মেহেরজান পর্ব ৩৬

মেহেরজান পর্ব ৩৬
লেখনীতে- সোহা

গ্রীষ্মের তাণ্ডবে বিরক্ত প্রকৃতি। বিরক্ত মানুষও।তবুও কিছুই করার নেই। বিভিন্ন মৌসুমের বিভিন্ন রূপ সহ্য করেই তো যুগ যুগ, হাজার হাজার বছর ধরে এই পৃথিবী চলে আসছে।মানুষজন, পশু-পাখি প্রকৃতি সবারই সয়ে গেছে।
কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়লো রাউশির। হাটা থামিয়ে ব্যাগ থেকে একটা টিস্যু বের করে ঘাম মুছলো। আবারও হাঁটা শুরু করলো ফুটপাত ধরে। পাশে যানবাহনের আনাগোনা তো রয়েছেই। অতিরিক্ত শব্দে মাথা ঘুরছে তার।ব্যাথা করছে বাম পায়ে প্রচুর ব্যথা করছে।গত সাত মাস যাবৎই এই কষ্ট সহ্য করে আসছে রাউশি। তবে মনের কষ্ট এই কষ্টের কাছে একদমই তুচ্ছসই৷ পায়ের অতিরিক্ত ব্যথায় হাঁটতে এতটাই কষ্ট হচ্ছে যে রাউশি এই তপ্ত রৌদ্রেরঝাঁজের নিচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়লো।হাপালো কিয়ৎক্ষণ। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ধক ধক করে পুরো পানি ভর্তি বোতল শেষ করলো। সামনে চোখ যেতেই দেখলো একটা বটগাছ। জায়গাটায় কিছুটা নিরিবিলি রয়েছে। রাস্তা থেকে বেশি দূরে নয়।

রাউশি সেদিকে হাঁটা ধরলো।কোনোরকম খুঁড়ে খুঁড়ে হেঁটে সে স্থানে পৌঁছে ইটের বানানো বেঞ্চটাতে বসে পড়লো।বাম পায়ের দিকে খেয়াল করতেই দেখলো পা-টা ফুলে রয়েছে সাথে লালও হয়ে গেছে। মৃদু যন্ত্রণায় চোখ বুজলো রাউশি। এই গাছটির নিচে কিছুটা ঠান্ডা বাতাস রয়েছে।সেই বাতাসে শ্বাস নিলো বারকয়েক।মেহরান নামক প্রিয় পুরুষটার কথা মনে পড়লো ভীষণ করে। মানুষটা কি করছে এখন?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আমেরিকা চলে গিয়েছে আজ প্রায় সাড়ে সাত মাস। অথচ রাউশির সাথে একটাবারও কথা বলে নি।এমনকি শুধু রাউশিই নয় পরিবারের কারোর সাথেই কথা বলে নি।কি এমন ব্যস্ততা তার? যে কারোর সাথেই কথা বলতে পারছে না?রাউশি যে এতগুলো দিন কতটা যন্ত্রণায় কাটিয়েছে সেটা কি মেহরান জানে?জানবেই বা কি করে খোঁজ রাখে কি?
রাউশি প্রতিরাতেই কান্না করে মেহরানের জন্য। ফোন করে মেহরানকে তবে মেহরানের নাম্বার বন্ধ থাকে সবসময়। বড় চাচাকে অনেকবার বলেছে মেহরানের সাথে কথা বলতে চায় সে তবে মাহবুব খান সরাসরিই বলেছেন মেহরান তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়।রাউশির দোষটা কোথায় এটাই জানে না রাউশি।শুধু জানে সে মেহরানের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, মেহরানের সুদর্শন মুখশ্রী অনেকদিন যাবৎ দেখেনি। আর সে এতটাই যন্ত্রণায় ভুগছে যে প্রতি রাতেই ঘুমের ঔষধ খেতে হয় তাকে।

মেহরানের কথা মনে পড়তেই কান্না পেল রাউশির। এ জীবন জীবন নয়।এ হলো মরণ যন্ত্রণা।মাঝে মাঝে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও থাকে না রাউশির।বৃষ্টির সাথে সমস্ত কথা শেয়ার করে।বৃষ্টি তাকে স্বান্তনা দেয়।তবে রাউশির আজও অজানা মেহরানের রাগের কারণ,মেহরানের এতমাস আমেরিকা থাকার কারণ আর মেহরানের তার সাথে কথা না বলার কারণ।আচ্ছা মেহরান কি জানে তার এক্সিডেন্টের কথা? উনি কি জানেন রাউশি ঠিক কতটা কষ্টে আছে?
রাউশি গাছে হেলান দিয়ে বসে থাকলো।চোখ বেয়ে কয়েকফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো নিচে।সেমুহুর্তে কাঁধে কারও স্পর্শ পেতেই চোখ তুলে পাশে তাকালো।বৃষ্টিকে দেখে আবারও চোখ বুজে বসে রইলো রাউশি।বৃষ্টি রাউশির পাশে বসলো।শান্ত আওয়াজে জিজ্ঞাসা করল,

