া আর বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকে।
এগুলো মূলত রাজের কর্মচারীদের জন্য। রাজ তার অধীনে কাজ করা লোকদের সবধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়। কাজের সময়ে পেশাদার থাকলেও কাজের বাইরে বন্ধুসুলভ। এই কারণেই রাজ আর লাবিবকে ওদের লোকেরা খুব ভালোবাসে, তাদের জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত থাকে সর্বদা।
সবাই গোল হয়ে বসেছে। রাজের লোকেরাও তাদের পাশে বসে হাসি-খুশিতে আড্ডা দিচ্ছে।
সবাই আড্ডা দিচ্ছে, কিন্তু রাহি আর আরফা মুখটা কে বেটকি মাছের মতো করে রেখেছে। তা দেখে চুমকি বলে—
কি রে, তোরা দুইটা মুখ ওমন করে রেখেছিস কেন?
রাহি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় ও দুঃখী এমন ভাব এনে একটা হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলে—
তুই বুঝবি না রে…
চুমকির সাথে সাথে সবাই খানিকটা মনোযোগী হলো রাহির দিকে। শুধু আরফা মিটি মিটি হাসছে।
চুমকি বলল—
কি হয়েছে বল না, কেন বুঝবো না?
রাহি এক নজর শান্তর দিকে তাকিয়ে ফের চুমকির দিকে তাকিয়ে বলে—
তুই বুঝবি না আমার দুঃখ, কারণ তুই বিবাহিত। দিন তো এখন তোদেরই। আরও একটা নিশ্বাস ছেরে রাহি বলে,
বিয়ে করেছিস, সংসার করছিস, প্রেম করছিস, ঘুরছিস, ফিরছিস—আহা! মজাই মজা। আমি আর আরফা শুধু বসে বসে মশা-মাছি মারছি, আর তোদের রং ডং দেখছি। অবশ্য এটা ছাড়া আমাদের আর কোনো কাজও দেখছিনা।
রাহি দুষ্টুমি করেছে বুঝে সবাই মিটি মিটি হাসছে। কিন্তু সবার হাসিতে এক বালতি পানি ঢেলে দিয়ে শান্ত বলে উঠলো একটা কথা, যা শুনে চুমকির রণমূর্তি ধারণ করল।
রাহি যখন বিবাহিত জীবন নিয়ে বলছিলো, শান্ত তখন কোল্ড ড্রিংকস খেতে খেতে অন্যমনেই বলে ফেলল—
বিয়া যে কতো মজা, তা বিয়ের পর বুঝবি বইন। অবশ্য তুই বুঝবি কেন — বুঝবে তো তোর জামাই। তোদের তো কোনো বেপারই নাই। শুধু খাবি-দাবি, শপিং করবি আর জামাইয়ের ওপর হুকুম চালাবি। মাঝে মধ্যে ধরে আবার কেলানিও দিবে কিন্তু সে কিছু বলতেও পারবে না।
যা শুনে চুমকি রেগে গেলো। কথাটা মেয়েদের উদ্দেশে বলায় ছেলেরা মনে মনে খুশি হলেও প্রকাশ করলো না। মেয়েরাও তেমন রেগে গেলেও তা প্রকাশ করলো না।
চুমকি তেড়ে শান্তর কাছে গিয়ে বলে—
কি বললে তুমি?
শান্ত বুঝে গেলো যে সে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। তাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা চালিয়ে বললো—
না মানে আসলে আমি কি বলেছি বলো তো? আহা, তুমি রাগ করছো কেন?
আমি তো ওইভাবে বলিনি। আমি বলতে চেয়েছিলাম যে বিয়ে হচ্ছে সব সমস্যার সমাধান। আর…
রাহির দিকে ফিরে ফের বলে—
রাহি বইন, তুই তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে ফেল। আর বিয়ে করে তোর যত সমস্যা আছে সব জামাইয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তুই বিন্দাস ঘুরবি বুঝলি? এটাই হচ্ছে বউদের প্রধান কাজ।
এখন কথাটা শুনে তো নারী-গণ খেপে যায়। সব রমনি একসাথে বলে ওঠে—
“কীইইই?”
শান্ত ঢোক গিলে বলে—
আসলে আমি এভাবে বলতে চাইনি, আমি আসলে এটা বলতেই পারি না যে বিয়ের পর বউরা নিজেকে মহারানি মনে করে আর জামাইকে ভাবে তার রাজ্যের কর্মচারি।
নারীগন আবার বলে—
“কীইই?”
