মেহেরজান পর্ব ২৩

মেহেরজান পর্ব ২৩
লেখনীতে- সোহা

রাউশি সোজা নিচে নেমে এলো।দেখলো সবাই কথা বলাবলিতে ব্যস্ত।একেকজন একেকরকম ভাবে গল্প করছে।রাউশি তাদের পাশ কাটিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলো। বাইরে আসতেই দেখা হলো বিপাশার সাথে। বিপাশার হাতে দুটো লাউ দেখে রাউশি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“এটা কি বাজারে থেকে কেনা? নাকি বাড়িতেই ফলন?”
বিপাশা খুশি খুশি জবাব দিলো,

“আমাদের বাড়িরই।চলুন রাউশি আপু আপনাকে আমাদের বাড়ির পেছনের দিকের সবজি ক্ষেতটা দেখিয়ে আসি।বেশি বড় নয়, আবার ছোটও নয়।চলনসই। আমি আর বাবা মিলেই করেছি সব।”
বলেই প্রাণখোলা হাসলো।আর বলল,
“আপনি অপেক্ষা করুন আমি আসছি।ওয়েট।”
তারপর চলে গেল লাউ দুটো ভেতরে রাখতে।বিপাশার কথামতো রাউশি একটু সাইডে দাঁড়িয়ে থাকলো।আশেপাশে চোখ দিতেই চোখ গেলো তানজিমের দিকে।একটু দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। পরনে একটি সাদা লুঙ্গি।লুঙ্গির এক মাথা হাত দিয়ে ধরা।রাউশির হাসি পেলো। তাড়াতাড়ি ফোন বের করে একটা ছবি তুলে নিলো তৎক্ষনাৎ। তখনই আবার বাড়ি থেকে গান গাইতে গাইতে বের হলো নাহিন।নাহিনও লুঙ্গি পড়েছে।ছেলেটাকে দেখতে কেমন অন্যরকম লাগছে।রাউশির হাসি পেলো।আর হেসেও ফেললো।হাসির আওয়াজ শুনে নাহিন পাশে ফিরে তাকালো। রাউশিকে দেখে কপাল কুঁচকে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ছাগলের মতো ভ্যা ভ্যা করছিস কেন? সমস্যা কি?”
রাউশি হাসতে হাসতেই বলল,
“তোকে লুঙ্গিতে একটুও মানায় নি।”
নাহিন নিচের দিকে তাকালো।লুঙ্গি নেড়ে চেড়ে দেখলো।মুখ ফুলিয়ে বলল,
“আমায় তো তাও দেখতে খারাপ লাগছে। তুই পড়লে তো জংলীর মতো লাগতো।”
রাউশি নাহিনের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“আমি মেয়ে, লুঙ্গি পড়ার কোনো চান্সই উঠে না।আর জংলী তো অনেক দূর।”
“এই সড় তো, আমায় যেতে দে।সকালে আসলাম এখানে মনমতো একটা মেয়েকেও দেখতে পেলাম না।এমন অসুখী জীবন নিয়ে যে বেঁচে আছি এই ঢের।”

“দাড়া ফুফুকে বলে দেব এই কথাগুলো।”
নাহিন যেতে যেতে বলল,
“তুই বলে দিলে আমিও বলে দেব মামাকে।”
রাউশি পেছন থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কি?”
নাহিন যেতে যেতেই চেঁচিয়েই বলল,
“মেহরান ভাই কোথায়?”

