মেহেরজান পর্ব ২৬

মেহেরজান পর্ব ২৬
লেখনীতে- সোহা

গাড়ির জ্যাম লেগেছে হঠাৎ করে।কোথায় নাকি গাছ ভেঙ্গে পড়েছে।সেই গাছটা রাস্তার মাঝ হতে তুলতে কিছুক্ষণ সময় লাগবে। এখনও সিলেট পেরিয়ে যেতে পারে নি মেহরান নুজাইশ।মেহরান রাউশিকে কল করলো অনেকবার কিন্তু পেলো না।অথচ আসার বারবার বলে রেখেছে রাউশিকে কল দিলে সঙ্গে সঙ্গেই ধরতে।কিন্তু এখন ফোন কেন তুলছে না এতবার কল করার পরও এটা ঠিক বুঝতে পারলো না মেহরান। মেহরানকে চিন্তিত দেখে নুজাইশ জিজ্ঞাসা করলো,

“কি হয়েছে?”
“রাউশিকে কল করছি অনেক্ষণ যাবৎ কিন্তু কল রিসিভ করছে না।”
“উজানকে কল দে তাহলে।”
মেহরান সত্যিই উজানকে কল করলো। তিনবার রিং হতেই কল রিসিভ করলো উজান।
“কোথায় তুই?”
“ভাই আমি এইতো বাড়িতে যাচ্ছি।”
“রাউশি কোথায়?”
“ও তো একটু আগেই বাড়িতে গেছে আবির ভাইয়ের সাথে।”
মেহরানের চিন্তা এবার বেশ গাঢ় হলো।দাতে দাত চেপে বলল,
“আবিরের সাথে মানে কি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আমরা একটু ঘুরতে বেরিয়েছিলাম।আমার কাজ পড়ে গেছে আর রাউশিকে বললাম আবির ভাইয়ের সাথে বাড়িতে চলে যেতে। অনেক্ষণ হলো ওরা গেছে বাড়িতে।”
মেহরান নুজাইশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইমিডিয়েটলি শিহাবকে কল কর।হারি আপ।”
নুজাইশ কল করলো।শিহাব তাড়াতাড়িই কল রিসিভ করলো।নুজাইশ মেহরানের দিকে একবার তাকিয়ে শিহাবকে জিজ্ঞেস করলো,

“রাউশি কোথায় শিহাব?”
“রাউশিরা তো বাইরে গেছে।”
“না রাউশি তো আবিরের সাথে নাকি বাড়ির দিকে গিয়েছে অনেক্ষণ আগে।”
শিহাব ভীষণ চিন্তিত হলে।বসে বসে পেইন্টিং করছিলো সে।এই মাত্রই নিচ থেকে এসেছে।রাউশির কথা জিজ্ঞাসা করেছিলো একটু আগে রূপা বেগমের কাছে।রূপা বেগম বললেন রাউশিদের নাকি বাইরে যেতে দেখেছে।সাথে উজান বিপাশা আছে ভেবে শিহাবও ততটা গুরুত্ব দেয় নি।তবে এই আবির কোত্থেকে এলো?নুজাইশের এমন কথা শুনে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্ফোরিত গলায় বলল,

“কি? আবির ভাইয়ের সাথে? কেন? কিভাবে? ও তো বাড়িতে আসে নি।আমি এই মাত্র নিচে থেকে আসলাম।”
লাউড স্পিকারে দেওয়া থাকায় সব শুনতে পেলো মেহরান।মেহরান উজানকে ধমকে বলল,
“আই সয়ার উজান, রাউশির যদি কিছু হয় তবে তোর জীবন আমি শেষ করে দেব। তুই আমার আপন ভাই নাকি অন্যকিছু দেখবো না।”
বলেই কল কেটে দিলো মেহরান।নুজাইশের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে শিহাবকে বলল,
“তোমায় আমি খেয়াল রাখতে বলেছিলাম শিহাব।এটা মোটেও আশা করি নি।রাউশিকে খোজো।প্লিজ খোজো। আমরা ব্যাক করছি।”

