মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৬

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৬
সাদিয়া

নিশীথের সময় তখন ঘড়ির কাটায় ৩ টার উপরে। ইহাম ঘরে ঢুকে থমথমে মুখে। বিছানার উপর চোখ গেলে দেখতে পায় মায়রার ঘুমন্ত মুখটা। সঙ্গেসঙ্গে ওর উদ্ধতপূর্ণ আচারণ মনে হতেই চোয়াল শক্ত হয় তার। হনহব করে ছুটে সোফায়। মৃদু কোঁকানোর আওয়াজ পেয়ে তাকায় সেদিক। অনন্তর খেয়ালে আসে মায়রা থরথর করে কাঁপছে। কপালে ভাঁজ তুলে ইহাম দ্রুত এগিয়ে যায় সেদিকে। গায়ে হাত দিয়ে দেখে শরীরে ভীষণ জ্বর এসেছে মেয়েটার। হঠাৎ এত জ্বর এলো কেন গায়ে? পায়ের ব্যথাও তো খুব বেশি নেই যে জ্বর চলে আসবে। তাহলে?

এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের প্যাকেট হাতড়ে রুমাল বের করল। ট্যাব ছেড়ে সেটা ভিজিয়ে আবার ফিরে কপালে লেপ্টে দিল মায়রার। গায়ের কম্বলটা ভালো করে মুড়িয়ে দিল। থরথর করে কাঁপছে। গলা দিয়ে কোঁকানোর শব্দ বের হচ্ছে। দেখে বুঝাই যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। ইহাম ব্যস্ত হয়ে কার্বাডে থাকা আরেকটা পাতলা কম্বল টেনে দিল মায়রার গায়ের উপর। আবারও রুমাল ভিজিয়ে এনে কপালে দিল। মেয়েটা বেগতিক জ্বরে তিড়তিড় করছে। এই পর্যায়ে উপায়ন্তর না পেয়ে ইহাম নিজের গায়ের টিশার্ট খুলল। মায়রার দিকে তীক্ষ্ণ করে তাকিয়ে বিড়বিড় করল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“মেয়ে তখন যে কাপুরুষ বললি এখন যদি জোরজবরদস্তি করে কিছু করে বসি তখন কি করবি? বা’ল পাকনা গর্দভ কোথাকার।”
সুড়সুড় করে ইহাম নিজেকে কম্বলের ভেতর জড়িয়ে নিল। আস্তে করে মায়রা কে টেনে নিল নিজের সাথে। হাতটা মেলে ধরে বক্ষস্থলে এনে রাখল মেয়েটাকে। উষ্ণ পরশে মায়রা নিজেও ওই বলিষ্ঠ শরীরে গুটিশুটি পাকিয়ে লেপ্টে রইল। বড্ড অস্বস্তি হলো মায়রার ওই তপ্ত শরীরের ছোঁয়ায়। উত্তপ্ত নিশ্বাসে তার শরীর ঝলসে যাবার উপায়। পুরুষত্বের ভিট ধস নেমেছে। খুব সূক্ষ্ম ভাবে ঢোক গিলে ফোঁস করে দম ছাড়ল সে।
“না জানি এই গোবর মাথার মেয়ে কাল সকালে কি করে।”

ভোর সকালে খবর এসেছে নাদিমের নানা মারা গেছেন। কাল রাতের মনোমালিন্য তারউপর এমন খবর শুনে দিশেহারা হলো ছেলেটা। আলো ফুটতেই বেড়িয়ে গিয়েছে একা একাই। সবাই কে বারবার করে বলে গিয়েছে তার জন্যে যেন ঘুরা বন্ধ না হয় ওদের। আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কারো কথা না শুনেই ছুটেছে সে।
গ্রুপের একজন বাদে বাকিরা ঘুরবে সেটা নিজ নিজ মন থেকে কেউ মেনে নিতে পারছে না। তারউপর কাল রাতের একটা প্রভাব সবার মনে মনেও বিদ্যমান আছে। মুখে কিছু না বললেও তারা স্বস্তি পাচ্ছে না।
তুহিন মন খারাপ করে বসে আছে। রাত থেকে গভীর কিছু চিন্তা করছে সে। সব নীরবতা কে ধুয়ে নিজ থেকে গম্ভীর কন্ঠে জানাল,

