মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭২
মির্জা সূচনা
ওদের দৌড়াতে দেখে সবাই হাসলেও, রিদ আর রাজ মুখটা গম্ভীর করে রাখল। এমন একখানা ভাব, যেন ব্যাপারটা তাদের মোটেও পছন্দ হয়নি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে —আসলে তো উল্টোটাই! বরং ওরাই সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। তাদের প্রিয় প্রিন্সেস প্রাণ খুলে হাসছে, দৌড়াচ্ছে—এটা দেখে তো তাদের অন্তর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা তো বোঝতে দেওয়া যাবে না! বড় ভাই হিসেবে একটু ভয়-ভীতি তো বজায় রাখতে হবে ভাব-গম্ভীরতা তো নিতেই হবে। বোনের জামাইকে বোঝাতে হবে—আমরা বড়ভাই,আমাদের সামনে এসব চলবে না।
রাজ আর রিদ একে অপরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে নিল। কিন্তু কেউ দেখার আগেই হাসিটা মিলিয়ে গেল হাওয়ায়, আবার গম্ভীর রূপে ফিরে এল তারা।
মেহবুবা, লামিয়া, চুমকি, আরফা,রাহি মেহের ও মেহরিন—মেয়েরা একসাথে দাঁড়িয়ে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে, হাসাহাসি করছে। অন্যদিকে দাঁড়িয়ে একদম কেবলা কান্তর মতো তাকিয়ে দেখছে রাজ, রিদ, শান্ত, লাবিব আর আরশ। অবশ্য তারা দেখবে নাই বা কেন—কতদিন পর সবাই একসাথে এভাবে মন খুলে হাসছে! বাড়ির বাইরে এসে সবাই মুক্ত পাখির মতো আচরণ করছে।
রাজ তার বউকে হাসতে দেখে হঠাৎই বলে উঠল—
—মাশাআল্লাহ!
রাজের কথাতেই সবাই নিজেদের কল্পনা জগৎ থেকে বের হয়। একেকজন তো বউ নিয়ে মনে মনে বিভিন্ন দেশে নেচে আসলো মনে মনে, সবাই এবার রাজের দিকে তাকাল। রাজ তা দেখে হাত উঁচু করে মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে, “হুশ হুশ” করতে করতে হেসে হেসে একটু দূরে চলে গেল। এটা দেখে সবাই আবার হেসে উঠল।
ওদিকে মেয়েরা ও এটা সেটা বলে হাসছিলো চুমকি হাসতে হাসতে বলল—
আল্লাহ মালুম, আজ রাকিব ভাইয়ার কপালে কী আছে!
মেহরিনও হেসে বলল—
কোনো বিপদ নাই! আমি যতটুকু ওদের চিনি, রাহি তেরে যাবে মারতে, আর রাকিব ভাইয়া সেটাকে কাজে লাগিয়ে একটু প্রেম করবে।
মেহরিনের কথায় সবাই হেসে উঠল।
লামিয়া বলল—
তোমরা আসল ব্যাপারটা ধরতেই পারোনি!
সবাই জিজ্ঞেস করল—
কি??
লামিয়া হাসতে হাসতে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ওরা অনেক চালাক, বুঝছো! ওরা একটু একা সময় কাটাবে বলে এই পথ অবলম্বন করল যেন একা একটু টাইম স্পেন্ড করা যায়। তবে হ্যাঁ, আমার মনে হয় রাহি গাধী ব্যাপারটা বুঝেনি। কিন্তু রাকিব ব্রো খুব চালাক! নইলে ভাবো—সে কেন দৌড় দিত? চাইলে তো এখানেই থাকতে পারত। কিন্তু সে কী করল দৌড়ে নিজের পিছু নিয়ে গেল আমাদের রাহিকে, কি বুদ্ধি মাইরি।
লামিয়ার কথায় আরেক দফা হাসির রোল উঠল।
মেহের হাসতে হাসতে বলল—
বাহ বাহ, লামিয়া! তোমার তো ভারি বুদ্ধি—কি সুন্দর ওদের প্ল্যানটা ধরে ফেলেছ!
লামিয়া হেসে উত্তর দিল,
বুঝতে হবে, বস! আর দেখতে হবে না আমি ননদ—কাদের?
লামিয়ার ওই কথায় মেহরিন আর মেহের দুই দিক থেকে তার গাল টেনে একসাথে বলে উঠল
ওলে ওলে, আমার বুদ্ধিমতী ননদিনি রে!
ওদিকে রাহি আর রাকিব তখনও দৌড়াচ্ছে। রাকিব মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে দৌড়াচ্ছে, আর রাহি রাকিবের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে রাকিবের পেছন ছুটছে।
রাহির রাগ হওয়ার অন্যতম কারণ—গ্রামে আসার ঠিক ৬-৭ দিন আগে থেকে তাদের ঝগড়া চলছে। রাগ করে রাহি রাকিবকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে রেখেছিল। এখন রাহির কথা—রাকিব কেন এই ৬–৭ দিনে একবারও কল দিল না, খোঁজ নিল না!
বেশ খানিকটা পথ তারা দৌড়ে এসে গেছে, এখন আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশে শুধু তারা দু’জন।
রাহি হাঁপিয়ে গেছে। একটা মেয়ে কি কোনো ছেলের সাথে কখনো দৌড়ে পারে? না—কখনোই না। আর যদি কেউ পারেও, তবে হয়তো পারতে পারে, কিন্তু রাহি পারে না। তাই সে তার শয়তানি বুদ্ধি কাজে লাগাল—ওই যে কথাটা আছে না, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হয়—রাহিও তাই করবে।
সোজা পথে সে কোনোদিনই এই রাকিব্ব্বাকে ধরতে পারবে না। তাই সে তার কেরামতি বুদ্ধি কাজে লাগাল।
দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ রাহি বসে পড়ল আর চিৎকার করে উঠল। বসে হাতে “ফুঁ” দিতে লাগল।
রাহির চিৎকার শুনে রাকিব থেমে গেল। পিছন ফিরে রাহিকে রাস্তার মাঝখানে বসে, হাতে ফুঁ দিতে দেখে রাকিবের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। কোনো কথা না বলে সে দৌড়ে কাছে এসে বলল—
কি হলো তোমার? পড়ে গেছ? ব্যথা পেয়েছ? কোথায় ব্যথা লেগেছে দেখাও আমাকে? বেশি লেগেছে?
এ সব বলতে বলতে রাহির দুই হাত উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। এর মধ্যেই রাকিবের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের দেখা মিলল।
তা দেখে রাহির ভীষণ হাসি পাচ্ছিল—কিন্তু সে হাসবে না, না কোনোভাবেই এখন হাসা যাবে না।
শুধু হাসি না—ভালোও লাগছে… লাগবে নায় বা কেন? প্রিয় মানুষের মনোযোগ পেয়ে, যত্ন পেয়ে, একটু খানি ভালোবাসা পেলে কার না ভালো লাগে!