“তুমি হঠাৎ এই জায়গায়?বাড়িতে কখন যাবে? আর একা কেন?”
বৃষ্টি মাস তিনেক আগে একটা চাকরি পেয়েছে। একটা ফ্যাশন হাউজে। ভালো বেতন হওয়ায় মা আর বোনকে নিয়ে রাউশিদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে একটা বিল্ডিং এ একটা ফ্ল্যাটে উঠেছে। মাঝেমধ্যে রাউশিকে দেখার জন্য যায় বৃষ্টি। রাউশি যখন বাড়িতে থাকে না তখন সবাই চিন্তিত থাকে। বৃষ্টি অফিসের ছুটি নিয়েই রাউশিকে সেসময় খুঁজতে বের হয়।আর এই বটগাছের নিচেই খুঁজে পায় বেশিরভাগ সময়। অফিসের বস ভালো হওয়ায় বৃষ্টি এই কাজ করতে পারে।
বৃষ্টির কথা শুনে রাউশি সহজ সরল উত্তর দিলো,

“আমার পুরো জীবনটাই একা।এসেছিলামও একা, মরে যাবও একা।অন্য কাউকে আশা করি না।একজন তো মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টি নামিয়েই উধাও।”
থামলো রাউশি।বৃষ্টির হাত ধরে বলল,
“আচ্ছা বৃষ্টি।মেহরান কি জানেন? আমি ঠিক কতটা তৃষ্ণার্ত?উনার মুখদর্শন হচ্ছে না আজ কতদিন।উনার কণ্ঠ নিঃসৃত কথা শ্রবণ হয় নি কতদিন।উনি কি জানেন আমি ঠিক কি পরিমাণ উনাকে চাই।”

বৃষ্টি হতাশার শ্বাস ফেললো।মেহরানের এমন হুট করে আমেরিকা চলে যাওয়া আর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারটা সবারই অজানা।বৃষ্টি এতমাস যাবৎ শুধু রাউশিকেই দেখে আসছে।কি নিদারুণ কষ্টে রাউশি এই কয়মাস কাটিয়েছে।রাতে বালিশে মুখ গুজে কান্না করেছে অবিরত।মাঝে মাঝে মেহরানের ছবি দেখে দেখে সারারাতই কান্না করেছে।রাউশির বিষাদময় সেই অশ্রুকণার ছাপ তাদের বাড়ির প্রতিটি কোণায় কোণায় রয়েছে যেন।মেয়েটার এত সুন্দর মুখখানিতে এখন বিষাদে ছেয়ে থাকে।প্রিয় মানুষের জন্য আর্তনাদ করতে করতেই যেন বয়সের ছাপ পড়েছে মুখে।

“বৃষ্টি আমায় পানি খাওয়াও না একটু।”
বৃষ্টির ধ্যান ফিরলো।সাইড ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে রাউশিকে দিলো। রাউশি পানি খেলো।পানি খাওয়া শেষেই হঠাৎ মুখে হাত দিয়ে হু হু করে কেঁদে দিলো।
কান্নাভেজা গলায় অভিমান মিশিয়ে বলল,
“মেহরান কি জানেন? আমি তৃষ্ণার্ত হয়ে পানি খেয়ে আজও শান্তি পায় না? আমি ভালো নেই বৃষ্টি। তীব্র যন্ত্রণায় আমার বক্ষপট হতে ভয়ানক আর্ত চিৎকার ভেসে আসে। সেই চিৎকার এতটাই নির্মম যে আমি ভালো থাকতে পারছি না। কেন উনি এভাবে চলে গেলেন?”

বৃষ্টি রাউশির মাথায় হাত দিয়ে স্বান্তনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করলো।চোখের অশ্রু ভারী হলো রাউশির।হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো।এক সময় থেমে গেলো।বৃষ্টি টিস্যু বাড়িয়ে দিতেই সেটা নিয়ে চোখমুখ মুছে উঠে দাঁড়ালো।বৃষ্টি ধরল রাউশিকে। রাউশি বৃষ্টির সাহায্যে সামনে এগিয়ে গেলো। আর বলতে লাগলো,
“মানুষটা আবারও ফিরে আসুক আমার জীবনে,অন্ধকারের এক উৎস আলো হয়ে। আমি সেই আলো অনুসরণ করে হেঁটে যাব আজীবন।”
বৃষ্টি রাউশিকে দেখলো শুধু।তার কিছু করার নেই।