শান্ত আবার বলে—
না মানে, আমি বলতে চাইনি যে বউদের প্রধান কাজ হচ্ছে জামাইয়ের মাথা খাওয়া।
আবারো নারীগন চিৎকার করে বলে—
“কীইই?”
এদিকে শান্তর অবস্থা দেখে বাকি ছেলেরা মিটি মিটি হাসছে।
শান্ত ফের বলে—
না মানে আমি এটা মোটেও বলতে চাইনি যে আমরা পুরুষরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছি নিজেদের বিয়ে করা বউয়ের কাছে।
নারীগন এবার সবাই দাঁড়িয়ে যায়, কোমরে হাত রেখে শান্তর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বলে—
“কীইই?”
শান্ত দুঃখ নিয়ে বলে—
বিশ্বাস করো, আমি এগুলো বলতে চাইনি। আমার মুখ ফসকে সব সত্যি কথা বেরিয়ে যাচ্ছে।
আবারো নারী-গণ একসাথে বলে ওঠে—
“কীইই?”
শান্ত কাদোকাদো মুখে চুমকির দিকে তাকিয়ে বলে—
বউ, বিশ্বাস করো, আমি মোটেও বলতে চাইনি তুমি স্বামী নির্যাতন করো।
বেসস, চুমকিকে আর পাই কে সে! সোজা গিয়ে রিনা খানের মতো শান্তর কলার ধরে বলে—
কি বললে তুমি? আমি স্বামী নির্যাতন করি?
শান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। অবশেষে, আসন্ন ঘূর্ণিঝড় সে কীভাবে মোকাবিলা করবে সেই উপায় পেয়ে গেল।
হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, প্যান্টের পকেট থেকে একটা রিং বক্স বের করে চুমকির সামনে ধরে বলে—
বউ, তুমি রাগ করো না। আমি শুধু তোমাকে একটু রাগিয়ে এই সারপ্রাইজটা দিতে চেয়েছিলাম।
আর বেসস, চুমকি গলে গেল। সবাই অবাক আর খুশি দুই-ই হলো। কিন্তু শুধু রিদ, রাজ আর লাবিব হাসল, কারণ তারা জানে আসল কাহিনি কী।
এদিকে চুমকির তো রাগ গলে পানি হয়ে গেছে। স্বামীর কাছে পাওয়া গিফটে। আসলেই নারী বড়ই অদ্ভুত। তাকে একটু বুঝতে পারলেই পুরুষের জীবন সুন্দর হয়, আগুনের লাভার নেয় রাগে গজগজ করতে থাকা নারীটিও বরফের মত শিতল হয়ে যায়—প্রিয় মানুষের একটু যত্নে, একটু আগলে রাখায়, একটু খানি ভালোবাসায়।
যেমন চুমকির রাগ নিমিষেই পানি হয়ে গেল স্বামীর কাছে পাওয়া উপহারে। শুধু রিং নয়, সামান্য একটা ফুল দিলেও এই রাগ গলে যেতো।
সে যাই হোক, শান্ত নিজ হাতে রিংটা পরিয়ে দিল চুমকির হাতে। সাথে সাথে একটা পুরোনো সৃতি চরন হলো মনে পরে গেলো সেই মধুময় সময়। যখন শান্ত চুমকিকে জানিয়েছিলো তার মনের কথা আর চুমকি ও সদরে গ্রহণ করেছিলো শান্তকে।
ঝগড়া-তর্ক সব শেষ, আবার সবাই আড্ডায় মনোযোগ দিল সবাই।
হাসি মজা আর আড্ডার মাঝে হঠাৎ করেই চুমকি রাজকে জিজ্ঞাসা করল,
আচ্ছা ভাইয়া, তুমি বলো তো, আমাদের মেহুকে প্রথম দেখে তোমার অনুভূতি ঠিক কেমন ছিল? এটা বলে একটু টিটকারি মরে চুমকি ফের বলে,
আর তার থেকেও বড় কথা—তুমি একজন মাফিয়া হয়ে, আমাদের মেহুর মতো একটা সাধারণ মেয়ের প্রেমে পড়লে কী করে?
