মেহেরজান পর্ব ৩৩
লেখনীতে- সোহা
মানুষের শরীরে হুট করেই রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আর তা যদি হয় সিরিয়াস তাহলে বেঁচে না থাকার একটি আতঙ্ক কাজ করে মন জুড়ে। এইযে মেহরানেরও একই অবস্থা।
বৃষ্টিদের বাড়ি থেকে আসার আগের দিন মেহরান আর নুজাইশ বাজারে গিয়েছিলো সেখান থেকে ফেরার সময় মেহরানের হঠাৎ অনেক কাশি উঠে যায় আর বুকে ব্যথা শুরু হয়। তীব্র মাথা ব্যথায় মেহরান কাঁচা রাস্তার ওপরেই বসে পড়ে। নুজাইশ প্রচুর চিন্তিত হয়ে পড়ে যখন দেখে মেহরানের কাশির সাথে রক্ত যাচ্ছে আর নাক দিয়ে রক্ত বের হয়েছে। সাথে সাথেই গ্রামের ফার্মেসী ডাক্তারের কাছে ধরে নিয়ে যায় নুজাইশ মেহরানকে।
গ্রামের ফার্মেসী ডাক্তার কি আর ভালো বুঝবে। কিছু ঔষধপত্র দিয়েছে শুধু। যেসব মেহরান রাউশি যাতে না দেখে সেজন্য নুজাইশের কাছে রেখে দিতে বলেছে। নুজাইশও মানা করে নি। সিলেট থেকে আসার সময় মেহরান সবার পেছনে বসেছিলো কারণ তার কাশি উঠলে যাতে পেছনে বসে ধীরে ধীরে কাঁশতে পারে। মেহরান ক্লান্ত ছিলো। তার যে দুরারোগ্য হয়েছে সেটা সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে। কেন যেন রাউশিকে দেখে খুব বেশি মায়া আর খারাপ লাগছিলো মেহরানের। অজানা ভয়ে ঠিক সেসময় তার এত স্ট্রং ক্যারেক্টারও নড়ে উঠেছিল।
মেহরান সমস্ত বিষয় সাঈদকে বলেছে। সাঈদ হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাপারে বলেছিলো। চেক আপ করানোর জন্য। তাইতো সাঈদের কল পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে হাসপাতালে।
সাঈদের কেবিনে ঢুকতেই আরও বেশি চমকে যায় মেহরান। কারণ সেখানে আরিয়া বসে ছিলো। মেহরান ভাবে এই মেয়ে এখানে কি করতে এসেছে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এদিকে আরিয়া এসেছিলো সাঈদের সাথে দেখা করতে। ব্লাইন্ড ডেইট যে কখনো এমন হাসপাতালে হয় সেটা আরিয়ার জানা ছিলো না। তবে এভাবে মেহরানের দেখা পেয়ে যাবে ভাবতে পারে নি। মেহরানকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে তার কাছে। কোণে একটা হাসি ফুটালো। মেহরান কপাল কুঁচকে সামনে এগিয়ে গেলো। সাঈদ আরিয়ার উদ্দেশ্য বলল,
“আপনার এখন যাওয়া উচিত মিস. আরিয়া।”
আরিয়া সাঈদের কথার উত্তর না দিয়ে মেহরানকে জিজ্ঞাসা করলো,
“কেমন আছেন মেহরান খান? আপনাকে অনেকদিন পর দেখছি।”
মেহরান আরিয়ার কথায় পাত্তাই দিলো না। তবে সাঈদের ভ্রুদ্বয়ের মাঝে গাঢ় ভাঁজ পড়লো। আরিয়া মেহরানকে চেনে? মেহরান বরং গম্ভীর স্বরে সাঈদকে বলল,
“পার্সোনালি কথা বলতে চাই।”
আরিয়ার পার্সোনালিটি আঘাত হানলো। তাই উঠে দাঁড়িয়ে গটগট পায়ে হেটে চলে গেলো। সাঈদ কিছু বলার আগেই মেহরান তাকে থামিয়ে বলল,
“এখন এই আরিয়ার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসা করিস না।আগে আমার সিটিস্ক্যান কর।”
সাঈদ ছোট করে শ্বাস ফেললো।কিছু জিজ্ঞাসা করলো না।
আধঘণ্টা ধরে বসে রয়েছে মেহরান। চিন্তায় আর তীব্র মাথা ব্যথায় তার মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। বমি বমি ভাব পেলেও নিজেকে কন্ট্রোলে রাখলো। রাউশি কয়েকবার কল করেছে তাকে। কিন্তু মেহরান রিসিভ করে নি।
মেহরান কপালে হাত দিয়ে বসে ছিলো। সেসময় সাঈদ আসলো। তার পিছুপিছু এক এক করে বন্ধুমহলের সবাই আসলো। মেহরান বিরক্ত হলো। এদের বলার কোনো মানে আছে? এই সাঈদ সবাইকেই বলে দিয়েছে নাকি?