নুজাইশ গাড়ি ঘোরালো।বিপরীত রাস্তায় জ্যাম না থাকায় খুব সহজেই গাড়ি চলতে শুরু করলো।এদিকে মেহরানের হাত পা কাঁপছে ভয়ানকভাবে।চোখ বুজে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলো।কিন্তু অদ্ভুত তার শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।কান্না পেলো কি মেহরানের? চোখের কোণ বেয়ে জল বের হলো।মেহরান তা স্পর্শ করলো।রাউশির মুখটা বার বার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। আবির আবার রাউশির কিছু করে নি তো? মেহরান আর ভাবতে পারলো না।রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে তার।আবিরকে পেলে সে মেরেই ফেলবে আজ।
শিহাব নিচে নেমে এলো।সবাইকে ঘটনা জানাতেই পুরো বাড়িতে একটা ভয়ানক পরিস্থিতি শুরু হলো।তানজিম দ্রুত বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।আরুশ পুলিশকে ইনফর্ম করলো তাড়াতাড়ি।অরুণ হাওলাদার লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছেন না।বিপাশা আর উজান বাড়িতে পৌঁছাতেই মাহতাব খান ছেলের গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিলেন।উর্মিলা বেগম ছেলেকে শাসিয়ে বললেন,

“মেয়েটাকে দেখে রাখতে পারলি না? তোদের অনেক্ষণ আগেই যেহেতু রওনা দিয়েছে তাহলে গেলো কোথায়?”
মাহতাব খান সোফায় বসে পড়লেন।বুকে ব্যাথা করছে।ছেলেকে দেওয়া কথা রাখতে সক্ষম হবেন তো এই ভয়?রূপা বেগম এক কোণায় দাঁড়িয়ে কাঁদছেন।রোকসানা বেগম উনাকে ধরে আছেন।মাহমুদ খান তানজিমের সাথে বেরিয়েছে।শিহাবও বেরিয়েছে।কাউকে একটা ফোন করেছে সে।আর তার ধারণাই ঠিক হলো।আবিরের দুজন বন্ধুও নাকি তাদের নিজ বাড়িতে নেই। শিহাবের হাত পা জমে গেলো।

আবির ছোট থেকে চুপচাপ স্বভাবের ছিলো। এমনকি খুবই নম্র ভদ্র এক ছেলে ছিলো আবির।কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে যখন ভার্সিটি লাইফে উঠলো তখনও খুব একটা কারও সাথে মিশতো না।একাই থাকতো একাই চলাফেরা করতো।তবে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়া কালীন পরিচিত হলো তারই ক্লাসমেট রাইশা নামের এক মেয়ের সাথে। অবশ্য রাইশাই আবিরকে প্রপোজ করে বসে ছিলো।আবির প্রথমে রিজেক্ট করলেও একটা সময় আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।তার ওপর আবার পুরুষমন। একটুতেই যেন গলে যায়।আবিরেরও ঠিক তাই হলো।এরপর কয়েক বছর তাদের দুজনের প্রেম চললো।আবির ঠিক করে সে নিজের একটা চাকরি ঠিক করেই রাইশার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে।যেই ভাবা সেই কাজ।ভার্সিটি লাইফ শেষে সরকারি একটি কলেজে চাকরিও হয়ে গেলো আবিরের।তবে তখনই ঘটে গেলো এক দূর্ঘটনা।রাইশা আর এক ছেলেকে গ্রামের মানুষ হাতে নাতে ধরলো।এ খবর আবিরের কানে পৌঁছাতেই পাগলপ্রায় হয়ে গেলো।

এদিকে রাইশা আর সেই ছেলেটিকে ধরে বেঁধে বিয়ে দেওয়া হলো।গ্রামটি আবিরদের গ্রামের থেকে বহুদূরে।আবির সেই গ্রামে গিয়ে গ্রামের মানুষদের অনেক রিকোয়েস্ট করলো রাইশাকে বিয়ে করতে তার সমস্যা নেই।তবে কেউ মানলো না।আর রাইশা নিজেই আবিরের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। আবির সেদিন রাইশাকে অনেক রিকোয়েস্ট করেছিলো।পুরুষমন গলিয়ে হু হু করে কেঁদেও রাইশার মন গলেনি। এমন এক পরিস্থিতিতে ধরা পড়েও নির্লিপ্ত রাইশা আবিরকেই উলটো চড় মেরে বসে ছিলো। আবির সারারাত কোথায় ছিলো সেদিন কেউ জানে না।পরদিন বাড়িতে আসতেই সমস্ত কষ্ট ছাপিয়ে বাবার কাছে গিয়ে রাইশাকে চাইলো।তার একাকী জীবনে রাইশা যে কতটা বড় প্রভাব ফেলেছিলো এটা মুহুর্তেই ধারণা হয়ে গেলো বাড়ির সবার।