কিন্তু এই ভালো লাগাটা টিকল না—রাহির রাগের কাছে হার মানল।
রাহি রেগে কিছু বলতেই যাচ্ছিলো। কিন্তু রাহিকে কিছু বলতে না দিয়েই রাকিব বসে পড়ে রাস্তায়, আর রাহির পা দুটো তুলে নেয় নিজের কোলে। তা দেখে রাহি বাঁকা চোখে তাকায়—সে মূলত বুঝতে চায় রাকিব কী করতে চাইছে।
রাকিব নিজের মতো কাজ করে যাচ্ছে। রাহির পা দুটো নিজের কোলে নিয়ে, একে একে দুটো জুতাই খুলে ফেলে রাকিব। রাহির গায়ের রঙ খুব ফর্সা, আর তাই অনেকক্ষণ জুতো পরে থাকায় পা দুটো লাল হয়ে গেছে। এ দৃশ্য দেখে রাকিব হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে, মনে কথা মনে না রেখে ধমকে উঠে বলে—
সবসময় এমন বাচ্চাদের মতো করো কেন? আমাকে টেনশনে না দিলে ভালো লাগে না তাি না? নাকি চাও তোমার ভাইরা আমাকে গুলি করে মেরে ফেলুক?
রাহির খারাপ লাগে, ভীষণ খারাপ। মনে মনে বলে—
ওহ! আমার ভাইদের ভয়েই এত যত্ন নিচ্ছে, মন থেকে নয়।
অভিমানী রাহি সঙ্গে সঙ্গে পা দুটো নামিয়ে নেয় রাকিবের কোল থেকে।
রাকিব গম্ভীর ভঙ্গিতে বলে—
কি হলো? পা সরাচ্ছো কেন? সবসময় শুধু নিজের মন মতো চলবে তাই না। তোমাকে তো…
বাকিটা আর বলতে পারে না রাকিব। রাহি পাশে খুলে রাখা জুতোগুলো তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারে ধান খেতের মাঝে।
ঘটনাটা এত আকস্মিক হয় যে রাকিব কিছু বুঝতেই পারে না যখন বিষয়টা মস্তিষ্কে ঢোকে, তখন আরও জোরে ধমক দেয়—
এটা কী করলে তুমি! মানে কী এসবের? ভাইরা অতি বড়লোক, তাই কোনো কিছুর দাম নেই তাই না? একটা গেলে দশটা হাজির করবে ভাইরা? তাই সবসময় এমন গা-ছাড়া ভাব তোমার তাই না?
রাহির এবার অভিমান আর রাগ—দুই-ই বেড়ে যায়। রাগ, দুঃখ আর অভিমানে রাহি রাস্তায় বসে পড়ে, হাঁটুর ওপর মুখ গুঁজে কাঁদতে শুরু করে।
তা দেখে রাকিব আহাম্মকের মতো চুপ করে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর সে নিজেও বসে পড়ে রাহির পাশে।
রাহি কাঁদছে আর নাক টানছে।
তা দেখে রাকিব ঠোঁট কামড়ে হাসে, তারপর পকেট থেকে টিস্যু বের করে এগিয়ে দিয়ে বলে
নিন ম্যাডাম এটা অবশ্য কম দামের। আপনার ভাইদের মতো এত টাকা তো আমার নেই, তাই দামি টিস্যুও নেই। এই কম দামেরটা দিয়েই চালিয়ে নেন এবারের মতো। পরে আবার ভাইদের সামনে গিয়ে কাঁদবেন। তখন তারা দামি টিস্যু দিয়ে মুছিয়ে দেবে আপনার চোখের পানি। আর আপনি তখনও আমার নামে ভালো মতো নালিশ করবেন। আর আপনার ভাইরা আমাকে থ্রেট দেবে।
রাহির কান্নার গতি বেড়ে যায়।
সে ভাবে—এই মানুষটা এতদিন কথা বলে নাই, খোঁজ নেয় নাই, এখন দুঃখ কমিয়ে ক্ষমা চাইবার বদলে ভাইদের টাকা নিয়ে খোঁটা দিচ্ছে, অপমান করছে কেমন খারাপ। কী দেখে এই বলদের প্রেমে পড়েছিল কান্না করতে করতে রাহি এগুলোই ভাবছে।
রাহিকে আরও জোরে কাঁদতে দেখে রাকিব আবারও হাসে, তারপর বলে—
পা দুটো মেলে বসে কান্না করেন ম্যাডাম।
রাহি কান্না করতে করতেই মুখ তুলে রাগি চোখে তাকায় রাকিবের দিকে।
তা দেখে রাকিব বুকের ওপর হাত দিয়ে বলে—
আল্লাহ! এভাবে কেউ তাকালে হার্ট ফার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে তো! আল্লাহ আমাকে কী জীবন দিলা? ভাইরা হুমকি দেয়—গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেবে, হাড়-গোড় ভেঙে দেবে। আর বোন এমনভাবে তাকায় যে তাকানোতেই আমার মৃত্যু অনিবার্য।
রাহি যেন রাকিবের কথা শুনছে না—সে কাঁদতেই থাকে।
রাকিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তারপর নিজেই রাহির পা দুটো ঠিক করে সমান করে বসায়, আর তার কোলের ওপর মাথা দিয়ে বলে—
নিন, এখন কাঁদুন ম্যাডাম।
রাহি আরও জোরে কেঁদে ওঠে।
তা দেখে রাকিব জোরে হেসে দেয়।
রাহি আবারও রাগি চোখে তাকায়।
তা দেখে রাকিব চোখ বন্ধ করে নেয়।
রাহি কাঁদতে থাকে।
রাকিব আস্তে করে চোখ খুলে তাকায়—আর তার চোখ আটকে যায় রাহির ঠোঁটে। ঠোঁটে লিপস্টিক লেগে আছে, তাও আবার অর্ধেক খাওয়া।
তা দেখে রাকিব ঠোঁট কামড়ে হাসে, তারপর দুষ্টুমি ভরা স্বরে বলে—
আপনার বড়লোক ভাইরা আপনাকে খেতে দেয় না? আপনার এত দুর্দিন এসেছে যে আমার খাবার খাচ্ছেন আজকাল?
রাহি নাক টেনে বলে—
মানে?