আলভি মেহরানের কাছে এসে বসে বলল,
“মেহরান আ’ ইয়্যু ওকে?”
সবার চোখেমুখে কেমন হতবম্ভ ভাব ছেয়ে আছে।মেহরান যা বুঝার বুঝে গেলো। কষ্টের মাঝেও ভীষণ হাসি পাচ্ছে হঠাৎ। এই দিন দেখতে হবে কখনও ভাবে নি সে।পরিবারের কথা মনে পড়ছে এখন। সবচেয়ে বেশি ডিস্টার্ভ করছে রাউশির প্রাণচ্ছোল মুখটা। একটি সুন্দর জীবন রাউশির সাথে পারি দেওয়া হবে না ভেবে শ্বাস রোধ হয়ে এলো তার।হাসফাস করলো মেহরান। কান্না পেলেও ছেলে মানুষকে কান্না করা শোভা পায় না ভেবে দমিয়ে নিলো নিজেকে।
সাঈদ রিপোর্টটা এগিয়ে দিলো মেহরান মুখে হাত দিয়ে হালকা কেঁশে উঠলো ।মেহরান হাত তুলে সেটা নিতে গিয়ে দেখলো হাত ক্রমশ কেঁপে চলেছে তার।অথচ তার ব্যাক্তিত্বের সাথে এই কাঁপাকাঁপি শোভা পায় না।বুক ভার হয়ে এলো।সাঈদ সড়ে গিয়ে ধপ করে নিজের ইজি চেয়ারে বসে মাথা উপরে তুলে হতাশার এক শ্বাস ছাড়লো। এদিকে তুষার কেঁদে দিলো।এহসানেরও একই অবস্থা। নুজাইশ নেই এদের মাঝে। ছেলেটাকে সাঈদ কল দিয়েছিলো।হয়তোবা ব্যস্ত আছে। তাই কল রিসিভড করতে পারে নি।
এদিকে আলভি মেহরানের কাঁধে হাত রেখে বসে আছে।কষ্ট হচ্ছে খুব।যে ছেলে সবসময়ই নিজেকে স্ট্রং রাখার উপদেশ দেয় সেই ছেলের আজ এমন মরনব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার কথা মাথাতেও আসে নি কারোর।
মেহরান রিপোর্ট খুলে দেখলো তার ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছে। সেকেন্ড স্টেজে আছে। মেহরান নিজের মনকে বোঝালো এখনও স্টেজ ফোরে যায় নি। তবে এত তাড়াতাড়ি এতদূর এগোলো কিভাবে তাও বোধে আসলো না।আপাতত এসব ভাবার মুডে নেই। বরং নিজেকে বারবার স্বান্তনা দিলো সময় আছে এখনও চিকিৎসা করাতে পারবে। সবার দিকে একপলক তাকালো। সবাই তারই দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকানো। মেহরান বুক ভরে শ্বাস নিতে গেলেও কষ্ট হলো। তবুও যতটা সম্ভব গম্ভীর স্বরে বলল,
“কেউ যাতে না জানে।”
উঠে দাঁড়ালো তারপর আবারও বলল,
“রাউশি যেন একেবারেই নয়।”
ভার্সিটিতে আজ কিসের যেন এক প্রোগ্রাম আছে। মেহরান গতকাল বাড়িতে ফেরে নি। রাউশিকে ফোন করে জানিয়েছে সে শহরের বাইরে গিয়েছে। রাউশিও খুব একটা ঘাটায় নি মানুষটাকে। তবে কণ্ঠটা অন্যরকম লেগেছে তার। কেমন ভাঙ্গা ভাঙ্গা লেগেছে। মানুষটার কাশি উঠেছে নাকি?