নুজাইশ রাউশি আর বৃষ্টির যাওয়া দেখলো দূর থেকে।গাছের আড়ালো দাঁড়িয়ে ছিলো সে।রাউশির কষ্টে সে নিজেও ব্যথিত।রাউশি সবসময়ই ওই বটগাছটির নিচে এসে বৃষ্টির পাশে বসে কান্না করে। নুজাইশ তা দূর থেকে দেখে।কিন্তু কিছু করতে পারে না।নুজাইশ চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুজল মুছে নিলো।ফোনের লক খুলে কিছুক্ষণ আগে তোলা রাউশির ছবিগুলো দেখলো। হোয়াটসঅ্যাপে তুষারের নাম্বারে সেন্ড করলো। পাশে দাঁড় করানো গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়িটা উলটো ঘুরে চলে গেলো অন্য কোথাও।
এদিকে ওয়াশিংটন ডিসি শহরের,

দশতলা বিল্ডিং এর একটি সপ্তম তলার একটি ফ্লোরে বেডে শায়িত মেহরান।ছয়মাস আগেই তার অপারেশন হয়ে গিয়েছে। মেহরান কোমায় চলে গেছে। সেদিন অতিরিক্ত ধুমপানের কারণে ফুসফুসে ভীষণ চাপ পড়ে। রক্ত জমাট বাঁধে। কিছু কিছু জায়গায় ব্লক হয়ে যায়। লিভারে সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি ভালো ভাবে পরীক্ষার পর জানা যায় অতিরিক্ত টেনশন আর এই ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণে ব্রেন টিউমারও ধরা পড়েছে। এই কথা শুনে সবাই এতটাই হতবাক হয়ে পড়েছিলো যে মেহরানের বেঁচে থাকা নিয়ে সবাই আশঙ্কায় ভুগছিলো।তবে আল্লাহর রহমতে মেহরান বেঁচে গেলেও কোমায় চলে গিয়েছে। আজ প্রায় ছয়টা মাস যাবৎ বিছানায় শায়িত সে। চোখ মেলে তাকায় না।আর না নড়াচড়া করে।শুধু ধীরে ধীরে শ্বাস নেয়। মেহরানের পাশে বসে আলভি, এহসান, তুষার প্রত্যেকটা দিন আহাজারি করে কান্না করে। রাউশির কথা বলে। মুখের সামনে নুজাইশের পাঠানো রাউশির ছবিগুলো ধরে।তবে মেহরান চোখ খুলে সেসব দেখে না। ডাক্তাররা বলেছেন আর একমাস পর যদি মেহরান চোখ না খুলে,জ্ঞান না ফেরে তবে আর কখনোই চোখ খুলে তাকাবে না।আজীবন কোমায় পড়ে থাকবে সে।
তুষার মেহরানের বিছানার পাশে বসলো চেয়ার টেনে। কাঁপা গলায় আগের মতোই রাউশির ছবিটা মেহরানের সামনে দেখিয়ে বলল,

“দেখ, তুই নিজেও কষ্টে আছিস। এই মেয়েটাকেও এত কষ্টে রেখেছিস। এখন সত্যিই বলতে ইচ্ছে করছে তুই খুবই নিষ্ঠুর আর নির্দয়।”
এহসান থাই গ্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে হাসপাতাল থেকেই বাইরের শহরের দৃশ্য দেখছিলো তুষারের কথা শুনে কষ্ট ছাপিয়ে কেঁদে দিলো।মেহরানে কাছে এসে মেহরানের গাল ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
“দোস্ত, দেখ তোর রাউশি ঠিক কি পরিমাণ কষ্ট পাচ্ছে।আমরা নাহয় নিজেদের সামলাচ্ছি কোনোভাবে।আমাদের পরিবার পরিজন আছে।কিন্তু রাউশির? এত কঠিন অতীত ফেলে তোকে নিয়ে এত সুন্দর এক জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলো।অথচ দেখ ওর সেই স্বপ্ন শুরু হতে না হতেই শেষ।অন্তত ওর জন্য সুস্থ হয়ে যা ভাই।চোখ খুলে তাকা মেহরান।”

মেহেরজান পর্ব ৩৫

সেসময় একজন শেতাঙ্গ নার্স ভেতরে প্রবেশ করলেন।এহসান আর তুষারকে এখানে এত চেচামেচি করতে দেখে ইংরেজিতেই বলল,
“Why are you shouting here? can’t you let him be in peace for a day?”
এহসান বিড়বিড় করে গালি দিলো।হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো সে।তুষার বসে রইলো।তবে নার্স তাকেও বের করে দিলো।নার্স কাজ করছিলেন কারোরই খেয়ালে আসলো না মেহরানের ডান হাতের বুড়ো আঙুল কিঞ্চিৎ নড়েছে।

মেহেরজান পর্ব ৩৭