রাকিব রাহির ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে—
এটা জিজ্ঞেস করবেন না, ম্যাডাম। আমি অতি ভদ্র ও সুশীল—এই সুনামে কালি লাগাতে চাই না। আপনি জিজ্ঞেস করলে যদি আমাকে হাতে কলমে বুঝিয়ে বলতে হয়, তবে আপনিই আবার আমাকে দুশ্চরিত্র উপাধি দেবেন।
রাহি কান্না থামিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে নেয় রাকিবের কথার অর্থ।
আর যখন বোঝে, তখন আবারও রাগি চোখে তাকায়।
রাকিব তখন হেসে বলে—
ওমন লুক দিয়ে লাভ নেই। আপনার ওই নরম নরম হাত দিয়ে আমার চুলগুলো একটু টেনে দেন। সাত রাত ধরে ঘুমাইনি—মাথাটা খুব ধরেছে।
রাহি রাকিবের কথা শুনে কান্না না থামালেও রাকিবের কথা মতো চুল টেনে টেনে কাঁদতে লাগল। তা দেখে রাকিব চোখ বড় করে হেসে ফেলে, ধীরে ধীরে বলে,
— পাগলি!
মিনিট পাঁচ রাকিব এভাবেই শুয়ে রইল। তারপর চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে, রাহি এখনও কাঁদছে। রাকিব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে বসল। রাকিবকে উঠতে দেখে রাহি তাকাল তার দিকে। রাকিব সুন্দর করে হেসে তাকাতেই রাহি মুখ ঝাঁমটা দিয়ে অন্যদিকে ফিরি আবার কান্নায় মন দিল। তা দেখে রাকিব হেসে ফেলল, কিন্তু পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে গেল।
এই মেয়ে, কী সমস্যা তোমার? কাঁদছ কেন? হে, তোমার কি জামাই মরেছে নাকি? জামাই মরলেও তো মেয়েরা এখন আর এভাবে কাঁদে না।
রাহি সঙ্গে সঙ্গে বলল,
তুই মরলে আমি এমনিও কাঁদব না।
রাহির কথায় রাকিব বাঁকা হেসে বলল,
ওহ! তার মানে তুমি মনে মনে আমাকে জামাই হিসেবেই ধরে নিয়েছো?
রাহি জবাব দিল,
মোটেও না, তোকে আমি বিয়েই করব না। যে আমার সঙ্গে কথা না বলে সাত দিন থাকতে পারে, সে সারাজীবনও পারবে। আর আমি তার সঙ্গে কথা না বলে প্রতিনিয়ত ছটফট করেছি। এতদিন পর এসে আমায় কেয়ার করার নাটক করছে। আর এখন আমার কান্না থামানোর নাটক করতে আসছে, কারন আমার কিছু হলে আমার ভাইরা তোকে বকবে। বাহ বাহ, কী ভালোবাসা আমার প্রতি!
রাকিব কিছু বলল না, শুধু তার প্রিয়সীর অভিমানী অভিযোগ শুনতে লাগল।
রাহি নাক টেনে বলল,
আমায় একটুও ভালোবাসে না, আমার জন্য একটুও মায়া হয় না। আবার নাটক করে বলে, আমি সেই ছোটোবেলা থেকে তোমায় ভালোবাসি। একটু ভালোবাসি না বলে হুদাই সারাক্ষণ পাশের গলির করিম চাচার কুকুরের মতো চেঁচায়।
রাকিব রাহির কথায় শুধু মিটি মিটি হাসে।
হঠাৎ রাহি রাকিবের দিকে আঙুল তুলে বলল,
তোর থেকে বেশি আমায় ওই শাকিল নামে ছেলেটা ভালোবাসে। রোজ আমায় এক নজর দেখার জন্য ওই গাছে উঠে উঁকি দেয়। ফুসকা ওয়ালা মামাকে পাঠায়। তোর তো কোনো হেলদুলই নাই আমায় নিয়ে। কিন্তু ওই শাকিল রোজ তিনবেলা বিভিন্ন আইডি থেকে এসএমএস দিয়ে জিজ্ঞেস করে আমি খেয়েছি কি না। তুই আমায়—
তার কথা শেষ হবার আগেই
ঠাসসসস!!!!
এক শক্ত হাতের চড় এসে পড়ল রাহির বাঁ গালে।
রাহি গালে হাত দিয়ে সামনে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে, কিন্তু রাকিবের লাল লাল চোখ দেখে আর কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে আবার কান্না শুরু করল।
রাকিব চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
কে এই শাকিল? হে! কবে থেকে তোর পিছু নিচ্ছে? তোর ভাইদের বলিসনি কেন? কী রে? কথা কানে যায় না? বল, কবে থেকে?
রাহিও চেঁচিয়ে উঠল,
বলব না তোকে!
রাকিব আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। রাহির গাল চেপে ধরে বলল,
নিজের ভালো চাইলে তেজ দেখানো বন্ধ করে ভালোয় ভালোয় বল, কে এই শাকিল? আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না, তোর ব্যাপারে আমার এক বিন্দুও ধৈর্য নেই। এখনই বল, নয়তো এখানেই মেরে পুঁতে ফেলব। তোর দুই ভাই আমার কী করবে, সে পরোয়া আমি করব না।
বল বল,কবে থেকে ওই ছেলে পিছু নিয়েছে? তোর দুই ভাই কী করে? ওদের এত লোক থেকে লাভ কী, যদি তোকে নিরাপত্তা দিতে না পারে? এমনই সময় তো মুখ আর হাত ভালোই চালাতে পারো, ওই ছেলেকে কষিয়ে দুটো দিতে পারতে না?
রাহি কিছু বলল না, কাঁদলও না, শুধু স্থির চোখে তাকিয়ে রইল রাকিবের দিকে।
রাকিব এবার রাহির গাল ছেড়ে বাহু শক্ত করে চেপে ধরল,
দেখো রাগিও না, বলো কবে থেকে হচ্ছে এসব? তুমি কেন জানাওনি আমায়?
রাহি বাঁকা ভাবে জবাব দিল,
মানুষকে কীভাবে জানাব? সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি আজ সাত দিন হলো।
রাকিব পাশে থাকা এক গাছের গুঁড়িতে ঘুষি মেরে বলল,
কী দিয়ে যোগাযোগ করব, হে? মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম—সিম—সব জায়গা থেকে আমাকে ব্লক করে রেখেছো। তখন কী আমি তোমাকে ইউটিউব এ গিয়ে কাল দিতাম?