রাউশি বুঝতে পারলো নাহিন কি বলছে। রাউশি এখন ভাবলো বলে দিলে কি হবে? হ্যা ওই একটু আধটু লজ্জা পাবে।রাউশির ভাবতেও লজ্জা করলো।তার সংকোচবোধ এখনও কাটে নি।পূর্ব বিবাহিত নারী সে। তারওপর আবার ডিভোর্সী।এই পরিচয়ে সমাজে একটা অন্যরকম দৃষ্টি আছে তার ওপর। ভাবতেই আবার মনটা কেমন করে ওঠে রাউশির।কিছুই ভালো লাগে না তখন। মেহরানের কথা মনে পড়লে মনটা আনচান করে ওঠে, মানুষটা কি তার সাথে সত্যিই আজীবন তার পাশে থাকবে? নাকি আবার সেও চলে যাবে? রাউশির মনে মেহরানের জন্যও ধীরে ধীরে ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। এখন যদি মেহরান তাকে ছেড়ে যায় রাউশি বেঁচে থেকেও মৃত ব্যক্তি হয়ে যাবে।এসব ভাবতেই গা শিওরে ওঠে রাউশির।চোখের কোণ বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। রাউশি হাত দিয়ে মুছলো না।
বিপাশা লাউগুলো বাড়ির রান্নাঘরে রেখে বেরিয়ে আসলো।আর রাউশিকে একবার দেখে নিয়ে বলল,

“চলুন আপু।”
রাউশিকে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। বিপাশার কথা খেয়ালে আসে নি।বিপাশা রাউশিকে এমন অন্যমনস্ক দেখে পাশে গিয়ে হাত ধরে ঝাঁকালো আর বলল,
“এই রাউশি আপু।কি হয়েছে আপনার?”
রাউশি সৎবিৎ ফিরে পেলো।তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।বিপাশার শেষের কথাগুলো শুনে বলল,
“তুমি সম্বোধন করো আমায়।আপনি সম্বোধনে আমার নিজেকেই কেমন বয়স্কা বয়স্কা লাগে।”
বিপাশা হাত টেনে ধরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ঠিক আছে আপু, চলো।”

মেহরান দোতলায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো অফিসের কোনো এক বিষয়ে।এইখান থেকে বাড়ির পেছনের দিকের সবজি ক্ষেতটা দেখা যায়। চোখ গেলো কালো রঙের থ্রিপিস পড়া রাউশির দিকে। বিপাশা সাথে ঘুরছে।বিপাশা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কিছু বলছে।রাউশিকে কেমন মনমরা লাগছে।চুপচাপ মুখটা স্বাভাবিক রেখে দাঁড়িয়ে আছে।বিপাশা হাসলেও রাউশি হাসছে না।মেহরান বুঝলো রাউশির মন খারাপ।তবে কি হয়েছে সেটা বুঝতে পারলো না।কথা বলার মাঝে ‘পরে ফোন করছি’ বলে কল কেটে দিলো।ভাবলো রাউশির কাছে যাবে।যেই ভাবা সেই কাজ। সিড়ি বেয়ে নামলো। তবে নিচে আসতেই অরুন সাহেব মেহরানকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন কাছে।মেহরান না চাইতেও যেতে হলো।

“তোমায় সারাদিন দেখলাম না বাবা।কেমন আছো?”
“ভালো আছি বড় মামা।”
“শুনে ভালো লাগলো।তোমাদের ব্যবসা কেমন চলছে?”
মেহরান গম্ভীর মুখে জবাব দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই চলছে সব।”
অরুন সাহেব আরও অনেক কথা বললেন। মেহরান শুধু উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।কথা বলতেও মন চাইছে না।কারণ মন তো পড়ে আছে রাউশির ওপর।এদিকে উনার তো কথাও শেষ হচ্ছে না।তারওপর যোগ দিলেন আমিন সাহেব।মেহরান ভাবছে আদও কি যাওয়া হবে? ঘড়িতে সময় দেখলো পাঁচটা বেজে যাচ্ছে।এই পরিবারের মানুষজন অনেক বেশি কথা বলতে পারে।তখনই মাহমুদ খানের আবির্ভাব ঘটে সেখানে।মাহমুদ খান বুঝতে পারলেন মেহরান এখানে থাকতে ইচ্ছুক নয়।শুধুমাত্র সৌজন্যতার খাতিরে কথা বলে যাচ্ছে।কাছে এগিয়ে এসে মেহরানকে দেখে মাহমুদ খান বললেন,

“তুই কোথায় যাবি মেহরান?”
মেহরান খুশি হলো খুব।একদিকে শ্বশুর অন্যদিকে মেজো চাচা।সবাই চুপ হয়ে গেলো তখন।কথা বলা থামিয়ে মেহরানের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালেন।মেহরান মুখে হাসি না ফোটালেও চক্ষু হেসে বলল,
“হ্যা চাচা।আমার বাইরে একটু দরকার ছিলো।”
“ঠিক আছে যা দেরি করছিস কেন?”