“তোরা বিষয়টা কে কিভাবে নিবি জানি না তবে আমার এটা ভালো লাগছে না। নাদিম কে ছাড়া গ্রুপ ট্যুর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। তোরা চাইলে বিষয়টা ভেবে দেখতে পারিস। তারউপর আমাদের উচিৎ নাদিমের বাড়ি গিয়ে ওদের পাশে দাঁড়ানো। আমরা সবাই জানি নাদিম ছোটবেলা থেকে নানার বাড়ি বড় হয়েছে। সেই ক্ষেত্রে ওর নানা ওর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বলার আশা রাখে না।”
তুহিনের কথাটা সবাই ভাবল। তারা নিজেরাও স্বস্তি পাচ্ছে না গ্রুপের একজনকে রেখে আনন্দ করতে। তাও আবার তার এত বড় দুঃখের সময়ে। তাই সবাই বসে ঠিক করে নিল যা করার।
বেলা তখন ৮ টা বেজে ১৭ মিনিট। গা থেকে জ্বর কেটেছে মায়রার। জাগ্রত হয়ে অদ্ভুত কিছু অনুভব করল সে। কপাল হাতড়ে রুমাল টা সরিয়ে বুঝার চেষ্টা করল এটা কি? ততক্ষণে তার চোখ চলে গিয়েছে ধবধব করা ইহামের শ্বেতবর্ণের বুকের উপর। কি আশ্চর্য! বিষয়টা বুঝতে তার একটু সময়ই লাগল। নিজেকে মানুষটার আলিঙ্গনে পেয়ে যবথব অবস্থা। চোখ কুঠর থেকে বের হবে। সেই সাথে অদ্ভুত এক দম বন্ধকর শিহরণ ছুঁয়ে গেল তার গা। ধড়ফড়িয়ে উঠল। তার নড়াচড়ায় ইহামেরও ঘুম ছুটে গিয়েছে। চোখ ঢলে কুঞ্চন করে তাকালও সেও। মায়রা চেঁচিয়ে উঠল,

“এই আপনি আমার সাথে কি? লুচ্চামি করছিলেন নাকি?”
“হোয়াট?”
“নয়তো কি? আপনি এমন উদাম গায়ে আমার সাথে কি করছিলেন সেটা বলুন?”
ইহাম জবাব দিল না। চোখ ঢলে ঘুম কাটালো। পরক্ষণে শান্ত করে তাকিয়ে থেকে জবাব দিল,
“সো হোয়াট?”
“সো হোয়াট মানে? আপনি আমার সাথে বাজে কিছু করতে চেয়েছিলেন?”
“বাজে কিছু মানে কি বুঝাতে চাইছো তুমি মায়রা?”
“বুঝেন না আপনি? আমাকে পছন্দ করেন না অথচ সর্বনাশ করতে এসেছিলেন?”
মেজাজ চটল ইহামের। খিঁচে জবাব দিল,
“আম ইউর হাজবেন্ট ড্যাম ইট। হোয়াট ইজ বাজে আচারণ? চাইলে সব করতে পারি।মাথায় কি গোবর তোমার মায়রা? সকাল সকাল গর্দভের মতো আচারণের মানে কি?”

