মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭৮

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭৮
মির্জা সূচনা

পাক্কা পঁচিশ মিনিট বাইক চালিয়ে সবাই এসে পৌঁছাল নিজেদের গন্তব্যে—এক বিশাল অরণ্যে, যেখানে হাজার হাজার পর্যটক ঘুরছে। এত গুলো বাইক এক সাথে দেখে আশেপাশের সবাই তাকিয়ে আছে রাজদের দিকে। হয়তো বুঝতে চাইছে কারা তারা।একে একে সবাই মাথার হেলমেট খুলে ফেলল সবার মুখে লেপটে আছে বাঁকা হাসি।
ঠিক তখনই এক লোক এগিয়ে এলো—পরনে রাজদের মতোই কালো পোশাক। সামনে এসে দাঁড়াল লোকটা। হেলমেট খুলতেই সবার হাসি গার হলো। লোকটা রাজের কাঁধে হাত রেখে বলে উঠল—
বুঝলি, ভায়া? অনেক দিন কোনো নরপিশাচের মৃত্যু দেখি না। দেখি না তাদের তরতাজা রক্ত। ছোচু মারতে মারতে আমার হাত, আমার শরীর সবই দুর্গন্ধময় হয়ে গেছে। নরপিশাচের টাটকা রক্তে আবার হাত রঞ্জিত করতে চাই ভায়া।
রাজসহ সবাই হেসে উঠল।
হঠাৎ লামিয়া হাসতে হাসতে বলে উঠল—

উফ! শিহাব ব্রো, তোমার সেই ইচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি পূর্ন হবে সময় আর সুযোগের অপেক্ষা মাত্র। জানো তো? মামুর দেওয়া এত এত প্রশিক্ষণ আমি কোনোদিন কাজে লাগাতে পারিনি। হয়তো আজ তোমার সঙ্গে আমিও সুযোগ পাব।
শিহাব হেসে উত্তর দিল—
অবশ্যই, অবশ্যই।
রিদ গম্ভীর স্বরে বলল—
এখানে সময় নষ্ট করা উচিত নয় চলো।
রিদের কথায় সবাই তার দিকে তাকাল।
তা দেখে রিদ আবারও বলে,
তোরা বুঝতে পারছিস মাহিন ওদের কাছে ছোট্ট শিশু—মা থেকে দূরে কত ঘন্টা যাবত।
রিদের কথায় মেহরিনের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। যতই শক্ত থাকার চেষ্টা করুক, মায়ের মন তো!
রাজ রিদের কাঁধে হাত রেখে বলল—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চিন্তা করিস না। মাহিন একদম ফিট অ্যান্ড ফাইন আছে। আমি যদি খুব ভুল না হই, তবে সে এখন এক নারীর কাছে আছে, যিনি তাকে মায়ের মতো আগলে রেখেছেন। তোর কী মনে হয় রাজ শিকদার এত কাচা খেলোয়াড়? আমার সন্তানকে অনিশ্চিত কোন জায়গায় রাখার মতো যুকি আমি কখনোই নিব না। আমার সন্তানরা যেখানেই থাকুক তাদের এক চুল ক্ষতি করার সাধ্য আল্লাহ বেতীত্ব কারো নেয়।
রাজের কথায় সবাই তাকাল তার দিকে। মেহরিন কিছু বলতে চাইল, কিন্তু রাজের চোখের গভীরতা দেখে আর কিছু বলল না। হয়তো নিজের প্রশ্নের উত্তর রাজের চোখেই পেয়ে গেছে। মেহরিনের মুখেও ফুটে উঠল এক রহস্যময় হাসি।

এদিকে সাব্বির নিজের ফোনটা দেখে বলল—
বস, সব রেডি চলুন।
সবাই সামনে এগোই নিজেদের গন্তব্য—মাহিন আর লাবিবকে উদ্ধার করতে। শত শত পশু আজ কুরবানি হবে। রঞ্জিত হবে ধরণি—কোনো রঙে নয়, রক্তে।
অন্যদিকে মহাসড়কে ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে এগারোটা কালো মারসিটিস। শত শত গাড়িকে পিছনে ফেলে ছুটছে তারা। দেখে মনে হচ্ছে কতো তাড়া তাদের! সেই এগারোটা গাড়ির পেছনে একই তালে ছুটে আসছে পঁইত্রিশটা ট্রাক—যাতে কমপক্ষে একশ সত্তর জন মানুষ হবে। সবার হাতে রামদা, কুড়াল,ছুরি আর বন্দুক। সবার চোখেমুখে সব কিছু ধংস করে দেওয়ার জ্বলন্ত স্পৃহা।

গাড়িগুলো এসে থামল জঙ্গলের এক বিশাল টিলার ওপর। একে একে সবাই নামল।
প্রথম গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল প্রেম নেওয়াজ। তার চোখদুটো দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। গাড়ি থেকে নেমেই সে একটা সিগারেট ধরাল। টিলার ওপর উঠে দাঁড়াল, বাচ পাখির মতো চারপাশে চোখ ঘোরাল। হঠাৎ কিছু একটা দেখে হাসল। হাতে ধরা সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষতে পিষতে বলল—
এই সিগারেটের মতোই পিষে পিষে মারব সবগুলোকে।
প্রেম সবার দিকে একবার দেখে পিয়াসের দিকে তাকায়।
পিয়াস একটা দূরবীন তুলে দিল প্রেমের হাতে। ভালো করে সবকিছু দেখে নিয়ে প্রেম বলল—
সবাই ছড়িয়ে পড়। আমার অডার না পাওয়া পর্যন্ত কেউ কিছু করবি না।
সবাই মাথা নেড়ে নিজেদের কাজে লেগে পড়ল। সবার চোখেমুখে স্পষ্ট আগুন দৃঢ়তা,সবার ভিতরে সব ধংস করার প্রবল স্রোত তবে ঠোঁটে একটিও শব্দ নেই। একদম নীরবতায় তারা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।
ধরণিতে তখনে নেমে এসেছে কালো অন্ধকার।