মেহরান মনে মনে থ্যাংকস আর একটা চোখ টিপ মেরে চলে গেলো।আর সেটা অবশ্যই সবার অগোচরে।মাহমুদ খান এবার কথা বলা শুরু করলেন উনাদের সাথে।মেহরান পায়ের গতি ফুল স্পিডে করে চলে গেলো বাড়ির পেছনের দিকে।রাউশিরা তখনও সেখানে।রাউশিরা মেহরানকে খেয়াল না করলেও মেহরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে রাউশিকে।রাউশি তখনও মনমরা হয়েই দাঁড়িয়ে আছে।কালো ওড়নাটা পেছন থেকে এনে দুপাশে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়েছে ঠান্ডা লাগার কারণে।মেহরান দেখলো আসলেই ঠান্ডা লাগছে।মেহরান পাঞ্জাবি পরনে ছিলো।এটা অবশ্য উর্মিলা বেগমই পড়তে বলেছেন দুপুরে।সুপুরুষ লাগছে সেটা মেহরান নিজেও জানে।দুপুরে ছোট মামার সাথে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিলো গ্রামটা দেখতে তখন গ্রামের মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ যে সে খুব ভালোভাবেই করতে পেরেছে এটা মেহরান বুঝতে পারে।মেহরান গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাড়ালো পা দুটো আড়াআড়িভাবে রেখে।অপেক্ষা করলো রাউশিদের এদিকে আসার।

বিকাল হয়ে আসছে ভেবে রাউশিরা ফেরার পরিকল্পনা করলো।রাউশি সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো মেহরানকে।গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।দৃষ্টি তাদেরই ওপর।রাউশি নড়েচড়ে দাড়ালো।এগিয়ে গেলো সামনে।বিপাশাপ পাশাপাশি আসছে। মেহরানের পাশে যেতেই বিপাশা বলল,
“ভাইয়া আপনি এখানে?”
“মনের মানুষ যেখানে আমারও সেখানে থাকাটা আবশ্যক।”
কথাটা ছোট করে বলায় বিপাশা শুনতে না পেলেও রাউশি মেহরানের একটু কাছে দাঁড়িয়ে থাকায় রাউশি শুনতে পেলো। চোখ তুলে মেহরানের দিকে তাকাতেই মেহরান বিপাশাকে বলল,
“বিপাশা গ্যারেজে একটা বাইক দেখলাম ওটা কার?”

এই বাড়িতে একমাত্র আবির ভাই-ই বাইক ব্যবহার করে।বিপাশা জবাব দিলো,
“ওটা আবির ভাইয়ার।”
“ওহ।ঠিক আছে চলো।”
বলে দুজন হাটা ধরলো বাড়ির দিকে।বিপাশা বাড়িতে ঢুকতে যাবে তখন মেহরান বলল,
“বিপাশা তুমি বাড়িতে যাও।রাউশির সাথে আমার কথা আছে।”
বিপাশা মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।রাউশি দাঁড়িয়ে থাকলো সেখানে।মেহরান রাউশিকে একবার দেখে নিয়ে কল করলো উজানের নাম্বারে।উজানকে নিচে আসতে বললে উজান কিছুক্ষণ পর এলো।মেহরান বলল,
“বাইকটা আমি কিছুক্ষণের জন্য নেব। আবিরকে সামলে নিস।আর আমাদের কথা জিজ্ঞাসা করলে বাবাকে বলে দিবি সত্যিটা।”