কথাটা শুনে মুহূর্তেই সবার দৃষ্টি গিয়ে থামল রাজের পানে। রাজও এক পলক মেহরিনের দিকে তাকাল—যে পরেই তার দিকে তাকিয়ে আছে, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে রাজের জবাবের । রাজের ছেলেরা খানিকটা এগিয়ে এসে কান খাড়া করল, তাদের ‘বস’-এর প্রেমের গল্প শোনার আগ্রহে।
রাজ মেহরিনের চোখে চোখ রেখে, গুনগুন স্বরে উত্তর দিল।
তাকে দেখিয়া প্রথম আমার অনুভুতি ছিলো কিছুটা এমন….
এক পা দু পা করে তুই এলি এই মনে!!
শেখালি আমাকে ভালোবাসার মানে!!
এক পা দু পা করে তুই এলি এই মনে!!
শেখালি আমাকে ভালোবাসার মানে!!
স্বপ্নে দেখেছি,,
তোকে দুচোখ ভরে!!
এতটুকু বলে থেমে রাজ আবার বলে,
আর তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নটা হচ্ছে, আমি একজন মাফিয়া হয়েও কেন আরিওনার প্রেমে পরলাম?
তবে জেনে রাখো তার প্রেমে আমি পরিনি তাকে প্রথম দেখাই ভালোবেসেছি। আর সে আমার কাছে কখনোই সাধারণ কেউ নায়।সে আমার ভালোবাসার মানুষ,সে আমার অর্ধাঙ্গিনী, সে আমার দুই রাজপুত্রের জননী,তার থেকেও বড় কথা সে আমার আরিওনা,সে আমার Moonbem। আর যদি বলো, আমি মাফিয়া হয়েও তাকে ভালোবাসার কারণ কী?
তবে আমি বলবো….
যখন ঐরূপ স্মরণ হয়!!!
থাকে না লোকও লজ্জার ভয়!!
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই ”
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই”
ওই প্রেম যে করে সে জানে!!
ওই প্রেম যে করে সে জানে….
আমার মনের মানুষেরও সনে!!
আমার মনের মানুষেরও সনে!!
আমি তাকে ভালোবাসার সংজ্ঞা দিতে পারবো না তবে এটুকু বলতে পারি…!
ভালোবাসা কোনো শব্দ নয়,
এটা এক অদৃশ্য স্পর্শ,
যা হৃদয়ের গভীরে নীরবে জন্ম নেয়,
আর চোখের জলে রূপ নেয় আনন্দে বা বেদনায়।
ভালোবাসা মানে—
কারো অপেক্ষায় বসে থাকা,
প্রিয় মানুষের কথা মনে পরলে,
আনমনে ঠোঁটের কোনে হাসি চলে আশা।
ভালোবাসা মানে—
ঝড়ের রাতে প্রিয় মানুষের হাত শক্ত করে ধরা,
আর ভোর হলে একই সূর্যের নিচে
একসাথে নতুন করে শুরু করা।
যত দিন যায়,
আমরা হয়তো বদলে যাই,
কিন্তু ভালোবাসা…
যদি সত্যি হয়,
তবে সে থেকে যায়—
শ্বাসের মতো, হৃদস্পন্দনের মতো,
চিরকাল।
রাজের উত্তর শুনে চুমকি,রাহি, আরফা, আর লামিয়া —এবং রাজের ছেলেরাও সবাই একসাথে চিৎকার করে “ওওওওও…” বলে উল্লাসে ফেটে পড়ল। সবার মুখে হাসি বিরাজমান।
এবার তীর ঘুরে যায় রিদের কাছে। চুমকি এবার রিদকে জিজ্ঞাসা করে,
আচ্ছা ভাইয়া, আপনি কি দেখে আমাদের মেহেরের প্রেমে পড়লেন?