অন্ধকার হওয়ার সাথেসাথেই চারদিক থেকে ভেসে আসে এক বিকট শব্দ। শব্দের তীব্রতা এতই বেশি যে সবার মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেছে। সবাই কানে চেপে ধরে চিৎকার করছে।
অমন সময়ে এক গুলির শব্দ হয়—যা ওই বিকট আওয়াজ আর শব্দের কারণে ঢাকা পড়ে গেলো। সেই গুলিতে একজন ঠাস করে পরে গেলো।আর সেখানে খুব সাবধানে অন্য একজন বসে পরলো ভাবটা এমন যেনো এখানে কিছুই হয়নি। আস্তে আস্তে শব্দ কমে আসে।বিকট শব্দ থেমে গিয়ে সবাই একটু শ্বাস ফেলে স্বস্তি পাচ্ছে।সবাই আবার নিজেদের কাজে মন দেয়।

রাজরা বসে আছে এক গর্তে। সবার কানে হেডফোন, যার কারণে ওই বিকট শব্দে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি।
রাজ হঠাৎ ইশারা করতেই মেহরিন, মেহের, লামিয়া ও মেহবুবা বেরিয়ে যায় সামনের দিকে।
একটু সামনে গিয়েই চার রমণী একে অপরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল।কি ভয়ানক সুন্দর সেই হাসি!
এই হাসি যে কারো মনে ঝড় তুলতে সক্ষম, আবার শত্রুর কলিজায় কাঁপন ধরাতেও।
চার অতিসুন্দর রমণী ঠোঁটে হাসি রেখেই এগিয়ে যায়—তাদের পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপান্তর করতে।
রাকিব বলে উঠল—

এটা কি ঠিক হলো? হাজার হলেও ওরা চারজনই মেয়ে।
রাকিবের কথার উত্তর দিল রিদ—
তুই ওদের এখনো চিনতেই পারিসনি। চিনলে এটা বলতি না।
রাকিব আর কিছু বলে না। সবাই তাকায় ঘড়ির দিকে।
সবার টাইম সেট করা—১০ মিনিট।
বিশাল এক বাংলোর সামনে এসে থামে তারা।
চার রমণী ওপরে তাকিয়ে—হঠাৎই বিশাল দেয়াল টপকে ভেতরে চলে যায়।
কিছুটা দূর থেকে কয়েক জোড়া চোখ তা দেখে বাঁকা হাসে।
দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, যেদিকে ঢুকেছে সেদিকে কেউ নেই। তারা আবার একে অপরের দিকে তাকায়, অবাক হয়। ভেবেছিল, এখানে কেউ না কেউ থাকবে।
মেহের ইশারায় বোঝাল—সব ঠিক আছে।
তারপর অবাক হওয়ার ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে তারা বাঁকা হাসি দিল। সামনে এগোতে লাগল।
ওদিকে টিলার ওপর প্রেম ঠোঁট কামড়ে হাসে।
মনে মনে বলে—

তোমার বিপদ হয় এমন কিছু কি আমি হতে দিতে পারি? আমি যে তোমাকে চিনি, প্রিয়তমা। তোমাদের যাওয়া দেখেই বুঝেছিলাম, এমনটাই হবে। তাই তো আগে থেকেই সব সরিয়ে দিয়েছি। আমার দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত কোনো বিপদ তোমায় বা তোমার পরিবারকে ছুঁতে পারবে না।
ওদিকে মেহের একটা টেক্সট পাঠাল।
সে এসএমএস দেখে রাজ সামান্য ওপরে তাকিয়ে হাসে।
সবাই একটু অবাক হলেও, রাজ হাসল।
হয়তো সে আগেই জানত। রাজ কাউকে একটা টেক্সট করল, তারপর বলল—
আর মাত্র ৫ মিনিট সবাই রেডি হও।
ওদিকে প্রেম সবাইকে একবার দেখে পিয়াসের দিকে তাকাল।পিয়াস হেসে মাথা নাড়ল।
মেহরিনরা খুব সতর্কতার সঙ্গে সামনে এগোল।
কারো পায়ের শব্দ শুনে সবাই লুকিয়ে যায়।
দু’টি ছেলে এসে দাঁড়ায়, এদিক-ওদিক তাকায়।

হাতে বর্শার মতো অস্ত্র, মুখ ঢাকা। দুই পাশে থাকে মেহরিন ও মেহের।হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে দু’জনের ওপর।
হঠাৎ তাদের সামনে আসায় লোক দুটো ঘাবড়ে যায়।
কিন্তু কিছু বলার বা করার সুযোগ না দিয়েই মেহরিন ও মেহের দু’জনের মাথা ধরে জোরে ঘুরিয়ে দেয়।
ফলে তারা পড়ে যেতে চাইলে—তার আগেই লামিয়া আর মেহবুবা এসে ধরে ফেলে, টেনে বাম দিকে নিয়ে ফেলে দেয়।
আসেপাশে তাকিয়ে একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয় দু’জনকে।
মেহের ডেকে ওঠে—জীবন?
ওপাশ থেকে জীবন সাড়া দেয়।
জীবন মেহেরের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
সে বলতে শুরু করে—

মেহের, তুমি যেদিকেই আছো, তার বাম পাশের দিকটাই যাও। সেখানে ৩টা রুম পাশাপাশি। একদম শেষ রুমটাই যাবে। সেখানেই লাবিব আছে।
মেহের “ওকে” বলে ওদের দিকে তাকায়।
মেহের কোনো কথা না বলে ইশারায় বোঝায়।
সবাই সতর্কতার সাথে এগিয়ে যায়।
সবার আগে লাবিবকে উদ্ধার করতে হবে।
কারণ তারা সবাই জানে—মাহিন সুরক্ষিত।
লাবিবকে ছাড়াতে পারলেই খেলা পুরোটা ওদের হাতে।
প্ল্যানমাফিক সব হচ্ছে।
ওরা একটু সামনে দিকে এগিয়ে যায়।
হঠাৎ আবার কারো পায়ের শব্দে লুকিয়ে পড়ে।
একটা মেয়ে এসে থামে।

লামিয়া তেরে যেতে চায়, কিন্তু মেয়েটার কথায় থেমে যায়।
ম্যম, আপনারা আমার সঙ্গে আসুন। I know, আপনারা চারজন এখানেই আছেন।খুব ধীরে কথাগুলো বলল মেয়েটি।
ওদিকে মেহরিন, মেহের, লামিয়া ও মেহবুবা একে অপরের দিকে তাকাল।
হঠাৎ লামিয়া বলে উঠল—
Say code…?
কোডের কথা জিজ্ঞেস করার একটাই করান রাজ বলেছিলো কেউ যদি বলে তাদের লোক তখন যেনো কোড চাই যদি কোড বলতে পারে তবে সে তাদের লোক।
মেয়েটি হেসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল—
Rs009..!