উজান মাথা নাড়ালো দুষ্টু হেসে।মেহরানের কাছে গিয়ে কানে কানে বলল,
“নিজের ব্যাপারে এতো কিছু আর আমার বিষয়ে এক আনাও না? এটা কিন্তু বৈষম্য ভাই।”
মেহরান চোখ তুলে উজানের দিকে তাকালো।উজান ‘কিছু না’ বলে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলো।রাউশিকে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেহরান বলল,
“চল।”
রাউশি বলতে চাইলো ‘যাব না’।এর আগেই মেহরান বলল,
“যেতে না চাইলে তুলে নিয়ে যাব।”
অগত্যা রাউশিও হাটা ধরলো মেহরানের পিছু পিছু।মেহরান বাইকটা নিয়ে এলো। রাউশির পাশে এসে বলল,
“উঠে বোস।বেলা আছে, পাঁচটা বাজে সবে।”
রাউশিও উঠলো।মেহরান গম্ভীর স্বরে বলল,

“পড়ে যাবি ধরে বোস।”
রাউশি ধরতে দ্বিধাবোধ করছে।অথচ মেহরান তাকে এর আগে দুবার চুমু খেয়েছে। হাত ধরেছে আর এখন কিসের এতো দ্বিধাবোধ রাউশি নিজেও বুঝতে পারছে না। নিজের প্রতি নিজেই রেগে যাচ্ছে।তবুও ধরলো না।মেহরান আবারও বলল,
“ধরতে বলেছি রাউশি।”
তখনই সামনে থেকে আসলো নুজাইশ আর শিহাব। দুজনের ভাব জমেছে বেশ।শিহাব নুজাইশকে গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখালো।দুপুরে বেরিয়েছিলো আর ফিরলো এখন।নুজাইশ আর শিহাব মেহরান আর রাউশিকে দেখে এগিয়ে আসলো।নুজাইশ রাউশিকে একবার দেখে মেহরানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

“কোথায় যাচ্ছিস?”
“বাইরে যাচ্ছি।”
“বাইকটা কার?”
“আবিরের।”
“ঠিক আছে যা।আর শোন ওই-যে বাজারটা পেরিয়েই একটা ছোট নদী আছে।ওখানে যেতে পারিস।জায়গাটাই আমিও ঘুরলাম। খুব সুন্দর।”
শিহাব মুচকি মুচকি হাসছে।মেহরান লুকিং গ্লাসে রাউশিকে একবার দেখে নিলো। থমথমে মুখে বসে আছে পেছনে।শিহাব ফোড়ন কেটে বলল,
“ভাই নদীটা থেকে কিছুটা দূরে একটা রেস্টুরেন্টও আছে।চাইলে তুমি ভাবিকে নিয়ে সেখানে যেতে পারো।রেস্টুরেন্টটা কাপলদের জন্যই।”

নুজাইশ মুখ চেপে হাসলো।রাউশি লজ্জা প্রচুর লজ্জা পেলো।মনে মনে বলল ‘এরা তো দেখি সব জানে।’ মুখ নামিয়ে অন্যদিকে ঘুরালো।মেহরান লুকিং গ্লাসে দেখলো সেটা।শিহাবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আবিরকে বলে দিস শিহাব।”
শিহাব আর আরুশের সাথে মেহরানের আগে থেকেই পরিচয় থাকলেও আবিরের সাথে পরিচিত নয় মেহরান।শিহাব মাথা নাড়লো।মেহরান আবারও বলল,
“রাউশি তোকে ধরতে বলেছি।”
শেষ কথাটা একটু ধমকে বললো।রাউশি না চাইতেও ধরলো।নুজাইশ বলল,
“শালা ধমকাধমকি কম কর।”
আর রাউশিকে বলল,
“অল দ্য বেস্ট রাউশি।”

