মেহেরজান পর্ব ৩৯
লেখনীতে- সোহা
সকালে রাউশির ঘুম ভাঙলো মুখের ওপর গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়াতে। ঘুমঘুম চোখ খুলতেই দেখলো মেহরানের ঘুমন্ত মুখশ্রী। আজকের সকালটা ভীষণ মিষ্টি মনে হলো রাউশির কাছে। এমন মিষ্টি সকাল আজীবন পেতে চায় রাউশি। মেহরানের চুলে হাত বুলালো। একটা আঙুল মেহরানের চোখ বেয়ে স্পর্শ করতে করতে ঠোঁটে এসে থামলো। রাউশি হেসে দিলো নিঃশব্দে। আঙুল সড়িয়ে তার কোমড়ে রাখা মেহরানের হাতটা সড়িয়ে উঠতে যাবে তার আগেই মেহরান হাত ধরে ফেললো।
রাউশি চমকে পেছনে ফিরে তাকাতেই মেহরান তাকে কাছে টেনে আলতো করে ঠোঁটে চুমু দিলো রাউশিকে। ঘুম ঘুম কণ্ঠে এক চোখ খোলা আর এক চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল,
“এটা প্রতি সকালেও পাওনা তোর।”
রাউশি থতমত খেয়ে গেলো। মেহরান রাউশিকে ছেড়ে আবারও ঘুমিয়ে গেলো৷ রাউশি উঠে দাঁড়ালো। শাওয়ার নেওয়ার জন্য একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো মেহরান তখনও ঘুমাচ্ছে। রাউশি খাটের কাছে এসে কিছুক্ষণ মেহরানকে দেখলো। সকালের স্নিগ্ধ আলো মেহরানের মুখে এসে ছিটকে পড়ছে মনে হলো। মেহরানের ফর্সা আদলে বদ্ধ আঁখিজোড়া, একখানা সুচালো নাক আর নিরেট চোয়ালে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষটাকে বাচ্চাদের মতো লাগলেও যখন গম্ভীর মুখ ধারণ করে সেসময় চেহারার আদল পালটে যায় মেহরানের। রাউশি আবারও হেসে উঠলো।
রাউশি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সোজা নিচে নেমে গেলো। বাড়ির কর্ত্রীরা একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত। রাউশি মায়ের কাছে গেলো। এই কয়মাস মায়ের সাথে ঠিক কয়বার কথা হয়েছে সেটা মনে নেই রাউশির। শুধু এটাই মনে পড়ে রাউশি সারাদিন, সারারাত বসে বসে প্রহর গুণেছে মেহরানের ফিরে আসার।
রূপা বেগম মেয়েকে সকাল সকাল নিচে দেখে বিস্মিত হলেন। আর তার চেয়েও বেশি বিস্মিত হলেন মেয়েকে হলুদ শাড়িতে দেখে। এমনিতে কখনও বাড়িতে শাড়ি পড়ে না রাউশি। রূপা বেগম মেয়ের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“মাশা-আল্লাহ, কারোর নজর না লাগুক।”
রাউশি হেসে শান্তমুখভঙ্গিতে বলল,
“মা আজ এতো কাজ কিসের তোমাদের?”
রূপা বেগম কেন যেন একটু অন্যরকম হলেন। মেয়ের হাত ছাড়িয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“তুইও কাজে লেগে পড়। আগামীকাল বিকেলে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান আছে।”
রাউশি প্রশ্ন করলো,
“কিসের অনুষ্ঠান?”
রূপা বেগম কথা ঘুরাতে চাইলেন,
“মেহরান উঠে নি ঘুম থেকে? আচ্ছা ঘুমাক তাহলে।”
বলে তিনি চলে গেলেন। রাউশির মনে হলো তার মা তার থেকে কিছু লুকোচ্ছে। তাই রাউশি রান্নাঘরে চলে গেলো। রোকসানা বেগম আর উর্মিলা বেগম আর দুজন পরিচারিকা সকালের নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত।
উর্মিলা বেগম রাউশিকে এখানে দেখে বললেন,
“তুই এখানে? মেহরানও উঠেছে?”
