মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭৩
মির্জা সূচনা
গা শিউরে ওঠার মতো হাসি হেসে লোকটা হঠাৎ মুখ গম্ভীর করে ফেলল। ক্রোধে ফেটে পড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল—
কোনো জা*নোয়ার বাচ্চাকে আমি ছাড়ব না, যার জন্য আমি তোমাকে হারিয়েছি। যাদের জন্য আমি তোমাকে জয় করার আগেই রাজ নিয়ে গেলো।
তারপরই গলার স্বর অদ্ভুত কোমল হয়ে এল—
মেহু, তুমি কী জানো?… তুমি আমার যৌবনে পদার্পণ করা বয়সের প্রথম ভালো লাগা, প্রথম ভালোবাসা। জানো, তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম, আমি যেন থমকে গিয়েছিলাম। তোমাকে দেখার পর কত রাত ঘুমাতে পারিনি… তোমার সেই বাচ্চা বাচ্চা মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠত। মনে পড়ে যেতো, দু’টো বেনি করে স্কুল ড্রেস পরে চুমকির সাথে খুনসুটি করতে করতে স্কুলে যাওয়ার দৃশ্যটা… মনে হতো, যেন স্বপ্ন দেখছি। কতদিন যে সপ্নের মধ্যেই তোমাকে ডেকে ডেকে ঘুম ভেগে যেতো।
লোকটা নিজের চোখ দুটো বন্ধ করে স্মৃতির গভীরে হারিয়ে গেল।
মনে আছে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
একদিম রাস্তার ধারে এক ছেলেকে উল্টে ফেলে কি মার টাই না মারলা তোমরা দুষ্টু দুই বান্ধবী? কিংবা ওই যে একবার তুমি আর চুমকি মিলে খায়রুল নামে এক লোকের গাছ থেকে কাঠ গোলাপ ফুল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়তে পড়তে দৌড়ে পালানো? তখন তোমার সেই প্রিয় নীল জুতোগুলো হারিয়ে গেল— কিন্তু আসলে তোমার জুতো গুলো হারাই নি। তুমি দৌড়ের মাঝে ফেলে দিয়েছিলে, যাতে দ্রুত পালাতে পারো। আর সে জুতো তোমার প্রিয় হওয়ায় আমি আমার কাছে রেখে দিয়েছিলাম। তখন তোমার পার্সনাল বডি গার্ডের মতো তোমায় পিছু করতাম কি না। জানো ভালোই লাগতো তোমার সব কিছুর সাক্ষী হতে পেরে।
ইসসস কতই না দুষ্ট ছিলে তুমি।
কথা শেষ হতেই আবার হেসে উঠল লোকটা। মজার ব্যাপার— সে যখন হাসে, তার চোখদুটো ছোট ছোট হয়ে যায়, যেন তার সাথে চোখও হাসছে।
আমার ছোট পাগলিটা ছোটবেলা থেকেই ভীষণ দুষ্টু, একেবারে প্রান খোলা আর গুণ্ডি…তখনও সব কিছু দাপিয়ে বেড়াতো আর এখনও।
এবার সে বিশাল এক আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আয়নার সামনে দারিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল— পরনে সাদা রঙের পাঞ্জাবি, কালো প্যান্ট, সাথে গায়ে জড়ানো একখানা কালো শাল। দেখতে যেন নব্বই দশকের কোনো জমিদার লাগছে। গায়ের অতিরিক্ত ফর্সা রঙে তাকে যেন রাশিয়ানদের মতো লাগছে,তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস হচ্ছে তার চোখ জোড়া চোখের মণি— অদ্ভুত গভীর ও কালো, কিছু মানুষ আছে না যাদের চোখের দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা যায় না।তার চোখেও এমন এক টান যা থেকে দৃষ্টি সরানো কঠিন আবার বেশিক্ষন সেই চোখের পানে তাকিয়ে থাকাও দায়। ঠোঁটগুলো হালকা গোলাপি, যেন লিপবাম লাগানো। চুল গুলো সিক্লি তবে একটু বড় বাবরি চুল যাকে বলে আর কী।
চুল গুলো হাতের সাহায্যে পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে, আয়নার দিকে তাকিয়ে সে হেসে বলে উঠল—
দেখো মেহু, আমি কত রূপে সাজাই নিজেকে, শুধু তোমার জন্যই। কারণ তুমি তো ভালোবাসো কল্পনার জগৎ— তাই আমি চেষ্টা করি তোমার স্বপ্নের রাজকুমার হতে। কখনো নব্বই দশকের জমিদার, কখনো রাজকুমার, কখনো আধুনিক ডিজাইনে সাজাই নিজেকে… যাতে আমি তোমার মনমতো হয়ে উঠতে পারি।
তার চোখে এক ধরনের উন্মাদ ভালোবাসার ঝলক—
হয়তো তুমি বলবে আমি পাগল। বলো তাতে ক্ষতি নেয় কিন্তু জানো, আমার এই জীবনটা আমি বহু বছর আগেই তোমার নামে সঁপে দিয়েছি। তোমার জন্যই বেঁচে আছি আমি… নইলে, অনেক আগেই আমি রাস্তার ধারে লাশ হয়ে পড়ে থাকতাম। কে জানে— হয়তো শেয়াল-কুকুর আমার শরীর ছিঁড়ে খেত, কেউ কবরও দিত কি না সন্দেহ…
হঠাৎ করেই লোকটা বুকের বাঁ পাশে হাত রাখল। ভাঙা গলার স্বরে বলল—
এই একটা জায়গা,যেখানে শুধু তোমার স্থান। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কি জানো মেহু? আজ তুমি অন্য কারো স্ত্রী… অন্য কারো সন্তানের মা…
ভালোবাসি আমি তোমাকে, অথচ তুমি অন্য কারো! কী ভাবছো এসব দেখে কি আমি তোমাকে ভালোবাসা ছেড়ে দিব? বলো তো, এটা কি কখনো সম্ভব?