লামিয়া হাসল।লামিয়ার হাসিতে মেহরিন ও মেহের যা বোঝার বুঝে গেল।
রাজ কেন ওদের ভেতরে ঢুকতে দিতে মানা করেনি—সেই উত্তর যেন পেয়ে গেল সবাই।
মেহরিনরা বেরোতে গেলে হঠাৎ মেয়েটি মাথা নেড়ে ‘না’ করে উল্টো ঘুরে দাঁড়াল।
ঠিক তখনই মেয়েটির কাছে এগিয়ে এলো দুটো ছেলে।
মেঘা, তুমি এখানে কেন?
একজন জিজ্ঞেস করল।
মেঘা নামের মেয়েটি শক্ত মুখে উত্তর দিল—

I am not obligated to answer you. Go about your business..!
ছেলেগুলো রাগী চোখে একবার মেঘার দিকে তাকাল, তারপর চলে গেল।
ছেলেগুলো যেতেই মেঘা ইশারায় মেহরিনদের বের হতে বলল।
ওদের নিয়ে সে সোজা চলে গেল লাবিবকে যেখানে আটকে রাখা হয়েছে সেদিকেই।
ভেতরে ঢোকার আগে মেঘা এদিক-ওদিক তাকিয়ে মেহরিনকে বলল—
ম্যম, ভেতরে একটা CCTV আছে।
কথাটা শুনেই মেহবুবা, লামিয়া আর মেহরিন মেহেরের দিকে তাকাল।
মেহের বাঁকা হেসে মেঘাকে বলল—
কোথায় বলতে পারো?
মেঘা মাথা নেড়ে বলল—

একদম ঘরের বাদিক, জানালার ঠিক ডান পাশে ফুলের টব।
মেহের হেসে পা একটু উঁচু করল।
একটা সাইলেন্টসার লেগানো ছোট পিস্তল বের করল।
দরজা না খুলেই, ফাঁক জায়গায় তাকালো এরপর এক চোখ বুজে তাকাল, নিশানা লাগাল আর গুলি চালাল।
সাথে সাথে ফুলের টবটা ভেঙে গেল।
রুমটা সাউন্ডপ্রুফ হওয়ায় কোনো সমস্যা হলো না।
কিন্তু ভেতরে থাকা তিনজন লোক হকচকিয়ে উঠে ওদিকে ছুটল।একজন বেরোতে চাইলে—তার আগেই মেহরিনরা ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল।
পাঁচজন ঝাঁপিয়ে পড়ল ওই তিনজনের ওপর।
আশেপাশে তাকালো কিন্ত কই লাবিবকে তো দেখা যাচ্ছেে না।
সবাই মেঘার দিকে তাকাল।
মেঘা চোখের ইশারায় সাথে যেতে বলল।

মেঘা গিয়ে একটা সুইচ টিপতেই—একটা দরজা উল্টো ঘুরে গেল।সেখানে হাত-পা দরজার সাথে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে লাবিব।
সারা শরীরে রক্ত। এখনও নাকের ডগা বেয়ে রক্ত পড়ছে।
মেহরিনের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল।
মেহবুবা দৌড়ে গিয়ে লাবিবের মুখে নিজের হাত রাখলো।
সারা মুখে হাত বুলিয়ে কান্না করতে লাগল।
লামিয়াও দৌড়ে গিয়ে—
ব্রো…!

বলে ডেকে উঠল।
ওদের ডাকে লাবিব চোখ মেলে তাকাল।
মেহের হাত মুঠো করে ফেলল চোখ গুলো রাগে জালা করছে।
মেহবুবাকে কাঁদতে দেখে লাবিব ঠোঁট কামরে হাসে পরক্ষণেই বিরক্ত গলায় বলল—
এই ল্যাদা বাচ্চা কাঁদছো কেন? তোমার কী জামাই করছে? না না তা হয় কেমনে আমি তো ফিট এন্ড ফাইন আছি। তাহলে?
লাবিবের সুস্থ, স্বাভাবিক কথা শুনে সবাই অবাক হলো।
মেহবুবা আবারও কেঁদে ফেলল।
মেহের ভ্রু কুঁচকে বলল—
Are you okay?
লাবিব হেসে মাথা নাড়ল।
মেহরিন তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, তারপর বাঁকা হেসে উঠল।
হয়তো আসল কাহিনি বুঝে গেছে।
মেহেরও বাঁকা হেসে বলল—
প্লেন?

লাবিব মাথা নেড়ে হেসে দিল।মেঘা এগিয়ে এসে মিষ্টি হেসে বলল—ইয়েস ম্যম। তবে স্যারের শরীরে যে আঘাতের চিহ্ন দেখছেন, সবগুলো ভুয়া। তবে রক্তগুলো সত্যি, কিন্তু সেটা স্যারের নয়।
এতক্ষণে সবাই সবটা বুঝে হেসে উঠল।
লাবিবও হেসে বলল—
বেচারা ভেবেছিল সব তার প্ল্যান!
মেহরিন আর মেঘা লাবিবের বাঁধন খুলে দিল।
ওদিকে মেহবুবা রাগে গজগজ করতে করতে দাঁড়িয়ে রইল।
মনে মনে ভাবল—
লাবিবের গুষ্টি উদ্ধার করছে! কত বড় খারাপ—একবারও বলল না এগুলো আসলে প্ল্যানটা। আর এদিকে কিনা সে চিন্তা করতে করতে শহিদ হয়ে যাচ্ছিল যাকগে, এখন কিছু বলবে না। বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে দেবে সব এই সব ভাবছে আর ফুস ফুস করছে সে।