পরবর্তীতে রাউশিকে শাড়ি পড়া দেখে কেমন মজার সুরে বললেন,
“মেহরান তো আজ তোর থেকে চোখই সড়াতে পারবে না।”
রাউশি লজ্জা পেলো,
“কি যে বলো না বড় মা।”
উর্মিলা বেগম আর রোকসানা বেগম হেসে উঠলেন।রাউশি একটু উর্মিলা বেগমের কাছে গেলো। আর জিজ্ঞাসা করলো,
“মা বললো আগামীকাল নাকি কিসের অনুষ্ঠান?”
উর্মিলা বেগম কেমন করে যেন রাউশির দিকে তাকালেন। তারপর আবারও কাজে মন দিয়ে বললেন,
“মেহরানের আসার খুশিতে আর কি ছোট খাটো কিছু করবো।”
রাউশির কেমন যেন লাগলো। একটা মানুষের বাড়িতে ফেরাতে অনুষ্ঠান করে নাকি কেউ? রাউশি মাথায় এক জটলা প্রশ্ন নিয়ে বেরিয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে। উর্মিলা বেগম রোকসানা বেগমের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসলেন।
রাউশি এবার সোজা চলে গেলো তানিয়ার রুমে। তানিয়াকে দেখা গেলো বিছানায় একটা ছবি নিয়ে ঘুমাচ্ছে। দরজা খোলা থাকায় রাউশি ঢুকতে পেরেছে। তানিয়ার পাশের খালি জায়গাটায় গিয়ে শুয়ে পড়লো রাউশি। তানিয়ার হাতে থাকা ছবিটা হাতে নিয়ে দেখলো একটা ছেলের ছবি। নিচে নাম লেখা আছে ফুয়াদ। রাউশির মনে পড়লো এই ছেলেই তানিয়ার হবু স্বামী। রাউশি মনে মনে খুব হাসলো। এই মেয়ে সারারাত ছবি দেখেছে নাকি ফুয়াদের?
সকাল দশটা বাজে। একে একে সবাই নিচে আসা শুরু করেছে। বাড়ির কর্তারা সেই ভোরেই নিজেদের কাজে চলে গিয়েছে। এখন শুধু বাড়ির ছেলেমেয়েরাই রয়েছে। আর তারাই একেকজন করে নিচে আসছে। গতকালকে নাহিন,মাইশাও এসেছিলো বাড়িতে। আজ নাকি রাউশির ফুফুরাও আসবে। আবার উজান ভাইও আসবে। রাউশির মনে হচ্ছে আজ বাড়িতে ঈদের দিন।
রাউশির কাঁধে হাত রেখে মাইশা বলছিলো,
“আমি এক নতুন রিলেশনে গিয়েছি৷ ছেলেটা দেখতে একদম ঝাক্কাস। কেমন হবে বলোতো আপু, যদি আমি বিয়ে পর্যন্ত আগায়।”
রাউশি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ভালো হবে।”
“সত্যি?”