রিদ মেহেরের দিকে তাকিয়ে হাসে, আর কৌতুকের সাথে বলে,
আমাদের প্রথম দেখা ছিল টর্নেডোর মতো। ম্যাডাম হাওয়ার বেগে এসে আমাকে গালি-গালাজ করে থার্ড দিয়ে চলে গেলো।
রিদের কথায় সবাই হেসে দিলো। মেহের রিদের দিকেই তাকিয়ে ছিল। রিদের এমন কথায় হয়তো কষ্ট পেলো খানিক অভিমান ও হলো বোধহয়, তবে তা কাউকে বুঝতে দিলো না—জোরপূর্বক মুখে হাসি রাখলো।
বোকা মেহের জানেই না, তার হাসির পেছনের অভিমান তার স্বামীর চোখে ধরা পড়লো। মেহেরকে জোরপূর্বক হাসতে দেখে রিদ মুচকি হেসে বলে,
তবে ওই যে কথাই আছে না, প্রেম এমন একটা জিনিস, যেখানে মন আমাদের কথা শোনে না—শোনে কোনো বাধা-নিষেধ। প্রেম হয়ে যায় অজান্তেই। প্রেম হচ্ছে একটা রোগ; যে রোগে একবার আক্রান্ত হলে তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে মন ও মস্তিষ্কে। মনের মধ্যে থাকা মানুষটাকে তো ভুলে যাওয়া যায় না। আর যদি সেই মানুষ সারাক্ষণ মস্তিষ্কে কিলবিল করে, তখন করোনিও—কি বলতে পারো?
যা-ই হোক, প্রথম দেখা আমাদের খুবই ভয়াবহ হয়েছিল। তবে সেই প্রথম দেখাতেই একজোড়া চোখ কেড়ে নিয়েছে আমার ঘুম। আমি শুধু ভাবো আমার মতো স্ট্রং পার্সোনালিটির একজন মানুষের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে সেই সর্বনাশা চোখ। ভাবতে পারছো তোমরা, কি মাদকতা ছিল সেই চোখ দুটোতে? সেই চোখ দুটো ভুলতে না পেরে যখন বাউণ্ডুলে হয়ে ঘুরছিলাম, মন আর চোখ দুটোই যখন তার খোঁজ করছিলো—তখনই আবার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দেখা পেলাম সেই রাগী রাগী নীল চোখের অধিকারিণীর।
তার চোখে যেনো নীল রঙের সমুদ্র,
আর ঢেউয়ের ভেতরে লুকানো কোন নীরব গান।
আমি তাকিয়ে থাকি সেই নীল সাগরের পানে,
আর সময় থমকে দাঁড়ায় তারই জন্যে,
যেন কেবল আমাদের জন্যই পৃথিবী থেমে যায়।
তার মুখে এক ফোঁটা হাসিতে,
আমার মনের আকাশে যেন ভোর হয়ে যায়।
আমার মন তাতে ডুব দিতে চায়,
হয়তো হারিয়ে যেতে চায়,
তার সেই নীল দিগন্তের গভীরে।
আমি জানি—
শব্দে বেঁধে রাখা যায় না ওই রঙকে,
তবে জেনে রাখো আমার ভালোবাসার আরেক নামই তার সেই নীল চোখ।
কি বলবো তোমাদের! তাকে দেখা মাত্রই এক ধাক্কা খেলাম। কারেন্টে সক্ট খেলে যেমন হয় আরকি আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আজ একটা সত্যি কথা বলি—ওইদিন আমি তার পিছু নিয়েছিলাম চুপিচুপি এবং তার বাড়ি চিনে এসেছিলাম। এরপর কতবার যে ছুটে গেছি তাকে এক নজর দেখার আশায়—মশার কামড় খেয়েও সেই নীল চোখের অধিকারিণীকে আমি দেখতাম, যার রাগ সবসময় থাকে নাকের ডগায়।
তবে সে জানে না তার এই রাগটাকেও আমি ভালোবাসি। ভালোবাসি তার কথায় কথায় রেগে যাওয়াটা, ভালোবাসি তার হুটহাট তেড়ে আসাটাকে। ভালোবাসি সেই নীল চোখের অধিকারিণী আমার নিলয়োনীকে—যার সেই সাগরের মতো গভীর দুটি চোখে আমি ভেসে গেছি আরো দুই বছর আগে। যার সেই নিল চোখে আমি দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ—সে আর কেউ নয়, যে এই মুহূর্তে এক বস্তা অভিমান জমিয়ে মুখে মিছে হাসি জোর করে ধরে রেখেছে। রাগী মানুষরা একটু বোকা হয়—কথাটা সত্যি। এই যে এক বোকা রানী, যে রাগী ঠিকই, তবে বোকা সে—এটা বোঝে না কোনটা তার মনখোলা হাসি আর কোনটা জোর করে ধরে রাখা হাসি। এর তফাৎ তার স্বামী করতে জানে।
আমার বোকা নারী বোঝে না আমি তাকে কতটা ভালোবাসি। আমি হয়তো রাজের মতো সবসময় প্রকাশ করি না আমার ভালোবাসার কথা—তবে তার মানে এই নয় যে আমি তাকে ভালোবাসি না। তোমরাই বলো, বউয়ের হাতে হোলিস্টিকের বারি খেয়েও যে স্বামী তার বউকে ছেড়ে যায়নি—সে ঠিক কতটা ভালোবাসে তার স্ত্রীকে!
এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে শুনছিল সবাই রিদের কথা। তবে রিদ-এর শেষের কথায় সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাসলো মেহেরও। মেহেরকে হাসতে দেখে রিদও হাসলো, আর হাসতে হাসতে গুনগুন করে উঠলো—
আমি দূর হতে তোমাকেই দেখেছি!!
আর মুগ্ধ এই চোখে চেয়ে দেখেছি!!!
রিদের গান শেষে সবাই খুশিতে হাততালি দিলো।
এবার সবাই তাকালো লাবিবের দিকে। সবাইকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে লাবিব একটু ভাব নিয়ে দুই হাত তুলে বলে,
থাক, বলতে হবে না—জানি জানি, তোমরা এখন এটাই বলবে, তো আমি এই ল্যাদা বাচ্চার প্রেমে কেমন করে পড়লাম।
সবাই হাসে লাবিবের কথায়। তবে মেহবুবা বিরবির করে বলে,
— বাদর!
লাবিব হঠাৎ উঠে চলে যায় ফাঁকা জায়গায়, আবার ফিরে এসে মেহবুবার দিকে আঙুল তুলে বলে,
এই ল্যাদা বাচ্চা সেই প্রথম দিন থেকেই আমার সাথে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতো—শুধু তাই নয়, মারতোও!
খানিক চুপ থেকে একটু লাজুক হেসে লাবিব ফের বলে,
আমি ওর হাতে মার খেতে খেতে ওর প্রেমে পড়ে গেছি। এর পর একটু গম্ভীর হয়ে বলে,
যদিও আমি ভালোবাসতাম অনেক আগে থেকেই ব্রো যখন ভাবিকে দেখে আমিও তখন এই ল্যাদা বাচ্চাকে দেখে ভালোবেসে ছিলাম।তবে যখন থেকে ওর আসেপাশে আসলাম—তখন থেকেই যেন প্রেমের পোকাটা জীবিত হয়ে উঠলো।
তবে আজ আমি সবার সামনে একটা কথাই বলতে চাই—আর তা হলো, সারা জীবন মার খেতে রাজি, তার পরও আমার ল্যাদা বাচ্চাকেই লাগবে!
সবাই তো হাসতে হাসতে শেষ, আর মেহবুবা রেগে বোম। লামিয়া হাসতে হাসতে বলে,
ব্রো, তুমি মেহবুবার প্রেমে পড়ার একটা যৌক্তিক কারণ বলো—অবশ্যই মার খাওয়া বাদে!
লাবিব নিজের কলারে টান দিয়ে বলে,
— অবশ্যই!
বলে সে আবার চলে যায় ফাঁকা জায়গায়, আর নাচতে নাচতে গায়—
আলতা রাঙা গায়ের বরণ..!
দিঘল কালো চুল-
লাজুক লাজুক মুখ যেনো তার”
ফোটা পদ্মফুল!!!
সবাই অবাক হয়ে লাবিবের নাচ দেখে—কারণ শুধু লাবিব নয়, লাবিবকে নাচতে দেখে রাজের ছেলেরাও এসে যোগ দেয় নাচে। এক একজন উড়াধুরা নাচছে লাবিবের সাথে।
নাচ শেষে সবাই লাবিবের দিকে তাকায়। লাবিব বেজায় খুশি হয়ে হাত তুলে “লাইক” দেখায়—ছেলেরাও খুশি হয়ে যায়, আর আবার আগের জায়গায় গিয়ে বসে।
মেহরিন হাসতে হাসতে শান্তকে জিজ্ঞেস করে—
তা ভাইজান, আপনী কী দেখে আমার বান্ধবীর প্রেমে পিছলা খেলেন?