কথা শেষ করেই লোকটা কাঁধ থেকে চাদরটা খুলে ছুঁড়ে মারল। সেটি কোথায় পড়ল, তা দেখারও প্রয়োজন বোধ করল না। তারপর খুলে ফেলল তার পরনের পাঞ্জাবি। মুহূর্তেই উন্মুক্ত হলো লোমে আবৃত বুক, আর বুকের বাঁ পাশে স্পষ্ট দেখা গেল চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা একটি সেলাইয়ের দাগ।
লোকটা সেই সেলাইয়ের ওপর হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল—
হায়… আমার ভাগ্য! সব কিছু থেকেও যেন কিছুই আমার নেই। চারপাশে সব কিছু যেনো শূন্য শূন্য লাগে। সেই শূন্যতার কারণ খুঁজতে গিয়ে বুঝলাম— আমার জীবনে তুমি নেই। তখনই বুঝেছি, আমি আসলে শূন্য নই, আমি নিঃস্ব… তুমি বিনা।
আবার হাত বুলিয়ে দিল সেই সেলাইয়ের জায়গায়। চোখ দু’টো চিকচিক করে উঠল— আচ্ছা লোকটা কী কাদছে? কে জানে, হয়তো কাঁদছে। ভাঙা গলায় বলল—
যদি ওই দিন ওই মুহূর্তে যদি আমি কোমায় না থাকতাম … তবে হয়তো আজ আমার জীবনের সব অন্ধকার মুছে যেত। আমার জীবন আর ঘর দুটোই আলোয় ঝলমল করত… তোমার উপস্থিতিতে।
ঠিক সেই মুহূর্তে চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা হৃদয়ভাঙা অশ্রু। কিন্তু পরক্ষণেই ঠোঁটে টেনে আনল তাচ্ছিল্যের হাসি, নিজের অপারগতার কারণে।
ভাবতে পারছো মেহু? তোমার বিরহে আমি প্রেম নেওয়াজ— ৩১ বছরের এক পুরুষ, যার গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, টাকা-পয়সা আছে কারি কারি,এক ইশারায় যার পেছনে নারী লাইন বেঁধে দাঁড়াবে— সেই প্রেম নেওয়াজ তোমার জন্য চোখের পানি ফেলছে। ভাবো তো, আমার যৌবন বয়সে তুমি আমার মনে কতটা গভীর দাগ কেটেছো, যে তোমাকে দেখার পর থেকে আর কোনো নারীকে আমার মনে ধরেনি।ভুল করে হলেও কোনো নারী আমার মনের দরজার কাছে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি।
তুমি আমার জীবনে আসার পর কোন নারীর সংস্পর্শে যাওয়া তো দূর-তুমি ব্যতীত সকল নারী প্রেম নেওয়াজের কাছে বিষের নেয়। হেসে হেসে বিষ পান করা কে উত্তম মনে করবো, তুমি ব্যতীত অন্য নারীর কথা ভাবার আগে ।
মৃদু হেসে প্রেম বলে,
ক্লাস সেভেনে পড়া এক পিচ্চি মেয়ের জন্য… ১১ বছর আগে আমার উত্তাল প্রেমের সাগরে যে ঝড় আমার মনে উঠেছিল, আজ ১১ বছর পরও সেই ঝড় ঠিক একই রকম বয়ে চলেছে। এই ঝড় থামবে কেবল আমার মৃত্যুর সাথে।
প্রেম একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেটে জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে তাকিয়ে হাসে, বললো –
তুমি বিহীন আমার জীবন এই সিগারেটের আগুনের নেয়, জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, মেহু।
সিগারেটে কয়টা সুখ টান দিয়ে ধোঁয়া গুলো নাক-মুখ দিয়ে ছেড়ে গুনগুন করে উঠলো প্রেম–
Hai Jo Irade Batadu Tumko,..
Sharma Hi Jaaogi Tum!!
Dhadkane Jo Suna Du Tumko,..
Gabrah Hi Jaaogi Tum!!!
Humko Aata Nahi Chhupana,,
Hona Hai Tujme Fanaa!!!
এইটুকু গেয়েই আবার হেসে উঠলো লোকটা।
ওদিকে মেহরিনরা ওই টাকলা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গকে কেলিয়ে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দিয়েছে। শান্ত, লাবিব, আরশ, রাকিব আর জীবন হালকা হয়ে মেহরিনদের খুঁজছে কিন্তু মানুষদের দৌড়াতে দেখে তারাও গেল ওদিকে।
কারণ একটাই—যে ঝামেলায় মেহরিনরা যদি থাকে, তারা তো আবার যেখানে সেখানে চণ্ডীরূপ ধারণ করে।
প্রথমে হাঁটতে হাঁটতে গেলও, একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে দিল ভূ দূর!
আর গিয়ে দেখে এক টাকলা ও তার সাথে কয়েকটা ছেলে-ছোকরা মাটিতে পড়ে আছে।
ওদিকে মেহরিনরা পাশেই দাঁড়িয়ে হাসছে। তা দেখে বোঝা গেল—নারীগণের হাতে কেলানি খাওয়া পাবলিক এরা।
এই বেচারা গুলোকে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো লাবিবরা।
লাবিব মেহরিনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
কি হয়েছে ভাবী?
মেহরিন সংক্ষেপে বললো সব।
সব শোনার পর লাবিব বিনা দ্বিধায় ছুটে গেল মাটিতে পড়ে নিজের ভবিষ্যৎ আঁকড়ে কাঁতরাতে থাকা টাকলার দিকে। টাকলার ভবিষ্যতের দিকে, গিয়ে আরেকটা লাথি মারলো।
লাবিব দাঁত চেপে বললো –
শালা মা***… গালি দিস কারে তুই? গলাই পারা দিয়ে তোর জিভটা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো শু*য়ারের বাচ্চা। ব্যবসা মারাও, ব্যবসা একদম জায়গামতো ভরে দিবো, ব*ন্দির বাচ্চা মানুষ চিনোস?
লোকটা আগেই নারীগণের কেলানি খেয়ে আধমরা। তারউপর লাবিবের লাথি খেয়ে তো দম যায় যায়। একেই বুঝি বলে মরার উপর খারা। লাবিব আরো কয়েক ঘা লাগিয়ে দিয়েছে।
বাকিরা লাবিবকে আটকাতে চাইলে লাবিব আঙুল তুলে শাসিয়ে বলেছে –
কেউ কিছু বললে তার খবর আছে!
তাই সবাই চুপ করে শুধু দেখছে, আপাতত আর কিছু করার নেই।
লাবিব আসলে খুব শান্ত, কিন্তু একবার রেগে গেলে তাকে কেউ সামলাতে পারে না—এমনকি রাজও না।
অন্য ব্যাপারে ঠিক আছে, কিন্তু যেখানে প্রসঙ্গ তার পরিবার, সেখানে কারো কথা কাজ দেয় না।
অবস্থা বেগতিক দেখে মেহরিন বললো –
“লাবিব!”
লাবিব বললো –
কি ভাবী, কিছু বলতেই!