যতই মেহরানের বন্ধু হোক নুজাইশ, ভার্সিটিতে রাউশির একজন স্যার।স্যারের সামনে এভাবে তারওপর স্যারের এমন সব কথাবার্তায় ভীষণ লজ্জা লাগছে রাউশির। শিহাবও রাউশিকে বেস্ট অফ লাক জানালো। মেহরান আর রাউশি চলে গেলো গেইট পেরিয়ে।সেদিকে অপলক তাকিয়ে থাকলো নুজাইশ।একদিকে খুব খুশি লাগলেও হৃদয়ের ব্যথাটা তখনও অক্ষত।আর না কখনও ঠিক হবে।বন্ধুর প্রিয়তমা রাউশি।তাকে ভালোবাসা যাবে না তবে দূর থেকে দেখা যাবে।তাকে ছোঁয়া যাবে না তবে দেখলে মনভরে দেখা যাবে।ব্যবধানটা কষ্টের হলেও সয়ে নিতেই হবে।তবুও রাউশির জন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা আশা রাখা যাবে না। আর অন্যমন খুবই খুশি কারণ রাউশি সুখে থাকবে ভবিষ্যতে।মেহরান নিজেও খুব সুখী হবে।কারণ ভালোবাসার মানুষকে পাচ্ছে তারা দুজন দুজনে।নুজাইশ মনভরে দোয়া করলো।শিহাবকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।

বিকেলের ঠান্ডা হাওয়াটা গা ছুয়ে দিচ্ছে বাইকে বসা মেহরান র রাউশির।রাউশি মেহরানের পাঞ্জাবির একাংশ ধরে বসেছে। মেহরান কিছু বলে নি।তবে রেগে আছে। কোথায় জড়িয়ে ধরবে তা না এভাবে বসেছে কোন আক্কেলে।
রাস্তাটা সুন্দর।গ্রামটা বেশ উন্নত।দুজনের দিকে রাস্তায় হেঁটে চলা মানুষজন কিভাবে যেন তাকিয়ে আছে।রাউশি একহাতে ওড়নাটা মাথায় দিলো আর মুখ ঢেকে নিলো।লজ্জা লাগছে তার।মেহরান বাইক চালাতে চালাতেই রাউশিকে বলল,
“এতো লজ্জা পাচ্ছিস যে আজ?”
রাউশি থমথমে মুখে বলল,
“জানি না।”
“জানি না মানে কি?”
“কিছু না।”
হার মানলো মেহরান।প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞাসা করলো,
“মন খারাপ করে ছিলি কেন?”

রাউশির কথাগুলো আবার মনে পড়লো। আনমনেই ঠোঁটে ঠোঁট চেপে একবার জিজ্ঞাসা করে বসলো,
“আচ্ছা আমি তো ডিভোর্সী, আমায় পরবর্তিতে ছেড়ে চলে যাবেন না তো?”
হাত কেঁপে উঠলো রাউশির।মেহরান ফোস করে একটা শ্বাস ছাড়লো।এই মেয়ের মনে কি কি চলে তা বুঝতে পারলো।তবে কথার উত্তর দিলো না।নুজাইশের কথা মতো সেই নদীর পাড়ে নিয়ে এলো রাউশিকে।সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে পাহাড়ের কোল ঘেষে।এখান থেকে বহুদূরে পাহাড়ের কালো আবছায়া দেখা যায়।কত সুন্দর সেই দৃশ্য।
“নাম!”