শান্ত চুমকির দিকে চেয়ে হাসে, আর দুই হাত তুলে সারেন্ডার করার মতো ভঙ্গিতে বলে—
আমি গানও গাইতে পারি না, নাচতেও পারি না, আবার ওমন সুন্দর করে গুঁজিয়ে বলতেও পারি না। তবে ভার্সিটিতে প্রথম দিন সেই ভীতু ভীতু চাহনিই আমার মনে ধরেছিলো। আর নবীন বরণ অনুষ্ঠানের দিন শাড়ি পরা অবস্থায় ম্যাডামকে দেখে তো আমি নিঃশ্বাস আটকে মরেই যাচ্ছিলাম—অল্পের জন্য হার্ট অ্যাটাক হয়নি! শাড়ি পরা অবস্থায় তাকে দেখেই মনে হচ্ছিলো,
তুনে মারি এন্ট্রিয়া রে…!
দিলমে বাজে ঘন্টিয়ারে..!
টিং টিং..
সেই ঘণ্টির দৌলতেই এখন সে আমার বউ, আর আমি তার পার্সোনাল কামের বেটা।
সবাই হাসে।
চুমকি চোখ গরম করে বলে—
“কীইই!”
শান্ত হাসে, চুমকির কাঁধে হাত রেখে বলে—
আরে রেগে যাচ্ছো কেনো? মজা করলাম। আমি ভালোবেসেছি, বিয়ে করেছি শেষ।
এমন সময় রাজ আর রিদের ফোন ভাইব্রেট করে। দু’জনেই ফোন চেক করে, আর দু’জনের মুখেই হাসি ফুটে ওঠে। রাজ বলে—
চলো সবাই, এখন আমরা আমাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিই।
সবাই উঠে একটু হালকা হাটা চোরা করে। আর এতক্ষণে রাজের ছেলেরা আবার সব চেয়ার-টেবিল ফ্যাক্টরিতে তুলে রাখে—যেনো এখানে যারা থাকে তাদের কোনো সমস্যা না হয়।
রাহি আবার যায় দুই ভাইয়ের মাঝখানে।
রাহি বলে—
ভাইয়া, আমরা বরং চলে যাই। ওখানে গিয়ে আমাদের আর কাজ নেই।
রাজ কিছু বলতে যাবে, এমন সময় একটা বাইকের শব্দে সবাই সামনে তাকায়। দেখে—একটা বাইক তীব্র গতিতে ছুটে আসছে এদিকেই। বাইকটা একদম রাহির সোজা আসছে।
যা দেখে রাজ আর রিদের মুখে সামান্য বিরক্তি ভর করে। বাইকটা এত দ্রুত আসছে যে রাহি সেখান থেকে না সরে চিৎকার দেয়, কারণ বাইকটা একদম তার সামনে এসে ব্রেক কষে দাঁড়ায়। সামান্য দূরে থামে। রাহি দু’হাত মুখের দিকে তুলে দিয়েছিলো। সবাই কিছুটা ঘাবড়ে যায়—
শুধু মেহরিন আর মেহেরকে বিচলিত হতে দেখা যায় না, বরং তাদের মুখে হাসি।
চুমকি, আরফা আর লামিয়া ততক্ষণে ওই বাইকে বসা ছেলেটাকে বকাঝকা শুরু করে দিয়েছে। ছেলেটার মুখ দেখা যাচ্ছে না, কারণ সে হেলমেট পরে আছে।
বাকিদের আওয়াজ ও নিজের শরীরের ব্যথা অনুভব না হওয়ায় রাহি বুঝলো তার কিছু হয়নি। চোখ খুলে বাইকটা এত সামনে দেখে বেজায় রেগে যায় সে—
কত বড় সাহস এই ছেলের! আমার দুই ভাইয়ের সামনে আমাকে আরেকটু হলে উড়িয়ে দিচ্ছিলো। কী হতো যদি পায়ে লাগতো? পা ভেঙে যেতো, তখন এই ভাঙা পা নিয়ে কী করে বিয়ে খেতাম? সে দায় কে নিতো? যথারীতি তেড়ে যায় রাহি।
বাইকে থাকা ছেলেটার দিকে আঙুল তুলে বলে,
এই কে রে তুই? তোর কত বড় সাহস! এমন করে বাইক চালাস? চোখ কি বাড়িতে রেখে এসেছিস? হত্যাছাড়া অনামুখো,পুরা মুখো!