“আপনি এমন মাছের মতো উদোম হয়ে শুয়ে ছিলেন কেন আমার সাথে? কি মতলব আপনার?”
“বলদি মেয়ে কাল রাতে তোর জ্বর এসেছিল। থরথর করে কাঁপছিলি। বারবার আমাকে ডাকছিলি তোর কাছে যেতে। আমি তো আর তোর মতো অভদ্র নই তাই ভদ্রতা আর সহানুভূতি দেখাতে তোর কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়ে তুই এত লুচ্চা যে আমার শরীরেরই ভেতর ঢুকে যেতে চাইছিলি। নিহাত তোর কথায় আমি কাপুরুষ। নয়তো আমার ২৮ বছরের ভারে আমাকে নিয়ে সর্বক্ষণ নাম জপ করতি সুপুরুষ সুপুরুষ মহাপুরুষ।”
ইহাম উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। মায়রা তখন স্তব্ধ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। কি বলল মানুষটা? সে কাল রাতে তাকে ডাকছিল? এমন কিছু কি আদৌত হয়েছিল? আর সে নাকি তার শরীরের ভেতর ঢুকে যেতে চাইছিল? ছিঃ কি কথা? আর শেষের গুলির মানে? নাউজুবিল্লা জপল মায়রা। বিব্রত এক ভাব তাকে কোণঠাসা করে দিল। সেই সাথে ভাবাল লোকটার ওই ধরনের অপ্রত্যাশিত কথা।

খাবার টেবিলে মায়রা আর তাকানোর সাহস পেল না মানুষটার চোখের দিকে। তার এমন নত ভাব দেখে বেশ আনন্দ পেলো ইহাম। যেন ঠিক জায়গায় ঠিক মলম লাগিয়েছে। সবাই কেমন মনমরা হয়ে হাল্কা একটু খাবার খেয়ে নিল। কটেজের লোক কিংবা তাদের মাঝে কারো মাঝে কোনো প্রভাব দেখা দিল না কাল রাতের ভয়ংকর তাণ্ডবলীলার।
ইবরাহিম এসে ইহাম কে জানাল,
“স্যার আপনার বলা মতো সব ব্যবস্থা করা হয়েছে আমার। এবার ওদের জায়গা মতো পাঠানো গেলেই অপারেশন কমপ্লিট।”
“হুম ইবরাহিম। আমরা একটু পরই বের হচ্ছি।”
“ওকে স্যার।”
তখনি তুহিন এগিয়ে এলো। মলিন কন্ঠে ডাকল,
“ইহাম ভাই আপনার সাথে একটু কথা ছিল।”

ইবরাহিম কে ইশারা করতেই সে চলে গেল। ইহাম শান্ত চাউনিতে দেখল তুহিনের অস্বচ্ছ মুখটা। যতদূর সে বুঝেছে তুহিন খুব ভালো হাসিখুশি ছেলে। হঠাৎ তার কি হয়েছে? আর কিসেরই বা কথা?
শিফু দূর থেকে সবটা দেখল। তার বুক দুরুদুরু করছে। তুহিন ভাই আবার ভাইয়ার সাথে কি কথা বলছে? কোনো ভাবে কি তার নামে নালিশ টালিশ করবে নাকি? তাহলে তো তার ভাইয়া তাকে আর ঢাকা পৌঁছাতে দিবে না একেবারে এখানেই জ’বাই করে খাদে ফালাবে। বুক কাঁপছে শিফুর।
“কি বলবে তুহিন?”
“ভাই আসলে নাদিমের নানা মারা গিয়েছে তাই ও চলে গিয়েছে। তাই আমরাও চাইছিলাম চলে যেতে।”
কথাটা শুনে ইহাম জবাব দিল না। সবার প্রথম সে ঘাড় বাঁকিয়ে হাত পাঁচেক দূরে বসে থাকা মায়রার দিকে তাকাল। মায়রও চোখ তুললে চোখাচোখি হলো দুজনের। সঙ্গেসঙ্গে মেয়েটা মুখ ঝামটে দৃষ্টি ঘুরালো। তা দেখে একটুও চটল না বদরাগী ইহাম। বরং ঠোঁট চেঁপে নিগূঢ় হাসল।

ব্যাগ থেকে বেশি কিছু বের করা হয়নি মায়রার। ইহামের রুমে এসে ফ্রেশওয়াস আর টাওয়াল টা মনমরা হয়ে ব্যাগে রাখছিল সে। যেতে একদম তার ভালো লাগছে না। তবুও নিরুপায় হয়ে যেতে হবেই। ঠিক তখনি গটগট পায়ের আওয়াজ তুলে রুমে এলো ইহাম। তাকে দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে। গোছানো জিনিস গুলিও কেমন এলোমেলো করে আবার গুছানোর তাড়া দেখাচ্ছিল মেয়েটা। সূক্ষ্ম নজরে ইহাম সবটা দেখল। পরক্ষণে ঠান্ডা কন্ঠে ডাকল,
“মায়রা এদিক ফিরো।”
মায়রা শুনেও না শুনার ভান ধরে কাপড় হাতড়াচ্ছিল। মুখ ভেংচে বিড়বিড় করছিল,
“তোর কথাতেই সব হবে নাকি রে বজ্জাৎ লুচ্চা?”
“মায়রা আমি তোমায় ডাকছি।”
“শুনছি না আমি।”
“কেন শুনছো না? আমার সাথে ত্যাড়ামি না করলে কি তোমার ভালো লাগে না? পেটের ভাত গুলি কি নাড়ী পর্যন্ত যায় না?”

মায়রা জবাব দিল না। তার খুব কান্না পাচ্ছে। এত কান্না পাচ্ছে কেন তার? এই মানুষটা এতটা কঠিন কেন? কেন একটু ভালো করে কথা বলতে চায়না? একটু সোহাগ করে কেন কথা বলে না সে? সবসময় কেমন আদেশ সুরে শক্ত ভাবে ডাকে। কিন্তু সে তো চায় ওই মানুষটা তাকে নরম করে আদুরে মাখা কথা বলুক। ঠিক কাল রাতের মতো।
ইহাম এগিয়ে গেল। মায়রার বাহু টেনে নিজের দিক ফিরালো। চোখ চকচক করতে দেখে মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“কাঁদছো নাকি গাধা?”
“একদম আমায় ছুঁবেন না আপনি। আমি কাঁদি মরি তাতে আপনার কি? ছাড়ুন আমার হাত।”
ইহাম হাসল খানিক। সে বোধহয় মায়রার রোগটা ধরতে পারল। তাই শান্ত কন্ঠে বলল,
“ঘুরতে পারবে না বলে খারাপ লাগছে নাকি আমাকে ছাড়াতে?”
এই মুহূর্তে আরো কান্না পেল মায়রার। তবুও নিজেকে সংযত রেখে বলল,
“আপনি কি আমার এমন কেউ যে আপনাকে ছাড়া থাকতে আমার খারাপ লাগবে। সেই জন্য কান্না করব?”
“তুমি বলছো তেমন নই?”
“না একদমই না।”
ইহাম কিছু বলল না। কেবল মুখ বাড়িয়ে দিয়ে মায়রার গালে টুপ করে একটা চুমু খেলো। মায়রা আবেগে আপ্লুত হয়ে টপটপ করে কেঁদে উঠল। তা দেখেও ইহাম ব্যস্ত হলো না। আর না বারণ করল। শুধু আঙ্গুল দিয়ে পানিটুক মুছে শান্ত ধীর কন্ঠে জানাল,

“এটা সেদিন চর দিয়েছিলাম তার জন্যে।”
মায়রা কাঁদোকাঁদো কন্ঠেই উত্তর দিল,
“জুতো মেরে গোরু দান করছেন?”
মায়রার ওমন মুখশ্রী আর ফোলা নাক দেখে ইহাম খানিক হাসল। তা দেখে মায়রা কেঁদে কেঁদে তার বুকে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলে উঠল,
“আপনি খুব পাষাণ। খুব কঠিন মানুষ। আপনার মতো খারাপ মানুষের সাথে থাকা যায় না। এখান থেকে ফিরেই আমি আব্বু কে বলব আপনার সাথে আমি থাকব না।”
“মায়রা শুনো।”
মেয়েটা বুক ভরা যাতনা নিয়ে চলে যাবার জন্যে পা বাড়াতেই ইহাম আটকালো। পকেট থেকে কয়েকটা এক হাজার টাকার নোট বের করে দিয়ে বলল,

“এ গুলি তোমার হাত খরচের টাকা। আমি নিজের অপারগতা কিভাবে বলব জানিনা। তবে চিন্তা করো না এবার থেকে তোমার দায়িত্ব সবটা সামলে…
ফুঁসে উঠল মায়রা। তার মস্তিষ্ক যেটা ধরতে পারল সে সেটাই উগলে দিল। জোর গলায় বলে উঠল,
“কি মনে করেন কি আপনি নিজেকে? টাকাই সব আপনার কাছে? দায়িত্ব কর্তব্য কি সবটাই টাকার উপর মিস্টার ফাহাদ ইহাম চৌধুরী? এতটা নির্বোধ আপনি? ছিঃ। একটা মেয়েকে বিয়ে করে খোঁজখবর না নিয়ে শুধু হাত খরচের টাকা দিলেই নিয়ম পালন হয়ে যায়? দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? একটা বাবা তার মেয়েকে অন্য একজনের কাছে সপে দেয় কি শুধু টাকার জন্যে? স্বামী নামক মানুষটার থেকে টাকা ছাড়া আর কিছু চাওয়ার থাকে না? এই দুনিয়ার সব দাম্পত্য শুধু টাকার উপর টিকে আছে এটাই আপনার ধারনা? তাহলে তো আপনি একটা নিচ মন মানসিকতার মানুষ ক্যাপ্টেন সাহেব। আপনার মতো এত বদ মানুষের সাথে কোনো মেয়েই থাকতে পারবে না। আপনি আসলেই একটা জাঁদরেল।”

মায়রা চোখের পানিটুক মুছতে মুছতে চলে গেল। ইহাম তখন স্তব্ধ। মায়রার কথা গুলি তার মাঝে বিস্তার করছে। সে তো শুধু হাত খরচের টাকা দিতে চেয়েছিল। সেখানে মেয়েটা কত কিছু বলে ফেলল সম্পূর্ণ কথা না শুনেই। এটা কি নিজের চেয়ে খুব বেশি কম বয়সের মেয়েকে বিয়ে করার ফল? বেশিরভাগ সময় যার ধারণাটুক উল্টো প্রভাব ফেলে নিজেদেরর মাঝে।

বান্দরবন থেকে এসেছে মায়রা আজ পাঁচদিন। এই তিনদিনে মেয়েটা না খাওয়া, না পড়ালেখায় কিছুতেই মন টেকাতে পারছে না। বারবার ওই পাষাণ মানুষটার কথা তাকে জ্বালাতন করে। আসার পর একদিন কল করে কথা বলতে চেয়েছিল সে নিজেই অবশ্য কথা বলেনি। কি দরকার একটু আধটু কথা বলে বেশি মায়ায় জড়ানো? ওই লোকটা তো আর সাথে মাখো মাখো কথা বলবে না। যা শক্ত দুই একটা কথা। তার মন মানতে চায়না। ওই মানুষটা তার স্বামী হতে গেল কেন? আর কেউ ছিল না? তাদের ক্লাসের অনেকের তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সংসারের ঝামেলায় ক্লাসেও তো আসতে পারে না। কিন্তু তাদের কাছে তাদের স্বামীদের কথা শুনলে শুধুই হাহাকার করে তার ভেতর। কই ক্যাপ্টেন সাহেব তো তার সাথে আদুরে ভাবে কথা বলে না, তার জন্যে মরিয়া হয়ে থাকেনা। ঘুরতে যাওয়া গিফ্ট দেওয়া কিছুই তো করে না। ভালোই বাসে না। এতএত সব চিন্তা তার ভেতর ফাঁপিয়ে দেয়। বুকে যন্ত্রণা দেয়। সে চায় ইহাম নরম সুরে আদুরে মাখা কথা বলুক তাকে, দিনে সময় মতো করে খোঁজ নিক তার, মন খুলে কথা বলার ডায়রি হোক। আবদার পূরণের সঙ্গি হোক। ভালোবাসার এমন একটা মানুষ হোক যে তাকে আগলে রাখবে। যার কাছে সে হবে অমূল্য।

সেদিনের টাকা দেওয়ার বিষয়টা বড্ড খারাপ লেগেছে তার। ইহাম কি বুঝাতে চাইল? দায়িত্বের কথাটা কি সে টাকার জন্যেই বলেছিল? ব্যস আর কিছু না? ওই নির্দয় ভালোবাসা হীন মানুষটার সাথে কিভাবে কি হবে তার? ধৈর্য ধরতে পারছে না সে। মাসেক পর টেস্ট পরীক্ষা হবে অথচ পড়ালেখায় মন বসাতে পারছে না কিছুতেই।
“মায়রা মায়রা মা, এই নে ইহাম বাবা কল দিয়েছে। তোকে চাইছে।”
ধক করে উঠল মায়রার হৃদয়। ইহাম কল দিয়েছে? তাকে চাইছে? তাও আবার তার মার ফোনে? বুকের স্পন্দন বাড়ল মেয়েটার। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ফাতেমা বেগম এসে মায়রা কে ফোন দিল,
“এই নে ধর। তোর ফোন বন্ধ কেন? ছেলেটা কতবার করে কল দিয়েছিল।”
ফাতেমা বেগম বিমূঢ় বসে থাকা মায়রার হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে পিছন ফিরে দেখলেন মায়রাকে। ফোনের ওপাশ থেকে গাম্ভীর্য কন্ঠ স্বরে ভেসে আসা “হ্যালো” শব্দটা তাকে স্তম্ভিত ফিরালো। হঠাৎ মনে মনে আওড়ালো,

“অসভ্য লোকটা কল দিয়েছে কেন? নাকি তার বাবা মার সামনে ভালো সাজতে কল দিয়েছে? যে দেখুন আমি আপনাদের মেয়ের কত ভালো হাব্বি। হাতির ডিম।”
ইহাম আবারও বলে উঠল,
“হ্যালো মায়রা শুনতে পাচ্ছো?”
ভালো লাগল না তার। ওই শক্ত গলায় বিরক্ত হয়ে ফোনটা কাটবে তার আগেই শুনা গেল,
“খবরদার ফোন কাটলে আমি এসে তোমার হাতের নলা কাটব।”
ফোনটা কাটতে গিয়েও থামল মায়রা। অদ্ভুত ধুকবুক অনুভূতিতে অবশেষে কানে চেঁপে ধরল তা।

“কথা বলো ননসেন্স। এমনি সময় তো ফটফট করো।”
“কল দিয়েছেন কেন?”
“আমি যেন কল দিতে না পরি তাই বলে ফোনটা বন্ধ রাখলে?”
“জানেনই তবে জিজ্ঞাস করছেন কেন?”
“সেটা ভালো কথা। বরং ফোন রেখে পড়ালেখায় মনোযোগ দেওয়া যাবে। তবে আমি শুনলাম তুমি নাকি নাওয়া খাওয়া পড়ালেখা বাদ দিয়ে শোকতাপ করছো। তা কিসের শোকতাপ তোমার মায়রা? স্বামী হারানোর?”
লোকটার এমন হেয়ালি কথা হঠাৎ হজম হলো না মায়রার। সে গাল ফুলিয়ে বলল,

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৫

“একদম যা তা কথা বলতে যাবেন না। এসব কে বলেছে আপনায়?”
“ওই তো আমার শাশুড়ি মা বললেন সিলেট থেকে আসার পর থেকেই নাকি তোমার এই রোগ দেখা দিয়েছে।”
“মুটেও না। আমি ঠিক আছি। আপনি কেন কল দিয়েছেন সেটা বলুন।”
“কিছুদিন পর তোমার টেস্ট এক্সাম। ভালো করে পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। সেটা জানাতেই কল দিয়েছি। আফটার অল কোনো ফেলটুশ ছাত্রীর হাজবেন্ট আমি মুটেও হতে চাই না।”

মোহমায়ার বাহুডোরে পর্ব ১৭