“হ্যা।”
“আব্বু-আম্মুকে বলি।”
“তোর ইচ্ছা।
” তুমি বলে দাও।”
“পারবো না।”
মাইশা হতাশ হলো,
“তাহলে আমিও পারবো না বলতে।”
“তাহলে বিয়ে করতে হবে না।”
“তোমার বিয়ে হয়ে গেলো। তানিয়ার বিয়ে হবে।আমি কেন সিঙ্গেল থাকবো।”
“সিঙ্গেলই ভালো।”
নাহিন এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“ওহ তাই নাকি? মেহরান ভাইকে কি এখন আর ভালো লাগছে না? মেহরান ভাইকে বলবো? দাঁড়া আজ আসুক মেহরান ভাই।”
নাহিন এবার বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই বেশি পেঁকে গিয়েছিস। দাঁড়া মা কে বলে দেব আমি।”
বিরক্ত হলো মাইশা। নাহিনের মাথায় গাট্টা মেরে চলে গেলো। নাহিন রাউশিকে বলল,
“দেখেছিস? এই মেয়ে যে বাড়িতে বউ হয়ে যাবে, সে বাড়ির সবার কপাল পুড়বে।”
মেহরান তখন সিড়ি বেয়ে নামছিলো। রাউশিকে আর নাহিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ দুটো বারবারই রাউশিতে মুগ্ধ হচ্ছিলো। যেন হাজার বছর পর রাউশিকে দেখছে তাও আবার শাড়িতে। রাউশি খেয়াল করে নি মেহরানকে। নাহিনই প্রথমে খেয়াল করলো মেহরানকে। আর চেঁচিয়ে বলল,
“মেহরান ভাই আসছে।”
রাউশি কানে হাত দিলো,
“তাই বলে এতো জোরে চেঁচাতে হবে?”
রাউশির চোখ গেলো সিড়ির দিকে। মেহরান তারই দিকে তাকিয়ে নিচে নামছে। চোখের চাহনীতে আলাদা এক শীতলতা যা রাউশির হৃদয় শীতল করে দিলো। নাহিন মেহরানের কাছে গিয়ে কোলাকুলি করলো। তারপর এক হাত দিয়ে রাউশির কাছে যেতে বললো নাটকীয় ভঙ্গিতে। নাহিন সে স্থান থেকে সড়ে গেলো। মেহরান রাউশির দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো।
“এই সাজ কি আমার জন্য?”
রাউশি ব্যঙ্গ করে বলল,
“অবশ্যই না।”
মেহরান রাউশির নিকটে এগিয়ে এলো। এপাশে কেউ নেই। মেহরান সেই সুযোগটা কাজে লাগালো। রাউশির কোমড় জড়িয়ে ধরলো। মেহরানের শীতল হাত রাউশির শাড়ি ভেদ করে পেটে স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠলো রাউশি। মেহরান রাউশির দিকে ঝুকে বলল কণ্ঠে মাদকতা মিশিয়ে বলল,
“তাই নাকি? তবে আমার দুষ্টু মেহরান তো বলছে তার মেহেরজান তার জন্যই আজ এমন সাজে, এমন রূপে।”
রাউশি ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হলো। কাঁপা গলায় বলল,
“ছেড়ে দিন। কেউ এসে পড়বে।”
মেহরান আরেক হাত রাউশির গালে রেখে বলল,
“আসুক।”
এরপর রাউশির গালে নাক ঠেকিয়ে একটা শ্বাস নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে বলল,
“তোর এমন রূপে আমি বারবার বশিভূত হতে চাই।”
নিশিদের ভিড়ে আলো সংকটাপন্ন। এমনই এক বদ্ধ রুম থেকে একটি মেয়ের চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসছে। তবে আশেপাশে তাকে সাহায্য করার মতো মানুষ তো দূর কোনো কাকপক্ষীও বসে নেই। মেয়েটি সাহায্য চাইছে বারবার।
হুট করেই দরজা খুলে গেলো। পরপর ভেতরে ঢুকলো তিনজন পুরুষ। মেয়েটা টের পেলো কিছুটা। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
মেহেরজান পর্ব ৩৮
“ইয়্যু বাস্টার্ড, তোদের আমি কাউকেই ছাড়বো না। সাহস হয় কি করে? আমাকে এভাবে ধরে নিয়ে আসার?”
“আমার আবার সাহস একটু বেশিই।”
কেউ একজন সুইচ টিপে লাইট জ্বালালো। সামনের পুরুষগুলোকে দেখে মেয়েটা চমকে গেলো। এ যেন এক অন্য রূপ মনে হলো তার। একদিকে মুগ্ধতা,অন্যদিকে বিস্মিত ভাব তো আবার রাগান্বিত ভাব নিয়েই বিড়বিড় করে আওড়ালো,
“মেহরান!”