লাবিব হয়তো মেহবুয়ার মনের ভাব বুঝল। তাই বলল—
খবরদার! আমাকে গালি গালাজ করবে না। উল্টাপাল্টা কিছু ভাববেও না।
মেহবুবা মুখ জামটা দিল।
লামিয়া এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরল।
লাবিব মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বলল—
চুমকি আপু?
মেহরিন হেসে জানাল—সব ঠিক আছে।
মেহরিন হঠাৎ তাকাল লাবিবের দিকে।
লাবিব হেসে বলল—

যেখানে আমার কিছু হয়নি, সেখানে আমাদের বাচ্চার কিছু কি হতে দেব?
কাক্ষিত উওরে মেহরিন হাসল।
লাবিব নিজের শরীর ঘার হাত সব ফোটাল, তারপর মেঘার দিকে তাকাল।
মেঘা সাথে সাথে পানি এনে দিল।
লাবিব হাত-মুখ ধুয়ে নিল।
ওদিকে মেহের জীবনকে সিগনাল দিল।
মেহরিনরা বেরিয়ে গেল।
গন্তব্য সবার একটাই—নরপিশাচের মুখোমুখি হওয়া।
ওদিকে সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় রাজরা এগিয়ে এলো।
দাঁড়াল সেই বাংলোর গেটে।
হাতে মেশিনগান।
তার পাশে রিদ, আরশ, রাকিব, শিহাব, জিবন।
রাজ সবাইকে দেখে হাসল।
বলল—

থ্রি… টু… ওয়ান…
বলতেই গেটটা ভেঙে পড়ল।
মাটিতে পড়তেই চারপাশ ধুলোয় ভরে গেল।
আস্তে আস্তে স্পষ্ট হলো রাজদের মুখ।
গেট ভাঙার শব্দে কতগুলো ছেলে দৌড়ে এলো।
কিন্তু আফসোস—
কেউ এসে জায়গামতো দাঁড়াতে ও পারল না।
তার আগেই এক একজনের মাথা, বুক ঝাঁঝরা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
রাজ মনের সুখেমেশিনগান চালাচ্ছে,তবে শুধু রাজ নয়—
রাজের সাথে আরও একজন গুলি ছুঁড়ছে।
বৃষ্টির ফোঁটার মতো সাই সাই করে গুলি ঝরছে।
দুজন সামনের দিকে, একজন সামনা সামনি অপরজন আড়াল থেকে।দুজনের নিশানায় একদম নিখুঁত।
রাজ গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঠোঁট কামড়ে হাসল।
বাকিরা সব দেখল, কিন্তু কিছু বলল না।
তাদের ধারণা—

বাকি গুলিগুলোও রাজের লোকেদের। রাজ ছাড়া আর কেউ জানলো না আড়ালে কে?
এক এক করে সবাই ঢুকে পড়ল সেই বাংলোতে।
বাংলোটা জঙ্গলের ভেতরে হলেও আধুনিকতায় ভরপুর।
একটা মজার ব্যপার হলো পুরো বাংলোটা সাউন্ডপ্রুফ।
অবশ্যই এর যথারীতি কারণও আছে—বইকি, এই বাংলোয় কোনো ভালো কাজ হয় না।সব কালো টাকার কারবার এখানে হয়—নারী পাচার, শিশু পাচার, নানা ধরনের অস্ত্র, ড্রাগস…এক কথায় বলতে গেলে—
যত ধরনের দেশদ্রোহী কাজ আছে, সব এখান থেকেই হয়।
আর যার মাস্টারমাইন্ড আজ এই বাংলোয়।
রাজ আর বাকিরা ভেতরে ঢুকে সোজা এগিয়ে যায় মেহরিনদের কাছে। আপাতত কোনো ঝামেলাই নেই বাংলোর ভেতর।যা ছিলো, সব লোক দেখানো ঝামেলা।
যে আগাছা ছিলো, সব সাফ করে ফেলেছে প্রেম।
যদিও এটা প্রেমের কাজ, তবে তা রাজ ছাড়া কেউ জানে না।
বাংলোর ভেতরে ঢুকেই রাজ আর মেহরিনরা চলে যায় দ্বিতীয় তলার একটা বিশাল রুমে।
রুমটা ভীষণ বড়।দক্ষিণ দিকে একটা বিশাল জানালা।
সাদা টাইলস।আসবাবপত্র সব বিদেশি।

দেখেই বোঝা যায়, দেশের বুকের ভেতর হলেও বাংলো সাজানো হয়েছে একেবারে বিদেশি কায়দায়। এসব দেখে রাজ বাঁকা হাসে।
শিহাব বলে—
– সালা, কালো টাকার কুমির! বুঝলি?
লাবিব বলে—
–দেখো না, বাথরুমেও এ.সি. লাগিয়েছে। বেশি টাকা হলে মানুষরে কেমনে কামড়াই এই আবাল কে দেখলেই বুঝবে মানুষ। নয়লে কেউ বাথরুমে এ.সি লাগাই তুমি বলো?
লাবিবের কথায় সবাই ফিক করে হেসে দেয়।
রাজ গিয়ে আয়েশ করে বসে একটা রাজকীয় সোফায়।
রাজের দেখা দেখি সবাই বসে পড়ে।

পাশ থেকে রাজ রিমোট হাতে নিয়ে দেয়ালে ঝোলানো বিশাল টিভিটা অন করে।
কিছুক্ষণ টিপে Tom and Jerry তে আটকে যায়।
শুধু রাজ নয়—
বাকি সবাই এবার নজর দেয় টিভিতে।সবার দৃষ্টি আটকে আছে জেরির দিকে।
জেরি টমের মুখে একটা বেলচা দিয়ে বাড়ি মেরে ছুটছে।
আর টম সেই বেলচা হাতে ছুটছে জেরির পিছনে।
টানটান উত্তেজনা—দেখে বোঝা যায়, এক্ষুনি ধরা পড়বে জেরি। টম প্রায় ধরেই ফেলছিলো। ঠিক শেষ মুহূর্তে জেরি রাস্তা পালটে ফেলে যায় ফলে টম গিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা খায়। টম রাগে জেদে জেরিকে ধরতে গিয়ে নিজের বিপদ খেয়াল করেনি।জেরি সরে যেতেই সবাই হৈ হৈ করে ওঠে।
শিহাব, জিবন এক সাথে বলে—
এইজন্যই লোকজন বলে—

ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।তাদের কথায় সবাই সায় দেয়।তবে রাজ বাঁকা হেসে বলে—
আসল কথা হলো—
নীরবে যুদ্ধে করে সে,সবচেয়ে উচ্চ শব্দে জিতে বুঝলি?
টম নিজের আকার দেখে,
কিন্তু ছোটো জেরির আকার ছোট হলেও তার মাথা ভরতি বুদ্ধি।যেখানে শক্তি কাজ করে না,সেখানে বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে হয়। যা ওই মাথা মোটা টমের নেই।
রাজের কথার পিঠে মেহের হেসে বলে ওঠে—
– “Look like you, brother!”
রাজ হাসে, মাথা একটু ঝুঁকিয়ে বুকের কাছে এক হাত রেখে বলে—
– জিও সিস্টার।

রাজের কথায় সবাই হেসে ওঠে।সবার হাসির মাঝেই হঠাৎ মেহরিন সবাইকে থামিয়ে দেয়।ইশারায় কিছু একটা বলে।
যা বুঝে সবাই বাঁকা হেসে নিজেদের জায়গায় ঠিকঠাক হয়ে বসে।
একটা লোক কানে হেডফোন লাগিয়ে হেলেদুলে আসছে।
গায়ে শুধু থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট।গলায় ঝুলছে তোয়ালে।
চুল থেকে টুপটাপ পানি ঝরছে—বোঝাই যাচ্ছে সদ্যই গোসল করেছে।
হ্যাঁ, সে-ই তো—
একটানা দুই ঘণ্টা সুইমিং করে আসলো।
আপনারা হয়তো জানেন, সুইমিং পুল সাধারণত বাইরে বা ছাদে হয়।কিন্তু এই বাংলোয় আছে একেবারে ভিন্ন ব্যবস্থা।
তৃতীয় তলার একটা রুম জুড়ে তৈরি করা হয়েছে সুইমিং পুল।দেখতে পুরোপুরি ঘরের মতো,তবে থাকার জন্য নয় সুইমিং করার জন্য।
পাকা দুই ঘণ্টা সুইমিং করে এখন বিশ্রাম নিতে যাচ্ছে লোকটা।পুরো বাংলো সাউন্ডপ্রুফ হওয়ায়,
সদ্য যে তাণ্ডব হলো তার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র খবর তার নেই।
আচ্ছা লোকটা যদি জানতো এটাই শেষ গোসল,
তাহলে কেমন হতো?
হয়তো মৃত্যুভয়ে, মৃত্যুর আগেই পটল তুলতো।

তবে লোকটাকে দেখলে কেউ বলবে না এই লোকটা মানুষ রুপি পশু। এই তো জিম করা, পেটানো শক্ত পেশিগুলো ফুলে ফেঁপে আছে।সাদা ধোপধাপে গায়ের রঙ।
চুলগুলো ব্রাউন।চোখগুলো হালকা বাদামি।দেখতে একেবারে বিদেশি ধাঁচের।একটা ভ্রু কাটা।
ঠোঁটের একটা নিচে সেলাইয়ের দাগ। দেখতে কী সুন্দর অথচ সে একটা পশু কত মানুষের অভিসাপ করে প্রতিদিন তা হয়তো সে নিজেও জানেনা। কত মায়ের কোল খালি করেছে এই লোক,কোন মেয়ের জীবন জাহান্নাম করে দিয়েছে,কতো মানুষের জীবন ধংস করছে প্রতিনিয়ত,কত শিশুর হত্যাকারি এই লোক। আমাদের আশে পাশে কত মানুষ রুপী পশু ঘুরে বেড়ায়। যাদের দেখতে সুন্দর হলেও তাদের মন পশুর মতো।
লোকটা হেলেদুলে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।
পাশে তাকায়।দূরে দু’জন ছেলে বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে।
অপর পাশে ফিরে দেখে,সেখানেও একই অবস্থা।
সব দেখেও লোকটা বাঁকা হেসে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে ঢোকে।রুমটা অন্ধকার।লোকটা বিরক্ত হয়ে গালিগালাজ করতে করতে লাইট অন করে।
লাইট জ্বালাতেই যা দেখে—

তা দেখে তার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম!প্রথমে নিজের ভুল ভেবে মাথা ঝাঁকায়।চোখ কচলিয়ে আবার তাকায়…
লোকটা হয়তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। লোকটাকে এমন করতে দেখে সবাই হেসে উঠল।
রিদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল—
হেই ব্রো, হোয়াটস আপ? চিনতে পারছ তো? তোমার অন এন্ড অনলি ব্রাদার রিদ তালুকদার! হাউ আর ইউ? এভরিথিং ইজ ওকে ব্রো?
লোকটা হয়তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। লোকটাকে এমন করতে দেখে সবাই হেসে উঠল।
এমন সহজ-সাবলীল অবস্থায় রাজ আর বাকিদের এখানে দেখে লোকটার হার্ট অ্যাটাক হওয়ার জোগাড় লোকটার। বিশেষ করে রিদকে এভাবে দেখে, রিদের কথা শুনে, লোকটার প্রান পাখিটা যেনো যায় যায় অবস্থা।
এদিকে মেহের বিরক্ত হচ্ছে—তার মনে এত কথা বলে সময় নষ্ট করার কী আছে আজব! তার তো হাত-পা নিশপিশ করছে।

লোকটা তখনও হতবাক, মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এত এত লোক, এত এত সিকিউরিটি পার হয়ে সুস্থ ভাবে সশরীরে রাজরা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে— এ যেন তার জীবনের ইতি টানার পালা এসে গেছে। ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও তা মুখে আনতে নারাজ। ছোট করে নিজের অবাক ভাব কেটে গিয়ে রাগভরা কণ্ঠে বলল—
সুস্থ অবস্থায় আমার সামনে এলোও বের হবে সব কয়টা লাশ হয়ে! কথাটা রাজের চোখে চোখ রেখে বলে।
রাজ বাঁকা হাসে। লামিয়া তেরে আসতে চায় তবে তার আগেই আরোশ তাকে আটকে দিল।
লামিয়া তখন বাঁচখায় গলায় চিৎকার করে উঠল—
ব্লাডি বিচ, আই জাস্ট কিল ইউ।
রাজ একবার লামিয়ার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলল। মেহরিন লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল—

কার লাশ বের হবে, সেটা আমি জানি না। কিন্তু… কিন্তু… কিন্ত তোর শরীরের কোনো অঙ্গ অবশিষ্ট থাকবে না— এটা নিশ্চিত জেনে রাখ। এই বাংলো থেকে শুধু তোর কলিজা খানা বের হবে। ওটা উপর মহলের আমানত!
মেহরিনের কথায় লোকটা বিকট হেসে উঠল।
— উফ্‌ফ্‌… মেহরিন শিকদার।
ঠোঁট কামড়ে লোকটা আবার বলল—
তোর শরীরে এত কারেন্ট কেন বল তো?
কথা শেষ হতেই দুই দিক থেকে ঘুষি খেল লোকটা। একদিকে লাবিব, অন্যদিকে জিবন। মার খেয়েও লোকটা হাসল, ঠোঁট কেটে গেছে রক্ত বের হচ্ছে লোকটা থুতু ফেলে।
মনে হলো, সে জানতো এমন হবেই। হঠাৎ লোকটা গিয়ে সোফায় বসে পড়ল। কাউকে ডাকল না। বিচক্ষণ মানুষ হওয়ায় বুঝতে দেরি হলো না— এখানে রাজের লোক আছে বলেই এত সহজে তারা ঢুকেছে।
লোকটা রাজের দিকে ফিরে বলল—

তোকে আর তোর বউকে কয়েকবার মারলেও আমার জ্বালা কমবে না। তবে তোর বউকে আমি মারতে চাইনি। আমি তো ওকে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলাম! বাট গড নোস এই মেয়ের ভেতরে কী আছে— দুনিয়ার সব বালেরা এর পেছনেই পড়ে আছে।
রাজ শিকদার, আমার সো কল্ড ব্রাদার রিদ তালুকদার আর ওই মাদার****দ প্রে এটুকু বলতেই রাজ বাধা দিয়ে বলল—

তোর আর তোর বাপ দু’জনেরই নজর খারাপ। এটা কি জন্মগত অভ্যাস, নাকি কী! আমায় দেখ— আমার বউ ছাড়া কারো দিকে আমি তাকাই না। হাজার জন চাইলে ও, আমি শুধু তাকেই চাই। আমি একটা কথা বুঝি না তোদের মেশিন এতো নড়বড়ে কেন? যাকে তাকে দেখলেই তোদের ছোট ভাই নাচানাচি শুরু করে? তোদের মত তোদের ছোট ভাই ও বারোবাতারি। এই দেখ! আমাকে দেখ! আমার মত স্ট্রং পার্সোনালিটির মানুষের থেকে শিক্ষা নিবি। আমি আর আমার ছোট ভাই দুইজনেই খুব স্ট্রং। আমাকে নিয়ে যা না নারীর বাজারে দেখবি আমার মেশিন থুক্কু আমার ছোট ভাই নড়াচড়া তো দূর বেঁকে যাবে প্রয়োজনের নষ্ট হয়ে যাবে অকেজো হয়ে যাবে দাও নড়বড়ে হবে না। দিস ইজ পাওয়ার অফ রাজ শিকদারের মেশিন থুক্কু ছোট ভাই।

রাজের কথায় লোকটা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। বাকিরা মুখ চেপে হাসছে। মেহরিন রাগী চোখে তাকায় কিছু বলতে চাইছিল, কিন্তু রাজ তাড়াতাড়ি বলে উঠল—
বউ, একদম চুপ। একদম চুপ ওকে। নইলে এক থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে, চুমু খেয়ে দম আটকে ফেলবো বলে দিলাম।
এবার সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
মেহবুবা হাসতে হাসতে বলে উঠল—
ভাইয়া, থাপ্পড় মেরে আবার চুমু খেয়ে দম আটকে দেয় কেমনে??
মেহরিন মুখ ফুলিয়ে রাজের দিকে তাকাল, মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল— এই লোক জীবনে কোনোদিনও ভালো হবে না!
রাজ তখন রিদের কাঁধে হাত রেখে বলল—

যা ভাই, বড় ভাইয়ের সাথে সুখ-দুঃখের একটু গল্প করে আয়। প্রথম আর শেষ সাক্ষাৎ বলে কথা যা যা..
রিদ মুখ ভার করে বলল—
হে হে, তবে শোন। আমার কিন্তু তেমন সময় নেই। মাত্র ৫ মিনিট। তুই তো জানিস, আমি একজন চাকরিজীবী মানুষ। সময়ের দাম অনেক।
রাজ হেসে , মাথা নাড়ল। মেহের বিরক্ত মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল—
— নাটকবাজ।
রিদ গিয়ে বসে পড়ল লোকটার পাশে।
— হায় মাই সো কল্ড বিগ ব্রাদার রূপন তালুকদার।
রূপন সামান্য হেসে বলল—

হ্যাঁ, আমি তোমার ভাই। আমি জানি তুমি আমাকে কখনো ভাই মানোনি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে নিজের ভাই ভেবেই এসেছি সারাজীবন। তাই তো মেহরিনকে পছন্দ করার পরও তোমার সাথে তার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম। শুধু তোমার জন্যই। আমি ওকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। জীবনের প্রথম কোন একটা মেয়েকে আমার ভালো লাগে। কিন্তু তার কিছুদিন পরেই জানতে পারি যে আমার ছোট ভাইও সেই মেয়েকে লাইক করে। তাই বাবার সাথে কথা বলে ওর সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করার বন্দোবস্ত কিন্তু আমিই করেছিলাম।শুধু তোমার জন্য নিজের পছন্দের নারীকেও আমি ছেড়ে দিয়েছি।
মেহরিন ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকাল।
রাজের মাথার রক্ত টগবগ করলেও সে শান্ত— কারণ একটাই: তার বউ। হাজার জন চাইলে ও সে শুধু তাকেই চাই।এটা ভেবেই রাজের ঠোঁট ফেটে হাসি বেরোল।
বেচারা রূপন জানেও না, তার কপালে কী অপেক্ষা করছে।
হঠাৎ রিদ রূপনকে জড়িয়ে ধরল। রূপন এর জন্য প্রস্তুত ছিল না, কিছুটা অবাক হলো। হঠাৎ রিদ কান্না শুরু করে দিল।

ও ভাইরে, এখন তোর কী হবে রে! তোর জন্য আমার বুক ফেটে যাচ্ছে রে ভাই!
কান্নার ভান করলেও চোখে এক বিন্দু জল নেই। তাই এদিক-ওদিক তাকাল। রাজের দিকে চোখ পড়তেই রাজ ইশারা করল। রিদ তাড়াতাড়ি একটু থুতু নিয়ে চোখের ওপর ঘষে দিল। এখন মনে হলো সে কাঁদছে।
ওদিকে রূপন হাবলার মতো তাকিয়ে রইল। আশেপাশে বাকিরা হেসে লুটোপাটি।
হঠাৎ রিদ রূপনের তোয়ালেটা টেনে নিল। চোখ-মুখ মুছে নিল, তারপর সেটা দিয়ে নাক পরিষ্কার করে তারপর রুপনের গলায় ঝুলিয়ে দিল।

রূপনের মাথার ওপর দিয়ে সব চলে যাচ্ছে। যখন বুঝতে পেরলো তখন চোখ বড় বড় করে তাকায় রিদের দিকে। এর পর ওয়াক বলে তোয়ালে ছুড়ে ফেলে দিল।
এদিকে লামিয়া আর মেহবুবা হেসে হেসে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।মেহরিন আর মেহের একেওপরের দিকে তাকিয়ে হাত কপাল চাপরায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে,
সিরিয়াস মুহূর্তে কীভাবে উল্টোপাল্টা কাজ করতে হয়, ওদের থেকেই শেখা উচিত!
রাজ দুই হাত তুলে সবাইকে থামতে বলল।
তারপর বলল—
অনেক মজা হলো। কিন্তু ভুলো না, আমরা এখানে কেন এসেছি। তোমাদের মাঝে কোনো সিরিয়াসনেস নেই। আমায় দেখো, আমি সবসময় সিরিয়াস! আজ থেকে সবাই সকাল সন্ধ্যা আমার কাছে ট্রেনিং নেবে কিভাবে সিরিয়াস থাকতে হয়।

রাজের কথায় মেহরিন মুখ বাঁকাল।
রাজ এগিয়ে যায় রুপনের কাছে, কিছু বলতে যেতেই রুপন বাঁকা হাসলো—
এখানে তো ঢুকে গেছিস। তবু ভুলে যাস না, তোর ছেলে কিন্তু আমার হাতে।
এ কথা কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে। রাজ রুপন মুখোমুখি বসে, পায়ের ওপর পা তুলে ইশারা করে লাবিব-এর দিকে—রুপনও রাজের ইশারা অনুসরণ করে তাকায় রুপনকে তাকাতে দেখে চোখ টিপে দেয় লাবিব। রুপন হাসে প্রথমে লাবিব-কে এখানে সুস্থ দেখেই বুঝে গিয়েছিল সব—রাজের প্ল্যান।
রাজ বাঁকা হেসে বলল—
তুই একটা জল জান্তু, আবুল চো*দা! একটা কথা কী জানিস? মানুষ অন্যের পুঁটকিতে গু আছে কিনা দেখতে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে, অথচ নিজের সাথেই যে পুঁটকি আছে সেটা বেমালুম ভুলে যায়। যেমন তুই—নিজের পুঁটকিতে গু রেখে মানুষের পুঁটকিতে গু খুঁজতে ব্যস্ত।

রাজের এহন কথায় ছেলেরা হাসলেও, নারীরা নাক-মুখ কুঁচকায়। তা দেখে রাজ ব্রু কুঁচকে বলে—
তোমরা এমন করছ কেন? শোনো, সবার পুঁটকিতে গু এর গন্ধ থাকলেও আমারটায় নেই। কারণ আমি আমার বউয়ের সাবান চুরি করে ব্যবহার করি। আর সেই সাবানের এমন সুবাস—যে আমি পাদ দিলেও তাতে স্যান্ডেলিনা সাবানের গন্ধ বের হয়! বুঝলে???
রাজের এ কথায় হু হু করে হাসির ফোয়ারা ছুটল। শিহাব হাসতে হাসতে বলে—
ভাই, আগে এখানকার চেপ্টার ক্লোজ কর, তারপর তোর পাদের গন্ধ শুকে দেখব।
শিহাব-এর কথাতে আবারও হাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। ওদিকে মেহরিন ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল—তাহলে কি রাজ সত্যিই সাবান তার ‘ইয়ে’-তে ব্যবহার করে?

এটা ভাবতেই হঠাৎ চোখ বড় করে রাজের দিকে তাকাল।
রাজও মেহরিন-এর তাকানো লক্ষ্য করে শিস বাজাতে লাগল, আর এদিক-ওদিক তাকাল যেনো সে মেহরিনকে দেখছেই না। মেহরিন রাগে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই রাজ অন্যদিকে সরে গিয়ে বলল—
এই এই, কাজ শুরু কর তোরা। বাল, একটাও কাজের না—সব ফাঁকিবাজ! কাজের বেলায় উল্টোপাল্টা কথা বলে শুধু সময় নষ্ট করে।
রাজ হঠাৎ হাসি হাসি মুখটা শক্ত করে দাঁত চেপে বলল—

যেখানে আমার ভাইকেই কিছু করতে পারিসনি নিজের ডেরায় এনেও সেখানে আমার ছেলের কিছু করতে পারবি ভাবলি কেমনে?এতই সোজা রাজ শিকদারের কলিজায় থাবা মারা।তুই এখনও এখানে বসে নিঃশ্বাস নিচ্ছিস কেন জানিস?তোর বডি পার্ট আমার বউ চেয়েছে, আর কলিজাটা চেয়েছে আমার মামনি। তাই আমি বা আমরা কেউ তোকে হাত দিচ্ছি না। অবশ্য, তোর মতো চুনোপুঁটিকে আমার বউ আর বোনরা একাই সামলাতে পারে। এই ওয়েট ওয়েট দাঁড়া—তুই তো মরেই যাবি। মরতে মরতে একটু উপকার করে যা।
রুপন ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও ওপরের দিকে শান্ত থাকে। মনে মনে ভাবে—একটু হলেও বাঁচার আশা আছে। কারণ মূল অস্ত্রটা এখনও কাজে লাগেনি।
রাজ দাঁত বের করে বলে—

আমার বোন লামিয়া আছে না? ও তোর ওপর একটু এক্সপেরিমেন্ট করবে, কেমন? মামু অনেক কিছু শিখিয়েছে ওকে, সেগুলো ঠিকঠাক শিখলো কিনা সেটা-ই দেখবে।
রুপন বাঁকা হাসে—
তুই হয়তো ভুলে যাচ্ছিস, তোর ছেলে আমার হাতে। আমার একটা ইশারাতেই ওর দেহ দেখে প্রাণ পাখি উড়াল দেবে।
এই পর্যন্তই বলছিল রুপন, কিন্তু থেমে গেল। থামিয়ে দিল মেহরিন—রুপন-এর গলা চেপে ধরেছিল সে। রাজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কোনোমতে মেহরিন-কে টেনে সরায়। কিন্তু মেহরিন-কে সরানোই যাচ্ছে না। মেহের, মেহবুবা আর লামিয়া চেপে ধরে আছে মেহরিন কে।
রাজ রুপন-এর গালে মেয়েদের মতো একটা গুতো মেরে বলে—

গুলামের ঘরে গুলাম, একটু চুপ থাকতে পারোস না? আমার বউকে রাগালে বাবা হওয়ার সম্পদ খুয়াবি জানিস না?মরবিই তো নিজের সম্পদ নিয়ে মরার ইচ্ছে নাই নাকি? মনে নেই, তোর বাবা আর সেই চাচাকে কীভাবে মেরেছিল?
মুহূর্তেই রুপন খেপে উঠে রাজের কলার ধরে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই দূরে ছিটকে যায়। ছিটকে যাবার পর বুক জ্বলে ওঠে, ভিজে ভিজে লাগে। চোখ নামিয়ে দেখে—রক্ত বের হচ্ছে। কারণ খুঁজতে সামনে তাকিয়ে দেখে—লামিয়া এক পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তখন বোঝে—লামিয়া তাকে লাথি মেরেছে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ওইটুকু একটা মেয়ে এক পায়ে লাথি দিয়ে তাকে সরিয়ে দিল! কিছু সময় শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে দুর্বল জায়গা প্রয়োজন—আমাদের শরীরে এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে অল্প আঘাতেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। লামিয়া সেই দুর্বল জায়গাটাই বেছে নিয়েছে।

রাজ আর বাকিরা হাসে। রুপন দয়াল ধরে নিজেকে সামলেয়। আর চিৎকার করে ডাকে—
এই কে? আসছিস, এদিকে আয়।
রুপন-এর কথায় সাথেসাথেই রুমে ঢুকে পড়ে কিছু ছেলে। কিন্তু ঢুকেই রাজদের দিকে বন্দুক তাক করে না—রুপন-এর দিকেই ধরে।
তা দেখে রুপন হেসে ফেলে। সে আগেই বুঝেছিল—তবুও ডেকেছিল, শেষ প্রচেষ্টা করতে।
রাজ দুই দিকেই মাথা নেড়ে হাসে—

সালা, আমার কথা কেউ গুরুত্ব দিল না। তখন যে গু এর কথা বললাম, ওটা কেন বললাম তুই বুঝলি না। শোন, একটা সিক্রেট বলি—তোর কাছে যারা আসে না, তারা তোর নয়, আমার কথাতেই আসে। তোর কথাতে কাজ করলেও চলে আমার কথায়। তুই যাদের জোরে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরাস ওরা নামে তোর লোক হলেও কাজে কিন্ত আমার লোক।আচ্ছা, তুই কি মাথা মোটা? কম চেষ্টা করেছিস আমার ক্ষতি করতে। কখনো সফল হয়েছিস?
শোন, আমি রাজ শিকদার—নিজের আপন মানুষ থেকেও শত্রুর পেছনে সময় দিই বেশি, ওদের কাছাকাছি থাকি বেশি। তোর মৃত্যু তো ফরজ হয়ে গিয়েছিল দুই মাস আগে, যেদিন আমার দুই রাজপুত্র পৃথিবীতে এসেছিল।
রাজের এমন কথায় সবাই ব্রু কুঁচকে তাকায় রাজের দিকে। মুহূর্তেই রাজের মুখভাব পাল্টে যায়। হিংস্র হয়ে ওঠে সে। রুপন-এর নাকে জোরে ঘুষি মেরে বলে—

আমার বাচ্চা আর বউকে কিডন্যাপ তোর কথাতেই করা হয়েছিল। তুই-ই করেছিলি। সব জেসি-কে দিয়ে। কি ভেবেছিস আমি কিছু জানিনা?
মুহূর্তেই আবার রাজের মুখভাব পাল্টে যায়। রাজ হেসে বলে—তোর আরেকটা বাপ আছে না? সে তোকে জোমের দুয়ারে পৌঁছে দিত আরও আগে—শুধু।
এতটুকু বলেই থামে রাজ। আরও কিছু বলবে, তার আগেই দরজা খুলে ঢুকে মেঘ আর একটি মহিলা—যার কোলেতে ঘুমিয়ে আছে মাহিন।
মহিলাটি সবাইকে দেখে সুন্দর করে হাসে। মেহরিন অবাক কন্ঠে বলে—

মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭৭

প্রেমা আপু!
মহিলাটি হেসে মাথা নাড়ে। মেহরিন দৌড়ে যায় প্রেমার কাছে—যেন মাহিন-কে নিতে যাবে। এমন সময় ঘরে ঢুকে আসে কিছু মুখোশধারী লোক। আসেই সবাইকে গানপয়েন্টে নিয়ে নেয়।
তা দেখে রুপন হেসে উঠে…

মেহরিনের সপ্নরঙ শেষ পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here