এদিকে আবির পাগলের মতো ব্যবহার শুরু করলো।তাকে বেঁধে রাখা হলো তার রুমে।বলতে গেলে আবির কিছুটা সাইকো টাইপের হয়ে গিয়েছিলো।হাড়ে হাড়ে যখন বুঝলো রাইশাও তাকে চিট করেছে তখন থেকে কেমন যেন আবারও চুপ হয়ে গেলো। বদ্ধ রুম থেকে বের করা হলো কয়েক সপ্তাহ পর।আবির আবারও নিজ জীবনে ফিরে গেলেও তার চোখ গিয়ে পড়েছিলো ফুফুর স্বামীর ভাইয়ের মেয়ের। অর্থাৎ রাউশির ওপর।নামের সাথে কিছুটা মিল থাকায় মানসিক ভারসাম্যহীন আবির রাউশিকেই রাইশা ভাবতে শুরু করলো। তবে সবার অগোচরে এটা সে দিনের পর দিন পুষে রেখেছে তার মনে।রাউশিরা যখন এ বাড়িতে আসলো তখন তার চোখ সবসময়ই রাউশির ওপর ছিলো।অথচ তাকে দেখলে কেউ মনে করবেই না এই ছেলে মানসিক ভারসাম্যহীন। রাউশিকে রাইশা ভেবে ভোগ করার জন্য একটা অনেক বড় আইডিয়া বানালো সে।যোগ দিলো তার বন্ধু দুজন।সুযোগটা সে আজই পেলো।

রাউশিকে জঙ্গলে টেনে নিয়ে গেলো তিনজন মিলে।রাউশি চেঁচাতে থাকলো। এই শক্তিধর তিন পুরুষের সাথে পেরে উঠবে না। মনের ভেতর ভিড় জমালো হাজারও খারাপ কিছুর।ভাবতেই বুক কেঁপে উঠলো।ভাবলো প্রথম বিয়ের পরও তার সাথে এমন কিছুই হয় নি।অথচ সিলেট ঘুরতে এসে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে হবে? চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়েই পড়লো শুধু।অসহায় রাউশিকে জঙ্গলের একেবারে গভীরে নিয়ে যাওয়া হলো।রাউশি মনে মনে ভাবলো এই বুঝি তার শেষ সময়? মেহরান যদি একটিবার বাঁচাতে আসতো রাউশিকে তবে খুব কি খারাপ হবে? আচ্ছা মেহরান জানে তো রাউশি বিপদে পড়েছে? এতো কল্পনা জল্পনার মাঝে রাউশিকে মাটিতে ছুড়ে ফেলা হলো।রাউশি হুশ আছে।বুঝতে পারলো এরা এখন খুবলে খাওয়ার জন্য রেডি হবে। অন্ধকারে সবকিছুই অপরিষ্কার। দেখা যাচ্ছে না কিছুই।রাউশি হাতড়ালো কিছু পাওয়ার আশায়।এদিকে আবির অর্ধনগ্ন হয়ে এগিয়ে আসলো রাউশির দিকে। রাউশির পাশে শুকনো মাটির স্তুপ পড়ে ছিলো।রাউশি সেসব পেতেই সামনে কালোমুর্তির ওপর ছুড়ে মারলো।আবির পিছিয়ে গেলো চোখে মুখে হাত দিয়ে।মুখ দিয়ে বলল,

“ধর একে।”
বাকিরা এগিয়ে আসলো।এদিকে রাউশি বাম হাতে পেলো একটা গাছের ডাল।শক্তিহীন শরীর নিয়েই উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে আসা জানোয়ারগুলোর মাথায় সজোরে আঘাত করলো।তারা দুজনও পিছিয়ে যেতেই রাউশি নিজের দেহ টেনে হিচড়ে দৌঁড়ানো শুরু করলো।আবিররাও পিছু পিছু দৌঁড়াতে লাগলো।এদিকে রাউশি যতটুকু শক্তি বেঁচে ছিলো তারই বলে প্রানপণে দৌঁড়াচ্ছে।শুধুমাত্র এই জানোয়ারদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য।অন্ধকারে খুব একটা কিছু ভালোভাবে না দেখলেও হাতড়ে হাতড়ে দৌঁড়াচ্ছে।পেছনে আবিরদের গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।

তানজিম আর শিহাব জঙ্গলের ভেতরে গেলো।শিহাবের মতে এরা এখানেই আসতে পারে।তাই তো জঙ্গলে এসেছে। তানজিম চেঁচিয়ে রাউশিকে ডাকছে।শিহাবও সঙ্গ দিচ্ছে।
এদিকে মেহরানরা বাড়িতে এসে পৌঁছালো। দুজনের মুখ দেখেই বোঝা গেলো দুজনই চিন্তিত।একজন প্রেমিক তো অন্যজন দূরদর্শী মাত্র।নুজাইশেরও হাত পা কাঁপছে ভয়ে।সে চায় না রাউশির কিছু হোক।আল্লাহর কাছে হাজারও দোয়া রাউশিকে যেন সুস্থ সমেত পাওয়া যায়।মেহরান শিহাবকে কল করে জানতে পারলো জঙ্গলে নাকি একটি ওড়না পাওয়া গেছে।মেহরান চোখ বুজলো।নুজাইশ আর সে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেলো।আবিরকে জানে মেরে ফেলবে মেহরান।

রাউশি দিকবিদিক হারিয়ে শুধুমাত্র দৌঁড়াচ্ছে।হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। একটা সময় গিয়ে ক্ষেতের মাঝে পতিত হলো রাউশি।এখান থেকে দূরদূরান্তে শুধুমাত্র ক্ষেত আর ক্ষেতই দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো এতক্ষণ যাবৎ না থাকলেও এখন কেমন পরিষ্কার আশপাশ।রাউশি সেদিকেই যাওয়া শুরু করলো।হেচকি তুলছে বার বার।মন বলছে যেন আর দেখা হবে না পরিবারের কারও সাথে। এদিকে আবিরদের পিছু ছাড়িয়েছে অনেক্ষণ যাবৎ। আবির হাত ঝামটা মারলো।রেগেমেগে চেঁচিয়ে বলল,
“পালিয়েছে মেয়েটা।”
তার একজন বন্ধু বলল,
“এখন কি করবো?”
“ফিরে চল।”
“সবাই যদি বুঝে যায়।”
“বুঝবে না কেউ।ফিরে চল।শুধু আল্লাহ আল্লাহ কর মেয়েটা যাতে মরে যায়।এই জঙ্গল এমনিতেও খুব একটা ভালো না।”

তিনজন মিলে উলটো পথে হাঁটা শুরু করলো এবার।কিছুদূর এগোতেই শুনতে পেলো কারও কণ্ঠস্বর। রাউশি রাউশি বলে চেচাচ্ছে।এটা শুনে আবির সব বুঝে গেলো। তিনজনে মিলে গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।তাদের আর বাড়িতে ফেরা যে হবে না এটা অনেক ভালোভাবেই বুঝে গেলো।
এদিকে রাউশি কোথায় যাচ্ছে সে নিজেও জানে না।শুধু এটা জানে আবিরদের থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে।নিজের সতিত্ব বাঁচাতে হবে।সুদূর হতে আলো আসছে।

মেহেরজান পর্ব ২৫

রাউশি এগিয়ে চললো সেদিকে কান্না করতে করতে।মেহরান নামটা বার বার উচ্চারণ করছে।কেঁদে কেঁদে বাচ্চাদের মতো বাবা বাবা করছে রাউশি।খুব জোরে জোরে কাঁদতে ইচ্ছে করলেও ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দিলো পাছে আবার আবিররা যদি শুনতে পায়।পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো জঙ্গলটা থেকে বহুদূরে চলে এসেছে রাউশি।
এখন তার গন্তব্য ঠিক কোথায় এটা সে নিজেও জানে না।

মেহেরজান পর্ব ২৭