মেহরিন শক্ত গলায় বললো –
লাবিব, ওটাকে ছাড়ো।
লাবিব কিছু বললো না, আরেকটা লাথি দিয়ে ছেড়ে দিল।
না, একেবারে ছাড়লো না—একে তো মারতেই পারলো না, এটাকে কেটে পিস পিস না করা পর্যন্ত মনে শান্তি মিলবে না।
লাবিব আবার চিৎকার করে ডাকে
ওর ছেলে-দের।
ছেলেরা এদিক-ওদিক ঘুরছিল, অনেকে আবার হালকা হতে গেছে।
লাবিবের গলা পেয়ে ছুটে এলো যারা পাশে ছিল।
লাবিব চিৎকার করে বললো –
তোরা থাকতে এই জা*নোয়ার বাচ্চার এত সাহস হয় কিভাবে আমার পরিবার আর মেয়েদের গালি দিতে? গালি দেওয়ার আগেই ওদের কল্লা নামিয়ে ফেল্লি না কেন?
একজন বললো –
স্যার, আমরা আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ম্যাম না করেছে।
লাবিব কিছু বলতে যাবে, এমন সময় মেহরিন বলে উঠলো –
লাবিব, ওদের ওপর চিল্লিও না, ওরা আসতে চেয়েছিল, আমি মানা করেছি।
লাবিব মেহরিনের কথায় থেমে গেলও, কিন্তু রাগে শরীর জ্বলছে তার—তা বুঝে মেহরিন লাবিবের কাছে এসে সামনে তাকা চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো –
আরেহ চিল ব্রো, এত হাইপার হচ্ছো কেন? তুমি কি জানো না তোমার পরিবারের মেয়েরা অন্য মেয়েদের মতো না?
এই কথা যেন কাজে দিলো।
লাবিব হাসলো, লাবিবকে হাসতে দেখে সবাই হাসলো।
রাকিব, জীবন আর শান্তর কাঁধে হাত রেখে বললো –
বুঝলে ভায়া, আজ একটা ভাবি নেই বলে এমনভাবে চুলগুলো ঠিক করে দিলো না, আর এই জন্যেই আমার সব চুল পড়ে যাচ্ছে।
রাকিবের রসিকতায় সবাই হাসলো।
রাহি বললো –
তাই নাকি! তো চুল যেহেতু পড়েই যাচ্ছে, আসেন স্যার, আপনার যে কয়টা চুল আছে, ওগুলোও আমি উপড়ে ফেলি। তাহলেই আর চুল পড়ার দুঃখ থাকবে না।
রাহির কথার জবাবে রাকিব নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো –
সে ম্যাডাম আপনার যা মন চায় উপড়ে ফেলুন, আমি পুরো টাই তো আপনার। তবে কথা হচ্ছে, টাকলা জামাই বিয়ে করলে আপনার মান-সম্মান থাকবে তো?
রাকিবের কথায় সবাই হেসে উঠলো, আর রাহি মুখ বেঁকিয়ে রইলো।
লাবিব মেহরিনকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে বললো –
তোমাদের কে বলেছে, উনি শুধু আমার ভাবী? উনি হচ্ছেন আমার দ্বিতীয় মা, বুঝলা? এক মা আমাকে জন্ম দিয়েছে, আরেকজন আগলে রেখেছে।
আম্মুর তো এখন বয়স হয়েছে, তাই আম্মুর যে কাজগুলো এখন আমার ভাবী মা করে—রাত করে বাড়ি ফিরলে না ঘুমিয়ে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করে, অসুস্থ হলে সেবা করে, ছোট-বড় সব বিষয়ে সাপোর্ট করে, আবার বিপদে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে।
যদি সহজ করে বলি, তবে একজনের ভিতর সব—বন্ধু, বোন, মা—সব কিছু আমি পাই এই একজন মানুষের ভিতর, বুঝলা?
সবাই একসাথে বলে উঠলো –
একদম!
লাবিবের কথায় মেহরিন হাসলো, লাবিবও হাসলো। হাসতে হাসতে আবার চোখ গেলো ওই টাকলার দিকে।
বেসস আবার গেলো, মেজাজটা বিগড়ে।
লাবিব এক চিৎকারে বললো –
এই টাকলা শালাকে এখান থেকে নিয়ে যা!সরা এটাকে আমার চোখের সামনে থেকে।
লাবিবের এখনকার কথায় আবার সবাই হেসে উঠলো। ছেলেরাও লাবিবের কথায় হাসতে হাসতে নিয়ে চলে গেল ওগুলোকে।
এতক্ষণে রাজ আর রিদ ওদের খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছে, পৌঁছে গেছে।
এতক্ষণ লোকের কানাঘুষা শুনছিল, কতো গুলো মেয়ে মিলে কিছু লাফাংগাকে ইচ্ছেমতো মেরেছে।
এটা শোনা মাত্রই রাজ আর রিদ বুঝে গেল, এগুলো তাদের বউ, শালী আর বোন ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না।
তারা জানে, একটা-ও ছাড় পাবে না, তাই আস্তে ধীরে এসেছে।
সবাইকে হাসতে দেখে রাজ রিদের কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বললো –
দেখেছিস, এত গুলো মানুষ পিটিয়ে এক একটা কেমন দাঁত বের করেছে, মনে হচ্ছে মানুষ পিটায়নি, কোনো পছন্দের গেম খেলেছে!
রাজও একই সুরে বললো –
তো মানুষ পেটানো তো ওদের পছন্দেরই গেম।এটা কি তুই জানিস না কি?
যদি না জেনে থাকিস, তাহলে যা একবার আমার শালির কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা কর, হাতে কলমে বুঝিয়ে দেবে।
রিদ চোখ রাঙিয়ে তাকালো রাজের দিকে।
রাজ তা দেখে বাঁকা হাসলো, আবার বললো –
রাগে যাচ্ছিস কেন? ভয় পেয়েছিস? অবশ্য পাওয়ারই কথা—তোর তো আবার রেকর্ড আছে বউ-এর হাতে মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার!
এটা শোনা মাত্রই রিদ এক লাথি মারলো রাজকে। রাজও এক ঘুষি মেরে বললো –
শালা, আমায় মারছিস কেন? পুরুষত্ব দেখাচ্ছিস? তোর যেহেতো এতই পুরুষত্ব আছে তো যা না, যা—বউয়ের কাছে গিয়ে দেখা। ওখানে তো পারবি না, যত জোর শুধু আমাকেই দেখাতে আসছিস, শালা! ওই যে কথাই আছে না নরম পাও যারে যাইত্তা ধরো তারে। তোর হয়েছে সেই অবস্থা বউ তো গরম তাই তার সাথে পারো না। আর এদিকে আমাকে নরম পেয়ে যত যাতা যাতি আমার সাথে।
রিদ রেগে কিছু বলতে যাবে এমন সময় মেহের বলে উঠল,
আপনারা দুজন ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী, তখন থেকে নতুন জামাই-বৌ এর মতো গুজুরগুজুর করছেন?