রাউশি নামলো।সূর্যাস্ত দেখতে লাগলো। আর ভাবতে লাগলো সময় কত তাড়াতাড়িই চলে যায় জীবনের।চোখের পলকের সাথেই যেন হারিয়ে যায় সময়।সেই সাথে পরিবর্তন হয় জীবনের গতিধারাও।আকাশ লাল লাল আভায় ছেয়ে গেছে।সাদা সাদা মেঘগুলো নেই আর।
মেহরান বাইকটা সাইডে রেখে রাউশির পাশে এসে দাড়ালো।রাউশি অনুভব করতে লাগলো আজকের এই সুন্দর সন্ধ্যা। যা এর আগে কখনও তার জীবনে আসে নি।
“অতীতকে ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে হয় রাউশি।আমাদের জীবন একটাই।এই ছোট্ট জীবনে পিছুটান রেখে লাভ নেই।বরং শক্ত হাতে জীবনের বর্তমানটা গড়তে হয়।ভবিষ্যতই হয় তার ফলাফল।তবে মনুষ্যজাতি অতীত নিয়েই বেশি কৌতূহলী থাকে সবসময়।যেটা করা নিছকই ভুল। এক জীবনে এমন অনেক ঘটনাই ঘটবে।সেসব মনে না রেখে আমাদের উচিত সামনে এগিয়ে যাওয়া।”
সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই রাউশির হাতের আঙুলের ভাজে নিজের হাতের আঙুল গলিয়ে দিলো।আর সরল গলায় বলল,

“আমার ভালোবাসা কয়েকদিনের না রাউশি। যে ছেড়ে চলে যাব। ছেড়ে যাওয়ার জন্য ভালোবাসিনি আজীবন এভাবেই ধরে রাখার জন্যই ভালোবেসেছি।ছেড়ে যাওয়ার হলে তখনই যেতাম যখন তোর বিয়ে হয়েছিলো।”
রাউশি ছলছল চোখে মেহরানের দিকে তাকালো।মেহরান পুনরায় বলল,
“তিনটে বছর আমি বিদেশে কিভাবে কাটিয়েছি সেটা শুধুমাত্র আমি নুজাইশ আর সাঈদ জানে।তোকে সেসব বলবো না।শুধু মনে রাখবি পুরো বিশ্ব তোকে ছেড়ে, তোর বিপক্ষে গেলেও এই মেহরান সবসময়ই তোর সাথে থাকবে,ভালোবাসবে।মরে গেলেও শরীর সমাধি হবে আমার এই ভালোবাসা নয়।অক্ষত আছে অক্ষতই থেকে যাবে।তুই হলি আমার জান।মেহরানের জান, মেহেরজান।”

রাউশি হাতের বাধঁন আরও শক্ত করলো।আরেকটু পাশ ঘেষলো মেহরানের।মেহরানের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিলো। মেহরান খুশি হলো।রাউশির বিয়ের কথাটা যেদিন মেহরান শুনেছিলো সেদিন তার দেশে ফেরার কথা ছিলো।সেটা অবশ্য বাড়ির কাউকে না জানিয়েই।অর্থাৎ সারপ্রাইজ দেবার কথা ছিলো।অথচ সেসব আর হয়ে উঠলো না মেহরানের।উদ্দেশ্য ছিলো বাড়িতে গিয়ে বাবাকে বলবে রাউশিকে বিয়ে করার কথা।যত দূরেই থাকুক,এত এত বছর না দেখুক তবে উজানের সাহায্যে সবসময়ই রাউশিকে দেখে গেছে মেহরান।আর ভালোবাসাটাও ঠিক সেভাবেই হয়েছে।

রাউশির বিয়ের দিন মেহরান সেই যে বাসা থেকে বেরিয়েছিলো সারাদিন মদ খেয়ে রাস্তার ধারেই পড়ে ছিলো।সাঈদ মেহরানের সাথে থাকতো এক বাসায়। সাঈদ সেদিন সারাদিন মেহরানকে খুঁজেও পায় নি। ফোনটা হারিয়ে ফেলেছিলো মেহরান তাইতো কেউ যোগাযোগও করতে পারছিলো না।এদিকে সাঈদ গাড়ি নিয়ে যখন বার্লিন শহর পুরো ঘুরছিলো ঠিক তখনই এক জায়গায় রাস্তার ধারে একটি বেঞ্চের নিচে মেহরানকে দেখতে পায়।সাঈদ তাড়াহুড়ো করে নেমে মেহরানকে নিয়ে বাড়িতে চলে যায়।মেহরান রাউশির ছবি কখনও তার বন্ধুদেরও পর্যন্ত দেখা তো না।বলতো বিয়ের দিন দেখে নিস।অথচ বিয়ের স্বপ্ন নিমিষেই ভেঙ্গে গিয়ে মেহরানকে আধ পাগল বানিয়ে দেয়।মেহরান জার্মানীর বড় একটি কোম্পানিতে খুব ভালো একটি পজিশনে চাকরি করছিলো।সেটা ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেও সেই মতামত পরিবর্তন করে নেয়।