রাহি মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল,
দেখাও করতে পারতো, মানুষ।
রাকিব গর্জে উঠল,
গিয়েছিলাম তোর সাথে দেখা করতে, বুঝেছিস? রাস্তায় তোর দাদাভাইয়ের সাথে দেখা। সে জিজ্ঞেস করল, এমন সময় কেন? আমি বললাম, তোর বোন রাগ করেছে, তাই। সালা আর কোনো কথা না শুনেই আমায় দু’ঘা লাগিয়ে দিয়ে বলল, তোকে যেন আর আমার বোনের আশেপাশে না দেখি, তা না হলে মেরে হাড়গোড় ভেঙে দেব শালা।
তারপর যখন অন্য রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম বাড়ির কাছে যাওয়ার আগেই তোর ভাইয়ার সাথে দেখা। সে তো আরও এক ধাপ উপরে! আমায় দেখে বলল, আমার বোনের রাগ ভাঙাতে যাচ্ছো নাকি? আমি বললাম, হ্যাঁ, ওই আর কি।
এটা বলার সাথে সাথেই সে বলল,
আমার বোন যদি তোমার জন্য কষ্ট পায় বা কাঁদে, তো গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেব। আমার বোনকে কষ্ট দিয়েছো, তাই আগামী সাত দিন আমার বোনের সাথে কোনো দেখা-সাক্ষাৎ হবে না।
তারপরও আমি চেষ্টা করেছি। ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। তোর ভাইয়ার লোকেরা আমাকে দেখে ভাইয়াকে জানিয়েছে, আর সে কল দিয়ে আমায় হুমকি দিয়েছে।
এখন বল, এখানে আমার দোষ কোথায়? আর এতদিনে তুই কিনা কোন ছেলে গাছে উঠে উঁকি দিচ্ছে, সেই গল্প শোনাচ্ছিস!
রাহি মনে মনে ভাইদের উপর রাগ জন্ম নিল, তবে প্রকাশ করল না। মনে মনে ভাবল, এই আগুন আগে নিভাতে হবে।
রাহি বলল,
সে তো, আমার ভাইরা যদি জানে কেউ তাদের বোনকে কষ্ট দিচ্ছে, তাহলে তারা রাগ করবেই, এটাই স্বাভাবিক, নয় কি?
রাকিব আবার তেড়ে এসে বলল,
তা না হয় মানলাম, ওই ছেলের ব্যাপারটা আমি তোর ভাইদের কাছ থেকেই জেনে নেব। তারা তোকে নিরাপত্তা দিতে পারল না কেন?এর জবাবও তাদের দিতে হবে। শুনে রাখ, আমি তোর ভাইদের ভয় পাই না, শুধু সম্মান করি।
রাকিব আর কিছু না বলে রাহির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। রাহি মনে মনে নিজেকে হাজার খানেক গালি দেয়— কেন এত কথা বলতে গেলাম!
হঠাৎ রাহি বলে ওঠে,
— শুনছেন স্যার?
রাকিব থেমে যায়, ঘাড় ঘুরিয়ে রাহির দিকে তাকায়। রাহি দাঁত বের করে হেসে বলে,
আমি আইসক্রিম খাবো।
রাকিব আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
এখানে দোকান নেই, সামনে পেলে কিনে দেবো।
রাহি বুঝতে পারছে না, এখন কী করবে। পায়ে হালকা তাপ লাগতেই মাথায় বুদ্ধি আসে। হঠাৎ মুখটা কাদুকাদু করে বলে,
উফ্! রাস্তা অনেক গরম, আমি হাঁটতে পারছি না, পা পুরে গেলো।
রাকিব সাথে সাথে নিজের জুতো খুলতে যায়, কিন্তু রাহি বাধা দিয়ে বলে,
কী করছো তুমি? জুতো খুলছো কেন? আমার কি তোমার মতো হাতির পা? ওই জুতো পরলে আমি উস্টা খেয়ে রাস্তার মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়বো।
রাকিব রাহির এই দুষ্টুমি বোঝে, মনে মনে হেসে আবার জুতো পরে নেয়। এরপর রাহিকে তুলে নেয় কোলের মধ্যে। রাহি ও গলা জড়িয়ে ধরে, রাকিব তার দিকে একবার তাকায়, আবার সামনের দিকে চোখ ফেরায়।
ওইইই শোনো না! — রাহি বলে ওঠে।
রাকিব গম্ভীর গলায় বলে,
আর একটা বাড়তি কথা বললে ফেলে দেবো।
রাহি হাসিমুখে জবাব দেয়,
ফেলে দাও, আমার কোমর ভাঙলে তোমারই লস। লোকেরা বলবে, রাকিবের বউ কোমর ভাঙা, তাতে তোমারই বদনাম হবে।
রাকিব বিড়বিড় করে বলে,
— নাটকবাজ!
রাহি শোনেও শোনেনি এমন ভান করে বলে,
আসলে সাকিল হচ্ছে একটা কল্পনা। তুমি তো আমার সাথে কথা বলো না, যোগাযোগ করো না, তাই আমি ভেবেছিলাম তুমি এমন করেছো। মানে ওই যে গাছে উঠে আমাকে একটু দেখবে, আমার জন্য ফুচকাওয়ালাকে পাঠাবে অন্য id খুলে আমাকে নোক দিবে— এসব আমি ভেবেই সেই কল্পনাটাকে শুধু একটা ছেলের নাম দিয়েছিলাম, হি হি হি!
রাকিব হতাশ গলায় বলপ— এই মেয়ে কী বলে! আমায় রাগানোর জন্য আমাকেই নিয়ে কল্পনা করে আমার সতীন বানিয়ে ফেললো!
আর ওইসব বলার জন্যই যে মাইরটা খেলে!
হঠাৎ রাহির মনে পড়ে যায়— রাকিব তাকে থাপ্পড় মেরেছিল। মুখটা কালো হয়ে যায় অপমানে। অপমানটা রাকিব মেরেছে বলে নয়— মেহরিন, চুমকি, মেহবুবা, লামিয়া মেহের— এরা স্বামীর হাতে মার খায়, আর সে কি না হবু বর-এর হাতে থাপ্পড় খেলো! এই ভাবনায় মনটা ভারী হয়ে যায়।
ওদিকে রাকিব দেখে রাহির মুখ কালো হয়ে গেছে। সে বলে,
— আই অ্যাম সরি, আমি আসলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।
রাহি আনমনে বলে,
— হ্যাঁ, জানি।
রাকিব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রাহি ভাবছিল— আমি কি তবে জামাই পেটানোর যুদ্ধে হেরে গেলাম? নাকি পিছিয়ে গেলাম?আমি কী এই হাতিকে মারতে পারবো না?
এইসব ভাবনার মাঝেই রাকিব হঠাৎ এমন এক কাজ করে বসে, যাতে রাহি একদম জমে যায়— রাকিব রাহির বাঁ গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নেয়! রাহি গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকে, আর দেখে রাকিব রাহিকে শিশুর মতো কোল থেকে উপরে ছুঁড়ে দেয়।
ভয়ে রাহি বলে ওঠে,
ও বাবা গো!
