মেহেরজান পর্ব ৩৪
লেখনীতে- সোহা
“মেহরানের ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছে নুজাইশ।সেকেন্ড স্টেজে আছে।মোটামুটি ভালো থাকলেও থার্ড স্টেজে যেতে সময় লাগবে না।কিন্তু ও কোথায় গিয়েছে এটাও জানি না।তুই একটু খোঁজ নিয়ে দেখ ভাই।”
শেষের কথাগুলো ভালোভাবে না ঢুকলো না প্রথম কথাটা শোনার পরই কানে আগুনের লাভা ঢেলে দেওয়ার মতো পরিস্থিত হলো যেন নুজাইশের। কথাটুকু শুনতেই ফোনটা হাত থেকে নিচে পড়ে গেলো। তার সামনেই রাউশি। তবে রাস্তার ওপরপাশে।নুজাইশ গাড়িতে বসে ছিলো।রাউশিকে দেখছিলো দূর থেকে।তখনই সাঈদের কল আসলে নুজাইশ চিন্তিত হয়ে পড়ে।সাঈদ ব্যস্ততার তাড়নায় খুব একটা কল করে না।প্রয়োজন পড়লে মেসেজ দিয়ে দেখা করে নুজাইশের সাথে।তবে আজ হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপে কল দিলো দেখে নিজেও চিন্তিত ছিলো।এরপর যখনই সেই বিশ্রি কথাটা শুনলো ফোনটা হাত থেকে নিচে পড়ে গেলো গাড়িতে।
তার নিজেরই কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো লাগলো নিজেকে না জানি মেহরানের কি অবস্থা? কাত হয়ে নিচে খুঁজতে লাগলো ফোনটা। হাতে পেয়ে মেহরানকে কল করার চিন্তা ভাবনা করলো।কল করলো কিন্তু মেহরান ধরলো না।এই ছেলেকে খুব তাড়াতাড়িই দেশের বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে।নয়তো মানুষটা বাঁচবে না।ফুসফুসে ক্যান্সার যদি ফোর্থ স্টেজে চলে যায় তবে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা একদম পাঁচ পার্সেন্টও থাকে না।সর্বোচ্চ পাঁচবছর কি দশ বছর বাঁচার সম্ভাবনা থাকে।কিন্তু মেহরানকে যে বেঁচে থাকতে হবে অনেক অনেক বছর। রাউশির জন্য বেঁচে থাকতে হবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নুজাইশ গাড়ি ঘুরিয়ে মেহরানকে খোঁজার জন্য বেরিয়ে পড়লো।এদিকে রাউশি ভার্সিটি থেকে বের হয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় হঠাৎ চোখ গেলো দূরে ফুঁচকার স্টলে। তানজিম আর একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁচকা খাচ্ছে। তানজিম ভাই কি ডেটে গিয়েছে নাকি? রাউশি খুব একটা ঘাটলো না। তবে তানজিমকে দেখে তার উজান ভাইয়ের কথা মনে পড়লো। রাউশি তো উজানের কথা ভুলেই গিয়েছিলো। রাউশি তাড়াতাড়ি করে ফোন বের করে উজানের নাম্বারে কল লাগালো। বারকয়েক রিং হলো তবে কল রিসিভড হলো না। রাউশি ভাবলো উজান ভাই হয়তো তার ওপর রেগে আছে। রাউশি বারবার কল করার পর শেষবারে কল রিসিভ হলো।
“হ্যালো!উজান ভাইয়া!”
ওপাশ হতে নিরুত্তর উজান।রাউশি পুনরায় বলল,
“ভাইয়া তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?হ্যালো!”
“বল।”
উজানের কণ্ঠস্বর অন্যদিনের তুলনায় ভিন্ন। কেমন অপরাধবোধ প্রকাশ পাচ্ছে যেন। রাউশি বলল,
“ভাইয়া তোমায় গতকাল আজ একটা দিনও দেখতে পেলাম না।কোথায় তুমি?”