প্রতিদিন রাতে মোবাইল হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে হু হু করে কাঁদতো।এতো গম্ভীর, রগচটা একটা ছেলে নাকি রাতের আঁধারে ফোন জড়িয়ে ধরে কাদতো এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। এলোমেলো মেহরানকে যেই দেখতো সেই অবাক হয়ে যেতো।বেশিরভাগ সময়ই মেহরানকে দেখা যেত একটি লেকের পাশে। রাতে পাওয়া যেতো সেই লেকের বেঞ্চির নিচে।মদ খেয়ে পড়ে থাকতো সেখানে। ভালোবাসার পরাজয় মানুষকে কি থেকে কি বানিয়ে দেয়? মেহরান যেন তার অন্যতম উদাহরণ।এতো স্ট্রং পার্সোনালিটির পুরুষ নাকি বিরহে পুড়ে এভাবে ভেঙে পড়েছিলো সেটা হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করবে না।একটা বছর সেভাবেই কাটিয়েছে মেহরান।নিজেকে নিয়ে ভাবতেও ভুলে গিয়েছিলো। সাঈদই পাশে থেকেছে সবসময়।মেহরান একবছর পর বাড়ির লোকদের সাথে যোগাযোগ করে।

তখন রাউশি আর আয়াশের ব্যাপারটা অবশ্য জানতে পারে।এরই পর আয়াশের সমস্ত খোঁজ খবর নিয়ে নেয় মেহরান।আর এখানে থাকতেই সমস্ত কিছু জেনে যায় শেষের দিকে।তখন আয়াশ আর অনিমা লিভ ইন এ থাকতো।ব্যাপারটা বলতে চেয়েও বলা হয়নি কাজের ব্যস্ততায়।এরপর অবশ্য দেশে ফিরলো সেদিন যেদিন আয়াশরা দেশে ফিরেছে।এসে অবশ্য সমস্ত ব্যবস্থা মেহরান আগে থেকেই করে রেখেছিলো। তবে রাউশিকে সেদিন সামনাসামনি দেখেই তার চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিলো।ভাবতে পারে নি এতো তাড়াতাড়িই আবার প্রিয়তমাকে পেয়ে যাবে সে।পুরোনো ক্ষত যখম হচ্ছিলো সেসময় জানতে পারলো বন্ধু নুজাইশ রাউশির প্রেমে মত্ত।অবশ্য নুজাইশ বুঝদার ছেলে।মেহরানের অব্যক্ত অনুভুতি সম্পর্কে অবগত ছিলো সে তবে সেই মেয়েটা যে রাউশি সেটা সে জানতো না।মেহরান অবশ্য এতো চিন্তিত ছিলো না নুজাইশকে নিয়ে।কারণ নুজাইশকে সে ভালোভাবে চেনে।

মেয়েটার যে মাঝে মাঝে এসব ভেবে মুড সুইং হয় এটা মেহরান জানে।তার মাঝেমধ্যে ভাবতে অবাক লাগে রাউশি এখন শুধুই তার। তবে বিয়ের পর একদম অফিশিয়ালি তার একান্ত হয়ে যাবে।বহুকষ্টের ফল রাউশি ছেড়ে যাওয়ার কথা তো মাথায়ও আসে না।
রাউশি কাঁপা কাঁপা গলায় প্রথম বারের মতো মেহরানকে বলল,
“ভালোবাসি আপনাকে।”
মেহরান ঠোঁট কামড়ে হাসল।তবে সেটা দেখলো না রাউশি।মেহরান দুষ্টুমি করে বলল,
“বিয়েটা তাহলে খুব তাড়াতাড়িই করে ফেলতে হবে।”
রাউশি বুঝলো মেহরানের দুষ্টামি।মেহরান পুনরায় দুষ্টুমির স্বরে বলল,
“আমার আফসোস তো এখানেই তোর ওই রক্তজবার মতো ঠোঁটজোড়ায় একটা বড়সড় চুমু খেতে পারছি না।তৃষ্ণার্ত কাক আমি।”