রাকিব আবার ধরে ফেলে, হেসে ওঠে। রাহি রাগে বলে,
এখনই তো পড়ে মরে যেতাম আমি, বেয়াদপ!
রাকিব রাহির নাকে নিজের নাক ছুঁইয়ে বলে,
আমার দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে, ততক্ষণ আপনার কিছু হতে দেবো না। আল্লাহ ছাড়া কারো বাবার সাধ্য নেই আপনার ক্ষতি করার।
রাহি মুখ বাঁকায়, রাকিব হাসে। রাহি শক্ত করে রাকিবের গলা ধরে থাকে।
তা দেখে রাকিব দুষ্টু কিছু কথা বলে, যা শুনে রাহির কানের কাছে যেন গরম হাওয়া বের হয়— লজ্জায় রাহি রাকিবের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে। রাকিব হেসে বলে,
যার কথায় লজ্জা পাও, লজ্জার হাত থেকে বাঁচতে আবার তার বুকে মুখ লুকাও— বাহ্ বাহ্!
রাহি এক হাতে কিল মারে রাকিবের বুকে, রাকিব হাসতেই থাকে। এরপর সে পা বাড়ায় সবার কাছে যাওয়ার জন্য।
যেতে যেতে আবার গান ধরে—
আমার গরুর গাড়িতে-বউ সাজিয়ে…!!
তুতুর তুততুর তুতুর তো, সানাই বাজিয়ে!!
যাবো তোমায় শ্বশুরবাড়ি নিয়ে…!!
রাহি রাকিবের বুকে মুখ গুঁজে, গলা জড়িয়ে থাকে। ওদিকে বাকিরা যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রাহিকে রাকিবের কোলে দেখে সবাই মুখ টিপে হাসছে।
মেহরিন টিককারি করে বলে উঠল—
তা কী গো ননদাই, আপনি গেলেন দৌড়ানি খেয়ে, আর ফিরলেন আমার ননদিনিকে কোলে নিয়ে ব্যাপার কী?
এর মধ্যে মেহের এসে বলে—
আরে বুঝিস না? ননদীনির মাইর ‘ওভার ডোজ’ খেয়েছে, আর সেই ওভার ডোজ যে দিয়েছে সে এখন দুর্বল। তাই তো কোলে করে নিয়ে আসতে হলো। তাই না?
হেসে উঠল সবাই।
রাকিবও কম যায় না, এদিক ওদিক তাকুয়ে দেখে রাজ, রিদ বা লাবিব কেউ নাই— সুযোগ বুঝে সেও বলে—
আসলে কি যে বলবো ভাবীগণ? আপনাদের ননদীনি তো ভিটামিন প্রেমের অভাবে ভুগছিল। আমি আবার খুব দয়ালু, কাউকে তো অসুস্থ হতে দিতে পারি না। তাই একটু ভিটামিন প্রেম দিলাম, মনে হয় ওভার ডোজ হয়ে গেছে। যা আপনার অতিনাজুক ননদীনির সহ্য হল না। তাই অতিরিক্ত ভিটামিন সেবনের কারণে অসুস্থ বোধ করছিল, তাই আমি কোলে করে নিয়ে এলাম— এই আর কি!
রাকিবের কথা শুনে সবাই হেসে দিল।
আর রাহি ধুম করে এক কিল বসিয়ে দিল, আর নেমে গেল রাকিবের কোল থেকে।
সাফাই দিয়ে বলল—
আরে না না, এসব বাজে কথা। আসলে আমি রাগে জুতো ধানক্ষেতে ছুঁড়ে মেরেছিলাম, আর রাস্তাও অনেক গরম ছিল, তাই ও আমাকে কোলে করে এনেছে— এই আর কি!
রাহির কথার বিপরীতে সবাই বলে উঠল—
“ওওও”
রাকিব রাহিকে রাগাতে বলল শুধু কোলে করে নিয়ে এসেছি নাকি? সাথে তো…
এতটুকু বলতেই রাহি রাকিবের পেটে কুনুই দিয়ে এক গুঁতা মারল।
রাকিব হেসে ফেলল, সাথে বাকিরাও।
চুমকি বলে উঠল—
আচ্ছা থাক, আমরা বুঝেছি— তোমরা প্রেম প্রেম খেলতে এসেছো। সে যাগ্গে এখন চল, আমরা রওনা দেই।
রাহি এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। গাড়িতে বাড়তি জুতো আছে।
এতক্ষণে রাজ, রিদ আর লাবিবও এসে গেছে তারা আসলে কোথায় গিয়েছিল কেউ জানে না।
রাজ সবাইকে তাড়া দেয়—
চলো চলো, এখন যাওয়া যাক।
সবাই তাদের পার্টনার নিয়ে রেডি।
হঠাৎ আরফা রাজের কাছে এসে বলে—
ভাইয়া, আমি বাড়ি চলে যাই। আমার ভালো লাগছে না, আর তোমরা সবাই জোড়া জোড়া— আমি সেখানে গিয়ে কি করব? এতক্ষণ না হয় রাহি ছিলো। এখন তো তারও জোড়া চলে আসছে। আমি একা যাব না। আর আমি বাইক চালাতে পারি না— আমি যাব কার সাথে?
এমন সময় কেউ একজন বলে উঠল—
আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবে আপনি আমার সাথে যেতে পারেন, ম্যাডাম।
সবাই পেছনে ফিরে তাকায়। সামনে দাঁড়ানো লোকটাকে দেখে রাজ আর মেহরিনের মুখে ফুটে ওঠে বাঁকা হাসি।
আরফা অবাক হয়ে বলে—আপনি এখানে?
সামনের লোকটি মৃদু হেসে বলে—
জি, আমিও আপনাদের সঙ্গেই যাচ্ছি।
এর মধ্যেই লামিয়ার গলা পাওয়া যায়—
হেই জীবন ব্রো ? তুমি আসবা, কেউ বলল না তো— ওয়াটা প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ, ব্রো!
জীবন লামিয়ার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে—
অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি, তাই চলে এলাম। আর কদিন পর তো আমার বনুর বিয়ে আমি না এসে পারি? তাই তো তাড়াতাড়ি চলে এলাম।
লামিয়া হেসে আবার বলে—
ইয়েস অফ কোর্স। কিন্ত দেশে কবে আসছো?
জীবন বলে—
দেশে এসেছি কালকে, আর আজ আমি তোমাদের সামনে!
লামিয়া আবার বলে—
কাওসার ব্রো আসেনি?