“আছি এখানে সেখানে।কেমন আছিস তুই রাউশি?আমার জন্য কত বড় বিপদে পড়লি নারে? আমায় ক্ষমা করে দিস বোন।”
রাউশি বিরোধিতা করে বলল,
“এসব কি বলছো?আমাদের ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই হয়।কখন কার কি হয় সেটা কি কেউ আগে থেকে নির্ধারণ করে নাকি কেউ সে পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়? হ্যা শত্রুপক্ষ এমন করে থাকে।তবে আপনজন কি কখনও এমন করে ভাইয়া?ক্ষমা চেওনা উজান ভাই।তুমি বাড়িতে চলে এসো। আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাব।”
উজান কান্নাভেজা গলায় বলল,
“আমি আর ও বাড়িতে যাব না বনু।রাখছি, ব্যস্ত আছি।”
কল কেটে দিলো উজান।হতাশ হলো রাউশি।কি একটা পরিস্থিতি তাদের ভাইবোন বাবা মায়ের মাঝে একটা বড়সড় ফাটল ধরিয়ে দিলো।না জানি কবে জোড়া লাগবে এই ভাঙন।
রাউশি অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তাটা পার হচ্ছিলো। খেয়াল ছিলো না একটি ট্রাক আসছে বাম দিক থেকে।রাউশি যখন পার হচ্ছিলো তখন বেশ দূরেই ছিলো তবে রাউশি রাস্তার মাঝে যেতেই এত দ্রুতই এলো যে রাউশি ঠাওর করতে পারলো না।শুধু চোখ বড় বড় করে বাম দিকে তাকিয়ে।তখনই কেউ তার হাত ধরে টান দিলো তবে ট্রাকের সাথে ডান বাম পায়ে বড়সড় ধাক্কা লাগে।ট্রাকের চাকার নিচে একটু পড়ে যাওয়ায় পায়ের বেহাল দশা হয়ে যায়। রক্তাক্ত হয় মুহুর্তের মাঝেই।এত স্পিডে ছিলো রাউশি ট্রাকের নিচে পড়ে মুহুর্তেই মারা যেত আজ।কিন্তু তবুও যখম হয়েই ছাড়লো।পায়ের অবস্থা গুরুতর।রাউশি আর্তনাদ করছে।কে টান দিয়েছে খেয়ালে নেই।মাটিতে ঢলে পড়লো। পুরো মুখ লাল হয়ে গেছে।পা কি থেতলে গেছে কিনা সন্দেহ।
আয়াশ রাউশির মাথা নিজের কোলে রাখলো।রাউশি অজ্ঞান হয়ে গেলো।আয়াশ উদ্বিগ্ন হয়ে আশেপাশে তাকিয়ে মানুষদের বলল,
“কেউ এম্বুলেন্স ডাকুন প্লিজ।”
মানুষ জড়ো হলো।এদিকে তানজিমরা দেখলো রাস্তায় মানুষ জড়ো হয়েছে। তানজিম কৌতূহল বশত বান্ধবী রিয়াকে রেখে সেদিকে গেলো। ভিড় ঠেলে সামনে যেতেই রাউশিকে ওমন অবস্থায় দেখেই চেঁচিয়ে ওঠে।
“রাউশি!”
দৌঁড়ে গেলো রাউশির দিকে।আয়াশ চিনলো না তানজিমকে তবে বুঝলো ছেলেটা রাউশিকে চেনে।আয়াশের চোখ ভিজে গেছে মুহুর্তেই।তানজিম পাগলের মতো হয়ে গেলো রাউশির এমতাবস্থা দেখে।একটা মাইক্রো যাচ্ছিলো সেদিক দিয়ে তানজিম থামিয়ে লিফট চাইলো।মাইক্রোর সেই ড্রাইভারও রাজি হলো।আয়াশকে সড়িয়ে তানজিম রাউশিকে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসালো। আর গাড়ি মুহুর্তের মাঝেই চলে গেলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।আয়াশ দাঁড়িয়ে রইলো। ভাবলো যাবে কিনা? তার কি যাওয়া উচিত কিনা?
বাড়িতে হাসনা বেগম, বৃষ্টিদের সাথে বাড়ির লোকেরা গল্পগুজব করছিলো।সেসময় রোকসানা বেগমের ফোনে কল আসলো। ফোনটা টেবিলের ওপর রাখা ছিলো। তানজিমের কল দেখে রিসিভ করলেন।
ওপাশ হতে তানজিমের কাঁপা গলায় ভয়ানক রকমের কথা শুনতে পেয়েই জমে গেলেন রোকসানা বেগম।হাত থেকে ফোন পড়ে গেলো।বসার ঘরে এসে কাঁপা কাঁপা গলায় কথাটা বলতেই রূপা বেগম যেন জমে যান।উর্মিলা বেগম ধরেন রূপাকে।বৃষ্টি আর তার মায়েরও অবস্থা একই।বৃষ্টির বুক কাঁপলো।মেয়েটা তো এই কিছুদিন আগেই একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেলো আর এখনই আবার এমন ভয়াবহ বিপদ? সব বিপদই কি রাউশির ওপর নাকি?