‘অসভ্য’ বলে রাউশি লজ্জা পেয়ে দূরে সড়ে গেলো মেহরানের।মেহরান হেসে উঠলো।সূর্য ডুবে গেছে।রাত হতে শুরু করেছে।হাত ঘড়িতে সময় দেখলো সাড়ে ছয়টা বাজে। মেহরান রাউশিকে নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলো।হালকা পাতলা খাওয়া দাওয়া করতে করতে আটটা বেজে গেলো।বেরিয়ে এসে বাইকে চড়ে বসলো দুজনে।আবারও পাড়ি দিলো সেই গ্রাম্য রাস্তা বেয়ে।এবার রাউশি জড়িয়ে ধরে বসেছে মেহরানকে।
“ঠান্ডা লাগছে তোর?”
“না আরাম লাগছে।”
মেহরান মুচকি হাসলো।বাড়ি থেকে আর কিছুটা দূর বাকি।তখনই বাইকটা নষ্ট হয়ে গেলো।মেহরান চেষ্টা করলো তবে আর স্টার্ট দিতে পারলো না।রাউশি নেমেছে একটু আগে বলল,
“চলুন হেঁটেই যায়।আর তো বেশিদূর নয় মনে হচ্ছে।”
মেহরান বলল,
“হেঁটে যাবি?”

রাউশি মাথা হ্যা সূচক নাড়লো।মেহরান ফোন বের করে শিহাবকে কল করে জানালো বিষয়টা।শিহাব গাড়ি পাঠিয়ে দেবে কিনা জিজ্ঞাসা করলো? মেহরান নাকোচ করলো।তারপর হাঁটা শুরু করলো দুজনে। কিছুদূর যেতেই রাউশি দাঁড়িয়ে গেলো।মেহরান তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কি হলো?”
রাউশি গিয়ে একটা উঁচু স্থানে দাড়ালো। মেহরানকে এগিয়ে আসতে বলল। মেহরানও এগিয়ে গেলো।
“কি হয়েছে এখানে এসে দাড়ালি যে?”
“আহ, আপনি পিঠ দিয়ে দাড়ান তো।”
“কেন?”
“আহ দাঁড়ান না।”

মেহরান রাউশির কথা মতো দাঁড়ালো। রাউশি পেছন থেকে মেহরানের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে করে নিয়ে আবদার করলো। মানা করলো না মেহরান।পেছন থেকে রাউশির পায়ের উরুতে শক্ত করে ধরে হাঁটা শুরু করে।রাউশি বলে,
পুরো রাস্তা এভাবেই নিয়ে যাবেন।”
তারপর রাউশি মুচকি মুচকি হেসে মেহরানের গলার কাছে মুখ নিলো। মেহরান রাউশির দুষ্টুমি বুঝতে পেরে বলল,
“এই সব কিছু আমি বিয়ের রাতেই পুষে দেব রাউশি।মনে রাখিস।”

মেহেরজান পর্ব ২২

রাউশি আরও শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরলো। রাউশির নিশ্বাস মেহরানের গলায় এসে বারি খাচ্ছে।এলোমেলো অনুভুতি হলেও সামলে নিলো।এদিকে রাউশি মাথা এগিয়ে গিয়ে মেহরানের গালে টুপ করে একটা চুমু খেল।মেহরান বলল,
“ভালো হচ্ছে না কিন্তু রাউশি।এর থেকেও আমি তোকে ভয়ানকভাবে যখম করবো কিন্তু বলে দিলাম।”

মেহেরজান পর্ব ২৪