জীবন বলে—
না রে, ও আসবে আরও ৩ দিন পরে।
ওহ আচ্ছা, সে যাই হোক, তুমি আসায় আমি খুব খুশি হয়েছি, বলে লামিয়া।
জীবন এক নজর তাকায় আরফার দিকে, তারপর এগিয়ে যায় সবার কাছে।
প্রথমেই লাবিবকে জড়িয়ে ধরে বলে—
— কংগ্রেস ব্রো!
লাবিবও হেসে জড়িয়ে ধরে বলে—
থ্যাঙ্কস, ব্রো— অ্যান্ড অল দ্য বেস্ট!
জীবন হেসে আরও সবার সাথে কুশল বিনিময় করে।শেষে রাজের কাছে এসে রাজের পেটে ঘুষি মেরে বলে—
হাই দোস্ত, হোয়াটস আপ, আফটার লং টাইম!
রাজও জীবনের পেটে একটা মেরে বলে—
— ইয়েস ব্রো!
ওদের এই মারামারি দেখে মেহরিন বলে—
আপনারা এমন জিব জন্তুর মতো মারামারি করছেন কেন?
রাজ কিছু বলার আগেই জীবন বলে ওঠে—
ওগুলো ভালোবাসা, ভাবী!
মেহরিন মাথা নেড়ে বলে—
আহা, কত যে ভালোবাসার ধরন দেখি, আর কী কী দেখবো জীবনে আল্লাহ মালুম।
রাজ আর জীবন দু’জনেই হেসে ওঠে।
জীবন ফের বলে—
আসসালামু আলাইকুম, ভাবী, কেমন আছেন?
মেহরিন সালামের জবাব দিয়ে বলে—
আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, আপনি?
জীবন পেছনে তাকিয়ে বলে—
—আল্লাহ যেমন রেখেছে।
মেহরিন হেসে বলে—
ভালো থাকা না থাকা কিন্তু আমাদের হাতে। চাইলে একটু পরিশ্রম করে নিজেরাই ভালো থাকতে পারি।
জীবন মাথা চুলকে বলে—
পরিশ্রম করার জন্যই তো মালয়েশিয়া থেকে এত দূরে বাংলাদেশে আসা!
ওদের কথার রহস্য কেউ না বুঝলেও মেহের কিছু আন্দাজ করতে পারে।
সবাই কুশল বিনিময় শেষ করে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
তবে আরফা দাঁড়িয়ে থাকে। সেটা দেখে মেহরিন ওর কাছে যায়—
কি হয়েছে, আরফু?
আরফা বলে—
আমার না, যেতে ইচ্ছে করছে না, মেহু আপু। তোরা যা আমি না হয় বাড়ি চলে যায়।
মেহরিন ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে—
আমরা সবাই একসাথে এসেছি, আর যাবোও একসাথে।
আরফা কিছু বলতে চাইলে মেহরিন বোঝায়—
তুই জীবন ভাইয়াকে চিনিস। সামান্য বাইকে উঠবি— অসস্থি হলে মনে করবি তুই কোন রাইডারের সাথে যাচ্ছিস শেষ। আর তোর কী মনে হয় জীবন ভাইয়া ভালো মানুষ, না হলে তোর ভাইয়া ওনার সাথে তোকে পাটাতে রাজি হত? আর তার পরও যদি তোর কিছু মনে হয় সঙ্গে সঙ্গে আমাকে কল দিবি।
আরফা মাথা নেড়ে রাজি হয়।
মেহরিন যখন আরফাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, তখন জীবন ওদের দিকে তাকিয়ে হাসে।
জীবন বলে—
ম্যাডাম, আপনার অনুমতি পেলে আমরা ও যাই।
আরফা মাথা নেড়ে উঠে বসে, তবে জীবনকে না ধরে পেছন থেকে ধরে।
জীবন সেটা দেখে বাঁকা হাসে, জীবন সামনের দিকে দেয় একটান— আর সাথে সাথে আরফা পড়ে যায় জীবনের পিঠে।
জীবন হেসে বলে—
ম্যাডাম, আমার শরীরে ময়লা লেগে নেয়— আসার আগে ১ ঘণ্টা সময় নিয়ে সাওয়ার নিয়েছি, তাও ডেটল সাবান দিয়ে!
জীবনের কথা শুনে আরফা না চাইলেও হেসে দেয়। আর সেই হাসিতে কেউ আবার ঘায়েল হয়।যে হাসির মায়ায় পড়েছিল ২ বছর আগে, তা যেন আবার নড়ে ওঠে।
জীবন বলে—
ম্যাডাম…
আরফা জবাব দেয়—
হুম..!
— ধরে বসুন!
আরফা কাঁপা কাঁপা হাতে জীবনের কাঁধে হাত রাখে। সাথে সাথে জীবনের শরীরে এক ঝাঁকি লাগে। আরফা ও তা উপলব্ধি করে।
আরফা চিন্তিত কণ্ঠে বলে—
কি হলো? আপনি কি অসুস্থ?
জীবন কাঁধে রাখা আরফার হাতের দিকে এক নজর তাকিয়ে বলে—
না ম্যাডাম, না… না চাইতেও অনেক কিছু পেয়ে গেলে যা হয় আর কি! সে যাই হোক, আপনি আমাকে ধরে বসুন— আমরা এখন উড়াল দেব।
আরফা ধরে বসে, আর জীবন বাইক চালাচ্ছে এত জোরে যে আরফা হাত কাঁধ থেকে সরিয়ে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।
জীবন মনের আনন্দে ছুটে চলেছে…
ব্যপার খানা দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে ৭টি বাইকে ৭ জোড়া কাপল, আর তাদের পিছনে ৭টি গাড়ি। পুরো রাস্তার উপর যেন তাদেরই আধিপত্য। বাইকারদের পেছনে ছুটছে গাড়িগুলো। রাস্তার মানুষজন দেখে অনেকেই ভাবছে—হয়তো কোনো নেতা-ফেতা হবে। যাই হোক, প্রায় ৩০–৪০ মিনিটের মধ্যেই তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেল।
জায়গাটা একেবারে রিসোর্টের মতো—নিরিবিলি, কোলাহলমুক্ত, আশেপাশে অনেক মানুষ ঘুরছে, ছবি তুলছে, আড্ডা দিচ্ছে তবে তেমন সারা শব্দ নেয়। দুপুর ২:৫০ বাজে, তাই সবারই বেশ খিদে পেয়ে গেছে। সবাই একটু এদিক-ওদিক ঘুরতে গেল, আর রাজ আর রিদ গেল খাবারের অর্ডার দিতে। ছেলেরা গেলো হালকা হতে।
মেয়েরা সবাই গল্প করছে, হাঁটছে—হঠাৎ মেহরিনের চোখ পড়ল দূরে, যেখানে এক লোক একটা বাচ্চাকে মারছে। বাচ্চাটার বয়স কত হবে ১২–১৩, হাতে কোল্ড ড্রিঙ্কসের ট্রে। লোকটা কী যেন বলছে আর মারছে, বাচ্চাটা কাঁদছে।
মেহরিন সবাইকে বলে উঠল—
তোমরা দাঁড়াও, আমি আসছি।
বলে সোজা ছুটে গেল বাচ্চা আর লোকটার দিকে। লোকটা আবার হাত তুলে মারতে যাবে, ঠিক তখনই মেহরিন লোকটার হাত ধরে ফেলল।
লোকটা ক্ষেপে উঠল—
ঘুরতে এসেছেন, ঘুরুন, ফিরুন খান, আর চলে যান। আমার কাজে বাধা দেবেন না।
মেহরিন লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে বাচ্চাটাকে জিজ্ঞেস করল—
কী হয়েছে বাবু? উনি তোমাকে মারছেন কেন?
বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে বলল—
উনি অন্যদের খাওয়া কোল্ড ড্রিঙ্কস আবার নতুন বোতলে ভরে বিক্রি করছিলেন। আমি দেখে বাধা দিয়েছি, উনি আমাকে অনেক বকা দিয়ে মেরেছেন। এখন একজন আমাকে টিপস দিয়েছিলেন, সেটা উনি নিতে এসেছেন। আমি না করেছি, তাই উনি মারছে।
মেহরিনের ঠাণ্ডা মেজাজ মুহূর্তেই গরম হয়ে গেল—প্রথমত্ব বাচ্চাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে, তার ওপর পর্যটকদের নোংরা খাবার খাওয়াচ্ছে, আর শেষে দিব্যি ডাকাতির মতো আচরণ!
তবুও সে নিজেকে শান্ত রেখে কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই লোকটা আবার বাচ্চাটাকে থাপ্পড় মারতে যায়। মুহূর্তেই মেহরিন তার হাত মুচড়ে ধরে বলল—
আপনার তেজ খুব বেশি মনে হচ্ছে? এই তেজ কমতে আমার দুই মিনিটও লাগবে না। এমন মার মারব, এক মাস হাসপাতালের বেডে পড়ে থাকবেন!
বলে হাত ছেড়ে দিল।
লোকটা ক্ষেপে উঠে বলল—
আপনি কিন্তু মাত্রা ছাড়াচ্ছেন! মহিলা মানুষ বলে কিছু বলছি না…
তার গলার আওয়াজে আশেপাশের সবাই জড়ো হয়ে গেল। মেহের এসে বলল—
তা না হলে কী করতি তুই?
লোকটা অবাক হয়ে একবার মেহরিনের দিকে আর একবার মেহেরের দিকে তাকাছে…
যখন বোঝলো ওরা জমজ, তখন লোকটা বিরক্ত মুখে বলল—
দেখুন, আপনারা এখানে ঘুরতে এসেছেন, ঘুরুন, খেয়ে চলে যান, এসব ঝামেলায় না জড়ানোই ভালো। আর মহিলাদের অত চোপা না থাকাই ভালো।
লোকটার এই কথা শুনে চমকে উঠল মেহবুবা, লামিয়া, রাহি আর আরফা—তারপর হু হা করে হেসে দিল, সঙ্গে মেহরিন আর মেহেরও হাসি চেপে রাখতে পারল না। লোকটা বিরক্ত হয়।
মেহরিন সরাসরি সেই বাচ্চাটার কাছে গিয়ে তার চোখ মুছে দিল, হাতে থাকা ট্রেটা পাশে রেখে জিজ্ঞেস করল—
তুমি কাজ করছো কেন? এটা তো পড়াশোনা করার বয়স, বাবু।
বাচ্চাটা কাঁদো গলায় বলল—
আমি পড়ি তো। ক্লাস ৫-এ পড়ি, কিন্তু রোজ স্কুলে যাই না—সপ্তাহে ২-৩ দিন যাই।
তার কথা শুনে সবাই অবাক। মেহরিন জিজ্ঞেস করল— কেন? বাকি দিন এখানে কাজ কর তাই?
বাচ্চাটা মাথা নাড়ল সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে। রাহি প্রশ্ন করল— তুমি কেন কাজ কর। তোমার আব্বু নেই?
ছেলেটা হেসে বলল—
না, আমার আব্বু তো অনেক আগেই মারা গেছেন। আগে আম্মু কাজ করত, কিন্তু কয়েক মাস ধরে আম্মু অসুস্থ—বিছানায় শুয়ে থাকে, উঠতে পারে না। তাই আমি এখানে কাজ করি। রাতের বেলা যাওয়ার সময় খাবার কিনে নিয়ে যাই।
সবাইয়ের মন খারাপ হয়ে গেল। ভাবল—এত সুন্দর একটা ছেলে যদি ধনী পরিবারের ঘরে জন্মাত, তাহলে হয়তো আজ রাজপুত্রের মতো থাকত। কিন্তু ভাগ্য… বাবাটা বেঁচে থাকলে হয়তো এই বয়সে ওকে কাজ করতে হতো না।
ঠিক তখনই সেই লোকটা আবার এসে বাচ্চাটাকে এক চড় মারল—
বড়লোক দেখলেই তোমার দুঃখের কাহিনি শুনিয়ে টাকা হাতানোর ধান্দা, তাই না?
এই কথা শোনামাত্রই মেহরিন নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে লোকটাকে এক চড় মারল। মেহের তো হাত নিশপিশ করছিলই—সে-ও সঙ্গে সঙ্গে অপর গালে দ্বিতীয় চড়টা দিল। দুই বোনের চড় খেয়ে লোকটার শুধু মাথা নয় যেন দুনিয়াই ঘুরে গেল।
লোকটা নিজেকে ধাতস্থ করেদাঁত চেপে বলল,
ভালো করলি না, তোরা বা*ন্দীর বাচ্চারা! তোরা চেনিস আমি কে? পর্যটক বলে এতক্ষণ অনেক ভদ্রতা দেখিয়েছি, আর নয়।
মেহের দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল—
তুই আমার কোন চে*টের বা*ল হে, শালা?তুই কে হে? বল তো, শোনি। তুই যা-ই হ, তুই কেন তোর বাপ আসলেও আমাদের একটা চুলও বাঁকা করতে পারবে না, বুঝেছিস, শালা টাকলা চামচিলা বা*ন্দীর পোলা!
প্রথমে মার, তারপর এইরকম গালিগালাজ শুনে লোকটা চরম অবাক। মেহেরের গালি শুনে আরফা আর রাহি ফিক করে হেসে দিল।
আরফা বলল—
তুই তো দেখি ছেলেদের মতো গালি দিস।
তারপর মজা করে জিজ্ঞেস করল—
আচ্ছা মেহের আপু, সত্যি করে বল, এইসব বাংলা গালি কোথা থেকে শিখলি তুই?