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এত মানুষের বকাঝকার পরও বাইকে থাকা ছেলেটার মধ্যে কোনো হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। সে আরামসে বাইকের ওপর হাত বুকের কাছে গুঁজে বসে আছে, তাকিয়ে আছে রাহির দিকে।
তা দেখে রাহী আরও চটে যায়—
কি রে তুই কি বোবা? কথা বলছিস না কেনো? কোন যুগ এলো রে? কানা বোবা ও বাইক চালায়? সাধারণ জনগণকে বিপদে ফেলে! এই তোকে লাইসেন্স কে দিয়েছে, তার নাম বল। তার নাম আমি কেস করবো।
এত কথার বিপরীতে যখন ছেলেটি কোনো কথা বলে না, তখন রাহির রাগ মাথায় উঠে যায়।
দাঁড়া! তুই কথা বলবি না, তোর বাপ-দাদা-নানা-নানী চৌদ্দগুষ্টি কথা বলবে।
বলেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজতে থাকে রাহি। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি চোখে পড়তেই সে ছুটে যায়। পাশে পড়ে থাকা একটা লাঠি তুলে নেয় আর তা নিয়ে তেড়ে যেতে থাকে বাইকের দিকে।
তা দেখে মেহরিন আর মেহের এসে ধরে রাহিকে। হাসতে হাসতে মেহরিন বলে—
আরে থাম, থাম! মারিস না, ওটা কানা ও না, বোবা ও না।
রাহি মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বলে—
ছাড় আমাকে, মেহু আপু! আজ এই বুবার একদিন কি, আমার যে কয়দিন লাগে, আজ ওর নানা-দাদার নাম ভুলিয়ে দেবো।
মেহরিন বলে—
এতো চেতিস না, বেডি। তার থেকে আমি যা বলি, তা শোন।
রাহি থামে। মেহরিনের দিকে ফিরে বলে—
কি?
মেহের হাসে, রাহির বাহুতে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে—
বলি ও ননদী!!
আর দুমুঠো চাল ফেলে দে হাড়িতে!!
মেহরিন ও বলে উঠে—
বলি ও ননদী!!
আর দুমুঠো চাল ফেলে দে হাড়িতে!!
মেহের হাসে, আবার বলে—
ঠাকুর জামাই এলো বাড়িতে!!
ও ননদী ”
ঠাকুর জামাই এলো বাড়িতে!!
রাহি তাদের কথা না বুঝে অবুঝের মতো তাকিয়ে থাকে। তবে বাকিরা হয়তো আন্দাজ করে সামনে থাকা মানুষটা কে। তাই তো তারা মিটি মিটি হাসছে।
মেহরিন হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করে—
বুঝিসনি?
রাহি না বোঝার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। মেহরিন আর মেহের একসাথে কপাল চাপড়ায়।
লামিয়া তখন আসে, রাহিকে বলে—
আরে বুদ্ধু, উনি হচ্ছেন রাকিব ভাই।
রাহী তাজ্জব হয়ে লামিয়ার দিকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে—
“সত্যি?”
লামিয়া রাহির মাথায় একটা গাঁট্টা মেরে বলে—
বুদ্ধু! ব্রো কী বলেছিলো মনে নেই? এখানে তার অনুমতি ছাড়া কেউ আসতে পারবে না। যে এসেছে, সে অবশ্যই ব্রো’র অনুমতি নিয়ে এসেছে। আর ভাবীরা কী গান গাইলো বুঝলি গাধী।
এখন রাহি বুঝতে পারে যে এটা আসলেই রাকিব। রাকিব ছাড়া এমন কাজ কেউ করতে পারে না। সে হঠাৎ করেই রাগে গিয়ে ফেলে দেওয়া লাঠিটা আবার তুলে নেয় আর তেড়ে যায় রাকিবের দিকে।
এদিকে রাকিব বাইক থেকে নেমে রাজ আর রিদের সাথে কুশল বিনিময় করছিলো। এমন সময় রাহী ডেকে ওঠে—
রাকিইব্বাাাাাা….!
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭০
হঠাৎ রাকিব রাহির গলা পেয়ে তাকিয়ে দেখে—রাহি লাঠি নিয়ে দৌড়ে আসছে। অবস্থা খারাপ বুঝে রাকিবও পিছনের দিকে দৌড় দেয়। সামনে একজন মার খাওয়ার ভয় পেয়ে ছুটছে, আরেকজন মার দেওয়ার জন্য তেড়ে যাচ্ছে।
এ দৃশ্য দেখে বাকিরা সবাই হেসে ওঠে।