মেহেরজান ২ পর্ব ১
লেখনীতে- সোহামণি
মেজর মেহরান খানের সামনে ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেলো রাউশি। এই একটা ঘটনা দ্বারা আশেপাশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিলো রাউশি। কিছুজনের ঠোঁটের কোণায় হাসি তো কিছুজন রাউশির জন্য দুঃখ পেলো বুঝি। এদিকে মেহরান ভ্রুদ্বয় কুঁচকে তাকিয়ে দেখছে রাউশিকে। মেয়েটার চোখমুখ লজ্জা আর নার্ভাসনেসে ভরে গিয়েছে। লাল টমেটোর মতো লাগছে।
লজ্জা আর অস্বস্তিতে রাউশির মুখায়ব লাল হয়ে উঠলো। মেহরান রাউশির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো ওঠার জন্য। তবে রাউশি সেই হাত উপেক্ষা করে নিজেই উঠে চেয়ার টেনে তৎক্ষনাৎ বসলো। মেহরান রাউশির এমন আত্মনির্ভরশীলতা দেখে কিছুটা উৎসাহ পেলো।
‘কোথায় ব্যথা পেয়েছেন?’গমগমে পুরুষালী কণ্ঠে জানতে চাইলো মেহরান।
রাউশি নিজের চেয়ারে বসে বলল,’ ঠিক আছি আমি।’
মুখে এটা বললেও মনে মনে মেহরানের বংশ তুলে দিলো রাউশি। মেহরান রাউশির ফুলিয়ে রাখা মুখ দেখেই কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’ বেশি ব্যথা পেলে আমায় বলতে পারেন। ‘
‘ আমি ঠিক আছি, আপনি প্লিজ শুরু করুন।’ কথায় বিরক্তি ভাব প্রকাশ পেলো রাউশির।
মেহরান এবার নিজেও গম্ভীর হয়ে গেলো। মুখের ভাব কঠিন করে গম্ভীর আওয়াজে জিজ্ঞাসা করলো,’ কি খাবেন অর্ডার করুন।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রাউশি চোখ নামিয়ে রেখেছিলো এতক্ষণ যাবৎ। এবার ভাবতে লাগলো সে কি খাবে? মূলত আজ সে হবু স্বামী মেহরান খানের সাথে ডেটে এসেছে। বিয়ে হবে আর দু-সপ্তাহ পর। তবে রাউশি এখন কিছুতেই বিয়ে করতে রাজি নয়। যে করেই হোক বিয়েটা ভেস্তে দিতে চায় সে। একবার চোখ তুলে এদিক ওদিক তাকালো। সামনে মেহরানের দিকে চোখ যেতেই ভ্রু কুঁচকে ভালোভাবে পরখ করলো। মেজর সাহেব সুদর্শন বটে। তবে রাউশি একে রিজেক্ট করলো রিজেক্ট। এমনই সময় কেউ এসে রাউশির পাশে বসলো।
‘ হ্যালো মি. মেহরান খান? আমি রাউশির বন্ধু ইউসুফ।’
রাউশির খুশিতে চোখ চকচক করে উঠলো। একে একে রাউশির বিশাল বন্ধুমহল এসে উপস্থিত হলো সেখানে। হাসিব,মিলি,নাঈম, রুনাসহ শ্রুতিও এলো। অন্যপাশের টেবিল থেকে চেয়ার টেনে টেবিল জুড়ে গোলাকার ভাবে বসলো সবাই। রাউশি তো ভীষণ খুশি। আজ এই মেজরকে একদম টাইট দিয়ে ছাড়বে। যাতে বিয়ে নামক ভুতটা এর মাথা থেকে বহুদূরে চলে যায়।
মেহরান একদম শান্ত রয়েছে। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না এদের দেখে সে খুব একটা বিচলিত হয়েছে। বরং ওয়েটার ডাকলো আর সবার উদ্দেশ্যেই বলল,
‘তোমরা কি খাবে অর্ডার করো!’
সবাই সবার দিকে একবার তাকাতাকি করে হরেক রকম খাবার অর্ডার করলো। রাউশি শুধু মেহরানের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। লোকটার চাহনী শান্ত এবং ভাবভঙ্গি শান্ত। রাউশি কপাল কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো এমন সময় মেহরানও রাউশির দিকে তাকালো ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ বাঁকা হাসির রেখা দেখা গেলো। রাউশি তৎক্ষনাৎ চোখ সড়িয়ে নিলো। লোকটার তীর্যক হাসির রেখাটা খুবই ভয়ানক ঠেকলো তার নিকট।
এদিকে শ্রুতি মেহরানকে বলল,
‘ আপনি তো অনেক হ্যান্ডসাম মেহরান খান। রাউশিকে রিজেক্ট করে আমাকে বিয়ে করলেই পারেন।’
হাসিব তাকে থামিয়ে বলল,’হ্যান্ডসাম না ছাই। এমন হ্যান্ডসাম রাস্তা ঘাটে অভাব নেই।’
নাঈমও তাল মেলালো,
‘ আমাদের কাছে কিছুই নয়। সে যাই হোক এখন বলুন আপনি করেন-টা কি?’
মেহরান রাউশির দিকে তাকিয়ে উত্তর করলো,
‘ আপনারা আমার পেশা সম্পর্কে পূর্ব অবগত।’
একপ্রকার থতমত খেয়ে গেলো সবাই। নিজেদের সামলে হাসিব এবার মেহরানের কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা ঘুরিয়ে বলল,
‘ আমার বান্ধবী খুবই ভয়ানক। জ্বীনে ধরেছে অনেকবার। রাত হলে ভয়ানক সব নাকি কথা বলে। দেখেন কেমন চোখ উলটো করে বসে আছে।’
রাউশি তখন চোখে কিছু ঢুকে যাওয়ায় চোখ উল্টো করে হাত দিয়ে কচলাচ্ছিলো। সেসময়ই হাসিব দেখিয়ে দিলো। মেহরান মনে মনে হাসলো। তবে মুখ গম্ভীর রেখে বলল,
‘ ও তাই?’
‘ হ্যা।’
তখনই তিনজন ওয়েটার মিলে খাবারগুলো এনে দিলো। এতো এতো খাবার দেখে সবাই একসাথে ঝাপিয়ে পড়লো। রাউশি ক্ষুদা না থাকলেও হামলে পড়লো যাতে তাকে মেহরান পছন্দ না করে। মুখে অনেক খাবার ঢুকিয়ে মেহরানের দিকে তাকালো। মেহরান তারই দিকে তাকিয়ে ছিলো। মেহরান চক্ষু হাসছে। রাউশি কোনোভাবে বলল,
‘ দেখেন আমি প্রচুর খাই। সারাদিনই খাই। এতো খাই, এতো খাই যে গোসলও করতে ভুলে যাই দিনে।’
‘ হ্যা হ্যা রাউশি আজ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে গোসল করছে না।’
শ্রুতি খেতে খেতে বলল। নাঈম খেতে খেতে বলল,’ এইযে মেজর আরও কিছু আইটেম অর্ডার করুন তো এসবে আমাদের হবে না।’
মেহরানও একজনকে ডেকে অর্ডার করালো আরও কিছু খাবার। এবার ইউসুফ বলল,
‘ এইযে মেহরান খান আপনি কি জানেন আমরা কে? রাউশির সাথে আপনার বিয়ে হওয়ার আগে যাচাই করবো আমরা৷ খারাপ কিছু দেখলে আপনার যে কি বাজে হাল করবো সেটা ভাবতেও পারছেন না আপনি।’
হাসিব বলল,’ আপনি রান্না পারেন তো?’
‘রান্না পারলেও কি হবে? বছরে এক দুবারই তো বউয়ের সাথে সময় কাটাতে পারবে।’ পাশ থেকে রুনা বলল কথাটা।
হাসিব ভেবে বলল,’ তাও ঠিক। তবে আপনি যখনই আসবেন তখনই রাউশিকে রেঁধে খাওয়াবেন। পারলে ওর জামা কাপড় ধুয়ে দেবেন। আর যদি আমাদের রাউশির গায়ে হাত তোলেন তবে একদম আপনাকে মেরে দেবো।’
নাঈম বলল,’ আগে আমরা একে যাচাই বাচাই তো করে নি।’
মেহরান চুপচাপ এদের কথা শুনছিলো। হাসি এলেও বহুকষ্টে হাসি আটকালো। মেহরান কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেউ কল করলো মেহরানকে। মেহরান কল রিসিভ করলো। সবাই তাকালো মেহরানের দিকে। ইউসুফ একপ্রকার চেঁচিয়ে বলল,
‘এত বড় কথা? আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে? হবু স্ত্রীর সামনে এমন ঘটনা? এ আমরা মেনে নেবো না। বিয়ে ক্যান্সেল। চল রাউশি।’
মেহরান গম্ভীর আওয়াজে ইউসুফকে বলল,
‘ চুপ করে বসে থাকো ছেলে। আমাকে কথা বলতে দাও।’
ইউসুফ কিছু বলবে তার আগেই মেহরান ফোনের অপরপ্রান্তের ব্যাক্তিকে বলল,
‘ লোকটাকে আধমরা করে রাখো। আমি আসছি কিছুক্ষণ পর। গিয়ে ওর হাত পা কেটে পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেবো। আর ওর সঙ্গীদের এমন হাল করবো না যে সারাটা জীবন জেলে পচে মরবে। আর বাকিদের জেলে চালান করে দেবো একদম। এমনিতেই মাথাটা গরম আছে।’
এমন কথা শুনে সবার খাবার গলায় আটকে গেলো। একেকজন কেঁশে উঠলো একপ্রকার৷ রাউশি মুখে খাবার রেখে মেহরানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মেহরান কল রেখে দিয়ে ইউসুফকে বলল,
‘ এবার বলো ইউসুফ কি বলতে চাও?’
ইউসুফ পানিয়ে খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলো। এই লোক তার নাম জানলো কিভাবে? চোরাচোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
‘কিছু না স্যার। আপনি আমার নাম..’
মেহরান তার কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
‘নাঈম,রুনা,শ্রুতি,হাসিব,মিলি আর তুমি ইউসুফ। সবাইকে চিনি আমি তোমাদের। বিয়ে করছি, হবু স্ত্রীর সমস্ত ডিটেইলস জানবো না এটা কোনো কথা হলো?’
থামলো মেহরান।এবার গম্ভীর গলায় বলল,
‘শুনেছি তোমরা অনেক দুষ্টু। তোমাদের নামে অনেক কম্পলেইন আছে। নেক্সট হতে সাবধান নয়তো তোমাদেরও জেলে চালান করে দেবো।’
রাউশি তাকিয়ে রইলো মেহরানের দিকে। বাকিদের একজনের গলায় খাবার আটকে গেলো তো একজন বিষম খেলো। মুহুর্তেই একেকজন উঠে চলে গেলো। সেখানে হ্যাবলাকান্তের মতো বসে রইলো রাউশি। খাবারটা গিলে নিয়ে পানি খেয়ে এবার রাউশি খুবই সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
‘দেখুন মি. মেহরান! আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি এখনই বিয়ে করবো না। তাই আপনার উচিত পরিবারে সবাইকে সবটা বলে দেওয়া।’
বলেই উঠে দাঁড়ালো রাউশি। হনহনিয়ে নিচে চলে গেলো। নিচে এসে দেখলো সবাই দাঁড়িয়ে আছে। রাউশি আসতেই নাঈম রাউশির মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
‘তোর সেনাবাহিনী হবু স্বামী তো আমাদের একদম খেয়ে দেবে রে।’
‘ ছি আস্তাগফিরুল্লাহ, এসব কি কথা?’ রুনা কথাটা বলে নাঈমের মাথায় একটা বারি মারলো।
‘ যাহ বাল। যা সত্য তাই তো কইতাছি।’
রাউশি গম্ভীর মুখে বলল,
‘আমি বিয়ে করবো না। উনাকে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছি।’
‘ তবে আমি যে বিয়েটা করবো। আর মেহরান খান নিজের মুখ হতে নিঃসৃত কথাগুলোও যে অক্ষরে অক্ষরেই পালন করে।’
কথাটা শুনে সবাই পেছনে তাকালো। রাউশিও তাকালো। চোখেমুখে এবার রাগ রাউশির। মেহরান রাউশির দিকে এগিয়ে এলো। রাউশির একদম কাছে এসে গম্ভীর মোটা গলায় বলল,
‘ বিয়ের জন্য রেডি হও মেয়ে।’
বলেই চলে গেলো। রাউশি রাগে মুখ ফুলালো। হাসিব বলে উঠলো,
‘ বাপ রে, এই লোক তো দেখি ভয়াবহ। রাউশি তোর বিয়ে এবার ফাইনাল।’
‘করবো না বিয়ে। এই লোককে তো আরও না।’
মেহরান তখন গাড়ি নিয়ে এলো রাউশিদের সামনে। ড্রাইভিং সিটে বসে থেকেই জিজ্ঞাসা করলো,
‘ এসো তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেই।’
‘দরকার নেই। প্লিজ লিভ নাও।’
মেহরান চোখের চশমা ঠেলে বলল,
‘আসলেই দরকার নেই? ঠিক আছে।’
বলেই চলে গেলো মেহরান। মিলি বলে উঠলো,
‘ ভাই এই লোকরে বিয়ে করলে তোর কপালে কষ্ট ছাড়া কিছু নেই।’
রাউশি মেহরানের গাড়ি চলে যাওয়া দেখলো। সেও সামনে হাঁটা ধরলো বন্ধুদের রেখে। একটাও কাজের না। তাকেই কিছু একটা করতে হবে বিয়েটা আটকানোর জন্য।
রাউশি ভেবে পাচ্ছে না সে করবে -টা কি?
ভাবতে ভাবতেই অনেকদূর এগিয়ে এলো। আর তখনই একটা গাড়ি তার সামনে এলো। রাউশি থেমে গেলো। গাড়ি থেকে দুজন লোক রাউশিকে হুট করেই তুলে নিলো গাড়ির ভেতর। রাউশি শুধু একবার চেঁচিয়ে উঠলো। তবে গাড়িটা মুহুর্তের মাঝেই চলে গেলো।রাউশির বন্ধুরাও শুধু রাউশির চিৎকারের আওয়াজ শুনলো।