রাজ একবার রিদের দিকে তাকিয়ে আবার মেহেরের দিকে তাকিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলল,
ছিঃ ছিঃ শালীকা, এটা কী বললে তুমি? আমি কোন দুঃখে ওকে জামাই বা বৌ ভাবতে যাব? আমার বৌ আছে, আর আমি তার লয়্যাল হাজব্যান্ড, বুঝলা? আর আমি কোন দুঃখে একটা ছেলের সাথে জামাই-বৌ এর মতো কথা বলব? বাই এনি চান্স , তুমি কি আমাকে ওইসব ভাবছ? শোনো, খবরদার, ওমন কিছু ভুল করেও মাথায় আনবে না।
তারপর রাজ রিদের দিকে তেসরা ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল,
ওটার জানি না, তবে আমি পাকা পুরুষ, আমার দুই-দুইটা রাজপুত্র আছে। আশা করি আমার পুরুষত্বের প্রমাণ পেয়েছো?তার প্রমান হিসাবে তোমাকে আমার ২ ছেলের খালামনি বানাই দিছি।
মেহেরের দিকে একটু এগিয়ে ফিসফিসিয়ে রাজ বলল,
ওর কি কোনো সমস্যা-টমসা আছে? থাকলে আমাকে বলতে পারো, আমার কাছে ভালো ডাক্তারের সন্ধান আছে।
পেছন থেকে রিদ এটা দেখে বলে উঠল,
–এই এই, তুই আমার বৌ এর কানে আমার নামে কী বিষ ঢালছিস, শালা?
রাজ কিছু বলার আগেই মেহের বলল,
ভাইয়া বলছে, আপনার কোনো সমস্যা আছে কি না, থাকলে জানাতে, ওনার কাছে ভালো ডাক্তার আছে।
মেহেরের কথা শুনে রিদ তো ভয়ানক রেগে যায়—যাবেই বা না কেন? তার পুরুষত্ব নিয়ে কথা!
আজ রাজের একদিন কি তার একদিন, রিদ দৌড়ে আসে রাজকে ধরতে, কিন্তু ধরতে পারলে তো।
রাজ আগেই বুঝেছিল তার উপর আক্রমণ হতে পারে, বিপদ বুঝে সে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল।
রাজকে দৌড়াতে দেখে রিদও ছুটে তার পিছু নিল—
দুজনেই ছুটছে, রিদ গালি দিচ্ছে আর ছুটছে। রাজও ছুটতে ছুটতে বলছে,
– শালা, ঠিকই তো বলেছি, তোর সিস্টেমে প্রব্লেম আছে!
রিদ রাজকে পেলে তো আজ কেলিয়ে বিন্দাবন পাঠিয়েই ছাড়বে!
ওদিকে এই দুই দামরাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
দেখে মনে হচ্ছে, এটা যেন ভার্সিটি ক্যাম্পাস, আর দুই বন্ধু ক্যাম্পাসজুড়ে দৌড়াচ্ছে মারামারি করার জন্য ।
অনেকক্ষণ দৌড়ানোর পর রাজ ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল, হাঁপাতে হাঁপাতে।
কিছুক্ষণের ব্যবধানেই রিদও এসে রাজের পাশে শুয়ে পড়ল—দুজনেই হাঁপাচ্ছে।
হঠাৎ একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।
তারপর মুহূর্তেই রিদ উঠে বসে রাজের উপর কলার ধরে বলল,
শালা, তুই আমার আগে বাচ্চার বাপ হয়েছিস, বলে আমার পুরুষত্ব নিয়ে কথা বলবি?
বলেই রাজের গালে এক ঘুষি মারল।
তারপর কী রাজও রিদকে ফেলে দিয়ে তার উপর উঠে বলল,
শালা, আমি একসাথে দুজনের বাপ হয়েছি, তোকেও কাকু বানিয়ে দিয়েছি। আর তুই এখনো আমার শালিকাকে বেবি দিতে পারলি না, তো বলব না কেন তোর সিস্টেমে প্রব্লেম আছে?
বলেই রিদের গালে এক ঘুষি মারল।
ওদিকে সবাই দৌড়ে এসে থামাল তাদের কাছে।
তাদের এমন মারামারি দেখে মেহরিন গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল,
– লাবিব, তোমার দামড়া ভাইকে বলে দাও, সে এখন কচি খোকা নয় যে এমন মারামারি করবে। সে এখন দুই বাচ্চার বাপ—ভুলে যায় নাকি?
মেহরিনের কথায় সবাই মুখ টিপে হাসল,
রিদ হা-হা করে হাসতে লাগল,
রাজ বোতা মুখে সরে আসলো রিদের কাছ থেকে।
রিদকে দাঁত কেলাতে দেখে মেহের বলল,
–রাহি, তোর ভাইকে বলে দে, সে আর ভাইয়া কিন্তু একই বয়সের। তাই সে বাচ্চার বাবা নয় বলে যেন নিজেকে ফিটার খাওয়া বাচ্চা মনে না করে!
বেসসস, রিদের দাঁত কেলানো মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল। এখন রাজও রিদের দিকে আঙ্গুল তুলে হাহা হিহি করে হেসে দিলো।
এদিকে মেহরিন কিছু বলবে এমন সময় আরফা বলে উঠল,
হয়েছে, থাক বোন, তোরা কি শুরু করলি?
আমার ওমন ভুলাভালা দুইটা নাদান ভাইকে আর কত কথা শোনাবি তোরা?
উঠতে বসতে মারিস, এখন ঘুরতে এসে একটু মজা করলেও তোরা আবার বুড়ো বলে খোঁটা দিবি!
আরফার কথায় রাজ আর রিদ কাঁদো কাঁদো মুখে তাকাল আরফার দিকে।যেনো আরফাই একমাত্র ওদের শুভাকাঙ্ক্ষী আর সবাই শত্রু পক্ষ। আহারে, বোনটা কত ভালো! এমন বোন যেন ঘরে ঘরে একটা করে হয়।
রাজ বলল,
–বোন, তুই শুধু আমাদের বুঝিস।
আরফা চোখের ইশারায় বোঝাল সে আছে।
ওদিকে আরফার কথা শুনে জিবন মুচকি হেসে বলল,
আপনি তো দেখি ভীষণ দয়ালু, আপনি বুঝি আপনার জামাইকে মারবেন না?
আরফা অক্কপটে জবাব দিল,
ও মা, ছি ছি, মারব কেন?
আরফার কথায় জীবনের হাসি গারো হয়, কিছু বলতেই যাচ্ছিল, এমন সময় আরফা বলে উঠল—
–শুধু আমার কথা না শুনলে বা বকলে, চায়ের কাপে একটু থুথু দিয়ে দেব, রান্নায় নুন-ঝাল বেশি দেব, আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে খবারে—ইঁদুর মারার বিষ মিশিয়ে দেব!
একেবারে ঝামেলা শেষ! আমি তো ওদের মতো মারামারি পারি না, ছোট মানুষ, তাই আমি ছোট কাজই করব। না থাকবে বাশঁ, না বাজবে বাঁশি।
আরফার এমন কথায় সবাই হাহা করে হেসে দিল।
জিবনের চোয়াল ঝুলে গেল, তা দেখে সবাই আরও জোরে হাসল।
হাসতে হাসতে সবাই ঘাসের উপর বসে পড়ল, সেখানে আড্ডার আসর জমে গেল—
একটা পিকনিকের মতো ভাইব চলে এল।
এতক্ষণে খাবারও চলে এল, তাই সবাই ঠিক করল ঘাসের উপর বসেই খাবে।
গ্রামের মতো একটা ভাইব নিয়ে খাবে।
ওখানকার লোকেরা একটা টেবিল এনে রাখল, তাতে সব খাবারের আইটেম সাজানো—
ডাল, আলু ভর্তা, চেপা ভর্তা, ডাল ভর্তা, ডিম ভর্তা, আরও অনেক রকম ভর্তা,
সাথে কাতলা মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘন্ট, দেশি মুরগির মাংস আর আরও অনেক কিছু।
সবশেষে সালাদ, লেবু, আর সাথে সাতখানা হাত-পাখা—
এটা অবশ্য মেহরিন বলেই আনিয়েছে, আজ তারা সবাই গ্রামের বউদের মতো স্বামীকে খাবার পরিবেশন করবে আর আদর্শ বউয়ের মতো পাখার বাতাস দিবে।
মেহরিনের প্রস্তাবটা সবাই মনে ধরল, আরফা ছাড়া। হবার কথাও নয়—এখানে সবাই হয় বিবাহিত, নয়তো এনগেজড,
আর আরফার নেই বয়ফ্রেন্ড, নেই হবু হাজব্যান্ড, আর নেই হাজব্যান্ডও।
কিছু না বলে শুধু সবাই কে আনন্দ দেখে হাসল, যেন অন্যদের আনন্দ নষ্ট না হয়।
মনে মনে বলল—ভালোবাসার সংজ্ঞা সবার কাছে এক নয়।
এখানে এতগুলো মানুষ ভালোবেসেছে আর পেয়েছেও,কারণ তারা দুজন দুজনকে চেয়েছিল।
অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আরফা, মনে উঠল কিছু যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতি, চোখ ভরে এল—
কিন্তু দ্রুত অন্য দিকে চলে গেল, যেন কেউ চোখের পানি দেখে বিচলিত না হয় আর সুন্দর মুহূর্তটা নষ্ট না হয়।
সব খেয়াল করছিল মেহরিন আর মেহের।
মেহের, মেহরিনকে ইশারা দিল।
মেহরিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জিবনের কাছে গেল, যে তখন অন্যদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত।
মেহরিন একটু হেয়ালী করে বলল,
হারাতে হারাতে পাওয়ার চান্স পেয়েছেন,
তো খালি জায়গাটা তাড়াতাড়ি পূরণ করুন, নয়তো সেই জায়গাটা পূরণ করতে অন্য কাউকে খুঁজব।
মেহরিনের কথার অর্থ বুঝে জিবন জিভ কেটে বলল,
ছি ছি ভাবি, মরে যাব! একদম মরে যাব!
আমার তো এই কথা শুনলেই প্রাণপাখি গলায় এসে আটকে ছিলো, এখন এমন কিছু হলে নিঃসন্দেহে মৃত্যু হবে।
আমি এখনই যাচ্ছি, শূন্য জায়গা পূরণ করতে।
জানি কষ্ট হবে, তবে আমিও রাজ শিকদারের বন্ধু—প্রয়োজনে অপেক্ষা করব, তবে নিজের জিনিস আদায় ঠিক করব।
মেহরিন হেসে বলল,
– গুড!
রিদ হঠাৎ কপালে হাত দিয়ে একটু স্লাইড করল।
তা দেখে মেহের এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,
— কী হয়েছে, আপনার?
রিদ মেহেরের দিকে তাকাল, কিছু বলল না।
মেহের আবার বলল,
— মাথা ব্যথা করছে?
মেহেরের কথায় রিদ ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল।
মনে মনে ভাবল,
এই মেয়েটা এত বুঝে কেমনে? মেয়েকে কিছু বলতেই হয় না, দেখেই সব বুঝে যায়।
এমন একজন বোঝে এমন মানুষ থাকলে জীবনে আর কী চাই!
রিদ হেসে মাথা নাড়ল।
মেহের তার সামনে বসে বলল,
— শুয়ে পড়ুন, আমি মাথা টিপে দিচ্ছি, ভালো লাগবে। খাবার খেয়ে ওষুধ খাবেন।
রিদ কিছু না বলে শুয়ে পড়ল মেহেরের কোলের উপর।রিদ মনে মনে বলল,
মাথা ব্যথা উঠলেই যদি বউয়ের এমন আদর পাওয়া যায়,তাহলে চাই আমি চব্বিশ ঘণ্টাই এই অসুখে ভুগি!
তাহলেই তো চব্বিশ ঘণ্টাই বউয়ের কোলে থাকতে পারব, আদর পাব। আহা, জীবনে আর কী চাই!
ওদিকে মেহের পরম যত্নে তার প্রিয় মানুষটার সেবা করতে লাগল—
মাথায় হাত বুলিয়ে, আঙুল দিয়ে টিপে, কপালের ভাঁজ মুছে দিচ্ছে।
রিদ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে, আর মুখে মুচকি হাসছে।
তা দেখে মেহেরও হেসে ফেলল।
কিন্তু স্বামী যে মনের মধ্যে তাকে নিয়েই কীসব ভাবছে,
এতটা বুঝতে মেহেরের বেগ পেতে হল না।
তাই একটু দুষ্টুমি করে বলল,
— কী ব্যাপার স্যার,হাসির কারণ কী?
অন্য কোনো রমণী মনে ধরেছে নাকি?
এই কথা শুনেই রিদ হঠাৎ চোখ খুলে মেহেরের দিকে রাগি রাগি চাহনি ছুঁড়ল।
তা দেখে মেহের বাঁকা হেসে বলল,
হলেও সমস্যা নেই, আমি আছি না!
সেই রমণীর সুন্দর ব্যবস্থাও করে দেব,
আর আপনার উপরে যাওয়ার টিকিটও কনফার্ম করে দেব।
বেস! রিদের শান্ত মেজাজ মুহূর্তে বিগড়ে গেল।
প্রিয় মানুষ বলে চুপ চাপ থাকে, হুমকি-ধমকি, মারপিট—সব সহ্য করে,কিন্তু তার ভালোবাসার দিক নিয়ে আঙুল তুলবে—
এটা রিদ কোনোভাবেই মেনে নেবে না।
রাগে ফুঁসে উঠে রিদ উঠে চলে গেল।
মেহের হেসে বলল, রাগী মানুষকে রাগাতে বেশ লাগে,আর সে যদি হয় প্রিয় মানুষ, তাহলে তো কথাই নেই।
তবে মেহেরও জানে, এখন না মানালে খাওয়াদাওয়াও বন্ধ করে দেবে সে।
তাই চুপচাপ পেছনে গেল।
রিদ বড় বড় পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছে,
মেহের বুঝল, এভাবে ধরা যাবে না—তাই দৌড় ছুটে এসে হাত ধরল।
রিদ কিছু বলল না, নিজের মতো হাঁটতে লাগল। অনেকটা চলে এসেছে তাড়া।
মেহের বলল,
— বেশি রাগ করছেন?
রিদ কোনো জবাব দিল না।
মেহের একটু হতাশ স্বরে বলল,
— হুম, তা তো করবেনই…
আমি এখন পুরাতন হয়ে গেছি না!
আবার আপনার সাথে রাগা-রাগি করি থ্রেট দেই,এখন তো আপনার মন নতুন বউ চাই—যে হবে শান্ত, শিষ্ট, বউ!
এই কথা শুনে রিদ হঠাৎ ঘুরে মেহেরকে দেয়ালের মতো এক গাছের গায়ে ঠেসে দিল।
মেহের তাকিয়ে আছে, আর রিদ সেই রাগে ফেটে পড়া চোখ দিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে—
যেন চোখ দিয়েই ভস্ম করে দেবে।
মেহের একটু থতমত খেয়ে বলল,
— কী হলো আপনা…
কথা শেষ হওয়ার আগেই রিদ তার সমস্ত রাগ আর জেদ ঢেলে মেহেরের ঠোঁটে চেপে ধরল নিজের ঠোঁট।
বরফের মতো জমে গেল মেহের—এমনটা হবে ভাবতেই পারেনি।
তারা অনেকটা সাইডে চলে এসেছে, আশেপাশে কেউ নেই—
রিদ অবশ্য এই কাজের আগে চারপাশ ভালো করেই দেখে নিয়েছিল।
রিদ ঠোঁট ছাড়ল না যতক্ষণ না তার রাগ পুরো ঠান্ডা হল।
টানা সাত-আট মিনিট নিজের রাজত্ব চালাল মেহেরের ঠোঁটে।
শেষে হালকা নোনতা স্বাদ পেয়ে বুঝল, ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হচ্ছে তখন ছাড়লো।
ঠোঁট ছাড়ার পরও রিদ দৃষ্টি সরাল না—
গোলাপি ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে রইল।
মেহের বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে—
কথা বলার চেষ্টা করতেই রিদ আবার হঠাৎ চুমু খেল।
মেহেরের এই বিস্ময়েরও কারণ আছে—
রিদ এক জন ভদ্র মানুষ,
সে যেমন সবার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ পছন্দ করে না,তেমনি তার লাজ-লজ্জাও বেশি।লোকসমক্ষে কখনো চুমু তো দূরের কথা, জড়িয়েও ধরে না প্রয়োজন ছাড়া ।
কিন্তু সেই মানুষ আজ রাগের বসে পাবলিক প্লেসে চুমু খেল—
তাও আবার লিপকিস, এবং তা এতক্ষণ ধরে!
মেহেরকে হতবাক দেখে রিদ বাঁকা হাসল…
মেহেরের ঠোঁটে এখনও বিন্দু বিন্দু রক্ত দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মেহেরের সেদিকে খেয়াল নেই। সে পলক ঝাপটাতে ঝাপটাতে রিদের দিকে তাকিয়ে আছে। আর রিদ মেহেরকে আরেকটা চুমু দিল—না, ঠিক চুমু না—যে রক্ত কণাগুলো লেগে ছিল, তা শুষে নিল। মেহের পেলে এখনই জ্ঞান হারাবে, এমন অবস্থায় রিদ নিজের ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল,
এটা কি লিপস্টিক লাগিয়েছো? টেস্ট ভালো! I like it. এই ব্র্যান্ডের আরও ক’টা কিনে নিও।
মেহেরের তো অক্কা যাবার অবস্থা, একটু হেলে পড়ে অতিরিক্ত শক্তি নিতে না পেরে রিদ হাসে, কোলে তুলে নেয় মেহেরকে। মেহের অবাক হয়ে বলে,
আপনার এমন রূপও ছিল? জানা ছিল না তো!
রিদ বাঁকা হেসে বলে,
তোমার দুলাভাই কি বলল শুনোনি? আমার নাকি সিস্টেমে সমস্যা! এখন ‘মিশেন বাবা’ হওয়া ওই সালাকে দেখাতেই হবে আমার কোনো সমস্যা নেই।
রিদের এমন কথায় মেহের হাসে ফেলে, রিদও হাসে। দুজন আবার ফিরে আসে সবার কাছে। ওদিকে ছোট ছোট সাতটা টেবিল আর পিরি সেট করা হয়েছে, সেখানে বসেই সবাই খাবার খাবে। আগে ছেলেরা আর পরে মেয়েরা। মেহের আর রিদকে এমনভাবে দেখে সবাই একসাথে বলে ওঠে—
“ও মা গো, টুরু লাভ!”
মেহের রিদের গলায় জড়িয়ে বলে,
উহুম, পিওর লাভ।
মেহেরের কথায় সবাই বলে ওঠে—
“ওওওওও…”
তারপর সবাই হাসে ফেলে। মেহরিন হাসতে হাসতে বলে,
দয়া করে আপনার পিওর লাভের কোল হইতে নামিয়া, তাহার জন্য খাবার সাজান, আর তাকেই বউ বক্তি দেখিয়ে বাতাস দেন।
মেহরিনের কথায় আবারও সবাই হাসে ফেলে। রিদ মেহেরকে নামিয়ে দেয়।
মেহরিন, রাহি, মেহের, লামিয়া, মাহবুবা, চুমকি—ছয়টা থালায় ভাত বাড়ে, আর বাটিতে করে তরকারি সাজায়। ওদিকে আরফা হাটতে হাটতে কিছু দূরে এসে বসে আছে। জিবন আরফাকে আকাশের দিকে বিষণ্ন মনে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে বলে,
উহু উহু, ম্যাডাম, আমি কি আপনার পাশে একটু বসতে পারি? আপনি কি অনুমতি দেবেন?
আরফা চোখ তুলে তাকায় জিবনের দিকে। আরফার এমন লাল চোখ দেখে জিবনের বুকের ভেতরটা কেমন ভেঙে আসে। জিবনের খুব বলতে ইচ্ছে করে—
তুমি কেঁদো না প্লিজ… তুমি কাঁদলে যে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়… তুমি আমার হও… আকাশের চাঁদ-তারা এনে দিতে না পারলেও, নিজের মনে রাজ্যের রানী করে রাখব… পৃথিবীর সব সুখ তোমার চরণতলে রাখব… তোমাকে দুঃখ-কষ্টরা ছুঁতেও পারবে না।
কিন্তু জিবন মনের কথা মনে রেখেই বলে,
কি হয়েছে আপনার?
আরফা বলে,
আপনি…
জিবন বলে,
কেন, আসতে পারি না?
আরফা মাথা নেড়ে বলে,
আর না, আমি ওটা বলতে চাইনি।
জিবন বলে,
তাহলে বসার অনুমতি দিচ্ছেন না নাকি? আবার ভেবেছেন আমার গায়ে ময়লা বা দুর্গন্ধ?
জিবনের এমন কথায় আরফা হাসে ফেলে বলে,
আর না, কি যে বলেন!
জিবন আরফাকে থামিয়ে বলে,
বসার অনুমতি দেবেন কি না, পা ব্যথা করছে তো।
আরফা বলে,
“বসুন।”
অনুমতি পেয়ে জিবন বসে পড়ে আরফার পাশে, পকেট থেকে রুমাল বের করে দেয় আরফাকে। তা দেখে আরফা অবাক হয়। কিছু বলতে মুখ খুলবে, এমন সময় জিবন বলে ওঠে,
এতে কোনো ময়লা নেই, আর না আছে দুর্গন্ধ। না বিশ্বাস করলে নিজেই দেখুন।
আরফা হাসিমুখে রুমালটা নেয়, নইলে আবার জিবন বলবে—তার রুমালে জীবাণু তাই নেননি। আরফা চোখ মুছতে গিয়ে কাজল লেপ্টে যায়, যা দেখে জিবন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। কে বলে পুরুষ গোঁছানো মেয়ের প্রেমে পড়ে,সুন্দর করে সাজলে আকৃষ্ট হয়! এগুলো নেহাতই বেমানান কথা।
জিবনের কাছে সামনে বসা মেয়েটা—তাকে অপরূপ সুন্দর লাগছে। সাজানো থেকে, অসাজানো আরফাকে কি সুন্দর লাগছে! ইচ্ছে করছে আজীবন এভাবেই তাকিয়ে থাকতে।
লেপ্টে যাওয়া কাজলে কারও চোখ এত মায়াবী লাগে—কোথায় আগে কখনও দেখেনি! নাকি দেখে দেখতে চায়নি? আসলে যারা সত্যিকার ভালোবাসে তারা সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসে না—আমরা মূলত যাদের ভালোবাসি, তারাই আমাদের চোখে সুন্দর লাগে।
জিবন যেন পলক ফেলতেও নারাজ, যদি এই পলক ফেলার মাঝে সামান্য দৃশ্যও মিস হয়ে যায়!
ওদিকে আরফা জিবনের এমন নজরে অস্বস্তি পাচ্ছে। বুঝতে পারছে না কি করবে—উঠে চলে গেলে বেয়াদবি হবে, আবার বসেও থাকা যাচ্ছে না। কেউ যদি এমন ডেপ-ডেপ করে তাকিয়ে থাকে, বসে থাকা যায়? মনে হচ্ছে যেন ভাতের হাঁড়ি কেউ চুলায় বসিয়ে রেখেছে!
আরফা গলা পরিষ্কার করে বলে,
“শুনছেন…”
জিবন আনমনে বলে ফেলে,
বলুন না, শুনতেই তো চাই।
আরফা বলে,
কীইই?
জোরে বলায় জিবনের ধ্যান ভেঙে যায়, বলে ওঠে,
হ্যাঁ, কি না… না না, কিছু না।
আরফা তোতলাতে তোতলাতে বলে,
এভাবে তাকাবেন না, আমার অস্বস্তি হয়।
জিবন ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
কেন তাকিয়ে আছি জানেন?
আরফা ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।
জিবন বলে,
“Wait…”
বলে নিজের ফোন বের করে সেলফি তোলার মতো ফোনটা ধরে। আরফা তাকাতেই ক্লিক করে। আরফা বলে,
এটা কি হলো?
জিবন বলে,
Wait, দেখাই…
তারপর জুম করে আরফাকে দেখায়। আরফা দেখে তার কাজল একটু লেপ্টে গেছে। হাতে থাকা রুমাল দিয়ে মুছতে যায়। বোকা আরফা বুঝতেও পারল না এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক পাগল প্রেমেক তার প্রিয়সি কে তার সাথে ক্যামেরাবন্দি করে নিল।
জিবন বলে,
“Wait…”
আরফা থামে। জিবন ফোনটা পকেটে রেখে আরফার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
আপনি আর ঘষবেন না, তাহলে আরও ছড়াবে আমি করে দিচ্ছি।
আরফা কিছু বলতে যায়, কিন্তু জিবন সেসব পাত্তা না দিয়ে ধীরে ধীরে আরফার হাত থেকে রুমাল নিয়ে ঠিক করে দেয় তার কাজল।
আরফার বুকের ভেতর কেমন ধকধক করে ওঠে—এটা স্বাভাবিকও বটে! কোনো পরুষ মানুষ এত কাছে থাকলে বুক কাঁপা স্বাভাবিক। উপরন্তু ৩ বছরের সম্পর্ক হলেও হাতে গোনা ৩–৪ বারই দেখা হয়েছে শুভর সাথে এত কাছাকাছি কখনো আসা হয় নি।
কাজ শেষ হলে জিবন আবার পাশে বসে বলে,
শেষ।
আরফা কিছু বলে না, তবে চোখ যায় রুমালের দিকে। আরফা বলে,
ইস্, আমার জন্য আপনার রুমালটা নোংরা হলো।
জিবন রুমালটা ভাঁজ করে নিজের পকেটে রেখে বলে,
কি! এটা কি বললেন! এটা মোটেও নোংরা হয়নি, উল্টো দামি হয়ে গেল—এত দামি যা কেনার সামর্থ্য সবার নেই।
আরফা কথার মানে না বুঝে বলে,
“কি?”
জিবন কথা ঘুরিয়ে বলে,
ওদিকে সবাই খেতে বসে যাচ্ছে, চলুন, আমাদের জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে।
সবাই মূলত অপেক্ষা করছিল ওদের দু’জনের জন্য। মেহরিনদের সাথে দেখা হতেই মেহরিন আর ইশারায় সবাই নিজেদের পার্টনার আর ছোট টেবিলে খাবার রেখে পাখা নিয়ে বসে গেল। মেহরিন বলল,
— তোমরা চলে এসেছো, বসে যান দেবরজী জীবন আর রাজের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায়।
মেহরিন রাজকে বাতাস করতে করতে বলল,
— আরফা শোন, একটা কাজ করতে পারবি?
আরফা হাসিমুখে বলল,
— হ্যাঁ, বল না।
মেহরিন বলল,
— তুই একটু জীবন ভাইয়ার খাবারটা দিয়ে দে, মানে সবাই তো বসে গেছে।
আরফা খুব গুরুত্ব না দিয়ে বলল,
— আচ্ছা।
বলে সাজানো খাবারের থালা জীবন আর টেবিলে রাখল।
তা দেখে জীবন ইশারায় মেহরিনকে কৃতজ্ঞতা জানাল। মেহরিন হাসল, বাকিদের মুখেও মৃদু হাসি। খাবার দিয়ে আরফা জীবনের সামনে রাখতেই মেহের বলল,
— বকাকে দিয়ে একটু বাতাস কর, দেখিস না আমরা সবাই করছি, সবার সাথে এসেছে, তা না হলে তো বৈষম্য হবে, একটা ব্যাপার তৈরি হবে, বেচারা।
আরফা অমতা অমতা করে বলল,
— কিন্তু…
সবাই বলল,
— দে দে, সমস্যা নেই।
আরফা বাধ্য হয়ে পাখা হাতে নিয়ে বাতাস দিতে লাগল। ছেলেরা খাচ্ছে, মেয়েরা খাবার দিচ্ছে আর বাতাস করছে। হঠাৎ রাজ এক লোকমা মেহরিনের সামনে ধরে দিল, মেহরিন হাসিমুখে নিল। রাজের ইশারায় বাকিরাও একই করল।
এদিকে বিপাকে পড়ল আরফা, কারণ জীবন তার মুখের সামনে খাবার ধরে আছে। অসহায়ভাবে আরফা মেহরিনের দিকে তাকাল। মেহরিন খেতে বলল,
— আমন করে একে একে সবার দিকে তাকালে তো সবাই খেতে বলবেই।
আরফা ভাবল, খেয়েই নেবে। তখনই জীবন বলল,
— দেখুন, আমার হাতে কোনো জীবাণু বা ময়লা নেই, আমি খাওয়ার আগে হাত ধুয়ে এসেছি।
এই কথা শুনে আরফা নিজের কপালে চাপড় মারল, তারপর জীবনের হাত থেকে খাবার নিল। এই দৃশ্য দেখে সবাই হাসল, আরফা আর জীবনও।
এরপর ছেলেদের খাওয়া শেষ হলে মেয়েরা বসল, ছেলেরা খাবার বাড়তে লাগল আর বাতাস করল। কিন্তু জীবন আরফার পাতে বেশি বেশি দিচ্ছে।
তা দেখে আরফা চোখ কুঁচকে বলল,
— কী কী করছেন? এত দিচ্ছেন কেন? আমায় কি বক রাক্ষস মনে হয়?
জীবন গম্ভীর স্বরে বলল,
— বেশি বেশি খান, বুঝলেন? নইতো কোনোদিন বাতাসে উড়ে যাবেন। খান, খান, একটু মোটা হন।
আরফা কিছু বলতে গেলে জীবন বলল,
— আবার বলব সেটা।
আরফা চোখ নামিয়ে মনে মনে বলল,
— আল্লাহ, কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম!
এমন সময় জীবন আবার ভাত দিল আরফার পাতে। আরফা বলল,
— আরে, আজব! এত দিচ্ছেন কেন? আমি খাবো না তো।
জীবন বলল,
— আরে, বেশি খান।
আরফা রাগে বলল,
— আরে, আজব! আপনি আমার মা নাকি?
আরফার কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল। শেষে, “মা” কথাটায় জীবন কষ্ট পেল, চুপচাপ উঠে চলে গেল।
তা দেখে আরফার মন খারাপ হল। ভাবল, একটু বেশি বলেই ফেলেছি বোধহয়। বাকি সবাইও খেয়াল করল। চুমকি বলল,
— আহারে, ছেলেটা এত যত্ন করে খাওয়াচ্ছিল, দিলি মন খারাপ করে।
মেহের বলল,
— এটা ঠিক হয়নি।
লামিয়া বলল,
— তুই বুঝবি না, আমার জীবন ভাইকে না বললে ও পারত না।
রাহী বলল,
— আহারে, বেচারা।
মেহরিন বলল,
— থাম, থাম, আর কিছু বলিস না। জীবন ভাইয়ার ভুল, ও একটু বেশি করে ফেলেছে।
সবাই এভাবে বলায় আরফার মন আরও খারাপ হল। খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবাই গেলো ওই বাচ্চাটার কাছে, তাকে খাবার কিনে দিলো সাথে অনেক গুলো টাকাও দিলো। রাজ তার ছেলেদের মধ্যে একজন কে বলে,
ওর মার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সাথে মাসে মাসে টাকা পাঠাতে যেনো ওদের কোন সমস্যা না হয়। এর পর বাড়ি ফেরার জন্য রওনা দিল সবাই। আগের মতোই জীবন আরফা বাইকে উঠল। কিন্তু জীবন কোনো কথা বলল না, চুপচাপ।
আরফা আগ বাড়িয়ে বলল,
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭২
— শুনছেন, জীবন?
জীবন বাঁকা হেসে বলল,
— হুঁ।
— আপনি কি আমার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছেন?
জীবন কিছু বলল না। পুরো রাস্তা আর একটা কথাও বলল না।
ছ’টার দিকে সবাই বাড়ি এসে পৌঁছল।