মেহের হেসে বলল—
আর বলিস না, আমি যাদের কেলাতে যেতাম, শালারা সবাই গালিবাজ ছিলো। ওদের গালি শুনতে শুনতে আমিও গালিবাজ হয়ে গেছি।
মেহেরের উত্তর শুনে সবাই হেসে উঠল। ওদিকে চুমকি একটা কথা বলে দিল লোকটাকে রাগিয়ে—
তবে তুই ঠিকই বলেছিস, এই লোকটা সত্যিই টাকলা।
বলেই চুমকি হা হা করে হেসে দিল—চুমকির সঙ্গে যোগ দিল আরফা, লামিয়া, রাহি, মেহবুবা আর সেই বাচ্চাটাও। কিন্তু লোকটার মাথা গরম হয়ে গেল। এই টাক নিয়ে সে কোন কথাই সহ্য করতে পারে না। কত যে তেল-ওষুধ মেখেছে, চুলের জন্য কিন্ত এই টাকের গোড়ায় কিছুতেই চুল উঠলো না।
লোকটা চুমকির দিকে আঙুল তুলে বলল—
এই বা*ন্দীর বাচ্চা, তুই আমায় টাকলা বললি কেন?
চুমকি তো ভীষণ রেগে গেল সঙ্গে সঙ্গে। তাকে গালি দিল,চুমকি মেহরিনের বেস্ট ফ্রেন্ড—কিন্তু লোকটা তো আর তা জানে না। চুমকি বলল—
— শা*লা টাকলা, তোকে তো আমি বলেই সে এদিক ওদিক চোখ বুলাই কিন্তু কাঙ্খিত জিনিসটি পেলো না। চোখে পড়ে সামনের রাখা কোল্ড ড্রিঙ্কসের ক্যানে সেটাই হাতে নিয়ে সরাসরি ওর দিকে ছুড়ে মারল ওই লোকের টাকে।
এ দৃশ্য দেখে আশেপাশের মানুষও হেসে উঠল। লোকটার রাগ চরমে উঠল—সে সঙ্গে সঙ্গেই ফোন বের করে কাউকে কল করল, গালাগাল দিয়ে বলল—
— এখনই এখানে চলে আয়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ১০-১২ জন ছেলে এসে হাজির। তাদের অবস্থা দেখে মনে হল, সারাদিন নেশায় ডুবে থাকে—হালকা ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে।
ওদের দেখে লোকটা চিৎকার করে বলল—
এই বা*ন্দীর বাচ্চাগো, অনেক দেমাক ওগো দেমাগো জায়গা মতো ভইরা দে।
এ কথা শুনে মেহরিনরা সবাই বাঁকা হেসে দিল। মেহের বলল—
— Come, come, hit me!
একজন এগিয়ে আসতেই মেহের এক ঘুসি মারল—সে উল্টে পড়ে গেল।
লামিয়া এয়্যা… হু! বলে মার্শাল-স্টাইল কিক মারল একজনকে।
রাহি আর চুমকি মিলে একজনকে ফেলে মন মতো কেলাচ্ছে। আরফা সাইডে দাঁড়িয়ে সব দেখছে—সে মারামারিতে যায় না।
ওদিকে মেহবুবা একজনের চোখ টিপ দেয়, তা দেখে ছেলেটা চুলে হাত বুলাতে বুলাতে কাছে গিয়ে বলল—
আমি আগেই জানতাম তুমি খুব ভা…
কথা শেষ করার আগেই মেহবুবা সেই ছেলের জায়গা মতো এক কিক মারল। সেই কিক খেয়ে ছেলেটার চোখ উল্টে গেল, নিজের নিম্নাঙ্গ ধরে কাতরাতে লাগল বেচারা।
মেহরিন হাসতে হাসতে এগিয়ে যায় ওই লোকটার কাছে আর বলে—
খুব শক না মেয়েদের গালি গালাজ করার!
এ কথা বলেই লোকটার কন্ঠনালীতে একটা ঘুষি মারে, তারপর গালে ও পেটে কয়েকটা ঘা লাগায়। সব শেষে মেন যায়গায় একটা লাথি দিতেই লোকটা কাতরাতে নিচে পড়ে যায়।
ওদিকে একজন তেড়ে আসে মেহরিনকে মারতে। সেটা দেখে বাচ্চাটা চিৎকার দিয়ে বলে,
আপামনি! আপনার পিছে!
মেহরিনও পেছনে ফিরে তাকায়, আর তেড়ে আসা ছেলেটাকে ধরে নিয়ে ইচ্ছামতো কয়েকটা ঘা বসিয়ে দেয়।
মেহরিন ঘুরে ঘুরে মারছে আর তা বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে,অন্য এক দেশে। অন্ধকার ঘরে পায়ের ওপর পা তুলে বসে ওয়াল ঘেঁষে বিশাল এক টিভিতে এসব দেখছে এক লোক। লোকটার ঠোঁটে হালকা হাসি, হঠাৎ গম্ভীর গলায় সে বলে—
আহা! তোমায় যত দেখি, ততই প্রেমে পড়ি। একজন মানুষ ঠিক কত ভাবে আকর্ষণ করতে পারে বলো তো?
কেউ দেখে বুঝতেও পারবে না তুমি দুই বাচ্চার মা। উফ… এখনও কি সুন্দর দেখতে তুমি।
কবে দেখা দেবে তুমি?
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭১
তোমাকে এক নজর দেখার ইচ্ছে যে আমার বেড়েই চলেছে। যখন দেখা হবে, তখন আমি তোমায় আমার করে নেব। প্রয়োজন হলে তোমার ওই দুই ছেলে-কেও আমার করে নেব। তোমাকে আমি চাই!
তুমি দুই বাচ্চার মা হও বা বিশ বাচ্চার—আমার তাতে কিছু যায় আসে না।
ওই শালা রাজ মাত্র পাঁচ বছর হলো তোমায় চিনি। ওই শালা এসে আমার জিনিস ছো মেরে নিয়ে গেল!
আর তুমি—আমার দীর্ঘ ১১ বছরের ভালোবাসা—আমি তো তোমায় ওর হয়ে থাকতে দেব না।
যেমন করে আমার কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়েছে ও, তেমন করেই আমিও ওর কাছ থেকে তোমাকে আর ওর সন্তানদের কেড়ে নেব।
এ কথা বলেই লোকটা ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে। কী ভয়ঙ্কর সেই হাসি! পুরো ঘরে সেই হাসির প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে, আর তা আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে।