মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৮
মির্জা সূচনা
অনুষ্ঠান চলছে জমজমাট। মঞ্চে এখনো আবৃত্তি, নাচ, গান চলছে।
হঠাৎই একটু গোলমাল শুরু হলো।
অনুষ্ঠান সঞ্চালক মাইকে বলল,
আমাদের পরবর্তী পরিবেশনা ছিল গান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, শিল্পী অসুস্থ হয়ে পড়ায় গান পরিবেশন সম্ভব হচ্ছে না।
ভীড়ের ভেতর একটু কানাঘুষা শুরু হলো।
পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে,
ঠিক তখনই ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টের স্যার, সুলতান স্যার,তিনি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললেন, তোমরা সবাই শান্ত হও ।
আমাদের ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টেই এমন একটা মেয়ে আছে, যার গলায় সুরের জাদু আছে। আমি নিজে ক্লাসে শুনেছি। তার নাম মির্জা মেহরিন। ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্ট এর প্রথম বর্ষের ছাত্রী। মেহরিন, তুমি কি আমাদের জন্য একটা গান গাইবে?
চুমকি আর মেহরিন দুইজনের অবাক হয়ে যায়।
মাইকে সুলতান স্যার হাসিমুখে বললেন,
মেহরিন, আমি জানি তুমি পারবে। আজকে তোমার বন্ধুরা আর আমরাও তোমার গান শুনতে চাই।
মেহরিন উঠে দাঁড়াতে ইতস্তত করছিল। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে যেন। মেহরিন গান গাইতে পারে, তবে এমন মঞ্চে কখনো গান গাইনি। এত এত মানুষের ভিড়ে কেমন নার্ভাস ফিল হচ্ছে আবার স্যারের রিকোয়েস্ট ও ফেলতে পারছে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
চুমকি কনুই দিয়ে হালকা গুতো দিল, ফিসফিস করে বলল,
আরে যা! দেখ না, স্যার কত অনুরোধ করছে। আর তোর গলা শুনলে তো সবাই ফিদা হয়ে যাবে।টেনশন করিস না যা হবে ভালোই হবে।
মেহরিন সংকোচে মাথা নাড়াল। তবুও বুকের ভেতর কেমন একটা সাহস জমা হতে লাগল।
চারদিকে বন্ধুরা হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিতে লাগল,
মেহরিন তুমি পারবে।
স্যার আবার একটু নরম গলায় বললেন,
মেহরিন, তুমি গাইলে আজকের নবীন বরণ সম্পূর্ণ হবে। আমাদের ইকোনোমিক্সের সম্মান তোমার হাতে।
এই কথায় মেহরিন চোখ বন্ধ করে গভীর একটা শ্বাস নিল।
নিজেকে সামলে মঞ্চের দিকে এগিয়ে গেল।
চুমকি পেছন থেকে ফিসফিস করে বলল,
All The Best..
মঞ্চে উঠে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে একবার চারদিকে তাকাল মেহরিন।
সবার মধ্যে একজোড়া চোখ একটু বেশিই অনুভব করল — রিদ তালুকদারের। কেমন যেনো বাকা চোখে তাকিয়ে আছে। অবাক আর কৌতুহল দুটোই বৃদ্ধমান।
মৃদু হাসি দিয়ে মাইক্রোফোনে বলল,
সবাইকে নবিন বরনের শুভেচ্ছা। আজ হঠাৎ করে গান গাওয়ার সুযোগ পেয়ে একটু নার্ভাস লাগছে… ভুল হলে ক্ষমা করবেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমারো পরানো যাহা চায় গানটা গাওয়া শুরু করে ….
আমারো পরানো যাহা চায়
তুমি তাই তুমি তাই গো,
আমারো পরানো যাহা চায়।
তোমা ছারা আর এ জগতে
মোর কেহ নাই কিছু নাই গো
আমারো পরানো যাহা চায়।
তুমি তাই,তুমি তাই গো।
আমারো পরানো যাহা চায়।
তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখেরী সন্ধানে যাও–
তুমি সুখ যদি নাহি পাও,
যাও সুখেরী সন্ধানে যাও–
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় মাঝে,
আর কিছু নাহি চাই গো।
আমারো পরানো যাহা চায়।
তুমি তাই,তুমি তাই গো।
আমারো পরানো যাহা চায়।
আমি তোমারো বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিবো বাস,
দীর্ঘ দিবস,দীর্ঘ রজনী,দীর্ঘ বরষো মাস।
যদি আর-কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস।
যদি আর-কারে ভালোবাস,
যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে,তুমি যাহা চাও,
তাই যেন পাও,আমি যতো দু:খ পাই গো
আমারো পরানো যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো।
আমারো পরানো যাহা চায়
তোমা ছারা আর এ জগতে
মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো
আমারো পরানো যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো।
আমারো পরানো যাহা চায়–
মিষ্টি কণ্ঠের ঢেউয়ে মুহূর্তেই ভরে উঠল পুরো মিলনায়তন।
সবাই চুপ হয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল।
রিদ তালুকদার সবার ভিড়ে থেকেও যেন একা হয়ে শুধু তাকিয়ে রইল মেহরিনের দিকে। মনে মনে ভাবছে এই মেয়েটার কি কি পারে।
মেহরিন নিজের অজান্তেই মঞ্চের আলোয় আর গানেই হারিয়ে গেল।
এ যেন তার নিজেরই একটা স্বপ্নের শুরু…
তার কণ্ঠের সুরে ছিল মধুর এক মায়া।
যেন একটা অদৃশ্য জাদু ছড়িয়ে পড়ল সবার মনে।
গান শেষ হতেই পুরো হঠাৎ সবাই হুশ ফিরে পেল।গানের যেন ভেসে গিয়েছিল সবাই।
এক মুহূর্ত স্তব্ধতার পর শুরু হলো উচ্ছ্বসিত করতালি।
কেউ চিৎকার করে বলল,
“ওয়াও! দারুণ!”
আরেকজন বলল,
“এতো সুন্দর গায়! আগে জানতামই না!”
স্যার মাইকে এসে আবার বললেন, সবাই শান্ত হও। দেখেছো? আমি তো বলেছিলাম, আমাদের ইকোনোমিক্স ডিপার্টমেন্টের একটা রত্ন আছে,আমরা খুবই গর্বিত তোমার মত একজন স্টুডেন্ট পেয়ে।
সবাই একের পর এক মেহরিনের প্রশংসায় ভেসে গেল।
শুধু চুমকি কাঁধ ঝাঁকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“হুঁ! আমার মেহরিন জানু তো এমনই। আমাকে অবাক করার কিছু নেই।
চোখ টিপে মেহরিনের দিকে তাকাল চুমকি।
মেহরিন মৃদু হেসে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। চোখে ছিল একটু লজ্জা, একটু আনন্দের ছায়া।
রিদ নীরবে তাকিয়ে রইল।
মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু চোখে ছিল এক অদ্ভুত প্রশ্রয়।
মেহরিন তার মনে একটু একটু করে রঙ ছড়াতে শুরু করেছে, সে টের পাচ্ছে না হয়তো, কিন্তু রিদ ঠিকই বুঝতে পারছে।
এরপর অনুষ্ঠান আবার চলতে লাগল — আবৃত্তি, নাচ, নাটক।
কিন্তু মেহরিনের গানের রেশ যেন সবার মনে থেকে গেল।
অনুষ্ঠান জমে উঠল, অথচ মেহরিনের মিষ্টি কণ্ঠের মুগ্ধতা ভার্সিটির অঙ্গনে বাতাসে ভেসে রইল অনেকক্ষণ।
অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে।
চুমকি মেহরিনের কানে ফিসফিস করে বলল,
শুন, আর থাকবো না। অনেক হয়েছে। চল একটু ক্যাম্পাসে ঘুরি তারপর বাসায় যাই।
মেহরিন মাথা নাড়ল। দুজন চুপিচুপি হলের পেছনের দিক দিয়ে বের হতে লাগল।
চারপাশে তখনো অনেক ভিড়। নবীন-পুরনোদের হইচই, ছবি তোলা, খুশির আমেজে চারদিক মুখরিত।
চুমকি আর মেহরিন ধীরে ধীরে হলের ভিড় ঠেলে বেরোতে চেষ্টা করছিল।
চারদিকে ঠাসাঠাসি, ধাক্কাধাক্কি।
হঠাৎ মেহরিন টের পেল, কেউ তার পেছন থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে ছুঁয়ে দিল।
সে চমকে উঠে তাকাল, কিন্তু ভিড়ের মাঝে কিছু বোঝা গেল না।
চুমকি বলল,
কি হলো! চল দ্রুত।
দুজন আবার হাঁটতে লাগল।
কিন্তু আবার — এবার একটু জোরে, ইচ্ছাকৃতভাবে তার কাঁধে হাত লাগানো হলো।
মেহরিন থমকে দাঁড়াল।
চোখে পানি এসে যাচ্ছিল রাগ আর অপমানে।
চুমকি ওর হাত ধরে টানল,
মেহরিন দাঁড়িয়ে গেছে বলে পাশ ফিরে চাইলো বল কি হয়ে**এটুকু বলেই থেমে গেল মেহরিনে চোখে পানি দেখে জিজ্ঞেস করলে কি হয়েছে ।
কিন্তু তখনি তৃতীয়বার — এবার মেহরিন এর কোমরে টাচ করলো।
আর তখনই মেহরিন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারল না।
ফুঁসে উঠল সে।
এক ঝটকায় সেই বাজে ছেলেটার হাতটা ধরে ফেলল।
সবাই হতবাক!
মেহরিন ঠান্ডা অথচ কাঁপা গলায় বলল,
তোর এত সাহস কে দিলো , ভিড়ের সুযোগ নিয়ে মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়ার?
ছেলেটা শুরুতে প্রথমে একটা থাথামা তো খেয়ে যায় কিন্তু তারপরেই আবার হেসে উড়িয়ে দিতে চাইছিল। ভাবছিলাম মেয়ে মানুষ কি আর করবে।
কিন্তু মেহরিন শক্ত করে ধরে রইল ওর হাত।
তারপর যেন এক ঝটকায় সমস্ত রাগ বের করে দিল —
তার ডান হাতের চপেটাঘাত বাজ পড়ার মতো করে পড়ল ছেলেটার গালে।
ঠাসসস!
চারপাশের ভিড়ে কিছু মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো।
ছেলেটা হতভম্ব হয়ে গেল।
চুমকি তখন মেহরিনের পাশে দাঁড়িয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে বলল,
শা**লা তোর ঘরে কি মা বোন নেই ? এই ঘাটের মরা এই মরার আর জায়গা পেলিনা, রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখলেই হায়নাদের মতো ঝাঁপিয়ে পরিস। ইচ্ছে তো করছে তোর পিছনে চারটা কুত্তা লাগাই দেই। শা’লা ঘাটের মরা তুই আর মানুষ পেলিনা শেষমেষ আমার জান্টুকে, কিন্তু তোর টাইমিংটা ভুল ভাই, ভুল জায়গায় হাত দিয়ে দিয়েছিস।সবাই তো আর অবহেলা নারী হয় না । এবার তোর কি হবে রে কালুয়া । মুখ দিয়ে ‘চু’ ‘চু’ শব্দ করে বলে তোর জন্য এখন খুব মায়া হচ্ছে কারন তুই এখন এমন ধোলাই খাবি — চিন্তাও করতে পারবি না।
ছেলেগুলো মধ্যে
একজন ধূর্ত হেসে বলল,
কি হলো, বেবি? গায়ে একটু হাত লাগলে আগুন হয়ে গেলে? ইচ্ছা করে আবার ধরবো, কি করবি?
তার বাজে কথাগুলো শুনে ভিড়ের মধ্যে কিছুজন অস্বস্তিতে মাথা ঘুরিয়ে নিল, আবার কেউ কেউ কৌতুহলে তাকিয়ে রইল।
মেহরিন চোখ নামাল না।
ওর মুখ শক্ত হয়ে গেল।
সোজা তাকিয়ে বলল,
তোদের মতো কাপুরুষদের কাজ’ই তো এগুলো আচ্ছা তোদের বাপের পরিচয় আছে তো।
এত কথা সহ্য করতে না পেরে ছেলেটা রেগে গিয়ে এগিয়ে এলো,
“তুই —”
বলতে বলতেই মেহরিনের দিকে চড় মারার জন্য হাত তোলে!
কিন্তু…
তার আগে চোখের পলক ফেলার আগেই মেহরিন ওর হাতটা পাকড়াও করে নিল,
একটা কনুইয়ের মোচড় দিয়ে দড়লো ছেলেটাকে। তারপর মেইন পার্ট একটা কিক
তারপর পরপর তিনটা ঘুষি — নাক,পেট আর বুকে!
ঠাস***ঠুস ****ঠাস****
ছেলেটা ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে।
চোখে-মুখে ভয় আর লজ্জার ছাপ।
মেহরিন তখন আর থামেনি।
পাশের আরেক ছেলে এগোতে আসতেই ওর কোমরে কিক মেরে উড়িয়ে দিল।
চুমকি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল — ওর মেহরিন যেন কোনো সিনেমার ফাইটার গার্ল হয়ে গেছে!
চারদিক স্তব্ধ।
ভিড়ের কেউ কেউ মোবাইলে রেকর্ড করছিল।
কেউ ফিসফিস করে বলছিল,
ওই মেয়ে তো মার্শাল আর্ট জানে মনে হয়।
দেখছ কি মাইক টাই না দিল? একদম ঠিক হইছে বাজে ছেলেগুলোর শিক্ষা হচ্ছে।
ছেলেগুলো দিশেহারা হয়ে পালাতে লাগল।
মেহরিন দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিল, রাগে-অপমানে কাঁপছিল তার শরীর।
কিন্তু মুখটা ছিল ঠিক আগুনের মতো দৃঢ়।
রিদ ও তার দলবল সবাই এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে।মূলত ওরা আসতে চেয়েছিল কিন্তু মেহরিন এর যে রূপ দেখল তাতে রিদ না করে দিয়েছে সবাইকে বললে দেখি কি করে । রীতিমতো ওরা সবাই সকট।
সাথী বলল, যাই বলিস মেয়েটার কিন্তু তেজ আছে। এক কথায় অসাধারণ একটা মেয়ে।নরমের সাথে নরম গরমের সাথে গরম।
মৌ বলল ,আসলেই অমন সিচুয়েশনে আমি পড়লে হয়তো কান্নাই করতাম।কিন্তু ওটা করেনি একদম উচিত জবাব দিয়ে দিয়েছে।
শান্ত বললো,আমি ওর ফাইটিং এর ফ্যান হয়ে গেছি ভাই।
রাকিব বলে,তুই যে ওর বান্ধবীর প্রেমে পড়ে গেছিস এটা জানতে পারলে দেখিস তোকে না আবার কয়েক গা লাগিয়ে দেয়। বি কেয়ারফুল শান্ত।
শান্ত রাকিবের কথা শুনে একটা ঢুক গিলে।
রাকিবের কথা শুনে সবাই হেসে ওঠে শুধু শান্তা মুখ ভোতা করে রাখে। অভিযোগের সাথে রিদ কে বলে। দেখলি রিদ ওরা আমার বন্ধু না শত্রু আমাকে সাহস না দিয়ে উল্টে ভয় দেখাচ্ছে। রিদ বলে, আহ কি হচ্ছেটা কি থামবি তোরা ।
মেহরিন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলো।
চুমকি ওর কাঁধে হাত রাখল, মৃদু হাসি দিয়ে বলল,
তুই তো আসলে বাঘিনী। আসলে কি বলতো ওরা ভেবেছিল তুইও মনে হয় অবলা নারী বেচারারা কি ক্যালানিটাই খাইলো।
মেরিন ছোট করে বলে, চল।
রিদ চুপ করে তাকিয়ে রইল মেহরিনের দিকে।
চোখে সেই সম্মান, মুগ্ধতা আর কিছু অজানা অনুভূতি…
আর মেহরিন?
ওর চোখের মধ্যে তখন ছিল আগুনের আলো আর একটুকরো অব্যক্ত গর্ব।
দিন চলে যাচ্ছে ভালোই।
সেই ঘটনার পর, মেহরিন আর চুমকি ভার্সিটিতে অনেকটা পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছে।
মেহরিনের সাহসিকতা আর ওর মধুর কণ্ঠ — এই দুইয়ে সবাই একরকম মুগ্ধ।
ক্লাসরুম থেকে করিডোর — মেহরিন মানেই এখন সাহস আর মধুর কন্ঠের অধিকারিনী।
চুমকি তো প্রথম থেকেই মেহরিনের ছায়াসঙ্গী।
তবে সময়ের সাথে সাথে আরোও কয়জন নতুন পরিচয় জুড়ে গেল ওদের জীবনে।
শান্ত, রাকিব, মৌ, আর সাথী মাঝেমধ্যে অবশ্য রিদ কেউ দেখা যায় তবে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া না।
যাদেরকে মেহরিন আর চুমকি আগেও থেকেই চিনতো।
নবীন বরণের সেই ঘটনার পরে, ওদের সাথে একটা বন্ধুত্ব শোলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মেহরিন আর চুমকির সাথে আলতো করে কথা বলা শুরু করল ওরা।
বিশেষ করে শান্ত চুমকির সাথে একটু বেশি কথা বলে।
প্রথমে ছোট ছোট আলাপ, ক্লাসের কথা, পড়াশোনা — তারপর ধীরে ধীরে…
চোখের ভাষা বদলাতে লাগল।
চুমকি টের পায়, শান্ত যখন ওর দিকে তাকায় — সেই দৃষ্টিতে কিছু যেন একটু বেশি থাকে।
কেবল বন্ধুত্বের উষ্ণতা বা জুনিয়র হওসাবে নয়, তার থেকেও একটু বেশি কিছু।
চুমকি প্রথমে হাসিতে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।
নিজেকে বোঝাতে চেয়েছিল,
ওর সাথে তো স্রেফ ভালো বন্ধুত্ব হচ্ছে। এর বেশি কিছু না।
কিন্তু মন যে বড্ড অবাধ্য।
শান্তর ছোট্ট একটা হাসি, তার খেয়ালি চোখের দৃষ্টি — চুমকির বুকের ভেতর অদ্ভুত রঙ ছড়িয়ে দেয়।
মেহরিন অবশ্য সব কিছু টের পাচ্ছিল।
ও মজা করে বলে,
চুমকি, তোর ওই শান্ত গাছের নিচে বেশ অশান্ত ঝড় উঠছে দেখি, যে ঝড়ের কোন কুল কিনারা নেয়। যে ঝড় বাসিয়ে নিয়ে যায় কারো ভালোবাসার দৌড়গোরায়।
চুমকি লাজুক হেসে বলত,
চুপ কর, ছাইপাশ বলিস।
কিন্তু মেহরিনের চোখে তখন অদ্ভুত এক আলোর ঝিলিক —
প্রেমের সূর্য যেন ধীরে ধীরে উঠছে ওদের ছোট্ট জীবনের আকাশে..
এতসব কিছু মাঝে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে তাহলে রিদ মেহরিনকে রীতিমতো এরিয়ে চলে।কেমন যেন মেহেরিনকে দেখলে পালায় পালায় করে,মেহরিন প্রথম প্রথম অবাক হলেও এখন আর তেমন মাথা ঘামায় না।
আর এদিকে রিদ,
রিদ নিজেও বুঝতে পারছিল, কিছু একটা বদলে গেছে তার ভেতরে।
প্রথমে বিরক্ত লাগত মেহরিনের এত কথা, অত হাসাহাসি, অদ্ভুত সব একটিভ অ্যাটিটিউড।
কিন্তু কখন যেন সেই ঝাঁঝালো মেয়েটাই তার মনে জায়গা করে নিয়েছে —
নরমভাবে, অজান্তেই।
মেহরিনের চোখের ঝিলিক, কথা বলার ভঙ্গি, ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসি — সবকিছুই রিদকে অদ্ভুতভাবে টানে।
কিন্তু রিদ তালুকদার কারও কাছে দুর্বল হতে শিখেনি।
আর এই মেয়ে?
ও তো ঠিক দুর্বলতা নয়, বরং অদম্য এক টান।
ভয়ংকর রকমের গভীর টান।
এই ভয় থেকেই…
রিদ ইচ্ছে করে মেহরিনের থেকে দূরে থাকে।
মেহরিনের সামনে পড়লে কথাবার্তা ছোট করে শেষ করে দেয়।
কখনো কখনো তো অন্যদিকে হাঁটতে শুরু করে — যেন দেখলে না-দেখার ভান করে!
মেহরিন অবাক হয়, মাঝে মাঝে কষ্টও পায়।
কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না। শান্ত, রাকিব, মৌ, সাথী সবাই তো কত ভালো করে কথা বলে ওর সাথে।তাহলে রিদ ভাই এমন করে কেন?
সে ভাবে,
আমি কি ভুল কিছু করেছি? নাকি রিদ ভাইয়া আমাকে অপছন্দ করেন?
কিন্তু রিদ জানে — আসলে সে ভীষণভাবে পছন্দ করে মেহরিনকে।
তবে ভালোবাসা মানে তার কাছে দুর্বলতা।
আর দুর্বলতার সামনে দাঁড়ানোর সাহস এখনও হয়নি রিদের।
ক্লাসরুমের করিডোর দিয়ে মেহরিন হেসে হেঁটে গেলে রিদ দূর থেকে তাকিয়ে থাকে।
কখনো তার চোখে-মুখে অদ্ভুত একটা হাসি খেলে যায়,
আবার পরক্ষণেই নিজেকে শক্ত করে নেয়।
ঠোঁট চেপে মনে মনে বলে,
না, আমি ওর কাছে কিছু অনুভব করবো না।
কিন্তু মনে কি কথা শোনে?
মনে তো শুধু মেহরিনের স্বপ্নরঙ ছড়িয়ে পড়ে — প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি অনভিপ্রেত মুহূর্তে।
আজ মৌয়ের জন্মদিন।
সবাই ঠিক করেছে, ছোট করে একটা সেলিব্রেশন হবে।
কিছু বন্ধু-বান্ধব মিলে কাছের একটা রেস্টুরেন্টে একসাথে সময় কাটাবে।
রেস্টুরেন্টের ভেতরে হালকা আলো, হেসেখেলে কেক কাটা, মোমবাতি ফুঁ দেওয়া — সবকিছুতে একটা উষ্ণতা ছিল।
মৌ হেসে হেসে সবার সাথে ছবি তুলছিল, আর মেহরিনও প্রাণ খুলে হাসছিল।
রিদও ছিল ওখানে।
কিন্তু সে দূর থেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল।
মেহরিনের হাসি দেখছিল, আর নিজের বুকের মধ্যে হালকা একটা যন্ত্রণা অনুভব করছিল —
এই হাসির ভেতর কি আমার কোনো জায়গা আছে?
প্রশ্নটা নিজের মনেই গুমরে উঠছিল।
সবাই মিলে খুব আনন্দ করছে হাসাহাসি হইহুল্লোড়ের মাঝে কেক কাটা হলো । সবাই মৌকে গিফট দিল।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার পর রাস্তায় ছিল আলো-আঁধারির খেলা।
কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছিল সবাই।
হঠাৎ পাশ থেকে দ্রুত একটা বাইক ছুটে এলো —
কেউ কিছু বোঝার আগেই একটা ধাক্কা —
মেহরিন ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেল।
তার মাথাটা শক্তভাবে পাথরের মতো কোনায় লেগে গেল।
“ধড়াস!”
মুহূর্তেই মাটিতে রক্তের ছোপ ছড়িয়ে পড়ল।
গা ছমছমে নীরবতা ছেয়ে গেল চারদিকে।
“মেহরিন” চুমকির গলা ফেটে বেরিয়ে এলো
সবাই ছুটে এলো, মৌ, সাথী,শান্ত, রাকিব সবাই।
কিন্তু সবচেয়ে আগে ছুটে এল রিদ।
তার চোখের সামনে যখন মেহরিনের মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল —
সে আর নিজের ভেতরের গম্ভীর ভাব ধরে রাখতে পারল না।
পাগলের মতো মেহরিনকে কোলে তুলে নিল।
তার মুখ একেবারে সাদা হয়ে গেছে, কাঁপা কাঁপা হাতে মেহরিনের মুখের কাছে মুখ এনে বলল,
মেহরিন… চোখ খোলো… কথা বলো মেহরিন প্লিজ…
তার গলা ধরে আসছিল।
একবার… দুইবার…
কোনো সাড়া নেই দেখে, রিদ চিৎকার করে উঠল,
অ্যাম্বুলেন্স! কেউ একটা অ্যাম্বুলেন্স ডাকো এখনই।
সবাই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে।
চুমকি মেহরিনের পাশে বসে কান্না করছে। আর শান্ত দৌড়ে গাড়ি আনতে ছুটলো।
রিদ আর অপেক্ষা করল না।
নিজের গাড়ির চাবি বের করে, কোলে করে মেহরিনকে নিয়ে ছুটে গেল।
চুমকি পিছন পিছন দৌড়াতে থাকলো।
রিদ তার গাড়িতে উঠে চ মেহরিনকে বসিয়ে দিলো চুমকি গাড়িতে উঠে মেহরিনের মাথা নিজের কোলে নিয়ে বসে। রিদ স্টিয়ারিং-এ বসল।
গাড়ির ছুটছে দুরন্তগতি তে কোনো নিয়ম মানলো না — চোখে ছিল শুধু একটাই কথা —
আমার মেহরিন ঠিক থাকতে হবে।ওর কিছু হলে আমি নিজেই মরে যাব ।
তার হাত কাঁপছিল, চোখ লাল গিয়েছিল অজান্তেই। পুরুষ মানুষ কাঁদে না। কিন্তু কেন জানি রিদের খুব কান্না পাচ্ছে। কানা করতে না পারা এই চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে ।
পেছনে সবাই আসছে শান্ত গাড়িতে।সবাই খুব ঘাবড়ে গেছে সবার মুখে চিন্তার ভাজ।
চুমকি কান্না করতে করতে অবস্থা খারাপ। রিদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ফিসফিস করে বললো,
এটা কী শুধুই বন্ধুত্ব বা সিনিয়র থেকে দায়িত্ববোধ… আর কিছু নয়।
কেন জানি মনে হচ্ছে এটা ভালোবাসা । হ্যাঁ ভালোবাসাই তো শুধু ভালোবাসা নয় অন্ধ ভালোবাসা যাকে বলে।
চুমকির বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ একটা চিনচিনে ব্যথা ফুটে উঠলো —
মেহরিন তো জানেই না, রিদ ভাইয়ার এই অন্ধ ভালোবাসার কথা…
রিদ গাড়ি চালিয়ে পাগলের মতো হসপিটালে পৌঁছে গেল।
মেহরিনের মুখে রক্তের দাগ, নিস্তেজ হয়ে তার কোলে ছিল।
হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে ঢুকেই চিৎকার করে উঠল,
ডাক্তার,জরুরি অবস্থা প্লিজ, কেউ আসুন!
ডাক্তাররা দৌড়ে এলো, দ্রুত মেহরিনকে স্ট্রেচারে শুইয়ে নিল।
তাকে সোজা আইসিইউতে নিয়ে গেল।
রিদ সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে থাকল একদম পাথরের মতো।
তার দুই হাত রক্তে ভেজা।
চোখের সামনে কেবল ভেসে বেড়াচ্ছে মেহরিনের অসাড় মুখটা।
চুমকি, রিদের পিছন পিছন দৌড়ে এসেছে । শান্ত, মৌ, সাথী আর রাকিব ওরা তখন হসপিটালে এসে পৌঁছেছে।
চুমকি কাঁপা গলায় বলল,
ভাইয়া… মেহরিনের বাড়িতে জানাবো না?
রিদ মুখ তুলে চাইল।
তার চোখের কোণে ব্যথা আর অসহায়তার ছাপ।
সে মোবাইল বের করল, হুঁশ ফিরিয়ে কঠিন গলায় বলল,
চুমকি, তুমি মাহির (মেহরিনের ভাই) নাম্বার দাও।
চুমকি কাঁপা হাতে নাম্বার দিলো।
রিদ এক সেকেন্ডও দেরি না করে ফোন করল।
ফোন রিসিভ হতেই, গলা শুকনো, অথচ দৃঢ় করে বলল,
তুমি মাহির তো?
আমি রিদ তালুকদার বলছি… মেহরিন… মেহরিনের একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে।
ও হসপিটালে। আইসিইউতে আছে।
প্লিজ… তাড়াতাড়ি চলে এসো।
ওপাশ থেকে মাহিরের চিৎকার ভেসে এলো,
কি বলছেন ভাই? এক্সিডেন্ট? কোথায়?আমার আপু ঠিক আছে তো?
রিদ শান্ত গলায় ঠিকানা দিল,
সিটি হসপিটাল… প্লিজ, তাড়াতাড়ি এসো। সময় নষ্ট করো না।
ফোন কেটে রিদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
তার চোখে জল আসছে কিনা বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু বুকের ভেতর একটাই কথা বাজছিল,
তুমি আমাকে কিছু একটা বলো, মেহরিন… শুধু একটা শব্দ… আমি বিরক্ত হব না সত্যি বলছি। তোমার প্রতিবাদ মূলক কথায় বলো না তাও কিছু বলো প্লিজ তোমার এই মৌনতা যে আমার ভিতরে রক্তক্ষরণ করছে।
রিদ যখন মাহিরকে ফোন করেছিল, তখন মাহির ভয় পেয়ে গেছিল।সে সঙ্গে সঙ্গে মেহবুবা আর বাসার সবাইকে জানালো।
মেহরিনের মা-বাবা তখনও ঠিকমতো ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন না।
কিন্তু মেহবুবা আর মাহির দুজনেই কেঁপে কেঁপে উঠেছিল।
বড় আপু… যদি কিছু হয়ে যায়? — মাহিরের গলা ভেঙে যাচ্ছিল।
মেহবুবা শক্ত করে মাহিরের হাত চেপে ধরে বলেছিল,
কিছু হবে না।মেহু কিছুতেই আমাদের ছেড়ে যাবে না।
সবার মুখে আতঙ্ক আর চোখে জল নিয়ে ওরা হসপিটালের দিকে ছুটে গেল।
হসপিটালে…
ডক্টর কিছুক্ষণ আগে জানিয়েছে মেহরিন এর মাথায় অনেক চোট পেয়েছে রক্তক্ষরণ হয়েছে অনেক। তাই এখনই তারা কিছু বলতে পারছে না। রিদ তখনও আইসিইউর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। কাপড়গুলো শুকনো হয়ে গেলেও হাত থেকে মেহরিনের রক্তের দাগ মুছে যায়নি।
চোখের নিচে গভীর ক্লান্তির ছাপ।
তবে হাল ছাড়েনি — মনে মনে শুধু একটা কথাই বারবার বলছিল,
তুমি অনেক সাহসী তুমি লড়বে, মেহরিন। তুমি হেরে যাবি না।
তখনই দৌড়ে এল মাহির আর মেহবুবা।
মাহির এগিয়ে এসে রিদকে ধরে বলল,
ভাইয়া, কেমন আছে বড় আপু? কিছু বলছে? চোখ খুলেছে?
রিদ নিচু গলায় বলল,
ডাক্তাররা চেষ্টা করছেন। মাথায় গুরুতর চোট লেগেছে। রক্তপাত হয়েছে… এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
মাহির আর মেহবুবা শুনেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
রিদ দাঁড়িয়ে থাকল — ভেতরে ভেতরে নিজেকে শতবার অভিশাপ দিল,
“আমি যদি আরও সাবধান হতাম… আমি যদি তাকে আগলে রাখতাম…”
একটু দূরে দাঁড়িয়ে কান্না করছে চুমকি, শান্ত আর বাকিরা ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
সাথী আর মৌ নিঃশব্দে কাঁদছে।
মেহরিনের মা আর বাবা যখন এলেন, তখন পরিস্থিতি আরও ভারী হয়ে গেল।
মেহরিনের মা জড়িয়ে ধরলেন চুমকি কে আর বলতে লাগলেন,
মেহরিনের সপ্নরঙ পর্ব ৭
আমার মেয়ে কিছু হবে না তো রে? আমার মেয়েটাকে ফেরা তোরা। চুমকি মালিহা মির্জাকে জাড়িয়ে ধরে। বলতে থাকে তুমি শান্ত হও মামনি।আমরা সবাই আছি তো, ওর কিছু হবে না।তুমি এখন এমন করলে চলবে বলতো তুমি তো আমার স্ট্রং মামনি।
রিদ তখনও চুপ — মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।
তার চোখের কোণ চিকচিক করছিল —
কিন্তু ওর মুখের এক্সপ্রেশন যেন পাথরের মতো শক্ত —
মেহরিনের কিছু হলে, আমি নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবো না।