রাউশি তানিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। রিকশায় চড়ে ভার্সিটিতে গেলো। একদম গেইটের সামনে গিয়ে দুজনে নেমে গেলো। তখনই আবার সেদিক দিয়ে আসছিলো আয়াশ। রাউশিকে দেখে চলন থামিয়ে দেয়। রাউশি প্রথমে খেয়াল না করলেও ভাড়া মিটিয়ে সামনের দিকে চোখ যেতেই আয়াশকে দেখে একবার তাকালো। আগের তুলনায় স্বাস্থ্য কমেছে। মুখ ভর্তি দাড়ি গজিয়েছে। ফ্যাকাসে হয়েছে মুখমণ্ডল। রাউশি মুখ ঘুরিয়ে তানিয়াকে নিয়ে চলে গেলো।
আয়াশ রাউশিকে দেখলো শুধু।রাউশির সামনে থাকলে তার নিজেকে কেমন যেন অপরাধী, পাপী মনে হয়। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে নিজেও ঢুকলো।
বছরের শেষের দিকে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে একটি প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়। আজই সেই দিন। রাউশির সাথে আজ প্রায় অনেকদিন পর বন্ধু-বান্ধবীদের দেখা হলো। রুনা দূর থেকে রাউশিকে দেখতে পেয়ে এক দৌঁড়ে এসে রাউশিকে জড়িয়ে ধরলো। বাকিরাও এগিয়ে এলো।
“অনেকদিন পর।”
হাসিবের কথায় রাউশিও হেসে তাল মেলালো,
“অনেকদিন পর।”
“শুকিয়ে গেছিস রাউশি।”
“আর তুই মোটা হয়েছিস।”
ইউসুফ হেসে উঠলো।হাসিবের কাঁধে হাত রেখে রাউশিকে বলল,
“আমাদের হাসিব সিনিয়রের সাথে প্রেম করছে।”
রাউশি অবাক হলো,
“সিনিয়র!”
“হ্যা সিনিয়র।”
হাসিব ইউসুফের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“সিনিয়র না আমার থেকে দুই মাসের ছোট। ওর বাপ মা ওরে আগে ভর্তি করাইছে স্কুলে আমারে পরে করাইছে। তাই ক্লাসের গ্যাপ এত।”
নাঈম ফোঁড়ন কেটে বলল,
“তবুও সিনিয়র কেমন যেন বাজে একটা অনুভুতি আসে আমার।”
“তোর আসে আমার আসে না। আর তুই তো প্রেম করছিস না।”
রাউশি বলল,
“হ্যা সেটাই তো।হাসিবের যেহেতু পছন্দ হয়েছে তাহলে ওই প্রেম করুক। তোরা শুধু ওদের লুতুপুতু প্রেম দেখে যা।”
মিলি দৌঁড়ে এলো।প্লাজুতে পা লেগে পড়ে যেতে নিলে নাঈম মিলির হাত ধরলো,
“সাবধানে হাটতে পারিস না?”
“প্লাজুতে পা লেগেছিলো।”
“প্লাজু পড়িস কেন?এমনিতেই আসতে পারিস না।”
মেহেরজান পর্ব ৩২
হাসিব নাঈমের পিঠে বড়সড় কিল বসিয়ে মনে করিয়ে দিলো নাঈম ঠিক কি রকমের কথা বলছে। নিজের কথার ধরণ বুঝতেই নাঈম ইতস্ততবোধ করলো আর মাথা চুলকে মিলিকে বলল,
“তুই একটা কানা।যাহ সর।আমায় যেতে দে।”
নাঈম কোনোভাবে কেটে পড়লো। এদিকে রুনা রাউশির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। পেছন পেছন বাকিরাও গেলো।