তানজিম অনেক্ষণ যাবৎ মেহরানকে কল দিয়ে যাচ্ছে তবে পাচ্ছে না। শেষবারের মতো কল করলো তাও পেলো না।ওটি থেকে ডাক্তার বের হলো তখন।তানজিম দ্রিত ডাক্তারের কাছে যেতে ডাক্তার বলল,
” বড়সড় কোনো ক্ষতি না হলেও ক্ষতটা অনেক। সুস্থ হতে সময় লাগবে।”
পরিবারের সবাই সেখানে উপস্থিত হলো সেসময়ে।ডাক্তারের কথা সবাই শুনলো। মাহমুদ খান ডাক্তারের কাছে গিয়ে বললেন,
“আমার মেয়ে কেমন আছে ড.? আমার মেয়ে ভালো আছে তো?”
ডাক্তার বিনয়ী স্বরে বললেন,
“উনার ক্ষত খুব গভীর।ট্রাকের নিচে পা পড়েছিলো মনে হয়? পায়ের অবস্থা কিছুটা বেগতিক।ঠিক হতে সময় লাগবে।”
এই বলে ডাক্তার চলে গেলেন।মাহমুদ খান দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন।সব বিপদ কেন তাদের ওপরই বয়ে যাচ্ছে?কি এমন করেছে তারা?তার মেয়ে এত কষ্ট কেন পাচ্ছে? কিছুদিন আগেই এতবড় বিপদ থেকে বেঁচে ফিরলো।আর এখনই আবার এক্সিডেন্ট?
এদিকে মেহরান একটি বদ্ধ অন্ধকার রুমে ফ্লোরে বসে আছে।অন্ধকারে কালো অবয়ব দেখা যাচ্ছে আর জলন্ত সিগারেট দেখা যাচ্ছে। ফুসফুসে ক্যান্সারের কারণই এই সিগারেট আর মেহরান এই সিগারেটই খাচ্ছে। মেহরান চোখ দুটো ভেজা।আধারের সমীপে সেটা বোঝা গেলো না।মেহরান অন্ধকারেই সিগারেট ফুঁকছে।আর ভাবছে তার কি এই মরনব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ারই ছিলো?
তানজিম অনেক্ষণ যাবৎ কল দিচ্ছিলো কিন্তু মেহরান রিসিভ করে নি।মন মেজাজ ভালো নেই তার।সিগারেটে শেষ টান দিয়ে এবার রাউশিকে ফোন করার জন্য ফোন হাতে নিলো।রাউশিকে খুব মিস করছে মেহরান।মেয়েটা কি জানে? মেহরানের সময় খুব কম? তাদের মেহেরজান নামক বন্ধনটা টগিক কতদিন অটুট থাকবে এ নিয়ে সংশয়ে ভুগছে মেহরান।একটা সুখের সংসার তো সেও ডিজার্ভ করে।তবে সৃষ্টিকর্তা যে নারাজ তাদের ওপর।হয়তোবা কোনো এক পাপ করেছিলো যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে।
মেহরান দুবার কল দিলো রিসিভ হলো না। ভাবলো হয়তো ব্যস্ত আছে।তবে এরপরই আবার রাউশির নাম্বার থেকে কল এলো। মেহরান এবার কল রিসিভ করে কথা বলতে নিয়ে গলা আটকে আসলো।কেমন অবশ অবশ লাগছে।কিন্তু তখনই ওপাশ হতে তানজিমের গলার স্বর শুনতে পেলো,
মেহেরজান পর্ব ৩৩
“ভাই রাউশির এক্সিডেন্ট হয়েছে।”
এটা শোনার পরই মস্তিষ্কই অবশ হয়ে গেলো মেহরানের। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো ঠিক শুনেছে কিনা। ওপাশ হতে তানজিম ‘হ্যালো,হ্যালো’ করছে।মেহরান হতবম্ভতা বজায় রেখে প্রশ্ন করলো,
“কি বললি?”
“রাউশির এক্সিডেন্ট হয়েছে ভাই।তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়।”